নীল চিরকুট পর্ব ৩+৪

নীল চিরকুট পর্ব ৩+৪
নৌশিন আহমেদ রোদেলা

‘ না। আপাতত বহিষ্কার করা হচ্ছে না। তবে আপনার এই ভয়াবহ অপরাধের জন্য আপনাকে ভয়ানক এক শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। তুমিময় শাস্তি। এই শাস্তিতে আপনি টাপনি নিষিদ্ধ নগরীর শব্দ। পত্রমিতাকে কেউ কখনো “আপনি” বলে সম্বোধন করেছে শুনেছেন কখনো? আচ্ছা? আপনাকে কি এখন বন্ধু বলে সম্বোধন করা যায়? অনেকটা আগের যুগের পত্রমিতার মতো?

ছোটবেলায় দাদির কাছে পত্রমিতাকে ঘিরে অজস্র গল্প শুনেছি। আমার দাদাভাই আর দাদির সম্পর্কটা হয়েছিল মূলত চিঠি-পত্রকে কেন্দ্র করে। দাদি যখন পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে তখন “পত্রমিতালী” বলে একটা সংখ্যা ছিল। একদিন দাদির সই দুষ্টুমি করে সেই পত্রমিতালীতে দাদির নাম ঠিকানা দিয়ে দিল। কিন্তু সপ্তাহব্যাপী কোনো চিঠিপত্র এলো না। সেখান থেকে চিঠি না এলেও চিঠি এলো অন্য একটা ঠিকানা থেকে। দাদুর ভাষ্যমতে সেটা ছিল দাদাভাই কতৃক ভুল ঠিকানায় চিঠি। ভুল চিঠিতে কিন্তু কোনো রোমান্টিসিজম ছিল না। চিঠিটা ছিল দাদাভাইয়ের দূর সম্পর্কের আত্মীয় মারা যাওয়ার দুঃসংবাদ বহন করা দুঃখী দুঃখী চিঠি। আমার দাদি ছিল অল্পবয়স্কা আবেগী মেয়ে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

দাদাভাইয়ের দুঃখে সে এমনই ব্যথিত হলো যে, দাদাভাইয়ের ঠিকানায় আবেগমাখা সান্ত্বনাপত্র পাঠিয়ে দিল। তারপরই শুরু হলো চিঠিচালান ভালোবাসা। প্রায় একবছর পর, দাদাভাই ঢাকা থেকে রাজশাহী দাদুর বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালেন। সেই বিয়েতে ওকালতি করার জন্য নাকি ঘটককে বিস্তর টাকা খাইয়েছিলেন দাদাভাই। আপনি ভাবতে পারছেন? সেই এতো এতো বছর আগে চুপি চুপি প্রেম করে বিয়ে করে ফেললেন তাঁরা। কেউ সেই প্রেমের খবর জানল না। বুঝল না। ব্যাপারটা মজার না? আমি রং-নাম্বারে প্রেমের গল্প শুনেছি কিন্তু এভাবে চিঠি প্রেমের গল্প একদম নতুন। আচ্ছা? তাদের প্রেমটাকে কী নাম দেওয়া যায়, বলুন তো? রং-নাম্বারের সাথে মিলিয়ে রং-লেটার?
বিঃদ্রঃ আপনি কিন্তু এবারও ইতিতে কিছু লেখেন নি। এবার আমি আপনাকে কী বলে সম্বোধন করি বলুন তো?
ইতি
শ্যামলতা ‘

চিঠিটা লিখে বার কয়েক চোখ বুলাল নম্রতা। তারপর কম্পিত হৃদয়ে চিঠিটা রেখে দিল নির্দিষ্ট বইয়ের মলাটের নিচে। বাকিটা সময় সেই অপরিচিত ‘সে’ এর থেকে পাওয়া দুই লাইনের চিঠিটা হাতে নিয়ে থম মেরে বসে রইলো। নোট বুক আর এসাইনমেন্টের পাতাগুলো ফ্যানের কৃত্রিম বাতাসে চঞ্চল হয়ে উঠল। নম্রতার খুশির জোয়ার যেন তাদের মাঝে প্রাণ দিল। বাতাসের ঝাপটায় উলোটপালোট হতে লাগল পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা। আনমনা নম্রতার কাছে বইয়ের পাতার উড়োউড়োর শব্দটাকে হঠাৎ-ই ভীষণ মাদকীয় বলে বোধ হতে লাগল। সেই সাথে মাথায় উঁকি দিয়ে গেল অদ্ভুত এক প্রশ্ন, ‘ আচ্ছা? পত্রমিতার ‘সে’ নামক লোকটা যদি টাক পড়া বৃদ্ধ কোন লোক হয়, তবে? বা রাস্তার কোনো ছাইপাঁশ বেয়াদব ছেলে?’ মস্তিষ্কের করা যুক্তিসংগত প্রশ্নটা মনের কাছে খুব একটা পাত্তা পেলো না। সেই অপরিচিত মানুষটি যেমনই হোক সে যে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন মানুষ তা বেশ বুঝতে পারছে নম্রতা। লাইনের ভাঁজে ভাঁজেই ফুটে উঠছে লোকটির প্রগাঢ় ব্যক্তিত্ববোধ। এটা কি শুধুই নম্রতার ভ্রান্ত ধারণা? হলে হোক। এই ভ্রান্ত ধারণা মেনে নিতেই যেহেতু ভালো লাগছে তাহলে এই ভ্রান্ত ধারণাতে কোনো সমস্যা নেই। মানুষের ছোট্ট জীবনটাতে কিছু কিছু ভ্রান্ত ধারণা থাকলে ক্ষতি নেই। ভ্রান্ত ধারণাকে বুকে আগলে ধরে খানিকটা খুশি আর খানিকটা স্বপ্ন দেখাতেও ক্ষতি নেই।

