নীরদ ক্লেশের অন্ত পর্ব ২২
লেখিকা-নামীরা অন্তিকা
মিনিট দশেকের মতো অন্ধকারে বসে আছে স্নিগ্ধা। মোম নিভু নিভু হয়ে আসার পর উৎস উঠে বাড়ির ভেতরের দিকে চলে গিয়েছে। ভেতরে যাওয়ার মিনিট দুয়েকের মাঝেই মোম নিভে গেছে আর স্নিগ্ধাও অন্ধকারে একা বসে আছে।
পরিবারের চিন্তায় স্নিগ্ধা এতটাই মত্ত হয়েছে চারদিকে অন্ধকারে তার একটুও ভয় অনুভব হচ্ছেনা। অবশ্য এতো বেশিও অন্ধকার নয়, চাঁদের আবছা আলোয় আলোকিত হয়ে রয়েছে চারদিক।
“একা একা ভয় করছে অন্ধকারে?”
ভাবনায় মত্ত থাকায় হুট্ করে উৎসের কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে হতচকিত হলো স্নিগ্ধা। আবছা আলোয় দেখলো উৎস তার পাশের চেয়ারে বসেছে। স্নিগ্ধা আড়চোখে তাকালো। হুট্ করেই উৎস আলোকিতময় কিছু একটা স্নিগ্ধার সামনে তুলে ধরলো। স্নিগ্ধা ভ্রু কুঁচকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাতে দেখতে পেলো একটা কাছের জারের মধ্যে অনেকগুলো জোনাকিপোকা। জোনাকিপোকার আলোয় স্নিগ্ধা উৎসের দিকে তাকালো। উৎস একদৃষ্টিতে তার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। স্নিগ্ধা একনজর সেই দৃষ্টি পর্যবেক্ষণ করে নিজের দৃষ্টি সরিয়ে ফেললো। উৎস সেই জারের মুখ খুলে দিয়েছে। জোনাকিপোকা একে একে বেরিয়ে আসছে, চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাচ্ছে। পরিবেশটা স্নিগ্ধার ভালো লাগলো, লাগলোনা শুধু উৎসের উপস্থিতি। উৎস আসার সময় সাথে করে মোম নিয়ে এসেছে, তিনটা মোম জ্বালালো সে। স্নিগ্ধার মুখশ্রী পানে তাকিয়ে বিরস কণ্ঠে বলে উঠলো,,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ভাবলাম কই একটু হাসবে, তা নয় মুখ গম্ভীর করে বসে আছো। একদম নিজের ভাইয়ের মতো হয়েছো, তোমার ভাই যেমন আমার বোনের সামনে মুখ গম্ভীর করে রাখে তেমনি তুমিও আমার সামনে মুখ গম্ভীর করে রাখো।”(বিরস কণ্ঠে)
স্নিগ্ধা ভ্রু কুঁচকে উৎসের মুখশ্রী পানে তাকালো। উৎসের বাক্য বচন কিয়ৎক্ষণ মস্তিষ্কে আওড়ালো। “বোন”, উৎস বোন বলে কাকে বুঝাচ্ছে? স্নিগ্ধা গমগমে স্বরে বলে উঠলো,,
“বোন? কে আপনার বোন?”(গমগমে স্বরে)
উৎস চুপ করে রইলো দৃষ্টি নত করে। কিয়ৎক্ষণ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর উৎস ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো। স্নিগ্ধার মুখশ্রী পানে তাকালো। ধীর কণ্ঠস্বরে বলে উঠলো,,
“তুমি যেহেতু আমার ভালোবাসা সেহেতু তোমার সবটা জানার অধিকার আছে। (লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে) ইলা হচ্ছে আমার বোন।”(ধীর কণ্ঠে)
স্নিগ্ধা কিঞ্চিৎ চোখ বড় বড় করে তাকালো উৎসের দিকে। অবাক স্বরে বলে উঠলো,,
“ইলাদি আপনার বোন মানে! কিভাবে সম্ভব!”(অবাক স্বরে)
উৎস আবারো দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মৃদু স্বরে বললো,,
“আমার মা আর বাবার লাভ ম্যারেজ হয়েছিল। মায়ের পৃথিবীতে আপন বলতে কেউ ছিলোনা। মা বাবাকে অনেক ভালোবেসেছিলো এবং এখনো বাসে আই থিঙ্ক। আমার যখন ছয় বছর বয়স তখন বাবা অন্য এক মহিলার জন্য আমাকে আর মাকে ছেড়ে চলে যায়। বাবা আর সেই মহিলার মেয়ে হচ্ছে ইলা। সম্পর্কে তো বোনই হয়, সৎ বোন। দীর্ঘ পঁচিশ বছর পর ওনার সাথে তিনমাস আগে আমার দেখা হয়েছে। ওনার হার্ট প্রব্লেম ছিল, সার্জারিটা আমি করেছিলাম।”(মৃদু স্বরে)
