ধরিয়া রাখিও সোহাগে আদরে পর্ব ১৭
জেনিফা চৌধুরী
“নাইট ড্রেস পড়ে বিয়ের করব? আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন, সায়র? তা ছাড়া এ বিয়েতে আমি রাজি নই। আপনি কি আমাকে জোর করে বিয়ে করবেন?”
সায়র আগের ন্যায় হেসে জবাব দিল,
“আমার জানা মতে, শাড়ি পড়েই বিয়ে করতে হবে এমন কোনো আইন নেই। আর থাকলেও সেটা আমি মানিনা। আর বিয়েটা যেহেতু আজ তাই শাড়ি-টাড়ি ম্যানেজ করা আমার জন্য খুব কঠিন। এখন নাইট ড্রেস পড়েই বিয়েটা সেরে নেই। তারপর না হয় লাল শাড়ি পড়িয়ে, নাচতে নাচতে আপনাকে বউ সাজিয়ে ঘরে তুলব। ওকে? অল ডান?”
মেহরিশ বিরক্তিতে চেঁচিয়ে বলল,
“নো, নট ডান। কি ভেবেছেন আপনি? সবকিছু ফান? বিয়েটা ছেলেখেলা? বললেন আর বিয়ে হয়ে গেল? আমার পরিবার, আপনার পরিবার কেউই উপস্থিত নেই। সবথেকে বড় কথা আমি নিজেও প্রস্তুত নই। তাহলে কিসের বিয়ে বিয়ে নাটক শুরু করলেন? ”
সায়র মেহরিশের কথায় কান না দিয়ে কাজির উদ্দেশ্যে বলল,
“কোথায় সাইন করতে হবে, শহিদ সাহেব?”
শহিদ সাহেব একটু কেশে বলে উঠল,
“কাবিন কত করবেন?”
সায়র বলল,
“আমার শাশুড়ী যত বলবে ততই হবে।”
নীলুফা বেগম একবার মেহরিশের দিকে তাকাতেই দেখল, মেহরিশ আগেই তার দিকে অগ্নীশ্বর চোখে তাকিয়ে আছে। তা দেখে নীলুফা বেগম মেঁকি হেসে বললেন,
“লিখেন, লক্ষ খানেক। আমার জামাই বাবাজীবন কি আর আমার মেয়েকে ছেড়ে দিবে নাকি যে কাবিন কোটি টাকার করতে হবে।”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
সায়র হেসে বলে উঠল,
“জিও, শাশুড়ী আম্মা। আপনাকে আমার থুক্কু আমাদের পক্ষ একজন নাতি গিফট করা হবে। তবে একটু সময় লাগবে। এই ধরুন ১বছর। মানে ডাউনলোড করতে এইটুকু টাইম তো লাগবেই বলেন?”
নীলুফা বেগম জিভে কামড় দিয়ে দৃষ্টি ঘুরিয়ে ঠোঁট চেপে হাসতে লাগলেন। মেহনূর চিৎকার করে উঠল। আর মেহরিশের অটোমেটিক কাশি শুরু হয়ে গেল। শহিদ সাহেবও হাসছেন। সায়র শুধু আনায়াকে গালে চুমু খেয়ে বলে উঠল,
“আম্মাজান, আপনার তো একটা খেলার সাথী দরকার তাই না বলেন?”
আনায়াও সাথে হুহু করতে লাগল। মেহরিশ এবার সায়রের পিঠে ধুম করে কিল বসিয়ে দিয়ে বলে উঠল,
“আপনাকে আমি যথেষ্ট ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পুরুষ মনে করতাম। এখন দেখছি আপনি প্রচন্ড অস*ভ্য, অ*ভদ্র একজন।”
সায়র মেহরিশের গা ঘেঁষে ফিসফিস করে বলে উঠল,
“আমি অভ°দ্র না হলে আপনি মা হবেন কি করে, জান?”
