দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৬৮

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৬৮
তাসফিয়া হাসান তুরফা

মানুষের জীবনে অতিরিক্ত কিছুই ভালো না। হোক সেটা রাগ, জিদ, অভিমান কিংবা ভালোবাসা! অতিরিক্ত রাগে মানুষ নিয়ন্ত্রণহীন পাগল হয়ে যায়, অতিরিক্ত জিদে মানুষ আশেপাশের সবকিছু ভুলে যায়, অতিরিক্ত অভিমানে মানুষ পাথর হয়ে যায় এবং অতিরিক্ত ভালোবাসায় মানুষ অন্ধ হয়ে যায়! আয়মান সাহেবের জীবনেও এর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। সালমা ছিলো তার যৌবন জীবনের প্রথম প্রেম। তার প্রতি ওনার ভালোবাসা ছিল অপরিসীম। যার কারণে তিনি সম্পর্ক চলাকালীন বারবার সালমার করা ভুলগুলো উপেক্ষা করেন বারংবার।

সালমা বেগমের প্রতি তার দূর্বলতা তাকে বাস্তবতা থেকে পৃথক করে রাখে। ইউনুস সাহেব ভেবেছিলেন বিয়ের পর আসমার যত্ন, দায়িত্বশীলতা ও ভালোবাসায় হয়তো আয়মানের মন পরিবর্তন হবে। ও সালমাকে ভুলে নিজের সংসারে মনোযোগ দিবে। কিন্তু বিয়ের কিছুদিন যেতে না যেতেই তার ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। ইউনুস সাহেব খেয়াল করলেন আসমা যত আয়মানের দিকে ভালোবাসার হাত বাড়াতে থাকে আয়মান যেন ততই তার থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে থাকে। সবসময় যেন আসমার থেকে পালিয়ে বেড়াতো সে। দিন যত যায় আসমার অসহায় মুখ ও করুন অবস্থা দেখে ইউনুস সাহেব মনে মনে দমে যান। দিন দিন আত্মগ্লানি ও অনুশোচনায় অন্তর ভরে উঠে তার। সংসারের যাবতীয় সব দায়িত্ব সে পুরোপুরি পূরণ করলেও বিয়ের প্রথম ও প্রধান যে দায়িত্ব সেটাই ও পূরণ করতে পারেনা। স্ত্রীকে ভালোবাসার প্রতিই যেন তার সকল অনীহা!
নিশীথ চোখের পানি মুছে বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

—নিজের জিদে তুমি বাবার বিয়ে দিলে ঠিকই কিন্তু সে তো তোমারই ছেলে এটা কিভাবে ভুলে গেলে, দাদু? সে তো তার জিদ ভুললোনা। উল্টো নিজের জিদ ও অভিমানের বশে সারাটা জীবন আমার মাকে শুধু হতাশা আর কষ্টই দিয়ে গেলো!
—আমি কি জানতাম তোর বাপ কোনোদিন পরিবর্তন হবেনা? আমি তো ভেবেছিলাম তোর মায়ের আকাশসম ভালোবাসায় আয়মানের পাথর মন গলতে বাধ্য হবে। আরে নিজের ভালো তো একটা পাগলও বুঝে! কে জানতো আমার ছেলের নিজের জিদে এভাবে অন্ধ হয়ে যাবে।
—এখন এসব বলে কি কোনো লাভ আছে, দাদু? তোমাদের বাপ-ছেলের দ্বন্দে মাঝখান দিয়ে বেচারি আমাদের নিরপরাধ মা সারাজীবন শাস্তি ভোগ করে গেলো! আর বড় খালামনি ও বাবার মাঝে যে এমনকিছু ছিলো তা আমরা কস্মিনকালেও ইমাজিন করতে পারিনি! উল্টো আমি সবসময় বাবার সাথে তার সুসম্পর্ক দেখে মনে করতাম তাদের বয়স সমান দেখে তারা বন্ধুর মতো! অথচ সত্যিটা আমাদের চিন্তা ভাবনা থেকে কত আলাদা!

—হুম। যাক গে এসব কথা। পুরনো কথা ভাবলেই অনুশোচনায় মনটা ভারী হয়ে আসে। এতগুলো বছর এ অনুশোচনা মনে বয়ে নিয়ে বেরিয়েছি কোনোদিন কাউকে বলিনি। আজ শুধু তোদের দুই ভাইয়ের জিদের কারণেই তোদের সামনে অতীত নিয়ে আসা। আশা করছি তোরা বউমাকে কিছু বলবিনা। তাহলে লজ্জায় আমি আর বউমার সামনে দাড়াতে পারবোনা।
নিশীথ কিছু বলবে এমন সময় নিশানের ফোন বেজে উঠে মেসেঞ্জারে টুংটাং কলের শব্দে। ফোন দেখে ওর মুখে সামান্য হাসির রেখা ফুটে উঠে। ও “আসছি” বলে বিদায় নেয় দাদু ও ভাইয়ের থেকে। নিশান যেতেই নিশীথ কি মনে করে উঠে গিয়ে রুমের দরজা চেপে দেয়। ইউনুস সাহেব ভ্রু কুচকে ওর কর্মকাণ্ড দেখতে থাকেন। নিশীথ দ্রুত কদমে হেটে এসে বলে,

