ধূসর রংধনু ৩ পর্ব ৮

ধূসর রংধনু ৩ পর্ব ৮
মাহিরা ইসলাম মাহী

সূর্যিমামার উত্তপ্ত শ্বাস ফেলার শেষ মুহুর্তে।
বিকালবেলা,প্রকৃতির সঙ্গে গোসা করে সুর্যিমামা ডুব দিবে আপন দেশে।
নাওমী চেপে বসেছে রিক্সায়।
গন্তব্য তার নতুন টিউশনির, সঙ্গে নতুন ছাত্র-ছাত্রীর সঙ্গে পরিচিত হওয়া এবং পড়াতে আরম্ভ করা।
বাবা-মা বিহীন সে পরে থাকে হস্টেলের এক কোণায়।
এমন নয় তার বাবা মা নেই কিংবা সে এতিম।
এমনটা মোটেও নয়।
বাবা-মা, ভাই সবই আছে তার কিন্তু সম্পর্ক গুলো ছোট সময়ের মত আর দৃঢ় নেই। খুনসুটি ঝগড়া নাড়াইয়ে ভাঁটা পরেছে বহু আগে।

সম্পর্কের ছোট্ট শব্দটায় ভাঙন ধরেছে হাজার। আমাদের জীবনে সম্পর্কের সমীকরণ গুলো মেলানো মাঝে মাঝে বড্ড সহজ।আবার কখনো আমাদের কৃতকর্মের কারণেই তা হয়ে উঠে ভীষণ কঠিন,কষ্টসাধ্য।
বাবা-মা নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিলে, ভালো থাকার তাগিদে সেপারেট হয়েছে। বছর খানেক আগেই ডিভোর্স নিয়েছে তারা। তারা ভাবেনি তাদের ডিসিশন ছেলেমেয়ের উপরে কি প্রভাব ফেলবে।
এই দুনিয়ায় নিজের ভালো ব্যতীত অন্যের ভালো ক’জনই বা চায়।
আপনি বাঁচলেই বাপের নাম। নিজেদের সুখ বিসর্জন দিয়ে অন্যকে সুখে রাখতে চায় ক’জন?
হাহ।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তবে নাওমী চায়, যদি কখনো তার অন্যের সুখের জন্য নিজের প্রিয় জিনিসটিও ফেলে দিয়ে নিজের সুখকে বিসর্জন দিয়ে দুঃখকে আপন করে নিতে হয় সে করবে।বাবা-মাকে সে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে নিজের সুখ কে বিসর্জন দিয়ে দুঃখকেও আপন করে নিয়ে ও বেঁচে থাকা যায় খুব সহজে।
বাবা-মায়ের ডিভোর্সের পর নাওমীর আর ইচ্ছে হয়নি ওমন ভাঙা গোয়ালে নিজের ঠাই গুঁজতে। তাই তো নিজের খরচ সে যথাসম্ভব নিজে চালাতে চেষ্টা করে।তবে বাবা মা দুজনে তার একাউন্টে টাকা পাঠান নির্দিষ্ট খরচ যাবত, তবে নাওমী তাতে হাত দেয় না খুব প্রয়োজন ব্যতীত।
ওই যে আছে না কিছু মানুষ আঘাত দিয়ে ক্ষততে মলম লাগানোর ন্যায়। তার বাবা-মা খানিকটা তেমনি।
কিছু কিছু বাবা-মা এতটা স্বার্থপর কেন হয় ?

কেন তার বাবা-মা অদিতি কিংবা কাশফির বাবা মায়ের মতন হলো না? কেন?
আসলে সম্পর্কের মাঝে শুরু থেকে ফাটল থাকলে সে ফাটল পুনরায় ভরাট করা বড্ড কঠিন।
ইট,বালু, সিমেন্ট কিংবা মাটি যা কিছুই দিয়েই ফাটল বন্ধ করো না কেন, সে স্থানে একটু চোঁট পেলে তাতে ফাটল পুনরায় ধরবেই।এবং একসময় একদম নিঃশেষ হয়ে যাবে।
তার বাবা মায়ের সম্পর্কটা ছিলো ও এমন।
প্রথমে রাগ, জেদ, এরপর শরীরের টানে কাছে আসা, যার কুফল হিসাবে সে আর তার ভাই।হ্যাঁ কুফলই। তারা দুনিয়ায় আসায় সুফল তো বয়ে আনে নি।
এরপর ভালোলাগা শেষ, পুনরায় ধরলো সম্পর্কে ফাটল।
এই তো জীবন তাদের।

