ধূসর রংধনু ৩ পর্ব ৪০

ধূসর রংধনু ৩ পর্ব ৪০
মাহিরা ইসলাম মাহী

সময় কাটে খুব দ্রুত।
পরবর্তী দিনটি হাজির হয় চোখের নিমেষে।
তৃপ্তির বাসায় হুলস্থুল কান্ড।
অদিতির জন্য যে সমন্ধ আসবে মূলত সমন্ধটা ঠিক করেছে অদিতির দুঃসম্পর্কের এক কাকা ।
যদিও বা পাত্রপক্ষ বলেছে ব্যস্ত না হতে তারা আসবে বিকালে।হালকা নাস্তা দিলেই হবে।
কথাটুকু শুনে তৃপ্তি অবাক হয়েছিলই বটে।কারণ আজ কালকার মানুষ ফ্রিতে খাওয়ার জন্য ওঁৎ পেতে থাকে।সেখানে তেনারা আসবে বিকালে।আশ্চর্য।
তৃপ্তি আলাদা করে পাত্র পক্ষের পরিচয় সম্পর্কে কিছুু জানেনা। আসলে সবকিছু এত দ্রুত ঘটলো যে সে সময়টাও পায়নি কিছু জানবার।

ইচ্ছে ওও হয়নি।ওনারা আসলেই নাহয় বরং পরিচিত হবে।
সব মিলিয়ে তৃপ্তি ভীষণ টেনশনে আছে।
অদিতি ঘরে বসে অপেক্ষা করছে নাওমীর আসার।
তারওপর ফেসবুকে কারো পোস্টের নোটিফিকেশনে অদিতির মেজাজ কেন জানিনা চট করেই খারাপ হয়ে গেল।
জাওরা ব্যাডায় পোস্ট করেছে। সুটবুট পরিহিত লাটসাহেব সেজে ফটো ছেড়েছে ।ইশশ ঢং দেখ।
ক্যাপশনে লিখেছে,
“ আ’ম কামিং মাই লাভ।মাই লিটল বার্ড আ’ম রিয়েলি সরি।”
অদিতি চট করে ফোনটা বন্ধ করে ছুঁড়ে ফেলল সোফায়।
বিয়ে করবে সে আজই।
যে আসবে তাকেই বিয়ে করবে। হোক সে কালো,ফর্সা,মোটা বাট্টু,নোংরা খোড়া।কিচ্ছু আসে যায় না তার।বিয়ে করবে মানে করবে।
এসব প্রেম লীলা সে আর দেখতে চায় না না না।
স্বামী নিয়ে দারুণ ভাবে সংসার করবে সে।
সঙ্গে বাচ্চা পয়দা দেবে ডজন খানিক।
পড়াশোনা সব বাদ।
দেখিয়ে দেবে সে জাওরা ব্যাডাকে হুহ।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বাসন্তী আর মাহীন রেডি হয়ে নিশান-নিশানী, মাহরিসা, নীবিড়কে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় নাওমী কে বলল,
“ নাওমী মা সাবধানে থেকো বুঝলে। আশে পাশে চোর বের হয়েছে কিন্তু। খবরদার না বুঝে দরজা খুলো না।”
নীবিড় বিরক্ত হয়ে বলল,
“ মা তুমি মিস নাউডুবা চশমিশ কে সাবধান না করে গেটে তালা ঝোলালেই পারো।”
“ তুই চুপথাক।”
“ চুপ থাকবো কেন।বাবা তো মানুষের দাঁত দিয়েও একটা তালা বানিয়ে ফেলতে পারে।”
বাসন্তী গরম চোখে চায় ছেলের পানে।
মা ছেলের কান্ডে নাওমী মুখ দিপে হাসে। চটপটে কন্ঠে সুধায়,
“ কিন্তু আন্টি আমার তো আজ বের হতে হবে।আমার বান্ধবীর বিয়ে।”
বাসন্তী অবাক কন্ঠে বলল,

