ধূসর রংধনু ৩ পর্ব ১৩
মাহিরা ইসলাম মাহী
ভার্সিটির প্রাঙ্গনে গুঞ্জনে মুখরিত। একে অপরের মাঝে ফিসফিস ধ্বনি প্রবল বার্তা দিচ্ছে বিপদের।
নিঃসন্দে তা জাওয়াদ পাটোয়ারীর সাহসিকায়।
কে এই সুদর্শন পুরুষটি? এত সাহস তার হলো কেমন করে।
থাপ্পড়ের পর্ব শেষ হতেই কোনো কথা বিহীন জাওয়াদ দৃঢ় কদমে হেঁটে চলল অফিসরুমের দিকে।
নীলাদ্র কে থাপ্পড় খেতে দেখে কাশফি খুশি হলো।
বেশ হয়েছে তাকে ধমকেছিল না একটু আগে।এবার বোঝ কেমন লাগে।সব জায়গায় বা হাত দেওয়া।
ক্লাসের ঘন্টা বেঁজে গিয়েছে ইতোমধ্যে।
নীলাদ্র রাগে ফোঁস ফোঁস করছে।নীলাদ্র’র ইচ্ছে হচ্ছে এই মুহুর্তে সে তাদের কেমিস্ট্রি ল্যাবে গিয়ে দাহ্য কেমিক্যাল এনে জাওয়াদের মুখে ছুঁড়ে মারতে।তবে বুঝি তার দিল্ খুশ হতো।
নীলাদ্র একপলক সাদাফ আর নীবিড়ের পানে চেয়ে হনহন করে হেঁটে চলে গেল ক্লাসে।
মাস্টার্সের ক্লাস আজ বোম হয়ে আছে।
সেই বোম বিস্ফোরণের তাগিদে হাজির হলো ভার্সিটি অথরিটির সঙ্গে আগমন ঘটলো জাওয়াদ পাটোয়ারী’র।
একজন সিনিয়র প্রফেসর তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে সুধালেন,
“ উনি হচ্ছেন তোমাদের নিউ, মোস্ট টেলেন্টেড কেমিস্ট্রি প্রফেসর জাওয়াদ পাটোয়ারী।
ইউকে থেকে কেমিস্ট্রিতে পিএইচডি শেষে
চার বছর তিনি ইউসিএল এ এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসাবে শিক্ষকতা করেছেন। নেচার কেমিস্ট্রি তে তার কিছু রিচার্স প্রবন্ধ ওও বেরিয়েছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
বিশেষ তাগিদে তাকে আমরা আমাদের ভার্সিটিতে নিয়োগ দিয়েছি।
আশা করি সকলে প্রফেসরের সঙ্গে কোয়াপারেট করে চলবে। “
ক্লাসে উপস্থিত সকলে বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে জাওয়াদের পানে চাইলো। ওও মাই গড প্রফেসরের সঙ্গে নীলাদ্র ঝামেলা করলো।
এখন কি তাকে ছেড়ে দেবে জাওয়াদ।এত সহজে?
নীলাদ্র’র মাঝে কোনো ভয় ভীতির দেখা পাওয়া গেল না।
অপরদিকে সাদাফ প্রাণপনে চেষ্টা করছে কারো চেহারা মনে করতে। তার কেন জানিনা মনে হচ্ছে জাওয়াদ কে সে আগে কোথাও দেখেছে।কোথাও দেখেছে।কিন্তু কোথায়?
প্রফেসরকে থামিয়ে জাওয়াদ থমথমে কন্ঠে বলে উঠলো,
“দ্যাটস ইনাফ, প্রফেসর শোয়েব। জাস্ট ওয়ান মিনিট। আই হ্যাভ সামথিং টু সে দেম।”
“ ওকে। প্লিজ প্রফেসর জাওয়াদ। “
জাওয়াদ মেরুদণ্ড সোজা করে সটান হয়ে দাঁড়ালো তার ফরমাল প্যান্টের পকেটে হাত গুঁজে।
দরজার বাইরে দাঁড়ানো অদিতিকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকলো সে।
“ হেই ইউ কাম ।”
অদিতি দুরুদুরু বুকে ভেতরে এসে দাঁড়ালো। তার পিছু পিছু নাওমী ও এলো।
জাওয়াদ অদিতির পানে চেয়ে আদেশ করে বলল,
“ দেখাও বটগাছের নিচে কে কে দাঁড়িয়ে ছিলো। আর কে কে তোমায় টিজ করছিলো।”
নীলাদ্র ফট করে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো,
“ ওটা টিজ নয় র্যাগিং করা হচ্ছিল। “
“ শাটআপ।তোমায় কুয়েশ্চেন করেছি? নো সাউন্ড টিজ ওর র্যাগ আমায় শেখাতে এসো না। “
জাওয়াদের হুশিয়ারিতে পুরো ক্লাস থমথমে হয়ে উঠলো।
নীবিড় ফিসফিস করে সাদাফের কানে কানে বলল,
“ ভাই এই প্রফেসরটা আবার কই থেকে উদয় হলো বলতো? আমাদের গুষ্টির ষষ্ঠী না করে ছাড়ে?”
