নিষিদ্ধ শব্দের দিনলিপি পর্ব ৩৬
ঝিলিক মল্লিক
আরবিনের অ্যাক্সিডেন্টটা সত্যিই হয়েছে। রিদির ভাবনাতেও আসেনি। সিলেট আসার আগ পর্যন্তও ও ভেবেছিল, আরবিন বোধহয় ইচ্ছাকৃত প্র্যাংঙ্ক করছে; কিংবা ওকে কাছে আনার জন্যই এসব মিথ্যা অভিনয় করছে। তবু এক অমোঘ আকর্ষণের টানে রিদি সিলেটে সত্যিই এসেছে। তবে একা নয়। না আরবিনের সত্যিই অ্যাক্সিডেন্ট না হলে ওর পরিবারের লোকজনদেরও যে ফোন করে সংবাদ দেওয়া হতো না— এদিকটা রিদি ভেবে দেখেনি। ওর মাথায় যে কিসব ঘুরছিল, তা ও নিজেই জানে না।
রিদি এসেছে ওর আব্বা আর শ্বশুরের সাথে। ওর কাকিমণিরাও এসেছে এখানে। শুধু বাকি রয়েছে রিদির আম্মা আর শাশুড়ি। রিদির শাশুড়ি একটু অসুস্থ হয়ে পরায় রিদির আম্মাকে সেখানেই থাকতে হয়েছিল। তারা রওয়ানা দিয়েছেন আরো পরে। রিদির শ্বশুর কল করেছিলেন। তাদের পৌঁছাতে এখনো ঘন্টা তিনেক লাগতে পারে।
আরবিনকে ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে নেওয়া হয়েছে। কয়েকজন অফিসার সিভিল ড্রেসে উপস্থিত ছিল সেখানে। ইউনিট কমান্ডার আবদুল মুহিত স্যার বারকয়েক এসে খোঁজ-খবর নিয়ে গেছেন। এখন ডিউটি টাইম নয়। সন্ধ্যা গড়িয়েছে অনেকক্ষণ হলো। রিদিরা রওয়ানা দিয়েছিল সকালে সংবাদ পাওয়ার পরপরই। ওর আব্বা আর শ্বশুর এসেছিল ওর কাকাবাড়ি। সেখান থেকেই একসাথে সবার এখানে আসা।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রিদি মাত্র এসে করিডোর পেরিয়ে দেয়ালের পাশ ঘেঁষে রাখা সারি সারি চেয়ারগুলোর একটাতে ধপ করে বসে পড়লো৷ ওর মাথা কাজ করছে না। কাকে যে কি বলবে, তা-ও বুঝে উঠতে পারছে না। কে যেন বললো, সেনা অফিসার লেফটেন্যান্ট আরবিন আল তৈমুর ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে। কিন্তু কথা হচ্ছে, কি এমন হয়েছে; যার জন্য ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে নেওয়া হলো! আরবিনের কি সিরিয়াস কন্ডিশন?
রিদি আর ভাবতে পারছে না। ভাবলেই প্রচন্ড মাথাব্যাথা হচ্ছে ওর। দম বন্ধ হয়ে আসছে৷ হাঁসফাঁস লাগছে।
একজন অফিসারকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। রিদির আব্বা আর শ্বশুর দৌড়াদৌড়ি করছিলেন। সব খোঁজ-খবর নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন৷ সেই অফিসারের সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলতে লাগলেন। ছেলেটা এগিয়ে এসে করমর্দন করে ভদ্রোচিতভাবে বললো,
“আঙ্কেল, আমার নাম কায়েস। আমি-ই কল করেছিলাম আপনাদের।”
ইকবাল জম্মাদার বললেন,
“আমার ছেলের এক বন্ধু আছে। ওর নামও কায়েস। কায়েস শিকদার।”
“আমি কায়েস আহমেদ।”
কায়েস টুকটাক কথা বললো আরো। পরের কথা যেটা শুনতে পেল রিদি— ওর শ্বশুর ইকবাল জম্মাদার কায়েসকে জিজ্ঞাসা করছেন,
“ওর কী অবস্থা?”