মেহরিশ পারছেনা এবার কান্না করে দিতে৷ বিরক্ত হয়ে খাট থেকে নেমে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই সায়র আটকে ফেলল। শক্ত বাক্যে হেসেই বলল,
“বিয়ে শেষ না হওয়া অব্দি কোথাও যাওয়া যাবে না।”
মেহরিশ জবাবে শক্ত হয়ে বলল,
“আমি এখন বিয়ে করতে পারব না, সায়র। আমার হাত ছাড়ুন।”
সায়র বলে উঠল,
“বিয়ে আপনাকে আজ, এক্ষুনি করতে হবে, মেহরিশ।”
বলেই শহিদ সাহেবের উদ্দেশ্যে বলল,
“কাবিন ১০লক্ষ ১০টাকা লিখুন, শহিদ সাহেব।”
শহিদ সাহেব লিখলেন। সাথে আরো কিছু লিখলেন। বিয়ের সমস্ত বিধিমালা শেষ করে রেজিস্ট্রি খাতাটা সায়রের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে উঠল,
“এখানটায় সাইন করে দিন।”
সায়র একদম দেরি করল ন। সাথে সাথে সাইন করে, ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে উঠল। এবার মেহরিশের দিকে খাতাটা এগিয়ে দেওয়া হলো। মেহরিশের বুক কাঁপছে। একদিন ভুল মানুষকে ভালোবেসে, পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে কোনো এক কাজি অফিসে এভাবেই তো বিয়েটা করেছিল। কই বছর খানেকও তো সংসার করতে পারল না। আজ আবারো সময়ের খরস্রোতে জীবনে এনে দাঁড় করালো সেই মুহূর্তে। মেহরিশের এখন কি করা উচিত? সায়রকে মেহরিশ পছন্দ করে। কিন্তু এখনো ভালোবেসে উঠতে পারেনি। মেহরিশ চায়না এখনি বিয়ে নামক বন্ধনে আবদ্ধ হতে। তাহলে কি করা উচিত? চোখের কোনে অশ্রু জমছে। একবার মেহনূর আর নীলুফা বেগমের দিকে তাকাল। তারা দুজনেই চোখের ইশারায় ভরসা দিল। মেহরিশের চোখ এই মুহূর্তে বাবা নামক মানুষটাকে খুঁজে যাচ্ছে। কিন্তু সেই মানুষটা তো কাল রাতেই শহরের বাইরে গেল কাজে। আর আজ সায়র এমন করছে। এর মানেটা কী? সায়রের পরিবারের সবাই মানবে তো? মেহরিশ আকাশ কুসুম ভেবে আনায়ার দিকে তাকাল। আনায়া সায়রের বুকে নিশ্চুপ হয়ে আছে। মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে যাবে। সায়রও খুব যত্নে আনায়াকে আগলে রেখেছে। মেহরিশ এবার দোটানায় পড়ে গেল। আনমনে বলে উঠল,
“ডিভোর্সের এখনো তিন মাস হয়নি, সায়র। তাহলে আমরা বিয়ে করব কিভাবে?”
সায়র থমকাল। শান্ত স্বরে জবাবে বলল,
“আমি আইন ও ধর্ম দুটো বিষয়ই অবগত, মেহরিশ। তবে আমি নিরুপায়। আমার আপনাকে বিয়ে করাটা এই মুহূর্তে জরুরি। আমার হাতে আজকের দিনটাই সময় আছে। আমরা শুধু রেজিস্ট্রি করে রাখব। আমাদের বিয়েটা এখন শুধু এই চার দেয়ালের মাঝেই বন্দি থাকবে। চার দেয়াল আর চারজন মানুষ ব্যতিত কেউ জানবে না। শহিদ সাহেব ঠিক আছে?”
শহিদ সাহেব হাসলেন। বললেন,
“জ্বি, স্যার।”
মেহরিশ মানতে পারছে না। কি হচ্ছে তাও বুঝতে পারছে না। সায়র কথাটা শেষ করে মনে মনে বলে উঠল,
“যেখানে আনায়া আর আপনার জীবনের প্রশ্ন উঠেছে, সেখানে আপনাদের জন্য সায়র সব নিয়ম ভাঙতে পারে, মেহরিশ।”
মেহরিশ কলম হাতে বসে আছে নিস্তব্ধ হয়ে। সাইন করার জন্য মন, মস্তিষ্ক সায় দিচ্ছে না। সায়র বিরক্ত হল। বলল,
“মেহরিশ, সাইন করুন।”
“আমি এখন বিয়েটা করতে পারব না, সায়র। প্লিজ জোর করবেন না। কাজি সাহেব আপনি এখন আসতে পারেন।”
সায়র কথার পৃষ্ঠে সাথে সাথে প্রশ্ন করল,
“আপনি সাইন করবেন কি না?”
