নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ২৩

নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ২৩
ঝিলিক মল্লিক

হাট-বাজার পেরোলেই ফুল-মার্কেট। এদিকটায় ফুলের চাষ মোটামুটি ভালোই হয়। আর ফুলের কেনাবেচাও। তাই এখানে একটা ফুল মার্কেটের অবস্থান রয়েছে। রিকশা থেকে নেমে দাঁড়ালো তাজরীন। সে মূলত এখানে এসেছেই কিছু ফুলের মালা কিনে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আজ তাদের মেয়েদের একটা ছোটোখাটো পার্টি রয়েছে। পার্টির আয়োজন এবং সমস্ত পরিকল্পনা তাজরীন এবং আয়েশা ভাবি মিলে করেছে। এই পার্টির মূল হোতা তাজরীন। মিডনাইট পার্টি সাধারণত করা হয় না।

আগে তাজরীনরা সব কাজিন একসাথে হলে আয়োজন করতো। সময়ের সাথে সাথে সবাই নিজেদের পড়াশোনা এবং কর্মজীবনে ব্যস্ত হয়ে এখন আর আগের মতো দেখা-সাক্ষাৎ, আড্ডা হয়ে ওঠে না তাদের। আজকের এই আসর আয়োজনের পরিকল্পনা ছেলেদের কেউই তেমনভাবে জানে না। তাজরীন নিষেধ করেছে কাউকে না জানাতে। রুবায়েত শুধুমাত্র এটুকু জানে, আজ তাজরীন তার সাথে জোর-জবরদস্তি করে এসেছে এখানে ফুলের মালা কিনতে। এসব ফাতরামিমূলক এবং আজাইরা কাজকর্ম রুবায়েতের মতে। তাজরীন যখন রিকশায় উঠে আবদার করে বসলো, সে এই ফুলের বাজারে আসবে; তখন রুবায়েত লোক সমাগমের ভিড়ে ওকে জোরেসোরে একটা ধমকও দিয়ে বসেছিল। কিন্তু ওর একগুঁয়েমি জেদের কাছে শেষ পর্যন্ত হার মেনেছে। কুট্টুস রুবায়েতের কোলে বসে চকলেট খেতে খেতে আশেপাশের পরিবেশ দেখছে। রুবায়েতের খোঁচা খোঁচা হালকা দাঁড়িযুক্ত গালে হাত রেখে আদুরে কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আঙ্কেল, তাজ বাবুকে বকা দিচচো কিনু? ও কি কনেছে?”
রুবায়েত হাসি চেপে রেখে গম্ভীর মুখে জবাব দিলো,
“তোমার তাজ বাবু খুব পঁচা, বুঝলে কুট্টুস সোনা।”
তারপর-ই রুবায়েত হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে অদূরে ফুল দেখতে ব্যস্ত থাকা তাজরীনের দিকে চেয়ে বিরবির করে বললো,

“এই বয়সের মেয়েরা হুটহাট প্রেমে পড়ে। যার-তার প্রেমে পড়তে পারে এরা। এদের সমস্যা হচ্ছে, এরা প্রেমে পড়ার সময় লোকজন, সময়, পরিবেশ, অবস্থান কোনোকিছু-ই বিবেচনা করে না। এমনকি কার প্রেমে পড়ছে, সেই মানুষটা কেমন; তা-ও দেখে না। একটা পর্যায়ে যেয়ে এরা বিপদসীমা অতিক্রম করে। ডিফেন্সের ভাষায় যাকে বলে “বর্ডার লাইন ক্রস করা।” এই বিপদসীমা অতিক্রম করা মানেই সর্বনাশ। সবাই সর্বনাশের মুখোমুখি হতে পারে না। সহ্য করা সবার পক্ষে সম্ভব নয়। হয় নুইয়ে পড়ে, নাহয় বিপরীত ব্যক্তিকে অভিশাপ দেয়। আর সেই বিপরীত ব্যক্তিও যে অভিশাপ মাথা পেতে নেবে— এমনটা নয়।”
“তোমি কী বলো রুবাই আঙ্কেল?”

