দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৪৯(২)

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৪৯(২)
তাসফিয়া হাসান তুরফা

নিশীথের বড় খালা বেশ অহংকারী মানুষ। বংশ মর্যাদার দাপট ও অহমিকা তার শিরায় শিরায় বিদ্যমান। আত্মীয়দের মধ্যে নিশীথের সাথে দোলার বিয়েতে আয়মান সাহেব ব্যতিরেকে যদি আর কেউ বিরোধিতা করে থাকেন তবে সেটা নিঃসন্দেহে ওর বড় খালা, সালমা বেগম। ঠিক এ কারণেই আসমা বেগম তাকে দেখে আতংকিত হচ্ছিলেন। বিয়ে পড়ানোর দিনেও তিনি এ কারণেই উপস্থিত হোননি। তাই আজ রিসেপশনে সবার সামনে দোলাকে অথবা ওর পরিবারকে আবার কোনোভাবে যেন অপমান করে না বসেন, এ চিন্তায় ভরে যাচ্ছিলো মস্তিষ্ক। আসমা বেগম নিজের ভাবনাচিন্তা পাশে সরিয়ে আপাতত বোনকে স্বাগত জানাতে মন দিলেন। এগিয়ে এসে হাসিমুখে বললেন,

—আরে আপা, তুমি এত দেরিতে এলে যে? এসো এসো!
—বের হতে হতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছিলো। কখন এসেছিস তোরা?
—আমরা এসেছি ঘণ্টাখানেকের বেশি পেরিয়েছে। কাল তুমি আসোনি, কষ্ট পেয়েছিলাম। তবে আজকে তোমায় দেখে ভীষণ খুশি হয়েছি, আপা!
আসমা বেগমের মন ভোলানো কথায় তার বোনের মন গললোনা। বরং উনি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

—যেমন বাড়ির মেয়ে পছন্দ করেছে তোর ছেলে, কোন মুখে বিয়ে খেতে আসি বল? হাজার হোক, আমাদের পরিবারের তো একটা মানসম্মান আছে!
আসমা বেগম জানতেন তার বোন অবশ্যই এমন কোনো কথা বলবেন! তাই তিনি বিশেষ অবাক হলেন না। এ মুহুর্তে অনুষ্ঠানের মাঝে কিছু না বলাই শ্রেয় বলে মনে করলেন। নয়তো হিতে বিপরীত হতে পারে। সালমা বেগমের বিশ্বাস নেই। সবার সামনে একবার মুখ খুললে কিসব বলবেন তার ইয়ত্তা নেই। আসমা বেগম নিজেকে শান্ত করে বললেন,
—যা হওয়ার হয়েই গেছে, আপা। ভাগ্যের উপর তো আমাদের কারো হাত নেই। আজকাল ছেলেমেয়েরা নিজেদের পছন্দেই বিয়ে করে, এ আর নতুন কি! আসো তোমার সাথে ওদের পরিচয় করিয়ে দেই।

এ দফায় সালমা বেগম কথা বাড়ালেন না। এগিয়ে গেলেন নিশীথ-দোলাকে দেখতে। সাক্ষাত বিনিময় স্বাভাবিকভাবেই হলো। সালমা বেগম বাকা চোখে দোলাকে বেশ কিছুক্ষণ দেখলেন! যেন বুঝার চেস্টা করছিলেন ওর মধ্যে এমন কি আছে যা দেখে তার বোনপো এভাবে গলে গিয়েছিলো। উনি মুখ খুলবেন সে সময় দাদু এলেন। তার পরিচিত ক’জনের সাথে নাতি-নাতবৌ এর পরিচয় করানোর ফলে সালমা বেগমকে স্টেজ থেকে নেমে যেতে হলো। আসমা বেগম হাফ ছেড়ে বাচলেন। পল পল নজর রাখলেন বোনের উপর যাতে উনি কোনোকিছু নিয়ে মেহমানদের সামনে কোনো কাহিনি না করতে পারেন। তার প্রয়াস সফল হলো। দেখা গেলো সবকিছু মিলিয়ে কোনো ঝামেলা ছাড়াই নিশীথ-দোলার রিসেপশন বেশ ভালোভাবেই সম্পন্ন হলো৷

