ধূসর রংধনু পর্ব ১৪
মাহিরা ইসলাম
ঢাকার যানজট পূর্ণ শহর, ধূলোর আস্তরণে সবকটা বিল্ডিং আবৃত।মাঝে মাঝে মনেহয় কেউ বোধহয় একটু ইউনিক রং করে রেখেছে টিনের ঘরগুলোতে।
টিনের ছাইরঙ টা কমলা, কালছে রঙ ধারন করে।
তাসফি বসে আছে তার অহংকারী ডাক্তার বরের গাড়িতে।তারা যাচ্ছে নিস্তব্ধ’র শ্বশুর বাড়ি।তাসফির সারা অঙ্গে উৎফুল্লতার ছোঁয়া। প্রায় একমাস পর সে যাচ্ছে তার নিজ ভবনে।কত স্মৃতি সেখানে তার।ছোট থেকে বেড়ে উঠার সাক্ষী তার সে স্থান।সে কি আর ভোলা যায়।
মায়ের কবরটা একটু খানি ছুঁয়ে দেখবে সে।অনেকখানি গল্প করবে মায়ের সঙ্গে। অভিযোগ জানাবে হাজারো।
এই তো গত পরশু বাবা তার অসহ্য বরের কাছে আবদার করলো নিজের কুটিরে যাবার।
আর আজ সকালে বাসন্তী আপা বললো,
-” এই তাসফি রেডি’হ তো ব্যাগ গোছা। তোকে তোর বাপের বাড়ি ফিক্কে মারবো।”
তাসফি ভ্রু কুঁচকে বলল,
-” কিন্তু আমি তো যাবো না আপাই।তোমার ভাই না গেলে আমিও যাচ্ছি না এবারে আর।বাবা ওই লোককে কত করে বলল,অনুরোধ করলো।এবারে তোমার ভাই না গেলে বিশ্বাস করো আপা ওই ইস্তব্ধ, নিস্তব্ধ’র গোছা ধরা সিলকি কালো কুছকুচে চুল গুলোর একটাও আস্ত রাখবোনা আমি।তোমার ভাই ঘুমানো পরে সানলাইট দিয়ে আমি তাতে আগুন ধরিয়ে দেবো।অতঃপর টেকো মাথায় তার ডাক্তারী করতে হবে এই বলে দিলাম।
“কে কার চুলে আগুন ধরাবে শুনি”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কথার মাঝে পেছন থেকে নিস্তব্ধ’র গম্ভীর কন্ঠ কর্ণে পৌঁছেতেই চমকে উঠলো তাসফি।সঙ্গে সঙ্গে জ্বীবে কামড় দিল সে। ইশশ লোকটা সবখানে এসে হাজির হয়।আবার ভেঙচি কাটলো।শুনুক তাতে তার কি সে কি ভয় পায় নাকি এই অসহ্য লোককে।হুহ।
নিস্তব্ধ আগমনি বার্তা পেতেই বাসন্তী নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে।তারা স্বামী -স্ত্রী নিজেদের ঝগড়া নিজেরাই মিটিয়ে নিক না।ঝগড়া থেকেই তো ঊদয় হবে মিষ্টি মধূর ভালোবাসা।বাসন্তী অনেকবার খেয়াল করে দেখেছে তার ভাই তাসফিকে সামনে সামনে দুঃছাঁই করলেও পেছনে পেছনে ঠিক তার খেয়াল রাখতেও ভুলে না।
নিস্তব্ধ বুদ্ধিমান ছেলে।তার নিজের পদক্ষেপ সে ঠিক নিজে নিতে জানে।যে কোনো কাজ করতে গেলে সে অবশ্যই ভেবে চিন্তেই করবে।তবে ভালোবাসার মতো জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়টা তার ভাই সম্পূর্ণ করতে বেশি দেরী না করে ফেলে।
বাসন্তী বেরিয়ে যেতেই নিস্তব্ধ দরজার ছিটকিনি তুলে দিলো।
নিস্তব্ধ কে ছিটকিনি তুলে দিতে দেখে তাসফি শুষ্ক ঢোক গিললো।সিটকিনি কেন দিলো।কি করতে চাইছে লোকটা।
নিস্তব্ধ কদম বাঁড়ানোর বাড়ানো সঙ্গে তাসফি পিছিয়ে যেতে লাগলো।কিন্তু ভাগ্য অসহায় দুপা পেছানোর পরে আর কোনো জায়গা খুজে পেল না সে।
নিস্তব্ধ নিঃশব্দে গিয়ে দাঁড়ালো তাসফির সামনে,
একটু নিচু হয়ে তাসফির কানের কাছে মুখ এগিয়ে ফিসফিস করে বলল,
-” তা ম্যাডাম কার চুলে আগুন ধরাবেন শুনি?”