সাদাফ চোখ রাঙিয়ে চাইলো।ফিসফিস করে বলল,
“ বেশি কথা বলিস না মহিষের বাচ্চা। “
“ ভাই তুমি আমার বাপ তুলে কথা বলো না প্লিজ।”
“ তো তোকে কি এখন নীবিড়ের বাচ্চা বলবো?”
“ আসতাগফিরুল্লাহ। এসব কথা বলে না লক্ষি ভাই আমার।নিস্তব্ধতা আসলেই আমি তোমার নামে বিচার দেব দেখে নিও।”
সাদাফ আমতা আমতা করে বলল,
“ দে না এখুনি গিয়ে দে।তোর কি মনে হয় ওকে আমি ভয় পাই?”
নীবিড় শয়তানি হেসে বলল,
“ সেটা তো বিচার দেওয়ার পরেই বুঝা যাবে।”
সাদাফ ধুম করে নীবিড়ের পিঠে কিল বসালো,
“ ভাই।মেরে ফেলবে নাকি।”
অদিতির কথায় দুজনেট কথার ইতি টানতে হলো।
অদিতি আর নাওমী একএক করে নীলাদ্র, তিয়াশা, সাফওয়ান, সাদাফ, নীবিড়, সকলকে দেখিয়ে দিলো।
নীবিড় আবারো বলল,
“ ভাই দেখলি কত্ত বর বেয়াদ্দব মেয়ে।ওকে কি আমরা র্যাগ দেওয়ার সুযোগটা পেয়েছিলাম বল?তার আগেই তো জাওয়াদ না ফাওয়াদ এসে হাজির হলো
তার পরেও দেখলি ঠিক আমাদের নামগুলো ঠুসে দিলো।”
নাওমী নীবিড়ের দিকে চেয়ে শয়তানি হাসি দিলো।
নীবিড় চোখ ছোট ছোট করে চাইলো।
যেন নীবিড় নিঃশব্দে বলছে,
“ নাম বলে আমার কিছুই করতে পারবেনা নাউডুবা চশমিশ। “
নাওমী তেমনি যেন চোখে চোখে বলছে ,
“ সেটা তো একটু পরেই বোঝা যাবে পিদিরের বাচ্চা। “
জাওয়াদ গমগমে কন্ঠে প্রফেসর শোয়েব কে বলল,
“ প্রফেসর ভার্সিটির সকল স্টুডেন্ট কে জানিয়ে দেবেন নেক্সট ডে দুপুর বারোটার সময় যেন সকলে মাঠ প্রঙ্গনে উপস্থিত থাকে।”
নীলাদ্রদের দিকে ঘুরে বলল,
“ আর তোমরা সকাল এগারোটায় মাঠের মাঝে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে।আমি উপস্থিত না হওয়ার আগ পর্যন্ত এক পা ও নড়বে না।নয়তো ফল খারাপ হবে।”
জাওয়াদ সহ সকলে বেরিয়ে গেল।
নীলাদ্র রাগে ফুঁসতে লাগলো।
নিঝুম সন্ধ্যা।আলো আধারির খেলায় মেতে উঠছে চারিপাশ।
নিস্তব্ধ, সুজন, মাহীন অনেকগুলো দিন পর আজ
একসঙ্গে উপস্থিত হয়েছে নিস্তব্ধ’র রেস্টুরেন্টে একটি বিশেষ কারণ উপলক্ষে। শূন্য রেস্টুরেন্টে তিন বন্ধু’র আড্ডায় মুখরিত।
কিন্তু বন্ধু তো তারা তিন জন নয় ছিলো তো সাতজন।
বাকি চারজন কোথায়?
সৃজন, তৃপ্তি, আয়ানা, আরশী তারা চারজন কোথায়?
