দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৮৪
তাসফিয়া হাসান তুরফা
দোলার এখন আট মাস শুরু হয়েছে। খুব বেশিদিন বাকি নেই ডেলিভারির। প্রেগ্ন্যাসির শুরুর দিকে যে মেয়েকে দেখে বুঝাও যেতোনা ও প্রেগন্যান্ট, এখন তাকে দেখে যেকেউ বলে দিতে পারবে ও জমজ বাচ্চার মা হতে চলেছে। শরীরের তুলনায় পেটখানা বিশাল বড় হয়ে গেছে। এ কারণে ওর জন্য চলাফেরা থেকে শুরু করে সবকিছুই বেশ কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিশীথ দোলার এসব কষ্ট দেখে মনে মনে ভাবে, ভালোই হয়েছে আল্লাহ ওদের একবারেই দুটো সন্তান দিয়ে দিচ্ছেন। নয়তো দোলাকে পুনরায় এমন কষ্ট পেতে দেখার সাহস নিশীথের ছিলোনা!
এইতো সেদিন রাতের কথা, নিশীথের অফিস থেকে ফিরতে দেরি হয়েছে। শুধু দেরি বললে ভুল হবে, বেশ ভালোই দেরি হয়েছে। ও আগেভাগেই তাই ফোন দিয়ে দোলাকে জানিয়ে ওকে খেয়ে ঘুমিয়ে যেতে কড়া নির্দেশ দিয়েছে। দোলারও শরীর খুব একটা ভালো না লাগায় তাড়াতাড়িই খেয়ে শুয়ে পারেছে, নিশীথের জন্য অপেক্ষা করেনি আর। নিশীথ বাড়ি ফিরলো রাত ১২টায়। ফ্রেশ হয়ে খাওয়া সেড়ে যখন ও বিছানায় এলো ততক্ষণে দোলা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। নিশীথ মিষ্টি হেসে ওর কপালে ও পেটে চুমু একে দিলো। দোলার পেটের কাছে মাথা নুইয়ে বললো,
—এই আমার টোনা-টুনি, সারাদিন মাকে খুব জ্বালিয়েছো নাকি? হুম? পাপা কিন্তু তোমাদের ভীষণ মিস করেছে। তোমরা আমায় মিস করেছো কি?
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
নিশীথ হাত বুলিয়ে দোলার পেটে আদর করে দিলো। ঠিক ওমনি কোনো একটা বাচ্চা পেটে লাত্থি দিলো। নিশীথ মুহুর্তের জন্য থমকে গেলো। এমন নয় যে এর আগে ও এই স্পর্শ পায়নি, দোলা প্রায়ই বাচ্চারা পেটে লাত্থি দিলে ওকে মাঝেমধ্যে দেখিয়েছে। তবে এবার ওর বাচ্চা প্রথমবার ওর কথায় সাড়া দিয়েছে, দোলার কথা ছাড়া শুধুমাত্র নিশীথের ডাকে বাচ্চারা সাড়া দিলো, এ অনুভূতি নিশীথের কাছে নতুন। ওর গা জুড়ে এক অদ্ভুত শিহরণ বয়ে যায়।
“বাচ্চারা বাবার আওয়াজ চিনে গেছে!”
মনে মনে বলে আবারও মাথা নুইয়ে টুপ করে চুমু বসিয়ে দেয় দোলার পেটে। অথচ দোলা এখনো বেঘোরে ঘুমোয়। নিশীথ ও বাচ্চাদের মাঝে ঘটা এ ছোট্ট মিষ্টি কাহিনি ও জানতেও পারলোনা! নিশীথ দোলাকে একপলক দেখে ওর গায়ে কাথা টেনে নিজেও শুয়ে পড়লো পাশে। এতক্ষণে রাত ১.৩০টা বেজে গেছে কিভাবে কিভাবে! পরদিন সকালে আবার অফিস আছে। ওর একটা ভালো ঘুম লাগবে।
নিশীথের ঘুম ভাংলো দোলার ডাকে। নিশীথের ঘুম কাটছিলোই না। এত তাড়াতাড়ি সকাল হয়ে গেলো? মনে হলো কিছুক্ষণ আগেই ঘুমিয়েছে ও! তবু দোলার ডাকে সাড়া দিয়ে উঠলো। ওর দিকে তাকাতেই নিশীথের ঘুম জানলা দিয়ে পালালো। ও দেখলো দোলা কাদছে! নিশীথ ঘড়ির দিকে তাকায়, রাত বাজে ৩.৩০টা। এখন দোলা ডাকছে কেন? ওর কি লেবার পেইন উঠেছে নাকি? নিশীথ অস্থির হয়। ছটফটিয়ে জিজ্ঞেস করে,
—কি হলো, জান? কাদছো কেন? পেটে ব্যাথা উঠেছে? হসপিটাল নিয়ে যাবো?
দোলা মাথা নাড়ে না-বোধক ভাবে। নিশীথ অবাক হয়। পেট ব্যথা না হলে কাদবে কেন? তবু শুধায়,
—তবে কি হলো? কেউ কিছু বলেছে?
নিজের প্রশ্নে এবার নিশীথ নিজেই বেকুব সেজে যায়। রাত ৩.৩০টায় কে-ই বা কি বলবে? ও জিব কেটে বলে,
—আচ্ছা বাদ দেও এসব। তুমিই বলো কি হয়েছে। কেন ডাকলে? আমি শুনছি।
—আপনি রাগ করবেন না তো?
—আরে নাহ। আমি কি দোলনচাঁপার উপর রাগ করে থাকতে পারি বলো?
—আমার না ভীষণ আইসক্রিম খেতে মন চাইছে!
দোলা এবার সাহস পেয়ে কাদো কাদো সুরে বলে। নিশীথ হাসবে না কাদবে বুঝেনা। এটায় কাদার কি আছে? মেয়েদের হয়তো অদ্ভুত কোন হরমোন কাজ করে এ সময়, যার কারণে ও মাঝেমধ্যে বুঝে উঠতে পারেনা দোলার আচরণ। তবু নিশীথ হাসিমুখে বলে,
—এটায় কাদার কি আছে, বোকা মেয়ে? ফ্রিজে আইসক্রিম আছে তো! আমি সেদিন দেখেছিলাম। নিয়ে আসছি দাড়াও।
—নেই। আমি খেয়ে ফেলেছি ওটা।
দোলা এবার নিচু স্বরে বলে। নিশীথ হতাশ হয়ে তাকায় ওর বউয়ের দিকে। এখন ও আইসক্রিম কোথায় পাবে? রাত ৩.৩০টায় কে দোকান খুলে রেখেছে ওদের জন্য? নিশীথ একবার ভাবলো দোলনচাঁপাকে বুঝিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেবে। পরবর্তীতে মনে করলো, হয়তো অনেক বেশিই খেতে ইচ্ছে করছিলো দেখেই ওকে ঘুম থেকে জাগিয়েছে দোলা নয়তো কখনোই ডাকতোনা ও দেরিতে ঘুমিয়েছে জেনেও। তাই নিশীথ মানাও করতে পারলোনা দোলার ওই মাসুম মুখটার দিকে তাকিয়ে। বেশ অনেকক্ষণ ধরে নিরবে কিছু চিন্তাভাবনা করলো এ সময় আইসক্রিম কোথায় থেকে জোগাড় করা যায়। তা দেখে দোলা স্বাভাবিক হয়ে বললো,
—পাওয়া যাবেনা তাইনা? আমিও বা কেমন বোকা আপনাকে অযথা ডেকে তুলেছি। আই এম সরি, প্লিজ আবার ঘুমিয়ে পড়ুন। আমার আর খেতে ইচ্ছে করছেনা। কাল সকালেও তো অফিস আছে আপনার! আমিও শুয়ে পড়ছি।
কথাটা বলেই দোলা চুপচাপ কাথা টেনে আবার শুয়ে পড়লো। কিন্তু নিশীথ বসে রইলো। দোলা শুধালো,
—কি হয়েছে? শুয়ে পড়ুন। অত ভাবতে হবে না। আমার সত্যিই আর ইচ্ছে করছেনা।
নিশীথ কোন জবাব না দিয়ে চুপচাপ বিছানা থেকে উঠে গেলো। শার্ট গায়ে চাপিয়ে ফোন আর চাবি হাতে নিয়ে বাইরে যেতে যেতে বললো,
—আমি না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করো।
দোলা বিস্ময় নিয়ে বোকার ন্যায় চেয়ে রইলো নিশীথের যাওয়ার পানে। মিনিট বিশেক পরে নিশীথ রুমে এলো। ওর হাতে ৬-৭টার মতোন আইসক্রিম। দোলার হাতে ওগুলো ধরিয়ে দিয়ে ও শার্ট খুলছিলো এমন সময় দোলা অবাক হয়ে বললো,
—এতগুলো আইসক্রিম কে খাবে? আমি তো একটা খেতে চেয়েছিলাম।
নিশীথ স্বাভাবিক মুখেই বললো,
—প্রতিদিন তো দোকানদারকে ঘুম থেকে উঠাতে পারবোনা মাঝরাতে তাই একবারে কয়েকটা নিয়ে এলাম। এগুলো শেষ হওয়ার আগে আরও কিছু স্টক করে রাখবো।
দোলা বিস্ময় ঢেকে বললো,
—কোন দোকানদার? কোথায় পেলেন এগুলো?
—ওসব তোমার না জানলেও হবে। আইসক্রিম তো পেয়েছো এখন। এবার খেয়ে আমাকে ধন্য করো! আমার বাবুদেরও খুশি করো!
—বলুন না প্লিজ। ভীষণ জানতে ইচ্ছা করছে।
দোলার অনুরোধে এবার নিশীথ শুনালো কিভাবে ও এই মাঝরাতে আকাশদের বাসার নিচে গিয়েছিলো। প্রথমে আকাশকে ঘুম থেকে ডেকে তুলেছে ফোন দিয়ে, এরপর ওদের বাসার নিচে যে দোকানদার ভাড়া থাকে, তাকেও ঘুম ডেকে তুলেছে আকাশকে দিয়ে। এরপর উনার দোকানের ফ্রিজ থেকে এই আইসক্রিম গুলো নিয়ে বাসায় এসেছে। নিশীথের কথায় দোলার গলায় আইসক্রিম আটকে যাওয়ার উপক্রম হলো! ওর এক অতি নিছক এবং সামান্য আবদার পূরণ করতে নিশীথ এতকিছু করলো তাও এই মাঝরাতে? ভাবা যায়! দোলার চোখ দিয়ে টপটপ করে অশ্রু ঝরলো। তা দেখে নিশীথ বিরক্ত হয়ে বললো,,
—এসব কি, দোলনচাঁপা? চোখের পানি দেখবোনা বলে আইসক্রিম এনে দিলাম এত কাহিনি করে তাও তুমি আবার চোখের পানি ঝড়াচ্ছো? তুমি কি জানোনা তোমায় কাদতে দেখলে আমার কষ্ট হয়? নাকি জেনেও ইচ্ছে করে করো? আমার কষ্টের কোন মূল্যই নেই দেখছি তোমার কাছে!
দোলা ওর ভারী পেটে বহুকষ্টে উঠলো বিছানা থেকে। নিশীথ ওকে উঠতে সাহায্য করলো। এখন ওদের একে-অপরকে আলিংগন করতেও কষ্ট হয় দোলার বিশাল পেটের জন্য। তবু দোলা নিশীথকে জড়িয়ে ধরলো। নিশীথও আলতো হাতে বুকে জায়গা করে দিলো প্রিয়তমাকে। দোলা ফিসফিসিয়ে বললো,
দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৮৩
—আমার কাছে এ দুনিয়ায় আপনার মূল্য সবচেয়ে বেশি। আপনাকে কোনো কষ্টই স্পর্শ না করুক, নিশীথ। আল্লাহ আমার সবকিছুর বিনিময়ে হলেও আপনাকে ভালো রাখুক!
দোলার কথা শুনে হঠাৎ নিশীথের বুকে ধ্বক করে উঠলো। আচমকা একই মুহুর্তে দোলার পেটে কোনো একটা বাচ্চা আবার লাত্থি দিলো। কিঞ্চিৎ ব্যথায় দোলা চোখমুখ কুচকে ফেললো। দোলাকে জড়িয়ে ধরে রাখায় তা নিশীথও স্পষ্ট টের পেলো!