নিষিদ্ধ অনুভূতি পর্ব ২৯+৩০
আহমেদ হৃদ
‘কে এসেছে তানিয়া?’
আরিফ সেহরানের কন্ঠ শুনে চমকে উঠলো তানিয়া। ভীতসন্ত্রস্ত নয়নে তাকালো বাক্সটার দিকে। কি আছে এতে? কেন কেউ পাঠাবে তাকে এমন বাক্স? ভেতরে কি আছে উপর থেকে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। আর ওই লেখাটা? কে সেই অপ্রিয় মানুষ? উপরের লেখাগুলো যদি তানিয়ার বাবা পড়ে ফেলে? তানিয়া শুকনো ডোগ গিললো। দরজাটা লাগিয়ে, বাক্সটা উল্টে আড়াল করে নিলো লেখাটা। এরপর ধীর পায়ে আরিফ সেহরানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো তানিয়া। আরিফ কপালে ভাঁজ ফেলে তাকালেন মেয়ের দিকে। হাতের বাক্সটার দিকে তাকিয়ে অতি গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
‘কি ওটা?’
তানিয়া নড়েচড়ে উঠলো। ক্ষীণ গলায় জবাব দেয়,’জানিনা। একটা লোক, দেখে মনে হলো ডেলিভারি করে, উনি দিয়ে গেলো।’
‘তোমার নামে এসেছে?’
তানিয়া মাথা নাড়ে। আরিফ একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ বাক্সটার দিকে। এরপর স্বভাবিক গলায় বললেন,
‘কে পাঠিয়েছে তুমি জানো?’
তানিয়া দু’দিকে মাথা নাড়লো। যার অর্থ সে জানে না। আরিফ আবারো গম্ভীর গলায় বললেন,
‘এই বয়সে এসব বাড়িতে আসবে এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে আসা উচিত ছিলো না। যাইহোক, কয়েক মাস পরে ফাইনাল এক্সাম সেদিকে লক্ষ রাখো। পার্সেলটা আস্তে করে গিয়ে ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দেবে। এসবে প্রায়োরিটি দিতে নেই। বুঝেছো?’
তানিয়া বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়ে। আরিফ সেহরান নিজের গম্ভীর্য বজায় রেখে বললেন,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘যাও এখন।’
তানিয়া পিছু ফিরে। আড়ালে একটা শ্বাস ছাড়ে। আরিফ কখনোই রাত দশটার আগে বাড়িতে ফেরেন না। তাহলে আজ কেন এতো তারাতাড়ি? বিশেষ কোন প্রয়োজনে? তানিয়া যত্রতত্র ভাবনা ঝেঁড়ে হাঁটা ধরতেই আবারো ডেকে উঠলেন আরিফ। তানিয়া থামে। ভেবেছিলো কৈফিয়ত চাইবে না আর। কিন্তু তানিয়ার ভাবনায় জল ঢেলে বলে উঠলেন তিনি,
‘সারাদিন কোথায় ছিলে?’
তানিয়া পিছু ফিরে তাকালো। নতজানু কন্ঠে জবাব দিলো,
‘আরুর বিয়ের সপিং এর জন্য আমায় নিয়ে গিয়েছিলো। তাই দেড়ি হয়েছে।’
‘ওহ্।’
তানিয়া অতি দ্রুত ড্রয়িংরুম ত্যাগ করলো। উপরের তলায় গিয়ে বাক্সটা ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দিলো। এরপর নিজ রুমে চলে গেলো। সপিং ব্যাগটা বিছানায় রাখলো তানিয়া। এখন একটা লম্বা শাওয়ার নেয়া দরকার।
রাত দশটা। পড়ার টেবিলে ঝিমাচ্ছে তানিয়া। ঘুমঘুম চোখে বইয়ের পাতার দিকে তাকিয়ে। আজ এতো জলদি ঘুম আসছে কেন? কিছুতেই চোখ খুলে রাখতে পারছে না তানিয়া। বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালো। ঘরময় পায়চারি করলো কতক্ষণ। তবুও মন থেকে একবিন্দু পড়ার ইচ্ছে জাগলো না আর। যেন আরও বাড়ছে ঘুমটা। কই, কালকেও তো রাত বারোটা অব্ধি পড়ে ঘুমিয়েছে। তানিয়া রুমের আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লো। হুট করে মাথায় এলো ‘আপনার অপ্রিয় কেউ’ কথাটা। কি ছিলো বাক্সটায়? কে তানিয়ার আবার অপ্রিয় ব্যাক্তি? কলেজের ওয়ান এন্ড ওনলি প্লে বয় শাকিল নয়তো? এ তো অসম্ভব! শাকিল হলে নিজের নাম বড়বড় করে লিখতো। পারলে পুরো পাড়ায় বলে আসতো। কলেজেও তো তেমন পিছনে ঘুরঘুর করেনা। হুট করে অভ্র’র নাম মনে এলো তানিয়ার। তানিয়া তড়িৎ গতিতে চোখ বোজে। দু’গালে আলতো চাপড় দিয়ে বলে ওঠে,
‘আসতাগফিরুল্লাহ্, আসতাগফিরুল্লাহ্!’
