নিষিদ্ধ অনুভূতি পর্ব ১৫+১৬
আহমেদ হৃদ
‘হাউ ডেয়ার ইউ!’
অভ্র’র রাগান্বিত কন্ঠে তানিয়া কেঁপে উঠলো। যে লোকের শান্ত, স্বাভাবিক গলাতেই ভয় লাগে, তার রাগান্বিত কন্ঠ কতটা ভয়াভয় হতে পারে ভাবতে পারছেন? তানিয়াও ব্যাতিক্রম নয়। সর্বস্ব ঝাঁকি দিয়ে উঠলো ভয়ে। অভ্র নিজের আসন ছাড়তেই তানিয়া চোখ-মুখ আবারো খিঁচে নিলো। কি এমন ভুল বললো সে? এতোগুলো ছেলের ছবি নিজের কাছে রাখা, তা দেখে মুচকি মুচকি হাঁসা, আবার সুন্দর-ও বলেছে নিজ মুখে! এ থেকে কি বোঝা যায়? সর্বপ্রথম মাথাতেই বা কি আসবে? তানিয়া তো অন্য সবার মতো নয়। সিধে কথা সিধে ভাবে বলা কি দোষের? হ্যা,দোষের! এই লোকটার কাছে দোষের! এইতো তার প্রমান!
হুট করে চারপাশ নিরব দেখে তানিয়া চোখ খুলবে ঠিক করলো। প্রথমে বা চোখ খুলে তাকাতেই কলিজা শুকিয়ে এলো তানিয়ার। সাথেসাথে চোখ বন্ধ করে নিলো আবারো। অভ্র ঠিক তার সামনে দাড়িয়ে। এতো কাছে কখন এলো? কপালের ভাঁজে ভাঁজে রাগের ছটা অভ্র’র! তানিয়া চোখ বুজে রেখেই চেয়ার পিছিয়ে উঠে দাড়ালো। চোখ খুলে ভয়মিশ্রিত সমীহ করে উঠলো। অভ্র কন্ঠনালি খিঁচে বলে উঠলো,
‘আপনার সাহস কি হয় এসব বলার?’
তানিয়া পিছিয়ে গেলো এক কদম। আমতা আমতা করে বললো,
‘ঠ্ ঠিকিই ত্ তো বলেছি।’
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
অভ্র টেবিলে থাকা কফির গ্লাসটা ছুঁড়ে মা`রলো মেঝেতে। শব্দ করে চৌচির হয়ে ভেঙে গেলো কফিশুদ্ধ মগটি। তানিয়া কেঁপে উঠলো আবারো। ভেতরটা ধরাস করে উঠলো। নিজের ওড়নার কোণা খিঁচে শক্ত হয়ে দাড়ালো। কাঁদো কাঁদো চোখে তাকালো অভ্র’র দিকে। রক্তিম লাল অভ্র’র দু’টি চোখ। নাক ফুঁসছে। আজ তানিয়া শেষ! এবার তানিয়ার মনে হচ্ছে, সত্যিই সে ভুল করেছে। মোটেই এসব চাকরি-বাকরি করা উচিত হয়নি তানিয়ার। পথে-ঘাটে ঠিক তানিয়া পটিয়ে নিতো! কিন্তু, পরপর-ই প্রশ্ন এলো তানিয়ার মাথায়; পটানো? তাও এই লোকটাকে? এসব চিন্তা করে কিভাবে সে? নিজেই নিজেকে গালি তানিয়া। অভ্র’র দিকে তাকাতেই দেখলো অভ্র তার দিকে আসছে। তানিয়া ভয়ে কাঠ! এবার কি হবে? তানিয়া পেছাতে লাগলো। অভ্র যত কাছে আসছে, বুক থেকে শুরু করে সারা শরীর কাঁপছে তানিয়ার। অভ্র তখনো এগোচ্ছে। থামছে না কেনো লোকটা? একটু দূরেই নিচু অংশ। কয়েকপা এগোলেই যে তানিয়া ধপাস করে পড়বে, একশো ভাগ শিওর। তবুও অভ্র এগোচ্ছে। চেয়েও তানিয়া নিজেকে থামাতে পারছে না। আর এক পা পেছলেই তানিয়া আজ নিশ্চিত ত্যাগ করবে ইহজগৎ। তানিয়া মনেমনে আল্লাহ’কে ডেকে নিলো। একটু পেছতেই চোখমুখ খিঁচে নিয়ে উল্টে পড়লো তানিয়া।
পড়ে গিয়েও অস্বাভাবিক ভাবে ব্যাথা লাগলো না তানিয়ার। তানিয়া তখনো চোখ বুজে। সে কি ম’রে গেছে? তানিয়ার মনে হচ্ছে সে ম’রে গেছে। তাই তো ব্যাথা লাগলো না। ধিরে ধিরে চোখ খুলে যখন দেখলো, অভ্র তার হাত ধরে আঁটকে নিয়েছে; সৃষ্টিকর্তা প্রতি শুকরিয়া আদায় করলো তানিয়া। লোকটাকে তানিয়া যতটা খারাপ ভাবে ততটা খারাপ নয় আসলে। অভ্র শান্ত মুখে তার দিকে তাকিয়ে। গম্ভীর গলায় বললো,
‘সামান্য এগোতে দেখেই যার নখ পর্যন্ত থরথর করে কাঁপে, সে কোন কলিজায় আমায় সমকামী বললো; ব্যাপারটা ভাবাচ্ছে আমায়!’
