ধূসর রংধনু ৩ পর্ব ১১

ধূসর রংধনু ৩ পর্ব ১১
মাহিরা ইসলাম মাহী

“ এই একদম ফালতু কথা বলবি না সজনেডাঁটার বাচ্চা। “
“আমি না বললে আর কে বলবে বল?”
“ তোর আত্মা বলবে ইডিয়ট।”
সাদাফ দাঁত কেলিয়ে হাসলো।
চট করে সে নিস্তব্ধতার পায়ে হাত দিলো,
“ এই নীরু কোথায় ব্যাথা পেয়েছিস দেখি দেখি।কিভাবে হাঁটিস বলতো।
তোর চোখ খুলে হাতে ধরিয়ে দেওয়া উচিত। “

“ আরে… কি করছিস।”
নিস্তব্ধতা পা সরিয়ে নিতে চাইলে সাদাফ চোখ গরম করে চাইলো।
“ তোর পায়ে কি সোনা বাঁধিয়ে রেখেছিস? আমি চুরি করে নিয়ে যাবো? তুই আমায় যাই ভাবিস না কেন? আর যাইহোক চোর নই।”
নিস্তব্ধতা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,
“ তুই চোর নোস? তুই একনম্বরের নাম্বার ওয়ান চোর।”
সাদাফ চোখ বড় বড় করে বলল,
“ ওরে মিথ্যুকের মিথ্যুক। কি চুরি করেছি তোর?”
নিস্তব্ধতা হাসলো জবাব দিলো না ।
দুজনের হাসি খুনসুটিতে অনেকটা সময় পেরুলো।
তাসফি কেবিনের দরজার সামনে থেকে সরে গেল খুব সাবধানে।
তাসফির এখনো খুব করে মনে আছে।
নিস্তব্ধতা যখন বিছানায় পরে ছিল।সাদাফ সারাদিনে ছুটে ছুটে আসতো।
কখনো কখনো পরণের টি-শার্ট উল্টো।
তো কখনো পায়ের জুতো ভিন্ন।
এসব ভুল গুলো কেন হতো ছেলেটার শুধু কি বন্ধুত্বের খাতিরে? বন্ধুর চিন্তায় মশগুল হয়ে?
তাসফি মুচকি হাসলো।
কালই সে আর নিস্তব্ধ সুজন আর আশার সঙ্গে কথা বলবে খুবই গোপনীয় কথা।ভীষণ সিক্রেট হুশশ।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

নতুন দিন, নতুন সকাল, সঙ্গে প্রতিদিনের ন্যায় সূর্য্যিমামার আগমন ধরণীতে খুবই নাটকীয় ভঙ্গিতে।
কখনো আকাশ মেঘলা তো কখনো ভীষণ উজ্জ্বল।
মানবজাতিকে এভাবে দুমুখো সাপের পরিচয় দিতে প্রকৃতি বোধহয় ভীষণ আনন্দ পায়।
কাশফি একা একাই ঘুরে ঘুরে দেখছে ভার্সিটির পেছনের দিকটা।
গতদিন অদিতি বলেছিল এদিকটায় ভীষণ সুন্দর ফুলের বাগান আছে।
সেখানে ওঁর জালা কাশফুল ও নাকি রয়েছে কিছুটা জায়গা জুরে।
ঋতুতে এখন শরৎকাল ঠিকই কিন্তু বৃষ্টির প্রকোপ আর আকাশের ছেলেমানুষী দেখে কে বলবে ইহা বর্ষাকাল নয় শরৎকাল গো শরৎকাল ।

মানুষের মতন প্রকৃতিও মুহুর্তেই পাল্টাতে পারে গিরগিটির ন্যায় রঙ বদল।
কাশফি উত্তরের দিকে হাঁটলো।ওই তো ওদিকটায় খানিকটা জঙ্গলের ন্যায়।সেখানে ফুটে রয়েছে নাম না জানা বন্যফুলের সঙ্গে কাশফুলের সমাহার।
কাশফুলের সঙ্গে তার সম্পর্ক খানিকটা তিক্ততায় মোড়া।
নিজের নাম কাশফি বলে কাশফুল কেও সে ভীষণ পছন্দ করতো।
ছোট বেলার ছেলেমানুষী মন তাকে মনে করিয়ে দেয় কিছু তীক্ত অনুভুতির দাবানলের হদিশ।
তার কথা বলতে সমস্যা হওয়ার কারণে নীবিড় ভাইয়া কে নীবিড় বলে ডাকতে অপারগ ছিল সে।
নীবিড়ের বলদে হয়ে যেত নিবিত। বহু কষ্টে বর্তমানে তা সে সংশোধন করেছে।
তা যে করতেই হবে।সে তো আর ছোট নেই।বড় হতে হতে মানুষ অনেক কিছু শিখে যায়।
নামের এই অদল বদলের কারণে সে সবসময় নীবিড়ের কাছে ধমক খেয়েছে।
ছোট থেকেই নীবিড় তাকে পছন্দ করতো না।