নিস্তব্ধ’র নিঃশ্বাসের গতিবিধি তাসফি ঠাহর করতে পারছে। অস্বস্তিতে সে জমে যাচ্ছে। কুল ডাউন তাসফি। এত গলে যাওয়ার কিছু হয়নি।তাসফি চোখ বন্ধ করে বড় করে শ্বাস ফেলল।ঝট করে নিস্তব্ধ’র বুকে হাত দিয়ে ধক্কা দিয়ে সরে পরলো সে ততক্ষণাৎ।ইশশ লোকটার ফিসফিসানো বলা পুরুষালী কন্ঠস্বর এতটা মাদকীয় কি করে হয়।প্রত্যেক পুরুষের ফিসফিস করে বলা স্বর কি এমনই শোনায় তবে।
খানিকটা দূরে সরে তাসফি মিছে চোট দেখিয়ে বলল,
-” যার ইচ্ছে তার চুলে আগুন ধরাবো তাতে আপনার কি।সানলাইট দিয়ে নয়,চ’লা কাঠ দিয়ে আগু ধরাবো বুঝলেন।তাতে আপনার কি।”
নিস্তব্ধ বিরক্ততে কঁপাল কুঁচকে নিলো।তার হাটুর বয়সী মেয়েটা বেশি কথা বলছে ইদানীং। তার মুখে মুখে তর্ক করছে।
সে কাঠ কাঠ কন্ঠে বলল,
-” কারো চুলে আর আপনার আগুন লাগানো লাগবে না ম্যাডাম।নিজের ব্যাগ প্যাক গুছিয়ে নিম কিছুক্ষণ পরেই আমরা বের হবো।”
-” বের হবো মানে।”
-” কেন নিজের বাপের বাড়ি যেতে চান না বুঝি?আপার কাছে তো খুব নালিশ দেওয়া হচ্ছিল ।”
তাসফি চোখ খুশিতে চকচক করে উঠলো।পিছন ফিরে উৎফুল্ল কন্ঠে বলল,
-” এই সত্যি যাবেন আপনি।”
নিস্তব্ধ ভ্রু কুঁচকে বলল
-” আমি যাবো তোমায় কে বলল?”
তাসফি হাসিখুশি মুখটা চুপসে গেল মুহুর্তেই,
-” তার মানে যাবেন না। এই মাত্র আমায় বললেন রেডি হতে?”
নিস্তব্ধ বাঁকা হেসে বলল,
-” তো আমি কি একবারো বলেছি আমি যাবো?”
তাসফি মন খারাপ করে বলল,
-” কেন যাবেন না।বাবা আপনায় এতকরে বলল তবুও যাবেন না?”
-” কেন যাবো বলো তো যার বাড়ি যাবো সেই তো এখনো একবারো বলল না।তো কি জন্য যাবো বলুম তো ম্যাডাম।এতটাও বেহায়া নই আমি।যে সেধে কারো বাড়িতে চলে যাবো।”
তাসফি চোখ ছোট্ট ছোট্ট করে বলল,
-” লাগবে না আপনারা যাওয়া।অসহ্য।”
বলেই সে বেলকনি তে চলে গেল।
লোকটা দিন দিন বড় মাপের বদমাশে পরিনত হচ্ছে। আগে তো কথাই বলতো না তার সঙ্গে অথচ এখন শুধু ঝগড়া করতে তৎপর থাকে।আশ্চর্য। সে কেন বলবে তাকে যেতে।বলবে না সে।কিসের ঠেকা পড়েছে তার।বাবা বলেছে এতে হয়নি।এখন কি তাকে নেওয়ার জন্য ঢোল ডগ বাজাতে হবে।পালকি সাজাতে হবে।অদ্ভুত।
ভাবনার মাঝেই বেলকনি তে তাসফি হঠাৎ নিজের পেছনে কারো অস্তিত্ব অনুভব করলো ।
একটা গরম নিঃশ্বাস তার ঘাড় বেয়ে নেমে এলো। আবারো সেই ফিসফিসানো পুরুষালী মাদকীয় কন্ঠস্বর,
-” রেডি হয়ে নাও মেয়ে। আমি যাচ্ছি।তবে শর্ত আছে।আমার চুলে আগুন ধরাতে চাওয়ার শাস্তি তোমায় দেওয়া হবে সময় মত।শর্তটা সময় মতো পূরণ করে নেবো।আর শাস্তি টা তোলা রইলো।এই নিস্তব্ধ ইয়াসার কিছুই ভুলে যায় না।সে তার শর্ত শাস্তি সময় মতো দুটোই পূরণ করে নেবে।মনে রেখ কিন্তু মেয়ে!
