দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৬৯
তাসফিয়া হাসান তুরফা
সামনে থেকে ব্যক্তিটাকে দেখে নিশীথ বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে পৌঁছে চিৎকার দিয়ে উঠলো।
“ভাইয়া?”
নিশীথের চিৎকারে নিশান সামনের লোকটাকে মারা বাদ দিয়ে থমকে দাঁড়ায়। ওকে দেখে মনে হয় যেন এ সময় হঠাৎ নিজের নাম শুনে ও ভীষণ চমকে গেছে। নিশানকে থেমে যেতে দেখে আশেপাশের মানুষও আগ্রহী দৃষ্টিতে দেখছে এখানে কি ঘটবে তার সাক্ষী হওয়ার জন্য! নিশান পাশ ফিরে নিশীথের দিকে তাকায়। এতেও ওর কদম নড়বড় করছে, নেশা যে পুরোপুরি চড়ে গেছে নিশীথ বেশ বুঝে! ও এগিয়ে ভাইকে ধরে বলে,
—ভাইয়া, তুমি এখানে কি করছো? এ অবস্থা কেন তোমার? আর এই মাঝরাতে রাস্তায় মারামারি করছো কেন?
—আমি বলি কেন করছে…
সামনের ড্রাইভারটা নিশীথের উদ্দেশ্যে বলে উঠে। ও এতক্ষণ বেশ ফুসে ছিলো নিশানের উপর এবার সবার মনোযোগ পেয়ে বলে,
—আমি গাড়ি ঘুরাচ্ছিলাম ফাকা রাস্তায় কোত্থেকে এসে আপনার ভাই আমার গাড়ির সাথে লাগিয়ে দেয়। দিয়ে চলে যাওয়া তো দূরের কথা উল্টো নিজে গাড়ি না সরিয়ে আমাকেই সরাতে বলে। পরে উনি বের হওয়ার পর তাকে দেখে বুঝতে পারি সে কোন অবস্থায় আছে। এ অবস্থায় থাকলে তো গাড়িকেও প্লেন মনে হয়। এজন্যই রাস্তা দিয়ে উড়াইয়া নিয়ে যাচ্ছিলো!
নিশীথ লোকটার কথায় বিব্রত হয়। ভাইকে মাঝরাতে এভাবে দেখবে তাও মাতাল অবস্থায়, মূলত এটা সে কল্পনা করেনি কখনো। এদিকে নিশান প্লেনের কথা শুনে হেসে ফেলে। নিশীথ মাথা চাপড়ায়। কিভাবে নিজের অপমানে নিজেই হাসছে ওর ভাই পাগলের মতো। আসলেই হুশ-বুদ্ধি সব গেছে! এদিকে এতক্ষণ সব শুনতে থাকা রাস্তার মানুষ বিরক্ত হয়ে বলে,
—এই ভাই আপনাদের এসব শেষ হলে এবার সরেন তো সামনে থেকে। রাস্তার মাঝে থেকে গাড়ি সরান, পারলে সারারাত রাস্তার সাইডে দাড়িয়ে আপনারা ঝগড়া করেন। আমাদের বাড়ি যেতে দেন, ১২টা বেজেই গেছে প্রায়!
রাস্তার লোকদের কথা শুনে ড্রাইভার বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
—সরবোই তো। আমার কোনো শখ নেই অযথা মাতালের সাথে তর্ক করার। গাড়ির হেডলাইটে মেরে দিয়েছে এজন্য কথা বলতে এসেছিলাম। এখন এটা কে ঠিক করাবে?
নিশীথ বেশ বুঝলো লোকটা ঠিক কি বুঝাতে চাইছে। আদতে নিশান ওর হেডলাইটের কোনো ক্ষতি করেনি গাড়ির সাইডে লাগিয়ে শুধু, তবু সুযোগের সদব্যবহার করে লোকটা কিছু ক্ষতিপূরণের নামে কিছু টাকা হাতিয়ে নিতে চাইছে। তবে এখন পরিস্থিতি বিবেচনা করে নিশীথ আর কথা না বাড়িয়ে লোকটাকে ক্ষতিপূরণ স্বরুপ কিছু টাকা দিয়ে দিলো। নিশানকে নিয়ে গাড়িতে বসে নিজে গাড়ি রাস্তায় সাইড করলো। ততক্ষণে জ্যাম শেষ হয়ে পেছনের গাড়িগুলো নড়তে শুরু করেছে। এরই মাঝে নিশীথের ফোনে কল এলো। ও গাড়ি থেকে নেমে নিশানকে বললো,
—চুপচাপ এখানে বসে থাকবে। আমি এখনি আসছি। ভুলেও এ অবস্থায় গাড়ি থেকে বের হবেনা! চুপচাপ গাড়িতে বসে থাকবে।
নিশান ততক্ষণে গাড়িতে হেলান দিয়ে পড়ে রয়েছে। নিশীথের কথায় মাথা নেড়ে মুখে আংগুল দিয়ে চুপ করে থাকার ভান করলো। তা দেখে নিশীথ মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ভাই এমন নেশায় বুদ হয়ে আছে, হুশবুদ্ধি কিছুই নেই। ওকে এ অবস্থায় মা দেখলে যে কি হবে নিশীথ ভেবে পাচ্ছেনা! কিন্তু এ মাঝরাতে অন্যকিছু ভাবার উপায়ও নেই। দোলা ও মা একা গাড়িতে বসে আছে, ওর জন্য অপেক্ষা করছে। তাই নিশীথ তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে খানিকটা পিছে যেতেই ওরা যে গাড়িতে উঠেছিলো সেটা দেখতে পেলো। নিশীথ গাড়ির কাছে গিয়ে দরজা খুলে মা ও দোলার উদ্দেশ্যে বললো,
—তোমরা বের হও।
—বের হবো মানে? এটা তো মাঝরাস্তা। বাসা তো এখনো অনেক দূরে!