পত্রপ্রণয়ের তৃতীয় চিঠিটা এবার দু’সপ্তাহের মাথাতেও হাতে পেলো না নম্রতা। প্রতিদিন কলেজ শেষে গ্রন্থগারের পরিচিত বইটিতে ডুব দিয়ে ব্যর্থ হয়েও খুব একটা মন খারাপ হলো না নম্রতার। বরং তার উচ্ছল প্রাণে জোয়ার এলো। ফুলে ফেঁপে উঠলো হাসি-তামাশাময় জীবন। অবসরে চিঠির জবাবে অপরিচিত ব্যক্তিটি কী কী লিখতে পারে সেই ভাবনায় আকন্ঠ ডুবে রইলো। সবাইকে অবাক করে দিয়ে কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে চমৎকার এক রবীন্দ্র সংগীতও গেয়ে ফেলল নম্রতা। বিস্ময়কর ভাবে পুরষ্কার হিসেবে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘দূরবীন’ বইটাও হাতে পেয়ে গেল। আহ! সেদিন নম্রতার কি আনন্দ। অল্পতে খুশি হয়ে যাওয়া নম্রতা সেদিন বান্ধবীদের পেছনে বিস্তর টাকা উড়াল। এক মাসের হাত খরচ আর জমানো টাকাগুলো শেষ করে মনের সুখে গান ধরল,

‘ তুমি একটু কেবল বসতে দিয়ো কাছে
আমায় শুধু ক্ষণেক–তরে।
আজি হাতে আমার যা–কিছু কাজ আছে
আমি সাঙ্গ করব পরে।
না চাহিলে তোমার মুখপানে
হৃদয় আমার বিরাম নাহি জানে,
কাজের মাঝে ঘুরে বেড়াই যত
ফিরি কূলহারা সাগরে॥’

এই গানটা সেদিন ওই টাইম-টেবিলহীন অপরিচিত ব্যক্তিটিকে ভেবে গেয়েছিল নম্রতা। নীরার ভাষায়, সেই গানের মতো আবেগময় গান নাকি পৃথিবীতে দ্বিতীয়জন গাইতে পারে নাই। কথাটা শুনে প্রচুর হেসেছিল নম্রতা। তার দামফাটা, প্রাণখোলা হাসির মাঝেও সেই লোকটির ভাবনা উঁকি দিয়ে গেল মাথায়। পত্রপ্রণয়ের তৃতীয় চিঠিটা এলো ঠিক ষোল দিনের মাথায়। এবারও সম্বোধনহীন গুটি গুটি অক্ষরে লেখা চিঠি। কিন্তু এবার আর সাদা নয় গাঢ় নীল রঙা পাতার মাঝ বরাবর দুই থেকে তিন লাইনের ছোট্ট এক চিঠি। নম্রতা ভেবে পায় না এই লোক এতো ছোট চিঠি লিখে কিভাবে? এর মাথায় কি এতো এতো কথা কিলবিল করে না? এই লোকটা কি স্বল্পভাষী? উহু, নম্রতা তো তাকে কথা বলতে দেখেনি। শুধু লিখতে দেখেছে। তাই লোকটিকে স্বল্পভাষী বলা যায় না। লেখার সাথে মিলিয়ে স্বল্পলেখ্য বলা যায়। নম্রতা আবারও চিঠির ওপর ঝুঁকে পড়ল। দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে গালের সাথে চেপে ধরে সুখী সুখী দৃষ্টিতে তাকাল। খোলা চুলগুলো ফ্যানের বাতাসে উড়ে এসে আছড়ে পড়তে লাগল চিঠিতে। দুই-তিন লাইনের চিঠিটাই আনমনা হয়ে পড়তে লাগল নম্রতা।