ওই যে সময়ের পরিবর্তন। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বদল ঘটে মানুষের জীবনেরও।
তৃপ্তিকে তিন বন্ধু তার হাসবেন্ড নিখিলের সঙ্গে দেখেছিলো সেইই ফ্যামিলি গেটটুগেদারে।
এরপর শুনেছিল মেয়েটা পুনরায় পারি জমিয়েছে বিদেশের মাটিতে।
এরপর ওর সঙ্গে আর কারো যোগাযোগ হয়নি।
হয়তো মেয়েটা চায় নি যোগাযোগ করতে।
কেন চায়নি সে তো তৃপ্তি নিজেই বলতে পারবে।
আরশী আর আয়ানা?
তারা দুজন আছে দিব্বি আয়ানা স্বামী সংসার নিয়ে সুখেই আছে।তবে তার কোনো সন্তান নেই।
একটা এক্সিডেন্টে সব শেষ হয়ে গেল কেমন করে। তবে সুখে থাকার বিকল্প পদ্ধতি রয়েছে তো।যেমন করে তাসফিকে তার বাবা সব সময় বিকল্প পদ্ধতির খোঁজ দিতো ঠিক তেমনি করে।
আয়ানা ও তার দশ বছরের পালিত ছেলেকে নিয়ে সুখেই আছে।সুখে থাকতে হলে নিজের সুখ নিজেকেই খুঁজে নিতে হবে।
আরশী আজও বিয়ে করে নি।
আরশী যে টাকলা বিটকেলার মাথায় অতি উত্তেজনায় ডিম ফাটিয়েছিল তার জন্যই দেবদাস হয়ে সে আজও বিয়ের পিরিতে বসে নি।
হসপিটালের যাচ্ছে ডিউটি করছে এভাবেই যাচ্ছে তার জীবন।
আচ্ছা কিছু মানুষের জীবন এমন বিষাদে পরিপূর্ণ হয় কেন?
এই দুনিয়ায় জীবিত প্রাণী কেউ পারফেক্ট নয়।কেউ না।
এইতো ধরা যাক না।
তাসফি জন্মের পর নিজের মাকে হারালো এরপর বাবাকে মেয়েটা হয়ে গেল এতিম।
তবে তাকে আগলে রাখতে নিস্তব্ধকে ঠিক উপরওয়ালা ঠিক করে দিলো।জোড়া বেঁধে দিলো দুজনের।যে বাঁধন আর কখনো ছিন্ন হবার নয়। ইহজমন পর জনম কোনো কালেই নয়।
এরপর আসা যাক
সুজন আর আশার কথায়।
আশা মেয়েটাতো জন্ম থেকেই হতভাগী। চাচা-চাচীর কত অত্যাচারের শিকার হলো।
শেষ পর্যন্ত সুজনের মত একজনকে তার জীবনে পাঠালো।যে নিজেও কিনা একজন ভুল মানুষকে ভলেবেসে বছর কাটাচ্ছিলো।
ওপরওয়ালা তাদের কষ্টকেও লাঘব করতে দুই হতভাগা কে এক করে দিলো।
এরপর আসা যাক
মাহীন আর বাসন্তীর বেলায়।
বাসন্তী মেয়েটাতো কম ঝড় ঝাপটা পোহায়নি।
যাকে ভালোবেসে বিয়ে করলো সে বেরুলো জানোয়ার রুপে। ডিভোর্সের তকমা লাগলো গায়ে।চাঁদের ন্যায় কলঙ্কিত হলো খুব করে।
কিন্তু পরিবারের সাপোর্ট ছিল তার ওপর সর্বাধিক।ওই যে ওপরওয়ালা এক দিকের পাল্লা থেকে কেড়ে নিয়ে শূন্য করে দিলেও ওপর দিকে ঠিক পরিপূর্ণ করে দেয় পুনরায়।
তার ওপর মাহীনের সাপোর্ট তার জীবনটাকে সুন্দর করেছে পুনরায়।
আর মাহীন বাপ ছাড়া ছেলেটা।
ছোট থেকেই পরিবারের বোঝা বৈতে হলো তার।এরপর ভালোবাসলো এমন একজন কে।যার বিয়ে হলো অন্যকারো সঙ্গে। দুঃখে জর্জরিত হৃদয় তার কুপোকাত।
কিন্তু ওপর ওয়ালা তাকেও নিরাস করেন নি।তার ভালোবাসার প্রতিদান দিয়ে পুনরায় বাসন্তীকে এনে দিয়েছে তার নিকট।