রিক্সা চালকের হুশিয়ারি ডাকে ভাবনাচূত হয় নাওমীর।
সামনে তাকিয়ে দেখে তার গন্তব্যে সে এসে পরেছে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে রিক্সা থেকে নামে।
ভাড়া মিটিয়ে সে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে।
চারপাশে বাউন্ডারি দেওয়া মাঝখানে গেইট করা লোহার।
তবে গেইটে কোনো তালা ঝোলানো নেই।
বোঝা যাচ্ছে বহু দিনের পুরোনো বাড়ি।
হয়তো বাপ দাদার আমলের।

কৌতূহল, সংশয় মিশ্রিত বদনে সে গেট পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো।
মাথার উপরে বিকালের নাম না জানা পাখিগুলো কিচিরমিচির করতে করতে ছুটে গেল তাদের নীড়ে।
চোখের চশমা ঠিকঠাক করে আঁটসাঁট হয়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতালায় উঠে কলিংবেল বাজালো নাওমী।
তবে প্রথম বাড়ে খুললো না, দ্বিতীয়বার বাজালো তাতেও কাজ হলো না।
ভ্রু কুঁচকালো নাওমী।বাসায় কেউ নেই নাকি।
তৃতীয়বার কলিংবেল দিতে নিতেই দরজার দু পাল্লা ধরে খুলে দাঁড়ালো এক যুবক।
যুবকের চোখেমুখে বিরক্তির শেষ নেই।

তার সামনে কে আছে সে দেখার তোয়াক্কা করলো না।কন্ঠে বিরক্তি ঢেলে হাজারো ক্ষোভ প্রকাশ করে সুধালো,
“ দেখতে পাচ্ছেন দরজা কেউ খুলছেনা।তার মানে বুঝতে হবে বাড়ির মানুষ অবশ্যই কোনো কাজে নিয়োজিত রয়েছে। এমন কাজ যা সে এই মুহুর্তে সম্পূর্ণ করতে না পারলে পেট খারাপ হবে, এরপর পোশাক খারাপ হবে,এরপর বিছানা খারাপ হবে, এরপর ঘর খারাপ হবে।কি বুঝতে পারেন নি? কি অদ্ভুত মানুষ সব ভাই আপনারা।
কোনো আক্কেল পছন্দ নেই।
একটা কাজ করতে পারলে বেঁচে যান।
আরে কলিংবেলেও তো একটা জান আছে নাকি।
অতিরিক্ত চাপাচাপি করলে তা তো দু দিনেই ভবলীলা সাঙ্গ করবে।”
নিজের কথা শেষে যুবক সামনের রমণীর পানে তাকাতেই যুবক-যুবতী দুজনেই একে অপরের দিকে চোখ বড় বড় করে চাইলো।
মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে তাদের চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে।
সঙ্গে দুজনের মুখশ্রী হতে মৃদু চাপা চিৎকারের সহিত বেরিয়ে এলো,