‘ “রং-লেটার লাভ স্টোরি! বাহ! ইন্টারেস্টিং তো। কিছু কিছু সম্পর্ক সম্বোধনহীন হলে মন্দ হয় না শ্যামলতা। আপনার-আমার সম্পর্কটা না-হয় সম্বোধনহীনই হোক। আর হ্যাঁ, আপনার দেওয়া শাস্তিটা আমি মাথা পেতে নিলাম। কোনো একদিন প্রয়োজন হলে সে শাস্তির সত্যিকার প্রতিফলন ঘটাব। তুমিময় শাস্তির আগে চিঠিগুলো একবার আপনিময় হোক।’
এটুকু পড়েই খুশিতে ঝুমঝুম করে উঠল নম্রতা। ছোট্ট একটু লেখাতে এতো আকর্ষণ কী করে ঢেলে দেয় এই লোক? লোকটির কাছে কি চিঠি-মাদক ধরনের কিছু আছে? নম্রতা প্রলম্বিত শ্বাস ছাড়ে। সেই পত্রপ্রণয়ের স্বল্পলেখ্য মানুষটি যে মনে করে সাদার বদলে নীল কাগজে চিঠি লিখেছে তাতেই নম্রতার খুশি যেন আর ধরে না। তারমানে, লোকটিও সময় করে তার মতোই চিঠিগুলোর কথা ভাবছে? ইশ! বেঁচে থাকা এতো আনন্দের কেন? অপেক্ষাগুলো এতো মিষ্টি কেন? আনন্দিত নম্রতা এবার খুশিমনে চিঠি লেখায় মন দিল। নীল কাগজের মসৃণ জমিনে কিশোরী আবেগের ঘটটা যেন উল্টে দিল। এক-দু শব্দ করে লিখে ফেলল দীর্ঘ এক চিঠি,

‘ সম্বোধনহীন চিঠি! বাহ রে! সম্বোধনহীন চিঠি লিখলে কিভাবে বুঝবো আপনার আর আমার সম্পর্কটা ঠিক কেমন? আমরা কি বন্ধু নাকি জীবনপথে হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়া দু’জন আগুন্তকঃ মাত্র?
আচ্ছা? আপনি কখনো জ্যোৎস্না আলোয় স্নান করেছেন? আমি ছেলেবেলায় একটা উপন্যাসে পড়েছিলাম খুবই অদ্ভুত এক ছেলে জ্যোৎস্না রাতে ছাঁদের পাটাতনে লম্বালম্বি শুয়ে জ্যোৎস্না বিলাশ করতো। তার সারা শরীরময় জ্যোৎস্নার মিষ্টি আলো ঝলমল করতো। একদম সিনেমার জ্যোৎস্নার মতো নীল দেখাতো তার গোটা শরীর। মাঝরাতের ঠান্ডা, শান্ত ঝিরিঝিরে বাতাসে কেঁপে উঠতো ছেলেটির উসকোখুসকো চুল। আমারও খুব ইচ্ছে জ্যোৎস্না স্নান করার। কিন্তু আম্মুর জন্য হচ্ছে না। মেয়েদের তো একা একা ছাঁদে থাকা বারণ তাই। আচ্ছা?

আপনারও কি রাতে ছাঁদে উঠা বারন? যদি বারণ না হয় তাহলে একদিন গভীর রাতে জ্যোৎস্না স্নান করবেন। তারপর সেই পূঙ্খানুপুঙ্খ অনুভূতিগুলো আমায় জানাবেন। কি, জানাবেন তো? আমিও অবশ্য জ্যোৎস্না স্নান করব। কিন্তু সে তো অনেক দেরী। জ্যোৎস্না বিলাস সবসময় একা একা করতে হয়। তবে পাশে যদি প্রিয়তম কেউ থাকতে চায় তাহলে অবশ্য দু’জন থাকার নিয়ম আছে। কথায় আছে না? এভ্রিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়ার। কিন্তু দু’য়ের অধিক থাকলে কিছুতেই জ্যোৎস্না বিলাস হয় না। সেটা ইংরেজি কম্পোজিশন ‘দি মুনলিট নাইট’ হয়ে যায়। আমি তো ছাঁদে একা যেতে ভয় পাই তাই বরের জন্য অপেক্ষা করছি। বিয়ের পর বরের সাথে জ্যোৎস্না স্নান করব। সুন্দর টলমলে জ্যোৎস্না থাকবে সেদিন। বিশাল আকাশটিতে থালার মতো হলদেটে এক চাঁদ থাকবে।