তানিয়া সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করলো অভ্র’র কথাটা। আকুতি করে বলে উঠলো,
‘ওঠান আগে। ভয় লাগছে।’
‘আগে উত্তর দিন।’
‘কি উত্তর দেবো? আচ্ছা আচ্ছা, যা বলেছি তার জন্য সরি।’
‘ব্যাস?’
তানিয়া চোখ ছোটছোট করে তাকালো। আর কি করবে? কষ্ট করে বানানো কফিটা তো ফেলে দিলো। সরি-ও বললো। তাহলে আর কি চায় লোকটা? তানিয়া উত্তর দিলো। আসলে উত্তর দেয়ার মতো কিছু পেলো না। একেই ঝুলিয়ে রেখেছে, আরও কিছু? অসম্ভব! অভ্র’র জন্যই তো তুর্য তাকে আয়া বলেছে। এটা তো ভোলার বিষয় নয়!
অভ্র ধীরগতিতে ছেড়ে দিলো হাঁতটা। সাথেসাথে চিৎ করে উল্টে পড়লো মেঝেতে। ধপাস করে পড়তে না পড়তেই আর্তনাদ করে উঠলো তানিয়া,’মাগোওওও! ম`রে গেলাম!’
তানিয়া ডানহাত কোনমতে তুলে কোমরে রাখলো। ব্যাথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। তানিয়া কস্মিনকালেও কল্পনা করেনি অভ্র এমন করবে। ‘ব্যাটা খচ্চর! বেয়াদব! তোর বউ অকালে মরবে দেখিস!’
মনেমনে ভাবলেও, পরক্ষণে তানিয়া জিভ কাটলো। অভ্র’র বউ তো তানিয়া হবে। তানিয়া যে এই দোয়া ভবিষ্যতে করবে, আর সেটা যে কবুল ও হবে; কে ভেবেছিলো? এইতো মর’ছে সে! ব্যাথায় বিষিয়ে উঠছে সারা শরীর। তানিয়া চোখ-মুখ কুঁচকে নিয়ে উঠে বসলো কোনমতে। নিশ্চিত কোমর ভেঙে গেছে! হাতটাও জ্বলছে! তানিয়া হাতের কনুই এর দিকে তাকালো। থিতিয়ে গেছে কিছুটা। ব্যাথায় চোখে পানি চলে এলো তানিয়ার। টলোমলো চোখে নির্দয় ব্যাক্তিটির দিকে তাকালো। আগের মতোই ভাবলেশহীন ভাবে দাড়িয়ে। তানিয়ার শ্বাস আঁটকে আসছে। কোমর ঝিলিক দিয়ে উঠছে। অভ্র আগের মতোই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে গিয়ে দাড়ালো টেবিলটার কাছে। টেলিফোন তুলে ফোন দিলো বললো,’কেবিনে আসুন।’ এরপর কেটে দিলো। নিজের কেদারায় আরাম করে বসে পূর্নদৃষ্টি মেলে তাকালো তানিয়ার দিকে। তখুনি কেউ নক্ করলো,
‘আসব স্যার?’
‘আসুন।’
অথৈ প্রবেশ করলো কেবিনে। তানিয়াকে ওভাবে পড়ে থাকতে দেখে অবাক হলো। আরও অবাক হলো, যখন দেখলো মেঝেতে কফি পড়ে আছে। অথৈ অভ্র’র দিকে তাকাতেই অভ্র নরম কন্ঠে বললো,
‘পড়ে গেছে আঘাত পেয়েছে। ওনাকে নিয়ে যান। যেখানে যেখানে ব্যান্ডেজ করার দরকার করে দেবেন।’
অথৈ অবাক হয়ে একবার অভ্র’র দিকে আরেকবার তানিয়ার দিকে তাকাচ্ছে। এতোবড় উঁচু-নিচু জায়গাটা মেয়েটা দেখলো না? অথৈ এগিয়ে গেলো। তানিয়াকে কোনমতে উঠিয়ে দাঁড় করালো। ব্যাথায় গোঙাচ্ছে তানিয়া। অথৈ কোনমতে তানিয়াকে নিয়ে বেড়িয়ে গেলো কেবিন থেকে। কমন রুমে নিয়ে বসালো তানিয়াকে। ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে এসে হাতে ব্যান্ডেজ করে দিলো। জিজ্ঞেস করলো,
‘আর কোথাও ব্যাথা পেয়েছো?’