—দাদু, আজকে যখন সব সত্যি বলেই ফেলছ প্লিজ আরেকটা সত্যি আমায় বলো।
—কি সত্যি, নিশীথ? আর কিছু তো বাকি নেই। যা ঘটেছিলো সবই তো বললাম।
—সব বললে বুঝলাম কিন্তু একটা জিনিস জানার ইচ্ছা আমার ছোটবেলা থেকেই। ভাইয়ার সামনে ওটা জিজ্ঞেস করতে পারছিলামনা ও কষ্ট পাবে বলে। এবার তোমাকে জিজ্ঞেস করছি।
—নিশানকে নিয়ে কি এমন প্রশ্ন? ও প্রেম করছে তোকে বলেনি দেখে?
—আরে নাহ। ধুর তুমি বুঝলেনা!
—তাহলে বলো, দাদু ভাই। বুঝাও কি জানতে চাও।
নিশীথ এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে অভিমানী কণ্ঠে বল্লো,
—বাবা ভাইয়াকে আমার চেয়ে বেশি ভালোবাসে। আমি ছোটবেলা থেকেই বিষয়টা খেয়াল করে এসেছি। সবসময় শুধু ভাবতাম কেন? তুমি কি কারণটা জানো, দাদু?
ইউনুস সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
—আয়মান যে তোকে ভালোবাসেনা এটা সঠিক নয়, নিশীথ। বরং তুই জেনে অবাক হবি যে ছোটবেলায় আয়মান নিশানের চেয়েও বেশি ভালো তোকেই বাসতো।
নিশীথ অবাক হয়ে বললো,

—কি বলছো?
—ঠিকি বলছি। তুই হওয়ার পর সবচেয়ে খুশি হয়েছিল তোর বাপ। কারণ তুই দেখতে হয়েছিলি অবিকল ওর মতো। তোর মাঝে যেন আয়মান নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পারতো। কিন্তু দিন যত গড়াতে থাকে তুই বড় হতে থাকিস নিজের মতো। একটা সময় আয়মান লক্ষ্য করলো তোর স্বভাব, আচরণ শুধুমাত্র ওর মতো নয়। বরং রাগ-জিদের দিক দিয়ে তুই আমাদের মতো হলেও মনের দিক দিয়ে তুই হয়েছিস ঠিক তোর মায়ের মতো। নিশান সবসময় আয়মানের কথা শুনতো, ও যা বলতো তাই করতো। কিন্তু তুই নিশানের মতো চুপচাপ না থেকে মায়ের হয়ে প্রতিবাদ করতি সেই ছোটবেলা থেকেই। তোর আগে কখনোই কেউ আসমার সাথে হওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে আয়মানকে প্রশ্ন করেনি। এমনকি আমি নিজেও না! আমি তো আয়মানের বিয়ের পর ওর সাথে কথা বলাই কমিয়ে দিয়েছিলাম। একমাত্র তুই ছিলি যে তোর মায়ের হয়ে কথা বলতি। হয়তো তোর এ স্বভাবটাই আয়মানে অনুশোচনায় ফেলতো আর ও তোর থেকে নিজেকে দূরে রাখতো। আমি যে এটা নিয়ে আয়মানকে বলিনি এমন না কিন্তু ও বিয়ের পর থেকে আমার কথা আর অতো গুরুত্ব দিয়ে শুনতোনা।

এজন্য এ ব্যাপারে আমি বিশেষ কিছু করতে পারিনি রে, দাদুভাই!
দাদুর কথা শুনে নিশীথ স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। একটা ব্যর্থ প্রেম ও সেই অভিমান থেকে জিদ যে মানুষের জীবন কতভাবে নষ্ট করে তার প্রভাব হারে হারে টের পায় সে। দাদুকে কিছু না বলে সে বিদায় নিয়ে চলে আসে নিজের রুমে। ধীরপায়ে রুমের দরজা খুলে প্রবেশ করতেই দেখতে পায় বিছানায় ঘুমানো দোলনচাঁপাকে। বুক পর্যন্ত চাদর মুড়ি দিয়ে কেমন নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে মেয়েটা ওর খাটে। দোলাকে দেখে মনে হচ্ছে ওর জীবনে কোনো চিন্তা নেই। নিশীথ ওর পাশে আছে জেনেই ওর ঘুম এত প্রশান্তির! প্রায় সাথে সাথেই নিশীথের মনে প্রশ্ন আসে। আচ্ছা, ওর মা কি কোনোদিন এভাবে শান্তির ঘুম দিতে পেরেছেন? বিয়ের প্রায় ত্রিশটা বছর সময়ে ঠিক কতরাত এমন তৃপ্তি নিয়ে ঘুমিয়েছেন তিনি? কষ্টে নিশীথের বুক ভারি হয়ে আসে।বাবা ও বড় খালার প্রতি রাগে-ক্ষোভে মাথা ভনভন করে। শরীর ঘেমে বমি পায়। ও নিজেকে সামলাতে পারেনা। অস্থির বোধ করে বেশ। বাথরুমে গিয়ে এই ঠান্ডা আবহাওয়াতেও ভোরবেলা ঠান্ডা পানির নিচে দাঁড়িয়ে যায়। সময় নিয়ে অনেকক্ষণ ভিজে নিজের মনের অস্থিরতা দূর করার চেষ্টা করে। হরেক রকম ভাবনায় মস্তিষ্কে বিস্ফোরণ হবার জোগাড়!

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৬৭

হঠাৎ করে নিশীথের মাথায় এক অদ্ভুত ভাবনা আসে। ওর মনে প্রশ্ন উঠে, যদি নিশীথের সাথেও ওর বাবার মতো ঘটনা ঘটতো তবে ওর জীবনের কি হতো? সে কি পারতো দোলনচাঁপাকে ভুলে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে নাকি ওর অবস্থাও অনেকটা আয়মান সাহেবের মতোই হতো?

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৬৮ (২)