“ ওমা সেকি তাই নাকি।কখন বের হবে তুমি নাওমী?”
“ এই তো এখনি আন্টি।”
“ তাহলে সবাই একত্রেই বের হই।তুমি রেডি হও মা আমরা বসি পাঁচ মিনিট।তারপর নাহয় তুমি ভিন্ন পথ ধরিও। তুমি ঝামেলা করে তালা মারবে তার দরকার নেই।”
“ না না আমি পারবো তো আন্টি।কোনো সমস্যা নেই।”
“ কোনো দরকার নেই আমরা বসছি তুমি যাও।”
হার মেনে নাওমী মাথা নাড়ালো, বাধ্য মেয়ের ন্যায় উপরে গেল রেডি হতে।
নীবিড় আঁড় চোখে নাওমীর যাওয়ার পানে চেয়ে।
মাহরিসা ভাইয়ের পেটে গুতো মেরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে ফিসফিস করে বলল,
“ ওদিকে কি তোর। চোখ নিচে নামা।নাওমীর দিকে ওভাবে তাকাস কেন? কাহিনী কি ভাই?সত্যি করে বলতো।”
নীবিড় আমতা আমতা করে বলল,

“ কাহিনী তোর মাথা। “
নীবিড় কথা ঘুরানোর চেষ্টায়,
“ এই মারু তোর জামাই যাবে তো সঙ্গে? “
আদ্রিতের কথা উঠতেই মাহরিসার গাল লাল হয়ে উঠলো।
বাসন্তীর ফোন বাজে।
তাসফির ফোন।
সে তাড়া দিচ্ছে।
নীবিড় চট করে বলল,
“ মা তোমরা বরং বের হয়ে যাও।আমি তালা মেরে বাইক নিয়ে পৌঁছে যাবো। তোমার নাওমীরওও বাড়তি কষ্ট হবে না।”
বাসন্তীর ছেলের আইডিয়া পছন্দ হয়।
মাহরিসা চট করে বলল,

“ তবে আমিও থাকি ভাই? তোর বাইকের পেছনে উঠে চলে যাবো।”
“ কোনো দরকার নেই। বাইকে আমি মেয়ে মানুষ উঠাই না।তুই তোর জামাইয়ের কাছে যা।”
মাহরিসা ভেঙচি কাটে।
মা সহ মাহরিসা সবাইকে ঠেলে পাঠিয়ে দরজা লাগিয়ে নীবিড় হাত পা ছড়িয়ে সোফায় বসে পরলো।
নাওমী যখন রেডি হয়ে নিচে নামে, ফাঁকা ড্রয়িংরুম দেখে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রয় সে।
শুধুমাত্র নীবিড় কে দেখে শুষ্ক ঢোক গিললো সে।
নাওমীকে দেখে নীবিড় হাসলো।চট করে উঠে দাঁড়িয়ে নাওমীর কাছে এগিয়ে গেল।
নাওমীর কেন জানিনা ভয় করছে।হাত পা শিরশির করে অদৃশ্যভাবে কাঁপছে।
তবুও স্বাভাবিক থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করলো সে।

“ সকলে কি চলে গেল নীবিড়?”
“ গেল।”
“ কেন গেল? “
“ জানিনা।”
নীবিড় নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে জবাব দিচ্ছে।
“ আপনি যান নি কেন?”
নীবিড় খানিক ঝুঁকলো নাওমীর দিকে,
“ সত্যিই চলে যাব নাউডুবা চশমিশ? “
নাওমী কেঁপে উঠে দু পা পিছিয়ে গেল।বুকের ভেতর অজানা কারণে দ্রিম দ্রিম শব্দ হচ্ছে তার।
“ প..পানি খাবো নীবিড়। “

বলতে দেরি নীবিড় টেবিলে থাকা গ্লাসের পানিটুকু চট করে নাওমীর সামনে ধরলো।
নাওমী এক নিঃশ্বাসে ঢকঢক করে পুরোটুকু গিলে নিলো।
“ যদি ভুল না হই তুমি কি আমায় ভয় পাচ্ছো নাউডুবা চশমিশ। যদি এই ফাঁকা বাসায় তোমার কিছু করে ফেলি।”
নাওমী আতঙ্কগ্রস্থ কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল,
“ আপনি আমায় ইচ্ছে করে ভরকে দিতে চেষ্টা করছেন মহিষের বাচ্চা। “
নীবিড় পুনরায় নাওমীর দিকে দু পা এগুলো।
“ মোটেও চেষ্টা করছি না।বরং দেব।”
নীবিড় নাওমীর মুখে ফু দিলো।

