নিষিদ্ধ অনুভূতি পর্ব ৫+৬

নিষিদ্ধ অনুভূতি পর্ব ৫+৬
আহমেদ হৃদ

‘প্রেম করার সখ মিটেছে মিস অরোনিতা?’
রুদ্রের কটাক্ষ করা কথাটায়; আরুর কান্নার বেগ যেন বাড়লো তিব্র গতিতে। ফুঁপিয়ে উঠলো আরু। লোকটা এমন কেন? আরুর যে কষ্ট হচ্ছে, সে বুঝছে না? নাকি বুঝেও না বোঝার ভান ধরছে? পিচ্চি একটা মেয়ে কাঁদছে; আর সে ব্যাঙ্গ করছে? কোথায় এই সময়ে একটু সহানুভূতিশীল হবে, তা না করে আরও ক্ষেপাচ্ছে তাকে। এরকম ছেলে বিয়ে করলে আরু বাঁচবে কিভাবে? তার আহ্লাদ, আবদার, দুষ্টামিগুলো যদি কেউ সেই কাঙ্খিত মানুষটা না বোঝে! বিয়ের পর যখন ঝগড়া হবে; আরু বলবে,’চলে গেলাম বাপেরবাড়ি।’
তখন রুদ্র বলবে,’এগিয়ে দেবো?’

ব্যাটা এমনটাই বলবে। আরু নিশ্চিত। এইতো তার দৃষ্টান্ত প্রমান। এখন আরুর মন চাইছে আইসক্রিম খেতে। এই লজ্জার কথা আরু বলতে পারবে মুখফুটে? পারবে না তো! রুদ্র ভাববে আরু বেহায়া, যে সবে গরম গরম ছ্যাকা খেয়ে এখন আইসক্রিম খেতে চাইছে। মুখ দেখেও কি বোঝেনে কিছু লোকটা? আরুর একটু শান্তনা চাই এখন, আর মাথা ঠান্ডা করতে আইসক্রিম। হুট করে আরুর মস্তিষ্ক জানান দিলো, আরে হ্যা, লোকটা তো পাগল। তার ছেঁড়া! নাহলে কি এতোকিছুর পরও বিয়ে করতে চাইতো তাকে? তার কাছে এসব আশা করে কি করে আরু?
‘আইসক্রিম খাবে মিস?’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আরু চমকে উঠলো। টলোমলো চোখ দুটি মেলে তাকালো রুদ্র’র দিকে। আহম্মক লোকটা বুঝলো কি করে? নাকি সৌজন্যের খাতিরে জিজ্ঞেস করলো। এটাই হবে। আর তাছাড়া, জিজ্ঞেস করার-ই বা কি আছে? এনে দিলেই তো পারে! কেউ একজন ঠিকিই বলেছিলো, মেয়ে মানুষের মন বোঝার ক্ষমতা ছেলেদের নেই।’
আরুর জিজ্ঞেসু দৃষ্টি দেখে রুদ্র নিঃশব্দে হাঁসলো। চোখ অন্যদিকে ফিরিয়ে দুষ্টু কন্ঠে বললো,
‘দূরের আইসক্রিম ঠেলাটার দিকে তাকিয়ে ছিলে। তাই ভাবলাম হয়তো ..’
আরু লজ্জা পেলো। ইশশ্! না না তাকালেও পারতো! কি ভাবলো লোকটা? মুখ নামিয়ে নিলো সে। একহাতে চোখের পানি মুছে নিলো। রুদ্র রুমাল এগিয়ে দিলো। আবারো মুখ তুলে তাকালো আরু।
‘রুমাল কেন?’

