দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৮০

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৮০
তাসফিয়া হাসান তুরফা

নিশীথ বাবার রুমের সামনে যেয়ে দুইবার নক করে দরজায়। আয়মান সাহেব চশমা চোখে ফোনে কিছু দেখছিলেন। দরজায় আওয়াজ শুনে ওদিকে না তাকিয়েই বললেন,
—ভেতরে এসো।
নিশীথ ভেতরে ঢুকলেও আয়মান সাহেব এখনো ফোন থেকে চোখ সরাননি। তাই সে বললো,
—ডেকেছিলেন নাকি! কোনো কাজ ছিলো?
এবার আয়মান সাহেব ফোন থেকে চোখ সরিয়ে ছেলের দিকে তাকালেন। রসিকতার সুরে বললেন,
—কেন কাজ ছাড়া কি আমি নিজের ছেলেকে ডাকতে পারিনা?
নিশীথ ইষৎ হাসলো। ওর হাসির ভাজে আয়মান সাহেব বেদনার ছাপ খুজে পেলেন। নিশীথ মৃদু কণ্ঠে বললো,
—আসলে কাজ ছাড়া আপনার সাথে কথা বলার অভ্যাস নেই তো তাই জিজ্ঞেস করলাম আর কি!
নিশীথের কথায় আয়মান বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, যার আওয়াজ নিশীথের কানে এলো। আয়মান সাহেব বললেন,

—মানুষ চাইলেই অভ্যাস বদলানো যায়
—তবে কি আপনি চাইছেন এ অভ্যেস বদলাতে?
—যদি বল হ্যাঁ, তবে কি তুকি রাজি হবে?
আয়মান সাহেব আগ্রহী চোখে শুধালেন। নিশীথ হাসলো। সারাজীবন ও ভেবেছে, কবে এ মুহুর্ত আসবে! কবে বাবা নিজে থেকে ওর সাথে এভাবে কথা বলবে! অথচ আজকে যখন এ মুহুর্ত এলো তখন ও খেয়াল করলো ওর চেতনা অসাড় হয়ে গেছে। নিশীথ বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকলো। আয়মান সাহেব ছেলের দিকে মনোযোগ দিয়ে ভাবলেন, কিসের এত চিন্তা করছে নিশীথ? কিসের এত দ্বিধা ওর মধ্যে? এবারও কি তবে বাপ-ছেলের মধ্যেকার দূরত্ব ঘুচবেনা?
নিশীথ কিছু এক ভেবে বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

—আপনার সাথে আমার এ দূরত্বের সূচনা কিন্তু এমনি এমনি না। আমাদের দূরত্বের পেছনে দুজন মানুষ সূক্ষ্মভাবে জড়িয়ে আপনি কি তা জানেন না?
আয়মান সাহেব ছোট একটা ঢোক গিললেন। বল্লেন,
—দোলনচাঁপাকে নিয়ে আমার এখন আর কোন অভিযোগ নাই। আজকে তো সবার সামনে ওকে নিজের মেয়ে বলে স্বীকৃতি দিয়েছি। তোমার কি একবারও মনে হয়েছে ওটা আমি মিথ্যা বলেছি? আমি মন থেকে না মেনে নিলে কখনোই এমন কথা বলার মানুষ না। এটা তোমার খুব ভালো করেই জানার কথা।
নিশীথ আয়মান সাহেবের দিকে তাকালো। ও জানে, তিনি যা বলছেন তা সঠিক। এতে বিন্দুমাত্র ভুল নেই। কিন্তু তিনি কি বুঝলেন না নিশীথ ঠিক কার কথা ইংগিত করছে? নাকি বুঝেও না বুঝার ভান করলেন? নিশীথ বাবাকে থামিয়ে বলে,