তানিয়ার চোখ বেয়ে তখনো পানি ঝড়ছে। তানিয়া কোনমতে উচ্চারণ করলো,’কোমরে।’
অথৈ ব্যাথার মলম লাগিয়ে দিলো। মেয়েটাকে দেখে খারাপ লাগছে অথৈর। নিশ্চয়ই অনেক ব্যাথা পেয়েছে! অথৈ জিজ্ঞেস করে,’কিভাবে পড়লে?’
নিজেকে স্বাভাবিক করে তাকালো অথৈর দিকে তানিয়া। তেতে বলে উঠলো,
‘ওই অসভ্য লোকটাই তো..’তানিয়া থেমে গেলো। অন্যদিকে ফিরে চুপ করে রইলো।
অথৈ জিজ্ঞেস করলো,’কোন অসভ্য লোক?’
‘ক্ কিছুনা।’
অথৈ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। এরপর চলে গেলো। অথৈ যেতেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো তানিয়া। এখনি বলে দিতে গিয়েছিলো। কিন্তু অভ্রকে তানিয়া দেখে নেবে! তাকে ফেলে দিলো তো? শোধ তুলেই ছাড়বে তানিয়া।
বেলা এগারোটায় ছেলেকে বাড়িতে দেখে অবাক হলেন ইরহাম। এতো বেলা অব্ধি কখনোই রুদ্রকে বাড়িতে দেখা যায় না। শনিবারে তো নয়’ই! ইরহাম পত্রিকার কাগজটা টি-টেবিলে রাখলেন। রুদ্র নিচে নামছিলো তখন। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, মাত্রই ঘুম থেকে উঠেছে। ইরহাম ডাকলেন,
‘রুদ্র।’
রুদ্র থামে। সে যাচ্ছিলো বাইরে। কালকে গাড়িটা বৃষ্টিতে ভিজে কাহেল অবস্থা হয়েছিলো। সেটা পরিষ্কার করতে বলতেই বাইরে যাচ্ছিলো রুদ্র। রুদ্র এগিয়ে এলো। বললো,’কিছু বলবে?’
‘বসো।’
রুদ্র সামনের সোফাটায় বসলো। ইরহাম জিজ্ঞেস করলেন,
‘আজ অফিসে যাওনি?’
পেপার হাতে নিতে নিতে রুদ্র’র উত্তর,’দেখছোই তো যাইনি।’
‘কেন যাওনি সেটাই তো জিজ্ঞেস করছি।’
‘অনেক রাতে ঘুমিয়েছিলাম। তাই..’
‘রাতকরে ঘুমানোর কারন?’
রুদ্র এবার বিরক্ত হলো। তার বাবা যখনি জিজ্ঞেস করতে থাকে, করতেই থাকে! রুদ্র’র মাঝেমাঝে মনে হয়, তার বাবা যদি পুলিশের চাকরি করতো; নিঃসন্দেহে আজ অনেক বড় কিছু হতে পারতো।
‘এই বয়সে তোমায় বোঝাতে হবে কেন রাত জাগছে? আর এই কয়েকদিন রুদ্র বাড়িতেই থাকবে। তুমি না হয় একটু গিয়ে দেখে আসবে।’
ইলিমা চায়ের কাপ রাখতে রাখতে বিরক্ত গলায় বললেন। ইরহাম তবুও কিছু বুঝলেন না। তবে আর প্রশ্ন-ও করলেন না। ইলিমা পাশে বসলেন। রয়েসয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
‘রুদ্র, আরুর সাথে তোর কথা হয়?’
রুদ্র পেপারেই মুখ গুঁজে রইলো। তার মা বুঝেছে, রাত জেগে আরুর সাথে গল্প করেছে রুদ্র। ওই মেয়ে এসব প্রেম-পুরিতি বোঝে? বুঝলে এমন সামান্য একটা কারন নিয়ে অভিমান করতো? রুদ্র হতাশ শ্বাস ফেললো। ছোট করে উত্তর দিলো,
‘হয়।’
‘একদিন আসতে বলিস তো ওকে।’
পেপার থেকে মুখ সরিয়ে মায়ের দিকে তাকালো রুদ্র। পাশে তার বাবাও তাকিয়ে। ইলিমা আশ্চর্য হলেন বাপ-ছেলেকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে। শুধলেন,
‘কি দেখছিস?’