‘মুখের অবস্থা তো পেত্নীর মতো। মুখটা মুছে নাও। কেউ দেখলে ভাববে,রাস্তা থেকে কোন পাগলিকে তুলে এনেছি।’
আরু শব্দ করে মুখ ভেঙালো। একপ্রকার ছিনিয়ে নিলো রুমালটা। কিন্তু ঠিক করবে কি করে? আয়না তো নেই। ফোন তো মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আরু আবারো তাকালো রুদ্র’র দিকে। রুদ্র এগিয়ে আসছে। আরু ভরকালো, অজানা ভয়ে পিছিয়ে গেলো এককদম। লোকটা এগোচ্ছে কেন? আরু চারিদিকে চোখ বোলায়। আশপাশ লোকজনে ভরপুর। জোড়া জোড়া শালিক (প্রেমিক-প্রেমিকা) ও রয়েছে কতগুলো।

এই এতোগুলো মানুষের মাঝে কাঁদছিলো আরু? নিজেকে মনেমনে গালি দিলো। রুদ্র এসেই ঝুঁকে পড়লো আরুর ওপর। শক্ত হয়ে জমে রইলো আরু। এতোক্ষণ না বুঝলেও, এখন রুদ্র’র পার্ফিউমের ঘ্রান নাকে লাগছে। রুদ্র’র ভারি নিঃশ্বাসের শব্দ অন্তস্থ নাড়িয়ে দিচ্ছে আরুর। বুকের ভেতর তোলপাড় হচ্ছে কি? হচ্ছে! এই তোলপাড়ের কারণ কি? আরু তো লোকটাকে পছন্দ করেনা। তাহলে?
রুদ্র,আরুর হাত থেকে রুমালটা নিয়ে নিলো। আরু টের অব্ধি পেলো না। রুদ্রর চোখে-মুখে বিচরণ করছে আরুর স্তব্ধ দৃষ্টি। ঠোঁটের বা পাশে রুদ্র’র তিল রয়েছে। ভীষণ ছোট। ফরসা মুখে তিলটা মানিয়েছে খুব। নাকটা পিচঢালা রাস্তার মতো মৃদু লম্বা। চোখদুটি ছোটছোট, ঠিক বিদেশি বিড়ালগুলোর মতো।

‘মিস আরু? কি দেখছেন এভাবে?’
আরুর ধ্যান ছুটলো। চোখ সরিয়ে নিলো আরু। সত্যিই তো, কি দেখছিলো সে? লোকটা কি দেখে ফেললো আরুর বেহায়ার মতো চাহনি? দেখেছে নিশ্চয়ই! আরু যেন লজ্জা পেলো। আজ বুঝি তার লজ্জা পাওয়ার দিন। লজ্জায় রাঙা মুখটি লুকাতে মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকালো। ছোট করে বললো, ‘হয়েছে?’
‘মোটামুটি।’

আরুদের বাড়ির সামনে রুদ্র’র গাড়ি থামলো। তখন বাজে তিনটা আটচল্লিশ। আরু গাড়ি থেকে নামতেই রুদ্র ডাকলো,’মিস অরোনিতা?’
আরু থামলো,তবে তাকানোর সাহস হলো না। রুদ্র’র কন্ঠে ‘মিস অরোনিতা’ নামটা কাঁপিয়ে তোলে আরুকে। আগে তো হতো না! আজ কেন জানি হচ্ছে। একটু লজ্জা-ও করছে তার। কিন্তু কেন? নির্বোধ আরুতো আর জানেনা, এ যে নিষিদ্ধ অনুভূতি’র সূচনা।
‘তো? দু’দীন পর আমাদের এনগেজমেন্ট। এটাই ফাইনাল। তাইতো?’ বললো রুদ্র।
আরু উত্তর দিলো না। প্রায় ছুটে চলে গেলো বাড়িতে। কিন্তু বিপত্তি ঘটলো তারপর’ই। বাড়িতে আহমেদ সাহেবকে দেখে বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলো আরু। এই সময়ে আরু নিজের বাবাকে মোটেও বাড়িতে আশা করেনি। আগে এমন অনেকবার করেছে আরু। কলেজ পিকনিক বা টুরে যখন আরুকে যাওয়ার অনুমতি দিতো না তার বাবা; খুব ভোরে উঠে পালাতো আরু। কিন্তু অফিস কামাই করে এভাবে বাড়িতে থাকেনি কখনো। আজ কি ছুটি? ছুট থামিয়ে নিজেকে সামলে নিলো নিজেকে। ধির পায়ে হেঁটে যেতে নিলেই,আহমেদ সাহেব ঠান্ডা গলায় বলে উঠলেন,’ফোন কোথায় তোমার?’