কেন জানিনা একধরনের হিংস্রতা কাজ করতো তার প্রতি।সে হিংস্রতা কাশফির ভাবনা পর্যন্তই নাকি আদৌও সত্য তা সে জানে না জানার চেষ্টা করে নি কখনো।ইচ্ছে হয় নি কেন জানিনা।
কাশফি ছোট সময়ে নীবিড়ের সঙ্গ খুব পছন্দ করতো।নামের বিকৃতির কারণে সে কয়েকবার নীবিড়ের হাতে থাপ্পড় ওও খেয়েছে।
কিন্তু ওইযে আছেনা
বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চাহিদা ও বাড়তে থাকে।সঙ্গে পছন্দ অপছন্দ ও পরিবর্তন হতে থাকে খুব করে।
পছন্দের জিনিস যে কখন অপছন্দের তালিকায় চলে যায় বোঝাই মুশকিল।
যত বড় হয়েছে কাশফি বুঝতে শিখেছে নীবিড় তার সঙ্গ পছন্দ করে না। তবে সে কেন নীবিড়ের সঙ্গ পাওয়ার চেষ্টা করে কষ্ট পেয়ে বিষাদে মন ভরাবে। উহু প্রশ্নই উঠে না। সে তো বেহায়া নয়।

ছোট সময়ের ধমক গুলো আসলেই ধমক ছিলো।আদ্রিত ভাইয়ের ন্যায় কোনো আদুরে ধমক ছিলনা সেগুলো।
ক্লাস ফাইভে পড়া কালিন একদিন কাশফি সহ তার কিছু বন্ধুরা মিলে ক্ষেত থেকে কাশফুল তুলে আনলো।তখন ছিল শরৎকাল। আকাশ স্বচ্ছ নীল।
তাদের স্কুলের সামনে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে তখন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতো নীবিড় ভাই।
ফেরার পথে নীবিড় তাকে কাছে ডাকলো।
নীবিড়ের পাশে তার বন্ধুদের দল।
“ তোঁতলারানী শোন এদিকে আয়।”
কাশফি ছোট্ট ছোট্ট কদম ফেলে নীবিড়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। তোঁতলা বলে ডাকায় সে লজ্জা পেয়েছিলো ভীষণ।সেবার সে মাত্রই বয়ঃসন্ধিতে পা দিয়েছিল।অপরাধ, লজ্জা,ভয়, সংকোচ তার মাঝে কাজ করতো তীব্র ভাবে।
“ ববব..লো নিবিত ভাইয়া। “
বাক্যটি উচ্চারণ করতেই সকলে একত্রে হেসে উঠলো জোরে জোরে। সেই হাসির সঙ্গে যোগ দিলো নীবিড় নিজেও।
কাশফির চোখ ভিঁজে এলো।
নীবিড় বলল,

“ তুতলারানী একটা কবিতা শোনা তো।আচ্ছা থাক কবিতা শোনানো লাগবে না তুই বরং এই ফুল গুলো আমায় দে।”
বলেই নীবিড় কাশফির হাত থেকে ফুলগুলো নিয়ে কাশফির মুখে ছুঁড়ে দিলো।
কাশফি অপমানে কাঁদতে কাঁদতে সেদিন বাড়ি ফিরেছিল।
আসলে মানুষের জীবনের রঙ কখন কখন হুটহাট বদলে যায় বলা মুশকিল। তার উপর মানুষ নিজের মাঝে কতগুলো রঙ সর্বক্ষণ ধারণ করে ঘুরে নিয়ে বেড়ায় সেটা বলা আরো মুশকিল।
এতএত মুশকিলের মাঝে কখন যে পছন্দের জিনিস গুলো ধীরে ধীরে অপছন্দের লিস্টে দাঁগ কেটে নেয় সেটা বলাও বড্ড মুশকিল।
সেই থেকে কাশফুলের প্রতিও তার অনীহা কাজ করতো।তবে গত পরশু সে তার মাঝে ভিন্ন কিছুর উপস্থিতি ঠাহর করেছে।
গত পরশু সে যখন ব্যাগ গুছাচ্ছিলো,
সাদা আর সবুজের মিশেলে একটি চিরকুট সে পেয়েছিলো।তাতে শুধুমাত্র একটি শব্দ লিখা ছিল,

