নিষিদ্ধ শব্দের দিনলিপি পর্ব ৩৪
ঝিলিক মল্লিক
হালিমা খাতুন ঘরময় পায়চারি করছেন। তার এক হাত মুখে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, ভীষণ চিন্তাভাবনায় মগ্ন তিনি। রিদি বিছানার ঠিক মাঝখানটায় বসে আছে। গায়ের ওপরে একটা পাতলা কাঁথা টানা। চুলগুলো এলোমেলো। পুরো পিঠময় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ঘন চুলগুলো। মুখ লাল। চোখ ঘোলাটে। ঠোঁটের শুষ্ক অবস্থা। খানিক বাদে বাদে তা কেঁপে উঠছে। কিছুক্ষণ আগে পর্যন্তও কাঁদছিল রিদি। এখন বেশ চুপচাপ। তাকিয়ে আছে ওর কাকিমণির দিকে। তার কার্যকলাপ দেখছে। পরিস্থিতি মোটেও সু্বিধের মনে হচ্ছে না। রিদি এবার গলা ঝেড়ে কেশে নিলো৷ তারপর আশেপাশে নজর বুলিয়ে কাকিমণির দিকে সতর্ক দৃষ্টিতে চেয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
“কী ভাবলে কাকিমণি?”
“ভাবছি বুঝলি।”
“কী?”
“আগে আমাকে কতগুলো প্রশ্নের জবাব দিতে পারিস মা?”
হঠাৎ পায়চারি করা থামিয়ে এগিয়ে আসলেন হালিমা খাতুন। বিছানার ওপরে বসলেন রিদির সামনে। তারপর প্রশ্নটা করলেন। রিদি ভড়কালো কিছুটা। সেভাবেই পাল্টা জিজ্ঞাসা করলো,
“কী প্রশ্ন?”
“কোনোকিছু ভাবনাচিন্তা করার আগে সবকিছু খতিয়ে দেখা খুবই জরুরি। তাই দ্বিধাদ্বন্দ্ব সব ঝেড়ে কেশে নে। প্রশ্নমালা লম্বা হবে কিন্তু। আর উত্তরপত্রও স্পষ্ট হতে হবে। আপাতত আমাকে তোর নিজের বন্ধু ভাবতে হবে।”
রিদি এবার সোজা হয়ে বসলো৷ প্রস্তুত হয়ে নিলো কাকিমণির প্রশ্নের জবাব দেওয়ার জন্য। কাকিমণির হাত টেনে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,
“তুমি তো বরাবরই আমার বন্ধু ছিলে কাকিমণি। তোমার কাছে আমি একটা খোলা বইয়ের মতো। নাও, এবার যা প্রশ্ন করার; করো।”
হালিমা খাতুন এবার সহজভাবে প্রশ্ন করলেন,
“বিয়েতে কী তোর শুরু থেকেই মত ছিল? মানে পরিবারের কথা চিন্তা করে কোনোভাবে আবেগী হয়ে রাজি হয়েছিলি এই বিয়েতে?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“না তো। বিয়েতে সম্পূর্ণ আমার নিজস্ব মতামত ছিল। আমার মত না থাকলে এই বিয়েটাই হতো না।”
“আরবিনের দিক থেকে ঠিক ছিল তো? মানে তোকে বিয়ে করতে রাজি হওয়ার পেছনে কারণ কী ওর?”
“তা তো জানি না কাকিমণি। উনার মনের কোনো কথা-ই আমার জানা নেই। সেই সুযোগটা কখনো দেননি উনি। তবে হ্যাঁ, এতোদিনে এতটুকু বুঝেছি— উনি মূলত ফ্যামিলির জন্য-ই এই বিয়েতে রাজি হয়েছিলেন। কোনো দ্বিমত ছিল না। আবার বিয়ে করার জন্য খুব বেশি উচ্ছ্বসিতও নয়। একদম স্বাভাবিক। মানে প্রতিক্রিয়াহীন। বিয়ে হলো কি হলো না, তাতে যেন উনার কিছু যায় আসে না৷ একজন মানুষের বিয়ে হলে এই সম্পর্কের জের ধরে সেই মানুষটার মধ্যে নূন্যতম পরিবর্তন আসে৷ অথচ সে তার মতো চলে।‘
হালিমা খাতুন কিছুটা ভাবুক হলেন রিদির কথা শুনে৷ আপাতত তিনি শুধু প্রশ্ন পর্ব চালিয়ে যেতে চান। তাই এই কথার আলোচনায় গেলেন না তৎক্ষনাৎ। বরং কথার পিঠে পাল্টা প্রশ্ন করলেন,
“বিয়ের প্রথম দিন থেকে তোদের মধ্যে সম্পর্ক কেমন ছিল?”
