ধূসর রংধনু পর্ব ২৪
মাহিরা ইসলাম
কিছুক্ষণ আগের ঘটনা,,
তাসফি ঘুমিয়ে ছিল রুমে। হাজারো চিন্তা ভাবনার মাঝে সে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে।অতঃপর তার চোখে ঘুম ধরা দিয়েছে প্রায় ভোরের দিকে।
সকাল তখন দশটা বাজবে বোধহয়। বেলকনির খোলা দরজা দিয়ে সূর্যের উজ্জ্বল রশ্মি ক্রমাগতই উঁকি মারছে রমণীর রুম জুড়ে। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে ফেলছে সে।
তার মাঝেই শ্বশুর বাড়ির লোক সহ নিস্তব্ধ’র বন্ধু’গন ঝাঁপিয়ে পড়লো তার রুমে।দরজা খোলা পাওয়ায় ঢুকতে বেগ পেতে হয়নি তাদের।মন খারাপের মাঝেও তাদের সমস্ত হৈ-হুল্লোড় যেন শুধু তাসফির মুখের একটুকরো হাসি ধরে রাখতেই।
দিনের মতো উজ্জ্বল, প্রানবন্তই তো তাকে মানায়।এমন নিঃস্পৃহ, ক্লান্তিকর মুখশ্রীতে তো তাকে শোভা পায় না।
বাসন্তী আর আরশী এগিয়ে গেল খাটের দিকে।বাকিরা একে একে এসে দাঁড়ালো।
আরশী তাসফির মাথায় টোকা মেরে বলল,
-” এই তাসফি উঠো তো সেই কখন তোমাকে নেওয়ার জন্য আমরা এসে বসে আছি বাফু।আর তুমি কিনা নাক ডেকে ঘুমাচ্ছো।এটা কিন্তু মোটেও ঠিক নয়।”
বাসন্তী বলল,
-” হ্যাঁ তাইতো।এই তাসফি ওঠ তো।দেখ সকাল সকাল আমরা সবাই তোর জন্য চলে এসেছি আর তোরই কোনো পাত্তা নেই তুই কিন্তু আমাদের এই ভাবে অপমান করতে পারিস না।”
দাদু বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-” আহাঃ তোরা দিদিভাইকে কেন ডিস্টার্ব করছিস। মেয়েটা অনেক রাতে ঘুমিয়েছে বোধহয়।তোরা এসেই হাঙ্গামা করছিস। দিদিভাই যখন উঠবে তখন নিয়ে যাস, সে তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না কোথাও।”
তাসফি চোখ পিটপিট করে উঠে বসলো। নাক টেনে ম্লান কন্ঠে বলল,
-” ঠিকআছে সমস্যা নেই দাদু।বলো তোমরা কি বলছিলে।”
মাহীন বলল,
-” কি ব্যাপার বলো তো তাসফি নিস্তব্ধ’র মতো তুমিও ঠান্ডা বাঁধিয়ে ফেললে নাকি।”
তাসফি আবারে নাক টেনে বলল,
-” ওই আসলে একটু ঠান্ডা লেগেছে বোধহয়।তোমরা কোথায় যেন যাওয়ার কথা বলছিলে?”
বাসন্তী বলল,
-” হ্যাঁ তোর শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার কথাই বলছিলাম।
তোকে সবাই মিলে ওও বাড়ি নিয়ে যেতে এসেছি। এখন আঙ্কেল ও নেই এখানে থেকে আর কি হবে বল।
দ্রুত ব্যাগ গুছিয়ে নে।না না তোর গোছানোড দরকার নেই , আমিই গুছিয়ে নিচ্ছি। ”
অনিমা বেগম তাতে সায় দিলেন,
-” হ্যাঁ আজই বরং চলে এসো।এই পরিবেশটাও তোমার জন্য এখন অস্বস্তিকর।”
-” কিন্তু আমি তো আর ওসমান ভিলায় যাচ্ছি না দাদু।