নাওমী চোখ বন্ধ করে নিতেই নীবিড় চট করে তার চোখের গোলাপি ফ্রেমের চশমাটা খুলে নিলো।
“ সুযোগের অসৎ ব্যবহার করছেন আপনি নীবিড়। “
“ সকলে তাই করে আমি নই। আ’ম অলটাইম ডিফরেন্ট ইউ নো?”
নাওমী ভয়ে পুনরায় গলা শুকিয়ে কাঠ কাঠ।
ক্ষণ সেকেন্ড কাটতেই নাওমী নিজ বাম গালে
উষ্ণ,শীতল, ভেজা’র সংমিশ্রণে কিছু অনুভব করে।
হৃদয়ে বিরাট আকারে দ্রিম দ্রিম শব্দ তুলে তার।
কি হলো ব্যাপারটা।কি ঘটলো তার সাথে।
“ নীবিড়। নীবিড়।নীবিড়।”

নিজের চোখের চশমা ফিরে পায় নাওমী।
চোখ মেলে তাকিয়ে নীবিড় কে দরজায় দেখতে পায় সে।
“ টেবিলের ওপরে চাবি। ঘর তালা দেবে সুন্দর করে নাউডুবা চশমিশ। “
নাওমী চোখ পিটপিট করে চায়।নীবিড়ের হাতে বাইকের চাবিটা গোল গোল ঘুরছে। তার চোখে মুখে রহস্যময় হাসি ঝুলছে।সে যেটা ভাবছে , যেটা অনুভব করলো সেটা কি আদৌও সত্য?
কি করে সম্ভব?
সম্ভব হলেও অন্তত তার পক্ষে মেনে নেওয়া অসম্ভব।
কখনো সম্ভব নয়। কখনো নয়।

সুজনদের দোতালা বাড়িতে মানুষের ভীড় উপছে পড়ছে।
ইতোমধ্যে সকলে রেডি হয়ে হাজির।
তাসফি,,নিস্তব্ধ, সুজন, আশা,, মাহীন, বাসন্তী, নিস্তব্ধতা, সাদাফ,আদ্রিত,মাহরিসা,নীবিড়, নিশান-নিশানী,কাশফি সকলে সেজেগুজে একসার।
সকলের মাঝে রাহেলা বেগম সবচেয়ে বেশি খুশি।
স্বামী গত হওয়ার এতগুলো দিন পর তার মুখে হাসি ফুটেছে।
তার একমাত্র নাতীর বিয়ে বলে কথা।দাদী হয়ে তার আনন্দ না করলে হয় বুঝি।
ভদ্রমহিলা এদিক ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছেন। একবার কিচেনে যাচ্ছেন তো একবার ড্রয়িংরুমে তো একবার নাতীর কপালে চুমু খাচ্ছেন।

আরেকবার নাতীর কপালে নজর দিকা লাগাচ্ছেন।
সাদাফের মনে হচ্ছে পাত্রী দেখতে নয় এতগুলো মানুষ তার শেষ কৃত্য সম্পূর্ণ করতে যাচ্ছে।
নিস্তব্ধতা দাঁতে দাঁত চেপে সুধায়,
“কচি মেয়ে বিয়ে করবি খুব ভালো লাগছে তাই না রে সজনেডাঁটার বাচ্চা। ফূর্তি হচ্ছে তোর মনে?”
সাদাফ জবাব দিলো না বরং নিস্তব্ধতার হাতটা জোড়ে চেপে ধরলো।
নিস্তব্ধতা চোখ বড়সড় করে চাইলো।হাসফাস করে উঠলো,
“ কি করছিস। হাত ভেঙে ফেলবি নাকি।সাদাফ ছাড়।মার খাবি।”
সাদাফ কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল,

“ ছাড়বো না।তুই আগে বলল ওবাড়িতে গিয়ে আমার পাশে পাশে থাকবি?”
“ কি আশ্চর্য আমি কেন তোর আর তোর কচি বউয়ের মাঝে কাবাব মে হাড্ডি হবো? তোকে কি আমার উচ্ছিষ্ট খাদ্য মনে হয়? খবরদার যদি তা ভেবেও থাকিস সঙ্গে সঙ্গে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল।”
“ এমন করিস কেন।”
“ এর থেকে ভালো ব্যবহার আমার থেকে আশা করিস না সজনেডাঁটার বাচ্চা। হাত ছাড়।”
সাদাফ মাথা নাড়লো।

