ধূসর রংধনু পর্ব ৪

ধূসর রংধনু পর্ব ৪
মাহিরা ইসলাম

** দুুপুরের বাকি সময়টা তাসফির ড্রয়িংরুমেই পান্নার সঙ্গে দুষ্টুমি করেই কাটলো। রুমের মাঝে বসে আছে অহংকারী দেমাগী ডাক্তার, তার সামনে যাবার তাসফির কোনো রকম ইচ্ছে নেই।
দাদু যখন নিস্তব্ধকে তাদের বাড়ি যাওয়ার বিষয় কথা উঠালো, অসভ্য ডাক্তার এককথায় না করে দিলো।সে এখন কোথাও যেতে পারবে না।এই তার শেষ কথা।
তাসফির ইচ্ছে হলে সে যেন একা চলে যায়।

যা বাবা এটা কেমন কথা সে কি করে একা একা চলে যাবে।বর ছাড়া নতুম বউ বুঝি একা একা বাপের বাড়ি চলে যায়। কেউ কখনো শুনেছে এমন কথা।
বিকালের দিকে হঠাৎ কলিংবেল বেঁজে উঠলো।রুম্পাটাও আশেপাশে নেই।সকলে তখন ভাতঘুমে থাকায় তাসফি নিজেই গিয়ে দরজা খুলে দিল।
সঙ্গে অবলোকন করলো পাঁচ ছয়জন যুবক- যুবতীর অচেনা,অজানা হাস্যউজ্জ্বল মুখশ্রী।তবে সবার মুখ হাস্যউজ্জ্বল নেই।ছয়জনের মাঝে একজন দাঁড়িয়ে আছে মুখ আমাবস্যা মতো অন্ধকার বানিয়ে।
–“কাকে চাই?”
যুবক -যুবতীগন কিছুক্ষণ ড্যাব ড্যাব করে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো।প্রশ্নের জবাব না দিয়েই তারা হুট করেই ভিতরে ঢুকে পরলো।
তাসফি আশ্চর্য হয়ে গেল।এ কেমন অসভ্যতা।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

–” একি আপনারা কিছু না বলে ভিতরে ঢুকছেন কেন। বললেন না তো কাকে চাই?”
মাহিন মাথা চুলকে বোকা হেঁসে বলল,,
“নিস্তব্ধ, নিস্তব্ধ কে চাই আমরা।
নিস্তব্ধ বাসায় নেই? আজ তো ওর বাসায় থাকার কথা।”
তাসফি কিছুটা ভাবুক স্বরে বলল,
–” জ্বী আছে তো।”
তাসফি বিরবির করলো,” বদমাশ ডাক্তার বাসায়ই আছে।”
বিরবির শুনে মাহীম আবার প্রশ্ন করলো,
কিছু বললেন?
তাসফি দাঁত কেলিয়ে মেকি হেঁসে বলল,

” হে হে কই নাতো। কিছুনা।”
সুজন মাহীন কে সরিয়ে বলল,,
” এই তুই সর তো ওই ব্যাটা কে ডাকতে দে।বউ নিয়ে ঘরে বসে ওর রোমান্স করা বের করছি।রোমান্সের শষ্টি করবো ওর আজ।”
নিস্তব্ধ, নিস্তব্ধতা। এই ব্যাটা নিস্তব্ধতা নিচে নাম।
সালা সারাক্ষণ নামের মতো ঘামটি মেরে থাকে।
হঠাৎ যুবতীদের মাঝে থেকে অমাবস্যার মতো মুখ করে থাকা লেডি ভ্রু কুঁচকে গম্ভীর মুখে প্রশ্ন করলো তাসফিকে,,
“তুমি কে তোমায় তো আগে কখনো দেখিনি। নতুন কাজের লোক নাকি।”

তাসফির চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো। সে কাজের লোক কেন হতে যাবে, তার সাজ পোশাক কি কাজের লোকের মতো আশ্চর্য ।তাসফির পড়নে দামি থ্রী পিচ, হাতে সোনার গয়না,কানে দুল, গলায় স্বর্ণের চেইন তাকে কোন দিক দিয়ে এই অসভ্য মেয়ের তাকে কাজের লোক মনে হলো।সে ঠাই দাঁড়িয়ে থেকে মেয়েটার দিকে তাকালো। আগন্তক মেয়েটি অত্যন্ত সুন্দরী বলা চলে।পায়ের রং ধবধবে ফর্সা। তবে চাল চলন একদম নিম্ন লেভেলের। পরনের পোশাক লো ক্লাস। টাইট জিন্স,আর টি শার্ট পড়নে,হাতে কেমন অসভ্য অসভ্য বেসলেট। কই অন্য মেয়ে দুটি তো এমন পোশাকে নেই। তাদের তো বেশ সাবলীল বেসভুসা , তাদের পড়নে কুর্তি।তবে এই ডেমনি মেয়ের এই অবস্থা কেন।
অসভ্য মেয়েটার কথার কোনো জবাব দিলো না তাসফি। এমন লো ক্লাস মেন্টালিটির কাউকে উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করছে না সে।