আরু না চাইতেও থেমে গেলো। চট মিথ্যে বলে উঠলো,’পড়ে ভেঙে গেছে।’
‘বিয়েটা ঠিক হয়েছে। বিয়ে কিন্তু এখনো হয়নি আরু।’
আরু শুকনো ডোগ গিললো। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে হাত মুঠো করে নিলো। তার বাবা জানলো কি করে রুদ্র’র সাথে ছিলো আরু? কে বললো?
মহুয়া কোথথেকে ছুটে এলেন। আরু মাথা নত করে দাড়িয়ে। তিনি এসেই আরুকে তাড়া দিয়ে বললেন,
‘আরু ঘরে যা। ফ্রেশ হয়ে খেতে আয়।’

আহমেদ সাহেব কঠোর দু’টি চোখ মেলে তাকালেন মহুয়া বেগমের দিকে। ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলে উঠলেন,
‘চুপ করো তুমি। আজ তোমার জন্য ওর এই হাল। ক্লাস অন থেকে সিক্স অব্ধি তো তবু ভালোই ছিলো। আর এখন?’
মহুয়া বলার মতো কিছু খুঁজে পেলেন না। আহমেদ সাহেব ধাতস্থ হয়ে বললেন,’যদি ওর সত্যিই পছন্দ হয়ে থাকে, বিয়ের সব ব্যাবস্থা করো। আর বিয়ের আগে দেখা যাতে না করে, বোঝাও ওকে।’ বলেই চলে যাওয়ার জন্য সোফা ছেড়ে উঠলেন আহমেদ। আরু-ও কোমরে হাত গুজলো। তিক্ন চোখে তাকালো মায়ের দিকে। উদ্দেশ্য আহমেদ সাহেব কে শোনানো,

‘তিন বছর প্রেম করে বিয়ে করেছো। আমি না-হয় হবু বরের সাথে বেড়িয়েছি, তাই বলে এমন রাগ দেখাবে তুমি আম্মু? মানে হলো, নিজের বেলায় ষোলো আনা, আর আমার বেলায় চার আনা?’
আহমেদ সাহেব থেমে গেলেন। কথাটা যে তাকেই বলেছে আরু, বুঝতে একদন্ড সময় লাগলো না তার। এদিকে আরু বাহ্যিকভাবে দেখালেও মন আরও খারাপ হলো তার। একপলক আহমেদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে ছুটে রুমে চলে গেলো। দরজা লাগিয়ে উবু হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো সে। আশিক’কে ভীষনভাবে মনে পড়ছে আরুর। এই ছোটখাটো দুঃখগুলো তো একজনের কাছেই বলতো আরু। আর সে কি-না তাকে ঠকালো? আরুর এবার সত্যিই মনে চাইছে ম’রে যেতে। আশিক, আশিক জপেই ঘুমের রাজ্যে ডুব দিলো আরু।

কলেজের পশ্চিমের বিরাট জাম গাছটার নিচে বসে তিনজন। সবুজ ঘাসের উপর আধশোয়া হয়ে শুয়ে রাহিল। ক্ষনে ক্ষনে সোনিয়া বিরক্ত হয়ে রাহিলকে দেখছে। যখানে পারে শুয়ে পড়ে ছেলেটা। জীবন শোয়া ছাড়া আর কোন কিছুতেই সিরিয়াসনেস নেই। আর পাশে বসা তানিয়াও বেশ উশখুশ করছে। তার দৃষ্টি অস্থির। আরুকে ফোন করেছে পাঁচ মিনিট হয়ে গেলো; মেয়েটার আসার নামগন্ধ অব্ধি নেই। এতোক্ষণ লাগে? সোনিয়া, তানিয়ার আর রাহিলের এমন ধারা আচরণে প্রচন্ড বিরক্ত। তার তো আড্ডা চাই!

