দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ৩১

দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ৩১
অবন্তিকা তৃপ্তি

ভোরের আলো সবেই ফুটেছে। সকাল সকাল বাড়িতে ভীষণ কোলাহল শোনা যাচ্ছে।শেখ মহলে সচরাচর তেমন হইচই শোনা যায়না। কারণ ওয়াহিদা-উমায়েদ দুজনেই উচ্চশব্দ পছন্দ করেননা। তবে আজকে কি হচ্ছে এসব?
নিধি-অরূপ দুজনেই সারারাত না ঘুমানোর কারণে বড্ড ক্লান্ত ছিলো । কিন্তু বাড়িতে চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে নিধি ‘উমম-‘ বিড়বিড় করতে করতে অরূপের নগ্ন বুক থেকে মুখ তুলে উঠে বসল। আপাতত গায়ে শুধুমাত্র অরূপের রাতের ব্ল্যাক টিশার্ট পড়া। অরূপও শব্দ পেয়ে আরমোড়া ভেঙে ততক্ষণে উঠে বসেছে। নিধি ঘুমঘুম স্বরে দরজার দিকে চেয়ে চিন্তিত হয়ে বলল-‘বাইরে কি হয়েছে? সবাই এত শব্দ করছে আজ।’’

অরূপকেও চিন্তিত হতে দেখা গেল। ও ভাবুক গলায় বলল-‘ভাই বোধহয় আবারও কোনও কাণ্ড ঘটিয়েছে। নিশ্চয়ই ভাবি আবার কিছু করে বসেছে।’
নিধি ভ্রু কুচকালো, প্রশ্ন করলো-‘আশা কিছু করেছে মানে?’
অরূপ মাথার বালিশ কোলে নিয়ে সেটায় হাত ভর দিয়ে আরাম করে বসলো। তারপর বললো-‘ইয়াহ! এই বাড়িতে আপাতত ভাইকে রাগানোর একমাত্র ব্যক্তি হলেন ভাইয়ের বৌ। ভাবির সঙ্গে এমন প্রায়ই হয়। অবশ্য আগে আরও বেশি হতো। এখন কমেছে অবশ্য।’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

নিধি অবাক হয়ে শুনছে। আশা কখনো তো এগুলো বলেনি নিধিকে। হাসে নিধি, ছোট আশা কি ভীষণ সাংসারিক হয়েছে। সংসারের ঝুট-ঝামেলা লুকিয়ে রাখতে শিখে গেছে।
নিধি একটু হেসে উঠে,খোলা এলোমেলো চুল খোপা করে গা থেকে কম্বল সরিয়ে উঠে দাঁড়াতে চাইলো। তবে পেছন থেকে হাত ধরে আটকে ফেললো অরূপ। নিধির হাত টেনে আবার জায়গায় বসিয়ে বলল-‘যাচ্ছো কোথায়?’
নিধি অবাক হয়ে বললো—‘নিচে, দেখি গিয়ে কি হয়েছে।’
অরূপ এদিক-ওদিক তাকালো। তারপর নিধির দিকে একটু ঝুঁকে গাল বাড়িয়ে দিয়ে কাচুমাচু হয়ে বললো-‘উমম…ম্যাই মর্নিং কিস?’

নিধি চোখ পিটপিট করে অরূপকে দেখল। এক রাতের মধ্যেই অরূপ নামক ভদ্র পুরুষের এই নির্লজ্জ স্বামী-স্বামী রূপ ঠিকঠাক হজম হলো না নিধির। ও পরপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো-‘সারারাত প্রচুর জ্বালিয়েছেন অরূপ। এখন অন্তত থামুন।’

