নিষিদ্ধ অনুভূতি পর্ব ২৩+২৪
আহমেদ হৃদ
কেন পিছু ডাকো, পিছু ডাকো
বারে বারে আমারে তুমি..
কাঁদো কন্যা তুমি, চোক্ষেরো জলে কি ভাসাবে সাধেরও জমি?
হায় যাবো না,যাবো না ফিরে..আর ঘরে..
পোড়া মন মানে না, সংসার তারিবা তরে..[2]
দেহ কাটিয়া মুই,বানাবো নৌকা তোমারি,
দুই কাটিয়া হাত বানাবো নৌকার দাড়ি..
আরিজিৎ সিং এর গান বাজছে ক্যাটেসে। খুব কষ্টের গান। কষ্টের গানে যে কষ্ট পেতে হয়, আরু তা জানে। তাই সে কষ্ট পাচ্ছে। ধুলোয় চাপা আবেগগুলো আবারো পরিষ্কার করে কষ্টে মূর্ছা যাচ্ছে তার ভেতরটা। থেকে থেকে আরিজিৎ সিং-এর দেয়া গভীর সুরের টানে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠছে আরুর। চোখের কর্নিশে জল জমেছে। নাক লাল হয়ে উঠেছে; টানছে একটু পরপর। আরুর মনে পড়ছে সেই দিনটার কথা, যেদিন প্রথম কথা হয়েছিলো আশিকের সাথে। হয়েও না হওয়া প্রেমিক মানুষটার সাথে। দিনটা মঙ্গলবার। এই মঙ্গলবারেই অমঙ্গল নিয়ে আগমন ঘটে আশিকের। দুপুর তখন কাটায় কাটায় দু’টো বাজে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তানিয়া, সোনিয়া আর রাহিলের সাথে ঘোরাফেরা করে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরলো আরু। ঘামে তার সারা শরীর ভিজে। ভেতরটা যেন জ্বলছে। আরু এসেই ড্রইংরুমের সোফায় ধপ করে বসে পড়লো। রিমুট টিপে এসি’টা অন করতেই শরীর ঠান্ডা হতে লাগলো কচ্ছপের গতিতে। শান্তিতে আরু চোখ বুজে মাথা এলিয়ে দিলো সোফায়। ঘুম যেন চোখের ডগায় এসে থাকে আজকাল। থাকবেনা আবার? সামনেই তো পরিক্ষা! আর পরিক্ষা মানেই ঘুমের সিজন আরুর। অন্যান্য সময়গুলোতে যখন চেয়েও ঘুম আনতে পারে না; তখন পরিক্ষা এলেই ঘুম চোখের ডগায় এসে থাকবে। চোখ বুজলেই ঘুমে তলিয়ে যাবে আরু। সেই অনুযায়ী আজকেও ঘুম আসার কথা। কিন্তু আরু ঘুমোতে পারলো না। হুট করে আগের মতোই ভ্যাপসা গরমটা লাগতে লাগলো আবারো। আরু বিরক্ত হয়ে চোখ খুললো। সামনে মহুয়া বেগমেকে রণমুর্তি হয়ে থাকতে দেখে পিলে চমকে উঠলো আরুর। মহুয়া কটমটে গলায় বললেন,
‘এই আপনার আসার সময় হলো? কলেজ ছুটি কখন হয়েছে?’
আরু জবাব দিলো স্বাভাবিক গলায়,’একটায়, তবে বেড়িয়েছি বারোটায়।’
‘আজ তোর বাপ আসুক শুধু। আমি কিছু বলবো না।আর কতবার বলেছি তোকে? এসি কিনেছি ঘর সাজানোর জন্য। ব্যাবহারের জন্য নয়!’
আরুর মন খারাপ হলো। এই একটাই এসি বর্তমানে চালু আছে পুরো বাড়িতে। তাছাড়া সবগুলোর’ই লাইন কাটা। আরু বিরক্ত হয়ে উপরে চলে গেলো। মহুয়া রাগান্বিত কন্ঠে চিৎকার দিয়ে উঠলেন,’যে মেয়ে পড়াশোনা করে না, তার রাগের ও কেউ পরোয়া করেনা। ইচ্ছে হলে খেতে আসিস।’
আরু আড়াল থেকে সবটা শুনে নিজ রুমে এলো। ফ্যানটা চালু করে উবু হয়ে শুয়ে পড়লো বিছানায়। ফোন হাতে নিয়ে ফেসবুকে ডুকলো। আরুর পরিক্ষার কারনে আহমেদ সাহেব ওয়াই-ফাই এর পাসওয়ার্ড পাল্টে দিয়েছেন। এ নিয়েও আরু কষ্টে আছে। অগত্যা ফ্রি-ফেসবুক চালাতে লাগলো। হুট করে একটি পোস্ট সামনে এলো আরুর। পোস্ট’টা অনেকটা এরকম,”আজ একটা তুমি নেই বলে ফেসবুকে ঘোরাঘুরি করছি। নাহলে তোমার মনে ভেতরে থাকতাম।” পোস্ট করছে ‘সুইট বয় আশিক’ আইডি থেকে। পোস্ট’টা দেখে আরুর খারাপ লাগলো। সে স্লো-মতে সেখানে স্যাড রিয়েক্ট দিলো। খানিক বাদেই সুইট বয় আশিক আইডি থেকে মেসেজ এলো,
‘Apnio ki amr mto singal?’