পান্না বুঝতে পারলো মেয়েটি তার কাকিয়া কে কাজের লোক বলেছে।
ছোট্ট পান্না সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে উঠলো।
তার কাকিয়া কে জরিয়ে ধরে তৃপ্তির দিকে রাগী চোখে বলল,,
— “কাজের লোক নয়।কাজের লোক নয়। আমার কাকিয়া। তুমি কাজের লোক কেন বলছো।”
–” আহাঃ পান্না সোনা অসভ্য মেয়েদের সঙ্গে তর্ক করতে নেই।যাও সোনা তোমার কাকাই কে ডেকে নিয়ে আসো তো যাও।”
তৃপ্তি পান্নার কথায় কোনো পাত্তাই দিলো না,উল্টো ফুঁসে উঠে বলল,

–” এই, এই মেয়েটা আমায় কি বললো সৃজন,আমায় অসভ্য বললো কোন সাহসে।বাড়ির কাজের মেয়ে আমায় অসভ্য বলল এই অপমানের জবাব নিস্তব্ধ কে দিতেই হবে।”
তাসফি ভাবলেশহীন মুখে দাঁড়িয়ে রইলো।
সুজন মেয়েটাকে ধমকালো,,
আহা তৃপ্তি থামনা। কি শুরু করলি তুই।
ডাকাডাকি শুনে নিস্তব্ধ নিচে নেমে এলো। দেখতে পেল তার বদমাশ বন্ধুর দলকে।
— “তোরা? তোরা আজ আসবি আমায় তো আগে জানাস নি?”
মাহীন রসিকতার স্বরে বলল,

— “কেন ভাই তোকে সবসময় বলে আসতে হবে কেন। এবার তো আমরা তোর কাছে আসিনি। আমরা এসেছি ভাবিকে দেখতে। সে কোথায় ডাক তাকে।”
নিস্তব্ধ আড় চোখে তাকালো তাসফির দিকে। দেখ পুঁচকে মেয়ে কেমন ডাগর ডাগর চোখ করে এদিকেই তাকিয়ে আছে।
তৃপ্তি চিৎকার করে বলল,,
তোর বউ পরে দেখে নেবো। আগে আমার অপমানের জবাব দে তুই।
তৃপ্তির কথায় নিস্তব্ধ ভ্রু কুঁচকে নিলো,,
— হোয়াট?

–” এই কাজের মেয়েটা আমায় অসভ্য বলেছে। তুই এর বিচার কর। এই মেয়েটা কেন আমায় অসভ্য বলল? ওর সাহস হয় কি করে ডাক্তার তৃপ্তি আহসান কে অসভ্য বলার।”
তাসফি চোখ বড় বড় করে চাইলো,” ও খোদা এই অসভ্য বেশভুসার মেয়ে নাকি আবার ডাক্তার। এ ডাক্তার হলো কি করে।নিশ্চিত টুকলি করে প্রুফ দিয়েছে। ডাক্তাররা বুঝি এমন চিপ মেন্টালিটি, ন্যারো মাইন্ডের হয়।”
তৃপ্তির কথায় নিস্তব্ধ রেগে গেল। সে তার বউকে এখনো বউ হিসাবে মানে না তার মানে এই নয় যে তার বউকে কেউ কাজের লোক বলবে। তাসফি কোনোদিক দিয়ে কাজের লোক হয় । তৃপ্তির সুন্দর হলেও তার চেয়ে হাজার গুন নাচ্যারাল সুন্দর তাসফি তা নিস্তব্ধ মানতে বাধ্য।তাছাড়া একটা মেয়েকে তো সে বাইরের করো কাছে অপমান হতে দিতে পারে না।যতই তারা তার বন্ধু হোক। সে ঘরের মাঝে যা খুশি করতে পারে।
নিস্তব্ধ তৃপ্তির উদ্দেশ্যে রাগী স্বরে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,,

