দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৫২
তাসফিয়া হাসান তুরফা
দোলা চুপচাপ বসে ছিলো রুমে। এরই মাঝে নিশীথ ঝড়ের বেগে রুমে ঢুকে বললো,
—ব্যাগ গুছানো শুরু করে দাও।
স্বাভাবিকভাবেই দোলা চমকে গেলো। নিশীথের কথার সারমর্ম ধরতে পারলোনা তৎক্ষণাত! ও অবাক স্বরে বললো,
—কোথাও যাচ্ছি আমরা?
—হুম। কাপড়গুলো গুছানো শুরু করো। তোমার জুয়েলারি থেকে শুরু করে ইম্পর্ট্যান্ট যা যা আছে সব তুলে নিবে। কিছুই বাদ পড়েনা যেন!
—আচ্ছা। ক’দিনের জন্য যাচ্ছি আমরা?
—জানিনা!
নিশীথ শান্তভাবে জবাব দিলো। এবার দোলা আরেক দফা চমকালো। নিশীথের অঙ্গভঙ্গি এবং কথাবার্তার গাম্ভীর্যতা বলছে, ও এখন অত্যন্ত সিরিয়াস মুডে আছে। তাই এখন হেয়ালি করে কোনোকিছু বলার কথা না। কিন্তু কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে না জানা অব্দি মেয়েটাত ভাত হজম হবেনা! তাই দোলা এবার খাট থেকে উঠে এগিয়ে গেলো। নিশীথের হাত ধরে বললো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
—এভাবে কথা বলছেন কেন? আর কোথায় যাচ্ছি আমরা? একটু ক্লিয়ার করে বলেন না! আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা।
নিশীথ তাকালো দোলার দিকে। বেশ কিছুক্ষণ একইভাবে স্থির দৃষ্টিতে চেয়েই রইলো স্ত্রীর দিকে। দোলাও জবাবের আশায় ধৈর্য সহকারে চাইলো ততক্ষণ। নিশীথ দোলার ধরে রাখা হাত৷ আরেকটু শক্ত করে ধরে বললো,
—আমরা এ বাসা ছেড়ে চলে যাচ্ছি, দোলনচাঁপা!
বিস্ময়ের প্রকোপে দোলার অক্ষিজোড়া বড় বড় হয়ে এলো! ঘটনার আকস্মিকতায় কিভাবে রিয়েক্ট করা উচিত ও যেন ভুলে গেলো! একিসাথে নিশীথের হাত ধরে রাখা ওর হাতটাও খানিকটা শিথিল হয়ে এলো! নিশীথ সেদিকে খেয়াল করলো। এক মুহুর্তের জন্য ওর মস্তিষ্কে ভয় ঢুকলো। দোলা কি তবে বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার কথা শুনে ওর সাথে যেতে রাজি নয়?
নিশীথের কপালে ভাজ পড়লো। ও জানে মনের প্রশ্ন ভেতরে রাখলে ভুল বুঝাবুঝি বাড়ে, আর এখন ও দুজনের মাঝে কোনোরুপ ভুল-বোঝাবুঝি চায়না। তাই নিশীথ মনের প্রশ্ন মনে রাখলোনা। দোলাকে দ্বিধাহীন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
—কি হলো? তুমি কি আমার এ সিদ্ধান্তে রাজি নও?
দোলা এতক্ষণ নিজেকে ধাতস্থ করছিলো, নিশীথ হঠাৎ করেই কেন এত বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভাবছিলো। এর মাঝেই নিশীথের এ প্রশ্ন শুনে ও তাকায়। জিব দিয়ে শুষ্ক ঠোঁট ভিজিয়ে বলে,
—আপনি যদি পাকাপোক্ত সিদ্ধান্ত নিয়েই থাকেন আমি কেন রাজি হবোনা? আমি তো ভাবছি আপনি হঠাৎ কেন এত বড় সিদ্ধান্ত নিলেন!
দোলা রাজি শুনে নিশীথ একটু নিশ্চিত হলো। এতক্ষণ ভেতরে চেপে রাখা দম ফেললো! দোলার প্রশ্নে বিরক্ত হয়ে বললো,
—একটু আগে এ বাসায় তোমার সাথে কি কি হলো সব এত তাড়াতাড়িই ভুলে গেলে?