অরূপের হাসিহাসি মুখটা মুহূর্তেই ছোট হয়ে গেল। ও মুখটা সরিয়ে ফেললো। কোল থেকে বালিশ নামিয়ে কণ্ঠস্বর মারাত্মক গম্ভীর করে বললো-‘একটা কিস চেয়েছিলাম বলে এত কথা বলে ফেললে?থাক, লাগবে না।’
অরূপ কথাটা বলে উঠে দাঁড়াতে গেল। নিধি হেসে ফেলল, হেসে হেসেই বললো-‘ওরে বাবা, এত রাগ?’
অরূপ শুনলো না, চলে যাচ্ছে ও। নিধি এবার অরূপের হাত ধরে ফেলল ঝট করে। অরূপ ফিরে তাকালো, নিধি লাজে রাঙা হয়ে হাতটা নিয়ে হাতের পিঠে চুমু খেয়ে ঝট করে আবার ছেড়ে দিল, লজ্জিত কণ্ঠে বললো-‘রাগ কমলো?’

অরূপ অবাক হয়ে তাকাল। নিধি লজ্জায় মুখ তুলছেই না আর। অরূপ হাসলো। ও আবারও বিছানায় বসলো, নিধিকে টেনে কপালে চুমু খেলো। কপালে কপাল ঠেকিয়ে জোরেজোরে শ্বাস ফেলতে ফেলতে ফিসফিস করে বললো-‘ওউ নিধিই..তুমি আমাকে পাগল বানিয়ে ফেলবি একদিন।’
নিধি লজ্জায় যেন মরে যাচ্ছে।ও আর এক মুহূর্ত সেখানে দাঁড়ালো না। অরুপকে ধাক্কা দিয়ে দৌড়ে উঠে শাড়ি নিয়ে বাথরুমে চলে গেল। অরূপ অবাক চোখে নিধির ছোটাছোটি দেখল, বাথরুমের দরজা বন্ধের আওয়াজ কানে যেতেই ও সম্বিত ফিরে পেয়ে বিছানায় থেকেই চেঁচালো উঠলো—‘আরে নিধি..আমাদের তো একসঙ্গে গোসল করার কথা ছিলো।’
নিধি বাথরুম থেকে শাসিয়ে উঠল-‘চুপ, নির্লজ্জ পুরুষ।’

বসার ঘরে সারি-সারি মিষ্টির প্যাকেট রাখা হয়েছে। ওয়াহিদা হাসিখুশি মুখে আশার পাশে বসে আছেন। আষাঢ় মুখটা থমথমে বড্ড। হয়তো যেকোনো মুহূর্তে ও এসব জ্বালাতন সহ‍্য না করতে পেড়ে চেঁচিয়ে উঠবে। অনিরুপ পাশের সোফায় বেশ আরাম করে বসে আপেল চিবুচ্ছে। আর আশার দিকে চেয়ে একটু পরপর অসভ্যের মতো চোখ টিপছে। আশা এসব দেখে পারছে না, অনিরূপকে কাচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে। অথচ ওয়াহিদা সামনে। উনার তো আবার অনিরূপ আদরের সুপুত্র, ছেলেকে কিছুই বলা যায়না। ছেলের আগে মায়ের গায়ে ফোসকা পড়ে যায়।

আশার সামনে অনেকগুলো ফলের থালা সাজিয়ে রাখা। ওয়াহিদা বিভিন্ন দোয়া-দুরুদ পড়ে আশার গায়ে ফু দিচ্ছেন। যেন অনাগত বাচ্চা আর মায়ের নজর না লাগে। আশা মুখটা বন্ধ করে এসব কিছু সজ্হ‍্য করছে। স্বামীর পাপে, এ দুটো বৃদ্ধ মানুষের খুশিটা আশা নষ্ট করে দিতে চায়না। এসবের ফাঁকে পাশ থেকে উমায়েদ কফি হাতে বললেন-‘আশা, ফলগুলো শেষ করো। এই সময়ে বেশি বেশি প্রোটিন, ভিটামিন খাওয়া উচিত। তোমার খাবারের লিস্টটা আজকে ডক্টরের কাছ থেকে নিয়ে নিবে। সে অনুযায়ী খাওয়া-দাওয়া করবে। বাচ্চা আর বাচ্চার মা; দুজনকেই এই জার্নিতে সুস্থ থাকতে হবে।’