“ কাশফুল।”
ভীষণ অবাক হয়েছিল সে এই অদ্ভুত চিঠি পেয়ে।
এমন অদ্ভুত চিঠির মানে কি।
নাম নেই ধাম নেই। না আছে কোনো বাক্যের গঠন। একশব্দে কি কখনো চিরকুট হয়?
কে বা রাখলো তার ব্যাগে এমন ঢংয়ের চিঠি।
কেন জানিনা আজ ভার্সিটিতে আসার পর তার চিরকুটটির কথা খুব করে মনে পরছিলো।
তার ইচ্ছে করছিলো আজ অনেকগুলো দিন পরে কাশফুলেদের স্পর্শ পেতে।তাদের গায়ে আদুরে হাত বুলাতে।
ভাবনার মাঝে কখন যে সে গোলাপ গাছের লাল গোলাপ খানা ছিঁড়তে গিয়ে কাটার খোঁচা খেল, সে হুশ তার নেই।
নিজের হাতে ঠান্ডা পুরুষালী হাতের স্পর্শ পেতেই চমক উঠলো কাশফি।
পরপর শোনা গেল নীলাদ্র’র ভারী তীর্যক কন্ঠস্বর।
“ এই যে মেয়ে কি করছো তুমি এখানে।জানো না পারমিশন ব্যতীত ভার্সিটির লিগ্যাল জিনিসে এবাবে হাত দেওয়া নিষেধ। “
নীলাদ্র’র হঠাৎ গম্ভীর হুশিয়ারি কন্ঠে কাশফি ঘাবড়ে গেল।

মাহীন সারাদিন ক্লিনিকে থেকে রাত করে বাসায় ফেরে।
আজ ব্রেকফাস্ট টেবিলে বাসন্তী সত্যি সত্যিই আদ্রিতের শেখানো বুলি মাহীনের নিকট উগড়ে দিলো।
“ মাহীন তোমায় একটা কথা বলার ছিল।
ভাবছি মাহরিসার বয়স তো কম হলো না।
মেয়েরা কুড়িতেই বুড়ি হয়ে যায় বুঝলে।
তার উপর আমাদের মারুর তো সে সময় পেরুলো আরো আগে।
আদ্রিত বলছিলো ওর কাছে পাত্র আছে।
তুমি হ্যাঁ বললেই ও মাহরিসার জন্য কনফার্ম করে দেবে।
পড়াশোনা নিয়ে চিন্তা করো না। বিয়ে পরে পড়বে সমস্যা কোথায়?”
মাহরিসা মাত্র রুটির টুকরো মুখে নিয়েছিলো। মা’য়ের কথা শুনে তার খাবার গলায় বেঁধে কাশি শুরু হলো।
মাহীন বাসন্তীর কথার জবাব না দিয়ে মাহরিসার দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো।
মাহরিসা পানি টুকু ঢকঢক করে গিলে ফেলল এক নিঃশ্বাসে।
মাহীন হেসে বলল,

“ মারু মামনী তোমার অসুবিধা হলে রুমে যাও কেমন।”
মাহরিসার মন যেতে অনিচ্ছুক হলেও বাবার আদেশে যেতে বাঁধ্য হলো।
তার বাবা এই গুনটি কি করে জব্দ করেছে কে জানে।
অতিরিক্ত রাগ কিংবা কাউকে বিরক্ত মুখে কথা বলতে নিলেও সে হাসবে।
এই যে মাহরিসা কে মাহীন আদেশ করলোও হেসে।কথা শুনে বোঝার কোনো উপায়-ই নেই তার ধরণ।
মাহরিসা চলে যেতেই বাসন্তী আবারো বলতে নিলো,
“ আদ্রিত বলছিলো, মারুর বিয়ে দেরিতে দিয়ে শুধু শুধু জামাইকে কষ্ট দিয়ে কি লাভ… “
“ জামাই টা কে বাসন্তী? “
বাসন্তীর কথা মাহীন মাঝ পথে কেড়ে নিয়ে সুধালো।
বাসন্তী ভাবনায় পরে গেল।আসলেই তো।জামাইটা কে।সেটাই তো সে আদ্রিতকে জিজ্ঞেস করতে ভুলে গিয়েছে।
মাহীন গম্ভীর কন্ঠে বলল,

“ আমি যেন কতগুলো বছর আপনার জন্য অপেক্ষা করেছিলাম বাসন্তী? “
বাসন্তী জবাব দিতে পারলো না তার চোখ ভিঁজে এলো।
মাহীন আবারো বলল,
“ আমার মেয়ের জামাইকে হতে হবে তার শ্বশুরের মতোই ধৈর্য্যশীল।অধৈর্যশীল হওয়া মোটেও চলবে না। বুঝলেন বাসন্তী। “
বাসন্তী ফট করে বলল,
“ যদি তোমার মত এত ধৈর্য্য তার মাঝে অবশিষ্ট না থাকে মাহীন?”
মাহীন হাসলো।
হাত ধুয়ে বাসন্তীর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,

ধূসর রংধনু ৩ পর্ব ১০

“ তবে ধরে নাও তোমার মেয়ে জামাই হবে তোমার ভাইয়ের থেকেও দুই ডাবল উপরে।একদম উপরের লেভেলের।
আল্ট্রা প্রো ম্যাক্স।যাস্ট বোম ব্লাস্ট হবে।তুমি আমি কেউই ঠেকাতে পারবো না।”
মাহীন চট করে বাসন্তীর বাম-ডান দু গালে চুমু খেয়ে হেসে রুমের দিকে এগুলো।
বাসন্তী হতবাক নয়নে সে দিকে চেয়ে রইলো।
কি বলে গেল আর করে গেল পাগল লোকটা।

ধূসর রংধনু ৩ পর্ব ১২