অপমানের কথা মনে হতেই দোলা মাথা নিচু করলো। কিন্তু পরক্ষণেই ওর মনে প্রশ্ন এলো, নিশীথ কি তবে ওর জন্য নিজের পরিবার থেকে দূরে হয়ে যাচ্ছে? আয়মান সাহেব তাহলে সত্যি কথাই বলেছিলেন? অনুশোচনা বোধে দোলার অন্তর হিম হয়ে এলো। ও এগিয়ে এসে আবারো নিশীথের হাতটা শক্ত করে ধরে বললো,
—আপনি আমার জন্য এ বাসা ছেড়ে দিবেন? একবার মা-র কথা, দাদুর কথা ভাবলেন না? আপনি বাড়ি ছেড়ে দিলে তারা কতটা কষ্ট পাবে?
—আমি সবই ভেবে দেখেছি, দোলনচাঁপা। এ বাসায় আমরা থাকলে সবাই খুশি থাকবে, তুমি বাদে। কারণ আজ নয়তো কাল খালামনির মতো মেন্টালিটির কেউ না কেউ আসবে আর তারা এসে হয়তো তোমায় কোনো না কোনো ভাবে অপমান করার চেষ্টা করবে। আর দেখা যাবে, আমার বাবাও আজকের মতো সানন্দে তাদের সাথে যোগ দিবে। ওটা আমি মোটেও সহ্য করতে পারবোনা! তাই সময় থাকতে আমাদের আলাদা হয়ে যাওয়াই ভালো। অন্তত এসব অশান্তি থেকে দূরে চলে যাবে!
দোলার চোখে পানি এলো নিশীথের কথায়। এটা সত্যি যে এ বাসায় থাকলে হয়তো ভবিষ্যতেও ওকে আজকের মতো অপমানিত হওয়ার সুযোগ আসতে পারে। কিন্তু লোকে কি বলবে? সবাই তো এখানেও দোলাকেই দোষ দিবে! বলবে, ওর জন্যই নিশীথ বাড়ি ছেড়েছে। ঘরের ছেলে তাদের থেকে দূরে চলে গেছে। লজ্জায় দোলার মন ভার হয়ে আসে! এদিকে ওর চোখে পানি দেখে নিশীথ হাত উঠিয়ে তা মুছে দেয়। সন্দিহান হয়ে শুধায়,
—কি হলো? তুমি রাজি থাকলে চোখে পানি কেন?
দোলা এবার নিজেকে ধরে রাখেনা। বহুকষ্টে এতক্ষণ চেপে রাখা অশ্রুগুলোকে আর আটকাতে পারেনা। নিশীথকে সম্বল মেনে ওকে জড়িয়ে ধরে তৎক্ষণাত। প্রশস্ত বুকে মাথা রেখে শান্ত না হওয়া পর্যন্ত কাদতে থাকে। নিশীথ দোলাকে শান্ত হওয়ার সময় দেয়। যতক্ষণ না ফোপানো থামে, ততক্ষণ দু’হাতে আগলে ধরে পিঠে হাত বুলিয়ে ঠান্ডা করে মেয়েটাকে। দোলা একটু থেমে বলে,
—আপনি যে কারণে আমায় এ বাসা থেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছেন, লোকে ঠিক সে কারণেই আমায় আবার দোষ দিবে!
—মানে?
নিশীথ দ্বিধাগ্রস্থ কণ্ঠে শুধায়।
—দেখবেন, আমরা বাসা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর সবাই বলবে আমিই আপনাকে বাসা ছেড়ে দিতে বলেছি। আমার কথাতেই আপনি পরিবার থেকে আলাদা হচ্ছেন। তখন সবার নজরে আমি খারাপ হয়ে যাবো! তাহলে কি বাড়ি ছেড়ে লাভ আছে?
—তুমি কি এখন সবার নজরে ভালো? নাকি এখনো ওরা তোমাকেই দোষ দেয় আমায় ফাসিয়ে বিয়ে করার দায়ে? যে বাসায় থেকে রোজ রোজ অশান্তি করতে হয়, সেখানে থেকেও কি আদৌ লাভ আছে?