আশা হালকা হাসার চেষ্টা করলো শশুরের দিকে চেয়ে। উমায়েদ পাশে বসা অনিরুপের দিকে চেয়ে বললেন-‘অনি, আশাকে নিয়ে আজ একবার ডাক্তারের কাছে যেও। তোমাদের এই ব্যাপারে তোমার ফ্রেন্ড তৃষাকে কনসাল্ট করা উচিত আমার মনে হয়।এখন থেকে তোমার হাসপাতালে বেশি চাপ নেওয়ার দরকার নেই। বৌকে সময় দাও কদিন।’
অনিরূপ আশার দিকে দুষ্টু চোখে চেয়ে পরপর ভদ্র-সভ্য মুখ বানিয়ে উমায়েদকে বলল-‘ ঠিকাছে বাবা।’

আশার মনে হচ্ছে, অনিরূপকে ধরে একটা আ/ছাড় মারতে। কতবড় খেলা খেললো আশার সাথে। আশা এখন চাইলেও এ বাড়ি থেকে বেরুতে পারবে না। সবার আলাদা নজর এখন সবসময়ই আশার উপর থাকবে। সবার এসব আদর-যত্ন উপেক্ষা করে আশা অনিরূপকে কোনপ্রকার শাস্তিও দিতে পারবে না। যন্ত্রণায় মাথাটা ব্যথা করছে ওর।
ততক্ষেণ অরূপ-নিধি এসে বসেছে সোফায়। অরূপ অনিরূপের সামনে রাখা থালা থেকে আপেল তুলে নিয়ে খেতে খেতে জিজ্ঞেস করল-‘সকাল সকাল বাড়িতে এত চেঁচামেচি কেন হচ্ছে?’
নিধি আশাকে দেখছে। আশা এই যেনো কেঁদে দিবে। নিধি তো কিছুই বুঝতে পারছে না। ওয়াহিদা উত্তর দিলেন-‘ তোমার ভাই বাবা হবে। সেটার জন্যে এত হইচই।’

অরূপ খাচ্ছিলো। এ কথা শুনে কেশে উঠলো। অবাক চোখে অনিরূপের দিকে একবার চেয়ে আবারও ওয়াহিদার দিকে তাকাল। তারপর নিজের বিস্ময় সামলে, হাসিহাসি মুখে বলে উঠলো-‘কংগ্রাচুলেশন ভাই এন্ড ভাবি।’
আশা হাসার চেষ্টা করলো।এবার মন থেকেই হাসলো ও। সত্য বলতে; এবার ও পুরো ব্যাপারটা ভীষণ উপভোগ করছে। হয়তো আজ সব ঠিক থাকলে, আশা নিজেই খুশিতে পুরো বাড়ি মাথায় তুলতো। তবে অনিরুপের উপর রাগটা এখনই অক্ষত থাকলেও, বাকি সবার এই আহ্লাদগুলো আশার বড্ড ভালো লাগছে।
নিধিও ভীষণ অবাক হলো, বোনকে একহাতে আগলে ধরল সঙ্গেসঙ্গে। আশার কানের কাছে আস্তে করে বললো-‘কি রে? কবে জানলি এসব? আমাকে আগে জানালিও না।’
নিধির কণ্ঠে আফসোস। আশা নিধির দিকে চেয়ে রাগ দেখানোর চেষ্টা করলো, গায়ে চিমটি কেটে বললো—‘ চুপ হও আপা।’

নিধি হেসে ফেলল নিঃশব্দে। অরূপের দিকে তাকাল ও আড়চোখে। অরূপও তাকিয়ে ছিলো, নিধি তাকাতেই অরূপ হালকা হাসল। নিধি বুঝতে পারছে, অরূপের মনে এখন কি চলছে।
ভাইকে বাবা হতে শুনে, বেচারার মনটাও লোভী হয়ে যাচ্ছে। নিধি লজ্জায় চোখ ফিরিয়ে নিলো।
অরূপ নিধির থেকে চোখ সরিয়ে দেখলো; ওয়াহিদর মুখটা হাসিখুশি। অথচ পাশে বসা আশাকে দেখে মোটেও মনে হচ্ছে না, আশা খুশি। অরূপ ঢোক গিলে। অনিরূপের দিকে ঝুঁকে আস্তে করে বলল- ‘ভাই ভাবিকে এত রাগী-রাগী দেখাচ্ছে কেন? তোমাদের মধ্যে আবারো কি ঝগড়া হয়েছে?’