এদিকে গেটের দ্বারে পা রাখতেই কলেজের মোস্ট প্লে-বয় এসে হাজির হয়েছে আরুর সামনে। আর এসে থেকেই পিছু নিয়েছে আরুর। এসে চুপ থাকারও ছেলে নয় শাকিল। আজগুবি হাজারো গল্প জুড়েছে। আরু অবশ্য পাত্তা দিচ্ছে না। সে এদিক-ওদিক তাকিয়ে রাহিলদের খুঁজছে। আরু ভাবলো একাডেমিক ভবনে একবার উঁকি দেবে, তারপর মনে হলো ভেতরে থাকলে তানিয়া কল করতে পারতো না। তাই পশ্চিম দিকে হাঁটা ধরলো আরু। শাকিল পিছুপিছু আসছে আর বকছে। এটা নতুন নয়, আরু আসার আগ অব্ধি অন্য মেয়েদের সাথে ফ্লার্ট করবে এই ছেলে। আর আরু এলেই তার পিছুপিছু ঘুরবে। আরু এবারে চরম বিরক্ত হলো। পিছু ফিরে কটমটে চোখে তাকালো শাকিলের দিকে। আরু তাকাতেই চুপসে গেলো শাকিল। বোকাবোকা হেঁসে চুলে হাত গুঁজলো। আরু মিচকে হাঁসলো। কেমন হয় যদি ছেলেটাকে সামান্য ছ্যাকা দেয়া যায়? বলে উঠলো,

‘আমায় পছন্দ করেন তাইনা শাকিল ভাইয়া?’
শাকিল মাথা দোলালো। আরু আবারো বলতে লাগলো,
‘আমিওতো কিন্তু… ‘
‘কিন্তু? কিন্তু কি আরু?’ উদ্বিগ্ন গন্ঠ শাকিলের।
‘আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে ভাই। তুই এক কাজ কর, অন্য কাউকে ফলো কর।’ বলেই হনহন করে হেঁটে চলে গেলো আরু। ফেলে গেলো শাকিলের বিষ্ময়মাখা চাহনি।
পশ্চিম দিকে যেতেই দেখা মিললো তানিয়াদের। এই তিনটা মেয়ে-ছেলে আরুকে শান্তিতে থাকতে দেবেনা। কই সে ভেবেছিলো; বিয়ের ছলে বাড়িতে থাকবে, গাঁদা গাঁদা টিসু নষ্ট করে কাঁদবে। সারাদিন খাবে, স্যাড এন্ডিং ফিল্ম দেখবে, এগুলো আর হলো কই? যতোই হোক, ছ্যাকা খেলে যে কাঁদতে হয়, স্যাড পোস্টে ফেসবুক ভাসিয়ে দিতে হয়, আরু তো জানে সেসব।

‘দোস্ত চাকরি লাগবে।’ বললো তানিয়া।
আরু ভ্র কুঁচকে তাকালো তানিয়ার দিকে। আরু যতদূর জানে, তানিয়ার বাবার বিশাল ব্যাবসা। কারি কারি টাকা ওদের। তাহলে হঠাৎ কি এমন হলো যে চাকরি চাইছে মেয়েটা?
আরু গিয়ে তানিয়ার বসলো। একটু চিন্তিত কন্ঠে বললো,
‘হঠাৎ কি হলো যে চাকরি খুঁজছিস? আর আমি’ই বা কোথথেকে চাকরি দেব?’
তানিয়া বলার আগেই সোনিয়া কটাক্ষ করে উঠলো,
‘ ওসব চাকরি-টাকরি কিছু নয়। চাকরি কি সাধে তোর থেকে চাইছে? তোর দেবরের অফিসে সেটিং করিয়ে দিতে বলছে এই মেয়ে। দেখতে সাধাসিধা হলেও, তলে তলে জিলাপির মতন।’