আমার গাঁয়ে থাকবে সাদা পাতলা এক শাড়ি। হাত ভরা লাল চুড়ি আর চোখ ভরা মায়াবী ঘন কাজল। ছাঁদের একপাশে একটি বেলীফুলের গাছ লাগাব সেখানে দু-একটা ঝড়া বেলীফুল ঝলমল করে ওঠবে। আমি খোলা লম্বা চুলগুলো ছাঁদের পাটাতনে ছড়িয়ে দিয়ে আকাশ দেখব। ঝিরিঝিরি বাতাসে আমার চুলগুলো উড়বে। বাতাসটা ভরে যাবে বেলীফুলের অদ্ভুত সুন্দর ঘ্রাণে। আমার পাশে শুয়ে থাকা প্রিয়তম হাতে হাত রেখে আবেগভরা কন্ঠে ফিসফিসিয়ে বলবে, ”শুনছো জ্যোৎস্না রাণী? আমি তোমাকে মায়াবী জ্যোৎস্নার মতো ভালোবাসি।” আহা! স্বপ্নটা সুন্দর না?

বিঃদ্রঃ আপনি কি ভূতে ভয় পান? ভয় বাতিক থাকলে আমায় জানাতে পারেন। আমি দারুণ সব সূরা জানি। ওগুলো শুনলে ভূত দৌঁড়ে পালাবে।
ইতি
শ্যামলতা ‘
চিঠিটা লিখে জোরে শ্বাস টানল নম্রতা। কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে চিঠির দিকে তাকিয়ে থেকে ভাবল, এমন সুপ্ত স্বপ্নের কথাগুলো কি এভাবে লিখে ফেলাটা ঠিক হলো? লোকটা আমায় কী ভাববে? পরমুহূর্তেই অস্বস্তিটা উবে গেল নম্রতার। মনে পড়ে গেল চির চিরন্তন বাক্য, একদম অপরিচিত মানুষ ছাড়া মনের সুপ্ত কথা প্রকাশ করে আরাম নেই। অপরিচিত মানুষ থেকে অনুভূতি নিয়ে কাটাছেঁড়ার আঘাত পাওয়ার ভয় নেই। তারা শুধু শুনে, ভাবে তারপর ভুলে যায়। তার পত্রমিতার ‘সে’ ও-তো তার অপরিচিত কেউই। ভীষণ অপরিচিত ‘সে’। তার কাছে অনুভূতি প্রকাশে ভয় নেই। একটুও না।

সন্ধ্যার আযান পড়ছে। দূরে কোথাও সুকরুণ সুরে সৃষ্টিকর্তার গুণব্যঞ্জন করছেন স্রষ্টার প্রেমে কাতর মোয়াজ্জেম। কন্ঠে তার মোলায়েম বিষণ্নতা। রোকেয়া হলে নম্রতার জন্য নির্দিষ্ট ঘরটির সফেদ পর্দাটা হালকা-মৃদু কাঁপছে। ঘরের ভেতর থাকা আলোটা টিম টিম করে জ্বলছে। জানালায় ভর করেছে একঝাঁক ফ্যাকাসে অন্ধকার। নম্রতা সেই বিকেল থেকে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আছে। হাতে পুরোনো, জীর্ণ ডায়েরি। চোখদুটো বোজা। ফ্যানের বাতাসে শুষ্ক চুলগুলো উড়ছে। চোখ বোজে রাখা নম্রতাকে দেখাচ্ছে গ্রীক দেবীদের মতো প্রসন্ন। নির্ভুল সুন্দর। ঠোঁটের কোণায় তৃপ্তির হাসি। নীরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানার পাশে এসে দাঁড়াল। প্রথমে মৃদু স্বরে। তারপর গলার স্বর খানিকটা চড়া করে নম্রতাকে ডাকল,

‘ এই নমু? ঘুমুচ্ছিস নাকি? আজান পড়ছে। বসে বসে কেউ ঘুমায়?’
নম্রতা চোখ মেলে তাকিয়ে স্বচ্ছ হাসল। কেমন সুখী সুখী দেখাল তার চোখ-মুখ। নীরা সন্দিহান কন্ঠে বলল,
‘ ঠিক আছিস?’
নম্রতা জোরালো শ্বাস ফেলে বলল,
‘ অবশ্যই।’
‘ মন ভালো?’
নম্রতা ভ্রু বাঁকিয়ে প্রশ্ন করল,
‘ খারাপ থাকার কথা ছিল নাকি?’
নীরা উত্তর দিল না। এতো বছরের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী এখনই নম্রতার মন ভালো হয়ে যাওয়াটা উচিত কথা নয়। নীরা সন্দিহান কন্ঠে বলল,