সত্যিই মানব জীবনে আসলেই একটি রহস্যময় গোলক ধাঁধাঁ। কখন কার জীবনে কি ঘটে যাবে কেউ জানে না। সময়ের গতির সঙ্গে পরিবর্তনের রেখা কোথায় গিয়ে থামবে তা কেউ জানেনা। জানা সম্ভব ওও না।
সবই তো জানেন ওই একমাত্র খোদা তায়ালা।
এই যে সকলের জীবনে এত এত বিষাদ।তবুও এই বিষাদের মাঝেও যেন হাজারো সস্তি।সুখের ঠিকানা। এই বিষাদের মাঝে তো তারা সবাই পুনরায় ফিরে পেয়েছিলো সুখের খোঁজ।
সকলের জীবনে কত নাটকীয়তা, জীবন তাদের দেখালো কত রং,ঢং। দিন শেষে সবই তুচ্ছ। বড্ড তুচ্ছ। আহাঃ জীবন। পরিশেষে জীবন আমাদের থেকে যা নেয় তার থেকে দুই ডাবল ফিরিয়ে দেয়।
সৃষ্টিকর্তা আমাের কখনো নিরাশ করেন না। তোমার তাকদিরে যা লেখা আছে তা ফলবেই।ভালো হোক কিংবা মন্দ।
আয়ানা আর আরশী হাসি মুখে হাজির হলো তখন রেস্টুরেন্টে।
দুজনের চেহারায় বয়সের ছাপ পরেছে।আগের মতো নেই সেই জৌলুস। তবুও মুখ গুলো বড্ড চেনা।
“ হেই নিস্তব্ধতা, সুজন মাঝি, মাহীন বাবু কেমন আছিস তোরা?”
বলেই আয়ানা আর আরশী খিলখিল করে হাসলো।ঠিক যেন সেই তাদের কলেজ লাইফের কিশোরীদের ন্যায়।
আহাঃ জীবন এত মধুর কেন।
নিস্তব্ধ দুজনের পানে কটমট করে চেয়ে বলল,
“ খবরদার যদি মেয়ে মানুষের নামে ডেকেছিস তো। আমার মেয়ের নাম তোরা আমায় দিচ্ছিস, আর ইউ ম্যাড?”
দুজনে দাঁত কেলিয়ে হাসলো।
“ সরি দোস্ত বিগ মিস্টেক। নিস্তব্ধতা তো আমাদের নতুন মা।”
সুজন আর মাহীন কোনো রিয়েক্ট করলো না বরং হাসলো।
তাদের নিস্তব্ধ তাসফি ব্যতীত সেই নিরামিষই রয়ে গেল।ইশশ।
সুজন তার পানে কটমট করে চেয়ে বলল,
“ ব্যাটা তুই আর ভালো হলি না। তোর মেয়ের সঙ্গে দুদিন পর ছেলে বিয়ে দেব আর তুই কিনা এখনো চোখ গরম দেখাস?”
নিস্তব্ধ ভ্রু কুঁচকে বলল,
“ তোর ছেলেকে কে মেয়ে দেবে? আমার মেয়েকে ভালোবাসে তোর ছেলে?”
সুজন নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল,
“ ভালো না বাসলে কি?”
“ ভালো না বাসলে আমি তার কাছে আমার মেয়েকে কেন দেব?”
সুজন প্রতিবাদ করে বলে উঠলো,
“ তুই কি তাসফিকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলি?”
নিস্তব্ধ শুষ্ক ঢোক গিললো।
এর জবাব সে দিতে পারবেনা।নিজের দাম্ভিকতার অতীতের নিশানা সে খুঁজতে চায় না।
ফেলে দিয়েছে তা সে নর্দমায়।
আয়ানা,আরশী আর মাহীন ওদের দুজনকে থামিয়ে সুধালো,
“ এই এক মিনিট এক মিনিট? সৃজন কোথায়?”
পাঁচ বন্ধু ভাবনায় বুদ হলো।
তবে তাদের ভাবনার ঘোর কাটাতে হলো খুব দ্রুত।
ধূসর রংধনু ৩ পর্ব ১২
“ হ্যাললো আজিব গুষ্টি। “
অতীব চেনা কন্ঠস্বর কর্ণগোচর হতেই পাঁচজন চট করে পিছু ফিরে চাইলো।
তবে একজনের বদলে ধরা দিলো দুজন সদর্শন পুরুষের মুখশ্রী।একজনের হাসি খুশি অথচ ওপরজনের গম্ভীর। অথচ চেহারার সারাংশে তাদের বড্ড মিল।