কলেজ থেকে বেরোতেই রাস্তার বিপরীতে রুদ্র’কে দাড়িয়ে থাকতে দেখে, চমকে উঠলো আরু। চকচকে সাদা গাড়িটায় হেলান দিয়ে আয়েশি ভঙ্গিতে দাড়িয়ে মহারাজ। আর কি ভাব! কালো শার্ট, কালো প্যান্ট; হাতে কোট’টা বেশ করে গুছিয়ে রাখা। আরু ভাবলো পাত্তা দেবে না। চলে যাবে। কিন্তু চারপাশে একবার চোখ বোলাতেই পা’দুটি থেমে গেলো আপনা-আপনি আরুর। কলেজ ছুটি হয়েছে প্রায় বিষ মিনিট! তবুও কিছু মেয়ে গেটের সামনে দাড়িয়ে এখনো। সবার নজর অকপটে রুদ্র’র দিকে। যদিও রুদ্র’র চোখ আরুতে স্থির। তবুও, মেয়েগুলো চোখ দিয়েই গিলে খাবে এমন হাব-ভাব। ফিসফিস করে কিছু বলছে, আবার হাঁসছেও! আরু ভ্রু কুঁচকে ফেললো। কপালের ভাঁজে ভাঁজে বিরক্তিতে ছেঁয়ে গেলো। কোনদিন কোন ছেলেকে দেখেনি নাকি মেয়েগুলো? এভাবে না দেখে বাড়িতে বিয়ের কথা বললেই তো পারে। কি ব্যাহায়া! আরু যেন মোটেই আর সহ্য করতে পারছে না। চেষ্টা করেও, নিজেকে দমাতে যখন ব্যার্থ হলো আরু, হনহনিয়ে এগিয়ে গেলো রুদ্র’র সামনে। কোমরে হাত গুজে চিৎকার করে উঠলো,
‘বিয়ের আগেই এতো লেট? আপনার টাইম সম্পর্কে নুন্যতম জ্ঞান নেই রুদ্রবাবু। খেয়ে দেয়ে শুধু মোটা’ই হয়েছেন। ঘটে কিচ্ছু নেই।’

আরু এতো জোড়ে বলেছে যে, সব মেয়েই স্তব্ধ হয়ে গেলো। মুখে নামলো নিকষ আঁধার। চকলেট বয় তো আগে থেকেই বুক করা। কি সাংঘাতিক! বিয়াইত্তা পোলাপানের এতো সাজার কি আছে? আর বউ কি হারিয়ে যাচ্ছিলো নাকি, যে কলেজের সামনে এসে দাড়িয়ে থাকতে হবে? সবাই বেজার মুখে চলে যেতে আরম্ভ করেছে। রুদ্র আরুর কথায় বিষম খেলো। মেয়েটা আসলেই ডেন্জ্ঞারাস! ব্যাপারটা আরুর দারুণ লাগলো। সবাইকে দলবেঁধে চলে যেতে দেখে মুচকি হাসলো আরু। অতঃপর যখন রুদ্র’র দিকে তাকালো; হাসি থেমে গেলো। মাথা চুলকিয়ে অন্যদিকে ফিরলো। আবারো তাকালো। বললো,