রুবায়েতের গাল ধরে ওর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো কুট্টুস। রুবায়েত জবাব দিলো না। বরং সামনে তাকিয়ে চেঁচিয়ে ফুলের রাজ্যে মগ্ন থাকা তাজরীনকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“এই মেয়ে, হয়েছে আপনার? দ্রুত আসুন। আমার সময় নষ্ট করবেন না।”
তাজরীন শুনেও শোনেনি। সে তখন দোকানদারের সাথে দরদাম করতে ব্যস্ত। দোকানদার এক টাকাও কমাবে না ফুলের। এদিকে তাজরীন এক টাকাও না কমিয়ে ফুল কিনবে না। রুবায়েত মহাবিরক্ত। মেয়েমানুষ নিয়ে আসার অভিজ্ঞতা তিক্ত হয়ে উঠছে। এতো সময় লাগে নাকি! তখনই রুবায়েতের ফোনে কল আসলো। ‘মা’ সম্বোধনে সেভ করা নাম্বারটা দেখা মাত্র-ই কল রিসিভ করলো রুবায়েত। ফোনের ওপাশ থেকে একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা বলে উঠলেন,

“আব্বু, তুমি বাসায় আসছো কবে?”
রুবায়েত হালকা হেসে জবাব দিলো,
“একথা জানার জন্য এখন এই অসময়ে ফোন করেছেন মা?”
ওপাশ থেকে রেশমা খাতুন জবাব দিলেন,
“তা নয়তো কী? কতগুলো দিন থেকে বলছি তোমাকে। আর তুমি শুধু ডেটের পর ডেট দিয়ে যাচ্ছো। ওদিকে আমি মেয়েটাকে আশা দিয়ে রেখেছি, তুমি এবার এলেই ওর সাথে তোমার কাবিনটা পড়িয়ে রাখবো। কিছু না হোক, অন্তত আকদ তো হওয়া দরকার। আর কতদিন অপেক্ষা করবে মেয়েটা?”
রুবায়েত এবার গম্ভীর স্বরে জবাব দিলো,
“আমার কোনোকিছুর শিওরিটি নেই মা। যার কথা বলছেন, সে চাইলে অপেক্ষা করতে পারে। নাহলে নয়। যখন সময় হবে, আমি জানিয়ে দেবো। তার আগে নয়। এখন রাখছি। পরে কথা হবে আম্মা। আপনার মেডিসিন নিয়েন রেগুলার টাইম মতো। আল্লাহ হাফেজ।”

রুবায়েত ফোন কেটে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। ফোন পকেটে রেখে আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো। সময় যেন কাটতেই চাইছে না। ঘড়ির কাটা এক জায়গায় থমকে আছে নাকি! রুবায়েত হাতঘড়িতে সময় দেখলো। সাড়ে সাতটা বাজে। আর কতক্ষণ যে অপেক্ষা করতে হবে। রিকশাওয়ালাও তাড়া দিচ্ছেন। এতোক্ষণে তার তিন-চারটে খ্যাপ মারা হয়ে যেতো। কতগুলো টাকা লস হলো! রুবায়েত বললো, বাড়তি আরো টাকা দেবে। তবু যেন আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে। না-হয় গ্রামের এমন বাজারের আশেপাশে রিকশা পাওয়া খুব দুঃসাধ্য ব্যাপার। রিকশা খুঁজতে হলে সেই গড়ের মাঠ অবধি যেতে হবে। অন্ধকারের মধ্যে বাচ্চা আর মেয়েমানুষ নিয়ে ওপথে যাওয়া সমীচীন হবে না।
তাজরীন ফিরলো আরো মিনিট পাঁচেক পরে। ততক্ষণে রুবায়েত পুরোপুরি অধৈর্য হয়ে উঠেছে। এখন তাজরীন না আসলে নিশ্চয়ই ও নেমে যেতো। তাজরীন উঠে বসতেই রুবায়েত ঝাঁঝালো সুরে ওকে বললো,
“ফারদার আর কখনো আমার সাথে আসতে চাওয়ার সাহস করবেন না। এই-ই লাস্ট। আপনার জন্য আমার প্রচুর টাইম লস হয়, হচ্ছে। ইন ফিউচারে কিন্তু আর টলারেট করবো না। আমি আপনার মতো এতো ফালতু টাইম নিয়ে বসে থাকি না।”