“ হাত ছাড় বলছি।”
“ ছাঁড়বো না।”
“হাত ছাঁড়বি না তাই তো?”
সাদাফ মাথা ঝোলালো।
নিস্তব্ধতা নিজ পায়ের উঁচু হিল সাদাফের পায়ে ডাবিয়ে দিলো মুহুর্তে।
“ আহহহহহহ।”
সাদাফ চিৎকার করে উঠে নিস্তব্ধতার হাত ছেড়ে দিলো।
তার চিৎকারে ড্রয়িংরুমে হুলস্থুল কান্ড বেঁধে গেল।
নিস্তব্ধতা আজ শাড়ি পড়েছে, নীল রঙের সিলকের শাড়ি। এই প্রথম বোধহয় মেয়েটা শাড়ি পড়লো।কিন্তু কার জন্য।
কাউকে আকৃষ্ট করার জন্য কি তার এই কারসাজি? কাউকে পাগল করার ধান্ধায়? কে জানে।
দারুণ দেখতে লাগছে মেয়েটাকে।

রাহেলা বেগম এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকে তার দিকে।
সে তাকিয়ে থাকলেই বা কি হবে।যার তাকিয়ে থাকার সেই তো তাকায় না।তার তাকানোয় আর কি আসে যায়।
নিস্তব্ধতা ড্রয়িংরুম ছেড়ে ডায়নিংয়ে টেবিলে বসা রাহেলা বেগমের দিকে এগিয়ে যায় চুপচাপ।
“ একগ্লাস পানি হবে দাদী?”
রাহেলা বেগম তার পান খাওয়া দাঁত বের করে হাসেন।নিস্তব্ধতার দিকে পানি এগিয়ে দেয়।
নিস্তব্ধতা সে টুকু ঢকঢক করে গিলে ফেলে এক নিঃশ্বাসে।
“ একি নাতনী তুই ক্যান মুখখান এমন গুমড়া কইরা রাখছোস ক দেহি?”
“ কিছু না দাদী। তোমার নাতী আস্ত একটা খাটাস।খাটাসের বিয়েতে হাসতে মানা বুঝলে।।”
“ নাহ বুঝলাম না।

শোন তোরে একখান ঘটনা হুনাই। আমাগো সুজন ছিল একবারে মুখচোরা স্বভাবের।বুক ফাটবে তবু মুখ ফুটবে না টাইপের বুঝলি তো। আশাকে দুচোখে পারতো না অথচ সেই সে একদিন আশা মা কে বিয়ে করে নিয়ে হাজির। কি বুঝলি?
আর তোর বাপ ছিল বিয়ে করবো না করবো না বলে মুখে ফ্যানা তুলে ফ্যালা পাবলিক।
অথচ একপ্রকার ধরে বেঁধেই তাকে বিয়ে দেওয়া হলো। বউ মানবে না সে কিছুতেই।অথচ মাস দুয়েক যেতেই বউ পাগল হয়ে গেল সেই ছেলে।

আর তোর মাহীন আঙ্কেল? বাসন্তী কে ভালোবাসে বিয়ের আগে থেকে। অথচ মুখ খুলতে পারলো না। বিয়ে হয়ে হেল তার অন্যত্ত।কিন্তু পরবর্তী তে কি হলো? খোদা এতটাও নিষ্ঠুর নন।
বাসন্তীর স্বামীর সঙ্গে দু’জনের ডিভোর্স হলো।
মাহীন নিজ ভালোবাসা পুনরায় ফিরে পেল।
এখন তারা সুখে শান্তিতে বাস করছে কতগুলো বছর হলো।
এএ জীবনে বহুত নাটক দেখেছি।বুড়ি তো আর বাতাসে হই নাই গো নাতনী। শোন আমাদের জীবনটা হইলো গিয়া একখান নাট্যমঞ্চ।কার সঙ্গে খোদা কার জুটি বেঁধেছেন তিনিই ভালো জানেন।
সেই জুটি ভাঙতে আমরা চাইলেও পারবো না।
জীবনের সকল সমীকরণ এত সোজা নয় মোটেও।