নিশীথের পাল্টা প্রশ্নে দোলা নিরব রয়। নিশীথের কথায় যুক্তি আছে ঠিকি কিন্তু দোলার মনে তখনো ভয়। নিশীথ যেন সবটা বুঝলো। বললো,
—যেখানে থেকে মানসিক অশান্তিতে থাকতে হয় সেখানে অন্তত ভালোভাবে সংসার করা যায়না, দোলনচাঁপা। আজ হয়তো তুমি আমি একা, দুজনে কোনোভাবে থাকলাম এখানে। কিন্তু ভবিষ্যতে আমাদের বাচ্চা হলে, এমন পরিবেশ চেঞ্জ না হলে ও একটা আনহেলদি পরিবেশে বড় হবে। যা আমি চাইনা। কারণ, যে বাসায় রোজ রোজ অশান্তি হয়, সে পরিবারে বেড়ে উঠা মানসিকভাবে কতটা কষ্টদায়ক সে অনুভূতি আমি জানি! আমি আবেগের বশে এ সিদ্ধান্ত নেইনি। ঠান্ডা মাথায় অনেক ভেবে তারপরেই নিয়েছি।
নিশীথের এত কথার জবাবে দোলার বলার মতো কিছু রইলোনা। আবার নিশীথের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা শুনে ও মনে মনে বেশ লজ্জায় পেলো। কিন্তু ও তো এতদূর ভাবেনি! দোলা তো শুধু নিশীথের কথাই ভেবেছে। ওর সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যাস আছে, নিশীথের তো নেই। ও কি পারবে সারজীবনের লাক্সারিয়াস লাইফস্টাইল ছেড়ে হুট করে আর দুটো সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষের মতো করে সংসার করতে?
দোলাকে চুপ থাকতে দেখে নিশীথ ওর বাহু ধরে ঝাকায়। দোলা তাকাতেই চোখের ইশারায় প্রশ্ন করে, “কি ভাবছো?”
দোলা একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
—আপনার ভীষণ কষ্ট হবে, নিশীথ। আমি আপনার জন্যই বলছিলাম এতক্ষণ। আমার কিন্তু বাড়ি ছাড়লেও কষ্ট হবেনা, কারণ আমি সবসময় এমন জীবনে অভ্যস্ত ছিলাম। কিন্তু আপনি বুদ্ধি হবার পর থেকেই মা-বাবার আহ্লাদে বড় হয়েছেন। কোনো জিনিস দুইবার চাওয়ার আগেই চোখের সামনে হাজির পেয়েছেন। কোনো শখ আহ্লাদ অপূর্ণ থাকেনি আপনার। তবে যে জীবনে আপনি যেতে চাচ্ছেন, সেখানে কিন্তু এমন হয়না! আমরা মধ্যবিত্তরা ভীষণ হিসেব করে চলি। প্রয়োজনের অতিরিক্ত শখ সবসময় পূরণ করার মতো পরিস্থিতি আমাদের হাতে থাকেনা অনেকসময়। এজন্যই বারবার বলছি। কারণ, এমন জীবনে অভ্যস্ত হতে আপনার জন্য ভীষণ কষ্ট হবে!
দোলার কথায় যুক্তি থাকলেও নিশীথ হঠাৎ রে’গে যায়। ফোস করে উঠে তাচ্ছিল্যের সাথে বলে,
—শা’লার কপাল আমার! যার জন্য করলাম চুরি, সেই বলছে চো’র!
দোলা ভ্রু কুচকে তাকাতেই ও বলে,
—তোমার আর বাবার কথার মধ্যে তো তাহলে কোনো ডিফারেন্সই থাকলোনা, দোলনচাঁপা! তুমি আমায় যেগুলো বললে, উনিও ঠিক এগুলোই বলেছেন। সাথে কি বলেছেন জানো? অভাবে পড়লে নাকি আমাদের ভালোবাসা জানলা দিয়ে পালাবে! কিন্তু আমি তার কথায় বিশ্বাস করিনি। আমি তোমার উপর, আমাদের ভালোবাসার উপর বিশ্বাস করেই নিজের কম্ফোর্ট জোনের বাইরে যেয়ে তোমার সাথে বাকি জীবন কাটাতে চাইছিলাম। কিন্তু এখন দেখছি তুমিই আমার উপর সন্দেহ করছো, তাহলে আমি কার জন্য এত বড় সিদ্ধান্ত নিলাম? কার উপর বিশ্বাস করা উচিত হবে? তুমিই বলে দাও শুনি।
দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৫১
দোলা মাথা চাপড়ায়। এ কেমন বিপদ রে বাবা? ও যা-ই বুঝাতে চাইছে, নিশীথ উল্টো বুঝে ছ্যা’ত করে উঠছে। এ রগচটা ছেলেটাকে নিয়ে ও কই যাবে?