রুদ্র জিজ্ঞেস করলো,’কেন?’
ইলিমা হাঁসলেন। বললেন,’ওমা, আসলে তো ভালোই। এমনিতে আরুকে বেশ ভালো লেগেছে আমার কাছে। কিন্তু কেমন যেনো দূরে দূরে থাকে। কাল তো কথাও বলেনি। হয়তো লজ্জা পায়। একদিন এলে সমস্ত লজ্জা-শরম কে`টে যাবে।’
কোথ থেকে দৌড়ে এলো জুঁই। তাল মিলিয়ে বললো,
‘আম্মু ঠিক বলেছে ভাইয়া। কাল আমি কথা বললাম, অথচ ভাবি কোন কথাই বললো না।’
রুদ্র গম্ভীর হয়ে গেলো। আরু কি আদেও আসবে? ইলিমা তাড়া দিয়ে উঠলেন,’কি রে, বলবি না?’
‘বলবো।’ উত্তর দিলো রুদ্র।
ইলিমা তৃপ্তি নিয়ে হাঁসলেন। এরপর তাকালেন জুঁই এর দিকে। কিছুটা কঠিন আওয়াজ তুলে বললেন,
‘জেবা কোথায় রে?’
জুঁই অন্যদিকে ফিরলো। জেবা তো এখনো ঘুমে। এই মেয়েটা প্রতিদিন জুঁইকে কেস খাওয়াবে। রাত জেগে কথা বলার দরকার কি যদি সকালে উঠতে না পারে? এখন তো তাকেও ধরবে তার মা। কলেজে পাঠিয়ে দেবে। জুঁইকে চুপ থাকতে দেখে ইলিমা কঠোর গলায় বললেন,’এখনো ঘুমে তাইনা?’
জুঁই মাথা দোলালো। ইলিমা ঠিক করলেন, আজ পিঠের চামড়া গুটিয়ে দেবে মেয়ের। কলেজে উঠেছে থেকে পড়াশোনা, কলেজ যাওয়া যেন লাটে উঠেছে। তিনি উঠতেই রুদ্র থামালো। বললো,
‘কিছু বলোনা। ঘুমাতে দাও।’
না চাইতেও ইলিমা বসে গেলেন। রুদ্র কাল যখন রাত দুইটার দিকে যখন বাড়ি ফিরলো, স্পষ্ট জেবাকে বেলকনিতে কারো সাথে ফোনে কথা বলতে দেখেছে। রুদ্র ইলিমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
‘অভ্রকে বলেছো খোঁজ নিতে?’
‘হ্যা, ও ছেলেটার খোঁজ নিয়ে জানাবে বলেছে। এমন রাত জাগা জাগি আর ভালো লাগে না। বিয়েটা দিয়ে দিতে পারলেই বাঁচি।’
বিকেল গড়াতে না গড়াতেই আকাশে আধার নেমে এলো। কালো মেঘে ছেঁয়ে গেলো গোটা আকাশ। থেকে থেকে গর্জন করছে। বইছে চারিদিকে হিমশীতল বাতাস। পূর্ব থেকে ধেয়ে আসা বাতাসে চুলগুলো এলোমেলো হয়ে উড়ছে তানিয়ার। সেগুলো স্ব-যত্নে কানে গুজলো তানিয়া। রাস্তায় দাড়িয়ে আছে দশ মিনিট হলো। মাঝ রাস্তায় এতো জ্যাম পেরোতে হয়, অথচ অফিসের সামনে তেমন গাড়িঘোড়া নেই। কি অদ্ভুত ব্যাপার। অফিস ছুটির প্রায় আঠারো মিনিট। তানিয়াকে অভ্র আর শাস্তি দেয়নি, যেটা বাড়তি তিন ঘন্টা বলেছিলো। প্রায় সবাই চলে হেছে। ব্যাথা শরীরে হাঁটতেই তো দেড়ি তানিয়ার।
এদিকে আকাশের অবস্থা ধিরে ধিরে আরও খারাপ হচ্ছে। রাস্তার ধুলোগুলো মিছিল তুলে জোট পাকিয়ে উড়ছে। তানিয়া চিন্তিত হয়ে তাকাচ্ছে এদিক-সেদিক। সব রিকশাগুলো কি দেশ থেকে উধাও হলো? তানিয়ার বিপদের অবসান ঘটিয়ে একটা বাইক থামালো তানিয়ার সামনে। হেলমেট থাকায় তানিয়া চিনলো না। বাইকার সেভাবেই বললো,
‘হেল্প লাগবে?’