এমন নাম মনে আসে কিভাবে? নিজের ভাবনার প্রতি ধিক্কার জানায় তানিয়া। অভ্র, আর গিফট্? তাও আবার তার চক্ষুশুল, তানিয়াকে? মন থেকে বিদ্রুপের হাসি হাসলো তানিয়া। কি আছে ওই বাক্সটায় জানতে ইচ্ছে হচ্ছে তানিয়ার। তারপরই আরিফ সেহরানের কথাগুলো মনে পরলো। না, না! তিনি ঠিকিই বলেছেন। এসবে মোটেও প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়। তানিয়া চোখ বুজলো। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, ঘুম আর নেই। তানিয়া আরও কিছুক্ষণ চোখ বুজে রইলো। তবুও ঘুম লাপাত্তা। আজব তো! পড়তে বসলে কবে থেকে ঘুম আসতে শুরু করলো তানিয়ার? তানিয়া কি ব্যাকবেঞ্চার হয়ে যাচ্ছে? এগুলো তো ব্যাকবেঞ্চারদের লক্ষন৷ ইয়া মাবুদ! তানিয়া এখনি পরতে বসবে আবার। যথারীতি তানিয়া উঠে পড়লো বিছানা থেকে। লাইট অন করে টেবিলে যাওয়ার সময় আবারো মনে পড়লো পার্সেলটার কথা।
তানিয়া এবার নিজেকে আটকাতে পারলো না। প্রবল কৌতুহল নিয়ে বেড়িয়ে এলো রুম থেকে। পা টিপেটিপে হেঁটে সেই ঝুড়িটার সামনে এসে দাঁড়ালো তানিয়া। আবছা আলোয় ঝুড়িটার ভেতর দেখতে পেলো বাক্সটা। আলগোছে ওটা উঠিয়ে নিয়ে ভোঁ দৌড় দিয়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজা আঁটকে দিলো তানিয়া। বাক্সটা নিয়ে বসলো বিছানায়। সিলিটেপ গুলো টেনে তুলে ফেললো। অজানা কারনে তানিয়ার হাত কাঁপছে। বুকের ভেতর দামামা বাজছে। বাক্সটা সম্পূর্ণ খুলতেই একটি সপিং ব্যাগ চোখে পড়লো। ব্যাগটি পরিচিত তানিয়ার। এই ব্যাগটাই তো ওই মলের। ব্যাগের উপরে বড়বড় করে নাম লেখা মলের।
সাথে লগোও আছে। ব্যাগ থেকে কাঙ্খিত জিনিসটা বের করতেই বিমুঢ় হয়ে গেলো তানিয়া। বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে রইলো সেই শুভ্র গাউনটার দিকে। হৃদপিণ্ড অস্বাভাবিক লাফাচ্ছে। এত গরমের মাঝেও লোমকূপ শিউরে উঠলো। থরথর করে কাঁপতে লাগলো হাত। একসময় তা হাত থেকে পড়েও গেলো গাউনটা। তানিয়া তখনো বিমুঢ় হয়ে তাকিয়ে বিছানায় পড়ে থাকা গাউনটার দিকে। কে পাঠালো তাকে এই গাউন? তানিয়া তো কাউকে বলেনি গাউনটার ব্যাপারে! তানিয়া বুঝতে পারলো, তার শরীর শুদ্ধ কাঁপছে এখন। গলা শুকিয়ে এলো। কোনমতে ডোগ গিলে আবারো তাকালো গাউনটার দিকে তানিয়া। ছাব্বিশ হাজার টাকার গাউন! কেউ এমনি এমনি পাঠিয়ে দিলো? তারউপর নামও লেখেনি।
তানিয়া কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। এরপর বাক্সটাকে আবারো কাছে আনলো। যদি ভেতরে কোন ক্লু থাকে। ভালো করে দেখতেই একটি চিরকুট নজরে এলো তানিয়ার। সেটা তুলেই খুলে ফেললো। গোটাগোটা অক্ষরে অল্প কয়েক লাইনে লেখা,
“তুমি বড়োই মিশুক। অচেনা কেউ দিলো বলে কি ফেলে দেবে এটা? দিও না! কোন এক স্পেশাল দিনে ওটা পড়ো। হয়তো পরিদের মতো লাগবে।”
সারা শরীরে অদ্ভুত এক শিহরণ বয়ে গেলো তানিয়ার। থমকানো দৃষ্টিতে কয়েক মিনিট তাকিয়ে রইলো চিরকুটের দিকে। লোকটা কি তানিয়াকে চেনে? নিশ্চয়ই চেনে! নাহলে ‘তুমি’ করে সম্মোধন করবে কেন? কে সে? সে যে-ই হোক না কেন,তানিয়া ওটা ছুঁয়েও দেখবে না। এক্ষনি ফেলে দেবে। চিরকুটটা কয়েক টুকরো করে ছিঁড়ে ফেললো তানিয়া। এরপর চোখ গেলো গাউনটার দিকে। ওটাও হাতে নিলো। কিন্তু কেন যেন ফেলতে ইচ্ছে হলো না। বেশি দামি বলেই কি? নাকি অপ্রিয় কেউ দিলো বলে? তানিয়া গাউনটা সেভাবেই ব্যাগে ঢুকিয়ে আলমারিতে রেখে দিলো। ওটার কথাও আর ভাববে না সে!
সারারাত আনচান করতে করতে কাটলো তানিয়ার। খুব সকালে বিছানা ছাড়লো তানিয়া। তবে বাইরে বেরোলো না। সে তার বাবার সামনে পড়তে চায় না। এখন নিশ্চয়ই খেয়ে বেড়িয়ে যাবে আরিফ সেহরান? যাক! তারপর তানিয়া রুম থেকে বেরোবে। তানিয়া বেলকনিতে গিয়ে বসলো। ঠিক সামনেই আরেকটি ফ্লাট। পাশের বাড়ির ছেলেটা সকাল সকাল সিগারেট ফুঁকছে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে। চোখমুখ কুঁচকে ফেললো তানিয়া। শুনেছে, কিছুদিন আগে নাকি আত্মহত্যাও করতে গিয়েছিলো একটা মেয়ের জন্য। আরে ভাই, দুনিয়ায় কি মেয়ের অভাব? অভ্র’র মতো প্রতিষ্ঠিত হলে মেয়ে পিছে পিছে ঘুরবে সারাক্ষণ। সিগারেট টানলেই কি মেয়েটা তার হবে? আশ্চর্য!
