দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৫২(২)
তাসফিয়া হাসান তুরফা
নিশীথের জিদের সামনে দোলাকে হার মানতে হলো। দুজনেই বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিলো। নিশীথের মা এ বিষয়টি জানার সাথে সাথে পাগলপ্রায় হয়ে গেলেন। একটাই ছেলে তার কাছে আছে, সে-ও দূরে থাকবে এটা তিনি মেনে নিতে পারলেন না। নিশীথ অনেকক্ষণ ধরে মায়ের শিওরে বসে আস্তেধীরে তাকে বুঝানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু আসমা বেগম কোনোকিছু মানতে নারাজ। উনি ছেলেকে যেতে দেবেন না, মানে দেবেন না!
—আমি তোকে আশ্বাস দিচ্ছি ভবিষ্যতে আর কেউ কখনো তোর বউয়ের সাথে খারাপ আচরণ করবেনা। তবু তুই এ বাসা ছেড়ে যাসনা, নিশু! আমি তোকে যেতে দিবোনা!
—আমাকে যে যেতেই হবে, মা। তোমার স্বামী ও বোন যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় রাখেনি আর!
—বাবার কথা কেউ গায়ে লাগায়? একটু না হয় রাগ করে কিছু বলেছেন। আমাকেও তো কতকিছুই বলেন। আমি কি কখনো বাড়ি ছেড়েছি? তুই কেন ছাড়ছিস তবে? তুই কোত্থাও যাবিনা। না মানে না। তোকে আমার কস…
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
—মা! এমন কোনো কসম আমায় দিয়োনা যা আমি পূরণ করতে পারবোনা! তুমি কি জানো, বাড়ি ছেড়ে যেতে আমার যতটা না খারাপ লাগছে তার চেয়েও বহুগুণ কষ্ট লাগছে তোমার এ অবস্থা দেখে! প্লিজ নিজেকে সামলাও! আর একটা সত্যি কথা বলি? কিছু মনে করোনা। আমি তোমার জন্য প্রতিবাদ করলেও, তুমি সবসময় বাবার খারাপ আচরণকে প্রশ্রয় দিয়েছো বলেই উনি বারবার তোমার সাথে বাজে ব্যবহার করতে আশকারা পেয়েছেন। ছোটবেলা থেকেই তো দেখে আসছি সেটা। আমার সবসময় মনে হতো যদি সময় থাকতেই তুমি নিজে থেকে প্রতিবাদ করতে তবে হয়তো সময়ের সাথে উনার আচরণও বদলে যেতো! কিন্তু আমি ছেলে হয়ে তো আর তোমাদের স্বামী-স্ত্রীর মাঝে কথা বলতে পারিনা তাই চুপ করে থাকতাম এতদিন। কিন্তু প্রসঙ্গ এবার আমার বউয়ের। আমি এ বাসায় থেকে দোলার অপমান হতে দিতে পারিনা, মা! আমার দিক থেকে বিষয়টা বুঝার চেষ্টা করো প্লিজ!
—কিন্তু নিশীথ.. তুই চলে গেলে আমি কিভাবে থাকবো? আমাকেও নিয়ে যা তোর সাথে!
মায়ের সরলতায় নিশীথ হাসে! মায়ের হাত নিজের হাতের মুঠোয় ধরে তাতে চুমু খেয়ে বলে,
—এখন তোমার ছেলে খালিহাতে বাড়ি ছাড়ছে, মা। তাই চাইলেও তোমায় সঙ্গে নিতে পারছেনা। আগে নিজেদের থাকার মতো অবস্থান তৈরি করি, আল্লাহ সামর্থ্য দিক তখন যত দ্রুত সম্ভব এসে তোমায় নিয়ে যাবো! তাছাড়াও এখানে দাদু আছে, আমি চলে গেলে তুমি ছাড়া আর কে আমার বুড়োর খেয়াল রাখতে পারবে বলো?