অনিরূপ ছোটো করে শ্বাস ফেলে উত্তর দিল-‘ হু।’
‘ইয়া খোদা। কি বলো? আজকেও আবার কেন?’- অরূপের হাহাকার গলার স্বর।
অনিরূপ জবাব দিল না। চুপ করে বসে রইলো। অরূপ ভাইয়ের মনমরা মুখটা দেখে কিছু একটা আন্দাজ করে বলল-‘রিজন কি? বাচ্চা নিতে চাননি নাকি ভাবি? তুমি কি জোর করেই-‘
অনিরূপ সঙ্গেসঙ্গে জবাব দিল-‘না,দুজনের ইচ্ছেতেই।’
‘তাহলে? কেইসটা কি?’ —অরূপ অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো।

অনিরূপ জবাব দিল না। ও তখনো আয়েশ করে সোফায় বসে আশার দিকে চেয়ে আছে। মাঝেমধ্যে সবার অলক্ষ্যে বৌকে টুকটাক ইভটিজিং করছে। সেটা দেখে আবার আশা রেগে মুখ ঝামটি দিচ্ছে।
অরূপ পাশে বসে এসব দেখে ছোট করে শ্বাস ফেললো। এই ভাই-ভাবির সংসারের ঝুটঝামেলা অরূপ একদমই বুঝে না। ভাবি কতটা শান্ত-শিষ্ট রমণী। অথচ দুদিন পরপর অনিরূপের সঙ্গে ভাবির লেগে যায়। কি নিয়ে লাগে-এটা কেউ জানে না। শুধু জানে; ভাবি ভাইর হৃদয় একেক ঝগড়ায় এঁফোড়-ওঁফোড় করে ফেলে। নরম আশা ভাইর সামনে এসেই পৃথিবীর সবথেকে জল্লাদ বৌ হয়ে যায়। এ কেমন সমীকরণ?

অরূপ ছোট করে শ্বাস ফেলে আবারো ভাবে, তার বড় ভাই কোনও অংশে কম নয় সেটা ও জানে ভালো করেই। নিশ্চয়ই ভাই কোনো ভুল করে, তাই ভাবির কাছে ধরা খায়।অল ইজ অ্যাবাউট ডেস্টিনি! অনিরূপ কখনো কারো কাছে হাল মানতো না, লোককে নাকের ডগায় নাচানো অনিরূপ একটা জায়গায় তো ধরা খাওয়ার প্রয়োজন ছিলো, একটা জায়গায় ওকে বাঘে আনার মানুষের প্রয়োজন ছিলো। সেটার সাইড এফেক্ট ভুগছে এখন।

পুরোটা সকাল ইচ্ছেমতো পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার পর এতক্ষণে ফুরসত পেয়ে উপরে এলো আশা। অনিরূপ রুমেই ছিলো। আশাকে ফেলে এসেছিল ওই হই-হল্লোড়ের মাঝে। কত খারাপ লোক! আশাকে আটকে রাখার জন্যে ওদের বেবিকে কাজে লাগিয়েছে। অনিরূপের এই শেয়ানা বুদ্ধি দেখে রাগে আশার মাথাটা ধপধপ করছে ভীষণ। আশা সোজা নিজের রুমে ঢুকে দরজায় অনিরূপকে একবার দেখে দরজায় সিটকিনি তুলে দিল। অনিরূপ তখন বিছানায় বসে মোবাইলে নিউজ দেখছে। আশাকে রুমে ঢুকতে দেখে ও আড়চোখে তাকালো। দেখে বোঝাই যাচ্ছে- বৌ রেগেমেগে ফায়ার। অনিরূপও ঘাটালো না বেশি, ও নিজের মতো করে ফোন দেখছে। আশা রুমে ঢুকে শাড়ির আঁচল মাথা থেকে নামিয়ে অনিরুপের কাছে এগিয়ে গেল। জেদ দেখিয়ে, তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে বলে উঠল-‘ লজ্জা করে না আপনার? নিজের বেবি কে নিজের স্বার্থের জন্যে ইউজ করছেন?’