—আমি একবারও বলিনি যে আমি আপনার কথা বিশ্বাস করিনা। দোলনচাঁপাকে আপনি মেনে নিয়েছেন খুব ভালো কথা, এটা নিয়ে আমরা পরে আলাপ করছি। আগে আসল ব্যাপারে কথা বলি
—মানে?
আয়মান সাহেব সব বুঝেও অবুঝের মতো প্রশ্ন করলেন। নিশীথ ঠান্ডা মাথায় বললো,
—আপনার আমার সম্পর্ক খারাপ হয়েছেই মূলত একটা মানুষকে কেন্দ্র করে। সেটা হলো আমার মা। দোলনচাঁপা তো অনেক পরে এসেছে আমাদের জীবনে। তাই শুধু ওকে মেনে নিলে আমার আপনার সম্পর্ক পুরোপুরি ভালো হবেনা। যতদিন না আমার মায়ের সাথে আপনার ব্যবহার স্বাভাবিক হয় আমাদের মধ্যে সম্পর্ক এমনই থাকবে!
আয়মান সাহেব মনে মনে ভয় পেলেন। তিনি কিভাবে বলবেন ছেলেকে নিজের অতীতের কথা, আসমাকে শুরুতে কেন মেনে নিতে পারেননি সে কথা! সবকিছু কি চাইলেও ছেলেকে বলা যায়? একটা চক্ষুলজ্জার তো ব্যাপার আছে তাইনা! আয়মান সাহেব ভীষণ ইতস্তত বোধ করলেন। নিশীথ বললো,

—কিছু বলতে চাইছেন?
আয়মান সাহেব হ্যাঁ বোধক মাথা নেড়ে আবার না বোধক মাথা নাড়লেন। তবুও নিশ্চুপ রইলেন। নিশীথ বাবার ইতস্ততবোধ বেশ ভালো করেই খেয়াল করলো। উনি কেন ওকে বলতে লজ্জা পাচ্ছেন তা বেশ ভালোভাবেই বুঝলো। বাবাকে সহজ করতে নিশীথ এবার নরম গলায় বললো,
— জানি আমাদের মাঝে দীর্ঘ সময় যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার কারণে আমাদের সম্পর্কে এক সমুদ্র দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে।
নিশীথ থামলো। আয়মান সাহেব ওর কথা শুনে এক দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। নিশীথ একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে বললো,
—কিন্তু মানুষ চাইলেই সমুদ্র পাড়ি দেওয়া যায়। একটু সময় লাগবে স্বাভাবিক, কিন্তু অসম্ভব বলে কিছুই নয়!
আয়মান সাহেব চট করে ছেলের দিকে তাকালেন। তার মাথায় রেডিও-র মতো বাজতে লাগলো নিশীথের কথা,
“মানুষ চাইলেই সমুদ্র পাড়ি দেওয়া যায়”

আসলেই কি তাই? আয়মান সাহেব ভাবলেন। এতবছর তিনি নিশীথকে শুধু অবজ্ঞা করেই গেছেন, এমনটা করার পেছনে তার ইগো ব্যতীত কোনো প্রকৃত কারণ ছিলো কিনা তার মনে পড়েনা। বাবা হিসেবে তিনি চাইলেই ছেলেকে বুকে টেনে সম্পর্ক ভালো করতে পারতেন। কিন্তু তিনি করেননি। সোজাসাপটা কারণটা হলো তিনি চাননি এটা করতে। আজ হঠাৎ নিশীথের কথায় তার মন চাইলো ছেলেকে বুকে জড়িয়ে নিতে, এতবছরের মান-অভিমান সব ভুলে যেতে। আয়মান সাহেবের খুব ইচ্ছে করলো নিশীথকে বুকে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু তিনি পারলেন না। এতবছরের সংকোচ বোধ তাকে না চাইতেও আটকে দিলো। আয়মান সাহেব কাপা হাত বাড়িয়ে ছেলের পানে চেয়ে বললেন,
—আমি কি তোকে একবার জড়িয়ে ধরতে পারি, বাবা?

নিশীথ বিস্মিত হলো। ঠিক কত বছর পর বাবার থেকে এমন মমতা মেশানো কথা শুনছে ও মনে করতে পারলোনা। সাধারণত বাবার সাথে ছেলেদের মায়া-মমতার কথা খুব একটা হয়ও না। কিন্তু ওর সাথে তো স্বাভাবিক কথাও হতোনা। তাই নিশীথ খুব বেশি সময় নিলোনা। শুধু স্মিত হেসে বললো,
—আপনি মন থেকে দূরত্ব মিটাতে চাইছেন তো?
এবার আয়মান সাহেব আর ছেলের জন্য অপেক্ষা করলেন না। বরং নিজেই এগিয়ে এসে বুকে টেনে নিলেন ছেলেকে। এতবছর পর বাবাকে জড়িয়ে ধরে নিশীথ উপলব্ধি করলো, ওর এমন এক অনুভূতি হলো যে অনুভূতির স্বাদ ও বহু বছরখানেক আগে হারিয়ে ফেলেছিলো। ছোটবাচ্চা সারাদিন পর মাকে জড়িয়ে ধরলে যেমন অনুভব করলে এই বয়সে এসেও নিশীথ এর নিজেকে সেই ছোট্ট বালকই মনে হলো! আয়মান সাহেব ওকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
—আমি জীবনে বরাবরই মানুষ চিনতে ভুল করেছি, নিশীথ। সেটা জোয়ানকালে হোক কিংবা এই বুড়ো বয়সে, এত বছরের অভিজ্ঞতাও আমাকে মানুষ চেনাতে পারলোনা।
আয়মান সাহেব দম নিয়ে বললেন,