তাজরীন আশ্চর্য হয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকালো রুবায়েতের দিকে। রাস্তার পাশের হালকা আলোয় দেখলো, লোকটার কপালের রগ ফুলে আছে। মেজাজ খুব খারাপ বোধহয়। তাজরীন আরো খারাপ করতে বললো,
“তো অপেক্ষা করেছেন কেন? কে অপেক্ষা করতে বলেছে আপনাকে? সময় নষ্ট হচ্ছে বলে মনে হচ্ছিল যখন, তাহলে চলে গেলেই পারতেন।”
রুবায়েত হাতের মুঠো শক্ত করে মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করলো। বারবার প্রমাণিত, পৃথিবীতে যত যা ঝামেলা; তার মূল হোতা বেশিরভাগ সময় হয় নারীরা। এদের সাথে তর্ক করা বোকামি। একথা ভেবে রুবায়েত চুপ হয়ে গেল। কিন্তু তাজরীন থামলো না। তাদের দু’জনের মাঝখানে ফুলের পলিব্যাগটা রেখে কুট্টুসকে রুবায়েতের কোল থেকে টেনে নিতে নিতে বললো,

“কুট্টুস সোনা আমার কোলে আসো। বদমাশ লোকদের কোলে যেতে হয় না বাবা। তোমাকে নিয়ে ছেলেধরাদের কাছে বিক্রি করে দেবে লোকটা।”
কুট্টুস অত্যন্ত গুরুতর স্বভাবের বাচ্চা। যেকোনো কিছুকে বাস্তবিকভাবে নিয়ে নিতে পারে। তাজরীনের এই কথাগুলোও মনে গেঁথে নিলো। তাজরীনের চাদরের ভেতরে গুটিসুটি মেরে জড়োসড়ো হয়ে বসে বেশ অবাক হয়ে এবং ভয় পাওয়া কন্ঠস্বরে বললো,
“রুবাই আঙ্কেল ছেলেধরা? মানে বাছছাদের ধলে নিয়ে বিক্রি করে দেয়? আমি আল রুবাই আঙ্কেলের কুলে তাবো না। তবাইকে বুলে দিবু, রুবাই আঙ্কেল ছেলেধরা।”
তাজরীনও কুট্টুসের সাথে তালে তাল মিলিয়ে ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ভয়ার্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
“হ্যাঁ সোনা। ওই লোকের কথা তবাইকে বলে দিবা। কেমন?”
কুট্টুস ভয়ে ভয়ে জোরে জোরে কয়েকবার মাথা নাড়ালো। রুবায়েতের বিরক্তি সীমা ছাড়াচ্ছে। অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে এই মেয়ের কর্মকাণ্ডে। রিকশার প্যাডেলে হাতটা জোরে বা’রি মেরে মুখে ‘চ’ কারান্ত শব্দ উচ্চারণ করে বিরবির করে বললো,
“আশ্চর্য মেয়েমানুষ!”