শোন নাতনী ভালোবাসা হইলো মৌচাকের ভেতরে থাকা মধুর ন্যায় মিষ্টি। হুট করেই মৌচাক আমাগো চোখে বাঁধে খাওয়ার জন্য জিভ লকলক করে অথচ সেই মধু জোগাড় করনের লাইগা মৌমাছি কামড় খাইতে হয় ঠিকই।
আমাগো ভালোবাসা হইলো গিয়া ওমন টাইপের।
দেখনের লগে ভালো আমরা একজন রে বাইসা ফালাই ঠিকই।কিন্তু সে ভালোবাসা পর্যন্ত পৌঁছাইতে আর টিকিয়ে রাখতে গেলে আমাদের বহুত কাঠখড় পুড়াইতে হয়।খাইতে হয় বিষাক্ত মৌমাছির বিষাক্ত কামড়।তবেই না সেই ভালোবাসা খাটি হয়।

ভালোবাসা যদি খাটি না হয় সিয়া আবার ভালোবাসা হয় কেমন কইরা বল দেখি নাতনী?”
নিস্তব্ধতা মুচকি হেসে বুড়ি কে জরিয়ে ধরলো। ফিসফিস করে বলল,
“ তোমার এত ভারী কথার মানে বুঝিনা গো বুড়ি।
শুনো তোমার সোয়ামী নাই বইলা যে আরেকজনের সোয়ামী লাগবো না, এমনটা মোটেও নয়, তোমার নাতী রে খুব ভালো করে বুঝিয়ে দিও তা। সারাজীবন আইবুড়ো থাকার ঢং বাইর করতে বইলো।
এই যে এহন কচি মাইয়্যা বিয়া করবো বুঝবো ঠ্যালা হুহ।”
“ দাও তো বুড়ি একটা পান দাও।”

রাহেলা বেগমের হাত থেকে পান নিয়ে মুখে পুরে সপ।গাল লাল হয় তার।
পান খাওয়া লাল গালে মিষ্টি হাসে যুবতী।
সেই লাল গালে হাসলে তাকে অপরুপা, পরিপূর্ণ অষ্টাদশী যুবতী লাগে।
রাহেলা বেগম মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে সে মায়াবী মুখশ্রীতে।
এত সুন্দার চেহারাখান কি তার নাতীর চোখে বাঁধে না বুঝি? মাশাআল্লাহ।
রাহেলা বেগম এগিয়ে নিস্তব্ধতার কপালে নজর টিকা লাগিয়ে দেয়। এমন আগুন চেহারায় কারো নজর না লাগুক।

মাহরিসা একপাশে সোফায় বসে।
আদ্রিত তার পাশ ঘেসে বসে ফিসফিস করে বলল,
“ সবাই কে বলে দেই আজ।আজ তোকে বাড়ি নেব।”
মাহরিসা ভয়ে শুষ্ক ঢোক গিলে।
“ এখনই নয় আদু ভাইয়া।সরে বসুন প্লিজ।কেউ দেখলে.. “
মাহরিসাকে কথা শেষ করতে দেয় না।আদ্রিত নিজ ডান হাত দিয়ে মাহরিসার বাম হাত চেপে ধরে শক্ত করে।
আঁতকে উঠে মাহরিসা।
“ কি করছেন কেউ দেখে ফেলবে…”
“ দেখুক।দেখানোর জন্যই তো ধরেছি।পরপুরুষ নই আমি।আমার বউয়ের হাত আমি ধরেছি তাতে কার বাপের কি? হুম? এত ভয় কিসের তোর?
আমাকে কাপুরুষ মনে হয় তোর? বিয়ে করেছি তোকে নিয়ে পুতুল খেলা করতে?” অসভ্য মেয়ে মানুষ। “
“ব্রো? কি করছো তোমরা দুজন।”
আদ্রিত মাহরিসার হাত ছেড়ে দিয়ে রক্তলাল চোখে চাইলো নীবিড়ের পানে।
নীবিড় ভরকে গেল।

“ তোদের বাপ ছেলের আমার আর আমার বউয়ের পেছনে পড়ে থাকা ছাড়া কোনো কাজ নেই? “
নীবিড় থতমত খেয়ে আমতা আমতা করে আদ্রিতের পাশে বসে তার ঘাড়ে হাত রেখে সুধালো,
“ কুল ডাউন ব্রো।তোমায় আইসক্রিম খাওয়াবো প্রমিস।”
“ তোর কাছে আইসক্রিম খেতে চেয়েছি? তোর বোনকে বোঝা।”
নীবিড় বিরবির করে,
“ যেখানে তুমি বউকে বোঝাতে পারছো না, সেখানো আমি বোনকে কি করে বুঝাই ব্রো? মেয়ে মানুষ মানেই জটিল কেস, বিশাল চাপের। কেস ফুল জন্ডিস কোনো সন্দেহ নেই তাতে।”

তাসফি নিস্তব্ধ’র পাশে বসে আদ্রিতের পানে সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“ আপনার গুনধর পুত্র মহাশয়ের মতিগতি কি বলুন তো?
সব সময় আমার মারু’র পিছুপিছু ঘুরঘুর করছে কেন সে?”
নিস্তব্ধ বউয়ের কথায় শুষ্ক ঢোক গিলে।
“ তোমার ছেলের মতিগতি তো মা হিসাবে তোমার ভালো জানার কথা বউ।আমি কি করে জানবো বলো তো।”
তাসফি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বুলিয়ে বলল,

“ আপনি জানেন না তাই?”
“ নাহ।”
“ ছেলে আমার আঁচল ছেড়েছে বহু বছর আগে জানেন না আপনি? তবুও কেন বার বার সেই কথা মনে করান আমায় ডাক্তার সাহেব? ভালো মা আমি হতে পারিনি।”
“ কেন পারনি?””
“কেন পারিনি আপনি জানেন না ডাক্তার সাহেব? ভালো মা আমি হতে পারিনি সেটা তো আমার দোষ।ছেলের মনের ইচ্ছা কে গুরুত্ব দেইনি সেটাও আমার দোষ বলুন? সব আমার দোষ।”
নিস্তব্ধ সকলের অগোচরে অর্ধাঙ্গিনীর কোমর জাপ্টে ধরে।
তাসফির অশ্রুসিক্ত চোখে গভীর দৃষ্টিতে চায়।
ফিসফিস করে সুধায়,

“ তোমার দোষ নয় ভুল অবশ্যই আছে জান।
তবে সেটা নিজেকে দোষারোপ করার মতন নয় মোটেও।
তুমি ভালো মা হতে পারো নি কে বলেছে বোকা মেয়ে?”
“ সত্যিই পারিনি আপনি বুঝবেন না।”
তাসফি নাক টানে।
প্রেয়সীর বাচ্চামো পাগলামোতে নিস্তব্ধ নিঃশব্দে হাসে।

“ বোকা মেয়ে।কে বুঝিয়েছে তোমায় এসব কথা?
এই যে নীরু’র এত খেয়াল রাখো তুমি প্রতি মুহুর্তে ক’জন মা করে তা?
আমাদের আদ্রিতের ভালোমন্দ চিন্তা করো সব সময় এগুলো ক’জন মা পারে?
ছেলে-মেয়েকে ছোট থেকে পেলেপুষে বড় করলে এত কষ্ট করে সেগুলো কি একজন ভালো মায়ের লক্ষণ নয়?
এই যে মাহরিসার জন্য ছেলেকে বিদেশ পাঠালে। কেন পাঠালে আদ্রিতের খারাপ চেয়ে?
না তো।

তুমি তো চেয়েছিলে মাহরিসা যেন আদ্রিতের উগ্র স্বভাবের জন্য ক্ষতিগ্রস্থ না হয়।
আমাদের মারু বড্ড নরম মনের মেয়ে সে তো তার মামির মতন কঠোর হৃদয়ের নয় যে একাই সব সলভ করতে পারবে।ছোট থেকে এত ঝোক মারু সামলাতে পারতো না।
কিন্তু ওর ভালো করতে গিয়ে যে নিজ ছেলেকে দূরে ঠেলে দিয়েছ, মা-ছেলের সম্পর্কে ফাটল ধরিয়েছ।এটা বুঝতে তোমার সময় লেগেছে। “

“ আপনি বুঝতে পারেন নি।আমি তো আদ্রিতকে পরিবর্তন হতে সময় দিতেই বিদেশে পাঠিয়েছিলাম।এমন তো নয় আমি ওর পছন্দ কে পায়ে ঠেলে দিয়েছি।
সময় হলে আমরা এগিয়ে যেতাম দুজনের সম্পর্ক ভেবে দেখতাম।
আপনি দেখেন নি সেদিন মাহরিসা আদ্রিত কে কতটা ভয় পাচ্ছিল।দেখেন নি আপনি?”
“ সেই সময় টাকি এখনো আসে নি তাসফি?”
তাসফি থমকে গেল।থেমে গেল তার কথা।
নিস্তব্ধ গম্ভীর হয়ে গেল।
থমথমে কন্ঠে বলল,

“ তোমার ভুলটা এখানেই বউ। তুমি সবসময় একপাক্ষিক ভাবে ভেবেছ।কখনো মাহরিসা কি চায় জানতে চেয়েছ? চাও নি তো।
ছেলেকে স্পষ্ট করে বলেছিলে যে তোমার ব্যবহার পরিবর্তন করে মাহরিসাকে নিজ হাতে আমি তোমার নিকট তুলে দেব বলেছিলে? বলো নি তো।
তবে কি করে হবে বলো?
ব্যক্তিগত জীবনে তুমি যতটা ফ্রি মাইন্ডের, ছেলের সঙ্গে তুমি ততটা ফ্রি মাইন্ডের হতে পারো নি।কৃপনতা করেছ তুমি সেথায়, কেন?

তোমার কোনো দোষ নেই কিন্তু ভুল আছে।
ভুল গুলো এক এক করে এখনো সুধরাতে পারো তুমি।সবটাই তোমার ইচ্ছা জান।বেস্ট অফ লাক।”
তাসফি কোনো প্রত্যুত্তর করলো না।প্রত্যুত্তর করার মতো কোনো শব্দ এই মুহুর্তে তার ভান্ডারে জমা নেই।
সে বুঝতে পারছে জীবনে চলতে হলে একপাক্ষিক ভাবে সবটা ভাবলে হয় না।অপরজনের মতামত বড্ড গুরুত্বপূর্ণ, হোক সে ছোট কিংবা অপরিপক্ক। সেই মানুষটার মতামত পরিস্থিতি এক লহমায় বদলে দিতে পারে।
দুনিয়ায় অসম্ভব কিছুই না।

নাওমী অদিতিকে সাজিয়ে দিচ্ছে। খয়েরী রঙা একখানা জামদানী শাড়ি পড়াচ্ছে নাওমী অতিথি পাখিকে।ভীষণ মিষ্টি লাগছে তাকে দেখতে।অজানা কারণে নাক ফুলে আছে অদিতির।তাতে আরো মিষ্টি লাগছে দেখতে।
শাড়ী খানা সে সঙ্গে করে এনেছে।
কে দিলো তা সিক্রেট।
একফাঁকে নাওমী অদিতিকে ফিসফিস করে বলল,

ধূসর রংধনু ৩ পর্ব ৩৯

“ শুনলাৃ পাত্রের নাম নাকি সাদাফ ইফতিসাম অতিথি পাখি। ”
অদিতি হতবিহ্বল দৃষ্টিতে চেয়ে।
কি আশ্চর্য তার সঙ্গে হচ্ছে কি এসব।শেষ পর্যন্ত এই ছিল তার কপালে? ছিঃ,ছিঃ,ছিঃ।
সময় গড়ায়। বিকাল নামে ধরণীর বুকে।তৃপ্তির ফ্লাটের কলিংবেল বাজে।
তড়িঘড়ি করে ছুটে যায় সে।
দরজা খুলে দিতেই স্তব্ধ বদনে চেয়ে রয় সে সামনে।
তার চোখে মুখে ফুটে উঠেছে বিস্ময়, হতবাকতা।কথা বলার ভাষা হারায় সে।
এও কি সম্ভব? কি করে?

ধূসর রংধনু ৩ পর্ব ৪১