দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৬৮ (২)

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৬৮ (২)
তাসফিয়া হাসান তুরফা

সাধারণত পঞ্চাশোর্ধ বয়স পার করার পর মানুষের জীবন তার কাছে দর্পনের ন্যায় হয়ে যায়। অর্থাৎ এ বয়সে এসে সে পুরো জীবনে কি কি করেছে, কি করতে পারেনাই এবং জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন থেকে শুরু করে সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা- সবটাই আস্তেধীরে বেশ ভালোভাবে উপলব্ধি করতে শুরু করে। আর জিনিসটা আয়মান সাহেবের ক্ষেত্রেও খুব করে খাটে! কেননা জীবনের এ বয়সে এসে, বিশেষ করে ছেলেকে বিয়ে দেওয়ার পর থেকে তিনি যেন প্রায়শই উপলব্ধি করেছেন তার জীবনের এত বছরের করা ভুলগুলোর কথা। যেভাবে নিজের ভাগ্যের পরিণতি না মেনে নেওয়ার ক্ষোভ অনবরত ঝেড়ে গেছেন নিজের নিরপরাধ স্ত্রীর উপর, ঠিক সেভাবেই নিজেরই সন্তানকে দিনের পর দিন ইগ্নোর করে গেছেন।

তাও শুধু মাত্র এ কারণে যে, সে নিজের মায়ের প্রতি হওয়া অন্যায়ের কারণ জিজ্ঞেস করেছিলো। বিষয়টা ভাবতে কষ্টকর হলেও এটাই সত্যি যে আয়মান সাহেব নিশীথকে মন থেকে ভালোবাসলেও ওকে সবসময় ইচ্ছে করেই এড়িয়ে যেতেন এবং এড়িয়ে যাওয়ার কারণটাও বেশ সুস্পষ্ট। তা হলো, উনি নিজের করা অন্যায়কে সবসময় হালকাভাবে নিতেন। একমাত্র নিশীথ ছাড়া অন্য কেউ তাকে উপলব্ধি করাতোনা যে তিনি আসমার প্রতি যে আচরণটা করছেন তা কতটা অন্যায়। নিশান সবসময় নিজের মতো ছিলো এবং সে ছিলো তার ভক্ত।তাই মায়ের প্রতি হওয়া অন্যায় তার চোখে পড়লেও সে নাক গলাতো না, এড়িয়ে চলতো বলা চলে। এমনকি ইউনুস সাহেবও তাকে বিশেষ কিছু বলতেন না। কিছু বললেই আয়মান জবাব দিতো,
“তুমি বিয়ে করতে বলেছো আমি বিয়ে করেছি। আমার যতদূর মনে পড়ে এর চেয়ে বেশি কিছু চাওয়া ছিলোনা তোমার।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ব্যস! আয়মানের এই এক কথায় ইউনুস সাহেবও বিপরীতে তেমন কিছু বলতে পারতেন না। তাইতো আয়মান সাহেব শুরুর দিকে আসমার সাথে খারাপ ব্যবহারে খানিকটা অপরাধবোধে ভুগলেও পরে অন্য কারও কোনো হস্তক্ষেপ না দেখে নিজের ন্যায়নীতি ভুলে এটাকেই স্বাভাবিক আচরণ হিসেবে ব্যবহার করতে থাকলেন। তবে নিশীথ জন্মানোর পর যেন তাদের জীবনে কিছু একটা পরিবর্তন এলো। আয়মান সাহেব খেয়াল করলেন নিশীথ ঠিক তারই মতোন জেদি, নিজের সিদ্ধান্তে অটল এক ব্যক্তিত্ব। অর্থাৎ নিশানকে তিনি যতটা সহজে নিজের বশে আনতে পেরেছেন নিশীথকে দিয়ে নিজের কথা মানানো ঠিক ততটাই কঠিন! আর ঠিক এ জিনিসটাই আয়মান সাহেবের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেয়। তার ছোটছেলে বড় হয়ে তার থেকে দূরে সরে যাবেনা তো? ধীরে ধীরে বাপের মনের ভয় সত্যে রুপান্তরিত হয়। তার নিজ দোষে, আসমার প্রতি করা ব্যবহার নিশীথকে অল্প বয়স থেকেই প্রতিবাদি বানায়,ওকে বাপের বিরুদ্ধে করে দেয়। নিশীথ সবসময় শুধু তাই করে যা ও চায় এবং আয়মান সাহেব খেয়াল করে এসেছেন। এবারো যেমন নিশীথ তার ইচ্ছেটাকেই পূরণ করলো আসমাকে নিজের সাথে ওর বাসায় নিয়ে গেলো এবং অদ্ভুতভাবেই আয়মান সাহেবও এখানে নিশীথের বিরুদ্ধে একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারলেন না! প্রথমে আসমাকে এ বাসায় রাখতে আয়মান বাবাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে ও বলেছিলো,