কপাল কুঁচকে মুখ ফিরিয়ে নিলো তানিয়া। চেনেনা, জানেনা আর একজনের থেকে সাহায্য নিয়ে নিবে? পরে কোন বিপদে পড়লে? তুর্য মাথা থেকে হেলমেট খুললো। তানিয়া আড়চোখে একবার তাকালো,তুর্যকে দেখে ছাইচাপা রাগটা জ্বলে উঠলো আবারো। এরপর আবারো অন্যদিকে ফিরলো। এই বেয়াদব ছেলেটাই তো তখন তানিয়াকে ‘আয়া’ বলেছিলো। এতো সহজে তানিয়া ভুলে যাবে? তুর্য হালকা কাশলো। উদ্দেশ্য, তানিয়াকে তার দিকে ফেরানো। কিন্তু তানিয়া ফিরলো না। আগের থেকে গুরতর ভাবে মুখ ফিরিয়ে রইলো। তুর্য হতাশ কন্ঠে বললো,
‘নেবেন না সাহায্য?’
‘না।’ গম্ভীর কন্ঠ তানিয়ার।
‘ওমা, কেন?’
তানিয়া আড়ালে মুখ ভেঙায়। ভাবখানা এমন, যেন কিছুই বুঝছে না। তুর্য সত্যিই বুঝলো না। আবার জিজ্ঞেস করলো,
‘আকাশ খারাপ। কোথায় যাবেন বলুন,পৌছে দিচ্ছি।’
তানিয়া শান্ত গলায় বললো,
‘তখন কি যেন বলেছিলেন? আমি নাকি আয়া! তো আয়া রাস্তায় থাকুক। নর্দমায় যাক, তাতে আপনার কি? আপনি চলে যান। আর একজন আয়া’কে আপনার বাইকে ওঠালে আপনার বাইক নোংরা হবে। সাহায্য করতে চাওয়ার জন্য ধন্যবাদ।’
তুর্য হাসলো তানিয়ার সহজ শিকারোক্তিতে। গোমড়া করে রাখা মুখের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তানিয়াকে দেখে তুর্য’র মনে হচ্ছে, এই পিচ্চি মেয়েটার পার্কে থাকার কথা। ছোটদের সাথে খেলাধুলা করার কথা। আর এই মেয়ে এসেছে চাকরি করতে। আবার আত্নমর্যাদা কি প্রখর! সাথে গড়নের ভাঁজে ভাঁজে রাগ। তুর্য শুধালো,
‘এখনো রাগ করে আছেন?’
তানিয়া উত্তর দিলো না। মুখ বাঁকিয়ে রইলো। তুর্য ফের বললো,
‘আরে আমি তো মজা করে বলেছিলাম তখন।’
‘বুঝলাম। যান এখন।’
‘সত্যিই চলে যাব?’
‘তো দাড়িয়ে থাকতে কে বলেছে আপনাকে?’
‘গেলাম কিন্তু।’
‘হ্যা, হ্যা, খুব ভয় পাইয়ে দিলেন একেবারে। যানতো।’
তুর্য মাথায় হেলমেট পরে নিলো। চাবি ঘুরিয়ে শেষ বারের মতো বললো,’গেলাম।’
তানিয়া মুখ ফিরিয়ে নিলো। তুর্য বাইক স্টার্ট দিয়ে একপলক তানিয়ার দিকে তাকিয়ে চলে গেলো। তানিয়া অবাক চোখে যাওয়া দেখলো তুর্য’র। সত্যিই চলে গেলো? আর একবার বললেই তো তানিয়া উঠে যেত। ছেলেরা আসলে এমনি’ই। এরা মেয়েদের মনের ভাষা কিছুতেই বুঝতে পারে না। এদিকে মেঘ বাড়ছে। থেকে গর্জে উঠছে আকাশ। আধারে ঢেকে যাচ্ছে চারপাশ। ধুর! এর থেকে উঠে গেলেই ভালো হতো। তানিয়া নিজেই নিজের উপর চরম বিরক্ত। এতো ইগো আসে কিভাবে এই বিপদে? ছেলেটা কতবার করে বললো নিয়ে যাবে। ধ্যাত!
দূরের রাস্তায় উঁকি দিলো তানিয়া। তুর্যকে ফিরে আসতে দেখে আটষাট হয়ে দাড়ালো। তানিয়া কল্পনাও করেনি তুর্য আসবে। তানিয়া যাকে’ই খারাপ ভাবে, আসলে তারা ভালোই হয়। ব্যাতিক্রম শুধু অভ্র। তানিয়া তুর্যকে ফিরে আসতে দেখে হাঁসলো। তুর্য আসতেই আগের ফর্মে ফিরে গম্ভীর হওয়ার ভান ধরলো। তুর্য বাইক থামালো; তাকালো তানিয়ার দিকে। নিভু গলায় বললো,
‘আজ মনুষ্যত্ব আছে বলেই আপনাকে রেখে যেতে পারছি না। নাহলে আমারো ইচ্ছে নেই কোন মেয়েকে অনুরোধ করে বাইকে ওঠানো। আমার হট স্টাইলের বাইকে মেয়েরা উঠতে মুখিয়ে থাকে; তা কি জানেন?’