“আরেএএ এ-তো দেখি কপোত-কপোতীরা। আমাদের গ্রামে নাকি? এরকম কপোত-কপোতী গ্রামে দেহা যায় না বহুত কাল।”
রুবায়েত চুপচাপ ভাড়ার ফিরতি টাকা নিতে লাগলো৷ পেছনে ঘুরেই এগিয়ে গিয়ে ছেলেটার কানের নিচে কয়েকটা বসিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা ওর মাথায় ঘুরছিল তখন। তার আগেই পিছু ঘুরে দেখলো, কুট্টুস দাঁড়িয়ে আছে তার পাশ ঘেঁষে। আর তাজরীন এগিয়ে গেছে সেই ছেলেটার দিকে। রুবায়েত ওকে থামানোর জন্য এগোতেই যাবে, তার আগেই সেদিক থেকে তাজরীনের গলার আওয়াজ শোনা গেল।

“আব্বে শালা! গ্রামটা কী তোর বাপের লাগে নাকি হ্যাঁ? এর আগে কপোত-কপোতী দেখোস নাই? নাকি নতুন দেখতেছোস? আর আগে দেখলেই নিশ্চয়ই অন্ধ নাহয় সদ্য জন্মানো ফুটফুটে বাচ্চা ছিলি। তখন তো চোখ ফুটে নাই। এখন বাচ্চাটার চোখ ফুটেছে। তাই নতুন নতুন দুনিয়া দেখতেছে। আহারে৷ বাচ্চাটার জন্য বড্ড মায়া হচ্ছে। থাক বাচ্চা। কান্দিস না। এরকম কপোত-কপোতী জীবনে আরো বহুত দেখতে পাবি। জাস্ট জবানটা সামলাইয়া নিস। নাহলে কপোত-কপোতী দেখার জন্য তোর চোখদুটো পরবর্তীতে আর বেঁচে থাকবে না।”
ছেলেটা কোনো জবাব দিতে পারলো না তাজরীনের কথার বিপরীতে। শুধু হা হয়ে দেখতে লাগলো সামনে দাঁড়ানো মোটামুটি ভালো-ই উঁচু লম্বা সালোয়ার-কামিজ পরিহিত ও শাল চাদরে আবৃত বখাটে গোছের মেয়েমানুষকে। এরকম মেয়েলোক এর আগে কখনো দেখেনি বলেই বোধহয় বেশি আশ্চর্য হয়েছে ছেলেটা। আশ্চর্য ভাব সহজে কাটবে বলে মনে হয় না। তাজরীন তখন ছেলেটার কাঁধে আলতোভাবে চাপড়ে দিয়ে বললো,

“মুখ বন্ধ কর বাজান। গ্রামাঞ্চলে যত্রতত্র মশা ঘুরঘুর করে। মুখে মশা ঢুকে যাবে কিন্তু!”
তাজরীন আন কথা বাড়ালো না। ছেলেটা আশ্চর্যের চূড়ান্ত সীমায় রেখে ফিরতি পথে পা বাড়ালো। রুবায়েত নির্বিকারভাবে দেখছিল ওর কর্মকাণ্ড। কিছু বললো না তবু। কুট্টুসকে কোলে নিয়ে ফোনের টর্চ জ্বালিয়ে হাঁটা ধরলো মেঠোপথে।

রুস্তম আর জীম পাশাপাশি বসে আছে।
যত ঝগড়া মারামারি, কাটাকাটি আর হানাহানি-ই হোক না কেন এই দু’টো বোধহয় একে-অপরের থেকে দূরে থাকবে না। এই-যে এখনো মনোমালিন্য কাটেনি তাদের মধ্যে। তবু তারা পাশাপাশি বসে খাবার খাচ্ছে। আজ ছিটা রুটি, নাজির শাহী চাউলের সাদা ভাত আর মেজবানি মাংস রাতের স্পেশাল আইটেম হিসেবে রাখা হয়েছে। উঠোনে প্যান্ডেলের কাজ চলমান। এখনো পুরোপুরি সম্পূর্ণ কাজ শেষ হয়নি। সেই প্যান্ডেলের নিচেই বিশাল শামিয়ানা টাঙিয়ে রাতের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আপাতত বাইশ জন বসেছে এখানে। ভেতরে আরো কয়েকজন। রুস্তমরা ভেতরে যায়নি। ওদিকে অতিরিক্ত গ্যাদারিং। তাই সবাইকে নিয়ে এই খোলা হাওয়ায় বসেছে। ইকবাল ভাই, হাফসা ভাবি, মাহমুদ আরো কয়েকজন মিলে খাবার সার্ভ করছেন। জীম কিছু খেতে পারছে না ঠিকমতো। সব খাবার তুলে দিচ্ছে শাহবীরের প্লেটে। শাহবীর সেগুলো দেখে বিরক্তি সহকারে তাকাচ্ছে জীমের দিকে। ফিসফিসিয়ে বললো,
“খেতে প্রবলেম কী? সবসময় দেখি এমন করো। খাবারের সাথে কীসের শত্রুতা? ডায়েটিং করছো?”