আরু প্রথমে ভাবলো রিপ্লাই দেবে না। কিন্তু বেচারা কষ্টে আছে দেখে মায়া হলো আরুর। আরু রিপ্লাই দিলো,’হ্যা, আপনি-আমি একই পথের পথিক।’
ব্যাস! সেই থেকে শুরু! আশিক বিশেষ দক্ষতার সহিত কি কি যেন করে পটিয়ে ফেললো আরুকে। আশিকের বানান ভুল করা মেসেজগুলোতে আরু মজা পাচ্ছিলো খুব। তারপর আশিক নিজের প্রাক্তনের কাহিনি শোনালো। আরু শুনলো মন দিয়ে। মেয়েটা নাকি ঠকিয়েছে তাকে। পনেরো হাজার টাকার মতো খরচ করেছিলো তার পেছনে আশিক। এই সুখ-দুঃখের আলাপ আলোচনা করতে করতে ছেলেটা প্রপোজ করে বসলো আরুকে। আরু তো প্রায় কেঁদে দিয়েছিলো সেই কষ্টের গল্প শুনে। তাই,রাজি হলো আরু। ছেলেটার মেসেজের ভঙ্গি এরকম,’Apni ki hoben amr sukher rani?’ এতেই তো আরুর মায়া বাড়লো তরতর করে। মনে প্রশ্ন জাগলো, কিভাবে কোন মেয়ে এমন একটা ছেলেকে ঠকাতে পারে? যে ছেলেটা একটু সুখ চায়! সেদিন থেকে শুরু হলো দিন-রাত এক করে চ্যাটিং। বাথরুমে, কলেজের বেঞ্চের নিচে, সবখানে চলতো কথা। দিনগুলো আজ শুধুই অতিত!
আরু গহীন থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। চোখের কর্নিশে জমা পানিটুকু মুছে নিলো আলগোছে। গান প্রায় শেষের পথে। আরুর মনে হলো, একজোড়া চোখ তাকে দেখছে। আরু সাথেসাথে ঘুরে তাকালো রুদ্র’র দিকে। রুদ্র শান্ত চাহনি নিয়ে দেখছে আরুকে। আরু লজ্জা পেলো। এতক্ষণ কি তাকিয়ে ছিলো লোকটা? ইশশ্! কত কি না ভাবলো! আরু নাক টেনে চোখ সরিয়ে নিলো। রুদ্র ধীর গলায় জিজ্ঞেস করলো,
‘কতগুলো প্রেম করেছো এ যাবত?’
আরু না তাকিয়েই জবাব দেয়,’একটাই।’
রুদ্র চোখ সরিয়ে অন্যদিকে ফিরলো। প্রেম করেছে একটা, অথচ ভাবটা এমন যেন দশ-বারোটা প্রেম করে ছ্যাকা খেয়েছে। আরু আড়চোখে একবার রুদ্র’র দিকে তাকালো। জিজ্ঞেস করলো,
‘আপনি?’
‘একটাও না।’ শক্ত কন্ঠ রুদ্র’র।
ঘুমন্ত তানিয়া বাসের ঝাঁকুনি’তে আবারো হেলে পড়লো অভ্র’র কাঁধে। ভ্রু কুঁচকে গেলো অভ্র’র। হাতের ফোনটা অফ করলো অভ্র। মেয়েটা কি ইচ্ছে করে এমন করছে? অভ্র কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলো। তানিয়া আরও সেঁটে গেলো অভ্র’র সাথে। এদিকে অভ্র’র অস্বস্তি হচ্ছে; অদ্ভুত লাগছে। সরাতে গিয়েও, অভ্র সরাতে পারলো না। এককথায়, সরাতে পারছে না। নিজের এহেম আচরণে সে অবাক হচ্ছে। যাকে দু’চোখে দেখতে পারে না, সে আজ কত কাছে! তবুও এতটুকু রাগ বা বিচলিত হতে পারছে না অভ্র। চেয়েও পারছে না। মন বারবার বলছে, থাকুক না; কি এমন ক্ষতি হবে?
পরক্ষণেই যখন তুর্য’র কথা মনে হলো অভ্র’র,হুট করে নিজের সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেললো অভ্র। সিদ্ধান্ত নিলো, সরিয়ে দেবে। পারলে ঘুম থেকে উঠিয়ে রাগ দেখাবে। আর যেন না রাখে। অভ্র তাকালো তানিয়ার দিকে। ঘুমে বিভোর তানিয়া। ওঠাতে গিয়ে থেমে গেলো আবারো অভ্র। কেন জানি ওঠাতে ইচ্ছে করছে না মোটেও। জানালা দিয়ে আসা বাতাসে তানিয়ার চুলগুলো উড়ছে। সেখান থেকে আসছে মিষ্টি একটা ঘ্রাণ। এই ঘ্রাণ কি মেয়ের নিজস্ব? নাকি স্যাম্পুর? অভ্র বুঝলো না। তানিয়ার ঘুমন্ত মুখখানিতে চুলগুলো এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে যাচ্ছে বাতাসে। স্নিগ্ধ ফরসা মুখে হালকা লাল চুলগুলো ছুঁয়ে যাচ্ছে বারবার। তবুও নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে তানিয়া। আচ্ছা, অভ্র না হয়ে যদি এখানে অন্য কোন ছেলে থাকতো; তাহলেও কি তানিয়া পারতো এভাবে ঘুমাতে? অন্য কোন ছেলের কাঁধে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে? তানিয়ার চুলগুলো উড়ে এসে গায়ে লাগছে অভ্র’র। অভ্র হুট করে অস্বাভাবিক কাজ করে বসলো। নিজ হাতে চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে কানে গুজে দিলো তানিয়ার। তানিয়া একটু নড়ে উঠলো। আরও ঘেঁষে এসে একহাত জড়িয়ে নিলো অভ্র’র। চমকে উঠলো অভ্র। ভেতরটা ধরাস করে উঠলো। হৃদপিন্ডের লাফানোর গতি বলে দেয়, সে বেড়িয়ে আসতে চাইছে। অভ্র শ্বাস টানলো কয়েকবার। প্রথম এই অবস্থায় পড়েছে সে। শরীর যেন অবস হয়ে আসছে। রীতিমতো কাঁপছে!