‘ টিএসসিতে যাবি? অন্তু,রঞ্জন,ছোঁয়া,নাদিম সবাই আসছে টিএসসিতে। ব্যাপক আড্ডা হবে। চল না যাই।’
নীরা অবাক চোখে তাকাল। দেয়ালে টাঙানো ঘড়িটিতে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল,
‘ পাগল? সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। অলমোস্ট সাতটা বাজে। এখন গেলে ফিরবি কখন? হল সুপার ধরে পেদাবে।’
নীরা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বিছানায় বসল। কুটিল হাসি দিয়ে বলল,
‘ আরে ধুর! ওই মহিলার কী? আমি ম্যানেজ করে নেব। তবুও ঢুকতে না দিলে, আজ রাতটা ছোঁয়াদের বাসায় থাকব। সমস্যা কই?’
নম্রতা ক্লান্ত কন্ঠে বলল,

‘ এতো কাহিনী করার কী দরকার দোস্ত? কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না।’
পরমুহূর্তেই উৎসাহ নিয়ে বলল,
‘তুই কী জানিস? আজকের দিনে ওর থেকে চতুর্থ চিঠিটা পেয়েছিলাম আমি।’
নীরা হতাশ চোখে তাকাল। নম্রতার হাত টেনে ধরে বলল,
‘ অলরেডি তিনবার শুনে ফেলেছি বইন। আর না, প্লিজ। সবাই অপেক্ষা করছে। চল তো।’
নম্রতা উঠে দাঁড়াল। বাসায় পরে থাকা প্লাজুর ওপর স্কার্ট পরে টপস বদলে নিল। চুলগুলো উঁচুতে খোঁপা করে চোখে-মুখে পানি ছিঁটাল। গলায় স্কার্ফ পেঁচিয়ে ব্যাগ হাতে নিতে নিতে বলল,
‘ বড্ড জ্বালাস তুই। চল।’

নীরা ঠোঁটে লিপস্টিক লাগাচ্ছিল। নম্রতাকে ডায়েরিটা ব্যাগে পুড়তে দেখে বিরক্ত কন্ঠে বলল,
‘ সব জায়গায় এই ডায়েরি না নিলে চলে না তোর? মানুষ জামাইরেও এমনে চিপকাই ধইরা থাকে না। আর এটা রেডি হওয়া হইলো? একটু সাজগোজ কর।’
নম্রতা হাসল। নীরার মাথায় চাটি মেরে বলল,
‘ আড্ডা মারতে যাচ্ছি, বিয়ে করতে নয়। আর সেজেগুজে কী হবে? যার জন্য সাজব সে-ই তো হাওয়া। একবার খালি পাই। আমার সাজের ধরন দেখতে দেখতেই মরে যাবে শালা।’
নম্রতা মাথায় চাটি দেওয়ায় লিপস্টিক ল্যাপ্টে গালে গিয়ে লাগল নীরার। নীরা লিপস্টিক হাতে কিছুক্ষণ ক্ষুধার্ত বাঘিনীর মতো বসে রইল। দাঁত কিরমির করে বলল,

‘ আল্লার ওয়াস্তে তোর সেই পত্রমানবকে যদি একবার খুঁজে পাই। কসম, আমি নিজেই খুন করব তারে। ব্যাটার যন্ত্রণায় জীবনটা ত্যানা ত্যানা হয়ে গেল। কত্ত কষ্টে মেকাপ করেছিলাম তোর কোনো ধারণা আছে?’
নম্রতা খিলখিল করে হেসে উঠল। ঘর থেকে বেরুতে বেরুতে বলল,
‘ তুই না সাজলেও অন্তু তোর দিকে হা করে তাকিয়ে থাকবে। আয় জলদি।’
নম্রতার কথাটা কানে যেতেই লজ্জায় লাল হয়ে গেল নীরা। পরমুহূর্তেই তীব্র অস্বস্তি নিয়ে বেরিয়ে গেল। সংকুচিত মনে একটা কথায় ভাবতে লাগল, এই একটা নাম শুনেই এতো লজ্জা কেন পায় সে? অন্তু তো আলাদা কেউ নয়। রঞ্জন আর নাদিমের মতোই খুব কাছের একজন বন্ধু। তবে?
রাত বেশি নয়। মাত্রই সন্ধ্যা নেমেছে আকাশে। কোলাহলে পরিপূর্ণ টিএসসিতে দুটো ব্রেঞ্চ দখল করে বসে আছে অন্তু, রঞ্জন, নাদিম আর নম্রতারা। সবার হাতেই গরম সমুচার প্লেট। ভ্যাপ্সা গরমেও পাশে রাখা ধোঁয়া ওঠা গরম চা। রঞ্জন সমুচায় কামড় দিয়ে গান ধরল,