হুট করে কয়েকদিন আগের দৃশ্য চক্ষুপুটে ভেসে উঠলো তানিয়ার। অভ্র জানালার সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিলো। যদিও ওই একদিনই দেখেছিলো তানিয়া। কিন্তু, লোকটা সিগারেট খায় কেন? প্রেম কখনো করেছে বলে তো মনে হয়না। তাহলে কষ্ট কিসের?
দেখতে দেখতে পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠলো। তানিয়া বেলকনি থেকে বেড়িয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো। একেবারে রেডি হয়ে, কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে নিচে গেলো তানিয়া। কিন্তু সিঁড়িতেই থেমে গেলো তানিয়া পা’দুটো। আরিফ সেহরান আজ অফিসে যায়নি এখনো। পা দুলিয়ে সোফায় বসে বারবার ঘরি দেখছেন। চোখেমুখে প্রবল বিরক্তির ছাপ। তানিয়া তন্দা মেরে দাঁড়িয়ে রইলো। অফিসে কেন যায়নি? আজ কি সূর্য অন্যদিকে উঠলো? ডোগ গিলে ধীর পায়ে নিচে নামলো তানিয়া। ভাবলো পাশ কাটিয়ে ডায়নিং-এ চলে যাবে। কিন্তু তার আগেই ডেকে বললেন আরিফ,
‘উঠে পড়েছো?’
থামলো তানিয়া। তাকিয়ে মাথা নেড়ে হ্যা বোঝালো। উনি ব্যাস্ত পায়ে উঠে দাঁড়ালেন। এগিয়ে এসে বললেন,
‘কোথাও যাচ্ছিলে?’
‘ক্ কলেজে।’ আমতা-আমতা করে জাবাব দিলো তানিয়া। এরিমধ্য আরেকবার ঘরিতে চোখ বুলিয়ে নিলেন আরিফ সেহরান। যেন প্রয়োজনীয় টাইম নষ্ট হচ্ছে তার। তিনি তাকালেন তানিয়ার দিকে। ব্যাস্ত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন,
‘ওহ্ আচ্ছা, কাল ফ্রি আছো?’
প্রশ্নসূচক চোখে তাকালো তানিয়া। এই কথাটা আর কবে শুনেছে, ঠিক মনে করতে পারলো না। দু’দিকে মাথা নেড়ে না বোঝালো তানিয়া। চোখের কোণে চিকচিক করে ওঠে নোনাজল। বুঝতে দেবে না বলে মাথাটা কিঞ্চিৎ নামিয়ে নিলো। কোথাও কি নিয়ে যেতে চায়? এতোদিন পর কি মনে হলো, মেয়েকে একটু সময় দেওয়া প্রয়োজন?
‘ফ্রী নও? কেন?’
‘কাল আরুর গায়ে হলুদ। ওখানে যেতে বলেছেন আন্টি।’
‘ওহ্, বিয়ের পর নিশ্চয়ই ফ্রি? বিয়ে শেষ কবে?’
‘তিনদিন পর বিয়ে।’
‘আচ্ছা। খেয়ে নাও। বিয়ে শেষ হওয়ার পরই না হয়..’
কথাটুকু শেষ না করেই দ্রুতপায়ে বেড়িয়ে গেলেন আরিফ সেহরান। তানিয়া মাথা তুলে তাকায়। দু’দিন পর? কি হবে সেদিন? আর কেনই বা ফ্রি আছে কি-না জিজ্ঞেস করলো হঠাৎ? তানিয়া চোখের কোনে জমা পানিটুকু মুছে নিলো। এরপর ডাইনিং এর দিকে গেলো। তানিয়া যেতেই,ষোলো বছর বয়সী ঝর্না এগিয়ে আসে। একগাল হেঁসে বলে ওঠে,
‘আপা, নাশতা দিবো?’
তানিয়া ‘হুম’ বললো। ঝর্না খাবার এগিয়ে দিতে লাগলো। এ বাড়িতে সে রান্না-বান্না সহ টুকটাক কিছু কাজ করে। বাকি কাজের জন্য সার্ভেন্ট আছে। তানিয়ার কাছে সে কৃতজ্ঞ। এই মানুষটা কখনোই চাকর-বাকর বলে হীনমন্যতা করে না। আবার স্কুলেও ভর্তি করে দিয়েছে। তানিয়া টেবিলে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলো,’আজ তোর স্কুল নেই?’