ডাঃ নিস্তব্ধ ইয়াসার কে আমি ডিবোর্স দিতে চাই।অনেক তো হলো তাসের ঘর করা।যেখানে ভালোবাসা নেই সেখানে সংসার টিকবে কেমন করে।জানি বলবেন ভালোবাসা ব্যতীত অনেকে আজীবন কাল সংসার করে যাচ্ছে। কিন্তু আমার দ্বারা ভালোবাসা ব্যতীত কোনো সংসার করা পসিবল নয়।তাছাড়া বাবাই যেহেতু বিয়েটার ভিত্তি ছিল তবে যেখানে বাবাই নেই সেখানে আর বিয়েটার কি দরকার।আমার দিন আমি ঠিক চালিয়ে নিতে পারবো।কথাটা আপনার নাতি কে স্পষ্ট করে বলে দেবেন দাদু।”
বাসন্তী ব্যাগ গেছানোর তাগিদে পা বাড়িয়েছিলো কেবলি কিন্তু তা আর সম্পূর্ণ করা হলো না তাসফির উক্ত বাক্যব্যয়ে।হতভম্ব হয়ে পিছু ঘুরে চাইলো সে।
মাহীন সৃজন ওরা দাঁড়ানো থেকে ঠাস করে বসে পড়লো ফ্লোরে।
বর্তমানে,
সুজন সব শুনে আপসোসের স্বরে বলল,
-” সর্বনাশ।তার ইগোওয়ালা বন্ধু তো দিশেহারা হয়ে যাবে।যে পাগলামি করলো সেদিন।এখন যদি শোনে ডিবোর্স দেবে তার বউ তোকে নিস্তব্ধ ব্যাটা কি রিয়েক্ট দেবে আমি তো তা জানার জন্য মশগুল হয়ে আছি।ইশশ খবর আমায় আর একটু আগে দিবি না।ক্লাইম্যাক্স সব খবর গুলো তোরা দেরিতে দিস কেন বলতো।”
সুজন ওদের মতো ফ্লোরে বসে থাকলো না। উঠে তাসফির দিকে এগিয়ে গিয়ে কৌতূহলী হয়ে সুধালো,
-” বোন তুমি কি সত্যিই ওই নিস্তব্ধ ব্যাটা কে ডিবোর্স দেবে? ভেবে বলছো তো?”
তাসফি সুজনের দিকে তাকিয়ে শক্ত কন্ঠে বলল,
-” হ্যাঁ ভাইয়া আমি সত্যিই আপনাদের বন্ধুকে ডিবোর্স দেব।আর এটাই ফাইনাল। কাল আমি অনেক ভেবেছি।ভাববেন না হুট করে আমি কোনো সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
বাসন্তী তাসফির হাত চেপে ধরলো।তাদের দুইভাইবোনের কি একই পরিনতি হবে তাহলে।কাল বাদে পর্শু তার ডিবোর্সের তারিখ।আর এখন কিনা তার ভাইটারও…কোথাও সমীকরণ মেলাতে তারা ভুল করে বসেনি তো।
সুজন তাসফি কে বাহবা দিয়ে বলে উঠলো,
-” একদম ঠিক বলেছো তুমি তাসফি।ওর মতো অপদার্থ বন্ধুকে ডিবোর্স দেওয়াই উচিত। সালার দ্বারা একটা কাজ যদি হয়। বিয়ের তিন মাস হয়ে গেল এখন পর্যন্ত আমাদের একটা সুখবর পর্যন্ত শোনাতে পারলো না। আর কবে চাচা ডাক শুনতে পাবো আমরা বলো তো? ব্যাটা এক নম্বরের হাড়ামী।”
আয়ানা চোখ গরম দিলো সুজন কে।
সঙ্গে সঙ্গে সুজন জ্বিবে কামড় দিলো।এই রে মিস্টেক!সিরিয়াস টাইমিংয়ে গুরুজনদের সামনে ভুল রিয়াকশন দিয়ে ফেলেছে সে।
দাদু তাসফি দিকে এগিয়ে গেলেন, নিঃশব্দে তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,
-” দিদিভাই তুমি শিওর তো নিস্তব্ধ দাদভাই কে ডিবোর্স দিতে চাও? আর একবার ভেবে নিতে পারতে কিন্তু। ”
তাসফি বলতে গেল,” হ্যাঁ দাদু আমি ভেবেই..?”