ধীরে ধীরে গরম নিঃশ্বাসের গতিবেগ বিলীন হতে লাগলো, সঙ্গে তাসফি ও মুচকি হাসলো।
আবার পরক্ষণেই চোখ মুখ শক্ত করে ফিসফিস করে বলল,আপনার দেওয়া যে কোনো শর্ত আমি সময় মতো মোটেও মানবো না নিস্তব্ধ ইয়াসার।আর আপনার দেওয়া শাস্তি? সেটাও আমি মোটেও সহজে গ্রহন করবো না তো।তার জন্য যে আপনায় বহু কাঠখর পোড়াতে হবে ডাক্তার সাহেব।অনেক কাঠ খড় পোড়া তে হবে।তৃষ্ণার্থ আকুল হৃদয়ে আপনি আমার পানে চেয়ে থাকবেন।আমি আপনায় দুঃছাঁই করে তাড়িয়ে দেবো।কেমন মজা হবে তখন বলুন তো।খুব মজা হবে।
আবারো মুচকি হাসলো সে।
তার সেই মুচকি হাসির রেশ গাড়ির মাঝেও প্রকাশ পাচ্ছে।পান্না তাকে ঝাকি দিয়ে চেঁচিয়ে বলল,
-” কাকাই,কাকিয়া হাসছে। ”
নিস্তব্ধ আড়চোখে লুকিং গ্লাসে তাসফির মুখাবয়ব অবলোকন করলো। পুনরায় ড্রাইভে মনোযোগ দিলো।
তাসফি ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো।
আয়েশা বলল,
-” কি ব্যাপার তাসফি কোন স্বপ্নে ডুবে ছিলে বলো তো।লক্ষণ কিন্তু ভালো ঠেকছে না।”
তাসফি আয়েশার দিকে তাকিয়ে আবারো মুচকি হাসলো।
নিস্তব্ধ কে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল,
-” লক্ষণ ভালো আর না ঠেকলে আমার কি করার বলো।আসলে নতুন নতুন প্রেমে পড়ার অনুভূতি একটু অন্য রকম বুঝলে।”
বলেই সে চোখ টিপে দিলো।
আয়েশা হায় হায় করে বলল,
-” বলো কি গো মেয়ে। আমার দেয়র কে ছেড়ে আবার কার দিকে মন দিলে গো মেয়ে। ”
নিস্তব্ধ চোয়াল শক্ত করে নিলো।দাঁতে দাঁতে চেঁপে সে নিজের রাগ সংবরণ করলো। অভদ্র মেয়েটা বড্ড বার বেড়েছে আজকাল।
দিন দিন তাকে কয়লার আগুনের দিকে ঠেলে পাঠাচ্ছে ইচ্ছে করে এই বজ্জাত মেয়ে।
সেও দেখে নেবে।
তাসফিদের পথযাত্রার সঙ্গে আয়েশা আর পান্না ও যুক্ত হয়েছে।
তাসফি তার শ্বাশুড়ির থেকে জানতে পেড়েছে আয়েশা এতিম একটা মেয়ে।বিয়ের পর বাপের বাড়ির আদর কেমন তা সে কোনো কালে ঠাহর করতে পারে নি।
আর তাইতো তাসফি বাবাকে বার বার করে বলে দিয়েছে তার জা এর সঙ্গে একটু কথা বলে যেতে রাজী করাতে।বাবা বললে আয়েশা গুরুজনদের কথা ফেলতে পারবে না।তার বাবা তাই করেছে।সকলে অনুরোধ করার পর পায়েলও রাজী হয়েছে।
এমন কি তাসফি দেখেছেও আসার পথে আয়েশা কতটা এক্সাইটেড ছিল।তার থেকে বোধহয় আয়েশা ভাবীই বেশি খুশি হয়েছে আসতে পেরে।