—আমি জানি আমার প্রতি তোর মনে অনেক ক্ষোভ। আসমার মনেও আছে হয়তো। থাকাটাই স্বাভাবিক। আমার মতো মানুষের প্রতি কারও ক্ষোভ না থাকাটাই বরং অস্বাভাবিক হবে। কিন্তু আমার এমন আচরণের পেছনেও একটা কারণ ছিল।
নিশীথ কোনো কথা বললোনা। বাবাকে সময় দিলো শুধু। আজকে উনি বলবে নিশীথ সব শুনবে। আয়মান সাহেব আবারো বললেন,

—তোর বয়সে থাকতে আমিও প্রেমে পড়েছিলাম। ঠিক তোর মতোই পাগল ছিলাম। এজন্যই তোকে দেখে আমার ভয় হতো। সবসময় ভাবতাম, আমি যে ভুল করেছি সে ভুল তুই করতে যাচ্ছিস না তো! কিন্তু অনেকটা পরে এসে আমি একদিন উপলব্ধি করতে পারলাম তোর আমার মাঝে সবচেয়ে বড় পার্থক্য ছিলো মানুষ নির্বাচন করায়। তুই দোলনচাঁপার সরল মন দেখে তাকে ভালোবেসেছিলি আর আমি শুধুই বাহ্যিক রুপে মুগ্ধ হয়ে প্রেমে পাগল হয়েছিলাম। আমি ভুলে গিয়েছিলাম সৌন্দর্য স্বল্প দিনের হলেও মানসিকতা সারাজীবনের হয়। আমি সঠিক জীবনসঙ্গী বাছাই করতে ব্যর্থ হলেও তুই পুরোপুরি সফল হয়েছিস! আজ আমি নিজে তোকে বলছি, দোলনচাঁপাকে পাওয়া তোর সৌভাগ্য।

নিশীথ যতটা না খুশি হলো তার চেয়েও দ্বিগুণ অবাক হলো। ও কি কখনো কল্পনা করেছিলো এমন দিন আসবে? যেদিন বাবা নিজে থেকে ওর দোলনচাঁপার প্রশংসা করবে? আজ সেদিন এসেছে! নিশীথ শক্ত করে বাবাকে জড়িতে ধরতেই রুমের দরজায় জোরে জোরে টোকা পড়লো। নিশীথ বাবাকে ছেড়ে রুমের দরজা খুলে দিতেই কাজের মেয়ে রিমা দৌড়ে এসে বললো,
—ছোট ভাইজান, খালাম্মা ডাকছে আপনারে।
—কোনো ইম্পর্ট্যান্ট কাজ ছিল? একটু পরে গেলে হবেনা?

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৭৯

নিশীথ এ মুহুর্তে যেতে চাচ্ছিলোনা। বাবার সাথে এমন মুহুর্ত জীবনে কতবারই বা এসেছে? কিন্তু কাজের মেয়ের কথা শুনে ও এক মুহুর্ত রুমে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলোনা। রিমা বললো,
—ছোট ভাবী বেহুশ হইয়া গেছে। খালাম্মা চিল্লাচ্ছে। আপনারে জলদি আইতে কইলো!
সাথে সাথে নিশীথের খেয়ালে এলো, কাল রাতেও তো দোলনচাঁপার তো অনেক জ্বর ছিলো। ওর কি শরীর খুব বেশি খারাপ হয়ে গেলো? নিশীথ কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা ছুটে গেলো নিজ রুমে। ও খেয়াল না করলেও ওর পেছন পেছন ছুটে গেলেন আয়মান সাহেব নিজেও!

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৮১