বলার আগেই তাসফির দাদি কমলা বেগম লাঠি ভর দিয়ে এগিয়ে আসতে আসতে হুংকার ছেড়ে বললেন,
-” না কোনো ডিবোর্স হবে না।ওও বুঝে কি এইটুকুনি একটা মাইয়্যা।সম্পর্কের মানে ওও বুঝে কি।কোনো ডিবোর্স ওও কাউকে দেবে না। ”
তাসফি বিরক্তি নিয়ে ভ্রু কুঁচকে দাদির দিকে চেয়ে বলল,
-” তোমার যখন এতোই সমস্যা, তাহলে আমার বদলে তুমিই গিয়ে সংসারটা করে আসো না বুড়ি।”
কমলা বেগম চোখ বড় বড় করে নিলেন,
মা*গী কয় কি।
কমলা বেগম কিছু বলার আগেই অনিমা বেগম তাকে থামতে বলে শক্ত কন্ঠে বললেন,
-” তাসফি ঠিকই বলেছে।আমার মনে হয় এবার ওদের ডিবোর্সটা দেওয়াই উচিত মাওয়ই মা।আমার ছেলে অতি বার বেড়েছে।তার একটা শিক্ষা পাওয়া উচিত।
তাসফির সঙ্গে সে যেই ব্যবহার গুলো করেছে তাসফি শক্ত মনের তাই সবটা গিলে নিয়েছে। অন্য কেউ হলে এতগুলো দিনও থাকতো না ওবাড়িতে।তাছাড়া তাসফি তো ঠিকই বলেছে,যে জন্য বিয়াইসাব বিয়েটা দিয়েছিলেন তার তো কিছুই হচ্ছে না। তাহলে বিয়েটা এগিয়ে নিয়েই বা লাভ কি।”
দাদু কিছু বলতে গেলে অনিমা বেগম তাকে হাতের ইশারায় থানিয়ে দিলেন।বললেন,
-” থামুন বাবা।আর কিছু শুনতে চাই না। তাসফি যা বলেছে তাই হবে।তাসফি এখানেই থাকবে। আর আপনার নাতিকে সব বলার দ্বায়িত্ব আপনার।বিয়ের প্রস্তাবটা যেহেতু আপনি দিয়েছিলেন ভাঙার প্রস্তাবটা ওও নাহয় আপনিই দিয়েন।”
অতঃপর অনিমা বেগম তাসফির মাথায় আদুরে হাত বুলালেন।
তাসফি তার কোমর জরিয়ে ধরলো,
তিনি ফিসফিস করে বলল,
-” চিন্তা করো না আমার মিষ্টি মেয়ে।সব ঠিক হয়ে যাবে।তুমি যা চাও তাই হবে।শুধু নিজেকে একটু শক্ত রেখো বুঝলে।আসি আজ কেমন। আমার পাগল ছেলেকে নাকে দঁড়ি দিয়ে ঘুরিয়ো কেমন।তার হাড় মাংশ এক করে ছাড়বে বুঝলে।”
তাসফি ফুফিয়ে কেঁদে উঠলো।
অনিমা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাকে আদর করে বেরিয়ে গেলেন।
তাসফিও রুমের বাইরে বেরিয়ে এলো।তার পিছু পিছু সবাই এলো।
যার জন্য আশা সেই বাইরে যাচ্ছে তাদের থেকে আর কি কাজ।
সন্ধ্যায় বাড়িতে পৌঁছে দাদু ওসমান শেখ কিছুতেই নাতির কাছে ডিবোর্সের বিষয়টা তুলতে পারলেন না। আসলে তারই ভয় করছে।নিস্তব্ধ কি রিয়াকশন দেবে তাই ভেবেই তিনি কুল পাচ্ছেন না।
এদিকে তার বউমা সমানে চাপ দিয়ে যাচ্ছে। খুঁচিয়ে যাচ্ছে কথাটা বলতে।
ওদিকে তাসফিও বারবার ফোন দিয়ে জানতে চাচ্ছে বলেছে কি না। দ্রুত সে ডিবোর্স চায় এ বাঁধন থেকে সে মুক্তি চায়।
ভদ্রলোক পড়েছে গ্যাড়াকলে।
ছেলেকে কথাটা জানালে ছেলেও তাসফিকেই সাপোর্ট দিয়েছে।ভেবেছিলেন ছেলেটা একটু বুঝবে। কিন্তু তিনি তো ভুলেই গিয়েছিলেন সারাদিন ঝগড়া করলেও বউমা আর ছেলে তার এক ধাঁচের।
এখন কি করে তিনি কথাটা তুলবেন নিস্তব্ধ’র কানে।বাসন্তীর কাছে থেকে কিছু টিপস নিতে হবে।মেয়েটাও আছে দুঃখের সাগরে।কাল বাদে পর্শুই তার ডিবোর্স।
মাঝে কেটে গেছে আরো একটি দীর্ঘ দিন।আজ বাসন্তীর কোর্টে হাসিবের সঙ্গে ডিবোর্সের তারিখ।সঙ্গে রাস্কেলটাকে জেলের ভাত খাওয়াবে আজ সে।