তাসফি যখন বললো পান্নাকে,
নানু বাড়ি যাবে পান্না মামনি।
তার সে কি খুশি।জীবনে প্রথমবার সে নানুবাড়ি যাবে।এতে যেন তার খুশি আর ধরেই না।সারা বাড়িময় সে ছুটে বেরিয়েছে। নানু বাড়ি যাবো নানু বাড়ি যাবো বলে।
ইশশ কি মিষ্টি সেই দৃশ্য। জীবনে প্রথমবার নানুবাড়ি বেরাতে যাওয়ার অনুভূতি বুঝি এমনি হয়।
বাসন্তী আপাকেও সে আসতে অনুরোধ করেছিল তবে সে বলেছে অন্য আরেকদিন যাবে।
নিলয় সাহেব বসে ছিলেন তার স্টাডি রুমে। কিছু কেসের ফাইল পর্যবেক্ষণ করছিলেন। অনিমা বেগম চা হাতে রুমে প্রবেশ করলেন।চায়ের কাপ টেবিলে রেখে তিনি স্বামীর মুখোমুখি হয়ে চেয়ারে বসলেন।
স্ত্রী আগমনে নিলয় সাহেব তার দিকে ফিরে তাকালো।
ভ্রু উচিয়ে জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে চাইলো তার পানে।
অনিমা বেগম কেনো জড়তা ব্যতীত কাঠ কাঠ কন্ঠে বলল,
-” হাসিবের সঙ্গে মেয়ের ডিবোর্স কি তুমি আদত্ত্বে করাবে নাকি আমি অন্য লয়য়ার দেখবো।কোনটা? আর একটা দিন ও আমার ইচ্ছে হচ্ছে না ওই রাস্কেলটার সঙ্গে আমার মেয়ের নাম জড়িত থাকুক।”
নিলয় সাহেব ঠান্ডা মাথায় মুচকি হেঁসে বললো,
-” এত রেগে যেয়ো না গিন্নি।এক সপ্তাহ ধৈর্য্য ধরো আমার মেয়ে মুক্ত হয়ে যাবে।আর ওই রাস্কেলটার উপযুক্ত শান্তি আমি তাকে দিয়ে ছাড়বো।”
অনিমা বেগন থামলেন না।তিনি অন্য প্রসঙ্গে বললেন,
আর ছেলের ব্যাপারে কি ভাবলে,
-” তোমার ছেলে কি ভেবেছে মেয়েটাকে সারাজীবন এমন তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করবে। ভদ্রলোক বিপদে পড়েছে নাহলে তার মেয়ের বিয়ে না কোনোদিন তোমার ওমন গোমড়ামুখো ছেলের সাথে দিতো না।”
নিলয় সাহেব মনে মনে বললেন,
-” ছেলেটা কার মতো হয়েছে দেখতে হবে না। হয়েছে তো একদম তোমার মতো গিন্নি, তুমি যেমন গোমড়ামুখো তোমার ছেলেটাও হয়েছে তো তাই।এখানে আমার দোষ কোথায়। আমার জিনের বেশিরভাগ পেলে ছেলেটা আমার মতোই হাসিখুশি হতো।কিন্তু হয়েছে তো সে তোমার মতো।বোধহয় বেশিরভাগ জিন তোমারটাই পেয়েছে।
তবে ছেলে জন্ম দেবার পরিকল্পনা করার সময় কি আর একটু ভেবে করা উচিত ছিল?মিস্টেক টা কি করে হলো।তার কতো জটিল জটিল কোনো কেসেই তো এই পর্যন্ত কোনো মিস্টেক হয় নি।তবে কি সে সংসার জীবনেই একটা বড় সর মিস্টেক করে ফেলেছে।”
