নিষিদ্ধ শব্দের দিনলিপি পর্ব ১৩

নিষিদ্ধ শব্দের দিনলিপি পর্ব ১৩
ঝিলিক মল্লিক

সিলেট, জালালবাদ ক্যান্টনমেন্ট।
রাত নয়টা। আরবিন সবে মাত্র কোয়ার্টারে ফিরেছে। ক্যান্টমেন্টের সাথেই সংযুক্ত আবাসিক কোয়ার্টার এটা।
আরবিন প্রথমদিকে সেনা অফিসারদের জন্য বরাদ্দকৃত মেসে থাকতো। এখানে এসে প্রথমেই আরবিন অ্যাডজুটান্ট ব্রাঞ্চের নিকট আলাদা আবাসিক কোয়ার্টারে থাকার ব্যবস্থা করার জন্য আবেদন করে। সাধারণত সেনা অফিসারদের আলাদা আবাসিক কোয়ার্টার বা অ্যাপার্টমেন্টে থাকার আবেদন গ্রহণ করা হয়, যদি তারা ফ্যামিলি নিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে অনেক প্রসেসিং-এর মধ্য দিয়ে যেতে হয়। আরবিনকেও অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। অ্যাডজুটান্ট ব্রাঞ্চ থেকে শুরুতেই জানানো হয়েছিল, আরবিনকে এই ইউনিটে বেশ কয়েকবছর কাজ করে যেতে হবে। তারপর পরবর্তী পোস্টিংয়ের ব্যাপারে ভাবা হবে।

এজন্য আরবিন সবদিক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগেই অ্যাডজুটেন্টের নিকট আবেদন করেছিল, আলাদা আবাসিক কোয়ার্টারের জন্য। তবে এক্ষেত্রে আলাদা আবাসিক কোয়ার্টারে থাকার ব্যবস্থা করতে পারাটা খুবই কঠিন ছিল ওর জন্য। কারণ, আবাসিক কোয়ার্টারে সেনা অফিসারদের বয়স এবং অভিজ্ঞতা দেখে থাকার অ্যাপ্লিকেশন অ্যাপ্রুভ করা হয়। সেখানে আরবিন বর্তমান ডিপার্টমেন্টে নতুন। তবে ওর পূর্ব অভিজ্ঞতা খুব ভালো। আর ওয়ার্ক স্কিলও সব দিক থেকে পারফেক্ট। শেষমেশ সিভিতে টাইগার আইটি বাংলাদেশে আরবিনের ভূয়সী প্রশংসাপত্র আর সেখানে জবের ভালো অভিজ্ঞতা দেখেই আবাসিক কোয়ার্টারের জন্য সিলেক্ট করা হয়েছে ওকে। যেহেতু রিদি কিছু মাস পরে এখানে আসবে; এজন্য আবার অফিসিয়াল আইডি কার্ড, স্বামী-স্ত্রীর পরিচয়পত্র, বৈবাহিক সনদপত্রসহ আরো বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র জমা দিতে হয়েছে আরবিনকে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আরবিন সবসময় ফ্ল্যাট পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখে। একা মানুষ। তেমন কোনো ঝামেলা পোহাতে হয় না। রান্না যদিও নিজেকেই করতে হয়, তবে তাতে আহামরি কোনো অসুবিধা হয় না। টাইগার আইটি বাংলাদেশে জবে থাকাকালীন আরবিন একটা মেসে একা সিঙ্গেল রুম নিয়ে থাকতো। এছাড়াও পড়াশোনার জন্য বুয়েটে পড়াকালীনও মেসে থাকতো। জীবনের বেশিরভাগ সময় বাইরে বাইরে থাকার কারণে রান্নাবান্নাসহ নিজস্ব সকল কাজ আরবিন নিজ হাতেই করে। এতে বেশ দক্ষ ও। আরবিনের কাজ অন্য কেউ করুক, এটা ওর মোটেও পছন্দ নয়।
ইউনিফর্ম খুলে আলমারির হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখলো আরবিন। ফ্রেশ হয়ে একটা শর্ট প্যান্ট আর স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে দিয়ে বিছানার ওপরে পা ঝুলিয়ে বসলো ও।