‘ তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা
মোর জানো না।
তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা। ‘
নাদিম গিটারে টুনটান শব্দ তুলেই মুখ কুঁচকাল। শার্টের কলার ঝেড়ে বলল,
‘ শালার গরমের জ্বালায় বাঁচি না বাল। শইল জ্বইলা যাইতাছে।’
ছোঁয়া কপাল কুঁচকে বলল,
‘ ভাষা ঠিক কর। এসব থার্ডক্লাস শব্দ আমার সামনে বলবি না।’
ছোঁয়ার কথায় আকাশ থেকে পড়ল নাদিম। বলল,
‘ আমি তোর ভাষার কোন বা….’
ছোঁয়া চেঁচিয়ে উঠে বলল,
‘ আবার!’
নাদিম গলা পর্যন্ত উঠে আসা শব্দটা গিলে নিল। মুখ কুঁচকে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বিরবির করে বলল,
‘ তোর প্রফেসার বাপের খাইঁসটে জ্ঞান দেখাস সারাদিন। ভাল্লাগে না বাল। যা কইলাম না।’
ছোঁয়া ফুঁসে ওঠে বলল,

‘ তুই আবার বললি। আর খাইঁসটে কী? ছিঃ বমি আসছে আমার। এতো বাজে কথা বলিস তুই!’
ছোঁয়ার কথায় নাদিমের মাথা ঘুরে যাওয়ার উপক্রম। মানে কী? এই মাইয়া বলে কী? সে কী এমন বলল যার জন্য তাকে বমি করে দিতে হবে? একটা সিম্পল কথা নিয়ে এতো লাফালাফি! কিভাবে পারে এই মেয়ে? এই মেয়েকে তো দিনে রাতে থাপড়ানো উচিত। অসহ্য! অন্তু সমুচায় কামড় দিতে দিতে উদাস কন্ঠে বলল,
‘ ওরে ছাড় তো। রঞ্জন গান ধরবে। তুই সুর তোল। পুরাই ছ্যাকা টাইপ গান , বুঝলি? অর্নাস থার্ড ইয়ারে উঠেও যদি জুনিয়রদের প্রেমলীলা দেখেই বুড়া হতে হয় তাহলে এই জীবন রেখে লাভ কী? এই নমু? তোদের কী একটুও মায়া হয় না? বন্ধু সিঙ্গেল থাকতে থাকতে ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছে। একটা মেয়ে টেয়ে তো খুঁজে দিতে পারিস, নাকি? স্বার্থপর।’

নম্রতা সরু চোখে তাকাল। হাতের কাপটা পাশে রেখে ডান পায়ের জুতোটা খুলে নিয়ে বলল,
‘ জুতো দেখছস? মাইর না খাবার চাইলে স্বার্থপর বলবি না। এই তিন বছরে কম ট্রাই করছি? তোর তো কোনোটাতেই মন ভরে না।’
অন্তু কিছু বলার আগেই লাফিয়ে উঠলো নীরা। আশেপাশে তাকিয়ে কিছু একটা লক্ষ্য করে বলল,
‘ আশেপাশে বহুত মেয়ে আছে দোস্ত। তুই খালি চুজ কর। পটাই দেওয়ার দায়িত্ব আমাগো। যেমনেই হোক পটামু। যা।’

অন্তু আহত দৃষ্টিতে তাকাল। সেই দৃষ্টিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে এদিক-ওদিক থাকা মেয়েদের নিয়ে পর্যালোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল নীরা। অন্তুর চোখে-মুখে ফুটে উঠলো হতাশার ছাপ। ভার্সিটির প্রথম বছর থেকে নীরার প্রতি দুর্বলতা প্রদর্শন করে আসছে অন্তু। সেই দুর্বলতা গত দু’বছরে জীবন-মরণ ভালোবাসায় রূপ নিয়েছে কিন্তু নীরা নারাজ। প্রথম বছরটা নীরাকে উঠতে বসতে প্রোপোজ করেছে অন্তু। নিজের আত্মসম্মানের জলাঞ্জলি দিয়েও নীরাকে ভালোবাসতে বাধ্য করতে পারে নি। শেষমেশ, পরাজিত সৈনিকের মতো জিগ্যেস করেছে, কেন পছন্দ করিস না আমায়? কোনো কারণ তো অবশ্যই আছে। একাধিক কারণও থাকতে পারে। বল শুনি। অন্য কোনো মেয়ে পটানোর আগে দোষগুলো ঠিকঠাক করা যায় কি-না দেখি।’ নীরা হাসিমুখেই উত্তর দিয়েছে, ‘ তুই আমার থেকে চার মাসের ছোট।’ কথাটা শুনে হতভম্ব চোখে তাকিয়ে ছিল অন্তু। নীরা কি তার সাথে মজা করছে? এমন একটা লেইম কারণে বার বার তাকে রিজেক্ট করা হচ্ছে? বিশ্বাস হয় না অন্তুর। নম্রতার গানের সুরে ঘোর কাটল অন্তুর। অতি সন্তপর্ণে তপ্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হাসিমুখে নম্রতার গানের আসরে মন দিল। নম্রতা তখন অন্তরা গাইছে। চোখ বোজে নিবিষ্ট মনে সুর তুলছে,

‘ আমার একলা আকাশ থমকে গেছে রাতের স্রোতে ভেসে,
শুধু তোমায় ভালোবেসে।
আমার দিনগুলো সব রং চিনেছে, তোমার কাছে এসে।
শুধু তোমায় ভালোবেসে।
তুমি চোখ মেললেই ফুল ফুটেছে আমার ছাদে এসে,
ভোরের শিশির খুব ছোঁয়ে যায়,
তোমায় ভালোবেসে।
আমার একলা আকাশ থমকে গেছে রাতের স্রোতে ভেসে,
শুধু তোমায় ভালোবেসে।’
নাদিম আলতো হাতে গিটার বাজাচ্ছে। সবাই নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ। আশেপাশের অনেকেই কান খাঁড়া করে শুনছে নম্রতার কিন্নরকণ্ঠী গান। গান শেষ করে চোখ মেলে তাকাল নম্রতা। দাঁত বের করে হেসে বলল,

‘ যা গাইলাম। এখন হলো?’
কেউ জবাব দিল না। রঞ্জন অদ্ভুত চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
‘ দোস্ত! তুই যে কী পরিমাণ মারাত্মক গাইছিস, বুঝতে পারছিস? এতো আবেগ কোথা থেকে আসে তোর গলায়? এর আগে তো এতোটা আবেগ দিয়ে গাস নি তুই। তবে? নতুন প্রেমে টেমে পড়ছিস নাকি?’
নম্রতা হাসলো। হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করে বলল,
‘ ধুর! আমি আর প্রেম? পুরাতন প্রেমে মজে মজেই শেষ হয়ে যাচ্ছি। আর তুই বলছিস নতুন?’
নাদিম চোখ বড় বড় করে বলল,
‘ পুরাতন প্রেম মানে কী? তুমি মামা ডুবে ডুবে জল খাও? আমাদের বলিস নি পর্যন্ত!’
নীরা সমুচার কোণা চিবোতে চিবোতে বলল,
‘ কেন? ওর ছ্যাঁকা খাওয়া কাহিনি শুনিস নাই? আজকেও তো ওর মন ভালো করতেই আড্ডা বসালি। তবু জানোস না?’
রঞ্জন অধৈর্য্য হয়ে বলল,

‘ ছ্যাঁকা যে খাইছে তা জানি। কিন্তু পুরা কাহিনি জানি না। তোর এতো আবেগের পেছনে যদি ওই একটা মানুষ থাকে। তাহলে আমি ওই মানুষ সম্পর্কে জানতে চাই। শুরুটা কিভাবে? আর শেষটাই বা কী?’
সবাই উৎসাহ নিয়ে নম্রতার দিকে তাকাল। নম্রতা বুক ভরে শ্বাস টেনে নিয়ে বলল,
‘ শুরুটা হয়েছিল চিঠি দিয়ে। পত্রপ্রেম বলতে পারিস।’
অন্তু কপাল কুঁচকে বলল,
‘ কলেজে ক্লাসমেট ছিল তোর? সেইম ইয়ার? বইয়ে বইয়ে পত্র বিনিময় টাইপ কিছু?’
নম্রতা হেসে বলল,
‘ নাহ্।’
ছোঁয়া চশমাটা ঠিক জায়গায় ঠেলে দিয়ে বলল,
‘ হোয়াট ইজ পত্রপ্রেম গাইস?’
নাদিম ফুঁসে ওঠে বলল,