“সিটিস্ক্যান, এমআরআই করানো হয়েছে। তবে সৌভাগ্যের ব্যাপার হলো, আল্লাহর অশেষ রহমতে ইন্টারনাল ব্লাডিং হয়নি স্যারের। তবে যথেষ্ট ইনজুরড হয়েছেন তিনি। তাই আর সময় নষ্ট না করে হসপিটালে নিয়ে এসেছে স্থানীয় মানুষজন। আমরা খবর পাই আরো পরে।”
“অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল কীভাবে?”
“স্যার আজকে ডিউটি টাইমের মাঝে অবসর সময়ে পরিচিত একজনের কার ড্রাইভ করতে বের হয়েছিলেন। আর তখনই ফেরার পথে অ্যাক্সিডেন্টটা হয়। একটা মিনি ট্রাকের সাথে। তবে যতদূর শুনেছি, স্যার বেহেড ছিলেন। একারণে অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল। যদিও একথা আমি বিশ্বাস করি না। স্যার এর আগেও বহুবার কার ড্রাইভ করেছেন। এতে বেশ দক্ষ তিনি। তার দ্বারা এমন ভুল হবে বলে মনে হয় না৷ আর হলেও. . .”
পুরো কথা শেষ না করে রিদির দিকে তাকায় কায়েস। রিদি এতোক্ষণ মনোযোগ সহকারে কান খাঁড়া করে সব কথা শুনছিল। এবার কায়েসের তাকানোর ইঙ্গিতে বুঝলো, কায়েস বলতে চাচ্ছে — স্যারের বেহেড অবস্থায় অ্যাক্সিডেন্ট হলেও ভাবীর জন্য হয়েছে।
হ্যাঁ! কায়েস মূলত এটাই বলতে চাচ্ছিল। কিন্তু হুট করে কি ভেবে যেন থেমে গেল। রিদি বুঝতে পারলো বোধহয়। তবু না বোঝার ভান করে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। ইকবাল জম্মাদার এবার জিজ্ঞাসা করলেন,
“ওকে মনিটরিং-এ রাখা হয়েছে?”
“জি আঙ্কেল। সম্ভবত আরো চব্বিশ ঘণ্টা রাখা হবে।”
“দেখা করতে পারবো?”
“ডাক্তার এখনো পর্যন্ত কাউকে দেখা করার অনুমতি দেয়নি। এক্সটার্নাল ব্লাডিং ভালোই হয়েছে। স্যারের ঘাড় আর মাথার অবস্থান ঠিক রাখতে নাকি কোলার, বেস ব্যবহার করতে হচ্ছে। এবার বুঝুন অবস্থা!”