—কয়দিনের জন্য নিয়ে যাচ্ছো তোমার মাকে? কবে আসবে এ বাসায়?
নিশীথ গম্ভীর মুখে বলেছিলো,
—যতদিন আমার ইচ্ছা!
—এটা আবার কেমন কথা? এ বাসা পুরোটা তোমার মা চালায়। ও চলে গেলে আমরা চলবো কিভাবে? তোমার দাদুর খেয়াল কে রাখবে?
আয়মান বিরক্ত হয়ে বলেছিলো। তবে নিশীথ বেশ হেয়ালি করেই তার জবাব দিয়েছে,
— মা তো সারাজীবন এ বাসায় থেকে আপনাদের সেবা করেই জীবন পার করে দিলো। এবার না হয় ছেলের বাসায় থাকুক! কিছুদিন ছেলের সেবা ভোগ করুক! তারও তো একটা হক আছে! আর রইলো দাদুর কথা, তার সেবাযত্ন করার জন্য লোক তো আছেই। ও আপনাদের নাস্তা বানিয়ে দেবে এবং বাকি কাজও করে দেবে। এটা নিয়ে চিন্তার কিছু নেই! আমার দাদুর সাথে কথা হয়েছে। দাদুও বলেছে মাকে নিয়ে যেতে!”
নিশীথের এত এত যুক্তি শুনে আয়মান একবার বলতে চেয়েছিলেন,
“তোমার মাকে আমি বিয়ে করে এনেছি এ বাসায় থাকার জন্যই। আসমা আমার সাথেই থাকবে”
কিন্তু কেন জানি শত চেষ্টা করার পরও
তিনি কথাটি বলতে পারলেন না। হয়তো এত বছর আসমার সাথে অবহেলা করা তার সত্ত্বা তাকে এ কথাটি বলার স্পর্ধা দিলোনা! অতএব নিশীথ আর কথা না বাড়িয়ে মাকে নিয়ে চলে এলো নিজের বাসায়।

নিশীথের ছোট্ট বাসায় তিনজনের দিন ভালোই কাটছিলো। সকালে নিশীথ অফিসে চলে গেলে আসমা বেগম ও দোলা পুরো দিন মিলেমিশে কাজ ও গল্পের মাঝে কাটিয়ে দেয়। দোলা অবশ্য আসমাকে খুব একটা কাজ করতে দেয়না। যদি না তিনি জিদ করেন তবেই সাহায্য নেয়। কেননা ও নিশীথের থেকে শুনেছে মা কিভাবে এতগুলো বছর কষ্ট করে গেছেন, বিনিময়ে তিনি কিছুই পাননি। তাই আসমা বেগমের জন্য ওর মনে অগাধ ভালোবাসা ও সম্মান কাজ করে। বিয়ের পরপরই ওরা দুজন এ বাসায় চলে আসায় দোলা আসমাকে খুব একটা পায়নি। তাই এবার শাশুড়িকে কাছে পেয়ে ও যথাসম্ভব একটা ভালো পুত্রবধূর দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করছে। আসমা বেগম যত দোলাকে দেখেন তত মুগ্ধ হোন। মেয়েটার মন তুলোর মতো নরম। বাহ্যিক দিক থেকে দোলা দেখতে যেমন সুন্দর-স্নিগ্ধ, ওর আচরণ-ব্যবহারও ঠিক ততটাই নমনীয়। অর্থাৎ, প্রকৃত অর্থেই দোলা যেন জীবন্ত এক দোলনচাঁপা ফুল। এবার আসমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠে কেনই বা এত কম সময়ে তার নিশীথ এত বেশি পাগল হয়ে গেছে এ মেয়েটার জন্য! আসমার নিজের একটা মেয়ে না থাকার আক্ষেপ যেন দোলার সান্নিধ্যে এসে নিমিষেই কর্পুরের ন্যায় উড়ে যায়!

