ধূসর রংধনু ৩ পর্ব ১২

ধূসর রংধনু ৩ পর্ব ১২
মাহিরা ইসলাম মাহী

মন্ত্রমুগ্ধ সকাল।
হসপিটালের জানালার ফাঁক গলিয়ে সূর্যিমামার একগুচ্ছ আলোকরশ্মি তীব্র ভাবে হানা দিচ্ছে নিস্তব্ধতা’র পুরো মুখশ্রী জুড়ে।
ঘুমের ঘোরে বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে আপনাআপনি তার।
পিটপিট করে চোখ মেলে চাইতেই তার সামনে তার পানেই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা যুবককে দেখে মৃদু চিৎকার দেয় নিস্তব্ধতা।
ভয়ে বুক তার ধুকধুক করছে।
আশ্চর্য ছেলেটা কি রাতে বাড়ি যায় নি?
সাদাফ এখনো আগের ন্যায়ই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিস্তব্ধতার মুখশ্রী পানে।
নিস্তব্ধতা দাঁতে দাঁত চেপে সুধায়,

“ গাঁধার বাচ্চা গাঁধা ভূতের মতো তাকিয়ে আছিস কেন।আমার কলিজা বের করে নিতে চাইছিস ?”
সাদাফ মাথা নেড়ে সুধালো,
“ উহু দেখিলাম। “
“ কি দেখছিলি?”
“ দেখছিলাম কি করে মেয়ে মানুষের নাল পরে ঠোঁট বেয়ে। ভেরি ভেরি ইন্টারেস্টিং কনসেপ্ট। “
নিস্তব্ধতা সঙ্গে সঙ্গে মুখে হাত দিলো,
“ ছিঃ।সজনেডাঁটার বাচ্চা তুই আস্ত একটা খবিশ।আর আমি ঘুমালে মোটেও আমার মুখে এটো জমে না।ফালতু কথা বলবি না বেয়াদব।”
সাদাফ গাঁ দুলিয়ে হাসলো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ তুই ঘুমানোর সময় এবারে সিরিয়াসলি আমি সিসিক্যামেরা লাগিয়ে রাখবো।”
“ চুপপ। তোর সিসি ক্যামেরা আমি এক আঁছাড় মেরে ভাঙবো।”
“ আবার জোড়া লাগাবো।সমস্যা কি?”
নিস্তব্ধতা একপলক সাদাফের হাতে থাকা ঘরির পানে রাগী দৃষ্টিতে ততাকালো আরেকবার সাদাফের পানে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে সুধালো,
“ এই এই সত্যি করে বলতো।তুই বাড়ি তো যাস নি? এই সকাল সাতটার সময় তোর ঘুম ভাঙলো কেমন করে? যাকে জাহার ফোন দিয়েও সকালে তোলা যায় না।”
সাদাফ চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে রাগ দেখিয়ে সুধালো,
“ তোকে কে বলল আমি বাড়িতে যাইনি? একরাত ঘুম না হলে আমার কতটা ক্ষতি হবে তুই জানিস?
তোর কোনো আইডিয়া আছে? একরাতে গিয়ে ঘুমিয়ে কি আবার আসা যায় না? সকালে আবার এসেছি।তুই এত প্রশ্ন করিস নীরু।ডিসকাস্টিং।”

সাদাফ অহেতুক মেজাজ দেখিয়ে বেরিয়ে গেল কেবিন ছেড়ে।
নিস্তব্ধতা চোখ ছোট ছোট করে চাইলো।
সাদাফ বলল সে নাকি বাড়িতে গিয়েছিল।
কিন্তু ছেলেটার লালবর্ণ ধারণ করা চোখ দুটো।
এলোমেলো মাথা।কি করে লুকাবে সে নিস্তব্ধতার থেকে।
রাতে সাদাফের সঙ্গে কথা কাটাকাটি করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল সে বলা মুশকিল।
আর সাদাফের অবস্থান করে নেওয়া রাতের চেয়ারটা ঠিক আগের জায়গায়-ই আছে। একটু নড়চড় করে নি। তবে নিস্তব্ধতা কেমন করে বিশ্বাস করবে অসভ্য টা সত্যিই বাড়িতে গিয়েছিল কি না।

“ এই যে মেয়ে কি করছো তুমি এখানে।জানো না পারমিশন ব্যতীত ভার্সিটির লিগ্যাল জিনিসে এবাবে হাত দেওয়া নিষেধ। “
পুরুষালী কন্ঠে কাশফি চমকে উঠে ভীতু চোখে ওপরে তাকালো।
তাকে র‍্যাগ দেওয়ার সময় সেদিনের ক্রমাগত ফোন স্ক্রল করতে থাকা নীলাদ্র নামের ছেলেটাকে দেখে সে আরো ভীতু হলো।
ছেলেটা তার হাত খানা এখনো ধরে আছে।
কাশফি হাত মোচড়ামুচড়ি করতেই নীলাদ্র হাতের বাঁধন ছেড়ে দিলো।
তীর্যক কন্ঠে সুধালো,
“ ডাঙায় থাকা মাছের ন্যায় ছটফট করছো কেন? ভয় পাচ্ছো নাকি? ভেব না কেটেকুটে ফ্রাই করে খাবোনা।সোজা মাঝ নদীতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আসবো।”
কাশফি শুষ্ক ঢোক গিললো।

“ আ..আসলে..”
“ শুনো মেয়ে আমি এখানে কোনো সুদ-আসলের হিসাব করতে আসি নি।
ওসব ব্যবসায়িক জিনিসপত্রে আমি বড্ড কাঁচা।”
কাশফি ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রইলো নীলাদ্র’র পানে।আশ্চর্য ছেলেটা এত কথা বলছে কি করে।কই সেদিন যখন তাকে অসভ্য গানটা গাইতে হলো তখন তো মুখে খই ফুটে নি তার।
এখন তো মুখ থেকে খুব ঝরঝর করে ঝরছে কথার প্রলাপ।শুধু মুখশ্রী হতে কামানের গোলা ছোটাই বাকি আছে আরকি।
কাশফি সামান্য তুতলে বলল,

“ শুনুন আমি কোনো হি..হিসাব শেখাচ্ছি না আ..আপনাকে।শুধু বলছিলাম, আ..মি মনের ভু..লে ছিঁড়েছিলাম গোলাপ টা।”
নীলাদ্র কাশফির পানে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে সুধালো,
“ মনের ভুলেই কিন্তু মানুষ পিছলে পড়ে।সজ্ঞানে কেউ কাঁদামাটিতে পিছলে পরে না কখনো ।ঠিক আমার বাবাও পড়েছিলেন এভাবেই।তার জন্য তাকে পস্তাতেও হচ্ছে আজও। আর যাদের করা ভুলের জন্য আমার বাবার এই অবস্থা তাদেরও আমি ছেড়ে দেব না।
এই যে ঠিক যেমন করে আনমনে তুমি কাঁটার খোঁচা খেলে।খেলে তো?”
কথা বোঝার স্বার্থে কাশফি চোখ গোলগোল করে চাইলো।
তবুও নীলাদ্র’র কথার আগামাথা তার কিছুই বোধগম্য হলো না।
“কি করছিস তোরা এখানে।”
সাদাফ, আর নীবিড়ের হঠাৎ আগমনে পরিবেশ থমথমে হয়ে দাঁড়ালো।
নীলাদ্র পিছু ঘুরে হেঁসে বলল,

“ ওও সাদাফ.. নীবিড় । আয় আয় আয়।”
নীলাদ্র ডাক শুনে মনে হচ্ছে সে তার পোষা মুরগীকে কাছে ডাকছে।
নীবিড় চোয়াল শক্ত করে বলল,
“ কি করছিলি?”
“ কি করতে পারি বলে তোর মনে হয় নীবিড়? প্রেম করছিলাম।”
পুনরায় হেসে বলল,
“ যাস্ট ফান। নাথিং।কিছুই করছিলাম না। যাস্ট ওকে যেখানে সেখানে হুটহাট ঢুকে পরতে নিষেধ করছিলাম। একবার ঢুকে পরলে কিন্তু বের করা মুশকিল হবে তোদের।”
সাদাফের দিকে চেয়ে বলল,
“নিয়ে যা তোর বোনকে। নয় তো আবার কাকে পিছলে ফেলতে পায়তারায় নামে বলা দায়।”
কাশফিকে নিয়ে সাদাফ যেতে যেতেই চট করে পিছু ঘুরে চাইলো।
নীলাদ্র কি করে জানলো কাশফি তার বোন।কই এ সম্পর্কে ভার্সিটির কেউ তো অবগত নয় সে যতদূর জানে।
নীলাদ্র এখনো বাঁকা হেসে চেয়ে আছে ওদের পানে।

মাহরিসা আজ কলেজে যায় নি।
তার মন আনচান করছে অজানা আশংকায়।
তার আদু ভাই কেন হুট করে তার বিয়ের কথা উঠালো।
সে কি লোকটাকে বলেছিল সে বিয়ে করতে চায়? আশ্চর্য মানুষ। মাহরিসার মেজাজ আদ্রিতের উপর প্রচন্ড খারাপ হচ্ছে।
বাবা যদি এখন সত্যি সত্যিই হ্যাঁ বলে দেয় তাহলে তো সর্বনাশ।
মাহরিসা দাঁত দিয়ে নখ খুটছে।
অতিরিক্ত টেনশনে তার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।
হঠাৎ বিছানায় থাকা তার ফোনটা বেঁজে উঠলো।

সেথায় আদ্রিতের নাম খানা জ্বলজ্বল করে ভাসতে দেখে তার আরো মেজাজ বিগড়ে গেল।
ফোন রিসিভ করতেই সে কথা বলার আগে ওপাশ হতে আদ্রিতের ঝারি ভেসে এলো।
লোকটা কথায় কথায় এত ধমকায় কেন।
“ আজ কলেজে আসিস নি কেন বেয়াদব?”
“ আমার শরীর ভালো না আদু ভাইয়া।আজ ছুটি।”
“ ফাজলামো করিস তুই আমার সঙ্গে? কে ছুটি দিলো তোকে? শরীর ভালো না তোর? থাপড়ে গাল ফাটিয়ে দেব বেয়াদব। ফুপি বলল আঁধা ঘন্টা আগে তুই একডজন রুটি খেলি এখন বলছিস শরীর ভালো না।আমায় ইডিয়েট মনে হয় তোর।”
মাহরিসা শুষ্ক ঢোক গিললো।
সঙ্গে হতবাক হলো লোকটার গাঁজাখুরী কথা শুনে।
সে কখন ডজনখানেক রুটি খেল।
খেল মাত্র দুটো তার আগেই মা তার খাওয়া ভন্ডুল করে দিলো,
তার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হলো,

“ না না আদু ভাইয়া আপনাকে আমার একদমই ইডিয়েট মনে হয় না। আপনি তো অতিরিক্ত শিক্ষিত। আমার তো আপনাকে আস্ত একটা সান্ডা মনে হয়। দব ভেবে গিলে ফেলি অথচ হজম করতে পারিনা। সান্ডা না হয়ে আপনি তো একটু মন্ডা মিঠাই ওও হতে পারতেন আদু ভাই। খুব কি ক্ষতি হতো তাতে?”
কিন্তু ওই যে এবারেও তার নিষ্ঠুর মুখশ্রী হতে শব্দ হলো বের হলো না।কণ্ঠনালী তার বড্ড বেঈমান।সব সময় তার সঙ্গে বেঈমানী করতে তৎপর।উফফ।

“ আপনি জানেন না ঠিকঠাক আদু ভাইয়া আমি অসুস্থ। “
“ তোর অসুস্থের খ্যাতা পুরি।আমার অসুখ তুই দেখিস না? চোখে বাঁধে না তোর?”
“ আপনার আবার কিসের অসুখ? “
“ কলিজার অসুখ তুই দেখতে পাশ? তোকে কি এখন কলিজা ফেরে বের করে এনে দেখাতে হবে?”
“ ছিঃ, ছিঃ কিসব বলছেন। আমি এমনটা কখন বললাম।”
“ আঁধা ঘন্টার মাঝে তুই কলেজে আসবি।যদি না আসিস গুনে গুনে তোকে আমি একশটা থাপ্পড় মারবো।”
ওপাশের লাইন কেটে গেল।সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলো।
মাহরিসা ফিসফিস করে বলল,
“ একশটা থাপ্পড় মারতে কি আপনার ধৈর্যে কুলাবে আদ্রিত ভাই?আমাকে কলেজে নিয়ে কি লাভ বলুন তো আপনার? কলেজে তো আপনি আমাকে চেনেনই না। তবে এত হুমকি ধামকির দরকারটা কি বাপু।”