বাড়ি ফেরার পর আজ রাতে নিশীথ আগেভাগেই রুমে ঢুকলো। দোলারও বুঝতে বাকি নেই কেন নিশীথের এহেন তাড়াহুড়ো। তবু ও লজ্জায় ঘাপটি মেরে বসে আছে। নিশীথ ডাকলেও উঠে আসছেনা। এক পর্যায়ে নিশীথ নিজেই এগিয়ে আসে। তা দেখে দোলা বিছানার চাদর খামচে ধরে বসে থাকে। কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে নিশীথ হুট করে এসে দোলাকে কোলে তুলে নিলো। লেহেঙ্গা পরিহিত দোলার মাথা থেকে নেটের ওড়নার আঁচল পড়ে গেলো। ভয়ে বিস্ময়ে নিশীথের কাধ খামচে ধরলো মেয়েটা। নিশীথ কোনো কথা না বলে ওকে নিয়ে বারান্দায় চলে যায়। দোলা তখনো একিভাবে ওর দিকে পলকহীন চেয়ে থাকে! নিশীথ সেদিকে না চেয়েই সামনের দিক তাকিয়ে বলে,
—আমায় দেখার জন্য জীবনভর সময় পাবে। আপাতত সামনে তাকাও!

দোলা লজ্জা পায়। চট করে চোখ সরিয়ে নিয়ে দৃষ্টি সামনের দিক ফেরায়। নিশীথ এর দৃষ্টি অনুসরণ করে সেদিকে তাকাতেই কিছুক্ষণের জন্য মুগ্ধ হয়ে যায়। হা করে তাকিয়ে থাকে রাতের আকাশের দিকে! পূর্ণিমা রাতের চন্দ্র সৌন্দর্যে দুজনেই ডুব দেয় মুহুর্তের জন্য। এরই ফাকে নিশীথ দোলাকে মাটিতে নামিয়ে দেয়। দোলা তখনো আকাশের দিক চেয়ে থাকলেও নিশীথের নজর এখন তার ব্যক্তিগত চাঁদের উপর। চাঁদের আলোয় দোলার চোখমুখ চকচক করছে। ওর চোখেমুখে আজ অন্যরকম খুশির আভা। নিশীথের ঘোর লেগে যায়। পেছন থেকে ঘোর লাগানো আওয়াজে ডাকে,

—দোলনচাঁপা!
দোলা একপলের জন্য শিউরে উঠে সে ডাকে। উত্তেজনায় পেছন ফিরতেও যেন ভয় পায়! নিশীথ খানিকটা এগোয়। কোমড় চেপে ধরে দোলার গালে গাল লাগাতেই ওর ছোট ছোট দাড়ির খোচায় দোলার সুড়সুড়ি লাগে। মেয়েটা নড়েচড়ে উঠে। নিশীথ সেদিকে পরোয়া করেনা। এখন ও আছে অন্য ধান্ধায়! বললো,
—এখন ভয় কমেছে একটু? বেটার ফিল করছো?
—হ্যাঁ, এখন ভালো লাগছে।

—তবে কি আমি এখন পারমিশন পাচ্ছি তোমার কাছে আসার? আই কান্ট ওয়েট, দোলনচাঁপা! মে আই?
নিশীথ কোনোরকম রাখঢাক না করে সরাসরিই বলে উঠে। লজ্জায় দোলার প্রাণ যায় যায় ভাব। একটা লোক এত অবলীলায় কিভাবে এসব বলছে ও ভেবে পায়না! ও পেছন ঘুরে ইনিয়েবিনিয়ে কিছু বলতে চায় কিন্তু শব্দগুলোও আজ যেন গলার কাছে দলা পেকে বসেছে ওর। চেয়েও কিছু বের করতে পারছেনা! দোলা কোনোমতে মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়ে কিছু বলার জন্য মুখ তুলে, ওমনি নিশীথ এক টানে ওকে নিজের কাছে টেনে নেয়। দোলার কথা আবারও ওর কণ্ঠনালির মাঝেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়, নিশীথ ওকে কথা বলার অবস্থায় রাখেনা! ওষ্ঠযুগুলের উষ্ণতার সামনে বাকি অনুভুতি ফিকে হয়ে যায়। বেশ অনেকক্ষণ লাগিয়ে নিশীথ ছেড়ে দিলে দোলা শ্বাস নেওয়ার অবকাশ পায়। নিজেকে একটু সামলে নিতেই নিশীথ আবারো ওকে কোলে তুলে নেয়। দোলা কিছু বুঝে উঠার আগেই ওকে বারান্দা ছেড়ে রুমে নিয়ে যায়। পূর্ণিমা চাঁদটাও যুগলের ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে লাজুক হেসে মেঘের আড়ালে লুকিয়ে যায়!