এভাবেই মিলেমিশে সুন্দর চলছিলো জীবন। সপ্তাহখানেক পর ছুটির দিনে নিশীথের মন চাইলো মাকে নিয়ে বাইরে খেতে যাবে। এ ক’দিন হলো মা এসেছে অথচ একটাবার ও সময় পেলোনা মাকে নিয়ে বাইরে থেকে ঘুরে আসার। অফিসে ভীষণ প্রেসার। বিশেষ করে ওর উপর কাজের স্তুপ জমা পড়েছে যেন। নিশীথের একবার মনে হয়েছে ওকে এত কাজ আয়মান সাহেব ইচ্ছে করে দিয়েছেন। আসমা বেগমকে ওর বাসায় নিয়ে যাওয়ার শাস্তি স্বরুপ ওকে ইচ্ছে করে জ্বালাচ্ছে বাবা। কিন্তু পরক্ষণেই ও ভাবলো, এত বছর যে মানুষ পাশে থেকে নিজের কদর বুঝাতে পারলোনা, সে চলে যাওয়ায় কি আদৌ কোনো প্রভাব পড়বে আয়মান সাহেবের উপর? নিশীথের মন মানতে নারাজ। তবু মনের কোথায় যেন একটা প্রশ্ন থেকেই যায় যেটার উত্তর মিলেনা। যাই হোক, আজ ছুটির দিন দেখে বেশ আগ্রহে নিশীথ মা ও দোলাকে নিয়ে বেরিয়েছে। উবার ডেকে তিনজনে ঢাকার বেশ নামিদামী এক রেস্তোরাঁয় খেতে এসেছে। হাসি-গল্প ও সুস্বাদু খাবারের সাথে সুন্দর সময় কেটেছে ওদের। ওরা যখন বের হবে ততক্ষণে বেশ রাত হয়ে গেছে।

মূলত নিশীথের উবার আসতেই দেরি হচ্ছিলো।দেশের যে পরিস্থিতি, তাতে এত রাতে মাকে এবং বিশেষ করে দোলনচাঁপাকে নিয়ে বাড়ি ফেরায় ও কোনো প্রকার রিস্ক নিতে চায়না। এ কারণে সময় লাগলেও ওরা অপেক্ষা করে উবারের গাড়িতে উঠেছে। বনানী পার হয়ে মেইনরোডে আসার সময় বেশ অনেকক্ষণ জ্যামে বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে নিশীথ নিজেই গাড় থেকে বেরোলো সামনে কিসের জন্য জ্যাম লেগেছে তা দেখার জন্য। আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকদের মাধ্যমে ও জানতে পারলো, সামনে এক মাতাল ব্যক্তি নেশা করে গাড়ি চালানোর সময় একটা মাইক্রোকে লাগিয়ে দেয়।

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৬৮

এরপর ড্রাইভার বের হয়ে আসে এবং দুপক্ষের তর্কবিতর্ক চলছে যা একপ্রকার হাতাহাতির পর্যায়ে চলে গেছে! সব শুনে নিশীথ বিরক্তির সাথে মাথা নাড়লো। দেশের এসব বড়লোকের বিগড়ে যাওয়া সন্তানদের থেকে আর কি আশা করা যায়! কিন্তু ওদের এসবের কারণে যে রাস্তার বাকি মানুষের ভোগান্তি হচ্ছে তা মেনে নেয়া যায়না। তাই বেশি না ভেবে নিশীথ সামনে এগোলো ঝগড়ার মিটমাট করানোর জন্য। ও পেছন থেকে দেখলো মাতাল লোকটা ঠিকমতো দাড়াতে পারছেনা অথচ ঠিকি সামনের ব্যক্তিকে মারার জন্য এগিয়ে যাচ্ছে! তা দেখে নিশীথের হাসি পায়। দুপাশে মাথা নাড়িয়ে ও আরেকটু সামনে এগিয়ে লোকটির কাছে যেতেই ওর মুখের হাসি উড়ে যায়!
চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসে প্রায়। বিস্মিত হয়ে নিশীথ নিজেকে চিমটি কাটে, ও চোখে ঠিক দেখছে তো?

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৬৯