একমিনিট, দুই মিনিট, তিন মিনিট কাটলো। তানিয়া আবারো তলিয়ে গেছে ঘুমে। তার ভারি শ্বাস হাতে পড়ছে। সস্থির শ্বাস ফেললো অভ্র। যদি উঠে পড়তো? অবাধ্য মন তবুও তাকাতে চাইছে তানিয়ার ঘুমন্ত তানিয়ার দিকে। চোখে তৃষ্ণা জাগছে। অভ্র চোখ বুজে নিলো। এই নিষিদ্ধ চাওয়া গুলোর দাম দিতে নেই। সবথেকে বড় কথা, কিভাবে করলো সে? কেন করলো? কেন চুলগুলো সরিয়ে দিতে গিয়েছিলো? যদি উঠে দেখে ফেলোতো তানিয়া? তাহলে নিশ্চিত অভ্র’কে খারাপ চোখে দেখতো। অভ্র আশেপাশে একপলক চোখ বুলায়। সবাই নিজের কাজে ব্যাস্ত। কেউ হেডফোন কানে গুঁজে চোখ বুঁজে, কেউ মোবাইলে চোখ রেখে, আর কেউ কেউ শুধুই চোখ বুজে রয়েছে। আপাতত এদিকে কারো খেয়াল নেই। অভ্র ধীরেসুস্থে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো তানিয়ার থেকে।
সূর্য অস্ত গেছে। অন্তরিক্ষ হালকা লাল। চারিদিক থেকে মাগরিবের আজানের মুখরিত সুর কানে আসছে। ঠিক সেই সময় কলাতলি পেড়িয়ে ‘সি ক্রাউন’ হোটেলের সামনে বাস থামলো।
তানিয়া জানালার বাইরে থেকে চোখ সরালো। তার চোখে-মুখে লজ্জার আভাস। ঘুম থেকে উঠে যখন বুঝতে পেরেছে অভ্র কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়েছিলো সে, তখন থেকে আর তাকায়নি অভ্র’র দিকে। তখন থেকে যেন শ্বাস নিতে ভুলে গেছে তানিয়া। হাসফাস করতে করতে পাড়ি দিয়েছে বাকি রাস্তা। করিম সাহেবের নির্দেশনা অনুযায়ী সবাই সবার ব্যাগ গুছিয়ে নিলো। একে একে নেমে পড়লো সবাই। অভ্র নামার ঢেড় সময় বাদে নামলো তানিয়া। অনেকটা দূরত্ব রাখলো অভ্র’র থেকে। লোকটা কেন ডাকেনি তাকে? কিছু বলেনি কেন তাকে? ব্যাপারটা চিন্তায় ফেলছে তানিয়াকে।
আরু নামতেই,দূর থেকে বিচ দেখতে পেলো। বেশি দূর নয়। কয়েক’শ মিটার দূরেই সমুদ্রের ঢেউ দেখা যাচ্ছে। মূলত সি বিচ-এর সামনে যেগুলো হোটেল, সেগুলো থেকেই বুক করা হয়েছে ‘সামার ভ্যাকেশন’ প্যাকেজ। আরু বিচ দেখে লাফিয়ে উঠলো। সমুদ্রের ঢেউ এর শব্দে কান লেগে আসছে। সন্ধ্যা হওয়ায় সোঁ সোঁ করে বাতাস এসে গায়ে লাগছে। কিছু দূরেই মানুষ দেখা যায়। তারা এখনো ঘোরাঘুরিতে মত্ত। অন্তরিক্ষে আধার নামছে তখন। দৃশ্যটি আরু ক্যামেরা বন্দি করলো। নিজের ছবি তুললো কতগুলো। রুদ্র এসে পাশে দাড়াতেই আরু তাকিয়ে হাঁসলো একবার। তার মুখে কৃতজ্ঞ কৃতজ্ঞ ভাব স্পষ্ট! সে যে কতটা খুশি, তা আরুর মুখ-চোখ দেখেই বোঝা যায়। আরু ফোন উঁচিয়ে রুদ্র’কে বললো,
‘স্মাইল।’
রুদ্র আশেপাশে তাকিয়ে ইতস্তত করতে করতে ক্ষিণ হাঁসলো। আরু পটাপট ছবি তুললো কতগুলো। বাছাই করে সবথেকে ভালো ছবিটা ওয়ালপেপারে দিলো আরু।
‘আজ রাতে বারে গেলে কেমন হয়? পাশেই সাইমন ক্লাব আছে।’
হাঁটতে হাঁটতেই ভ্রু কুঁচকে তাকালো রুদ্র আরিফের দিকে। আরিফ একটু ভয় পেলো। রুদ্র’র চাহনি এমন, যেন খুব বাজে আবদার করেছে সে। ভয়ে ডোগ গিললো আরিফ। কিন্তু সবাই উৎসুক হয়ে তাকালো। তারা মনেপ্রাণে চাইছে, রুদ্র যেন রাজি হয়। রুদ্র গম্ভীর স্বরে বললো,
‘আজকে তো এসেছো! রেস্ট নেওয়া লাগবে না?’
রুদ্র’র কথায় সাহস যুগিয়ে ইনান বললো,
‘স্যার, পরশুই তো ফিরতে হবে। তাহলে গেলে সমস্যা কোথায়? তোমরা কি বলো এতে? যেতে চাও?’
ইনান সকলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো। মুখের হাঁসি প্রসস্থ হলো সবার। সবাই একসাথে চিৎকার দিয়ে উঠলো,’অফকোর্স যেতে চাই।’
সবার আগ্রহ দেখে রুদ্র কি করবে বুঝে উঠতে পারলো না। একপলক অভ্র’র দিকে তাকালো। অভ্র নিজের মতো হাঁটছে। যার অর্থ, রুদ্র যা বলবে তা-ই হবে। আরু পাশ থেকে মৃদু ধাক্কা দিলো রুদ্র’কে। ফিসফিসিয়ে বললো,’রাজি হয়ে যান।’
উপায় না পেয়ে সায় দিলো রুদ্র। ছোট করে বললো,
‘ওকে ফাইন।’
সকলেই হাঁসলো। শুধু তানিয়া বাদে। এসবে তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। কোনমতে রুমে যেতে পারলেই সে বাঁচে। তুর্য পাশে এসে দাঁড়ালো তানিয়ার। গোমড়া করে রাখা মুখের দিকে তাকিয়ে চিন্তিত গলায় জিজ্ঞেস করলো,
‘কি হয়েছে? এভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আপনার আগ্রহ নেই?’
তানিয়া তখনো গভীর ভাবনায় মশগুল। অভ্র’র ঘোলাটে, অদ্ভত আচরণগুলো বড্ড ভাবাচ্ছে তানিয়াকে। তুর্য’র করা প্রশ্ন তানিয়া বুঝলো না। উত্তর দিলো আনমনে,
‘এ্যাহ্?’
‘আপনি কি শুনছেন? বলছিলাম যে, যাবেন সবার সাথে বারে?’