স্নিগ্ধা অবাক চোখে উৎসের দিকে তাকিয়ে আছে। উৎসের দৃষ্টি এখন জ্বলন্ত মোমের দিকে। অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠলো,,
“ইলাদির বাবা আপনারও বাবা!”(অস্পষ্ট স্বরে)
উৎস তাচ্ছিল্যর হাসলো, বললো,,
“যেই বাবা নিজের ছয় বছরের ছেলে ও স্ত্রীকে ফেলে অন্য মহিলার হাত ধরে ছেড়ে চলে যায়। সে বাবা হওয়ার যোগ্য নয়, আমি ওনাকে মনে প্রাণে ঘৃণা করি, বাবা হিসেবে মানিনা।”(তাচ্ছিল্যর হেসে)
উৎস আর বসে থাকলোনা। উঠে দাঁড়িয়ে স্নিগ্ধার হাত ধরে স্নিগ্ধাকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে যেতে লাগলো। স্নিগ্ধা অবাক চোখে উৎসের দিকে চেয়ে রইলো।
বাড়ির ভেতরে কাঙ্খিত কক্ষের সামনে এসে দাঁড়ালো উৎস। পেছন ফিরে স্নিগ্ধাকে উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,,
“তোমার রুম, এখানেই থাকবে আজকে থেকে।”
উৎস পাশের রুমে চলে গেলো, স্নিগ্ধা তখনো ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। বেয়াদব, অসভ্য, চরিত্রহীনের পাশাপাশি লোকটা অদ্ভুত! ভাবতে ভাবতে স্নিগ্ধা ঘরে প্রবেশ করলো।
রাত প্রায় তিনটার কাছাকাছি,,
আদিত নির্ঘুম, স্নিগ্ধা কোথায় আছে, কোন অবস্থায় আছে ভেবে ভেবে অস্থির হচ্ছে আদিত। রুমে জ্ব’লন্ত লাইটের আলো বি’ষের মতো ঠেকছে আদিতের কাছে। রুমের দরজায় ঠক ঠক আওয়াজে, দরজার দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো আদিত। দরজা খুলে দেখলো কল্যাণী দাঁড়িয়ে আছে।
“এখনো ঘুমাসনি কেনো?”
“স্নিগ্ধা কোথাও নেই, কোথাও খুঁজেও পাইনি! এই অবস্থায় আমি ভাই হয়ে কিভাবে ঘুমাবো মা?”
“অহেতুক অস্থির হচ্ছিস। উৎস চৌধুরীর উপর আমার ভরসা আছে। স্নিগ্ধার কোনো ক্ষতি হবেনা। ভাবছি কি জানিস?”(মৃদু স্বরে)
“কিভাবে ভরসা করছো ওই অসভ্য লোকটাকে! ওর সাহস হয় কি করে আমার বোনকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার! একবার শুধু পেয়ে নেই, ওর খবর করে ছাড়বো।”(রাগান্নিত কণ্ঠ স্বরে)
“অযথা রাগ করিস না, আমি যখন বলছি উৎস চৌধুরী স্নিগ্ধার ক্ষতি করবেনা মানে করবেনা। এটা নিয়ে ভাবিস না, মনে করে নে স্নিগ্ধা প্রাণবন্ত হওয়ার জন্য একটা ট্যুরে গিয়েছে। এখন আমার ভাবনার কথা শুন। কালকে ইলার পরিবারকে ডিনারে ইনভাইট করবো তোর আর ইলার বিয়ের কথা বলতে।”(এক নিঃশ্বাসে)
কল্যাণী এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে হাঁপাচ্ছেন। আদিত নির্ভীক হয়ে চেয়ে আছে কল্যাণীর দিকে। বিছানার পাশে থাকা টেবিল থেকে গ্লাস ভর্তি জল নিয়ে কল্যাণীর সামনে ধরলো আদিত। কল্যাণী পানিটুকু জল খেয়ে তাকালো আদিতের দিকে। আদিত নির্লিপ্ত ভাবে গ্লাস হাতে নিয়ে পুনরায় টেবিলে রেখে দিয়ে মায়ের মুখশ্রী পানে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলে উঠলো,,
“বিয়ের কথা না তুললেই কি নয়? আমি ইলাকে আমার সাথে জড়াতে চাইনা।”(মৃদু স্বরে)
কল্যাণী তির্যক ভাবে তাকালেন আদিতের দিকে। মুখশ্রী খানিকটা কঠোর করে বলে উঠলেন,,