রিদির এবার কান্না পেল কায়েসের কথা শুনে। এতোক্ষণ সবকিছু মুখ বুঁজে ধৈর্য ধরে শুনছিল ও। শেষের কথাগুলো আর সহ্য করতে পারলো না। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। ওয়াশরুম খুঁজতে ব্যস্ত হলো। এই মুহূর্তে পাবলিক প্লেসে থাকলে ওর মান-ইজ্জত যাবে বৈকি।
আফসানা বেগম সেই কখন থেকে কেঁদেই চলেছেন। তার পাশে বসে তাকে সামলানোর চেষ্টা করছেন তানিয়া বেগম আর হালিমা খাতুন।
রিদি দূরে দাঁড়িয়ে আছে। বেশ অনেকটা দূরে। কোনো তাড়াহুড়ো নেই। কেমন যেন শান্ত মুখশ্রী ওর। তা দেখে দূর থেকে তানিয়া বেগম আরো কঠোর চাহনিতে তাকালেন মেয়ের দিকে। মেয়েটা এমন পাষাণ হলো কবে থেকে! একটুও কী মায়াদয়া নেই? ওদিকে স্বামীটা হসপিটালের বেডে পড়ে আছে আহত অবস্থায়। এদিকে শাশুড়ির আহাজারি একমাত্র ছেলের জন্য। তবু মেয়েটার একটুও হেলাফেলা নেই। এসে থেকে দেখছেন, সেই যে এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, একটুও নড়াচড়া নেই। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে লম্বা করিডোরের অদূরে।
রাত এখন গভীর। আরবিনের কলিগরা সবাই বেরিয়ে গেছেন কিছুক্ষণ আগেই। সকালে আবারও আসবেন তারা। রিদির আব্বা আর শ্বশুরআব্বা বেরিয়েছেন অনেকক্ষণ হলো। ডাক্তারের দেওয়া প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ফার্মেসি থেকে ওষুধপত্র আনতে গেছেন তারা। হাসপাতাল মোটামুটি শুনশান নীরব। সারাদিনের মতো ততোটা কোলাহল নেই। আর না আছে কারো তাড়াহুড়ো। তানিয়া বেগম এবার হালিমা খাতুনকে বেয়াইনের পাশে বসিয়ে রেখে উঠে এগিয়ে আসলেন মেয়ের দিকে। মেয়েকে কিছুটা দূরে টেনে নিয়ে ওর হাতের বাহু চেপে ধরে বললেন,
“কী হয়েছে তোর?”
“কী হবে?”
রিদি ভ্রু কুঁচকে তাকালো মায়ের দিকে। প্রশ্নের পিঠে পাল্টা প্রশ্ন করলো। তানিয়া বেগম এবার ফিসফিসিয়ে বললেন,
“ওদিকে তোর স্বামী হসপিটালের বেডে। দেখেছিস?”
রিদি দুই পাশে মাথা নাড়িয়ে “না-সূচক” জবাব দেয়। যার অর্থ সে দেখেনি। তানিয়া বেগম এবার দাঁতে দাঁত চেপে বেশ কঠোর গলায় বলেন,
“ওই দেখার কথা বলছি না। এখানের পরিবেশ-পরিস্থিতি ভালো না। ছেলেটার অমন অবস্থা। তোর শাশুড়ির মানসিক অবস্থা ভালো নয়। তুই এখনো এতোটা শান্ত আছিস কীভাবে? একটু তো কাঁদ। নাহলে যে খারাপ দেখায়। মানুষ মন্দ কথা বলবে।”
“কিছু খারাপ দেখায় না আম্মা। আর মানুষের বলাবলিতে আমার কিছু যায় আসে না। তুমি অতিরিক্ত সহজ-সরল। কিন্তু আমি ইমোশনাল নই। আমি কান্নাকাটি করলেই উনি সুস্থ হয়ে যাচ্ছেন না।”
তানিয়া বেগম এবার রিদির হাত ছেড়ে দিয়ে দাঁত পিষে বললেন,
“আমার জন্মের তা এমন বেয়াদব হয়েছে চিন্তা করা যায়! কান্নাকাটি করতে না পারো, মুখটা একটু কষ্ট করে সামলে রাখো। তোমার ওই কথার ধারে তোমার শাশুড়ি আবার একদফা অসুস্থ হয়ে না পড়েন — আমার হলো সেই টেনশন।”
তানিয়া বেগম চলে গেলেন। রিদি সেদিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে থেকে আনমনে বিরবির করে বললো,
“উনিই তো আমাকে কঠোর হতে শিখিয়েছেন আম্মা। আমার কী দোষ?!”