শাহবীরের কথা শুনে জীম অবাক হওয়ার ভান করে গালে হাত দিয়ে ওর দিকে চেয়ে বললো,
“মারে মা! ডায়েটিং-ফায়েটিং আবার কী জিনিস? ওসব আমি করি না। বিয়ের আগেও কত মোটা ছিলাম দেখেননি? ওজন ছিল পঞ্চাশ কেজি। আত্মীয়-স্বজনরা সবসময় বলতো, ‘তিন ভাই-বোনের মধ্যে কী শুধু তোমাকেই তোমার আব্বা-আম্মা খাওয়ায়? আর দুটোকে খাওয়ায় না?’ তাহলে বুঝুন, আমি কেমন ডায়েটিং করতাম।”
শাহবীর বিরোধ করে বললো,
“আগে করতে না। কিন্তু এখন করো।”
জীম কপাল কুঁচকে জবাব দিলো,
“আসলে ডায়েটিং-ফায়েটিং কিছু না। খেয়াল করলে লোকে ঠিকই বুঝবে, বিয়ের আগে আমার আব্বা-আম্মা আমাকে কেমন ভালোবাসতেন, আদর-যত্ন করতেন। আর বিয়ের পরে আমার স্বামী আমার সাথে কেমন আচরণ করেন। সব-ই ভালোবাসার প্রভাব। ওটার মানের ওপর নির্ভর করে।”
শাহবীর এবার এক টুকরো মাংস জীমের মুখে ঠেসে দিয়ে ওর কাছ ঘেঁষে ফিসফিসিয়ে বললো,
“ভালোবাসার প্রভাব, আই মিন ভালোবাসার অভাবের কথা বলছো? ওটা বরং তোলা থাক। পরে দেখছি।”

রাতের খাওয়া শেষে উঠানেই আড্ডা বসেছে। গানবাজনার ব্যবস্থা করেছে মাহমুদ। সবাই আসরে বসে গান গাইছে, গল্প শোনাচ্ছে, জোকস বলছে। সায়নের বন্ধুরাও সবাই আছে আড্ডার মাঝে। ওরা বেশ মজার মানুষ। জোকসগুলো বেশিরভাগ ওরা-ই বলছে। বিশেষত কাউসার, আহসান আর ইয়ামিন৷ এরইমধ্যে যে-কোনো একজনকে গান গাইতে বলা হলো। সবাই একে-অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো। শাহবীর আর রুবায়েত তো আগেই বাদ। গম্ভীর, বেরসিক মানুষদের কাছ থেকে এসব আশা করা অকল্পনীয় ব্যাপার। জীম জানালো, সে গান গাইলে রাতের জীন-ভূতেরা অতিষ্ট হয়ে ভয় দেখাতে চলে আসবে। শোয়েবকে ধরা হলো। শোয়েব অজুহাত দিলো, তার গলা ভেঙেছে। তার পক্ষে আপাতত এই প্রতিভার ভার গ্রহণ করা অসম্ভব। আফিম আর তহুরার মধ্যে সম্ভবত ঝামেলা এখনো চলমান। দু’জন তো অনেকক্ষণ ধরেই চুপচাপ। তারা এককথায় নাকচ করে দিলো। একে-অপরের সাথে পাল্লা দিয়ে চলছে যেন। গান যে কে গাইবে তা নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া যাচ্ছে না। আলোচনা চলতে লাগলো। তখনই সেই মুহূর্তে তাজরীনের ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। এতোটাই জোরে, যে সবার মনোযোগ তার দিকে গেল। তাজরীন ফোন স্ক্রিনে তাকিয়ে অপ্রস্তুত হলো৷ ওকে অমন পরিস্থিতিতে দেখে রিক্তি আবার মজা করে বলে বসলো,
“কে গো? জামাই ফোন করেছে নাকি?”