আজ সারাদিনে ফোন হাতে নেওয়া হয়নি। গতকাল দুপুরে রিদির সাথে আর রাতে আব্বা-আম্মার সাথে ভিডিওকলে কথা বলা— এইটুকু সময়ের জন্যই ফোনটার প্রয়োজন পরেছে আরবিনের। আজ সারাদিনে ফোন ছুঁয়েও দেখেনি ও। মাত্র ফোন হাতে নিয়ে ডাটা অন করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঢুকলো আরবিন। ডাটা অন করা মাত্র নোটিফিকেশন আসলো কতগুলো। সচারাচর ওর ফটো, পোস্টে রিয়্যাক্ট আর কমেন্ট অহরহ আসতেই থাকে৷ যেহেতু প্রোফাইল পাবলিক করা! তবে ওসব নোটিফিকেশন আরবিন ঘেঁটেও দেখে না। তবে আজ মাত্রাতিরিক্ত নোটিফিকেশন দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেললো ও। নোটিফিকেশন বারে ঢুকে দেখলো ইংরেজি অক্ষরে — ‘রিদি বিনতে সোহরাব’ নামের আইডিটা থেকে আরবিনের আইডির শুরু হতে একেবারে শেষ পর্যন্ত প্রতিটা ফটো, পোস্টে হাহা মে’রে এসেছে। আরবিন সোশ্যাল মিডিয়া খুব কম ব্যবহার করে। ওর সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করার মেয়াদ প্রায় বারো বছর হতে চললো। ইংরেজি অক্ষরে “আরবিন আল তৈমুর” নামক এই আইডির বয়স প্রায় পাঁচ বছর। তবে পোস্ট ও ফটো সংখ্যা সবমিলিয়ে একশোর ওপরে যাবে না। কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউ কখনো ভুলেও ওর সিরিয়াস টাইপ পোস্টে ভুলভাল রিয়্যাক্ট দেয়নি। সেখানে এই মেয়ে ওর সিরিয়াস পোস্ট হাহা আর ফানি পোস্টগুলোতে কেয়ার রিয়্যাক্ট দিয়েছে। নিশ্চয়ই আরবিনকে জ্বালাতন করার জন্য এমন করেছে বলে মনে হলো আরবিনের।

কিছুক্ষণ চোখ বুঁজে একটা দীর্ঘ শ্বাস টেনে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো আরবিন। মাথা যথেষ্ট ঠান্ডা রাখলো।
এরমধ্যে খেয়াল করলো রিদি এই অকাজ করে আবার ওকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টও দিয়ে রেখেছে। কতটা বজ্জাত চিন্তা করা যায়! আরবিন উঠে দাঁড়ালো। ঘরময় পায়চারি করতে করতে দাঁতে দাঁত চেপে রিদির নাম্বারে কল দিলো ডিরেক্ট। একবার রিং হয়ে কল কেটে গেল। আবারও একইরকম হলো। কমপক্ষে দশবার কল দেওয়ার পরে অবশেষে রিদি কল রিসিভ করতেই ফোনের এপাশ থেকে যেন ঝড় বয়ে গেল। আরবিন চিৎকার-চেঁচামেচি করে বললো,
“এই বেয়াদব! কই ছিলে তুমি? এতোবার করে কল দিলাম, রিসিভ করোনি কেন?”
“ইচ্ছা করছিল না।”

রিদির শান্ত জবাব। তাতে যেন আরবিন আরো বেশি ক্ষেপে গেল। এই মেয়ের ত্যাড়া ত্যাড়া কথাবার্তা আরবিনের মাথায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া জন্য যথেষ্ট। তবুও নিরন্তর প্রচেষ্টায় মাথা ঠান্ডা করে দাঁতে দাঁত চেপে ও বললো,
“হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিওকল দিচ্ছি। ইমিডিয়েট কলে আসো।”
“পারবো না।”
“পারবে না মানে?”
“আমার ভালো লাগছে না।”
“ভালো লাগছে না কেন? জলদি কলে আসো। তোমার চাঁদবদন মুখটা একটু দেখি। তোমার এতো ভালো না লাগার রোগ কোথা থেকে আসছে দেখবো!”
আরবিন কল কেটে হোয়াটসঅ্যাপে গেল৷ নিজেই নিজের কাছে আশ্চর্য হয়ে গেল। রিদিকে ভিডিওকলে আসার জন্য এতো জোরাজোরি করছে কেন! এর তো কোনো মানে হয় না! বিগত দুই মাসে মেয়েটাকে একবারও দেখা হয়নি যদিও।

নিজের মনকে কোনো বুঝ বা কৈফিয়ত দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা মনে করলো না আরবিন। আপাতত ওর মাথা গরম আছে। তবু শান্তভাবে কথা বলছে।
ভিডিওকল দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রিদি কল রিসিভ করলো। আরবিন বিছানার ওপর এসে বসলো। ফোনের ওপাশে রিদি মাথায় ওড়না টেনে ফোন হাতে মুখ বুঁজে বসে আছে। আরবিন কিছুক্ষণ নিরবে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর নরম গলায় বললো,
“কান্নাকাটি করেছো কেন?”
রিদি আশ্চর্য হলো। আরবিন কীভাবে বুঝলো, ও কান্নাকাটি করেছে! রিদি ধীর কন্ঠে জবাব দিলো,
“কোথায়? কান্নাকাটি করিনি তো।”