‘হ, আছে তো! আজ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। আমি গানে নাম দিছি আপা।’
‘বাহ্, বেশ ভালো।’
মাথায় হাত দিয়ে তিরিক্ষি মেজাজে বসে আছে অভ্র। মাথাটা ভীষণ যন্ত্রণা দিচ্ছে আজকাল। সময়ে, অসময়ে এই ব্যাথা শুরু হয়। ঔষধ খেয়েও লাভ নেই। মেঝেতে এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে আছে কফির মগের টুকরো। পাশেই ছলছল চোখে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে অথৈ। এই কয়েকদিন অভ্র কফি খায়নি। আজ ও খেতো না, কিন্তু অথৈ হুট করে কফি নিয়ে হাজির। অভ্র ভেবেছিলো, খেলে হয়তো একটু ভালো লাগবে। কিন্তু হলো উল্টোটা। জিভে বিস্বাদ লাগলো। রাগ করে ফেলে দিলো কফিটা অভ্র। তারপর থেকেই মাথা ব্যাথা শুরু। তানিয়ার হাতে কফি খাওয়ার পর আর কোন কফিই ভালো লাগেনা অভ্র’র। সেই জন্যই তো কপি খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলো। যাতে তানিয়াকে ডাকতে না হয়। অভ্র একহাতে কপালে স্লাইড করলো। সিগারেট ধরাতে মন চাইছে। অথৈর সাথে হুট করে করা আচরণে খারাপ লাগছে অভ্র’র। মেয়েটার তো দোষ নেই। অভ্র সেভাবেই বললো,
‘আমি ইচ্ছে করে করতে চাইনি।’
অথৈ ঠোঁট টেনে হাসলো। বললো,’আমিই হয়তো বানাতে পারিনি ঠিকমতো স্যার। তার জন্য সত্যিই আমি দুঃখীত।’ এটুকু বলেই কবিন থেকে বেড়িয়ে গেলো অথৈ। অভ্র আরও কিছুক্ষণ সেভাবেই বসে রইলো। এরপর পাশে থাকা টেলিফোন তুলে কল দিলো কাউকে। সাথেসাথে রিসিভ হলো ফোন। অভ্র ‘কেবিনে আসুন’ কথাটুকু বলেই কেটে দিলো। টেবিল ছেড়ে দ্রুত উঠে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো অভ্র।
কেবিনের সামনে ব্যাস্ত পায়ে এসে দাঁড়ালেন করিম সাহেব। অনুমতি নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। অভ্র জানালার বাইরে চোখ রেখেই বললো,
‘মিস তানিয়াকে একটু ডেকে দিন।’
‘উনি এখনো আসেননি, স্যার।’
অভ্র দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকালো। আটটা আটান্ন বাজে। এখনো আসেনি? অভ্র আবারো সূদুরে দৃষ্টি রেখে বললো,’
আসলে পাঠিয়ে দেবেন।’
‘জ্বি, স্যার।’
বেড়িয়ে গেলেন করিম সাহেব। অভ্র’র প্রচন্ড ইচ্ছে করছে একটা সিগারেট ধরাতে। ড্রয়ারেই আছে। অভ্র মুষ্টি বদ্ধ করে নিজেকে দমালো। সিগারেট সে খাবে না। একেবারে ছেড়েই দিয়েছিলো, কিন্তু তানিয়ার জন্যই ঐদিন প্যাকেটটা আনিয়েছিলো করিম সাহেবকে দিয়ে।
‘মে আই কামিং স্যার?’
পরিচিত একটি কন্ঠ কানে আসতেই ঘুরে দাঁড়ালো অভ্র। মুষ্টি করে রাখা হাতটা ছেড়ে দিলো। বললো,’আসুন।’
তানিয়া শুকনো ডোগ গিলে প্রবেশ করলো ভেতরে। অস্বাভাবিক বুক কাঁপছে তানিয়ার। আজ হঠাৎ ডাকার কারন তানিয়ার বুঝতে বাকি নেই। কাল মিথ্যে বলেছিলো না? তার শাস্তি না দিলে কি পেটের ভাত হজম হবে? সেই জন্যই ডেকেছে লোকটা। আবারো ডোগ গিলে ভয়টাকে হজম করতে চাইলো তানিয়া। কিন্তু হজম হলো না। আরও জেঁকে বসলো। তানিয়া মাথা নিচু করে দাঁড়ালো অভ্র’র থেকে দূরত্ব রেখে।
বেশ সাধারণ পোষাক, কাঁধে ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে তানিয়া। কে বলবে এই মেয়ে বিশিষ্ট বিজনেসম্যান আরিফের মেয়ে! হালকা গোলাপি ঠোঁটা তিরতির করে কাঁপছে তানিয়ার। হুট করে আবারো রেগে উঠলো অভ্র। অন্যদিকে ফিরে আড়াল করলো রাগটুকু। ওই ঠোঁটেই সেদিন বারে যাওয়ার সময় লিপস্টিক দিয়েছিলো মেয়েটা। অভ্র শকৃত গলায় বললো,
‘কফি নিয়ে আসুন।’
অভ্র’র অর্ডারে বিন্দুমাত্র অবাক হলো না তানিয়া। সবে তো শুরু! আজ নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাবে লোকটা। তানিয়া এটাচড্ রুমে চলে গেলো। বিশেষ নজর দিয়ে কফি বানালো। সে জানে, তাকে অপমান করার জন্য অতি ক্ষুদ্র প্রসঙ্গই যথেষ্ট অভ্র’র জন্য। ভুল করা চলবে না। তানিয়া কফি নিয়ে অভ্র’র সামনে যায়। কাঁপা কাঁপা হাতে কফির মগটা এগিয়ে দিয়ে বলে ওঠে,
‘স্যার, কফি।’
অভ্র তাকালো। কাঁপতে থাকা মগটার দিকে তাকিয়ে সূক্ষ্ম হাসি হাসলো অভ্র। কপালে ভাঁজ ফেলে তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললো,
‘শাস্তি আপনি পাবেন। তবে আজ নয়, অন্য একদিন। এমন শাস্তি, যা আপনি সহ্য করতে পারবেন না মিস তানিয়া!’
তানিয়ার ভাঙা গলায় আর্তনাদ শুনতেই চমকে পিছু ফিরলো অভ্র। মেঝেতে এলোমেলো হয়ে ছড়িয়া থাকা কফির ভাঙা টুকরো গুলোর এক অংশ স্লিপার ভেদ করে বেড়িয়ে গেছে। রক্তাক্ত তানিয়ার পা। তা দেখে মুহুর্তে ভেতরটা ধক্ করে উঠলো অভ্র’র। অভ্র তড়িৎ গতিতে ছুটে যায়। কফির মগটা টেবিলে রেখে, মেঝেতে এক পা ঠেস দিয়ে বসে তানিয়ার সামনে। তানিয়া চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে আছে৷ নিশ্চয়ই অনেক ব্যাথা পেয়েছে? মেয়েটা কি চোখে দেখে না? সৃষ্টিকর্তার দেয়া চোখের ব্যাবহার করে না কেন? অভ্র পায়ের ক্ষতটার দিকে তাকালো। চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছে সেখান থেকে। মেঝেতে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। পা উঁচিয়ে দাড়িয়ে তানিয়া। অভ্র অস্থির চিত্তে পায়ে হাত দিলো। কিছুটা চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
‘আপনি কি চোখে দেখেন না?’
এতক্ষণ অভ্র’র উপস্থিতি তানিয়া লক্ষ্য করেনি। পায়ের ক্ষত’তে কারো হাতের স্পর্শে কুঁকিয়ে উঠলো ব্যাথায়। দ্রুত চোখ মেলে তাকালো। অভ্র’কে হাটু মুরিয়ে পায়ে হাত দিয়ে থাকতে থাকতে দেখে চমকালো তানিয়া। যেন বিশাল এক ঝটকা খেয়েছে সে। এ-ও কি সম্ভব? যে মানুষটা কালকে গাড়িতেই নিয়ে যেতে চাইছিলো না, আর আজ সে বিবর্ণ মুখে তার সামনে বসে? আতঙ্কিত হয়ে বুকে হাত রাখলো তানিয়া। ধুপধাপ শব্দ হচ্ছে বুকে। তড়িঘড়ি করে সরে এলো। পা মেঝেতে পড়তেই আবারো ব্যাথাতুর শব্দ করে উঠলো তানিয়া। মেঝেতে আলতো করে বসে পড়লো। ঘনঘন শ্বাস ফেলে সামলে নিলো নিজেকে।
অভ্র একপ্রকার তেড়ে এগিয়ে এলো। তানিয়া এভাবে সরে আসায় চোখেমুখে রাগের ফুলকি উঠতে লাগলো অভ্র’র। কতটা কেটে গেছে! জ্বলছে নিশ্চয়ই? তবু এতো হেয়ালি কিসের মেয়েটার? মেঝেতে এভাবে বসেই বা পড়লো কেন? মেঝেতে কত রকমের জীবানু থাকে মেয়েটা জানে না? পড়াশোনায় তো ফার্স্টক্লাস! তাহলে সাধারণ জ্ঞানের এই অবস্থা কেন? যদি ইনফেকশন হয়ে যায়, তখন? অভ্র আবারো পায়ে হাত দিতেই, অস্বস্তিতে পা সরিয়ে নিলো তানিয়া। অভ্র’র চেয়াল শক্ত হয়ে এলো। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে উঠলো,
‘সমস্যা কি আপনার? দেখছেন না কতটা কেটে গেছে?’
‘কতটা কেটে গেছে’ শুনে পায়ের দিকে তাকালো তানিয়া। মগের ভাঙা টুকরোর মাথা লেগে কিঞ্চিৎ কেটে গেছে। ছোটবেলা থেকেই একটু কাটলেই সেখান থেকে রক্ত’র বন্যা বয়ে যায় তানিয়ার। এই সামান্য ক্ষতটা কি কত’টা হলো? এতো উতলা কেন হচ্ছে অভ্র? ভাবখানা এমন, যেন গোটা একটা পা কেটে গেছে। তারথেকেও বড় কথা, ব্যাথা যেন সয়ং নিজে পাচ্ছে। তানিয়া কোনমতে বললো,
‘আমি ঠিক আছি।’
রাগটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো অভ্র’র। আগেপিছে না ভেবে উঠে দাঁড়িয়ে পাজকোলা করে কোলে তুলে নিলো তানিয়াকে। তানিয়া আকম্মিক ঘটনাকে স্তব্ধ হয়ে গেলো। কয়েক সেকেন্ডের জন্য যেন ভূলে বসলো পায়ের ব্যাথা। অভ্র’র শরীর থেকে কড়া পার্ফিউমের ঘ্রাণ আসছে। চৈতন্য-চেতনা হারিয়ে তাকিয়ে রইলো অভ্র’র মুখপানে। অভ্র পাশের চেয়ারে বসিয়ে দিলো তানিয়াকে। কিছুটা ঝুঁকে তানিয়ার মুখ বরাবর এসে থামলো অভ্র। তানিয়া চেয়ারের সাথে সেঁটে যায় ভয়ে। তাচ্ছিল্য কন্ঠ অভ্র’র,
‘আমার ছোঁয়ায় এতো ঘৃনা, মিস তানিয়া?’
থমকে গেলো তানিয়া। বিমুঢ় হয়ে তাকিয়ে রইলো। অভ্র’র রক্তিম চোখদুটি দেখতেই বুক কেঁপে উঠলো তানিয়ার। সাথেসাথেই চোখ সরিয়ে নিলো। ‘আমার ছোঁয়ায় এতো ঘৃনা?’ কথাটা প্রতিধ্বনি হয়ে কানে বাজলো কয়েকবার। তানিয়া কখন বললো এ-কথা? নিজে নিজেই ধরে নিলো? অভ্র কাছে এলে তানিয়ার কি পরিমান অস্বস্তি হয়, বোঝে না অভ্র? তাও আবার পায়ে হাত দিয়েছে! এতেই তো মরি মরি অবস্থা তানিয়ার। আর, নিজে? ছোঁয়া তো দূরের ব্যাপার, শুধু ‘ভালোবাসি’ বলেছিলো বলেই কত বড় শাস্তি দিয়েছিলো, সেটা মনে নেই? তানিয়া তপ্তশ্বাস ফেললো। কিঞ্চিৎ রাগত গলায় বললো,
‘সবাইকে নিজের মতো ভাববেন না।’
‘ওহ্ রিয়েলি?’