মেহরিশও জোর খাটিয়ে উত্তর দিল,
“না। আমি সাইন করব না।”
সায়র আবারো প্রশ্ন করল,
“শেষ বার বলছি মেহরিশ, সাইন করে দিন। আমাকে উল্টাপাল্টা কিছু করতে বাধ্য করবেন না।”
মেহরিশ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“আপনি যা খুশি করুন, তবুও আমি সাইন করব না।”
সায়র দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সবার আড়ালে এক হাত রাখল মেহরিশের কোমরে। মেহরিশ কাঁপল। চোখ দুটো বড়ো বড়ো হয়ে গেল মুহূর্তেই। গলার জোরটা নিমিশেই হাওয়া হয়ে গেল। সায়রের দিকে তাকাতেই সায়র দাঁত কেলিয়ে হাসল। মেহরিশের কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলে উঠল,
“মেহরিশ, আপনি কি এই মুহূর্তে চুমু চান নাকি আমার হাতের অনাকাঙ্ক্ষিত ছোঁয়া চান?”
মেহরিশ ঘাবড়াল। রোবটের মতো হয়ে বসে রইল। নড়চড় করতে ভুলে গেল। ঢোক গিলল কয়েকবার। সায়র পুনরায় বলল,
“মেহরিশ, সাইন করুন। আমাকে নির্লজ্জ হতে বাধ্য করবেন না। আপনার ঠোঁট দুটো আমাকে ভয়ংকর ভাবে ডাকছে।”
বলেই হাত দিয়ে মেহরিশের কোমরে খানিকটা চাপ প্রয়োগ করতেই মেহরিশ নড়ে উঠল। নীলুফা বেগম আর মেহনূরের চোখ এড়ালো না দৃশ্যটা। উনারা দুজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছে৷ মেহরিশ তবুও সাইন করছে না দেখে সায়র আর একটু ঘেঁষে বসল। বলল,
“কোথায় চুমু খাবেন ঠোঁটে নাকি বু…।”
কথাটা সম্পূর্ণ করার আগেই মেহরিশ তড়িঘড়ি করে সাইন করে ফেলল। সবাই মিলে এবার একসাথে আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠল। হাসির রোল পড়ে গেল রুম জুড়ে। একে একে সবাই ওদের স্পেস দিতে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। মেহনূর বেরিয়ে যাওয়ার আগে ওদের কংগ্রেস করতে ভুলল না। সাথে সায়রকে বলল,
“এখন কিন্তু সকাল ১০টা। রাত ১০টার জন্য না হয় নিজেকে প্রিপেইড করুন, দুলাভাইইইই।”
কথাটা শেষ হতেই সায়র হেসে মেহনূরের বাহুতে চাপড় মে°রে বলল,
“এই না হলে আমার শালি? আমাকে সাবধান করার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ শালি সাহেবা।”
মেহরিশের ধমকি খেয়ে মেহনূর আর এক মুহূর্ত দাঁড়াল না। এক দৌড়ে বেরিয়ে গেল। মেহনূর চলে যেতেই মেহরিশ খাট থেকে নেমে দাঁড়াল। রাগে ড্রেসিংটেবিলের উপর রাখা জিনিসপত্র গুলো এলোমেলো করে ছুঁড়ে ফেলতে লাগল। সায়র থামাল না। ভড়কালো না। আনায়া ঘুমিয়ে যাওয়ায় আনায়াকে ঠিক করে শুইয়ে দিল৷ তারপর নিজেও খাট থেকে নেমে দাঁড়াল। মেহরিশের পাশে যেয়ে দাঁড়িয়ে শান্ত বাক্যে বলল,
“জীবনের কিছু কিছু মুহূর্ত অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও অনুভূতি গুলো দারুন মিষ্টি হয়।”
মেহরিশ পাশ ফিরে সায়রের বুকে দুইহাত রাখল। মুহূর্তেই সায়রকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিয়ে চিৎকার করে বলে উঠল,
ধরিয়া রাখিও সোহাগে আদরে পর্ব ১৬
“আপনার উপর আমার ঘৃণা হচ্ছে, সায়র। আপনি নামক পুরুষ আজ থেকে আমার এক আকাশসম ঘৃণায় বাঁচবেন।”
সায়র তবুও হাসল। পুনরায় এগিয়ে আসল মেহরিশের কাছে। মেহরিশ দূরে সরে যেতেই সায়র দুইহাত ধরে ফেলল। মেহরিশ ছোটাছুটি করতে লাগল। সায়র ছাড়ল না। ফুঁ দিয়ে মেহরিশের মুখশ্রীতে পড়ে থাকা চুল গুলো সরিয়ে দিল। হেসে বলে উঠল,
“আপনার ভালোবাসায় না হোক ঘৃণায় বাঁচতে পারাটাও আমার এ জীবনে পরম পাওয়া হয়ে থাকবে, মেহরিশ।”