অনিরূপ ধীরেসুস্থে ফোনটা রাখলো টেবিলের উপর। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো—‘মা-বাবার সম্পর্ক ঠিক করতে বেবিকে ইউজ করা ইজ নট লাইক অ্যানি স্বার্থ। এটাকে বলে নিজেদের বেবিকে একটা সুন্দর পরিবেশে বড় করার জন্যে স্টেপ নেওয়া।’
অনিরূপের যুক্তিতে আশা গর্জে উঠলো–‘বেবিকে নিয়ে এত কিসের মায়া আপনার? ওটা তো আপনার অভিনয়ের ফল, রাইট?’

অনিরূপ এবার তীক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে বললো-‘ মোটেও না। আমাদের বেবি আমাদের ইচ্ছেতে, দুজনের ভালোবাসাতেই এসেছে। এটার অন্য মনে তুমি বের করবে না একদম।’
আশা হাঁপিয়ে উঠল। ও কি বলবে আর? প্রতিটা কথার বিপক্ষে অনিরূপের কাছে যুক্তি তৈরি করাই আছে। ও জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে ফেলতে বললো-‘বেবির কথা আপনাকে কে জানিয়েছে? সত‍্যি করে বলুন।’
অনিরূপ হাসলো, দুষ্টু হাসি। ও ঠোঁটে মৃদু হাসি ঝুলিয়ে, উঠে ড্রয়ার থেকে গতকাল রাতের কিটটা বের করে আশার সামনে ধরলো। আশা অবাক হয়ে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে দেখলো কীটটা।অনিরূপ বলল-‘ গতকাল রাতে এটা পালঙ্গের নিচে পরে ছিলো। আমি পায়ে দেওয়ার জুতো খুঁজতে গিয়ে এটা পেয়েছি। এন্ড রাতেই জেনেছি দ্যাট আমি বাবা হতে যাচ্ছি, কিন্তু এতরাতে তোমার ঘুম নষ্ট হবে দেখে আর জাগাই নি। যতই বলো, প্রেগন্যান্সি টাইমে ঘুম ইজ মোর মোর ইমপোর্টেন্ট।’
আশা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এসব তো হওয়ারই ছিলো। আশা অসহায় চোখে কীটটার দিকে চেয়ে বলল-‘ কি চান আপনি এখন?’

অনিরূপ এবার একটু নরম হল। এগিয়ে এসে আশার দুহাত ধরে নিজের দিকে বৌটাকে বড্ড আদর করে টেনে নিয়ে বললো-‘একটা সুন্দর সংসার। যেখানে আমি,তুমি আর আমাদের বেবি মিলে সুখে-শান্তিতে বসবাস করব। এন্ড যেখানে কোনো ভুল বোঝাবোঝি আমাদের মধ্যে থাকবে না।’
আশার চোখে জল, ও ভেজা চোখ নিয়ে বললো-‘আমি আপনাকেভুল বুঝিনি, আপনি নিজের মুখে যেটা বলেছেন সেটাই বিশ্বাস করেছি।’

অনিরূপ এবারও ধৈর্য‍্য দেখাল,আঙুল দিয়ে আশার চোখের অশ্রু মুছে দিল যত্ন করে। তারপর ববড্ড নরম গলায় বললো-‘ ভিডিওটা আমাদের বিয়ের শুরুর দিকে। আমাদের বিয়ের এখন একটা বছর হয়ে গেছে, আশা।এতদিনেও তোমার একবারো মনে হয়নি যে, আমি তোমাকে সত‍্যি সত‍্যি ভালোবেসেছিলাম?’