জবাব দিলো তানিয়া,
‘জ্বি, হ্যা। কালকে মাফ চাইতে এসেছিলাম, মাফ করেছেন? আমি নাহয় একটা ভুল করে করে ফেলেছি, তাই বলে আপনি ওমন পাল্টে যাবেন?’
শেষের কথাটুকু বলেই তানিয়া জিভ কাটলো। মুখে হাত দিয়ে চোরাচোরা চোখে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলো। কি বললো তানিয়া? কি সর্বনাশা ব্যাপার! অভ্র কি বুঝে ফেললো?
অভ্র’র ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফোটে তানিয়ার কথায়। দৃঢ় কন্ঠে বলে,
‘কেন? কষ্ট পেয়েছেন আমি পাল্টে গেছি বলে?’
তানিয়া থতমত খেয়ে গেলো। লোকটা ঠিক বুঝতে পেরেছে! মুখ ফসকে ওমন বিচ্ছিরি মার্কা কথা বেরোবে, তা কে জানতো? তানিয়া আমতা-আমতা করে বললো,
‘ক্ কষ্ট কেন পেতে যাবো?’
‘তাহলে বললেন যে পাল্টে গেছি?’
তানিয়া উত্তর দিলো না। অন্যদিকে তাকিয়েই ফিসফিসে বললো,’আপনি মানুষটাই খারাপ! খুব খারাপ!’
ঠোঁট নাড়ানোর ভঙ্গিতেই বুঝে ফেললো অভ্র। মেয়েটা কি অভ্র’কে এতোটা বোকা ভাবে? ক্রুর হাসলো অভ্র। হাসিটুকু বজায় রেখেই উঠে দাঁড়ালো। আলমিরা থেকে ফার্স্ট এইড বক্স এনে আবারো হাটু মুড়িয়ে বসলো তানিয়ার সামনে। জীবানুনাশক দিয়ে ভালো করে পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে দিলো। এরপর তড়াক করে উঠে দাঁড়ালো। শক্ত গলায় বললো,
‘সে-ই তো! আমি তো সত্যিই খুব খারাপ। এতোটাই খারাপ যে..’
তানিয়া তন্দা মেরে তাকিয়ে ছিলো ব্যান্ডেজটার দিকে। অভ্র’র থেমে যাওয়া কথাটা টেনে বলে উঠলো,
‘যে..? থামলেন কেন? বলুন..’
অভ্র তাচ্ছিল্য হাসে। এই ‘যে’ এর মানে নিজে কি বোঝে না? বুঝবে না কোনদিন? ছোট করে শ্বাস ছাড়লো অভ্র। বললো,
‘একা একা যেতে পারবেন না, তুর্য’কে ডাকবো?’
অভ্র যে কথা ঘুরিয়েছে, স্পষ্ট বুঝলো তানিয়া। কঠিন চোখে তাকালো অভ্র’র দিকে। রাগে, অভিমানে আবারো ফিরিয়ে নিলো চোখ। ক্ষিপ্ত গলায় আওড়ায় তানিয়া,
‘আমি একাই যথেষ্ট!’
বলেই কোনমতে উঠে দাঁড়িয়ে বাইরে যাওয়ার জন্য রওনা হলো তানিয়া। অভ্র পিছু ফিরে। এই অবস্থায় হাঁটতে দেখে রাগের মাত্রা তরতর করে বাড়ে। অভ্র দাঁতে দাঁত পিষে বলে ওঠে,
‘তানিয়া স্টপ।’
তবুও তানিয়ার মাঝে কোন হেলদোল দেখা গেলো না। নিজের মতোই হাঁটতে লাগলো সে। অভ্র তেঁতে এগিয়ে এসে সামনে দাঁড়ায়। কর্কশ গলায় বলে ওঠে,
‘ভুলে যাচ্ছেন আপনি আমার সেক্রেটারি মিস তানিয়া। আমি যা বলবো তা করতে আপনি বাধ্য।’
‘আপনার মতে আমার সাহায্য প্রয়োজন। আমার মতে নয়, স্যার।’
তানিয়ার নিরস গলা শুনে অভ্র সামলে নিলো নিজেকে। জোরে শ্বাস টানলো। যথাসম্ভব শিতল গলায় বললো,
‘আপনার বয়ফ্রেন্ড এসে নিয়ে যাবে আপনাকে। এভাবে একা যাওয়ার..’
কথা শেষ হওয়ার আগেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো তানিয়া। অভ্র ভ্রু কুঁচকে তাকালো। এতে হাসির কি পেলো মেয়েটা?
‘স্টপ লাফিং মিস তানিয়া।’
কোনমতে হাসি থামালো তানিয়া। বললো,
‘আপনার থেকে এর বেশি এক্সপেক্ট করা যায় না, স্যার। অচেনা-অজানা কাউকে আমার প্রেমিক বানিয়ে দিলেন? বাহ্! সাইড দিন, স্যার।’
চক্ষুদ্বয় শিথিল করে হয়ে আসে অভ্র’র। স্তম্ভের মতো দাড়িয়ে রইলো। তানিয়া একপা একপা করে বেড়িয়ে যায় কেবিন থেকে। অভ্র দেয়ালে একহাত ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো। শরীর যেন ভর ছেড়ে দিচ্ছে। কি বললো তানিয়া? তুর্য’র সাথে কোন সম্পর্ক নেই? কথাটা সত্যি? তাহলে বাসে যখন জিজ্ঞেস করেছিলো, কোন উত্তর কেন দেয়নি তানিয়া? মথাটা ঝিমঝিম করতে লাগলো অভ্র’র। ধীর পায়ে হেঁটে টেবিলের সামনে দাঁড়ালো। ড্রয়ার থেকে বের করলো সিগারেট ভর্তি প্যাকেট’টা!
গায়ে হলুদের জন্য ছোটখাটো অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন আহমেদ সাহেব। মহুয়া বেগম সকাল থেকে বেশ ব্যাস্ত। পুরো বাড়িটায় পরিপূর্ণ পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজনে। সাজানো হচ্ছে চারপাশ। গাধা ফুলের গন্ধ নাকে আসছে। আরুর এসবে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। হলুদ শাড়ি গ্রামীণ ভঙে পড়ে বিছানায় জুবুথুবু হয়ে বসে আছে সে। ফুলের কসমেটিকস্ গোটা গায়ে। আরুর মন ভালো নেই। মোটেই সে আনন্দ পাচ্ছে না। উম, বাড়ি থেকে চলে যেতে হবে এই জন্য নয়; আরুর মন খারাপের কারন হলো আরুর বন্ধু-বান্ধবের জন্য। সকাল থেকে কি একবারও হেসেছে আরু? না! হাসেনি। রাহিল, তানিয়া, সোনিয়ার সকাল সকাল চলে আসার কথা। কেউ এলো না এখন অব্ধি। ওরা না এলে ভালো লাগে? কেন আসছে না ওরা? আরু ব্যাস্ত ভঙ্গিতে ফোন হাতে নিলো। তানিয়াকে কল দিতেই ব্যাস্ত দেখালো। আজ তো শুক্রবার। তানিয়ার অফিস নেই। তাহলে?
এদিকে মহুয়া বেগম বারবার এসে হাঁক ছাড়ছেন। যেন তর সইছে না তার। বাঁদরগুলো না এলে আরু গায়ে হলুদ দেবে না। এখানেই গাঁট হয়ে বসে থাকবে। আরুর বিগড়ে যাওয়া মেজাজ আরও খিঁচে দিতে রুমে প্রবেশ করলেন আরুর ফুপি। আরু মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকালো। এই মহিলা হঠাৎ এই রুমে কেন? মহিলা বেজায় ধুরন্ধর! কি মতলবে এসেছে, কে জানে!
‘আরু কি করছিস?’
‘তোমার পিন্ডি চটকানোর ব্যাবস্থা করবো বলে ভাবছি ফুপি। মাথায় তেমন প্লান আসছে না।’ মনেমনে বললো আরু। আরুকে নিশ্চুপ দেখে আফিয়া তাহসিন রয়েসয়ে বসলেন আরুর পাশে। দু’চোখ দিয়ে ড্যাপড্যাপ করে দেখে নিলেন আরুকে। কি ভাগ্য এই মেয়ের! ফেলটুস মেয়েটা এত বড়লোক বাড়ির বউ হবে, কেউ কি কল্পনা করেছিলো? সবই ভাগ্য! আফিয়া এসব চিন্তা ঝেঁড়ে ফেললেন মাথা থেকে। আরুর কাঁধে হাত রেখে অত্যান্ত দুঃখী গলায় বললেন,
‘মন খারাপ মা? বিয়ের সময় ওমন হয় একটু আধটু।’
আরু তবুও তাকালো না। আফিয়া মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলে উঠলেন,’কি রে? তাকা ফুপির দিকে।’
আরু বিরক্ত হলো। ভ্রু কুঁচকে তাকালো আফিয়া তাহসিন-এর দিকে। আজ হঠাৎ কি হলো এই মহিলার? এমন ‘মা’ ‘মা’ করছে কেন? মুখ দিয়ে যেন মধু ঝরছে! আরু খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। কেমন চোর চোর ভাব মুখেচোখে। আফিয়া আবারো বললেন,
‘কাল নাকি রুদ্র’রা সপিং এ নিয়ে গেছিলো তোকে? কি কি নিয়ে দিলো রে?’
আরু দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এতক্ষনে মহিলা নিজ ফর্মে ফিরেছে। ফুপির কু-মতলব বুঝতে পেরে হা-হুতাশ উঠলো আরু। বড়ই তিক্ত ভঙ্গিতে বললো,’কি যে কিপটে ফুপি! আমার ফুপাকে তুমি যেমন বানিয়ে ছেড়েছো, ওরাও ঠিক তেমন। বুঝলে তো?’
আফিয়া নিখুঁত অপমানটুকু বুঝতে পারলেন। কিন্তু প্রকাশ করলেন না। আরু যতোই বলুক, যারা এনগেজমেন্ট পার্টি ওমন হৈ হৈ করে করে তারা আর যাই হোক কিপটে নয়। তিনি গলা পরিষ্কার করলেন। আরু যে এই বিষয়ে কথা বলতে চাইছে না, বুঝেও তিনি প্রসঙ্গ থেকে সরলেন না। এখন এদের সাথে মিল রাখাটা বড্ড প্রয়োজন আফিয়ার। শুধালেন,
‘তোর দেবর কি করে আরু?’
আরুর কুঁচকানো ভ্রু-যুগল আরও বেঁকে গেলো। এই মহিলা কি অভ্র’র ঘটকালি করার মতলবে এসেছে? তাহলে তানিয়ার কি হবে? বিয়ে না করেই বিধবা হবে? আরু নিজেকে সামলায়। এটা হতে দেওয়া যাবে না। কিছুতেই না!
‘ওই মেয়ে? বল!’
তাড়া দিয়ে বললেন আফিয়া। আরু সোজাসাপটা বলে উঠলো,
‘তুমি কি তোমার মেয়ে অতুশির সাথে বিয়ের ঘটকালি করতে চাইছো ফুপি? মাত্র বারো বছর ওর।’
আফিয়ার মোটেই পছন্দ হলো না আরুর কথাগুলো। মন চাইছে ঠাটিয়ে একটা চড় বসিয়ে দিতে। বড়দের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয়,এইটুকু শিক্ষাও মেয়েটাকে মহুয়া দিতে পারেনি। তিনি গম্ভীর হয়ে কি যেন ভাবলেন। এরপর হেঁসে বললেন,
‘তুই যে কি বলিস! আমার ননদ শ্রাবনীর জন্য বলছিলাম আরকি। ওকে নিয়েও এসেছি। একা বাড়িতে কতদিন রেখে আসা যায়, বল?’
‘কেন, তোমার বুড়ি শাশুড়ীকে খেয়ে দিয়েছো এতো তারাতাড়ি?’
‘আরু!’ ধমকে উঠলেন আফিয়া। তবুও ভ্রুক্ষেপহীন আরু। ফিকে হেসে বললো,
‘তা কাজি ডেকে আনোনি? আচ্ছা যাই হোক, আমার বিয়েতে যে কাজিটা আসবে না? তাকে দিয়েই না হয় বিয়ে পড়িয়ে দিও। তোমার ক’টা টাকা বাঁচবে ফুপি।’
বলেই আরু উঠে চলে গেলো বাইরে। আফিয়া মুখ ভেঙালেন। যেমন মা তার তেমন মেয়ে। যে যাই বলুক! শ্রাবনী কি অসুন্দর নাকি? আরুর থেকেও হাজারগুনে সুন্দর। আর লেখাপড়াতেও ভালো। বললে ওনারা না করবে না নিশ্চয়ই। বিয়েটা হোক একবার, তারপর এই আরুর মুখে ঝামা ঘষে অভ্র’র সাথে শ্রাবনীর বিয়ে দিয়ে দেখিয়ে দেবে আফিয়া। তবে, আরু কিন্তু অতোটাও ভূল বলেনি! কাজি আনাটা বোধহয় জরুরি ছিলো।
আরু তিক্ত মেজাজে বাইরে আসতেই তানিয়া, সোনিয়া, রাহিলকে দেখতে পেলো। ছুটে গিয়ে বুকে ঝাপিয়ে পড়লো তানিয়ার। তানিয়া পায়ে কিঞ্চিৎ ব্যাথা পেলেও নিজেকে সামলে নিলো। আরুর মতোই জড়িয়ে নিলো। সাথে যোগ দিলো সোনিয়া। আরু ছাড়ে। উৎফুল্ল কন্ঠে বলে ওঠে,
‘এসেছিস তোরা? এসেছিস? আমি তো মরেই যাচ্ছিলাম।’
তানিয়া হেঁসে ফেললো। এগিয়ে এসে আরুর থুতনিতে হাত রেখে বলে উঠলো,’আরে বাহ্! তোকে তো দারুন লাগছে হলুদ শাড়িতে।’
আরু লজ্জা পেলো। হুট করে রাহিলের পাশে পরিচিত আরেকটি মুখ দেখে ভ্রু কুঁচকে গেলো আরুর। শাকিল! ও এখানে কি করছে? শাকিল হাতের মিষ্টির প্যাকেটটা নিয়ে এগিয়ে আসে। মুখচোখ শুকনো। ঠোঁট টেনে হেঁসে বললো,
‘আগে যা করেছি তার জন্য সরি বলতে এসেছি আরু। আ’ম রিয়েলি সরি।’
আরুর গম্ভীরতা আরও বাড়লো। হুট করে হেসে বলে উঠলো,’সরি কেন? আজকে ফ্লার্ট করবি না?’
শাকিল কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিজেও হেঁসে ফেললো।
নিষিদ্ধ অনুভূতি পর্ব ২৭+২৮
আরুর গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান করা হচ্ছে ছাঁদে। আরুকে কাঠের পিড়ায় বসিয়ে হলুদ মাখাচ্ছে সবাই। ছোট্ট ইরু আরুর পাশে বসে। যে যে আরুকে হলুদ দিচ্ছে, তার থেকে সে-ও হলুদ মাখিয়ে নিচ্ছে। তানিয়া, সোনিয়া আরুর পাশে দাঁড়িয়ে। একে-অপরকে হলুদ ছোঁড়াছুঁড়ি করছে দু’জনে। রাহিল হেলেদুলে এসে দাঁড়ায় আরুর সামনে। হাতে হলুদ নিয়ে কপালে লাগিয়ে দিলো খানিকটা। এরপর মিষ্টি খাইয়ে হাতে দু’টাকার দু’টো নোট ধরিয়ে ভোঁ দৌড় দিয়ে পালালো। হেসে উঠলো সবাই। আরু চোখ পাকিয়ে তাকালো। আরেকবার কাছে পেলে হয় শুধু!
ব্যাগ থেকে তানিয়ার ফোন বেজে উঠতেই তানিয়া সরে এলো। হাতটা ধুয়ে ফোন নিতে নিতে কেটে গেলো ফোনটা। অচেনা একটা নাম্বার ভাসছে স্ক্রিনে। ফোনটা রেখে দেয়ার জন্য উদ্যত হতেই মেসেজের শব্দ কানে এলো। চেক করতেই পিলে চমকে উঠলো তানিয়ার,
‘আমার দেয়া উপহারটা কি ফেলে দিয়েছো?’