“সবটা মজা পেয়েছো? মেয়েটাকে ভালোবাসার, একসাথে থাকার স্বপ্ন দেখিয়েছো। মেয়েটা তোমায় অসম্ভব ভালোবাসে, এতো যে অপমান করো তবুও তুমি তুমিই করে। এখন তুমি ওকে ভালোবাসোনা, বিয়ে করতে চাওনা বলে মেয়েটার মন বিষিয়ে তুলনা। আমি স্পষ্ট কথা ইলার সাথেই তোমার বিয়ে হবে, কালকে আমরা এটা নিয়ে দুই পরিবার ডিসকাস করবো। তোমার মতামত আর গ্রহণযোগ্য নয়, আমি যা বলবো তাই হবে।”(কঠোর কণ্ঠস্বরে)
কল্যাণী আর দাঁড়ালেন না, হনহন করে বেরিয়ে গেলেন। আদিত মনে মনে হাসলো, যেখানে জীবনের নিশ্চয়তা নেই সেখানে নিষ্পাপ একজনকে নিজের সাথে জড়িয়ে তাকেও অনিশ্চিততায় ভোগান্তি করাতে আদিত অনিচ্ছুক, ভীষণ ভাবে অনিচ্ছুক। এতো অনিচ্ছুকতার মাঝে আদিত চায়, ইলাকে ভীষণ চায়। কিন্তু ঐযে অনিশ্চিত জীবন। দীর্ঘশ্বাস ফেললো আদিত, মাথা প্রচুর যন্ত্রনা করছে।
প্রথমত স্নিগ্ধাকে কি’ড’ন্যা’প করে নিয়ে গেছে উৎস চৌধুরী। দ্বিতীয়ত, যেই প্রফেশনটা আদিত নিজ ইচ্ছায় বিষন্নতায় আপন করে নিয়েছিল, এরপর হুট্ করেই নিজ ইচ্ছাটা ছেড়ে দিয়েছিলো সেই প্রফেশন আবার ফিরে আসতে চাইছে। পরিচয় গোপন রেখে প্রফেশনটা পালন করলেও তার পরিচয় লিক হয়ে গেছে এমন একটা দলের কাছে যাদের লিডারকে টাকার বিনিময়ে মা’র্ডার করেছিল আদিত। এসজে(দলের নাম) আদিতকে খুঁজতে খুঁজতে তারা বিপুল রায় অব্দি পৌঁছে গেছে, বিপুল রায়কে গার্ড দেওয়া সকল বডিগার্ডকে খু’ন করে বিপুল রায়কে কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছে এসজে গ্রুপের সদস্যরা।
রাত দুটোর দিকে তার ফোনে একটা মেইল আসে, সে সাথে একটা ভিডিও। ভিডিও ওপেন করে আদিত থ হয়েছিল। বিপুল রায়কে র’ক্তা’ক্ত অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছে। ওনার বুঁকের উপর পা দিয়ে এসজে গ্রুপের বর্তমান লিডার বিশ্রী কয়েকটা গালি দিয়ে আদিতকে হুমকি দিয়েছে, যদি সে তাদের কাছে আত্মসমর্পন না করে তাহলে বিপুল রায়ের এমন অবস্থা করবে আদিত ভাবতেও পারবেনা।
আর ভাবতে পারলোনা আদিত, চুল খামচে বিছানায় বসে রইলো। মাথায় তীব্র যন্ত্রনা করছে আদিতের। সে তো সবটা ছেড়ে দিয়েছে তবে এখন এই ঝামেলা কেনো হচ্ছে! হাস্যকর লাগলেও আদিতের মনে একটা কথাই ঘুরছে, “পাপ তার বাপকেও ছাড়েনা।”
“জান..”
শুভসকাল, শুভ দিয়ে সকাল শুরু হয়েছে মানে দিনটা প্রচুর ভালো কাটবে তোমার। শুধু আজকের সকাল আর দিনটা কেনো প্রতিটা দিন, প্রতিটা সকাল তোমার শুভ হোক সেই কামনাই করি। কথাগুলো তোমায় সামনাসামনি বলতে পারতাম তবে বলিনি কেনো জানো? আজকে সেপ্টেম্বর মাসের সূচনা, আজকে নাকি বিশ্ব চিঠি দিবস। ভাবলাম তোমায় চিঠি দেওয়া যাক। চিঠিতে প্রেম জমে বেশি। অন্যরকম অনুভূতি অনুভূত হয়। সে যাই হোক, পাশে ব্রেকফাস্ট রাখা আছে খেয়ে নাও এবং ঘুরতে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে নিচে আসো। চিঠিদিবস একটু অন্যরকম ভাবে উপভোগ করবো এবং তোমায় আজ খুশি করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো। তৈরী হয়ে নিচে আসো, ভালোবাসিইই।”
নীরদ ক্লেশের অন্ত পর্ব ২১
ইতি..
স্নিগ্ধার উৎস।
নির্লিপ্ত ভাবে চিঠির কথাগুলো মনে মনে আওড়ালো স্নিগ্ধা। শেষে স্নিগ্ধার চোখ আটকে গেলো “ভালোবাসিইই” শব্দটাতে।