দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৮৩

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৮৩
তাসফিয়া হাসান তুরফা

একটা বাসায় যখন নতুন মেহমান আগমনের সুখবর আসে তখন ও বাড়ির মানুষ ও পরিবেশ দুটোই বদলে যায়। ঠিক তেমনি হয়েছে তালুকদার ভবনে দোলনচাঁপা আসার পর থেকে, মূলত ও প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর থেকে। যে যেভাবে পারছে ওর জন্য কিছু না কিছু করছে। বিগত কয় মাস ধরে আয়মান সাহেব প্রতিদিনই সকালে হাটতে যাওয়ার সময় আসার পথে ফলমূল কিছু একটা নিয়ে আসবেনই বউমার জন্য। আসমা প্রায়ই এটাসেটা রান্না করে খাওয়াচ্ছে, দোলাকে সময় দিচ্ছে গল্প করছে।

দাদু কি কি দোয়া পড়তে হবে নজর থেকে বাচতে এসব শিখিয়ে দিচ্ছেন আর নিশীথ, সে তো আছেই সদা দোলনচাঁপার পেছনে বটগাছের ছায়া হয়ে। ওর ভুমিকার কথা নতুন করে আর বলার প্রয়োজন রাখেনা। বেশ আরাম-আয়েশ করেই দোলার দিনগুলি কাটছিলো। বিয়ের পর মেয়েরা শশুড়বারি থেকে যেরুপ যত্ন আশা করে, আগে তা না পেলেও এখন সুদে আসলে সব ফেরত পাচ্ছে যেন! এমনকি নিশীথও বাসার সবাইকে এভাবে দোলার খেয়াল রাখতে দেখে বেশ স্বস্তি অনুভব করে। আসলেই এ সময় ও বাসায় একা দোলাকে নিয়ে থাকলে ও সারাদিন চিন্তায় পাগল হয়ে যেতো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বাবা জিদ করে ওদের এ বাসায় রেখে ভালোই করেছেন ওদের জন্য। ইদানীং অফিস থেকে ফিরে ও আবার আগেকার মতো ছেলেদের সাথে আড্ডায় যোগ দেয়। যেটা ভাড়া বাসায় দোলা একা থাকায় আগে পারতোনা। সবমিলিয়ে নিশীথের কাছেও জীবনটা বেশ উপভোগ্য লাগে আজকাল। আকাশ, কবির, তূর্য, অর্কদের সাথে পুরনো দিনের স্মৃতি চারণের পাশাপাশি নতুন জীবন নিয়েও বেশ গভীর আলোচনা হতে লাগলো। নতুন নতুন বাবা হতে চলা নিশীথ নিজের যে সকল অনুভূতির কথা আর কাউকে বলতে পারে না ওগুলো নিজের ছেলেপুলেদের কাছে অনায়াসে বলে দেয়। এই যেমন আজকের আড্ডায় একটু আগে ও বললো,

—তোদের কি মনে হয়? আমার ছেলে হবে নাকি মেয়ে হবে? বল তো সবাই দেখি
—কেন ভাই? যারটা ঠিক হবে তাকে খাওয়াবে নাকি বাবু হওয়ার পরে?
আকাশ দুষ্টুমির সুরে বলে। খাওয়ার কথা শুনে বাকি ছেলেরাও হইহই করে উঠলো। নিশীথের কাছে থেকে খাওয়া পাওয়া ওদের কাছে বিশাল ব্যাপার। খরচের ব্যাপারে নিশীথ বিন্দুমাত্র কৃপণ নয় তাই ও খাওয়ালে মনমতো পেটপুজো করা যায়। নিশীথ হেসে বললো,
—খাওয়াতেই পারি! এভাবেও অনেকদিন তোদের কিছু খাওয়াইনা। তোরা শুধু দোয়া কর সুস্থভাবে আমার বাচ্চা দুনিয়ায় আসুক আর আমার দোলনচাঁপা ভালো থাকুক।
—তা তো অবশ্যই করবো, ভাই। তবে জানো আমার কেন জানি মনে হয় তোমার একটা ফুটফুটে মেয়ে হবে!
তূর্য বললো। পাশ থেকে কবির ফোড়ন কেটে বললো,