রাত তখন তিনটা। সবাই বসে আছে কেবিনের সামনের করিডোরে। সবারই নির্ঘুম রাত কাটছে। কারো চোখে একফোঁটা ঘুম নেই। ডাক্তার এসেছিলেন এদিকটায় কোনো একটা জরুরি কাজে। এতো রাতে আসার কারণ কি, তা কারো জানা নেই। তবে তিনি কেবিন থেকে বের হতেই ইকবাল জম্মাদার উঠে গেলেন। ডাক্তার জানালেন, আরবিনের জ্ঞান ফিরেছিল বহু আগেই। ইনজেকশন পুশ করায়, আরো কিছুক্ষণ ঘুমিয়েছিল। মাত্র কিছু সময় আগে আবার জ্ঞান ফিরেছে। ইকবাল জম্মাদার এবার ডাক্তারকে খুব করে অনুরোধ করলেন, যেন ছেলের কাছে যেতে দেওয়া হয়। ডাক্তার প্রথমে নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও পরে তার মন নরম হলো। তবু অনুমতি দিয়ে শক্ত গলায় বললেন, যেন রোগীর সাথে একসঙ্গে দুই-তিনজনের বেশি দেখা না করে এই মুহূর্তে। একসাথে বেশি মানুষের আনাগোনা ও কোলাহলে রোগীর স্বাস্থ্যের আরো অবনতি হতে পারে। ইকবাল জম্মাদার ডাক্তারের কথা রাখলেন৷ প্রথমে তিনি, তার স্ত্রী আর সোহরাব হোসেন ভেতরে গেলেন। আরবিন কেবিনে চোখ বুঁজে শুয়েছিল। ওর আব্বা-আম্মার কথাবার্তা শুনে চোখ খুললো। ইকবাল জম্মাদার স্ত্রী’কে বারবার সতর্ক করে এসেছেন বাইরে থেকে, যেন ছেলেকে দেখে একটুও কান্নাকাটি না করে। তবু মায়ের মন তো! ছেলের শুকনো মুখ দেখেই আড়ালে একটু কাঁদলেন আফসানা বেগম। ছেলের পাশে বসে তার হাত মুঠোয় রেখে কথা বললেন অনেকটা সময়। আরবিন শুধু নিশ্চুপ হয়ে শুনছিল মায়ের কথা।
বেশ আধ ঘন্টাখানেক পরে সবাই কেবিন থেকে বেরিয়ে আসলো। রিদি তখনও দেয়ালে ঠেস দিয়ে বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে ছিল। ওর ওড়না ঝুলছে একপাশে। চুলের খোঁপাও খুলে গেছে বেখেয়ালিতে। সেদিকে মোটেও খেয়াল নেই ওর। সম্পূর্ণ আনমনে দাঁড়িয়ে আছে ও। শাশুড়ি মানুষটা যে কখন রিদির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, তা খেয়াল করেনি রিদি৷ শাশুড়ির মুখে নিজের নাম শুনতেই ধ্যান ভাঙলো ওর। আফসানা বেগম বোধহয় কাঁদছিলেন কিছুক্ষণ আগে পর্যন্তও। চোখ-মুখ ফুলে গেছে তার। রিদির ভীষণ মায়া হলো তাকে দেখে। তবে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষাও আপাতত হারিয়ে ফেলেছে ও। আফসানা বেগম এবার রিদির হাত ধরে টেনে ওকে কেবিনের বন্ধ দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বললেন,
“যাও, দেখা করে এসো।,”
“উনি খুঁজছিলেন আমাকে?”
“খোঁজ করেনি। তবে দেখা করা তো জরুরি। যাও।”
আফসানা বেগম একপ্রকার ঠেলে রিদিকে কেবিন রুমের ভেতরে ঢুকিয়ে দিলেন। রিদি দরজা লক করে দিলো। সামনে হাত চারেক দূরে লম্বা বেড। তাতে শুয়ে আছে আরবিন। গায়ের ওপর একটা মোটা সাদা রঙের কম্বল টানা। শীত করছে নাকি! যদিও এখন শীতের মৌসুম নয়। রিদি এগিয়ে গেল। আরবিনের বেডের পাশ ঘেঁষে একখানা চেয়ারের অবস্থান। তাতে নিঃশব্দে বসলো রিদি। আরবিন তখনও চোখ বুঁজে শুয়ে আছে। রিদির উপস্থিতি টের পেয়েছে কিনা কে জানে! রিদি এবার খুব দ্বিধাবোধ নিয়ে আলতোভাবে অস্ফুটস্বরে ডাকলো,
“আরবিন!”
