দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৮১

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৮১
তাসফিয়া হাসান তুরফা

ডাক্তার এসেছে অনেকক্ষণ। দোলনচাঁপার চিন্তায় বিভোর হয়ে নিশীথ বাড়িতেই ডাক্তার এনেছে। আপাতত ও দোলাকে কোথাও নেওয়ার প্যারা দিতে চাচ্ছেনা। ডাক্তার দোলার পার্লস চেক করে কিছুক্ষণ পর নিশীথকে বলে,
—আপনার ওয়াইফ তো বেশ দূর্বল। উনার প্রেসার ভীষণ লো। নিজের যত্ন নেয়না বুঝি একদমি?
নিশীথ আড়চোখে বিছানায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখা দোলার দিকে তাকালো। মেয়েটার ক’দিন ধরেই জ্বর। নিশীথ চাইলেও এবার ঠিকমতো ওর খেয়াল রাখতে পারেনি। নিশানের ঝামেলার কারণে মানসিক ভাবে ও বেশ পেরেশানিত্র ছিলো। সবমিলিয়ে আগের মতো দোলনচাঁপার যত্ন নেওয়ারও সুযোগ হয়নি। নিশীথের রাগ হয় নিজের উপর!
ও ডাক্তারকে বলে,

—কিছুদিন ধরে আমরা বেশ ঝামেলায় ছিলাম তো এজন্য এমন অবহেলা। তবে এমনটা আর হবেনা। আপনি আমায় বলুন ওকে দ্রুত সুস্থ করতে কি কি করতে হবে?
নিশীথের চিন্তা দেখে ভদ্রলোক হাসলেন। উনার এতবছরের অভিজ্ঞতায় এমন কম ছেলেই তিনি দেখেছেন যারা বউয়ের সামান্য জ্বরে এমন চিন্তিত হয়। বেশিরভাগই হয় বিরক্ত হয় নয়তো কোন ওষুধ খেলে দ্রুত সেড়ে যাবে তা দিতে বলে। তবে নিশীথ এক্ষেত্রে ভালোই সচেতন। ডাক্তার ভদ্রলোক একবার চোখ বুজে থাকা দোলার দিক চেয়ে নিশীথকে কাছে ডাকলেন। ও এগোতেই নিচু স্বরে বললেন,
—তোমার বউকে হাসপাতালে নিয়ে যেয়ো তো একবার।
—কেন? ও কি এতটাই অসুস্থ?
নিশীথ আঁতকে উঠে! ডাক্তার বিরক্ত হয়ে বলেন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

—আরে ইয়াং ম্যান, এত বোকা হলে হবে? তুমি কি বুঝোনি আমি কি মিন করছি?
ডাক্তার দুষ্টু হেসে বললেন। নিশীথ কিছুক্ষণ তার দিকে চেয়ে উপলব্ধি করলো ওনি কি বলছে! বিষয়টা মাথায় ঢুকার সাথে সাথে মুহুর্তেই ওর হার্টবিট বেড়ে গেলো! বুকের মাঝে ধক করে উঠলো। অজানা খুশির স্রোত ওকে ভাসিয়ে নেওয়ার আগেই ও নিজেকে সামলে নিলো। ডাক্তার ওর পিঠ চাপড়ে দিয়ে বিদাই নিলেন। নিশীথ তড়িৎ গতিতে দোলার কাছে গিয়ে বললো,
—জলদি উঠে রেডি হও। আমাদের হসপিটাল যেতে হবে।
দোলা বিস্মিত হলো। একটু আগেই যে মানুষ ওকে শুয়ে না থাকার জন্য বকা দিচ্ছিলো সে কিনা এখন তাড়াতাড়ি রেডি হতে বলছে? আবার হসপিটাল কেন? ও কি এত বেশি অসুস্থ বলো হঠাৎ করে? দোলা মনে মনে ঘাবড়ে গেলো। তবু দেরি না করে যত দ্রুত সম্ভব রেডি হয়ে নিশীথের সাথে রওনা হলো।

গাইনি ডাক্তারের রুম থেকে মাত্রই বেরিয়েছে দুজনে। নিশীথের পাশাপাশি দোলার চোখ দুটোও ছলছল করছে। খুশির চোটে চোখে ঘোলা দেখছে মেয়েটা। নিজের অজান্তেই দোলার বাম হাত ওর পেটের উপর গেলো। মুহুর্তেই ওর হাতের উপর নিশীথ হাত রাখলো। দোলা পলক ঝাপ্টে পাশ ফিরে চাইলো। নিশীথের চোখ দুটোও ঠিক ওরই মতো টলমলে। ঠিক ক’দিন আগেও ওদের জীবনে কতই না কষ্ট ছিলো, অথচ আজ-কালের ব্যবধানে একই দিনে ওর জীবনে একসাথে এত বড় দুটো খুশির খবর আসবে ওরা দুজন কি আদৌ কখনো কল্পনা করেছিলো? মা-বাবা হওয়ার ছোট্ট একটা খবর যে মানুষের জীবনে এত বড় আবেগ সৃষ্টি করতে সক্ষম ওরা কি তা জানতো?
দোলা নিভু গলায় শুধালো,

—আমি কি স্বপ্ন দেখছি, নিশীথ?
নিশীথ চোখে পানি নিয়েও হাসে। আশেপাশের কারও তোয়াক্কা না করে দোলাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায় কপালে। পরম আদরে আগলে নিয়ে বলে,
—এটা স্বপ্ন নয়, দোলনচাঁপা। এটাই বাস্তবতা। মধুর মতো মিষ্টি বাস্তবতা!
—বিশ্বাস করুন, আল্লাহ যে হঠাৎ একসাথে আমাদের এত সুখ দিবে আমি কল্পনাও করিনি, নিশীথ!
নিশীথ আস্তেধীরে দোলাকে আলিংগন থেকে ছেড়ে দেয়। হসপিটালের জানলা দিয়ে দেখা যাওয়া এক টুকরো নীলচে আকাশের পানে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,

—আমাদের কল্পনার সীমা ভীষণ ছোট, দোলনচাঁপা। আল্লাহর মহিমা ভীষণ বড়। আমাদের কল্পনা যেখানে শেষ হয়, উনার রহমত সেখান থেকে শুরু হয়!
নিশীথের কথাগুলো দোলনচাঁপার খুব ভালো লাগলো। ইদানীং ও খেয়াল করেছে নিশীথ ধর্ম সম্পর্কে ভালোই জ্ঞান আরোহন করছে। নামাজ-কালামেও ভালোই মনোযোগী হয়েছে। বিয়ের প্রথম প্রথম দোলা ওর অমনোযোগীতা দেখে ভীষণ রাগ করতো তবে এখন আর প্রয়োজন মনে করেনা। ওর সাথে থেকে নিশীথ নিজে থেকেই যেন বদলে গিয়েছে! দোলা মনে মনে মহান সৃষ্টিকর্তার প্রশংসা করে নেয় ওদের জীবনে একে একে ভালো জিনিস নিয়ে আসার জন্য।

গাড়িতে উঠার পর সিটবেল্ট লাগানোর সময় নিশীথ হঠাৎ দোলার দিকে ঝুকে আসে। আচমকা এই আচরণে মেয়েটা চমকে উঠে। নিশীথ চোখের পলকে ওর ঠোঁটে চুমু একে বলে,
—আমার জীবনের সবচেয়ে বড় খুশির আগমন ঘটানোর জন্য তোমায় ধন্যবাদ, দোলনচাঁপা। আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবোনা এ মুহুর্তে আমি কেমন ফিল করছি!
দোলনচাঁপা লাজুক মুখে মুচকি হাসলো শুধু। লজ্জায় কথা বলার কিছু পেলোনা! অতঃপর দুজন কাউকে কিছু না জানিয়েই বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হয়।

দোলার মা, পারভীন বেগম জামাইয়ের তরফ থেকে ফোন পাওয়া মাত্রই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে ছুটে এসেছেন তালুকদার ভবনে। নিশীথ সচারাচর তাকে এভাবে জরুরি কাজের জন্য আসতে বলেনা, আজকে ইমার্জেন্সি তে বাসায় আসতে বলেছে মানে নিশ্চিত কোনো বড়সড় ঝামেলা হয়েছে। উনার মন সকাল থেকেই ছটফট করছে। তিনি জানতেন মেয়ের জ্বর, কিন্তু তাই বলে কি মেয়ের অবস্থা এত বেশিই খারাপ হলো যে জামাই এভাবে ফোন করে ডেকে পাঠালো? তাও কিনা আবার তাদের পুরাতন বাসায়, যেখানে ওরা বিশেষ কোনো প্রয়োজন ছাড়া যায়না! পারভীন বেগম নিশীথের এক ফোনকল পেয়ে সবকিছু ফেলে রেখে শিমুল কামিনিকে নিয়ে ছুটলেন। যেয়ে দেখলেন তালুকদার ভবনে যেন সালিশ বসেছে। দাদু থেকে শুরু করে আয়মান সাহেব আসমা বেগম, নিশীথের চাচা-চাচি ওরা সবাই একছাদের নিচে অপেক্ষমান। সবারই চোখেমুখে চিন্তার ছাপ। স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে ওরা সবাই একিরকম সন্দিহান। কেউই কিছু জানেনা। সবার মাঝে ধৈর্যের বাধ ভেঙে দিয়ে আয়মান সাহেব বললেন,

—এগুলো কেমন কথা, নিশীথ? এতক্ষণ ধরে সবাই ওয়েট করছে কিন্তু তুমি এখনো বলছোনা ব্যাপার কি? সবাই চিন্তা করছে দোলনচাঁপার জন্য!
— দোলনচাঁপার অবস্থা ভীষণ সিরিয়াস।
নিশীথ বেশ গম্ভীর মুখে বললো। পারভীন বেগম এবার ভীষণ ভয় পেয়ে গেলেন। একেতো অল্প বয়সে স্বামীকে হারিয়ে তিনি কষ্টে তিন সন্তানকে মানুষ করেছেন তার মাঝে দোলনচাঁপার কিছু হলে উনি কি করবেন! দোলা মায়ের চেহারার দিকে তাকাল, তার ভেতরে চলমান ঘুর্নিঝড় স্পষ্ট টের পেলো। ও নিশীথের দিকে বিরক্তিকর দৃষ্টিতে চেয়ে চাপাস্বরে বললো,

—এভাবে বলছেন কেন? মা খুব টেনশন করছে। প্লিজ জলদি বলুন। এমন করার কি মানে হয়?
নিশীথ দোলার কথায় তোয়াক্কা না করে বললো,
—ওর অবস্থা এতটাই সিরিয়াস যে প্রতি মাসে মাসে ওকে হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে। ওর খাওয়াদাওয়ার দিকেও ডক্টর স্ট্রিক্টলি নির্দেশনা দিয়েছে।
—কি হয়েছে আমার দোলার? খুলে বলো, বাবা। না হলে এখন আমিই হার্ট অ্যাটাক করবো!
পারভীন বেগম কাপা গলায় বললেন। এবার শাশুড়ির কথায় নিশীথের একটু মায়া হলো। ও আর দুষ্টুমি না করে মৃদু হেসে বললো,

—আপনার মেয়ের বিশেষ যত্ন নিতে হবে এখন থেকে, মা। দুই বংশেই প্রথম নাতি আসছে। কেয়ারটাও স্পেশাল ভাবে নিতে হবে!
নিশীথের কথায় মুহুর্তেই রুমে থাকা প্রত্যেকটা মানুষের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে যায়। দুশ্চিন্তার ঘন মেঘ কেটে সেখানে খুশির রোদ ঝলমলিয়ে উঠে! সাথে সাথে সবাই দোলনচাঁপাকে ঘিরে উল্লাসে মেতে উঠে। শুধুমাত্র আয়মান সাহেব হঠাৎ রুম থেকে চলে যান। তা দেখে নিশীথ একটু বিচলিত হয়। বাবার কি হলো আবার? পরক্ষণেই সকলের মাঝে ও বাবার কথা ভুলে যায়। সবাই যখন দোলাকে অভিনন্দন জানাতে ব্যস্ত তখন রুমে আয়মান সাহেব এলেন একটি খাম হাতে। সকলের মনোযোগ তার দিকে গেলো। আয়মান সাহেব খামটা দোলার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৮০

—এত বড় সুসংবাদ দিলে মা, আমি খালি হাতে শুভকামনা জানাতে পারলাম না। এতটা আনন্দের খবর শেষ কবে শুনেছিলাম আমার মনেও নেই!
উনি দোলার মাথায় হাত রেখে বললেন। সবার এত ভালোবাসা পেয়ে আজ দোলার মনে হলো এ পরিবারে যেন কখনোই কোনো দূরত্ব ছিলোনা। যেন সবকিছু আগে থেকেই ঠিক ছিলো। নয়তো সবাই একসাথে এভাবে আনন্দের মুহুর্ত উদযাপন করে?

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৮২