‘আপনি এখানে?’
আরুর প্রশ্নে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়লো রুদ্র,’আমি মোটা?’
আরুর নির্লিপ্ত কন্ঠ,’হুম। মোটাই তো।’
রুদ্র অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। বেশ স্বাভাবিক হয়ে দাড়িয়ে আরু। রুদ্র একটু কড়া গলায় বললো,
‘ফিটনেস বোঝো? ফিটনেসের ‘ফ’ ও তো বোঝোনা। এটাকে মোটা বলে না।’
‘ষাঁড়ের মতো তো শরীর, আবার বলে কি-না ফিটনেস! ওগুলো চর্বি। চর্বি বোঝেন? আমায় দেখুন। কত ফিট আমি। হাহ্! আরুকে বোঝাতে এসেছে ফিটনেস। আমার কাছে আপনি মোটা মানে মোটাই।’ বেশ স্বাভাবিক স্বরে বললো আরু।

রুদ্র বিষ্মিত হয়ে বললো,’চর্বি! সিরিয়াসলি?’
‘তা নয়তো কি, হুম?’
রুদ্র হাতাশ শ্বাস ফেললো। আরু তো আরুই! একে বোঝানো আর গাঁধাকে বোঝানো একই ব্যাপার। তাই কথা বাড়ালো না রুদ্র। ছোট করে বললো,’গাড়িতে বসো।’
কথাটুকু বলেই গাড়ির দরজা খুলতে যাচ্ছিলো রুদ্র; আরু ঘোর আপত্তি নিয়ে বলে উঠলো,
‘বসবো না।’
‘কেন? আবার কি হলো?’
‘আব্বু নিষেধ করেছে।’
‘কিহ্?’

আরু মাথা দোলালো। গম্ভীর হওয়ার ভান ধরে বললো,’জ্বি হ্যা। আপনার সাথে ঘোরাফেরা করতে বারন করেছে আব্বু। বলেছেন, আপনার চরিত্রে দোষ আছে।’
শেষের কথাটা আরু বানিয়ে বলেছে। মুখের হাসি আড়াল করে গম্ভীর্য বজায় রাখলো নিজের। রুদ্র চমকালো, ভেতরটা কেমন করে উঠলো। সে কি ঠিক শুনলো? তার শশুর তাকে ইন্ডাইরেক্টলি ‘চরিত্রহীন’ বলেছে? তা-ও রুদ্র’র হবু বউয়ের কাছে! নিজের মেয়ের কাছে! রুদ্র দ্রুত পায়ে আরুর সামনে এসে দাড়ালো। চোখমুখ শক্ত করে বলে উঠলো,
‘হাউ ডেয়ার ইউ, মিস অরোনিতা? আমাকে আপনার এমন মনে হলো? কিছু না করেই চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন? দেখাবো চরিত্রহীন হয়ে?’
শেষের কথাটা চিবিয়ে চিবিয়ে বললো রুদ্র। আরু ভয় পেলো একটু; তবে প্রকাশ করলো না। ভয় পেলে তো চলবে না। সাধু লোকেরা নিশ্চয়ই কলেজের সামনে দাড়িয়ে থাকে না? দাড়িয়ে থাকে বখাটেরা। চরিত্রহীনরা! আরু ইতস্তত কন্ঠে আওড়ায়,

‘ঠি…ঠিকি’ই তো বলেছে।’
‘হোয়াট!’
রুদ্র রীতিমতো রাগে কাঁপছে। এই প্রথম কেউ তার চরিত্র নিয়ে কথা বলেছে। ইতিমধ্যে চোখের শিরা লাল হয়ে উঠেছে। রুদ্র’র হঠাৎ এমন চেহারা দেখে ভরকে গেলো আরু। এতোটা রাগবে, কল্পনাও করতে পারেনি সে। এক’পা পিছিয়ে ভীত কন্ঠে জবাব দিলো,
‘ভালো ছেলেরা তো এমন কলেজের সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকে না।’
রুদ্র দমলো। শরীরের ভার ছেড়ে বড় করে শ্বাস নিলো। মেয়েটার মাথায় সমস্যা আছে। না না, শুধু মাথায় নয়। পুরোটাই আস্ত সমস্যা। মেয়েটাকে কি সৃষ্টিকর্তা বুঝ দেয়নি? সে কি বুঝছে না, শুধু এবং শুধুমাত্র তার জন্য’ই এসেছে রুদ্র। এসেছে বলেই কি কোন মেয়ের দিকে তাকিয়ে ছিলো? ছিলোনা তো!
রুদ্র নিজেকে শান্ত করলো। বললো,

‘গাড়িতে বসো।’
‘বসবো না।’
‘বসো বলছি।’
‘বললাম তো না।’
রুদ্র আরুর হাত শক্ত করে ধরে গাড়িতে বসিয়ে দিলো। তারপর নিজে ড্রাইভিং সিটে বসে তাকালো আরুর দিকে। তার দিকেই কটমটে চোখে চেয়ে আছে। দাঁতে দাঁত চেপে আরু বিরবির করছে,’আসলেই চরিত্রহীন।’
আরুর কথাটায় কেন জানি হাসি পেলো রুদ্র’র। ঠান্ডা কন্ঠে বলল,’শুধু তোমার জন্য মিস।’
গাড়ি স্টার্ট করলো রুদ্র। হুট করে আরুর কিছু মনে পড়তেই জিব কাটলো আরু। তাকালো রুদ্র’র দিকে। সম্পূর্ণ মনোযোগ ড্রাইভিং এ তার। লোকটাকে এখন না গালি দিলেই কি চলছিলো না? এখন আরু তানিয়ার ব্যাপারে কিভাবে বলবে? আরু উশখুশ করতে লাগলো। এ নিয়ে একপ্রকার ঝগড়া করে এসেছে সে। তানিয়া অভিমান করে কলেজ থেকে চলে গেছে তখন’ই।

‘একটা কথা বলি?’
‘হুম, বলো।’
‘একটা চাকরি লাগবে, ইমারজেন্সি।’
হুট করে ব্রেক কষলো রুদ্র। অবাক চোখে তাকালো আরুর দিকে। বললো,
‘চাকরি? কার জন্য?’
‘আমার বান্ধবীর। ও আমার মতো নয়। পড়াশোনায় বেশ ভালো।’
‘তো চলে আসতে বলিও অফিসে।’
আরু এবারে ঘামছে। সে কি করে বলবে, যে অভ্র’র অফিসেই চাকরি চাই মেয়েটার। আরু নতজানু হলো। ধির গলায় বললো,

‘আপনার ভাই তো আপনার অফিসেই কাজ করে। তাইনা?’
রুদ্র তখন গাড়ি আবারো স্টার্ট করেছে। বললো,’হুম।’
‘কোন ব্রাঞ্চে? মানে কোন অফিসে?’
রুদ্র একপলক ভ্রু কুঁচকে তাকালো আরুর দিকে। অতঃপর বললো,’এখানেই। সব অফিসে ম্যানেজার আছে। দরকার তেমন পড়ে না।’
‘তাহলে এখানেই লাগবে।’
রুদ্র কি যেন ভাবলো কিছুক্ষণ। আরুর অভ্র’র প্রতি কিউরিওসিটি কেন? রুদ্র অতশত ভাবলো না। শুধু বললো,’কাল সকালে চলে আসতে বলিও, ইন্টারভিউ দিতে।’
আরুর চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো। আহা, এই সুযোগে তার-ও একবার দেখে আসা হবে রুদ্র’দের অফিস!