পরদিন সকালে গোসল শেষে লম্বা সময় নিয়ে দোলা বের হয়। ভেজা চুল ঝেড়ে মুছে চটজলদি মেরুন রঙের শাড়ি পেচিয়ে নেয় শরীরে! ওর শুভ্র বদনে শাড়িটা দারুণ ফুটে উঠে। দোলা আয়নায় তাকিয়ে নিজেকে দেখে নিজেই হাসে। একিসাথে মনে পড়ে গত রাতের ঘটনা! মুহুর্তেই শাড়ির রঙের সাথে পাল্লা দিয়ে দু গাল লাজরাঙা হয়ে যায়। লজ্জায় দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেলতেই পেছন থেকে নিশীথ বলে,

—এমন দৃশ্য দেখবো বলেই তো এতদিন ধৈর্যের বাহিরে গিয়ে অপেক্ষা করেছি!
দোলা চমকে পেছন ফিরে তাকায়। বিছানায় খালি গায়ে শুয়ে থাকা নিশীথের ঘুমন্ত মুখে দুষ্টুমির আভাস দেখে ওর দিকে বালিশ ছুড়ে মারে! নিশীথ হেসে ওই বালিশ ক্যাচ ধরে আবারও ঘুমিয়ে পড়ে। দোলা সেদিক চেয়ে বোকার ন্যায় তাকিয়ে থেকে হেসে ফেলে! তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে মাথায় আঁচল চেপে রুমের বাহিরে বের হয়।
সকাল সকাল সালমা বেগম ড্রয়িংরুমে বসে একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছেন দোলাকে। তার প্রশ্নের তোপে পড়ে বেচারি দোলার নাজেহাল অবস্থা প্রায়! সালমা বেগমের প্রশ্নের ধরন ছিলো কিছুটা এরুপ-

—কি পড়ছো?
—অনার্স থার্ড ইয়ারে।
—তোমার ভাইবোন কয়জন?
—দুজন। একটা বোন, একটা ভাই!
—তোমার মা কি চাকরি করেন?
—স্কুলের শিক্ষিকা!
—নিশীথকে কতদিন ধরে চিনো?
—জি, মাস তিনেক হবে!
—কে আগে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিলো?
—উনিই দিয়েছিলেন।
—এত অল্প সময়ে কিভাবে প্রেম হলো তোমাদের?

ব্যস! দোলা হাফিয়ে উঠেছে তার শত শত প্রশ্নের ঝুলির জবাব দিতে দিতে। একটা মানুষ কিভাবে একটা নতুন বউকে প্রথম সাক্ষাতে এতগুলো প্রশ্ন করতে পারে দোলা ভেবে পায়না। ওর এক পর্যায়ে মনে হলো যেন ও ভাইভা বোর্ডে বসে আছে। অন্তত সেখানেও এর চেয়ে কম নার্ভাস লাগতো ওর! দোলার এসব ভাবনার মাঝে হঠাৎ করে সালমা বেগম হঠাৎ বললেন,

—তুমি কি জানতে তোমার আগে নিশীথের জন্য কতগুলো ভালো পরিবারের মেয়ের প্রস্তাব এসেছিলো?
দোলা বিব্রত হয়। তবু কোনোমতে মাথা নেড়ে হ্যাঁ সুচক উত্তর দেয়। তা দেখে সালমা বেগম তাচ্ছিল্যের সাথে হাসেন। দোলাকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে খোচা মেরে বললেন,

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৪৯

—তা নিশ্চয়ই এই রুপের জা’লেই ফাসিয়ে বিয়ে করেছো আমাদের নিশীথকে, তাই না? নয়তো এত ভালো ভালো বংশের মেয়েদের রেখে তো ওর তোমায় বিয়ে করার মতো কোনো কারণ চোখে পড়ছেনা আমার!
এবার দোলার মুখ থমথমে হয়। এতক্ষণ ধৈর্য ধরে সবকিছু শুনলেও এবার ধৈর্য ধরা কঠিন হয়ে যায়!

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৫০