রিদি এবার মাথা নুইয়ে চুপ করে রইলো। এই প্রশ্নের জবাবে কি বলবে সে! সেদিন যে একটা তুলকালাম কান্ড ঘটেছিল আর তার দায়ভার যে রিদির ওপরেও বর্তায়; তা বলা মোটেও সমীচীন নয়। তবে এই মূহুর্তে রিদিকে মুখ খুলতেই হবে। আর কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। না আছে কোনো পিছুটান। হালিমা খাতুন এবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রিদির দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে গম্ভীর স্বরে বললেন,
“দ্যাখ রিদি, অত্যন্ত সিরিয়াস বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছে। এখানে জড়তা রাখার কোনো কারণ দেখছি না। আর জড়তা রেখেও লাভ নেই। তাহলে আমি সমাধান করতে পারবো না ব্যাপারটার। আগেই বলেছি, ডিভোর্স কোনো সমাধান হতেই পারে না। আর সেখানে সর্বনাশ তো যা হওয়ার হয়েই গেছে। তাছাড়াও তোর বাপ-চাচাদের বংশে কোনো মেয়ে ডিভোর্সি নেই। আমি চাইছি না, হুটহাট সিদ্ধান্তে তোর জীবনটা নষ্ট হয়ে যাক। বুঝতে পারছিস আমার কথা?”
“জি কাকিমণি।”
“তাহলে বল এবার।”
রিদি ধীরেসুস্থে জড়তা কাটিয়ে মুখ খুললো এবেলায়। বললো,
“প্রথমে সবকিছু স্বাভাবিক-ই ছিল কাকিমণি। উনার সাথে বিয়ের আগে আমার মোটামুটি একটা ফর্মালিটির সম্পর্ক ছিল। উনাকে অপছন্দ করার কোনো কারণ-ই ছিল না। ভালো আর বিচক্ষণ ভদ্রলোক বলে জানতাম। কিন্তু বিয়ের প্রথম দিন রাতে এমন একটা ঘটনা ঘটে গেল যে…”
রিদি এটুকু বলেই থেমে গেল। হালিমা খাতুন এবার উৎসুক হয়ে বললেন,
“কী ঘটনা? তোদের দু’জনের মধ্যকার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্কিপ করে যতটুকু বলা যায়, ততটুকু বলতে পারিস আমাকে।”
“উনি যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আইটি এন্ড সাইবার সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্টের একজন অফিসার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন, সে ব্যাপারে আমি বিয়ের আগ পর্যন্তও জানতাম না। মনে আছে, সন্ধ্যায় তুমি উনাকে আমার ঘরে পাঠিয়েছিলে?”
“হ্যাঁ। হালকা মনে আছে।”
“ওইতো তখন ঘরে আসার পরে প্রথমে স্বাভাবিক আলাপ হয় আমাদের। আর কথায় কথায় জানতে পারি উনার জব সম্পর্কে। আর তখন আমি..”
রিদি বাকিটা বলতে পারে না। চুপ করে যায়। নিজের দোষের কথা কে-ই বা বলতে চায়! তবে হালিমা খাতুন ছাড়লেন না। রিদিকে চেপে ধরে ওর দিকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
“তখন তুই কী?”
“আমি ওভার রিয়্যাক্ট করে ফেলেছিলাম মাথা গরম থাকায়। উনার সাথে খুব বাজে আচরণ করেছিলাম।”
“কিন্তু কেন?”