—আরে নাহ। ভাইয়ের ছেলে হবে দেখিস তোরা। আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আর ও হবে আমাদের গ্যাং এর সবচেয়ে ছোট সদস্য!
কবিরের কথায় নিশীথ সহ বাকি ছেলেরাও হেসে দিলো। নিশীথ হাসতে হাসতে বললো,
—কথাটা কিন্তু ভালোই বলেছিস। তবে আমি চাই আমার মেয়ে হোক, ঠিক আমার দোলনচাঁপার মতোন। যাকে দেখলেই আমার অন্তর প্রশান্তিতে ভরে যাবে।
—তাহলে আমাদের গ্যাং এর নতুন মেম্বার মিস হয়ে গেলো?
আকাশ হতাশ মুখে শুধায়। নিশীথ চোখ পাকিয়ে বলে,
—আল্লাহ চাইলে সবই হবে! এবার মেয়ে হলেও বা কি? আমি আছি তো। তোদের গ্যাং এর নতুন মেম্বার আনার দায়িত্ব আমার!

নিশীথ এর কথায় হো হো করে হেসে উঠলো সব। টং এর দোকানটায় যেন হাসির রোল পড়ে গেলো! নিশীথ সিগারেট খাওয়া বাদ দিয়েছে বেশ আগেই। দোলা প্রেগন্যান্ট হবার পর থেকে আরও সতর্ক থাকে বাইরে কি খাচ্ছে না খাচ্ছে সেসব ব্যাপারে। সামান্য তম অসুবিধাও যাতে দোলনচাঁপার ফেস করতে না হয় ও ব্যাপারে সদা তৎপর থাকে! সে যাই হোক, রাতে ছেলেপুলেদের সাথে কথাবার্তা শেষে নিশীথ যতক্ষণে বাড়ি ফিরলো ততক্ষণে সবার ডিনার শেষ। নিশীথ দোলার সন্ধানে রুমে ঢুকলো। দেখলো মেয়েটা এসি ফুল টেম্পারেচার অন করে শুয়ে আছে কাথা গায়ে দিয়ে। নিশীথ একটু অবাক হলো। এত তাড়াতাড়ি দোলা ঘুমিয়ে গেছে? ওর আসার অপেক্ষাও করলোনা? নাকি শরীর খারাপ হলো বুঝি!
নিশীথ হাত মুখ ধুয়ে এসে খাটের কাছে এগিয়ে যায়। দোলার মাথায় হাত রাখত্রি ও চোখ মেলে তাকায়। নিশীথ শুধায়,

—ঘুমাওনি?
দোলা মাথা নাড়ে না-বোধক ভাবে। নিশীথ চিন্তিত সুরে বলে,
—শরীর খারাপ লাগছে? গরম লাগছে খুব?
—ইদানিং গরমটা একটু বেশিই লাগে। বলেছিলাম তো আপনাকে।
নিশীথের মনে পড়ে দোলা ক’দিন আগেও বলছিলো ওর গরম লাগার কথা। অকারণেই হঠাৎ হঠাৎ শরীর ঘেমে ভিজে যায়, সাথে মাথা ঘুরানো তো আছেই। নিশীথ ভয়ে ছিলো এমন হওয়ায় পরে মা বলেছে এটা নাকি এ অবস্থায় নর্মাল। নিশীথ ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে বলে,
—কি খেয়েছো রাতে?
দোলা জবাব দেয়না। নিশীথ আবার শুধায়। দোলা আস্তে করে বলে,