তানিয়া এবারেও কিছু বললো না। সুযোগ পেলেই নিজেদের বড়াই করতে ছেলেমানুষের একপ্রকার স্বভাব।
‘পরে কিন্তু বিপদে পরবেন। এই রাস্তা দিয়ে তিন বছর যাতায়াত করছি। সন্ধ্যার দিকে নেশাখোর ছেলেদের দেখা যায়। কি? এখনো যাবেন না?’
বললো তুর্য। এবারে তানিয়া নতজানু কন্ঠে উত্তর দেয়,’যাব।’
তুর্য হাঁসলো। বাইক ঘুরিয়ে এসে দাড় করালো তানিয়ার সামনে। তানিয়া উঠে বসলো। দূরত্ব রেখে বসে বললো,’চলুন।’
তানিয়া এতো দূরুত্ব রেখেছে যে তুর্য’র মনে হচ্ছে বাইক স্টার্ট দিলেই উল্টে পরবে এই মেয়ে। এতো কোনায় বসার কি আছে?
‘এগিয়ে বসুন। নাহলে পড়ে যাবেন।’
‘আমি ঠিক আছি।’
‘না, ঠিক নেই। এতো লজ্জা থাকলে ওঠার দরকার নেই। পরে পড়ে-টড়ে গেলে আবার আমার ঝামেলা।’
‘পড়া’ শব্দটি শুনেই সারা শরীর রি রি করে উঠলো তানিয়ার। একবার পড়েই শরীরের যাচ্ছেতাই অবস্থা। আরেকবার পড়লে তানিয়া নিঃসন্দেহে হসপিটালের বেডে থাকবে। তাই রিস্ক নিলো না। এগিয়ে বসলো। তুর্য স্টার্ট দিলো বাইক।
অফিসের মেইন গেটে গাড়ি থেকে সবটা দেখলো অভ্র। আকাশ খারাপ দেখে আজ তারাতাড়ি বেড়িয়েছে অভ্র। তানিয়া আর তুর্যকে দেখে, না চাইতেও অভ্র গাড়ি থামায়। সবটা দেখে অভ্র ঠোঁট বাঁকালো। বিরবির করে বললো,
‘এইটুকু মেয়ের আবার বয়ফ্রেন্ড ও আছে? হাহ্!’ শেষের কথায় দীর্ঘশ্বাসের ছাপ স্পষ্ট অভ্র’র কন্ঠে।
আরু বিষন্ন মনে হাঁটছে বাড়িজুড়ে। বাড়িতে তেমন আত্নীয় নেই। রয়েছে শুধু আরুর মামী আর মামাতো ভাই। আরুর আর ভালো লাগছে না। মনটা আনচান করছে রুদ্র’কে দেখতে। এই লোকটার প্রতি যার কাল অব্ধি আগুন রাগ ছিলো, আজ তাকে দেখতেই এতো উতলা হচ্ছে ভেবে আরুর আর-ও বিরক্ত ঠেকছে নিজের প্রতি। সারাদিনে একবার ফোন ও দিলোনা লোকটা! এতো কাছে টেনে, ভালোবাসা দেখিয়ে, আরুকে মায়ায় জড়িয়ে, এখন বেপাত্তা! কি অদ্ভুত!বাইরের গুমোট আকাশের মতো আরুর মনটাও গুমোট আজ।
তার কারন কি রুদ্র? হ্যা! তাইতো ক্ষনে ক্ষনে হৃদয় পুড়ছে, তিব্র তৃষ্ণা জাগছে দেখার। সারাবাড়ি টহল দিয়ে নিজের রুমে এলো আরু। না! ঘরেও মন টিকছে না আরুর। বেহায়ার মতো রুদ্র’কে ফোন দিতে ইচ্ছে করছে, মেসেজ করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু আরু তো দেবে না। কেন দেবে? একবার রাগ ভাঙিয়ে, নিখোঁজ হয়ে গেছে লোকটা! আবার ফোনে বলে প্রেমের কথা! হুহ্! নিজে যে কতোবড় ‘ইয়ে’ সেটা কি নিজে বুঝে? আরু বাথরুমে গেলো। আয়নায় কিছুক্ষন নিজের সাথে কথা বলে, নেচে-কুঁদে বেড়িয়ে এলো। রুদ্র’র বাড়ি গিয়ে কথা শুনিয়ে আসতে মন চাইছে আরুর। আরু আবারো বেরোলো ঘর থেকে। ঘরে যে আর টিকে না বেহায়া মন! লাফিয়ে লাফিয়ে নিচে নেমে এলো। আরুর মামীসহ মহুয়া বেগম ভুনাখিচুড়ি রান্না করছে। ঘ্রাণ শুকেই আরুর মনটা একটু হালকা হলো। বৃষ্টিময় স্যাতস্যাতে রাতে খাওয়াটা জমবে আজ। ড্রইংরুমের সোফাতে জুবুথুবু হয়ে বসে থাকলো কিয়ৎক্ষন। এরপর গেলো রান্নাঘরে। আরুর মামী ইরিনা’কে কফি নিয়ে বেরোতে দেখে আরু ছুটে গেলো। বললো,
‘কফি নিয়ে কই যাচ্ছো মামী?’