আসমা বেগম চিন্তিত সুরে প্রশ্ন করলেন। তা শুনে নিশীথ বললো,
—মা, তোমার ছেলে যখন বের হতে বলেছে তার মানে অবশ্যই কিছু বুঝেশুনেই বলেছে। এখন কথা না বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি বের হয়ে আসো।
আসমা বুঝলেন ছেলের কথা। তাই অতকিছু না ভেবে আপাতত গাড়ি থেকে বের হয়ে এলেন। তিনি বাম পাশ থেকে বের হওয়ায় দোলা রাস্তার সাইডে ডান পাশ দিয়ে দরজা খুলে বের হতে নিচ্ছিলো। নিশীথ তা দেখে দ্রুতপায়ে ডানপাশে চলে এলো। দোলা বের হওয়ার আগে আশেপাশে রাস্তা দেখে নিয়ে ওর ঢাল হয়ে ওকে নিয়ে যেয়ে আসমা বেগমের পাশে দাঁড় করিয়ে দিলো। অতঃপর ড্রাইভারকে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে দুজনকে নিয়ে নিশানের গাড়ির কাছে এগিয়ে গেলো। গাড়ির কাছে যেতেই আসমা বেগম চিনতে পারলেন। অবাক হয়ে বললেন,
—আরেহ! এটা তো আমাদের গাড়ি। তাইনা, নিশীথ?
মায়ের নিশীথ মাথা নাড়লো। তা দেখে দোলা বিস্মিত হয়ে শুধালো,
—বাসার গাড়ি এখানে কি করছে? কে আছে গাড়িতে?
—ভাইয়া।
নিশীথ জবাব দিলো। ওর কথায় খুশি হয়ে আসমা বেগম দ্রুত এগিয়ে গেলেন বড়ছেলেকে দেখতে। কিন্তু ভেতরে যেয়ে তিনি দেখলেন নিশান ঘুমিয়ে আছে গাড়ির ভেতর। এতে আসমা আরও অবাক হলেন। মাঝরাতে নিশান গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছে তাও কিনা গাড়ির মাঝে ঘুমিয়ে আছে? এটা কেমন কথা!
—নিশান ঘুমাচ্ছে কেন, নিশীথ?
আসমা প্রশ্ন করলেন ছেলেকে। ভাইকে ঘুমাতে দেখে নিশীথ একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। যাক এবার তাহলে কিছু বানিয়ে বলা যাবে! মা অন্তত কষ্ট পাবেনা।
—সামনে যে জ্যাম দেখেছিলে না একটু আগে? ওটা ভাইয়া আরেকটা গাড়ির সাথে লাগিয়ে দিয়েছিলো ঘুমের ঘোরে। তাই আমি ওকে দেখে বললাম তুমি গাড়িতে থাকো আমি মা ও দোলাকে নিয়ে আসছি। আমি ড্রাইভ করে নিয়ে যাবো। কিন্তু ও বেশিই টায়ার্ড ছিল বোধহয়। আমরা আসতে আসতে ঘুমিয়ে গেছে।
সব শুনে দোলা দুঃখপ্রকাশ করে বললো,
—আহারে। ভাইয়া বেচারার জেটল্যাগ হচ্ছিলো বোধহয়। এজন্যই ওভাবে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরছিলেন। ভালোই হয়েছে আমাদের সাথে দেখা হয়েছে। এখন আপনি ড্রাইভ করে নিয়ে যেতে পারবেন।
বউয়ের সরলতায় নিশীথ জোরপূর্বক হেসে মাথা নাড়ে। মনে মনে বলে,
—সবাই যদি তোমার মতো সরল হতো তবে দুনিয়াটা কতই না ভালো হতো, দোলনচাঁপা!
কিন্তু আসমা বেগম যেন নিশীথের কথা বিশ্বাস করলেন না। ঘুমন্ত ছেলের উষ্কখুষ্ক আবরণ, এলোমেলো চুল দেখে মায়ের মন সন্দেহের সুরে বললো,
দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৬৮ (২)
—নিশান কি আসলেই টায়ার্ড ছিলো নাকি অন্য কিছু হয়েছিলো? আমার ওকে কেন জানি ঠিক লাগছেনা!
নিশীথ তাড়া দিয়ে বলে,
—অতকিছু তো জানিনা, মা। যাই হোক এখন তাড়াতাড়ি বাসায় চলো। রাস্তায় দাঁড়িয়েই সব কথা বলবে নাকি আজব!
ওরা দুজন পেছনে বসতেই নিশীথ ড্রাইভিং এ বসে গাড়ি স্টার্ট করলো। বাসায় যাওয়ার পথে মনে মনে ভাবলো, এ যাত্রায় তো নিশানকে ও কোনোমতে বাচিয়ে দিলো কিন্তু মা-বাবা এ ব্যাপারে জানলে কি হবে? আর নিশানের মদ্যপানের অভ্যাস শুরুই বা হয়েছে কবে থেকে? এভাবে নেশাতুর হয়ে রাস্তায় ঝামেলা করে কবে যে কি বিপদে পড়ে কে জানে! অতএব, নিশানের জ্ঞান ফিরলেই ওর সাথে এ ব্যাপারে সরাসরি আলাপ করতে হবে! বিদেশে যেয়ে ভাইয়ের জীবনে আরও কি কি পরিবর্তন এসেছে সবটাই ওর সোজাসুজি জানতে হবে!