নিশীথ নিজের কথায় অটল রইলো। অতঃপর বহুকষ্টে মা-কে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে নিজের দিকটা বুঝিয়ে কতক উপায় অবলম্বন করে তাকে রাজি করাতে সক্ষম হলো। এসবের মাঝে দোলনচাঁপা দূর থেকে তাদের মা-ছেলেকে দেখে গেলো শুধু৷ ওর নিজেরও খারাপ লাগছে আসমা বেগমকে এভাবে কাদতে দেখে, ও এটাও জানে যে নিশীথের অবশ্যই ওর চেয়েও হাজারগুণ বেশি কষ্ট হচ্ছে এভাবে নিজের আপনজনদের ছেড়ে চলে যেতে। বিশেষ করে মা ও দাদু নিশীথের বড়ই আপন। তাদের ছাড়া জীবন ও কল্পনাও করেনি কখনো। এজন্যই তো বড়ভাই বিদেশ যাওয়া সত্ত্বেও ও দেশেই থেকে গেলো। শুধুমাত্র মা ও দাদুর খাতিরে। আর আজকে ভাগ্যের নির্মম পরিণতি ওকে বাধ্য করলো এ বাড়ি ছাড়তে!
দাদু বেশ বিচক্ষণ মানুষ। উনি হয়তো আগে থেকেই আন্দাজ করেছিলেন এমন কোনো পরিস্থিতি আসবে, যে কারণে তাকে আসমা বেগমের মতো অতটা বিচলিত হতে দেখা গেলোনা। উল্টো উনি শুধু রিক্ত চোখে বললেন,
—কোনোভাবে কি এখানে থাকা যায়না, দাদুভাই?
দাদুর কথায় নিশীথ মাথা নিচু করলো। দাদুকে জড়িয়ে ধরে বললো,
—যদি আমার পক্ষে সম্ভব হতো তবে কি কখনো তোমায় এ বয়সে একা রেখে চলে যেতাম, বুড়ো?
দাদু নিশীথের পিঠে হাত বুলিয়ে দিলেন। নিশীথ চোখ বন্ধ করে বললো,
—দোলার মা-কে কথা দিয়েছিলাম তার মেয়ের কোনোরুপ অসম্মান হতে দেবোনা। তবে নিজের কথার বরখেলাপ কিভাবে করি, দাদু? আমরা তালুকদার, আমাদের জবানের দাম আছে তুমিই তো শিখিয়েছিলে! তোমার শিক্ষা কি করে ভুলি বলো?
দাদু যেন সবটা বুঝলেন সেভাবে মাথা নাড়লেন। বৃদ্ধার চোখদুটোও পানিতে ঝাপসা হয়ে এলো! নিশীথের মাথায় হাত রেখে বললেন,
—তোকে ন্যায় ও মনুষ্যত্বের সঠিক শিক্ষা দিতে পেরে আমি ধন্য, দাদুভাই। যা তবে আল্লাহর নাম নিয়ে এ যেখানে যাচ্ছিস যা! কোথায় যাবি ঠিক করেছিস? এত জলদি তো বাসাও পাবিনা কোনো। আমাদের কলাবাগানের যে ফ্ল্যাট খালি পড়ে আছে ওখানে থাকবি? এখনো ভাড়া হয়নি ওটা। এসিও আছে, সব আছে। তোদের সুবিধা হবে!
দাদুর কথায় নিশীথ হেসে ফেললো। মাথা নেড়ে বললো,
—ওই ফ্ল্যাটটা এখনো আমার নামে হয়নি গো, দাদু
ওটা তোমার ছেলের নামে আছে। আর আমি আপাতত তার নামের কোনো জিনিস গ্রহণ করতে চাইছিনা। এখন আমাকে এসব বলে কষ্ট দিওনা প্লিজ! বাসা নিয়ে চিন্তা করোনা। তুমি আকাশকে চেনোনা আমার বন্ধু? ওদের বাড়ির তিনতলা খালি হয়েছে এ মাসে। ভাড়া খুজছে ওরা। আমি ওকে বলবো ভেবেছি। তাই বাড়ি নিয়ে চিন্তা করছিনা আপাতত। লোকেশন এখান থেকে কাছেই আছে। তোমরা যেতে পারবে প্রায় প্রায়ই। আর আমি ভাবছিলাম আমাদের অফিস থেকেও রিজাইন নিয়ে অন্য কোথাও সিভি….