হালকা মন খারাপ ভাব কাজ করলেও। মনের মাঝে আজ সে অদ্ভুত প্রফুল্লতা অনুভব করছে সে। এতদিনের টানাপোড়ন থেকে আজ সে মুক্ত হবে। নিজের মতো করে বাঁচতে পারবে এতেই যেন তার সুখ।
কোর্টের বাইরে বাসন্তী হাসিবের দিকে ঘৃণা নিয়ে চাইলো।
হাসিব বাসন্তীকে প্রত্যেক বারের মতো মারতে তেড়ে আসলে সবাই তাকে ধরে আটকালো।নিলয় সাহেব তাকে শাসালো।
বাসন্তী তাচ্ছিল্যে হাঁসলো। এইতো তা স্বামী আগের ফর্মে ফিরে এলো। কোথায় গেল কদিন আগে তার রুমে বসে পায়ে ধরে মাফ চাওয়া।ফিরে যাওয়ার জন্য কাকুতিমিনতি করা। সবই ছিল নাটক।হাহ।
বাসন্তী ডিবোর্স পেপারে সই করে হাসিবের দিকে থুথু ফেলে বেরিয়ে এলো। সাথে দিয়ে এলো বিশ্ব জয়ের হাসি।বাবার ওই রাস্কেলটার নামে মানহানীর মামলার সঙ্গে, নারী নির্যাতনের মামলা দিয়েছে।এবার পঁচে মরুক ওই জেল খানায় তার প্রাক্তন স্বামী।হ্যাঁ তার প্রাক্তন স্বামী।আজ থেকে সে মুক্ত। স্বাধীন সে সংসারের বেড়াজাল থেকে।
বাসন্তী দু হাত মেলে খিলখিল করে হাসলো।
কি অদ্ভুত মানব জীবন কারো ডিবোর্সে চিত্ত খুশি হচ্ছে তার।আবার কারো ডিবোর্সের কথা শুনে তার একই মন হালকা কেঁপে উঠছে অজানা আশঙ্কায়।
সন্ধ্যা বেলায় ওসমান ভিলায় সবাই প্রফুল্ল চিত্তে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে চা পান করছিলো।
তখনি বাসন্তীর ফোনে তাসফির ফোন এলো।
বাসন্তী ইতস্তত করে ফোনটা তুললো।
ফোন তুলতেই ওপাশ থেকে তাসফির ভাবলেশহীন কন্ঠ ভেসে এলো,
-” তোমার ভাইকে জানিয়েছো আপা?”
এইরে বাসন্তী এই ভয়টাই পেয়েছিলো।
সে আমতা আমতা করে বলল,
-” হ্যাঁ হ্যাঁ এই তো এখনি বলবে। এখনি বলবে। বলার জন্যই আমরা সবাই বসেছি।”
তাসফি কৌতুক করে বলল,
-” বা,বা এইটুকু কথা বলতে তোমাদের সবাইকে নিয়ে বসতে হচ্ছে। ইন্টারেস্টিং, ভেরী ইন্টারেস্টিং। ”
বাসন্তীর কথা বলার ধরণ দেখে নিস্তব্ধ ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো,
-” কার সঙ্গে কথা বলছিস এমন আমতা আমতা করে?”
বাসন্তী ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বোকা হাসার চেষ্টা করলো।
নিস্তব্ধ ভ্রু কুঁচকেই তাকিয়ে রইলো।
ভাইয়ের এভাবে তাকানো তে বাসন্তীর আরো অস্বস্তি লাগলো।ওখান থেকে উঠে বারান্দায় গিয়ে আরো কিছু কথা বলে ফোন কেটে ড্রয়িংরুমে এলো সে।
বাসন্তী ফোন কাটতেই তাসফির পাশে বসা আনিকা কৌতূহলী হয়ে বলল,
-” দুলাভাই কে কি সত্যিই ডিবোর্স টা দিয়ে দিবি রে তাসফি।”
তাসফি ভাবলেশহীন কন্ঠে বলল,”হ্যাঁ”
আনিকা আগ্রহ নিয়ে বলল,
-” কেন রে সে তো দেখতে একদম মাশআল্লাহ।কি ফিগার। ডিবোর্স কেন দিবি শুধু শুধু।আমি হলে তো সারাক্ষণ আঁচলে নিয়ে ঘুরতাম।”
তাসফি আনিকার কানে কানে ফিসফিস করে বল,
ধূসর রংধনু পর্ব ২৩
-” ওই অহংকারী লোকটার উপরের ফর্সা চামড়া আর ফিগার টাই শুধু সুন্দর বুঝলি।ভেতরটা একদম পঁচা নারিকেলের মতো দুর্গন্ধযুক্ত।ভুলেও ওদিকে নজর দিস না সাবধান।”
আনিকা ড্যাব ড্যাব করে তাসফির যাওয়ার পানে তাকিয়ে তার কথার সারাংশ বোঝার চেষ্টা করলো।তাসফি কথার আগা মাথা কিছুই তার বোধগম্য হলো না।