সেকেন্ড পঁচিশের মধ্যে আরবিন চোখ খুললো। রিদি ওই চোখের চাহনি দেখে কিঞ্চিৎ ভয় পেল। তবে চোখে-মুখে তা প্রকাশ করলো না।
আরবিনের চোখ টকটকে লাল৷ রাগ না জেদ, তা জানে না রিদি। তিরস্কার কিংবা ধিক্কারও হতে পারে। রিদি আরবিনের হাতের বাহু শক্ত করে চেপে ধরে বললো,
“ব্যাথা কোথায়?”
“এখানটায়।”
আরবিন আলতোভাবে একহাত উঠিয়ে বুকের বাঁপাশে হাত রেখে ইঙ্গিত করে কথাটা বললো। রিদি চুপ করে রইলো। কোনো জবাব দিলো না। আরবিন এবার ধীরে ধীরে কঠোর গলায় বললো,
“এসেছো কেন?”
“কেন? আমার আসার কথা ছিল না?”
“না, ছিল না। চলে যাও এখান থেকে।”
“এমন করছেন কেন? আমার ওপর জেদ ধরে নিজের অ্যাক্সিডেন্ট করিয়েছেন না?”
“বেশি বাজে বকো কেন? কে তুমি? যে তোমার জন্য নিজের অ্যাক্সিডেন্ট ঘটাতে যাবো?”
“আপনার কাছে আমি কে, তা তো আমার জানার কথা নয়। আপনি নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে দেখুন।”
আরবিন এবার উঠে বসার চেষ্টা করলো। রিদি ওর পিঠে হাত রেখে ওকে উঠে বসতে হেল্প করলো। তবে পুরোপুরি না উঠতে পারলেও বালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া হলো। রিদি আরবিনের হাতের পাঁচ আঙুলের ফাঁকে নিজের হাতটা গুঁজে নিলো। তারপর আরবিনের চোখে চোখ রাখলো। আরবিন তখন একদৃষ্টিতে রিদির দিকে তাকিয়ে। রিদি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে আরবিনকে। সেই পাষাণ লোকটাকে। রিদি এবার আরবিনের কাছ ঘেঁষে বসে হালকা ফিচেল হেসে বললো,
“ইশশ! লেফটেন্যান্ট আরবিনের কি অবস্থা করে ছেড়েছি আমি। ছ্যাঁকাখোর মার্কা চেহারা বানিয়েছেন কেন? চুল উষ্কখুষ্ক। মুখ শুকিয়েছে। হালকা গোঁফও গজিয়েছে দেখছি। হেব্বি একটা মিলিটারি মিলিটারি ভাব এসেছে।”
আরবিন এবার ওর হাতের আঙুলের ভাঁজে থাকা রিদির নরম আঙুলগুলোকে আলতোভাবে চাপ দিলো। রিদি একটুখানি সরতে চাইলো। আরবিন সরতে দিলো না। ইশারা করে বেডে ওর পাশে এসে বসতে বললো। বাধ্য স্ত্রীর মতো বসলো রিদি। আরবিনের দিকে আকুল দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। আরবিন হঠাৎ শক্ত করে দুহাতে জড়িয়ে ধরলো রিদিকে। নিজের বুকের মধ্যে টেনে নিলো৷ এতোটাই জোরে যেন ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে। আরবিন এবার ফিসফিসিয়ে রিদির কানের নিকটে মুখ রেখে বললো,
“একজন সেনা অফিসারের যোগ্য স্ত্রী হয়ে উঠেছো এবার দেখছি। হাসবেন্ড ইনজুরড হয়ে বেডে পড়ে আছে, তা-ও কাঁদছো না?!”