বাড়িতে চোরের মতো ডুকতে হচ্ছে আরুকে। ওড়না দিয়ে আড়াল করে রাখা কিছু। আরু নিজের রুমে ডুকেই দরজা বন্ধ করে দিলো। তার মা দেখলে তুলকালাম বাঁধাবে। আরু ঘরের এসি হাই পাওয়ারে চালালো। ঘেঁমে একাকার আরুর শরীর। বিছানায় সটানভাবে শুয়ে আড়াল করা প্যাকেটটা হাতে নিলো সে। প্যাকেটিং টা দারুনভাবে করা হয়েছে। উপরে চারকোনা আকারের কাগজে লেখা,’ফুসফুসের জন্য।’ আরু মুচকি হাসলো। প্যাকেট’টা রুদ্র দিয়েছে আরুকে। আরুতো এক্সাইটমেন্টে-এ তখুনি খুলে ফেলতো। কিন্তু রুদ্র তাকে আটকালো। বললো, ‘চুপিচুপি খুলিও। যখন একলা থাকবে। নাহলে লজ্জা পেতে পারো।’

আরু আর খোলেনি। লোকটার সামনে লজ্জা পাওয়ার থেকে মরে যাওয়া ঢের ভালো। কেউ লজ্জা পেলে কি তাকে বলতে হয়,’তুমি লজ্জা পেয়েছো?’ বলতে হয় না! কিন্তু রুদ্র তো পাগল; ব্যাতিক্রম! সে বলবে এবং আরও লজ্জায় ফেলে আড়ষ্ট করবে। কিন্তু গাড়ি থেকে নামার পর থেকেই তার হাত নিশপিশ করছে খোলার জন্য প্যাকেট’টা। রুদ্র যেহেতু নিজে মুখে বলেছে, সে লজ্জা পাবে। তাহলে পাবেই! তাইতো লুকিয়ে আনা।

আরু প্যাকেট’টা খুললো ধিরে সুস্থে। প্রথমেই একটা চিঠি। নীল কাগজে লেখা। আরু পড়লো না। পাশে রেখে দিলো। তার চিঠিতে এখন অন্তত আগ্রহ নেই। আগ্রহ, প্যাকেটে কি আছে তা জানতে।পুরোটা খুলেই চোখ বড়বড় হয়ে গেলো আরুর। রুদ্র ফোন গিফট্ করেছে। তা-ও বেশ দামি। আরুর মন খুশিতে বাক-বাকুম। তার তো এটার’ই প্রয়োজন ছিলো। মনেমনে অসংখ্য ধন্যবাদ দিলো রুদ্র’কে আরু। আরু ফোন অন করলো। সমস্ত সরজ্ঞাম লাগানো আগে থেকেই। অন করে লকস্ক্রিনের ফটো দেখে অবাক না হয়ে পারলো না আরু। রুদ্র’র হাফ প্যান্ট আর শার্ট পড়া একটা ছবি। দেখতেই লজ্জায় রঙিন প্রচ্ছদে মুড়ে গেলো আরুর চোখ-মুখ। ইশশ! সত্যিই লোকটা তাকে লজ্জা দিলো। আরু ফোনটা ছুড়ে ফেললো একটু দূরে। না না, সে দেখবে না! সে দেখবে না, হাটু অব্ধি উন্মুক্ত করা ভাবলেশহীন লোকটাকে। লোকটার কি লাজ-লজ্জা নেই?

নিষিদ্ধ অনুভূতি পর্ব ৩+৪

খানিক চুপ করে শুয়ে রইলো আরু। ভেতরটা এখনো টিপটিপ করছে। আরেকবার দেখবে ছবিটা? না না, সে দেখবে না। আরু বিরক্ত হলো, এমন খারাপ চিন্তা আসে কিভাবে? ওটা পাল্টে পেলবে এখনি।
আরুর ভাবনার মাঝেই সাঈদের আগমন ঘটলো। আরুকে চুপচাপ শুয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়ে বললো,
‘আপু কি শুয়ে আছো?’
এই একটি কথা’য় শিউরে গেলো আরু। সাঈদ একবার জানলে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে পুরো মহল্লায় গিয়ে বলে আসবে। আরু উঠে তড়িৎ গতিতে চিঠি সমেত ফোন বালিশের নিচে চাপা দিলো। আরু ঠিক করলো, চিঠিটা রাতে পড়বে।

নিষিদ্ধ অনুভূতি পর্ব ৭+৮

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here