অনিমা বেগম আবারো বললেন, “আত্মীয় স্বজন কে ডেকে ঘটা করে অনুষ্ঠান করবে কবে তা ভেবেছো? তারা তো মুখিয়ে আছে ছেলের বউ দেখবে বলে। কত দিন তাদের বুঝ দিয়ে রাখা যায়।”
নিলয় সাহেব হেঁসে বললেন,
-” সে তোমার ছেলে যতদিন পর্যন্ত না বলছে।তোমার ছেলের নতুন কর্মস্থলেও তো কেউ জানে না
ভাবো তবে কতটা ডেঞ্জারাস। তোমার ছেলে তোমার মতোই একদম ফাস্ট ক্লাস হয়েছে,কি বলো?হাহাহা।”
অনিমা বেগম কর্কশ স্বরে বললেন,
-” আমার মতো নয় তোমার মতো হয়েছে ছেলে।যেমন বাপ তার তেমন ছেলে।”
নিলয় সাহেব হতভম্ব হয়ে স্ত্রীর গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইলেন,
-” যা বাবা সারাক্ষণ আমার ছেলে তার ছেলে করে মুখে ফ্যানা তুলে ফেলে।তার যেই কিনা একটা অন্যায় আবদার করে বসলো, অমনি সে ছেলে তার হয়ে গেল।আজব মহিলা গুষ্টি। এদের মন বুঝিবার সাধ্যি আছে কার।”
আশা একা একা মন খারাপ করে বসে আছে ক্লাসে। আজ তার প্রিয় বান্ধবী তাসের ঘর ও আশে নি,তার ক্রাশ স্যার নিস্তব্ধ ওও আসে নি। কি মুশকিল! এখন সে একা একা কি করবে টা কি।
প্রথম ক্লাস শেষে আশা বাইরে বের হলো।
একা একা বসে থাকতে ভালো লাগছে না আর।কলিডর পার হতে গেলে হঠাৎ কিছু স্টুডেন্ট এর অযাচিত কিছু কথায় তার চলন থামিয়ে দিল।কান পেতে শুনতে চেষ্টা করলো কথা গুলো।
মান্সার সঙ্গে থাকা তার এক চ্যালা রাই বলল,
-” তুই তো নিস্তব্ধ স্যারকে পছন্দ করিস।কিন্তু স্যার তো তোকে পাত্তাই দেয় না কি করে পটাবি স্যার কে।মাঝে দেখি স্যার তাসফি মেয়েটার দিকে খেয়াল রাখে।কিছুতো ঘাপলা আছেই বুঝলি।
আর মেয়েটাও বড্ড বাড় বেড়েছে।সেদিন তো তোকে থাপ্পড় ও মেরে দিলো।কতবড় সাহস মেয়েটার দেখেছিস।
মান্সা সয়তানি হেঁসে বলল,
-” হুমম।ওই মেয়েকে তো আমি দেখে নেবো।আজ কলেজে আসে নি।তবে আজই ওর খেল খতম করতাম।ওর বড় বড় চোপা ভেঙে দিতাম।
আর নিস্তব্ধ স্যার তো এই মান্সারই হবে।বাবাকে আজ বাড়ি গিয়ে বলবো স্যারের কথা। বাবাকে বলবো স্যারের সঙ্গে আমার বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে।অতএব নো চিন্তা। এই মান্সা কে অপছন্দ করবে এমন কোন ছেলে আছে। আমার এক চাউনিতে ছেলেরা লাইন লেগে যাবে।”
রাই বলল,
-” বাব্বাহ একবারে বিয়ে। ”
মান্সা লাজুক হাঁসলো।
আরেকজন বলল,
-“এই তাসফি মেয়েটাকে কি করবি রে?”