মুখ তুলে চাইলো তানিয়া। হুট করে নজর পড়লো অভ্র’র দিকে। তার দিকেই সূক্ষ সূচালো দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে অভ্র। এতক্ষণ তো তাকায়নি একবারও! হঠাৎ কেন তাকিয়ে লোকটা? কি যেন একটা ভাবলো তানিয়া। হুট করে কুটিল হাঁসি ফুটলো তার ঠোঁটে। তুর্য’র দিকে তাকিয়ে উৎফুল্ল কন্ঠে বললো তানিয়া,
‘কেন যাবো না? নিশ্চয়ই যাবো।’
তুর্য তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। এইতো বেজার মুখে হাঁটছিলো। হুট করে কি হলো?
সবাই প্রবেশ করলো হোটেলে। বাইরের থেকে যেমনটা আশা করেছিলো আরু, তার থেকেও দ্বিগুন সুন্দর করে সাজানো ভেতরটা। আরু চারপাশে ঘুরঘুর করতে লাগলো। সবাইকে ওয়েলকাম করলেন দু’জন সার্ভেন্ট। রিসিপশন থেকে চাবি নিলেন করিম সাহেব। সবাইকে সবার চাবি বুঝিয়ে দিলেন তিনি। আগের থেকে আজকে অনেকটা প্রাণবন্ত লাগছে করিম সাহেবকে। আড়ালে হাঁসলো তানিয়া। লোকটা হয়তো ভালোই, শুধু অভ্র-রুদ্র’র সাথে থাকলে তো ওমন হয়েছে!
আরু-রুদ্র পাশাপাশি রুম নিয়েছে। অথৈ চাইছিলো অভ্র’র পাশের রুমটি নিতে। তবে তা হয়ে গেলো সামনা-সামনি। অথৈ আক্ষেপ করলো না। সামনা-সামনি হলেও, অনেকটা চান্স আছে। তানিয়াকে একটি চাবি ধরিয়ে দিলেন করিম সাহেব। সবাই লিফট নিয়ে উঠে গেলো তিনতলায়। সবাই জায়গা পায়নি। তবে বেশিরভাগই তিনতলায়। নিজ রুমে প্রবেশ করতে গিয়ে যখন পাশের রুমটা অভ্র’র দেখলো তানিয়া; মুখের হাঁসি দীর্ঘ হলো তার। সে যেন চাইছিলো এটাই!
অভ্র নিজ রুমে প্রবেশ করতেই গায়ের কোট’টা ছুড়ে ফেললো বিছানায়। মাথাটা দপদপ করছে তার। রাগে তার চেয়াল শক্ত। এখন বাজছে বাজে প্রায় সাড়ে সাতটা। খানিক বাদে নিশ্চয়ই সবাই বেরোবে? অভ্র তো যেতে চাইছিলো না! ভেবেছিলো তানিয়াও এসবে ইন্টারেস্টেড নয়! কিন্তু তুর্য বলতেই যে রাজি হয়ে যাবে, অভ্র ভাবেনি। তার রাগ হচ্ছে। মাথা ধরে আসছে। কেন এমন হচ্ছে? যাক না! তাতে অভ্র’র কি? কিন্তু এ’কথায় তার মন মানছে না। কমছে না খারাপ লাগা! রাগ বাড়ছে তিব্র গতিতে। অভ্র মাথার চুলগুলো মুঠো করে নিয়ে বিছানায় বসলো। যন্ত্রণা হচ্ছে তার। তিব্র যন্ত্রণা!
কিছুক্ষণ পর ওয়াশরুমে গেলো অভ্র। লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে ট্রাউজার আর ব্লাক টি-শার্ট পড়ে বেড়োলো। তখনি নক্ করলো কেউ। অভ্র টাওয়াল দিয়ে মাথা মুছছে তখনো। বললো,
‘কামিং।’
রুমে প্রবেশ করলো ওয়েটার। ট্রে-তে সাজানো খাবার রেখে বেড়িয়ে গেলো। ক্ষিদেয় পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে। অভ্র খেতে বসে। ব্রেডে মাখন লাগিয়ে একধ্যানে চেয়ে থাকে ব্রেডটার দিকে। খেতে ইচ্ছে করছে না তার। কিন্তু ক্ষিদে তো পেয়েছে! অভ্র জোর করে মুখে দিলো এক কামড়। গলা দিয়ে খাবার নামছে না। বিরক্ত হয়ে একগ্লাস পানি ডগডগ করে খেয়ে বেলকনির দিকে এগোলো অভ্র। ঠান্ডা বাতাস আসছে। শোনা যাচ্ছে সমুদ্রের ঢেউ এর শব্দ। অবলোকন করা যায় পানিগুলো দূর থেকে। অভ্র তাকিয়ে রইলো সূদুর আকাশের দিকে।
‘স্যার।’
সম্বিত ফিরল অভ্র’র। পরিচিত কন্ঠ পেয়ে বাম দিকে তাকাতেই দেখলো তানিয়াকে। ভেজা চুল ছড়িয়ে দাড়িয়ে আছে তার পাশের বেলকনিতে। বাতাসে তিরতির করে উড়ছে তানিয়ার চুলগুলো। বেলকনির হলদে আলোয় ভেজা চুলগুলো চিকচিক করছে। সদ্য স্নান করা তানিয়াকে স্নিগ্ধ লাগছে। অভ্র চোখ সরিয়ে নিলো।
তানিয়া গলা পরিষ্কার করলো। উদ্দেশ্য, অভ্র’কে তার দিকে ফেরানো। অভ্র ফিরলো না। জিজ্ঞেস করলো তানিয়া,
‘আপনি আমাদের সাথে যাবেন স্যার?’
অভ্র শক্ত হয়ে দাঁড়ালো রেলিং ধরে। চিবুক শক্ত হয়ে এলো তার। মেয়েটা কি ইচ্ছে করে খোঁচাচ্ছে তাকে? হ্যা, ইচ্ছে করেই! নিজেকে সামলে নিলো অভ্র। গম্ভীর স্বরে বললো,
‘না।’
‘ওহ্।’ বলে মাথা দোলালো তানিয়া। ফের জিজ্ঞেস করলো,’ব্রেকফাস্ট করেছেন স্যার?’
তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো অভ্র। গুটিয়ে গেলো তানিয়া। আড়ষ্ট গলায় আওড়ালো,’আমি তো যাচ্ছি। সবাই মনে হয় এসে পড়েছে।’
এটুকু বলেই দ্রুত বেলকনি ত্যাগ করলো তানিয়া। রুমে ঢুকে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। বেশ মজা পেয়েছে তানিয়া। এতো রাগ কিসের লোকটার? তুর্য’কে জেলাস ফিল হয়, বললেই তো হয়! কতদিন অস্বীকার করবে? তানিয়াও দেখবে কতদিন না বলে থাকতে পারে। যতদিন নিজে বলবে না, তানিয়া শুধরাবে না। তানিয়া নিজের বেবিহেয়ার গুলো ফু দিয়ে উড়িয়ে দিলো। বাঁকা হেঁসে বললো,
‘জেলাস হচ্ছেন? আমিও দেখবো কতদিন থাকেন এভাবে; লালচান!’
ফোনের ম্যাসেজের শব্দ আসতেই তানিয়া দ্রুতপায়ে এগিয়ে গেলো। তাদের অফিস গ্রুপ থেকে মেসেজ এসেছে। সবাইকে বেরোতে বলা হয়েছে। তানিয়া আয়নার সামনে গিয়ে বসলো। হেয়ার ড্রয়ার দিয়ে চুলগুলো শুকিয়ে নিলো। ওড়না গলায় জড়িয়ে বেরোবে, হুট করে ফিরে এলো আবারো। ইচ্ছে করেই ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক দিলো। মুখে পাউডার দিলো একটু। আয়নায় নিজেকে দেখে হাঁসলো অভ্র। এরপর ধীরে সুস্থে বেরোলো বাইরে। সবাই দাড়িয়ে সিঁড়ি অভিমুখে। একটু দূরেই মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে আছে আরু। নিশ্চিত রুদ্র তাকে যেতে দিতে রাজি হয়নি। তানিয়া এগিয়ে যেতেই তুর্য জিজ্ঞেস করলো,
‘অভ্র স্যার যাবে না?’
তানিয়া পেছনে তাকালো একবার। লোকটা সত্যিই কি যাবে না? তাহলে যে তানিয়া কতকিছু ভাবলো, লিপস্টিক দিলো! তার কি হবে? তানিয়ার যাওয়ার ইচ্ছে যেন মুহুর্তে মরে গেলো। ঠিক করলো ওখানে গিয়েই মুছে ফেলবে। তানিয়া হতাশ শ্বাস ফেললো। নিচু গলায় বললো,
‘যাবে না।’
তানিয়ার কথার পরপরই ভেসে এলো পরিচিত শিতল স্বর,
‘কে বলেছে যাবো না?’
চাঁদের স্নিগ্ধ আলো বিরাজমান গোটা ছাঁদে। সাঁ সাঁ শব্দ তুলে ছুটছে বাতাস। প্রবল বাতাস উপেক্ষা করে ছাঁদে এসে দাঁড়ালো আরু। শীতল বাতাসে লোমকূপ দাড়িয়ে যায়। রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ায় আরু। এদিক-ওদিক তাকিয়ে চোখের পানি আড়াল করলো সে। নিজেকে মনে মনে তিরষ্কার জানালো। ক্রুদ্ধ হলো। কেন আসতে গেলো আরু? তার তো অজানা নয় রুদ্র’র রাগের ব্যাপারে! রাগ যখন সহ্যই করতে পারেনা, তখন এতো সাধ কিসের তার? আকাশে জ্বলজ্বলে চাঁদের আলো মুখে এসে পড়লেও আধারে ঢাকা আরুর মুখশ্রী। মন খারাপের কারন শতাধিক তার। কে শুনবে তার অভিযোগ গুলো? আরু নিঃশব্দে শ্বাস ফেললো। গলায় দলা পাকিয়ে আসছে। রুদ্র’র ব্যাবহারে আরু আঘাত পেয়েছে। কষ্ট হচ্ছে বুকে। সবার সামনে ধমক দিলো লোকটা? একটুও মায়া-দরদ নেই? পারতো না বুঝিয়ে বলতে? তানিয়াও তো যাচ্ছিলো সবার সাথে!
পাশে কারো অস্তিত্ব পেতেই আটষাট হয়ে দাঁড়ালো আরু। নাকে এলো মিষ্টি একটি ঘ্রাণ। ঘ্রাণটা বড্ড পরিচিত আরুর। তবে কিসের ঘ্রাণ সেটা মনে করতে পারলো না এই মুহুর্তে। আরু পাশে তাকাতে গিয়েও তাকালো না। চুপ করে আছে মানেই রাগচটা অসভ্য লোকটা এসেছে। কেন এসেছে? আলগা পিরিত দেখাতে? দরকার নেই আরুর। থাকতে চাইছিলো না একা? থাকুক না! এসেছে কেন তাহলে? আবেগে চোখে জল এলো আরুর। সন্তর্পণে তা মুছে নিলো। রুদ্র’কে শ্বাস ফেলতে শোনা যায়। দীর্ঘশ্বাস! লোকটা কি বিরক্ত হচ্ছে? তাহলে এসেছে কেন? অভিমান তিব্র হলো। ফ্যাঁচফ্যাঁচিয়ে কেঁদে উঠলো আরু। রুদ্র শান্ত ভঙ্গিতে এগিয়ে আসে চোখ রাখে ক্রন্দনরত আরুর মুখে। শিতল কন্ঠে বলে,
‘আ’ম সরি মিস অরোনিতা।’