ইরিনা জবাব দিলেন,’তোর ইফাদ ভাইয়ের ঘরে। মিনিটে মিনিটে কফি খাওয়া স্বভাব হয়েছে ছেলেটার।’
আরু কি যেন ভাবলো। অতঃপর সেধে বললো,’আমায় দেও। আমি দিয়ে আসছি।’
‘তুই পারবি?’
আরু কিছু বলার আগেই মহুয়া খুন্তি নাড়তে নাড়তে বললেন,’ওকে দিওনা। মাঝপথে খেয়ে নেবে।’
আরুর মুখ কালো হয়ে এলো। সবসময় তার মা আত্নীয়-স্বজনের মাঝে তাকে পঁচাবে। আরু কিছু না বলেই ফিরলো। উদ্দেশ্য, চলে যাবে। ইরিনা আরুকে থামিয়ে দিলেন,
‘তাহলে তো ভালোই হয় আরু। এখনো অনেক কাজ বাকি এখানে। এই নে ধর; সাবধানে যা।’
আরু থেমে গেলো। এই মামীটাকে আরুর ভীষন ভালো লাগে। আরু হেঁসে গিয়ে নিয়ে নিলো কফির মগ। রান্নাঘর থেকে আবারো রিটার্ন দিয়ে উপর মুখো হাঁটা ধরলো। কফি থেকে দারুন গন্ধ আসছে। আরুর মাথায় ঘুরছে নিষিদ্ধ চাওয়া। মন চাইছে কফিটা নিজে খেয়ে নিতে। সিঁড়ি পেরিয়ে উপরে উঠতেই এই বাসনা আরুর তিব্র হলো। আরু নিজের বাসনা ধামাচাপা দিয়ে নিজেকে শাসালো,’আরু নিজেকে সামলা, মায়ের বলা কথাটা সত্যি করিস না।’ আরু ডোগ গিলে থামে গেলো সিঁড়িতেই। না চাইতেও কফিটার প্রতি যেমন টান অনুভব করছে আরু, এমনি টান তার রুদ্র’র প্রতি।
রুদ্র কথা মনে হতেই আরু চোখমুখ খিঁচে নিলো। সবকথার মাঝে লোকটা আসছে কেন এতো? আরু কোনমতে দো’তলায় উঠলো। দো’তলার রেলিং ধরে কফির মগে ঠোঁট ছোঁয়ালো। নেশাখোরদের কষ্ট যেমন নেশাতে ঘোচে, তেমনি কফির প্রতি চুমুকে আরু নিজের কষ্ট ভুলবার চেষ্টা করছে। কফি খেয়ে প্রশান্তিতে ছেঁয়ে গেলো আরুর মন। কফিটা একেবারে খাঁটি দুধে বানানো। পুরোটা শেষ করে গেলো ইফাদের রুমে। আরু বাইরে থেকে একবার উঁকি দিয়ে ভেতরে ডুকলো। ইফান তখন মন দিয়ে বই পড়ছে। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। হাতেও তেমনি মোটা একটা বই। দেখেই গা শিউরে উঠছে আরুর। এতো পড়াশোনা করে কিভাবে এরা? পড়তে পড়তে চোখ পর্যন্ত নষ্ট করে ফেলেছে। আরু চোখ বুজে শ্বাস টানলো। সবথেকে বড় কথা হলো, এতো পড়ে কি হবে? একদিন তো মরেই যেতে হবে।
আরু সারাঘরে পাইচারি করে বেড়িয়ে এলো। ইফাদ কি বুঝেছে আরু এসেছিলো? বুঝলে বুঝুক, না বুঝলে নাই।আরু নিজের রুমে গেলো আবারো। বালিশের তল থেকে ফোন বের করলো। স্ক্রিন অন করতেই খুশিতে বাক-বাকুম আরু। অবশেষে লোকটার আরুকে মনে পড়েছে তাহলে। আরু মন দিয়ে রুদ্র’র মেসেজগুলো পড়লো। রিপ্লাই দেয়নি বলে, সে কি রাগ! আরু মুখ টিপে হাঁসলো। রুদ্র’র এই রাগটা আরুর আজকাল ভীষন পছন্দের। এই রাগে আরু না তো ভয় পায়, আর না কষ্ট। এই রাগে আরু শান্ত হয়, মনে বসন্ত আসে। চারপাশে আনন্দ দেখে আরু। আরু তড়িঘড়ি করে ফোন দিলো। সাথেসাথে ফোন রিসিভ হবে কল্পনাও করেনি আরু। ওপাশ থেকে রুদ্র’র কন্ঠ,
‘কি করছিলে এতোক্ষণ?’