আশা দমে। ওর ব্রেইন বিশ্বাস করে, অনিরূপ ছলনা করেছে। কিন্তু ওর হৃদয় বলে- এতদিন যা ছিলো, সব কখনোই পুরোটা মিথ‍্যা হতে পারেনা। অনিরূপের ভালোবাসার উপর আশার হৃদয় কেন যেন আঙুল তুলতেই পারেনা। একথা ভাবার পরপরই আশার মস্তিষ্ক আশাকে গালি দিয়ে উঠে। যে সম্পর্কের শুরুটা এতবড় ছলনার মধ্যে দিয়ে শুরু হয়েছে-সেই সম্পর্কের ভিত কোনোদিন, কখনোই ভালোবাসা হতে পারেনা।
আশা পরপর রেগে গর্জে উঠে বললো-‘কিন্তু আমাদের এই সম্পর্কের শুরুটা ছলনা দিয়ে হয়েছিল, এটা আপনি অস্বীকার করবেন?’

অনিরূপ এবারেও শান্ত থাকল, বললো-‘এটাকে মোটেও ছলনা বলে না। এটাকে বলে জেদি বৌর ভালোবাসা না পেলে, তাকে কিভাবে নিজের কাছে আটকে রাখা যায়,যেন ইন ফিউচার বৌটাকে এভাবে ভালোবাসা দিয়ে জয় করা যায়।’
অনিরূপের গলার স্বরে কৌতুক,কথা বলতে বলতে ও আশার গালে আলতো করে চুমু খেলো। তবে স্বামীর এই কৌতুক স্বর মোটেও হজম হলো না আশার। ও জোর করে নিজের কাছ থেকে অনিরূপকে ছাড়িয়ে নিলো। দুহাতে ভেজা চোখ মুছে সরাসরি বললো-‘ আমি আপনাকে বিশ্বাস করতে পারছি না আর। বিশ্বাসটা আমার মন থেকে আর আসছেই না। কি করব আমি?’

অনিরূপ হেসে আশার কপালে চুমু খেলো, আশার রাগকে পাত্তা না দিয়ে বললো-‘তাহলে বরং আমি আবার তোমার মনটা জয় করি?’
আশা তাকাল মানুষটার দিকে। কতটা নির্লিপ্ত সে। কতটা বিশ্বাসী, যেন আশার মনটা একটা খেলনা। চাইলেই জয় করা যায়। অথচ অনিরূপ জানে না, ভাঙা খেলনাও দ্বিতীয়বার জোড়া দেওয়া যায়না। আশা উত্তর দিলো না। অনিরূপ বললো-‘ আমার রাগটা প্লিজ আমাদের বেবির উপর দেখিও না। ওটা তো একটা বাচ্চা? অনেক ছোট, রাইট? ও কি আমাদের এই মনের কষ্ট বইবার ক্ষমতা রাখে? ওকে মাফ দিয়ো, রাগ যা দেখানোর তা নয় মাস পরে ইচ্ছেমতো দেখিও, বাঁধা নেই। কিন্তু এখন প্লিজ নিজেকে সবসময়ই হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করো, স্ট্রেস ফ্রি রাখার চেষ্টা করোনিজেক। তাহলে আমাদের বেবি সুস্থ, এন্ড হেলদি হবে।’

দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ৩০

আশা শোনে, দেখে অনিরূপের অনাগত বাচ্চার প্রতি দরদ! ও অনিরূপকে এড়িয়ে আলমারি থেকে গোসলের জন্যে শাড়ি বের করতে করতে বলে উঠলোএকটা কথা-‘আর যদি নয় মাস পর আমিই না থাকি?’
অনিরূপ বিস্মিত হলো, জিজ্ঞেস করলো- ‘মানে?’

দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ৩২