আরু জবাব তো দিলোই না বরং কান্নার বেগটা বেড়ে গেলো আরও। পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলো রুদ্র’র তপ্ত স্বর শুনেও। রুদ্র এগিয়ে আসে। তাকায় আরুর দিকে। আসলেই বড় হয়নি মেয়েটা। ক্লাস ফাইভে পড়া মেয়েরাও এমন ভ্যা ভ্যা করে কাঁদে না এখন। যাকে সভ্য ভাষায় ম্যাচিউরিটি বলে! আর এই মেয়ে? তবে অবাক করা বিষয় হলো, রুদ্র এতটুকু বিরক্ত নয় এসবে। বিচলিত-ও যে নয়, তা রুদ্র’র মুখ দেখে বোঝা যায়। এই আরুকে ভীষন উপভোগ করে রুদ্র। ঠোঁটে একচিলতে হাসি রুদ্র’র। একহাত পেছোনে লুকানো। আড়াল করছে কিছু। রুদ্র এগিয়ে আসতেই আরু ঘুরে দাঁড়ায় অন্যদিকে। আজকের রাগ অত জলদি কমবে না। পণ নিয়েছে কোন কথাও বলবে না লোকটার সাথে আরু। ঘটা করে এসে আবার সরি বলছে। ভেঙচি কাটলো আরু। রুদ্র আড়াল করা হাতটা সামনে আনে। হাতে লাল টকটকে তাজা গোলাপ। সদ্য ছেঁড়া গোলাপটার সুভাস দারুণ! রুদ্র আরুর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে সামনে তাকালো। একহাত পকেটে গুঁজে শান্ত গলায় বললো,
‘ঠিক আছে। মিস অরোনিতা যখন আমার সাথে কথা বলবে না ঠিক করেছে, তাহলে গোলাপটা অযথাই আনা হলো। চোরের খাতায় নাম লেখালাম বৃথাই! আমি বরং ফেলে দেই ওটা। ওটার তো প্রয়োজন নেই এখনে।’
চমকে উঠলো আরু। গোলাপ ফুল মানে? তড়িৎ গতিতে ফিরে তাকালো রুদ্র’র পাণে। একহাতে তার তাজা গোলাপ। আরু গোলাপের ঘ্রাণ চিনেনি না বলে নিজেকে গালি দিলো। এতো নির্বোধ কেন সে? চাঁদের আলো গোলাপের পাপড়িতে পড়ায় আরও মোহনীয় লাগছে। আরু ঘোরে পড়ে যায়। তাকিয়েই থাকে সেভাবে গোলাপের দিকে। রুদ্র ফিচেল হাঁসে। বলে,
‘ফেলে দেবো?’
চিন্তার সুতো কাটলো আরুর। দৃষ্টি সরিয়ে নিলো সে। রাগটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো আবারো। গোলাপ এনেছে, আবার ফেলে দিতে চাইছে? আরু তো গোলাপ মানেই ফিদা! এভাবে লোভ দেখিয়ে কি বোঝাতে চাইছে লোকটা? নিজেকে সামলালো আরু। ফেলে দিক! কোথায় ফেলবে? আরু ঠিক কুড়িয়ে আনবে ওই গোলাপ।
‘আমি চাইনা আমার হবু বউ অন্য কোন ছেলেদের সামনে যাক, নাচুক। তাই যেতে দেইনি। সরি, মাই সিন্ড্রেলা উপস্ উড়নচণ্ডী!’
মুখে হাত দিয়ে শেষের কথা উচ্চারণ করলো রুদ্র। কান খাড়া করে সব কথাগুলো শুনলো আরু। একরাশ ভালোলাগায় ছেঁয়ে গেলো আরুর অন্তর। রাগ উবে গেলো মহুর্তে। প্রতিটা কথা প্রতিধ্বন্নি হয়ে কানে বাজছে আরুর। ‘আমি চাইনা আমার হবু বউ অন্য কোন ছেলেদের সামনে যাক, নাচুক’ কথাটায় অদ্ভুত ভালোলাগা রয়েছে। এভাবে বললে কার রাগ থাকবে, থাকতে পারে? রুদ্র এগিয়ে এলো। আরুকে নিজের দিকে ফেরালো রুদ্র। হেঁচকা টানে ফিরিয়ে নিলো আবারো। আরুর পিঠ ঠেকলো রুদ্র’র বুকে। ঘটনা এতো দ্রুত ঘটেছে যে বুজতে সময় লাগলো আরুর। উষ্ণ বুকে পিঠ ঠেকতেই থমকে গেলো দেহ, নিঃশাস। ছাঁদ বর্তমানে ফাঁকা। বাতাসের শব্দ, চাঁদের জোছনা ছাড়া তৃতীয় কারো অস্তিত্ব নেই। হাতের গোলাপ ধীর গতিতে চুলে গুঁজে দিলো রুদ্র। তখনো নিঃশাস আঁটকে আরু। শ্বাস নিতে ভুলে গেছে সে। রুদ্র’র খোঁচালো দাড়িযুক্ত থুঁতনি উদাম ঘারে পড়তেই দিন-দুনিয়া ভূলে গেলো আরু। মুদে ফেললো নিজ আঁখিদ্বয়। ঠোগ গিললো একবার। দুজন মানুষের হৃদপিণ্ডের জোড়ালো শব্দ কানে বাজছে। শরীর শ্রান্ত হয়ে এলো আরুর। রুদ্র আলগোছে মুছে নিলো আরুর চোখের নোনাপানি। মৃদু ঘুরে কানের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
‘ভালোবাসি বলেই এতো ভয় মিস অরোনিতা।’
শিতল গলার উষ্ণ শ্বাস গলায় পড়তেই শরীর ঝাঁকি দিয়ে উঠলো আরুর। হাপড়ের মতো ওঠানামা করতে লাগলো বুক। রুদ্র বুঝতে পেরে ক্ষিণ হাঁসলো। ইচ্ছে করে আরও ঘনিষ্ঠ হলো আরুর। ফের একই ভাবে জিজ্ঞেস করলো,
‘সরি এপ্রুভড্?’
উত্তর দিতে পারলো না আরু। নিজের মধ্যে থাকলে তো উত্তর দেবে! রুদ্র ছেড়ে দিলো আরুকে। রুদ্র ছাড়তেই আরু লম্বা শ্বাস ফেললো। গলা শুকিয়ে গেছে তার। একফোঁটা পানি প্রয়োজন। আরু সেখানেই থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলো। হেঁসে ফেললো রুদ্র। ডানহাত ধরে আরুকে টেনে নিয়ে গেলো ছাঁদের এক কোনায়। আরু লজ্জায় মাথা নিচু করে রেখেছে। আপাতত আরুর তাকানোর মতো সাহস নেই। শক্ত করে আঙ্গুলের ফাঁকে আঙ্গুল রেখে দাড়ালো রুদ্র। নরম গলায় বললো,
‘বললে না যে?’
আরু তখনো চুপ করে। গলা থেকে স্বর বেরোচ্ছে না তার। লোকটার কি লাজ-লজ্জা নেই? কতকিছু হয়ে গেলো, তবুও বে-শরমের মতো কথা বলছে। এতে আরও বেশি করে লজ্জা পাচ্ছে আরু। রুদ্র সামনে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাঁসলো আবারো। বিয়ের পর যখন কঠিন ঝগড়া হবে, তুলকালাম বাঁধানো ঝগড়া; তখন আস্তে করে গিয়ে আরুকে চুমু খাবে রুদ্র। ব্যাস! সব ঠান্ডা! রুদ্র নিজের হাঁসি থামিয়ে গম্ভীর হলো। ঠান্ডা গলায় ডাকলো,
‘আরু!’
চকিতে তাকায় আরু। ভাবুকের মতো তাকিয়ে থাকে। দেখে রুদ্র’কে। আবারো হাঁসি পায় রুদ্র’র। নিজের হাঁসি লুকিয়ে রুদ্র সামনে তাকায়। গম্ভীর আওয়াজ তুলে,
‘তোমার নাটক শেষ হলে চলো এখান থেকে। একেই ফুল চুরি করেছি। কেউ দেখে ফেললে সাইরেন্ট বাজিয়ে বলে বেড়াবে।’
চেয়াল শক্ত হয়ে এলো আরুর। রাগে অগ্নিশর্মা চোখে তাকালো রুদ্র’র দিকে। নাটক করছে সে? এগিয়ে গিয়ে জোরসে একটা কিল বসিয়ে দিলো বাহুতে। রুদ্র একচুলও নড়ে না। শব্দ করে হেঁসে ওঠে। আরুর রাগ বাড়ে। ছুটে গিয়ে বুকে পড়ে। হাঁসি থামায় রুদ্র। জড়িয়ে নেয় বুকে। উষ্ণ বুকে মাথা গোজে আরু। ঠোঁট কামড়ে হাঁসে রুদ্র। বিরবির করে,’উড়নচণ্ডী! আমার উড়নচণ্ডী!’
তানিয়া গুটিশুটি মেরে দাড়িয়ে আছে বারের কাছে। সে কল্পনাও করেনি এই পার্টি এতো উশৃঙ্খল হবে। কান যেন ফেটে যাওয়ার উপক্রম মিউজিকের আওয়াজে। তারউপর কিছু মেয়েদের পোশাক-আশাকের ছিঁড়ি দেখলে পায়ের রক্ত মাথায় উঠছে তানিয়ার। হাঁটুর উপর অব্ধি ছোট ছোট জিন্স প্যান্ড পড়ে বেলাল্লাপনায় মেতে মেয়েগুলো। অনেকে সাধারণ পোষাকেও আছে। তারাও ড্যান্সে মত্ত। তানিয়া বারবার দেখছে অভ্র’কে। অভ্র কি এই মেয়েগুলোকে দেখছে? ঝাপসা আলোয় মুখ দেখা যাচ্ছে না অভ্র’র। মাথা অব্ধি হুডি উঠেয়ে সে-ও দাঁড়িয়ে দূরে কিছুটা। তুর্য মেয়েদের সাথে নাঁচছে। অথৈকে ঘুরঘুর করতে দেখা যাচ্ছে অভ্র’র আশেপাশে। মোটকথা, সবাই ছড়িয়ে গেছে আসার পর। যে যার মতো ব্যাস্ত।
তুর্য দূর থেকে তানিয়াকে দেখলো। ভেবেছিলো আসবে না এখানে মেয়েটা। তবুও চলে এলো। তুর্য জানতো তানিয়া এখানে ইনজয় করতে পারবে না। অগত্যা পার্টনার মেয়েটিকে সরিয়ে চলে এলো এদিকে তুর্য। তানিয়ার কাছে এসে দাঁড়ালো। সৌজন্য হেঁসে বললো,
‘উইল ইউ ড্যান্স উইথ মি, মিস তানিয়া?’
তুর্য’র কথায় উশখুশ করতে লাগলো তানিয়া। অস্বস্তিতে পড়লো। আশেপাশে তাকালো একবার তানিয়া। সে ভীষনভাবে আরুকে মিস করছে। কেন এলো না মেয়েটা? আরু এলে অন্তত কিছু একটা বলে সরে পড়া যেত। তানিয়া ঠিক করলো না বলে দেবে। আচমকা কিছুটা দূরেই হুডি পড়া অভ্র’কে অথৈর সাথে দেখে থমকে গেলো তানিয়া। পাথর নামলো বুকে। এতো সহজেই চলে গেলো ধৈ ধৈ করে নাচতে? এতোটা অসভ্য অভ্র? তানিয়াও তো দাঁড়িয়ে ছিলো, কই তাকে তো ডাকলো না! বললো না ড্যান্সের কথা! কপালে ভাজ পড়লো তানিয়ার। তুর্য’র প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সোজা হাত ধরে নিলো তানিয়া। টেনে নিয়ে গেলো ড্যান্স ফ্লোরে। যদি অভ্র পারে, তানিয়া কেন পারবে না? অভ্র-অথৈ আর তাদের মাঝে কয়েক মিটারের দূরুত্ব। অভ্র চেয়াল শক্ত করে তাকিয়ে রইলো তানিয়া-তুর্য’র দিকে। তানিয়া কোনদিকে ফিরে তাকালো না। গানের তালে তালে স্টেপ মেলাতে লাগলো তুর্য’র সাথে। তুর্য প্রথমে অবাক হলেও, মানিয়ে নিলো। নাচে মত্ত হলো দু’জনে।
অথৈর সাথে নাচলেও চোখ সরে না তানিয়ার থেকে অভ্র’র। ঠিক তানিয়াও। তীক্ষ্ণ চোখ নিয়ে তাকিয়ে সে। ধিরে ধিরে মিউজিকের লাউড বাড়ছে। মাথা ঘুরে উঠছে তানিয়ার। বেশ কিছুক্ষন সংবরণ করে নাচলো তুর্য’র সাথে। তারপর হুট করে চলে গেলো তুর্যকে ছেড়ে। তুর্য হতভম্ব! হুট করে কি হয় মেয়েটার? তানিয়ার পিছুপিছু সেও ছুটলো। অভ্র তখনো নাচছে অথৈর সাথে। চোখ তানিয়া-তুর্য’তে স্থির।
তানিয়া আবারো এসে দাঁড়ালো আগের জায়গায়। এসি চলা সত্ত্বেও গরম লাগছে তানিয়ার। ওয়েটারকে সফট্ ড্রিংকস দিতে বলে অভ্র’র দিকে তাকায় তানিয়া। রাগে গা-পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে তার। তুর্য পাশে এসে দাঁড়ায়। জিজ্ঞেস করে,
‘কি হলো?’