“ তুমি”
“ আপনি?”
নীবিড় চোখ বড় বড় রেখেই নিজেদের দরজায় আরো আঁটো সাঁটো হয়ে দাঁড়ালো,
“ নাউডুবা চশমিশ তুমি আমার বাসায় কি করছো?এই তুমি আমার পিছু করে আমার বাড়ি পর্যন্ত চলে আসো নি তো। খবরদার যদি প্লান করে থাকো আমার বাসায় এসে তুমি আমার মাথায় পুনরায় জল ঢালবে তাহলে বড্ড ভুল ভেবে ফেলেছ?”
নাওমী নিজের মাথা দুবার ঝাঁকিয়ে বলল,
“ এটা আপনার বাসা? ওওও গড। এই দিন ও বুঝি আমার দেখার ছিল।”
“ সরি এখন দিন নয় বিকাল। আর আমার বাসা মানে?তাতে তোমার কোনো সন্দেহ আছে? জলজ্যান্ত আমি টাকে তুমি তুমি দেখতে পাচ্ছো না?
চশমা তো পরে আছো।এখন তো দেখার কথা
এই তুমি চশমা পরেও কি কম দেখ নাকি?”
নীবিড়ের আজগুবি বকবকানিতে নাওমীর মেজাজ বিগড়ে গেল।

“ শাটআপ, ষ্টুপিড। কান ঝালা ফালা করে দিলো। এই আপনার মাথায় কি সামান্য কমনসেন্সটুকু ও নেই?”
নীবিড় চোখ বড় বড় করে বলল,
“ আমার বাড়ি এসে তুমি আমায় ঝারি মারছো নাউডুবা চশমিশ? তোমার সাহস দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। এক্ষুনি বেরিয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে।
মাকে কতবার করে বললাম যেন গেটে একটা তালা লাগায় তবে তো এই উটকো ঝামেলা গুলো আসতে পারে না”
“ এই কি বললেন আপনি? আমি উটকো ঝামেলা? কে টেনে এনেছে শুনি এই উটকো ঝামেলা? ওয়েট।”
নাওমী কাঁধের ব্যাগ থেকে ফোন বের করলো।
একটা টিউশনি পোস্টের সাপেক্ষে বারিশ মাহতাব আইডির কনভারসেশান দেখালো ফোনটা নীবিড়ের সামনে ধরে।
কনভারসেশান থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে ক্লাস এইটে পড়ুয়া নিশান-নিশানী কে পড়ানোর তাগিদে তাকে ঠিক করা হয়েছে প্রাইভেট টিচার হিসাবে।”

নীবিড় শুষ্ক ঢোক গিললো। কারণ আইডিটা তারই।
সেই কদিন আগে মাহরিসা কে দিয়ে পোস্ট করিয়েছে বান্দর দুটোর উপর অতিষ্ঠ হয়ে।মাহরিসাই বোধহয় কথা বলে নাউডুবা চশমিশ কে ঠিক করেছে।সে এসব কিছু জানেনা।
বিচ্ছু দুটো এতো বেয়াদব। সে কদিন পড়াতে নিতেই কিছু পড়ে না শুধু বলে পারিনা।তীব্র রাগে নীবিড় প্রত্যেকদিন দুটোর গালে বসিয়েছে চর।
বেয়াদব দুটো বাসন্তীর কাছে নালিশ জানিয়েছে।তারপরই তো এই উদ্যোগ।
বারিশ মাহতাব তার আইডিকার্ডের আসল নাম।
নীবিড় মাথা চুলকানো।
বাসন্তী তখন ভেতর থেকে এলেন হাঁক ছাড়তে ছাড়তে,
“ কে এলো নীবিড়? চিল্লাচ্ছিস কেন বাপের মত। বাপ বেটা একটার গলাও যদি একটু কমে।মেয়েদের মতো ঝগড়া করিস তোরা কিভাবে।”

বাসন্তী এসে নাওমীকে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়ে বলল,
“ কে গো তুমি মা? নীবিড়ের ফেন্ড?ওকে বাহিরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিস কেন হারামজাদা? বান্ধবী কে কেউ বাহিরে দাঁড় করিয়ে রাখে।”
নাওমী কথা বলতে চেষ্টা করলো কিন্তু বাসন্তী সেই সুযোগই দিচ্ছে না।
নীবিড়ের কান টেনে ধরলো বাসন্তী।
বান্ধবী কে ভেতরে নিয়ে বসা হারামজাদা।
বুদ্ধি সুদ্ধি কবে হবে তোদের।একটাকেও মানুষ বানাতে পারলাম না।সব হয়েছে এক একটা আস্ত গরু।
“ কি করছো মা কান ছাড়। এই মেয়েটার সামনে..”
নাওমী নীবিড়লর পানে চেয়ে না চাইতেও মুখ টিপে হাসতে লাগলো,
“ তোমার শুধু কান নয় পিঠে মারবো এবারে আমি খুন্তি দিয়ে।কোনো আক্কেল নেই। আর এই মেয়ে কি হ্যাঁ।অসভ্য ছেলে।”