“মিথ্যা কথা বলবে না। মিথ্যা বলা মোটেও পছন্দ করি না। গতকালও তুমি আমাকে চরম একটা মিথ্যা কথা বলছো! হোয়াই রিদি? হোয়াট ইজ ইওর প্রবলেম? এক্সপ্লেইন টু মি।”
রিদি নত মুখে বসে রইলো। কোনো জবাব দিলো না। আরবিন ফোনটা আরেকটু সামনে নিয়ে বললো,
“আমাকে কতবড় মিথ্যা বলেছো! তুমি এক্সামে ফেইল করোনি। গতকাল রাতে আম্মার কাছে শুনলাম আমি। তাহলে ওই টাকা নিয়ে কী করেছো? এতগুলো টাকা নিয়ে নিশ্চয়ই ঝালমুড়ি খাবে না? কীসে উড়িয়েছো?”
“ফ্রেন্ডদের ট্রিট দিয়েছি।”
“কীসের ট্রিট?”
“আমার বার্থডে ট্রিট।”

রিদি আজ গড়গড় করেই সব জবাব দিচ্ছে। কোনোরকম তর্ক করছে না বা মুখে মুখে কথাও বলছে না। আরবিন বেশ অবাক হলো, রিদির এমন আচরণ দেখে। ঝাঁঝালো সুরে বললো,
“মিথ্যে বলার কোনো প্রয়োজন ছিল? আমি তো দেখছি না। তাহলে তুমি মিথ্যা কথা বলে টাকা নিলে কেন? সরাসরি বললে আমি দিয়ে দিতাম। তুমি আমাকে অশান্তিতে রাখতে প্রতিনিয়ত এসব করছো না? ভেবেছো, তোমার ফেইল করার কথা শুনে চিন্তিত হবো? ফাক অব দিস!”

“গতমাসে আপনার কাছে ব্লুটুথ হেডফোন কেনার জন্য টাকা চেয়েছিলাম। আপনি দিয়েছিলেন?”
“ওহহ! কাম অন রিদি! ওই বিষয় আর এই বিষয় সম্পূর্ণ আলাদা। এখন তোমার ব্লুটুথ হেডফোন কেনার কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। অযথা টাকা ওড়ানোর কোনে মানে দেখি না। তাই সরাসরি নাকচ করে দিয়েছি। কিন্তু এটা তোমার জন্মদিনের বিষয়। আমাকে একবার বলে দেখতে পারতে!”
“আমার কোনোকিছুর গুরুত্ব আছে আপনার কাছে? কে আপনি? আপনাকে বলতে হবে সবকিছু?”
রিদি এবার ত্যাড়াভাবে কথা বলতে লাগলো। আরবিন কিছুক্ষণ চুপচাপ দেখতে লাগলো ওকে। ওর চোখ, নাক, মুখ, ঠোঁট, গলা…

তারপর মুখে আঙুল রেখে প্রশ্ন করলো,
“শুকিয়েছো কেন? খাওয়া-দাওয়া করছো না?”
“না করছি না। তাতে আপনার কী?”
“আম্মু কোথায়? আম্মুর কাছে ফোনটা দাও।”
“আমি আম্মুর কাছে নেই।”
“মানে? কোথায় আছো তুমি?”
“কাকিমণিদের বাসায়?”
“ওখানে গেছো কেন?”
“কাকিমণিরা তাদের নতুন বাড়িতে উঠেছে দু’দিন আগে৷ তাই আমি এখানে আছি। আগামী কয়েকদিন থাকবো।”
“ওখানে থাকবে ভালো কথা, পড়াশোনার কী হবে?”
“বইখাতা সাথে এনেছি।”
“ওকে ফাইন। এবার মেইন টপিকে আসি। তুমি ফেসবুকে যাবে এখুনি। গিয়ে আমার সব পোস্ট থেকে রিয়্যাক্ট উঠাবে। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট ক্যান্সেল করবে।”
“আপনি আমার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করলেন না যে?”
“করবো না।”
“কেন?”