মান্সা সয়তানি হেঁসে বলল,
-” আসুক না একবার কলেজে, তখনই দেখাবো মজা। এই মান্সা কি জিনিস সে হারে হারে টের পাবে।”
সব কথা শুনে মান্সা চোখ বড় বড় করে নিলো।
আর নিস্তব্ধ স্যারকে বিয়ে করার কথা শুনে ফিক করে হাঁসতে গিয়েও আবার মুখে হাত চাপা দিলো।
নাহ এই অসাধারণ খবর তো তাসফিকে দিতেই হচ্ছে।
তাছাড়া তাসফির কি ক্ষতি করবে ওই অসভ্য মেয়েটা। তাসফিকে সতর্ক থাকতে বলতে হবে। আজই বাড়ি গিয়ে ফোন দিতে হবে।মেয়েটা গিয়ে উধাও হলো কই।
মান্সার কথা শোনা শেষে দ্রুত কলিডর পার হতে গেলে মুহুর্তেই শক্তপোক্ত পুরুষালী অবয়বের সাথে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়লো সে।
পুরুষটি মুহুর্তেই চোখমুখ কুঁচকে গালি ছুরতে নিয়েও থেমে গেল এটা তার প্রফেশন ক্ষেত্র এটা ভুললে তার চলবে না।
পুরুষটি নিজেকে সামলে নিয়ে আশার উদ্দেশ্য কঠোর স্বরে বলল,
-” চোখ কোথায় রেখে চলাফেরা করো মেয়ে।যে জোরসে ধাক্কা মেরেছো।তোমায় ধাক্কায় আমার বত্রিশটা দাঁত ভাঙতে ভাঙতে বেঁচে গেছে এই শুকরিয়া। খবরদার যদি আর এভাবে চলা ফেরা করতে দেখি অভদ্র মেয়ে।”
বলেই সুদর্শন পুরুষটি হনহন করে হেঁটে চলে গেল নিজ কাজে।
আশা তাজ্জব বনে তাকিয়ে রইলো পুরুষটির যাওয়ার পানে।ছিঃ কতবড় অকৃতজ্ঞ লোক।
সুজন স্যার যে এমন মানসিকতার মানুষ সে ভাবতেই পারলো না।
লোকটা ক্লাসে কি হাসিখুশি ভাবে সবার সাথে কথা বলে।হাসি ঠাট্টা করে।আর তার সাথে কিনা এমন দুর ব্যবহার করলো।সে যে পড়ে গেল ধরে পর্যন্ত ওঠালো না।আশ্চর্য!
হঠাৎ আকাশটা কালো মেঘে ছেয়ে গেল।কেমন যেন ঝড় হাওয়া বইছে চারিদিকে।
আশা উঠতে গিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখলো সুদর্শন পুরুষটি পুনরায় তার দিকে এগিয়ে আসছে। দক্ষিণা বাতাসে তার সিল্কি চুলগুলো এলোমেলো উড়ছে। তার ঠোঁটের কোনে বাঁকা হাসি।
ইশশ,ডাক্তার সুজন বুঝি এতটা সুন্দর দেখতে।কই আশা আগে তো তা খেয়াল করে নি।ফর্সা, মায়াবি একটা চেহারা।মনে হচ্ছে নিস্তব্ধ স্যারের কার্বন কপি।কই আশা আগে তো এতকিছু ভাবে নি। তবে এখন কেন ভাবছে।কোথাও স্বপ্ন দেখছে না তো সে।
সুজন এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিলো আশার দিকে।
ঝাড়ি দিয়ে বলল,
-” এই মেয়ে উঠে এসো।এখনো এভাবে বেকুবের মতো বসে আসো কেন মেয়ে আশ্চর্য। ”
আশা নিজের কাঁপাকাঁপা হাত সুজনের হাতের মাঝে রাখলো।শির শির করে উঠলো তার শরীর একবার বাইরেটা পরখ করলো। মনে হচ্ছে প্রবল ঝড় হাওয়ার বার্তা। ঠিক কি তার মনের মাঝে যে ঝড় বইছে তার মতোই নাকি তার চেয়েও বেশি আতঙ্কিত হবে এ-ই ঝড়।
কেন এই ঝড় তার মনে হঠাৎ হানা দিলো।এমন টা তো সে চায় নি।এই পুরুষ যে তার কোনো দিন হবে না। সম্ভবই না তা।
ধূসর রংধনু পর্ব ১৩
তার মতো বামনের কি আর চাঁদের দিকে হাত বাড়ানোর অধিকার আছে? উহু কখনোই না।
বাবা -মা ছাড়া চাল চুলোহিন মেয়ে সে।ভাগ্যিস কাকাটা ছিলো তার তাইতো আজ এই মেডিকেল কলেজে পড়তে পারছে।তবেও এতে চাচির কম কথা শুনতে হয় না তাকে।সারাক্ষণ টাকার খোঁটা শুনতে হয়।
ক্লাসে বসে আশার মনটা বিষন্নতায় ছেয়ে গেল।কেন হঠাৎ করে হৃদ গহিনে এই বসন্তের আগমনি বার্তা ঊদয় হলো।সে তো এমনটা চায় নি।
মন ভাঙ্গার করুণ ব্যাথা নিয়েই কি তার পার করতে হবে সারাটি জীবন ভর?