“কাঁদতে হবে বুঝি?”
“না। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বসে থাকো এভাবেই। তাতেই অর্ধেক সুস্থ হয়ে যাব।”
“এটা কোন ধরনের কথাবার্তা? মেডিসিনে মানুষ সুস্থ হয়। জড়িয়ে ধরায় নয়।”
“তুমিই আমার মেডিসিন।”
রিদির কাঁধের ওড়না সরিয়ে উন্মুক্ত করে আলতোভাবে একটা প্রগাঢ় চুমু বসিয়ে কথাটা বললো আরবিন। রিদি কী ঠিক শুনলো? হ্যাঁ, বোধহয় তাই। তবে আশ্চর্য হলো। চরম আশ্চর্য! এহেন কথাও আরবিন বলতে পারে? জানা ছিল না ওর। রিদি আরবিনের পিঠ খামচে ধরে আলতো স্বরে বললো,
“আপনি আমাকে ভালোবাসেন না তো।”
“কোন কুলাঙ্গারের বাচ্চা বলেছে ভালোবাসি না? হারামির বাচ্চাকে সামনে পেলে কু’পাবো।”
“তাহলে একবার ভালোবাসি বলবেন?”
“ভালোবাসি না বলেও ভালোবাসা যায় রিদি।”
“সেটা কীভাবে?”
“সব কথা কেন আমার বুঝিয়ে দিতে হবে? এই-যে তোমার জন্য এতোটা বেহেড হওয়া, অ্যাক্সিডেন্ট করা, প্রতিটা মুহুর্তে তোমার জন্য দুশ্চিন্তায় থাকা, সেদিন তোমার অনুপস্থিতিতে বেপরোয়া হওয়া— এসবের মাঝে কী তুমি ভালোবাসার সন্ধান পাও না? এতোটা অবুঝ হলে কবে থেকে?”
“আপনি কেমন যেন!”
“আমি এমন-ই রিদি। তুমি শুধুমাত্র আমার কঠোরতাকে দেখতে পাও। তোমার প্রতি আমার ফিলিংসকে নয়।”
“তাহলে কী আমি বোকা?”
“না, তুমি বোকা নও। তুমি প্রেমের প্রতিমূর্তি। আমার আগ্নেয়গিরির মতো পুড়ে ছারখার হয়ে যাওয়া জীবনে এক টুকরো শীতল বরফ। একমাত্র তুমি পারো আমার ভেতরকার দহন নেভাতে। আর কেউ পেরেছে কখনো?”
“না।”
“তাহলে নিজেকে এতো তুচ্ছ মনে করো কেন? আমার হাইপার মেজাজ। কন্ট্রোল করতে পারি না। এটুকু বোঝো না?”
“হুঁ।”
রিদি নতমুখে জবাব দিলো। নিজেকে এখন অপরাধী মনে হচ্ছে ওর। আরবিন ওর গলার ভাঁজে মুখ রাখলো। সেখানে ঠোঁট চেপে ধরে ফিসফিসিয়ে বললো,
“একটা প্রস্তাব দিই?”
“কী?”
নিষিদ্ধ শব্দের দিনলিপি পর্ব ৩৫
রিদি কেঁপে উঠে প্রশ্ন করলো পাল্টা। আরবিন গলার স্বর আরো গভীর অথচ শক্ত রেখে বললো,
“সারাজীবনের জন্য আমার এই বেহেড মেজাজকে কন্ট্রোল করার দায়িত্ব নিতে পারবে জান?”
রিদি জবাব দিতে পারলো না শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল যেন। আরবিন ওকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলো।