ধরিয়া রাখিও সোহাগে আদরে পর্ব ১৬

ধরিয়া রাখিও সোহাগে আদরে পর্ব ১৬
জেনিফা চৌধুরী

“জীবনে বাঁচতে হলে কি দ্বিতীয় বার বিয়ে করা খুব দরকার, সায়র?”
ছাদের কার্নিশের কোনে ষ্টীলের দোলনায় পাশাপাশি বসে আছে দুজন। সায়র বিয়ের প্রস্তাব দিতেই মেহরিশ নাকোজ করে দেয়। এখন মেহরিশ বিয়ে নিয়ে ভাবছে না। কিন্তু সায়র নাছোড়বান্দা। ও কালকের মধ্যেই মেহরিশকে বিয়ে করবে। হোক মেহরিশের সম্মতিতে অথবা অসম্মতিতে। ওদের দুজনকে এক প্রকার জোর করেই আলাদা কথা বলতে পাঠায় নিলুফা বেগম। ছাদে এসে কিছুক্ষণ নিরবে বসে ছিল। নিরবতা ভেঙে মেহরিশ উপরোক্ত প্রশ্নটি করল। মেহরিশের প্রশ্নে সায়র হালকা হেসে শান্ত স্বরে বলে উঠল,

“মেহরিশ, আপনি বাঁচবেন কয়দিন?”
মেহরিশ ভড়কে গেল। মজার ছলে প্রশ্ন করছে? অবাক পানে জিজ্ঞেস করল,
“মজা করছেন?”
সায়র আগের ন্যায় জবাব দিল,
“আমাকে দেখে মনে হচ্ছে আমি মজা করার মুডে আছি?”
মেহরিশ এবার সামান্যই বিরক্তির স্বরে বলল,
“তাহলে এই প্রশ্ন করছেন যে? আপনি নিজে কী জানেন আপনি কয়দিন বাঁঁচবেন?”
সায়র হেসেই জবাবে বলে উঠল,
“আমার এই প্রশ্নের উত্তর শুধু আপনি বা আমি কেন, পৃথিবীর কেউ দিতে পারবে না। আমরা মানুষ। আমাদের সৃষ্টি করেছে যিনি তিনিই জানেন আমরা কতদিন, সময়, ঘন্টা, সেকেন্ড এই পৃথিবীতে থাকব। আমাদের হায়াত, মউত তিনিই নির্ধারণ করে দিয়েছেন।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মেহরিশ এবার শান্ত সুরে প্রশ্ন করল,
“তাহলে এই প্রশ্ন করলেন কেন?”
সায়র ঠান্ডা মাথায়, নরম সুরে বলতে লাগল,
“তুমি তোমার ২৫বছরের যৌবন, জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে হেসে খেলে। আচ্ছা, তুমি একবার মেয়েকে বড় করতে যেয়ে সঙ্গীর অভাব কি সত্যিই ফিল করবে না? মেয়ের ক্যারিয়ার গড়ে তোলার জন্য যখন সারাদিন একা লড়াই করবে, দিন শেষে একটু হলেও সঙ্গীর অভাব ফিল করবে। কারোর কাঁধে মাথা রেখে শান্তিতে চোখ বন্ধ করার জন্য ছটফট করবে। কারোর বুকের বা-পাশে শুয়ে থেকে রাত কাটাতে মন আনচান করবে। তখন বুঝবে জীবনে সুখে থাকার জন্য একজন লাইফ পার্টনার ভীষণ দরকার। মেহরিশ, শুধুমাত্র শারিরীক চাহিদা মেটানোর জন্য একজন সঙ্গীর দরকার পড়ে না।

মানসিক শান্তির জন্য একজন সঙ্গী থাকা গুরুত্বপূর্ণ। আচ্ছা, তাও বাদ দাও। ধরো, তুমি ৮০ বছর বাঁচলে। তোমার মেয়ে বড় হলো। বিয়ে হলো। সংসার হলো। তখন সে তার সংসার, ছেলে-মেয়ে নিয়ে ব্যস্ততায় দিন কাটাবে। সেই ব্যস্ততার মাঝে তুমি হয়ে যাবে একা। বৃদ্ধ বয়সে তোমার একাকিত্ব নিবারনের জন্য একজন সাথী দরকার। মনের কথা খুলে বলার জন্য সই দরকার। চোখের চশমাটা খুঁজে পাওয়ার জন্য আলাদা একটা হাত দরকার। লাঠি হাতে সঠিক পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য একজন পথপ্রদর্শক দরকার। মেহরিশ, তোমার শারিরীক চাহিদা মেটানোর জন্য, আমি তোমার মানসিক চাহিদা মেটানোর সাথী হতে চাই। একবার আমার হাতটা ধরে দেখো, যেদিন দেহ থেকে রুহ আলাদা হয়ে যাবে সেদিন ছাড়ব। তার এক সেকেন্ড আগে অব্দি ছাড়ব না। প্রমিস।”
মেহরিশ চুপচাপ কথা গুলো শুনল। মনে আলাদা একটা ভালো লাগা বয়ে গেল। কী সুন্দর কথা বলে ছেলেটা! একটা কথাও ফেলে দেওয়ার মতো না। মেহরিশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে উঠে দাঁড়াল। সায়র ঠান্ডা মাথায় জিজ্ঞেস করল,

“তাহলে কি ডিসিশন নিলে? বিয়ে করবে নাকি না?”
মেহরিশ ছোট্ট করে জবাব দিল,
“ভেবে জানাব।”
সায়র এবার উঠে দাঁড়াল। বাঁকা হেসে হুট করেই মেহরিশের কোমর জড়িয়ে নিজের কাছে টেনে নিল। আচমকা টান খাওয়ায় মেহরিশ ঘাবড়ে যায়। পড়ে যাওয়ার ভয়ে হাত দুটো গিয়ে আটকায় সায়রের শার্টে। শার্টটা দুই হাতে শক্ত করে খামচে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেলল। মেহরিশ ভয় পাওয়া চেহারাপানে তাকিয়ে সায়র মুচকি হাসল। এক হাতে মেহরিশের কোমরে রাখল। অন্য হাত রাখল মেহরিশের ঘাড়ে। প্রথমবার সায়রের স্পর্শ পেয়ে মেহরিশ কেঁপে উঠল। হৃদযন্ত্র ধপধপ শব্দ করে বাজতে লাগল। পা থেকে মাথা অব্দি শরীরের প্রত্যেকটা অঙ্গ প্রতঙ্গে কম্পন সৃষ্টি হলো। ঠোঁট দুটোও সামান্য মাত্রায় কাঁপছে৷ সায়রের ইচ্ছে করছে মেহরিশের ঠোঁট দুটো নিজের করে নিতে। কিন্তু এখন এই মারাত্মক ইচ্ছাটাকে যেভাবেই হোক দমিয়ে রাখতে হবে। মেহরিশের মুখে সায়রের নিঃশ্বাস পড়তেই ফট করে চোখ মেলে তাকাল। সায়রের চোখে চোখ পড়তেই লজ্জায় নুড়ে গেল। নিজেকে সায়রের এত কাছে দেখে ভীষন থেকে ভীষণতম অবাক হলো। সরে আসতে চাইলে সায়র আরো কাছে টেনে নিল। মেহরিশের কণ্ঠে স্বর নেই৷ কোনো শব্দ উচ্চারণ হচ্ছে না। গলা শুকিয়ে আসছস৷ শুকনো গলায় আমতা আমতা করে বলল,

“সায়র, ক.ক.কি করছেন?”
সায়র হেসে মেহরিশের গালের সাইডে এবার হাতের উল্টো পাশ দিয়ে স্পর্শ করতে লাগল। মেহরিশ অনুভূতিতে নড়ে উঠল কিঞ্চিৎ। সায়র মেহরিশের আরো কাছাকাছি চলে এলো। মেহরিশের কানের পাশে গিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“আজ কিছু করলে বাসর রাতের জন্য কি রাখব? আমার তো এখুনি বাসর সেরে ফেলতে ইচ্ছা করছে।”
সায়র কথা বলাতে মেহরিশ কানে সায়রের ঠোঁটের নরম স্পর্শ পেয়ে কাঁপলো খানিক। তবে সায়রের কথা শুনে রাগও হলো বটে। রেগে জিজ্ঞেস করল,
“কাল বাসর মানে? আমি কি বিয়েতে মত দিয়েছি? বলেছি আপনাকে বিয়ে করব?”
সায়র হেসে জবাবে বলল,

“আপনি রাজি থাকলেও কাল বিয়ে, না থাকলেও কাল বিয়ে।”
মেহরিশের কপাল কুঁচকে আসল। নাকও কিঞ্চিৎ ফুলে উঠল। কঠিন বাক্যে বলল,
“জোর করে বিয়ে করবেন?”
সায়র হাসল। বলল,
“সোজা আঙ্গুলে কাজ না হলে, আঙ্গুল বাঁকাতে হয় ডার্লিং।”
মেহরিশ দাঁত কটমট করে, চোখ রাঙিয়ে তাকাল। ফোসফোস করতে করতে বলল,
“সায়র, মুখ সামলে কথা বলুন। আপনাকে এতদিন আমি ভদ্র ভাবতাম। এখন তো দেখছি আপনি ভীষণ অভদ্র।”
সায়র দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,

“প্রেমে পড়লে পুরুষ মানুষ একটু আধটু অভদ্র হয়, জানেন না?”
মেহরিশ ছিটকে এবার সরে আসল সায়রের কাছ থেকে। রাগী স্বরে বলল,
“অসভ্য, অভদ্র, গায়ে পড়া স্বভাবের ছেলেদের আমার একদম পছন্দ না, সায়র।”
সায়র হাসি বিনিময় করে বলে উঠল,
“গায়ে পড়া স্বভাবের হলে এখুনি বাসর সেরে ফেলতাম। যেমন পোষাক পড়েছেন তাতে আমি সায়র কেন, পৃথিবীর যেকোনো পুরুষের পক্ষে নিজের পুরুষাঙ্গকে সামলাতে কষ্টসাধ্য হয়ে যাবে। আপনার টাইট ফিট টপসের গলা এতই বড় যে, আপনার বুকের নরম অংশ দুটো স্পষ্ট চোখে ভাসছে৷ যেখানে না চাইতেও আমার চোখ আটকে যাচ্ছে। মেহরিশ, আপনি একজনের মা। একজনের কন্যা। এবং একজনের হবুর স্ত্রী। দয়া করে নিজের লজ্জাস্থান সামলে চলুন। পোষাকের ক্ষেত্রে আরেকটু সচেতন হোন। আশা করি, নেক্সট টাইম আপনি নিজের ব্যাপারে সর্তক হবেন।”
বলে সোজা ছাদ থেকে নেমে আসল। মেহরিশ নিজের দিকে তাকিয়ে দেখল সায়রের বলা কথাগুলো সত্য। কিছুটা লজ্জাও পেলেও বটে। কিছুক্ষণ নিজে নিজে লজ্জায় হাসফাস করে নিচে নেমে আসল।

“গুড মর্নিং, সায়রের ডার্লিং। কাইন্ডলি, ঘুম থেকে জেগে উঠুন। এখন, এই মুহূর্তে আপনার বিয়ে।”
ঘুমের মধ্যে কথাটা মেহরিশের কানে যেতেই মেহরিশ নড়েচড়ে পাশ ফিরে পুনরায় শুয়ে পড়ল। ভেবেছে ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখছে। কিছুক্ষণ অতিবাহিত হতেই পুনরায় কেউ কানের কাছে বলে উঠল,
“আপনাকে এক মিনিট টাইম দেওয়া হলো, ঘুম থেকে উঠে বসুন। নয়তো, আপনাকে মর্নিং কিস দিয়ে ঘুম থেকে তোলা হবে।”
এবার মেহরিশ তৎক্ষনাৎ লাফিয়ে উঠে বসে পড়ল। মুহূর্তেই দু চোখের ঘুম উবে গেল। ঘুম ঘুম দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে দেখল সায়র সাদা রঙের পাঞ্জাবী পড়ে বসে আছে। মেহরিশ একবার নিজের দিকে তাকাল। মেহরিশের গায়ে সাদা রঙের নাইট ড্রেস। সায়রকে দেখে মেহরিশ বালিশের পাশ থেকে স্কাফটা নিয়ে গলায় ঝুলালো। ঘুমন্ত বাক্যে জিজ্ঞেস করল,

“সকাল সকাল মজা করার মতো মানুষ খুঁজে পাননি?”
সায়র হেসে জবাবে বলল,
“আমার মজার করার মানুষ তো শুধুমাত্র আপনি, মেহরিশ।”
মেহরিশ আবার শুয়ে পড়তে পড়তে বলল,
“প্লিজ, জান।”
সায়র মেহরিশকে শুতে না দিয়ে ধরে রেখে বলে উঠল,
“বলেন, জান।”
মেহরিশ বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে বলল,
“মানে রুমের থেকে জেতে বলছি।”
“যাবো না। কিছুক্ষণ পর এটা আমারো রুম হয়ে যাবে।”

মেহরিশ প্রচন্ড বিরক্ত হলো। ঘড়ির দিকে নজর দিয়ে দেখল বেলা ১১টা বাজে। রাতে আনায়া কান্না করছিল, ঘুমাতে দেয়নি একদম। ভোরের দিকে আনায়াকে নীলুফা বেগমের কাছে দিয়ে এসে ঘুমিয়েছিল। এখন ইচ্ছে করছে সায়রের গ° লা টি°পে দিতে। মেহরিশ কিছু বলবে তখনি রুমে নীলুফা বেগম, আনায়া, মেহনূরসহ আরেকজন স্যুটফুট পড়া লোক ঢুকল রুমে। তাদের দেখে মেহরিশ কিছুটা ভড়কাল। কিন্তু সায়র আরাম করে আসন পেতে বসল। মেহরিশ ঘুমন্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল,

ধরিয়া রাখিও সোহাগে আদরে পর্ব ১৫

“উনি কে, মা?”
মেহনূর হাসতে হাসতে বলল,
“পৃথিবীতে একমাত্র তুমিই সেই মেয়ে যে, কিনা নাইট ড্রেস পড়ে বিয়ে করতে যাচ্ছে।”
কথাটা মেহরিশের কানে যেতেই মেহরিশ খাট থেকে লাফিয়ে নামতে যেতে পায়ে পা লেগে ধুম করে নিচে পড়ে গেল। সায়রসহ বাকি সবাই হাসিতে মত্ত হয়ে উঠল। মেহরিশ শুধু অসহায় চোখে সবার দিকে বলে উঠল,
“আল্লাহ! আমাকে এ কোন দুনিয়ায় পাঠালে?”

ধরিয়া রাখিও সোহাগে আদরে পর্ব ১৭