“আমার ফ্রেন্ডলিস্টে গুরুত্বপূর্ণ আর কাছের মানুষেরা থাকে। তুমি এমন জরুরি কেউ নও। একথা তোমাকে প্রতি মুহূর্তে উপলব্ধি করাতে। তুমি এসব কেন করছো? আমাকে অশান্তিতে ফেলতে চাইছো কেন? এতোটা অধঃপতন তোমার! আমি আশ্চর্য হয়ে যাই মাঝেমধ্যে।”
রিদি আস্তে করে জবাব দেয়,
“আপনাকে আমার সহ্য হয় না।”

“সেইম টু ইউ। কিন্তু তোমার মতো আমি তোমাকে জ্বালাই না৷ আমার অনেক কাজ থাকে৷ আরে তোমাকে তো আমার কখনো মনের ভুলেও মনে পড়ে না। তোমাকে গুনেও দেখি না। তুমি কী মনে করছো? আমার কাছে তোমার গুরুত্ব অনেক? যদি তা-ই মনে করো, তাহলে তুমি বোকার স্বর্গে বাস করছো। রিদি, আজ হোক, কিংবা কাল; একদিন না একদিন আমি তোমাকে ডিভোর্স দেবো। কারণ তোমাকে নিয়ে পুরো লাইফ কাটানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার পার্সোনাল লাইফে কেউ ইন্টারফেয়ার করুক, সেটা আমি মোটেও পছন্দ করি না। সেখানে তুমি আমার ওয়াইফ হয়ে এসব বারবার করার চেষ্টা করছো। আমার লাইফ পার্টনারকে হতে হবে কুল টাইপের। তুমি আমার লাইফ পার্টনার হওয়ার যোগ্য নও। আমি পরের বার ফিরলে ডিভোর্সের ব্যবস্থা করবো। এই কথাগুলো কয়েকদিন যাবত আমার মাথায় ঘুরছিল৷ তোমাকে না বলে উপায় দেখছি না। কারণ, তুমি সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছো। আমি কথা দিয়েছিলাম, যতক্ষণ আমরা নামে স্বামী-স্ত্রী থাকবো, ততদিন তোমার দায়িত্ব আমার। আর আমার কথা আমি অবশ্যই রাখি। তোমার প্রয়োজনীয় টাকা সময়মতো প্রতি মাসে পেয়ে যাবে। কিন্তু আজকের পর থেকে আমার সাথে আর কখনো যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না। আমি টলারেট করবো না। কজ, ইউ আর নট ইম্পর্ট্যান্ট টু মাই লাইফ অ্যাট অল।”

রিদি কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ, নির্বাক হয়ে চেয়ে রইলো আরবিনের দিকে। ওই নিষ্ঠুর, আবেগহীন পুরুষের চোখে-মুখে কি মারাত্মক কঠোরতা! দেখে মনে হয়, সম্পূর্ণ অনুভূতি বিহীন মানুষ। এমন মনোভাব যে তার মনে ছিল, তা ধারণাও করতে পারেনি রিদি। আগে যদি বুঝতো, তাহলে এতোটা নির্বোধ হতো না৷ এতোটা জেদ দেখাতো না!
নিজের ওপর মারাত্মক রাগ উঠলো রিদির। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে সামলে নিলো নিজেকে। আরবিনের চোখে চোখ রেখে শক্ত গলায় এবার জবাব দিলো,

“হ্যাঁ! আমারও কোনো ইচ্ছা নেই আপনার সাথে যোগাযোগ রাখার। আপনি এমন ইম্পর্ট্যান্ট কেউ না। শুধুমাত্র আমার খরচার টাকার জন্যই এতোদিন জ্বালিয়েছি। যখন বলছেন, আপনি সময় করে টাকা পাঠিয়ে দেবেন; তাহলে আমার আপনার সাথে আর যোগাযোগ না রাখলেও চলবে। আর ডিভোর্সের কথা যখন তুললেনই, তাহলে ওই ছেলের প্রপোজাল একসেপ্ট করা যায় কিনা ভাবছি।”
“এসব ভন্ডামি বাদ দিয়ে পড়াশোনায় মন দাও। কাজে লাগবে। জীবনে কিছু করার চিন্তা করো। আর তুমি যদি ওইদিন রাতের কথা ভেবে বসে থাকো, তাহলে বলবো, ওই রাতটা তুমি জাস্ট একটা শাস্তি হিসেবে মনে রাখবে। তোমার প্রতি আমার কোনো অবসেশন ভেবে ভুল করো না। এমন দিন কখনোই আসবে না যে, লেফটেন্যান্ট আরবিনের তোমার প্রতি অবসেশন কাজ করবে।”
রিদি পাল্টা জবাব দিলো না এবার। ইতিমধ্যে চেখ ছলছল করছে ওর। সামান্য তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে কল কেটে দিলো ও।