—খাইনি
—কেন?
রিমি তো বললো বাসার সবার খাওয়া শেষ। দোলা মাথা নেড়ে বললো,
—সবাই খেয়েছে তো। আমি বাদে
—আশ্চর্য! তুমি খাওনি কেন?
—আপনার জন্য ওয়েট করছিলাম।
—এটা কেমন কথা, দোলনচাঁপা? এতক্ষণ হয়ে গেছে তুমি না খেয়ে বসে আছো আর সবাই খেয়েও নিলো তোমাকে রেখে? মার সাথে কথা বলতে হবে তো দেখি…
নিশীথকে রেগে যেতে দেখে দোলা উঠে বসে শোয়া থেকে। ওর হাত ধরে বলে,
—মা অনেকবার সেধেছিল খাওয়ার জন্য আমিই শুনিনি কথা। কাউকে কিচ্ছু বলবেন না খবরদার!
নিশীথ ভ্রু কুচকে বললো,
—আলবত বলবো। তোমাকেই বলবো এখন। কোন হিসেবে তুমি না খেয়ে বসে আছো? আমার বাচ্চাকে ক্ষুধার্ত রাখার সাহস কোথায় পেলে তুমি?
দোলা হাসে নিশীথের কথায়। বাচ্চা না আসতেই নিশীথের যত অধিকারবোধ, বাচ্চা দুনিয়ায় আসার পর যে কি হবে কে জানে! ও হেসে বলে,

—আপনার বাচ্চাটা তার বাবাকে ছাড়া খাবেনা তাই অপেক্ষা করছিল বাবার জন্য! আপনি কি তাকে খাইয়ে দিবেন নিজ হাতে?
দোলার আহ্লাদী কথায় নিশীথ গলে যায়। আর বাক্য ব্যয় না করে দ্রুত রুম থেকে প্রস্থান করে। মিনিট পাঁচেকের মাঝে গরম গরম ভাত ও সব্জি তরকারি নিয়ে আসে দোলার জন্য। ভাত মাখিয়ে দোলাকে খাইয়ে দিতে দিতে লক্ষ্য করে ওর বউটাকে মনোযোগ দিয়ে। দোলার এখন ছয় মাস শুরু হয়েছে। প্রেগ্ন্যাসির প্রথম তিন মাসেও যথেষ্ট শুকনো ছিলো দোলা অথচ এখন যত শেষের দিকে যাচ্ছে ওকে অনেকটাই গোলুমোলু লাগছে। নাকটা ফুলে গেছে ভালোই। নিশীথের কাছে বেশ কিউট লাগছে ব্যাপারটা। দোলনচাঁপার মাঝে কি যেন আছে, ও যখন যেরুপেই থাকেনা কেন নিশীথের সবসময় ওকে দেখতে ভালো লাগে। এইযে কিছু মাস আগেও শুকনো কেন এটা নিয়ে অভিযোগ করা দোলনচাঁপা এখন নাদুসনুদুস হয়ে অভিযোগ করছে, অথচ নিশীথের কাছে ওকে এই রুপেও ভীষণ আবেদনময়ী লাগছে। এটা কি শুধু ওর একার ক্ষেত্রেই হচ্ছে নাকি দুনিয়ার বাকি প্রেমিক পুরুষের ক্ষেত্রেও একি ঘটবা ঘটে? নিশীথ মনে মনে ভাবে। খাওয়ানো শেষ করে নিশীথ হাত ধুয়ে এসে বলে,

—কাল তোমায় ডাক্তার এর কাছে নিয়ে যাবো
—হঠাৎ কাল কেন? আমার সিরিয়াল তো পরের সপ্তাহে।
—জানি। কিন্তু আমার একটা জিনিস জানতে ভীষণ ইচ্ছে করছে। আচ্ছা, তোমার কি মনে হয় দোলা আমাদের প্রথম বাচ্চা ছেলে হবে নাকি মেয়ে হবে?
—হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন?
—না, মানে আজ ছেলেদের সাথেও এ বিষয়ে কথা হলো তো। এরপর থেকেই আমার আরও তীব্র ইচ্ছা হচ্ছে জানার আমাদের ছেলে হচ্ছে নাকি মেয়ে! কালকেই ডাক্তার এর কাছে যাবো চলো!
নিশীথের অস্থিরতা দেখে দোলা কিটকিটিয়ে হাসে। দোলা বললো,
—কি হলে আপনি বেশি খুশি হবেন? ছেলে না মেয়ে?
—যেটাই হোক, হবে তো আমারই সন্তান। তবুও প্রথমটা মেয়ে হলে মন্দ হয়না!
—তাই? আমার কিন্তু মনে হচ্ছে আমাদের ছেলে হবে।
দোলা দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে বললো। নিশীথ দাত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে বললো,
—আচ্ছা সেটা কালকেই জানা যাবে!

মিনিট বিশ খানেক যাবত দুজন বসে আছে ডাক্তারের রুমের সামনে। এই রোগী বের হলেই ওরা ঢুকবে। নিশীথ দোলার হাত ধরে বসে আছে। ওরা দেখলো সামনের কাপলটা রুম থেকে বের হলো ঝগড়া করতে করতে। মেয়ে হবে দেখে স্বামী ভীষণ অখুশি। দোলা ওটা দেখলো আর ভাবলো, দুনিয়ায় এমন কত মানুষ এই যুগেও আছে যারা ছেলে-মেয়ের মাঝে এখনো তফাৎ করে। আর এদিকে নিশীথ নিজে চাচ্ছে যেন ওদের প্রথম সন্তান মেয়ে হয়। এমন স্বামী ক’জন পায়? মেয়েটার চোখের জল দেখে দোলার ভীষণ কষ্ট লাগে। এ অবস্থায় স্বামীর সাপোর্ট যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা দোলা বুঝে, ও মন থেকে মেয়েটার জন্য দোয়া করে!
ডাক্তারের রুমে ঢোকার পর দোলার আল্ট্রাসাউন্ড এর রিপোর্ট দেখে ডাক্তার হাসে। তা দেখে নিশীথ দোলা ভ্রু কুচকে তাকায় একে-অপরের দিকে। নিশীথ জিজ্ঞেস করে,

—কি হয়েছে ম্যাডাম? সব ঠিক আছে তো?
—ঠিক তো আছে। কিন্তু দোলার জন্য ঝামেলা বেড়ে গেছে!
ডাক্তারের কথায় নিশীথের শ্বাস আটকে আসে। দোলার জন্য ঝামেলা বেড়েছে মানে? ও ধুকপুক বুকে দোলার হাত চেপে ধরে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করে,
—কেমন ঝামেলা? বেবির পজিশন ঠিক নেই নাকি অন্য কিছু? দোলার কিছু হবেনা তো?
ডাক্তার এবার শব্দ করে হাসেন। বললেন,
—দোলা, তোমার স্বামী দেখি বাচ্চাদের মতো ভয় পাচ্ছে। পারবে তো একসাথে তিন বাচ্চাকে সামলাতে?
“তিন বাচ্চা” শুনে নিশীথ দোলা একসাথে চমকে উঠে। দুজন সমস্বরে চিল্লায়,
—তিন বাচ্চা মানে?
ডাক্তার এবার হাসি মুখে বলে,

—তোমার দুই বাচ্চা আর তোমার শাশুড়ির এই বাচ্চা। মোট মিলে হলোনা তিনটা বাচ্চা?
ডাক্তারের কথায় নিশীথ দোলার পেটে হাত রাখে। ওকে দেখে মনে হয় যেন ও পেটের মাঝে হাত রেখে দুই বাচ্চাকে বুঝার চেষ্টা করছে। তা দেখে দোলা বিরক্ত হলেও ডাক্তার আবারও শব্দ করে হাসেন। হাসতে হাসতেই বললেন,

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৮২ (২)

—আমার আগেও ডাউট হচ্ছিলো কিন্তু এবার রিপোর্ট এবং আল্ট্রাসাউন্ড এর ছবিগুলো দেখে শিওর হয়ে নিলাম। কংগ্রেটস মিস্টার ও মিসেস তালুকদার। আপনারা টুইন্স এর মা-বাবা হতে চলেছেন। ফার্স্ট প্রেগ্ন্যাসিতে মানুষ একটা বাচ্চা নিয়েই কাহিল হয়ে যায়। আপনাদের সামনে বেশ চ্যালেঞ্জিং সময় আসতে চলেছে। অনেক সাবধানে থাকতে হবে। ডেলিভারির সময়ও ঝামেলা হতে পারে। পারবেন তো সবকিছু সামলাতে?
ডাক্তারের কথায় দোলা নিশীথের দিকে তাকায়। নিশীথ এখনো মাটির দিক তাকিয়ে। দোলা ওর হাতের উপর হাত রাখতেই খেয়াল করলো, নিশীথের হাত কাঁপছে!

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৮৪

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here