–” ফাস্ট অফ অল তাসফি ইস নট এ্যা সার্ভেন্ট।
এ্যান্ড সেকেন্ডলি সি ইজ মাই ওয়াইফ। ”
তাই গলা টা নামিয়ে কথা বলবি তৃপ্তি। তোকে কেউ অধিকার দেয়নি আমার ওয়াইফ এর সঙ্গে গলা উঁচু করে কথা বলতে,বা কাজের লোক বলতে।”
তাসফি তাকিয়ে রইলো রাগে চোয়াল শক্ত করে রাখা অহংকারী পুরুষটির পানে। কে বলল তার বর তাকে মানে না। এই যে সে নিজেই অজানতেই তাসফিকে তার অর্ধাঙ্গীনীর স্বীকৃতি দিলো। এটাই বা কম কিসের।
— কিন্তু তুই তো তোর বউকে মানিস না নিস্তব্ধ।
— ” প্রথমত তুই তোর এই চিপ মেন্টালিটি টাকে চেঞ্জ কর।আমি মানি কি না মানি সেটা তোর দেখার তো বিষয় নয়। বউ দেখতে এসেছিস? দেখে চলে যাবি ঝামেলা শেষ।”

অপমানের তৃপ্তির মুখখানা থমথমে হয়ে গেল। আবারো, আবারো এভাবে অপমান করলো নিস্তব্ধ তাকে। তার বার বার ভালোবাসার আর্জি নিয়ে যাওয়ার পরে এভাবেই বার বার অপমানিত হয়েছে সে নিস্তব্ধ’র কাছে।ছাড়বেনা সে কাউকে। তৃপ্তি হনহন করে বেড়িয়ে গেল।
মাহীন হাত তালি দিয়ে বলল,
— “কেয়া বাত হে মামা কেয়া বাত হে। কি দিলি ভাই?”
ছোট্ট পান্না ও খুশিতে হাত তালি দিলো।
আয়ানা আর আরশী এগিয়ে গিয়ে তাসফি কে জরিয়ে ধরলো।বলল,
“তাহলে এই হলো আমাদের ডাক্তার তাসফি ইয়াসারের বলা পুঁচকে বউ।আর আমাদের মিষ্টি ভাবী।”
বলেই তাসফির গাল টেনে দিলো।যেন সে ছোট্ট বালিকা।
তাসফি ভারী লজ্জা পেল। অহংকারী পুরুষটি বন্ধুদের মাঝেও তার পুঁচকে উপাধি রটিয়ে দিয়েছে তাহলে।
আরশী রশিকতা করে বলে উঠলো,

— “ওমা দেখ দেখ আমাদের পুঁচকি ভাবীজানে গাল কেমন টুকটুকে লাল হয়ে গেছে লজ্জায়।”
বলি কোন দিক দিয়ে আমাদের ভাবীকে তোর পিচ্চি মনে হয় বলতো নিস্তব্ধ। তার উপর একটু আগে যা খেল দেখালো।৷ নেজুরিটাকে বাড়ি থেকে বের করে ছাড়লো।
বেচাড়া আমাদের কত অনুরোধ করে সঙ্গে এসেছিল।
তাসফি জিজ্ঞেস করলো,
— নেজুরি কে আপু।
— নেজুরি কে দেখলে না কেমন গটগট করে হেঁটে চলে গেল।
ওর কথায় কিছু মনে করো না তুমি কেমন।ওও একটু এমনই।

ওদের রশিকতায় তাসফি ওমিষ্টি হাসলো। আপু দুটো ভারী মিষ্টি। যাক বর বদমাশ হলে কি হবে তার বন্ধু গুলো ভারী সুন্দর। ব্যবহারে আর চেহারায় ও।
“দেখ দেখ নিস্তব্ধ আমাদের পিচ্চি ভাবীর হাসিটা কি মিষ্টি।”
নিস্তব্ধ ভ্রু কুচকে তাকালো।
“এই একদম আমাদের দিকে ভ্রু কুচকে তাকাবিনা নিস্তব্ধ। তোর ভ্রু কুঁচকানোতে আমাদের কিছুই যায় আসে না।
— তাসফি তাড়া দেখিয়ে বলল,,
আপনারা দাঁড়িয়ে কেন আপু বসুন, বসুন না।
তখন পায়েল নিচে নেমে এলো।
ওদের দেখে খুশি হয়ে বলল,,