রিদি জামিয়ার ঘরে বসেছিল। দ্রুত বাথরুমের দিকে পা বাড়ালো ও। বাথরুমের দরজা আঁটকে ট্যাব চালু করে পানি ছেড়ে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়ালো রিদি।
মুখে হাত চেপে কান্নার শব্দ আটকানোর চেষ্টা করলো। যেন বাইরে আওয়াজ না যায়। কাঁদতে কাঁদতে বাথরুমের দরজা ঘেঁষে বসে পরলো রিদি।
কি মারাত্মক অসহ্যকর যন্ত্রণা হচ্ছে। বুকে কেমন দহনের সৃষ্টি করছে। মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। হাত কাঁপছে রীতিমতো।
আজ দিনটাই খারাপ ওর জন্য। না না! ওর ভাগ্যই খারাপ। সব ওর দোষে হয়েছে। এই বিয়ে করাটাই ওর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল। তা আজ খুব ভালোভাবে টের পেয়ে গেছে রিদি।

সন্ধ্যায় যখন কৌতূহলবশত আরবিনের ফেসবুক আইডি সার্চ করে আইডির ভেতরে যায়, তখন ভালোভাবে ঘেঁটে দেখে— আরবিনের আইডির পোস্টে অনেক মেয়েরা রিয়্যাক্ট, কমেন্ট করে। তখন রিদি রাগ-ক্ষোভের বশে হাহা দেয়। কিন্তু ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আগেই দিয়ে রেখেছিল, তাই ক্যান্সেল করতে ভুলে যায়। এরপর রিদি ওর ফ্রেন্ড সাইফাকে কল করে ওকে কথায় কথায় এ ব্যাপারে বলে ফেললে সাইফা বলে—
“এসব আর্মি, সেনাবাহিনীর সদস্যরা এমনিতেও খুব একটা ভালো হয় না। ঘরে বউ থাকলেও এদের ঝোঁক থাকে অন্যদিকে। বউকে ইগনোর করে সবসময়। তাছাড়াও এরা বেশিরভাগই সুদর্শন হয় বলে, এদের ওপর কিছু মেয়ের নজর বেশি থাকে। বেশিরভাগ ডিফেন্সের লোকেদের স্বভাব-চরিত্র খারাপ হয়। মেয়েমানুষ দেখলে তো আরো বেশি বিগড়ে যায়। আর এরা যেহেতু কর্মসূত্রে বউয়ের থেকে দূরে অবস্থান করে, তাই এদের স্ত্রীর প্রতি অবহেলা তৈরি হয়; আর একসময় স্ত্রীর ওপর থেকে মনও উঠে যায়। শেষমেশ সম্পর্ক শেষ হয়ে যায় ডিভোর্সের মাধ্যমে।”
সাইফার খালামণিরও নাকি এভাবেই ডিভোর্স হয়েছিল। তার হাসবেন্ড বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে জব করতো। তার তো কপাল আরো খারাপ। একটা বাচ্চা থাকাকালীন তার স্বামী তাকে ডিভোর্স দেয়। তার স্বামী কারণ হিসেবে জানায়, তাকে নাকি আর আগের মতো ভালো লাগে না। এখন সাইফার খালা সিঙ্গেল মাদার হিসেবে বাচ্চাকে বড় করছেন।

সাইফার এসব কথা শুনেই একা ঘরে বসে নানান চিন্তাভাবনা মাথায় এনে কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করছিল রিদি। এর-ই মধ্যে আরবিনের কল আসলো। আর তারপর এসব কথা, এমন ব্যবহার। কি জঘন্য সত্যিগুলো বিনা দ্বিধায় বলে দিলো আরবিন। একটুও সংকোচ কাজ করলো না! ওদের সম্পর্ক কী এতোটাই ঠুনকো? সেই রাতটাকে কী নিছকই মজার ছলে নিয়েছে আরবিন?

নিষিদ্ধ শব্দের দিনলিপি পর্ব ১২

কিন্তু রিদি যে মনের অজান্তে গুরুত্ব দিয়ে ফেলেছিল! তবে রিদির যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে। সিদ্ধান্ত ইতিমধ্যে নিয়ে ফেলেছে ও। আরবিনের সাথে আর কোনোদিনও যোগাযোগ করবে না।
আচ্ছা, রিদির সাথেও কী সাইফার খালার মতো ঘটনা ঘটবে? ভাগ্যিস আরবিনের সাথে সেদিন গুরুতর কিছু হয়নি! নাহলে একসাথে দু’টো জীবন ধ্বংস হতো!

নিষিদ্ধ শব্দের দিনলিপি পর্ব ১৪