তাজরীন মাথা নোয়ালো। আরো বেশি অপ্রস্তুত হয়ে পরলো। কোনো জবাব দিলো না। সবাই ওর দিকেই চেয়ে আছে জবাবের আশায়। শাহবীর তখন বললো,
“কী রে? ওর ফোনটা ধর। দরকার হয়, উঠে গিয়ে ওপাশে যেয়ে নিরিবিলিতে কথা বল।”
সবাই তখন হা হয়ে আছে৷ জেসি, রিক্তি আর তহুরা তো বেশ অবাক হয়েছে। সবাই কানাঘুঁষা করতে লাগলো নিজেদের মধ্যে। বললো,
“তাজরীনের বিয়ে হয়ে গেছে, অথচ আমরা জানলাম না? দাওয়াত পেলাম না? এটা কিছু হলো!”
শাহবীর সামান্য হেঁসে জবাব দিলো,
“বিয়ে হয়নি। জাস্ট এনগেজমেন্ট হয়েছে। বিয়ের আয়োজন সামনে। আমার হবু সম্বন্ধী-ই কল করেছে। তাজের ফিয়োন্সে!”

সবাই অবাক। অগোচরে এতোকিছু! কবে হলো, কিভাবে হলো, সেসব বরং তাজরীনের মুখ থেকেই গল্প শুনবে। আপাতত তাজরীনকে অভিনন্দন জানিয়ে কথা বলার সুযোগ দেওয়ার জন্য যেতে দিতে চাইলো সবাই। তাজরীন এতোক্ষণ মাথা নুইয়ে ছিল। শুধুমাত্র একজন ব্যক্তি তাকে অভিনন্দন জানায়নি এই ভরা আসরের মধ্যে। তাজরীন এবার সামনা-সামনি বসা মানুষটাকে দেখলো ধীরে ধীরে মুখ উঠিয়ে। চোখে চোখ পরতেই তাজরীনেরর বুকের হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল। ভেতর থেকে খিঁচুনি উঠলো যেন। ওই চোখদু‘টো অমন অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছে কেন তার দিকে! কোনো প্রতিক্রিয়া স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে না। শুধু চোখদু’টোতে দুনিয়ার একরাশ বিস্ময় লক্ষ্য করা গেল। তাজরীনের দিকেই বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। হাতের পেশি শক্ত, মুঠো করে রাখা।

তাজরীন ফোন রিসিভ করে কানে ধরে ‘হ্যালো’ বলতে বলতে দ্রুত উঠে গেল আসর ছেড়ে। পেছনে ফেলে রেখে গেল একরাশ বিস্ময়, বিভীষিকা, মিথ্যা এবং মিথ্যা সম্ভাষণ। সবটাই মিথ্যার চাদরে ঢাকা!

নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ২২

না, এটা নিতান্তই অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েমানুষ, একটা নির্দিষ্ট সম্পর্কে থাকতেই পারে। গোটা সবটাই স্বাভাবিক। রুবায়েত শান্ত, নিস্তব্ধ। যেন কোথাও কিছুই হয়নি। কিছু হলেও তার কিছু যায় আসে না। কিছুই না!

নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ২৪