“তুমি তো জানো কাকিমণি, কেন। বিয়ের সময়েও কেউ আমাকে উনার জবের ব্যাপারে প্রোপার্লি বলেনি। বললে, আজ এই দিন দেখতে হতো না৷ যত নষ্টের গোড়া সব ওই বিয়ের প্রথম দিন থেকেই শুরু হয়েছিল। তা-ও অমন একটা ঘটনার জের ধরে।”
“তোর কাকাই মা’রা যাওয়ার পরে তো আমিও ট্রমায় ছিলাম। কিন্তু তার কাজকে কখনো ছোট করে দেখিনি। বরং একজন শহীদ সৈনিকের স্ত্রী হিসেবে গর্ব করেছি সবসময়। আমরা কেউ যদি ঘুনাক্ষরেও জানতাম, ওই মান্দা আমলে মনে পুষে রাখা সামান্য একটা ভাবনার জের ধরে তোর জীবনে এমন প্রভাব পরবে, তাহলে কী তোকে বলতাম না ভেবেছিস? সরকারি চাকরিজীবী — এটুকুই তো যথেষ্ট ভেবেছিলাম। যদিও আমাদের ভুল ছিল কিছু। তবে তুইও তো কম যাস না রে। সামান্য একটু ইস্যু নিয়ে এতোকিছু?”
“আমি ভুল করেছি, তা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই। কিন্তু শুধু আমি একা ভুল করলেও মেনে নেওয়া যেতো। সে কী কম ভুল করেছে? যাক, তা-ও বাদ দিলাম। সে আমার সাথে ওই সন্ধ্যায় বাজে ব্যবহার করার পরে কী করেছে শুনবে না?”
হালিমা খাতুন জীবনের অনেকটা সময় পার করে এসেছেন। জ্ঞানের ধার তার নেহাত-ই কম নয়। তাই রিদির কথা বুঝতে তার অসুবিধাও হলো না। আর রিদি যে কি বলতে চাইছে, তা বুঝতেও নয়। তাই তিনি রিদিকে থামাতে হাত উঠিয়ে বললেন,
“থাক। আমি বুঝতে পেরেছি। অন্য কথায় আয়।”
তবে রিদি থামলো না। বললো,
“না। তা কী করে হয়? আমার দোষের কথা শুনলে, তারটা শুনবে না? সে সবসময় কেন ছাড় পেয়ে যাবে? ওইদিন রাতে উনি জোর করে আমার সাথে ইন্টিমেন্ট হয়েছিল। তারপর কী বলেছিল জানো?”
“কী?”
“এটা নাকি আমার জন্য শাস্তিস্বরূপ। আমাকে শাস্তি দিতেই এমনটা করেছে। আসলেই তাই। এই শাস্তি আমি এখনো পাচ্ছি বুঝলে। উনি প্রতিনিয়ত শাস্তি দিয়ে চলেছেন আমাকে। কিন্তু পরবর্তীতে উনার সাথে সিলেট যাওয়ার পরে আমি ধীরে ধীরে সব ঠিক করে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। সম্পর্কটাকে বহুবার সুযোগ দিতে চেয়েছি। কিন্তু উনি বারবার শুধু নানান দোহাই দিয়ে আমাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছেন। লাস্ট টাইম উনার বোন সিলেট থেকে ঢাকা ফেরার আগে আমাকে পরামর্শ দিয়েছিল, এমন কিছু করতে; যাতে উনি আমার শূন্যতা আর গুরুত্ব — দু’টো একসাথে উপলব্ধি করেন। এরপর আমি একটা ভয়ঙ্কর কাজ করে ফেলি।”
শেষের কথাটা কিছুটা মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বললো রিদি। তারপর নতমুখী হয়ে বসে রইলো অপরাধীর ন্যায়। হালিমা খাতুন অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে রিদির সব কথা-ই শুনছিলেন। এবার তিনি ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলেন,
“কী করেছিস তুই?”
“ফেরার হয়েছিলাম।”
“মানে?!”
“এইতো গত সপ্তাহের ঘটনা। সেদিন সকালে যখন উনি ক্যান্টনমেন্টে চলে গেলেন, তখন বেশ প্রস্তুতি নিয়ে ফোনটাকে কোয়ার্টারে ফেলেই গেট পাস কার্ড দিয়ে আমি বাইরে বের হলাম। ক্যান্টনমেন্ট এরিয়া পার হয়ে হাঁটতে হাঁটতে কোথায় যে গিয়েছিলাম, তা আমি নিজেও জানি না। এখনো পর্যন্ত মনে করতে পারি না৷ ভুলে বসেছি। তারপর আর কী? সেদিন সারাদিন বাইরে ছিলাম। সকাল দশটা হতে শুরু করে সন্ধ্যা ছয়টা-সাতটা বাজে বোধহয় তখন। ফিরে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা ছিল না। হাঁটছিলাম পথের ধার দিয়ে। আমি বোধহয় তখন শহরের কোনো এক পাশে হবো। লেকপাড়ে। কোয়ার্টার থেকে অনেকটা দূরে। জায়গার নাম জানি না৷ বেশ নির্জন পরিবেশ। বসে বসে আরো আশা করছিলাম, আরবিন যেন খুঁজে পাগলপ্রায় হয়ে যায়। আমার জন্য একটু হলেও আহাজারি করে। আমাকে যেন খুঁঁজে না পায়৷ আরো একটু সময় বসি বরং।
কারণ, আরবিনের কোয়ার্টারে ফেরার নরমাল টাইম পাঁচটা-সাতটা। এভাবেই রাত নয়টা পর্যন্ত বসার পরে হঠাৎ সেখান থেকে একজন বৃদ্ধ লোক যাওয়ার সময়ে বললেন, আমাকে বাসায় চলে যেতে। জায়গাটা এই সময়ে নাকি ভালো না। খারাপ কিছু হওয়ার সম্ভবনা নেহাৎ কম নয়। লোকটার কথা শুনে আমি আর সেখানে বসিনি। যেপথে এসেছিলাম, সেই পথেই হেঁটে গেলাম কিছুদূর। আর তারপর অটোরিকশা নিলাম। কোয়ার্টারে ফিরেছিলাম প্রায় সাড়ে নয়টার কাছাকাছি সময়ে। ভাবতে পারো?! কতটা জেদ জন্মেছিল আমার মধ্যে! প্রায় গোটা একটা দিন বাইরে ছিলাম! ফ্ল্যাটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তো তুমুল অবস্থা। যা ভেবেছিলাম ঠিক তার উল্টো হলো। ভেতরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে জড়িয়ে ধরে আহাজারি করার বদলে গালে দু’টো থাপ্পড় বসালো মহামান্য লোকটা। শুরুতেই এই কাজে আমি হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। যখন সিকিউরিটি গেটে সিকিউরিটি অফিসারও আমার দিকে আড়ে আড়ে তাকাচ্ছিল, তখনই আমার ঘটনা বুঝে যাওয়া উচিত ছিল।
আগে বুঝলে সেদিন আর কোয়ার্টারে ফিরতাম না৷ বাবাগো! আমার ওপর দিয়ে যা গিয়েছিল সেদিন! গোটা একটা ঘূর্ণিঝড়! সারারাত ঝাড়ির ওপর রেখেছিল। যা মেজাজ দেখিয়েছিল সেদিন! ভাবলেই এখনো গায়ে কাটা দেয়। প্রায় মা’র খাবো খাবো, তখন নাটক করে একটুর জন্য বেঁচে গিয়েছিলাম। উনি নাকি আমার জন্য পুরো কোয়ার্টার, ক্যান্টনমেন্টে তুলকালাম কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছিলেন। এমনকি কোয়ার্টার হেডের হেল্প নিতেও ছাড়েননি। যদিও এসব কথা আমি পরে শুনেছি অন্যের মুখে। সে যাকগে! ওই ঘটনার পরে উল্টো প্রতিক্রিয়া হলো। যা ভেবেছিলাম, ঠিক তার পুরোটা ভিন্ন। উনি আমার থেকে আরো বেশি দূরে তো সরলেন-ই, সাথে তারপর থেকে কথায় কথায় ধমকানো, চেঁচামেচি করা— এসব তো আছেই। লাস্ট টাইম আমাকে এতোগুলা শক্ত কথা শোনালেন, যে আর সহ্য করতে না পেরে আমি চলে আসলাম এখানে।”
হালিমা খাতুন এতোক্ষণ নিঃশ্বাস আটকে রিদির কথা শুনছিলেন। এবার জোরে জোরে শ্বাস ছাড়লেন তিনি। বিস্ময়ে মুখের ভাষা হারিয়েছেন যেন। বিস্মিত কন্ঠে জোর গলায় রিদিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“বাপরে! আসলেই ভয়াবহ কান্ড ঘটিয়েছিস তুই! অমন কান্ড ঘটানোর পরেও যে তোকে আস্ত রেখেছে, এ-ই অনেক বড় ব্যাপার।”
“কাকিমণি, তুমিও?!”
“দোষ যে তুই করেছিস, তা আমি অস্বীকার করতে পারবো না রিদি। তবে আরবিনেরও দোষ রয়েছে। এতোক্ষণে মূল বিষয়টা বুঝতে আমার অসুবিধা হচ্ছে না এখন।”
“কী বিষয়?”
“আরবিন তোকে এখনো শাস্তি দিয়ে চলেছে। তুই যেসব কাজ করে বেড়িয়েছিস, সেসবের শাস্তি। যদিও ওর এটা করা উচিত নয় বলে আমি মনে করি৷ ওর শাস্তি দেওয়ার পন্থা ভুল।”
“সেটাই তো আমি বলছি কাকিমণি। ভালোবেসে বোঝালে কি আমি বুঝতাম না? উনি আসলে কখনো ভালো-ই বাসেননি আমাকে। নাহলে এতো সহজে ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা বলতে পারতো না।”
হালিসা খাতুন এবার কিছুটা নরম গলায় বললেন,
“তোমার দোষের কারণেই ও তোমাকে শাস্তি দিচ্ছে বারবার। তবে ওর দিকটা আমার কাছে এখনো পরিষ্কার হইনি তোমার কথায়। আগে ওর মনোভাব বুঝতে হবে। ডিভোর্সের কথা এখনই ভেবো না। সবকিছু ছেলেখেলার মতো করে নিলে জীবন চলে না।”
“তাহলে?”
“ওকেও কিছুদিন পাল্টা শাস্তি পেতে দেওয়া জরুরি। তুমি ডিভোর্সের কথা তুলবে। কিন্তু ডিভোর্স দেবে না৷ ও কনট্যাক্ট করার চেষ্টা করলে ওর সাথে কনট্যাক্টও করবে। তবে খেয়াল রাখবে, তোমার বলার ভাষা যেন কঠিন হয়। এটাই ওর জন্য সবচেয়ে বড় শাস্তি হলেও হতে পারে। তাতেও কাজ না হলে তখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবো। নরম হলে বিপদ। নরম মাটিতে আঁচড় কাটা খুব সহজ।”
হালিমা খাতুন উঠলেন। বললেন,
“সংসার করা খুব কঠিন রে মা। ধরে রাখতে জানতে হয়। তবে চেষ্টাটা দু’দিক থেকে করা জরুরি৷ নাহলে অচিরেই সবকিছু ভেঙেচুরে যায়।”
রিদি উঠে বসলো। হালিমা খাতুন ঘর থেকে বের হবেন, তখনই আবারও তার ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। ফোনের দিকে একনজর তাকিয়ে তিনি রিদিকে বললেন,
“আরবিন কল দিয়েছে আবার। কথা বলতে চাইলে এবার কথা বলবি। কিন্তু যা বলেছি, মনে রাখবি। বুঝেছিস?”
“হুঁ।”
রিদি মাথা নেড়ে সায় জানায়। হালিমা খাতুন কল রিসিভ করার সঙ্গে সঙ্গে কানে চেপে ধরে কিছু একটা শুনে রিদির হাতে ফোন ধরিয়ে দিয়ে ইশারা করে বললেন, কথা বলতে। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। বাইরে থেকে দরজা ভেজিয়ে দিলেন। রিদি আস্তে-ধীরে ফোনটা তুলে কানে চেপে ধরলো। একটা শব্দও করলো না।
“রিদি!”
ফোনের ওপাশ থেকে ভরাট কন্ঠস্বর শুনতেই কিছুটা বুক ধড়ফড় করে উঠলো রিদির৷ মস্তিষ্ক এলোমেলো হতে লাগলো৷ তবু কাকিমণির বলা কথাগুলো স্মরণ করে মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে সামলে নিলো রিদি। চোখ বুঁজে জোরে শ্বাস টেনে শান্ত হলো। তারপর জবাব দিলো,
“হুঁ।”
“কী করছো?”
আরবিনের কন্ঠস্বর কেমন যেন শোনালো! ঠিক স্বাভাবিক নয়। একটু অন্যরকম। রিদির সন্দেহ জাগলো মনে। জবাবে মিথ্যা বললো একটু। প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য।
“আজিজের সাথে কথা বলছিলাম।”
“আজিজ! কে এই হারামজাদা?”
“আমার কলেজ লাইফের ফ্রেন্ড।”
“কী কথা বলছিলে?”
“প্রপোজ করলো আমাকে। সেই নিয়েই কথা হচ্ছে দীর্ঘ সময় ধরে। কেন? কী হয়েছে? কোনো দরকার থাকলে দ্রুত বলে শেষ করুন। আপনার সাথে অতো ফালতু আলাপ করার টাইম আমার নেই।”
“ফালতু! তোমার আমাকে ফালতু মনে হয়? বেয়াদব! স্বামীকে ছেড়েছুড়ে যেয়ে এখন ওখানে উল্টাপাল্টা কাজ করে বেড়াচ্ছো!”
“করছি তো? আপনাকে তো আমি ডিভোর্স দিচ্ছি-ই। আমার লাইফ, আমার ডিসিশন। এখন যা খুশি করবো। ঘুরবো, উড়বো। আপনি কৈফিয়ত চাওয়ার কেউ না।”
“কেউ না?”
“না কেউ না।”
“হাসবেন্ড হই তোমার।”
“নামকাওয়াস্তে। কিছুদিন পর হবেন এক্স হাসবেন্ড। অগ্রিম অভিনন্দন।”
“রিদি দেখো বাড়াবাড়ি কোরো না, প্লিজ। অনুরোধ করছি।”
“বাড়াবাড়ি করছি না তো। বরং যা আগেই করা উচিত ছিল, তা-ই এখন করছি।”
রিদি থামলো কথাটা বলে। ফোনের ওপাশ থেকে কিছুক্ষণ কোনো কথাবার্তা নেই। ভীষণ মজা পাচ্ছে রিদি। আরবিনের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে শুধু। আরবিন এবার ফিসফিসানো সুরে বললো,
“তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে..”
পুরো কথাটা শেষ করলো না আরবিন। এটুকু বলতেই তাই কত দ্বিধা! রিদি এবার ভ্রু কুঁচকে বললো,
নিষিদ্ধ শব্দের দিনলিপি পর্ব ৩৩
“কী?”
“কিছুনা। রাগ-জেদ ছাড়ো। সিলেট চলে আসো।”
“কারো আদেশ শোনার জন্য বসে নেই। আমি ফিরবো না। এ জীবনে অন্তত কখনোই না।”
ফোনের ওপাশ থেকে এবার ঢকঢক করে কিছু গিলে খাওয়ার আওয়াজ শুনতে পেল রিদি৷ ও ভাবলো, পানি গিলছে বোধহয়। তাই চুপ করে রইলো৷ এবার ফোনের ওপাশ থেকে একটা মাতাল মাতাল কন্ঠস্বর শোনা গেল,
“প্লিজ জান। ব্যাক করো আমার কাছে। তোমাকে ছেড়ে থাকা সম্ভব হচ্ছে না আমার পক্ষে। রাতে ঘুমাতে পারছি না ঠিকমতো।”