তানিয়া একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অভ্র’র দিকে। মুচড়ে ওঠে ভেতরটা। নিজেকে সামলে চোখ সরিয়ে নিলো তানিয়া। ক্ষিণ গলায় জবাব দিলো,’মাথা ঘুরছে।’
তুর্য চিন্তিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,’খুব বেশি খারাপ লাগছে?’
তানিয়া দু’দিকে মাথা নাড়ায়। যার অর্থ লাগছে না। তুর্য একচোখে তাকিয়প থাকে তানিয়ার দিকে। ওয়েটার সফট্ ড্রিংক এগিয়ে দিলো। তুর্য পাশ থেকে ওয়েটারকে বললো,
‘আমার জন্য স্পেশাল ওয়ান।’
তানিয়া ড্রিংটা নিতে গিয়েও থেমে গেলো তুর্য’র কথায়। স্পেশাল ওয়ান মানে কি? তুর্য’র দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো তানিয়া। অবাক হয়ে বললো,’স্পেশাল ওয়ান মানে?’
থতমত খেয়ে গেলো তুর্য। অন্যদিকে মুখ করে ঠোঁট ভেজালো। এই স্পেশাল ওয়ান-এর মানে সে কিভাবে বোঝাবে তানিয়াকে? কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে আমতা-আমতা করে বললো তুর্য,
‘স্পেশাল ওয়ান? স্পেশাল ওয়ান মানে…হলো আপেল।’
‘আপেল?’
‘হ্ হ্যা।’
‘আপেলকে কেউ স্পেশাল ওয়ান বলে?’
তানিয়ার প্রশ্নে তুর্য’র অস্বস্তি বাড়লো। সাথে মিশ্র অস্থিরতা। আগের মতোই আমতা-আমতা করে বললো,’আসলে..লেবুর সাথে আপেল দিয়ে বিদঘুটে একটা শরবত হয়, ও্ ওটাই!’
কপালের ভাজ স্বাভাবিক হয় তানিয়ার। চটপট বলে ওঠে,’ইন্টারেস্টিং তো! আমাকেও দিতে বলুন।’
স্তব্ধ হয়ে যায় তুর্য। এটা যে হুইস্কি! কিভাবে বোঝাবে এই মেয়েকে? তুর্য নিজের এই কাজে বিরক্ত হলো। সিধবিধ বলে দিলে কি হতো? এতো ভালো সাজার দরকার কি ছিলো? এখন যদি সত্যিই খেয়ে ফেলে তানিয়া? তুর্য’র চিন্তার মাঝে আবারো ডেকে উঠলো তানিয়া,
‘কি হলো? দিতে বলুন।’
দু’দিকে মাথা নাড়ে তুর্য। ওয়েটারকে দিতে বললো আরেকটা। ওয়েটার দু’জনকে দিতেই, তানিয়া চুমুক দিলো হুইস্কিতে। চুমুক দিতেই চোখমুখ খিঁচে নিলো বিদঘুটে স্বাদে তানিয়া। পাশে তাকাতেই অবাক হলো। তুর্য নেই! কই গেলো? এখানেই তো ছিলো। অভ্র’র দিকে তাকিয়ে আরেক চুমুক দেয় তানিয়া। এবার আর বিদঘুটে স্বাদ’টা লাগলো না। একটু ঝাঁঝালো, তবে বেশ ভালো লাগলো। তানিয়া একডোগে খেয়ে নিলো সবটা। চোখমুখ ঝাঁঝালো স্বাদের কারণে খেঁচা। বেগ পেতে হলো স্বাভাবিক হতে। তানিয়া আরেকটা ওর্ডার দিলো। ওটাও খেয়ে নিলো। মাথা ধরে গেলো তানিয়ার। ঝাপসা হয়ে আসতে লাগলো চারপাশ। আরেকটা গ্লাস নিলো তানিয়া। নেশাটা চড়া হলো এবার। দূরের অভ্র’কে দেখে ক্রোধে ফেটে পড়লো সে।
নিষিদ্ধ অনুভূতি পর্ব ২১+২২
হাতের গ্লাসটা টেবিলে রেখে ঢুলতে ঢুলতে এগিয়ে গেলো তানিয়া। ড্যান্স ফ্লোরে গিয়ে আবারো খুঁজলো অভ্র’কে। ওইতো দেখা যাচ্ছে! তানিয়া টলুটলু পায়ে অভ্র-অথৈর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। নাচ থেমে গেলো তাদের। অথৈ অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তানিয়ার দিকে। হুট করে অথৈকে একটানে দূরে ছিটকে দিলো তানিয়া। আকম্মিকতায় কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়ালো অথৈ। অভ্র স্থির। শক্ত দুটো চোখ মেলে তাকিয়ে তানিয়ার দিকে। তানিয়া এগিয়ে যায়। টাল সামলাতে না পেরে উবু হয়ে বুকে পড়ে অভ্র’র। আবারো উঠে দাড়ায়। চোখে চোখ রেখে তানিয়া অভ্র’র দিকে তাকায়। হুট করে অভ্র’র হুডি টেনে ধরে তানিয়া। চেয়াল খিঁচে চিৎকার দিয়ে ওঠে,
‘আপনার সাহস কি করে হয় অন্য মেয়েদের সাথে ড্যান্স করার? লজ্জা করে না? আপনি শুধু আমার। আই লাভ ইউ! বুঝেছেন আপনি? ভালোবাসি আপনাকে!’