— ওমা তোমরা আজ এলে বুঝি বিয়েতে তো আসলে না।
— আরশী বললো,,
” কিভাবে আসবো বলুন তো ভাবী আপনার দেয়র তো আমাদের বিয়ের দাওয়াতই দেয়নি। ”
— “বিয়েটাও হুট করে হয়ে গেল তো। সকল আত্নীয় কে সেরকম করে বলাও হয়নি। এই আমাদের আমাদের মাঝেই আছে। ”
— জ্বী ভাবী বুঝেছি।
— আচ্ছা তোমরা বসো না দেখি একটু নাস্তা পানি ব্যবস্থা করি আমি।মা তো ঘুমিয়ে আছে।
এক ফাকে সৃজন ফিসফিস করে নিস্তব্ধ’র কানে কানে বলল,,
কি ব্যাপার বন্ধু আমাদের পুঁচকে ভাবীকে কি আস্ত রেখেছো নাকি তোমার নিচেই পিষে ফেলেছো হুম হুম?
সৃজনের কথায় নিস্তব্ধ তার নিস্তব্ধতা ছাড়িয়ে চোখ গরম করে তার দিকে চাইলো।
“একদম চোখ গরম করে তাকাবিনা। তোর চোখ গরম কে আমরা ভয় পাই নাকি বল মাহীন?”
মাহীন ওও সায় দিয়ে বলল,,

— হ্যাঁ তাই তো অবশ্যই আমরা ভয় পাই নাকি।
নিস্তব্ধ বাঁকা হেঁসে বলল,,
“তাই না। সৃজন তুই তোর বউ কে কিভাবে পিষিস সেটা তো আমরা সবাই জানি। কি তাই না গাইস।
— ” নিস্তব্ধ একদম বাজে কথা বলবি না। ”
নিস্তব্ধ সয়তানি হেঁসে ব,
— “এখন বাজে কথা না, এখন বাজে কথা।”
নিস্তব্ধ সব গুলোকে দৌঁড় করিয়ে বাগানে নিয়ে এলো।

–“একি সবাই কোথায় গেল।”
পায়েল ট্রেতে নাস্তা নিয়ে এসে দেখে,ছেলেপেলে সব উধাও।
— আরে ভাবী আপনি এত কষ্ট করতে গেলেন কেন। রাখুন রাখুন। ওরা তো গেল বাইরে গেছে এসে পড়বে।
তিনজন পুনরায় গল্পে মগ্ন হয়ে পড়লো।
আয়ানা তাসফি কে ফিসফিস করে চলল,,
–” নিস্তব্ধ তোমায় ছুঁয়েছে?
মানে ইন্টিমেট..?”
তাসফি মাথা নাড়িয়ে দুষ্টু হেঁসে বলল,,

“কি যে বলেন না আপু। ছু্তে চাইলেই আমি দেবো নাকি। এত সোজা। আমাকে সে বউ হিসাব মানেনা আমার কাছে কেন আসবে বলুন তো। আমিও বা কেন দেবো।
তাছাড়া ওই অহংকারী পুরুষের ছোঁয়া পেতে তো আমি মরে যাচ্ছি না তাই না বলুন। “”
তাসফির কথায় আয়ানা, আরশী, দুজনে চোখ বড় বড় করে চাইলো।
কি দেখছে তারা, নিস্তব্ধ’র পুচকে বউ তো যে সে বউ নয়, একদম ধানিলংকা।কোথায় এই মেয়ে লজ্জা টজ্জা পাবে অথচ।
আরশী শায় দিয়ে বলল,,

” হ্যাঁ তাইতো। একদম ওই হতচ্ছাড়া কে কাছে ঘেসতে দেবে না।বউ মানে না আবার কাছে আশা কিসের। একদম নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাবে।”
আয়েনা বলল,
–” কি গো মেয়ে তবে আমার বন্ধু কে আবার বেশি কষ্ট-তষ্ট দিয়ো না যেন। সময় মতো কাছে টেনে নিয়ো কিন্তু। অতিরিক্ত জ্বালিয়ো না তাহলে সে আবার অতিষ্ট না হয়ে যায়।

ধূসর রংধনু পর্ব ৩

তাসফি ও মিষ্টি করে হাসলো।
জ্বালানো তো কেবল শুরু। হুমহ।
অহংকারী পুরুষের অহংকার সে টুকরো টুকরো করে ভেঙে দিবে।

ধূসর রংধনু পর্ব ৫