“ মা বোঝার চেষ্টা করো ওও আমার বান্ধবী… “
বাসন্তী নীবিড়ের কথায় পাত্তা না দিয়ে বলল,
“ হ্যাঁ আমি জানি ওও তোমার বান্ধবী।”
সে আবারো নাওমীর দিকে চেয়ে মুচকি হেসে সুধালো,
“ তুমি এখনো বাইরে দাঁড়িয়ে কেন মা।এসো ভেতরে এসো।বেয়াদব টার কথা আর বলো না। তুমি আসবে ওও আমায় জানাবেনা।তবে তোমার জন্য আমার হাতের স্পেশাল পাকোড়া বানিয়ে রাখতে পারতাম। এমনি এমনি কি আর বলি বাপের মত হয়েছে। বাপ থাকে সারাদিন ক্লিনিকে,সকলের দাঁত উঠিয়ে বেরান।আর ছেলে তার বাহিরে বাঁদরামি করে বেরান।”

বাসন্তী নাওমীর হাত টেনে ভেতরে এনে সোফায় বসালো তাকে।
নীবিড় বাসন্তীকে বোঝানোর তাগিদে তার পিছু ছুটলো।
নাওমী হাসলো। বুঝলো ভদ্রমহিলা বড্ড মিশুকে।
তীব্র আফসোসে মন ভার হলো তার।ইশশ এমন একটা মা যদি তার থাকতো। জীবনে তার আর কোনো আপসোস থাকতো না।
গোপনে দীর্ঘশ্বাস বের হলো তার।
তার নিয়তিকে সে মেনে নিয়েছে।
সবাই তো জীবনে সব কিছু পায় না। সব যে পেতে হবে এমন কোনো কথা ওও নেই।
যারা এতিম তারাও তো বেঁচে আছে। তবে সে কেন আফসোস করবে।উহু আফসোসের প্রশ্নই উঠে না।
বাসন্তী পানির ভরতি গ্লাস নাওমীর হাতে দিতে দিতে প্রশ্ন করলো,

“ তোমার নাম কি মা?”
“ জ্বী। নাওমী।মুশফিকা নাওমী আন্টি।”
“ বাহ ভীষণ আদুরে নাম।তোমাদের বাসা কোথায় মা?”
বাসন্তীর এবারের প্রশ্নে নাওমীর মুখখানা চুপসে গেল।
মিহি স্বরে বলল,
“ আমি হস্টেলে থাকি আন্টি?”
বাসন্তী নীবিড়ের পানে চেয়ে কটমট করে সুধালো,
“ তুই তো আমায় বলিস নি আগে নীবিড় মেয়েটা হস্টেলে থাকে।কোনো আক্কেল নেই তোর। আহারে বেচারী।আমরা নিজেরাও তো পেইন্টগেস খুঁজছিলাম।
হস্টেলের ওসব ছাঁইপাশ খাবার খাওয়া যায়।
শুনো মা তুমি কিন্তু আমাদের এখানে উঠে যেতে পারো।কোনো সমস্যা নেই।
নাওমীর চোখ ভিঁজে এলো।

ধূসর রংধনু ৩ পর্ব ৭

ইশশ আন্টি টা এত মিষ্টি কেন।
এত মিষ্টি আন্টির বদমাশ ছেলে হলো কেমন করে? নিশ্চয়ই অসভ্যটার মাথায় সমস্যা আছে।
বাসন্তী পুনরায় প্রশ্ন করলো,
“ তোমাদের বাসা কোথায় মা? তোমার মা-বাবা কোথায় থাকেন?”

ধূসর রংধনু ৩ পর্ব ৯