সকাল প্রায় এগারোটার কাছাকাছি।
ভার্সিটির বিশাল বটগাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে দুটো দল।আজ যেন তারা ভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রীদের একত্রে র‍্যাগিংয়ের খেলায় মেতেছে।
নীবিড়দের এবারের শিকার নাওমী।
আর নীলাদ্রদের শিকার অদিতি।
আচ্ছা যুগল গুলো কি একটু এলোমেলো হয়ে গেল না?কেমন খাপছাড়া লাগছে।
অদিতির মন ভীষণ করে চাইলো কেউ একজন আসুক।ভার্সিটির এসব ফাতরামি গুলো কেউ তো বন্ধ করুক।আর কত তারা এসব সহ্য করবে আর পারা যাচ্ছে না।
দিনের পর দিন এবারে সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
এই তিয়াশা মেয়েটা আরো বাড় বেড়েছে।
তিয়াশা অদিতিকে বলল,

“ কানে ধরে উঠবস করতে।”
অদিতি হাতের মুঠো শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইলো।
কাঠ কাঠ কন্ঠে বলল,
“ আমি পারবো না আপু। আমরা তো আপনাদের গোলাম নই যে যা ইচ্ছা তাই করাবেন আপনারা আমাদের দিয়ে।”
তিয়াশা রাগী চোখে চাইলো।
অদিতির গায়ে হাত তুলতে নিতেই
অদিতি চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো।এই বুঝি সে ভরা মাঠে অপমানের খাতায় নাম লেখালো।
তার চোখ ভিঁজে এলো।
কিন্তু কয়েক মুহুর্ত কাটতেও মুখে সে কোনো থাপ্পড়ের অস্তিত্ব পেল না।
চোখ পিটপিট করে চাইলো সে।
দেখতে পেল তিয়াসার পেছন থেকে একখানা অচেনা পুরুষালী হাত তিয়াশার হাত চেপে ধরেছে শক্ত করে।
পুরুষটি তিয়াশার পেছনে থাকায় সে তা দেখার ফুসরত পেল না।

“ এই কে বে তুই।”
কথাটি তিয়াশার মুখশ্রী হতে নিঃসৃত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরুষটির তিয়াশারকে এক ঝটকায় ঘুরিয়ে ওর গালে ঠাস করে থাপ্পড় বসিয়ে দিতে দেরি হলো না।
ঠাস করে শব্দ হলো।
অদিতি চোখ বড় বড় করে সঙ্গে সঙ্গে মুখে হাত দিলো।
“ওও মাই গড।”
এই বেয়াদব মেয়েটাকে মারতেও কেউ সাহস রাখে।
থাপ্পড়ের শব্দে ওপাশে থাকা সাদাফ নীবিড় সহ ওদের দলে থাকা সবাই ও এসে ঘিরে দাঁড়ালো।
তিয়াশা ফ্যালফ্যাল করে লোকটার মুখের দিকে চেয়ে রইলো।
এত গর্জিয়াস লুক ও বুঝি কোনো পুরুষের হতে পারে। পুরুষটির মুখশ্রী একদম অচেনা। আগে তাকে এঃ ভার্সিটিতে বোধহয় না দেখা গিয়েছে।
নীলাদ্র ভ্রু কুঁচকে বলল,

ধূসর রংধনু ৩ পর্ব ১১

“ কে তুই? তিয়াশাকে মারার সাহস পেলি কোথায়।”
সঙ্গে সঙ্গে নীলাদ্র’র গালে দ্বিতীয় থাপ্পড়টি পরলো সেকেন্ডের মাঝে।
পরপর পুরুষালী,দাম্ভিক, গমগমে কন্ঠস্বর সকলের কানে বাজলো তীব্র ভাবে।
“ জাওয়াদ।জাওয়াদ পাটোয়ারী। “

ধূসর রংধনু ৩ পর্ব ১৩