আরু নিঃশব্দে হেঁসে জবাব দেয়,’চান্দে আছিলাম।’
‘সেটাইতো দেখছি।’
‘তবু ভালো,কারো অন্তত মনে পড়লো এই অধমকে।’
আরুর টেরা কথায় নিঃশব্দে হাঁসলো রুদ্র। তবে কি প্রেমে পড়েছে? আগে তো ফোন দিলেই গাইগুই করতো।রুদ্র গলা পরিষ্কার করলো। গম্ভীর স্বর তুলে বললো,
‘বাই দা ওয়ে,কাল সকাল সকাল একবার আসতে পারবে?’
আরুর কপালে সূক্ষ্ম তিনটি ভাজ পড়লো। জিজ্ঞেস করলো,
‘কোথায়?’
‘আমাদের বাড়িতে।’
‘কেন?’
‘আম্মু তোমায় ডেকেছে।’
আরু সাথে সাথে নাকচ করে উঠলো,’না না, পারব না আমি।’
‘পারতে হবে।’
আরু চুপ রইলো। এখানে যেমন তিরিং-বিরিং সারাদিন লাফায়, ওখানে কি পারবে? মোটেই না! বরং শশুর-শাশুড়ির সামনে ভেজা বেড়াল হয়ে থাকতে হবে। লজ্জায় লাল-নীল হওয়ার ভান ধরতে হবে। আরুকে এগুলো বলেছে সোনিয়া। আর এগুলো আরুর দ্বারা মোটেই সম্ভব নয়।
‘আমিও থাকবো বাড়িতে।’
আরুর চোখ মুহুর্তে চকচক করে উঠলো। রুদ্র যে থাকবে আরু ভাবেইনি। ভালোই হলো, এই সুযোগে রুদ্র’র রুমটা দেখে আাসা যাবে। ও বাড়িতে যাওয়ার পর থেকে আরুর ইনটেনশন একটাই, লোকটার রুম দেখা।তার থেকেও বড় কথা,ভালোমতো জ্বালানো যাবে লোকটাকে। আরু গলা খেঁকিয়ে বললো,
‘আমার তো যাওয়ার একদমই ইচ্ছে নেই। নেহাৎ আপনি এতো করে বলছেন তাই ভেবে দেখবো।’
‘শুধু ভেবে দেখবে?’
‘উফফ্! এতো জোর কেউ করে? আচ্ছা, যাবো। এমনিতে, আমার কিন্তু একেবারেই মত নেই।’
‘সে-ই তো! তোমার তো এক্কেবারে ইচ্ছে-ই নেই।’
‘তাইতো! এতো করে বলছেন বিধায়..আচ্ছা, কখন যাবো?’
‘আমি নিতে আসব। রেডি থেকো সকালে।’
‘এমনভাবে বলছেন যেন বাপের বাড়িতে বেড়াতে এসেছি। আর আপনি আমায় নিতে আসবেন। আব্বু রাজি হোক আগে।’
নিষিদ্ধ অনুভূতি পর্ব ১৩+১৪
‘তুমি পার্মিশন ও নাও?’
রুদ্র’র চকিত কন্ঠে আরু জিভ কাটলো। রুদ্র তো ভূল কিছু বলেনি।
‘বলে আসবে। আগের বার কি হয়েছিলো ভূলে গেছো?’
রুদ্র’র কথায় স্বাভাবিক হলো আরু। হুট করে জিজ্ঞেস করে উঠলো,
‘আচ্ছা, আপনি কি আমায় বিয়ের পর-ও লেখাপড়া করাবেন?’
খট করে লাইন কাটে দিলো রুদ্র। আরু বিমুঢ়, স্তব্ধ। লাইন কেটে কি প্রমান করতে চাইলো? জীবনেও বই হাতে নিতে দেবে না; নাকি বই পড়িয়ে পড়িয়ে শেষ করে দেবে! আরু চিন্তার সাগরে ডুব দিলো!