—নিশীথ! আর একটা কথাও বলবিনা।
নিশীথকে থামিয়ে দিয়ে দাদু ধমকে বললেন। নিশীথ বিস্মিত হয়ে তাকাতেই আবারো শুরু করলেন,
—বাসা নিয়ে তোর যেখানে ইচ্ছা যা আমি কিছু বলবোনা কিন্তু খবরদার যদি আমাদের বিজনেস ছেড়ে অন্যের অফিসে চাকরি করেছিস তো আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবেনা।
—কিন্তু দাদু আমি…
—তুই কি হ্যাঁ? এত কষ্ট করে তোকে ভালো ভালো জায়গা থেকে পড়িয়েছি অন্যের কোম্পানিতে তোর মেধা কাজে লাগানোর জন্য? বাপের সাথে তোর পারসোনাল লাইফে যাই হোক না কেন, অফিসে তোদের সম্পর্ক প্রফেশনাল। পারসোনাল সম্পর্কের জন্য প্রফেশনাল জায়গায় কেন লস করবি? নিশান দেশে থাকলেও এক কথা ছিলো। ও যেহেতু নাই, এখন তো তুই আমাদের এ ব্যবসার উত্তরসূরী। তবে কেন অযথা মানুষের কোম্পানিতে নিজের মেধা ব্যবহার করবি?
দাদুর যুক্তিতর্কে নিশীথ এবার হার মানলো। ও কিছু বলতে পারলোনা। কিছুক্ষণ চুপ থেকে মাথা নেড়ে দাদুর বক্তব্য মেনে নিলো। ইউনুস সাহেব স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন! যাক একটা দিকে তো নাতিকে রাজি করাতে পেরেছেন! এদিকে দরজার পেছন থেকে সবার আড়ালে একজন ব্যক্তি এসব কথাবার্তা শুনছিলো। উনি হচ্ছেন আয়মান সাহেব। করুন চোখে নিশীথ ও ইউনুস সাহেবের কথা শুনছিলেন তিনি।
বরং এতক্ষণ এখানে যা যা কথা হলো কোনোটাই তার অজ্ঞাতে হয়নি। উনি শুরু থেকেই উপস্থিত ছিলেন এবং সবটাই শুনছিলেন , যা আর কেউ লক্ষ্য না করলেও খেয়াল করলো দোলনচাঁপা। ও তাকাতেই আয়মান সাহেব ভড়কে গেলেন, দ্রুত পায়ে দরজার পেছন থেকেই নিজের রুমের দিকে প্রস্থান করলেন। তাকে চলে যেতে দেখে দোলা বড় করে এক দীর্ঘশ্বাস ফেললো! পরিবারের এ টালমাটাল দেখে দুই চোখ বারবার জলে টইটম্বুর হচ্ছে ওর। এক সময় চোখের পাতা বেয়ে সে জল গালের উপর গড়িয়ে পড়লো।
তবু অশ্রুসিক্ত দোলা পুরোটা সময় শুধু একধ্যানে নিশীথের দিকেই চেয়ে রইলো। ও জানে এ মানুষটা শুধুমাত্র ওর আত্মসম্মানের কথা চিন্তা করে নিজের স্বার্থের বাইরে যেয়ে, নিজের সাজানো গোছানো পরিবার ও বিলাসবহুল জীবন ছাড়তে রাজি হয়েছে। এতকিছু এর আগে কেউ কখনো করেনি দোলার জন্য।
দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৫২
নিশীথের এ কাজ দোলার কাছে যেমন ভাবনাতীত, ঠিক তেমনি ওর চোখে, ওর অন্তরে নিশীথের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা হাজারগুণে বৃদ্ধি পেলো! দোলার ভাবনা শেষ হওয়ার আগেই নিশীথ সবাইকে রেখে ওর দিকে এগিয়ে এলো। হাত বাড়িয়ে দোলার গালে বেয়ে পড়া পানি মুছে দিলো তো বটেই, একিসাথে শক্ত করে ওর হাত ধরে রুমের দিকে নিয়ে গেলো। বাড়ি ছাড়ার সব প্রস্তুতি শেষের দিকেই প্রায়। এবার শুধু বাড়ি থেকে বের হবার পালা!