ধূসর রংধনু পর্ব ১৯

ধূসর রংধনু পর্ব ১৯
মাহিরা ইসলাম

কাল রাতের ঝড়ের পর সকাল থেকে যেন পরিবেশেটা একটু বেশিই শান্ত।কেমন বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ নেই।পাখিদের ডাক নেই।চারিদিকে কেমন যেন হঠাৎ করে নিস্তেজ, থমকে যাওয়া ভাব বিধ্যমান।স্বচ্ছ আকাশ মেঘমুক্ত।
নিস্তব্ধ দুপুরে না খেয়েই বেরিয়ে গেল।হঠাৎই সকল উচ্ছ্বাস ছেড়ে, কর্পূরের মতো হাওয়ায় ভাঁসা বিষাক্ত তার। ঝিম মেরেছে আনন্দানুভূতি।
গমন পথে সে মোস্তফা সাহেব কে বলেছে,

-” আজ আসছি আঙ্কেল।দোয়া করবেন। অন্য কোন এক সময় এসে অনেক দিন থাকা হবে হয় তো।হসপিটালে জরুরী একটা কাজ পড়ে গেছে হঠাৎই।আফ.. তাসফি আর ভাবীরা বিকালে গাড়ি করে চলে যাবে।আমাদের ড্রাইভার মোহন কাকা গাড়ি নিয়ে আসছে।আমি আসতে বলে দিয়েছি চিন্তা করবেন না।”
মোস্তফা সাহেব আর কি বা করবেন।জোড় করে তো আর রাখা যায় না কাউকে।তবুও তার বেশ চিন্তা হচ্ছে। মেয়ে জামাইয়ের মাঝে সব ঠিকঠাক আছে তো।তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে সে একটু বেশিই তাড়াহুড়ো করে ফেলেননি তো। বিয়েটা যেভাবে হুট করে দিলেন। নিস্তব্ধ কে নিয়ে তার কোনো অভিযোগ নেই।ছেলেটা ভালো,বুদ্ধিমান, সৎ। তবুও… বাবার মন তো।হাজারো অযাচিত ভাবনা ঘোরে মাথায় ভেতর।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তাসফি নিস্তব্ধ যাওয়ার সময় কিচ্ছুটি বলল না।শুধু দেখে গেল। যাক যেখানে খুশি যাক তাতে তার কি।
তার কি আশে যায়।সে কেন চিন্তিত হবে।
তাসফি সোফায় বসে ছিল।মোস্তফা সাহেব তার কাছে এগিয়ে গিয়ে মেয়ের পাশে বসলেন সোফায়।
বাবাকে দেখে তাসফি বাবার কোলে মাথা রাখলো।
ভদ্রলোক নিঃশব্দে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন।
জিজ্ঞেস করলেন,

-” ওবাড়িতে সব ঠিকঠাক তো মামনি? কোনো সমস্যা নেই তো?”
তাসফি মুচকি হেঁসে বলল,
-” ওবাড়িতে সব ঠিকঠাক বাবা
আর সবাই খুব ভালো।তুমি আমায় নিয়ে একদম চিন্তা করবে না বুঝলে। নিজের শরীরের দিকে খেয়াল করো।দিন দিন কেমন শুকিয়ে যাচ্ছো দেখেছ।”
ভদ্রলোক মেয়ের কথায় মুচকি হাঁসে। মনে মনে বলে,
“শরীর তো সেই কবেই শেষ মামনী এখন আর নতুন করে কিছু শেষ হবার নেই তো। এই রক্ত মাংসের গড়া আদল কি আর দীর্ঘস্থায়ী হয় কখনো?তার বেলা যে ফুরাবেই।”

আয়েশা রান্না বান্না কাজে মেজ চাঁচি কে একটু সাহায্য করছে নিজে থেকে সেধে।
সে তো তাকে রান্না ঘরে আসতেই দেবে না।
মানুষ টা খুব ভালো মনের।
আয়েশার মনে হচ্ছে তার নতুন মা কে পেয়েছে।ভদ্রমহিলা ভীষণ আদর করছে তাকে।
বহুকাল বহু জনম পর মা মা গন্ধ পাচ্ছে সে চাঁচি হতে।
আচ্ছা তার মা যদি থাকতো তবে কি এমনই মিষ্টি হতো?
এই তো কিছু ক্ষণ পরেই খাওয়া দাওয়া শেষে একটু রেস্ট নিয়ে তারা বের হবে তার শ্বশুর বাড়ির উদ্দেশ্যে।আবার কবে আসে বলা তো যায়।পরবর্তীতে আসার সৌভাগ্য হবে কিনা তা উপর ওয়ালাই ভালো জানেন।

রাত তখন এগারো টা কি সাড়ে এগারো টা।
নিস্তব্ধ’র বাসার গলির মোড়ের এই চায়ের দোকানটাই শুধু খোলা রয়েছে।সেখানে আজ বসেছে বন্ধুদের গল্পের আসর।তবে আজ গল্পের বদলে নিস্তব্ধ’র অস্বাভাবিক আচরণের দিকেই সবাই হতবাক হয়ে চেয়ে আছে।
কে কি বলবে না করবে কিছুই বুঝতে পারছেনা।
এমন অদ্ভুত আচরণ করছে কেন ছেলেটা কেউ কিছুই বুঝছেনা।
যে ছেলে একটা সিগারেট পর্যন্ত ছোঁয় না।সেখানে সে একের পর এক একটা সিগারেট শেষ করেই যাচ্ছে।
নিস্তব্ধ প্রথমে দোকানে এসে কারো সঙ্গে টুশব্দ বিনিময় না করে,চায়ের বদলে বলল,

-” মামা এক প্যাকেট সিগারেট দিয়েন তো।”
দোকানদার মামা তাজ্জব বনে নিস্তব্ধ দিকে তাকিয়ে রইলো।কারণ নিস্তব্ধ কখনো সিগারেট খায় না।আর কখনো চায় ওও নি।দোকানদার মামা শিওর হওয়ার জন্য বলল,
কি বলো আব্বা তুমি সিগারেট খাইবা?
নিস্তব্ধ তার পাংশুটে গলায় বলল,
-” জ্বী।দিন মামা।”
এই তো কদিন আগে মাহীন নিস্তব্ধ কে বলেছিল,
“ভাই একটা সিগারেট খা না প্লিজ। একটা খেলেতো কোনো মহাভারত অসুদ্ধ হচ্ছে না ভাই।!
নিস্তব্ধ তখন শক্ত গলায় বলল,,
— “মাহীন তোরা জানিস আমি সিগারেট খাই না।”
সুজন দুষ্টু হাসলো কৌতুক করে বলল,,

–” কেন ভাই? আগে নাহয় খেতে না তোমার ওই গোলাপি ঠোঁটখানা কালো হয়ে যাবে।মেয়েরা তোমায় পছন্দ করবেনা বলে। বিয়ে ওও হবে না।
কিন্তু আঙ্কেল তো তোমার পথ সুগোম করে দিয়েছে।আমরা সুন্দরী ভাবী পেয়েছি।তুমি কচি বউ পেয়েছো।
এখন তো আর তোমার ভয় পাওয়ার কারণ দেখছি না বন্ধু..। নাকি অন্য মেয়ে পটানোর ধান্দা করছো হুম হুম?
নিস্তব্ধ চোখ লাল করে কটমট করে চাইলো ওর দিকে।
পিঠে বসালো ঘুসি।
শিকারি লোচনে চোখ ছোট ছোট করে বলল,,

–” তোর নাটক বন্ধ কর সুজন।আর বন্ধ না হলে আমি ব্যবস্থা করবো।তোর তিন নম্বর গার্লফেন্ডের তথ্য কিন্তু আমার কাছে আছে।তোর প্রেম চাঙে ওঠাবো আমি। আন্টির কাছে সব তথ্য লিক করতে আমার এক মিনিট ও সময় লাগবে না।”
বন্ধুর নিরব হুমকিতে সুজন চোখ বড় বড় করে চাইলো।বুঝলো লক্ষণ বেশি সুবিধার না।
সে খপ করে নিস্তব্ধ’র এক হাত চেপে ধরলো।
হা-হুতাশ এর নাটক করে বলল,,

–” এই কথা তুই বলতে পারলি বন্ধু। কেমনে পারলি। তুই জানিস এই চামিলিকে কত কষ্ট করে পটিয়েছি।
আর তুই আমার বাড়া ভাতে পানি ঢালতে চাইছিস বন্ধু। তুই এমন করে আমার প্রেমে ব্যাগড়া দিলে তোর মেয়ের সঙ্গে আমার ছেলের বিয়ে দেব কিভাবে।
আগের দুটো তুই ভেঙেছিস।এমন করিস কেন বল।
নিস্তব্ধ বিস্মিত কন্ঠে বলল,,

–“কার মেয়ে?কার ছেলে?
— কেন তোর মেয়ে আমার ছেলে।এমন ভাব করছিস যেন আমরা কোনোদিন কাকা ডাক শুনবো না।
— তুইকি তোর চামিলি কে বিয়ে করবি?
— আসতাগফিরুল্লাহ, না না প্রশ্নই উঠে না।
নিস্তব্ধ দুইভ্রু উঁচিয়ে বলল,
–” তারমানে এটাও টাইমপাস তাইতো?
সুজন একবার ডানে বামে মাথা নাড়লো অর্থাৎ হ্যাঁ পুনরায় জ্বিব কামড় দিয়ে উপর নিচ মাথা নাড়লো।
এইরে ভুল সংকেত দিয়ে ফেলেছে সে।
নিস্তব্ধ বলে উঠলো,

–” দাঁড়া তো ছেলে মেয়ে বিয়ে দেওয়া আমি ছুটাচ্ছি।
সৃজন সহ সবাই উচ্চ স্বরে হেঁসে দিলো সঙ্গে দোকানিও।
সুজন করুন চোখে তার হারামি বন্ধুগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে।দেখ তার বিপদের সময় কেমন দাঁত বের করে হাসছে সয়তানগুলো।
সুজন হাত জোর করে বলল,
-” মাফ চাই দোস্ত তোর কাছে মাফ চাই।তোর কোনো সিগারেট ফিগারেট খাওয়া লাগবে না। মেয়ে ছেলে বিয়ে দেওয়াও লাগবে না।

নিস্তব্ধ ভেবে পায় না এমন দুষ্টু একটা বন্ধু সে তার বাল্যকাল থেকে সহ্য করে এলো কেমন করে।পরক্ষণেই অতীতে বন্ধুদের দুষ্টুমির কথা ভেবে আড়ালে ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো।
অবশ্য নিস্তব্ধ ও জানে ওগুলো কোনো প্রেম নয়।ম্যাসেন্জারে হাই হ্যালো পর্যন্তই।মন দিয়ে রেখেছে তো তৃপ্তি কে। এক মনের দবিদার কি অন্য কাউকে দখল দেওয়া সম্ভব? উহু সম্ভবই নয়।
সপ্তাহের এই দিনটাই তো তারা একটু আড্ডা দেওয়ার সময় পায়।সবার জীবনেই কর্ম ব্যস্ততা।তবে সবার মাঝে এ-ই সৃজনটাই আলাদা। ওও বুদ্ধিমান ছেলে।বাবার বড় ব্যবসা সে একা হাতে সামলায়।পরিবার,বউ বাচ্চা কে সময় দেয়।
সুজনে ক্রমাগত খোঁচানোতে মাহীন ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো।
মাহীন বিরক্তি নিয়ে বলল,

-” কি হয়েছে।”
সুজন ফিসফিস করে বলল,
-” আরে ভাই নিস্তব্ধ কে দেখ,থামা ওকে। কি অবস্থা করেছে দেখ এক প্যাকেট তো শেষ।কিছু বল।”
মাহীন তাকিয়ে দেখলো আসলেই।অবস্থা তো খারাপ।কোনোদিন সিগারেট না খাওয়া ছেলেটা।একের পর এক সিগারেট খাচ্ছে। চোখ মুখ লাল টকটকে হয়ে গেছে।মাঝে মাঝে কাশছে ও।
মাহীন সৃজন কে ইশারা দিলো।
সৃজন নিস্তব্ধ’র কাঁধে হাত রাখলো।
নিস্তব্ধ হাত থেকে সিগারেট কেড়ে নিলো জোড় করে।অতঃপর বলল,

-” কি হয়েছে দোস্ত। এমন করেছিস কেন।আমাদের বল। দেখি কোনো সল্যুশন দিতে পারি কি না।আরে তোর এতগুলো বন্ধরা থাকতে তোর কিসের চিন্তা বলতো।ভাবীর সাথে ঝগড়া করেছিস?”
নিস্তব্ধ মাথা নাড়লো।
সুজন আবার জিজ্ঞেস করলো -“তাহলে?”
নিস্তব্ধ কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকলো।
অতঃপর মুখে চোখে মুখে অস্বাভাবিক ভাবে হাত বুলিয়ে বলল,

-” তাসফির বাবা হসপিটালে।ওও খুব কাঁদছে সৃজন আমি কি করবো বল কিছু বুঝতে পারছি না।ওও ওও জানলে কি করবে আমি জানিনা। ওও একদম ভেঙে পরবে । কি করে বলবো আমি ওকে এই কথা?বল?”
সুজন এগিয়ে এলো।নিস্তব্ধ কেন এতটা ভেঙে পরতে সে আগে কখনো দেখেনি।তাদের এমন শক্ত সামর্থবান বন্ধুটা কেন হঠাৎ করে এমন অদ্ভুত আচরণ করছে।
সৃজন নিস্তব্ধ কে ধরে বলল,
-” কি হয়েছে আমাদের বল।এমন করছিস কেন।কে থমকে যাবে।তাছাড়া আঙ্কেলের কি হয়েছে বল আমায়। ভাবী জানে না আঙ্কেল হসপিটালে?”
নিস্তব্ধ বলল,

-” জানে।”
-” তাহলে কি জানলে থমকাবে।ক্লিয়ার করে বল নিস্তব্ধ।এমন করিস না দোস্ত। দেখ সব কিছুরই তো পজিটিভ, নেগেটিভ দিক আছে।”
নিস্তব্ধ চোখ বন্ধ করে বিকালের সেই হৃদয় বিদারক স্বচ্ছ কিছু ঘটনা মনে করার চেষ্টা করলো।সব কিছু পরিষ্কার তবুও নিস্তব্ধ’র মনে হচ্ছে কোথাও যেন অন্ধকার, হাহাকারে মোড়া।

ধূসর রংধনু পর্ব ১৮

মানুষের জীনবন সবসময় কেন সুখের হয় না।
মাঝে মাঝে কেন দুঃখ গুলো কে হৃদয় নিংড়ে বের হয়ে আসতে হয়।কেন আকরে ধরে থাকা যায় না, সুখের মুহুর্তগুলো মুঠো করে রাখা যায় না কি?দুঃখগুলো হানা দিয়ে কি সুখ খুঁজে পায়?

ধূসর রংধনু পর্ব ২০