‘ ওই এই ইংরেজের বাচ্চারে চুপ করতে বল। ছোঁইয়ার বাচ্চা। বেশি কথা বললে চড় খাবি। যতটুকু বুঝবি ততটুকু মন দিয়া শোন। কথার মাঝে বাম হাত ঢুকাবি না।’
ছোঁয়া মুখ ফুলিয়ে বলল,
‘ আমার নাম ঠিক করে উচ্চারণ কর। আমার নাম ছুঁইয়া না ছোঁয়া। সুন্দর নাম।’
নাদিম ধারালো গলায় বলল,
‘ ওই তোরে চুপ করতে বলছি না? ছোঁয়া! সুন্দর নাম! এই সুন্দরের কী বুঝোস তুই? তোর নামটা টোটালি ক্ষেত!’
রঞ্জন ওদের থামিয়ে দিয়ে বলল,
‘ চুপ কর তো তোরা। নমুকে বলতে দে। তাহলে শুরুটা কিভাবে? কলেজ সিনিয়র ছিল? বা স্কুল সিনিয়র?’
নাদিম কথা কেড়ে নিয়ে বলল,

‘ বা পাশাপাশি বাড়ি। প্রতিবেশী ভাইয়া ছাইয়া?’
নম্রতা হেসে ফেলে বলল,
‘ ওসব কিছুই না।’
অন্তু অধৈর্য্য হয়ে বলল,
‘ তাহলে দেখলি কেমনে?’
‘ দেখি নি।’
নম্রতার বলা ছোট্ট শব্দটা কানে যেতেই চোখ বড় বড় করে তাকালো সবাই। শুধু নীরা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে চায়ের কাপে চুমুক দিতে লাগল। রঞ্জন কিছুটা ধাতস্থ হয়ে বলল,
‘ দেখিস নি মানে? না দেখে প্রেম হয়?’
‘ হলো তো।’

‘ আমি কিছু বুঝতেছি না। দেখিস নি তাহলে চিঠি পেলি কিভাবে? কাহিনীটা কী? স্পষ্ট কর তো।’
নম্রতা ধীরে ধীরে কাহিনি বর্নণা করতে লাগল। তাদের তৃতীয় চিঠি প্রাপ্তির ঘটনা পর্যন্ত শুনেই আৎকে উঠল রঞ্জন। নাদিম চোখ কপালে তুলে বলল,
‘ এভাবেও প্রেম হয় নাকি? সত্যি ঘটেছে এমনটা?’
রঞ্জন ঘোর লাগা কন্ঠে বলল,
‘ আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না। তারপর কী হলো? ব্যাটার চতুর্থ চিঠি কবে পেলি হাতে?’
নম্রতা হালকা হেসে আকাশের দিকে তাকাল। ব্যাগ থেকে ডায়েরিটা বের করে আঠায় লাগানো চতুর্থ চিঠির পৃষ্ঠাটা বের করল। বন্ধুদের দিকে এগিয়ে দিয়ে আবারও অতীতে ডুবলো।

নম্রতার হাতে যখন চতুর্থ চিঠিটা এলো তখন কলেজে গ্রীষ্মের ছুটি। বাসা থেকে বেরুনো একেবারেই নিষেধ। টিউশনিগুলোতেও সাময়িক ছুটি জারি করেছেন স্যারেরা। বাইরে বের হওয়ার অজুহাতের ঘট ফাঁকা। নম্রতা দিন-রাত ভূতের মতো পায়চারি করে আর ভাবে, কলেজগুলো এভাবে বন্ধ রাখার মানে কী? বছরে হাফ সময় যদি গ্রীষ্মের ছুটিই থাকে তাহলে পড়াশোনাটা হবে কখন? নাহ্ সরকারি কলেজের এহেন দূর্দশা আর মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। গভীর রাতে বাবাকে ডেকে তুলে বা নীরাকে ফোন দিয়ে উঠিয়ে গম্ভীর কন্ঠে আলোচনা করে নম্রতা, ‘এইযে এতো টাকা দিয়ে টিউশনি করছি। লাভটা কী হচ্ছে? বছরের বেশির ভাগ সময় তো স্যারেরা গ্রীষ্মের ছুটিই কাটিয়ে ফেলছেন। গরম তো বাসায় বসে থাকলেও করবে শশুর বাড়ি বেড়াতে গেলেও করবে। গরম হাওয়া খাওয়ার জন্য অন্যের টাকা মেরে স্যারদের শশুরবাড়ি বসে থাকার মানে কী?

আমাদের বাপের টাকা কী নদীতে ভেসে এসেছে? আসে নি। তাহলে এতোকিছু সহ্য করা কেন? টাকা দিয়ে যেহেতু পড়ছি আমাদের উচিত প্রটেস্ট করা। হ্যাঁ কি না?’ নীরা আর নম্রতার বাবা ঘুমে ঝিমুতে ঝিমুতে বলেন, ‘হ্যাঁ। অবশ্যই। লেটস প্রোটেস্ট।’ এভাবে প্রায় এক সপ্তাহ কাটিয়ে দেওয়ার পর ফট করেই একটা অজুহাত পেয়ে গেল নম্রতা। মাকে গিয়ে রঙিয়ে চঙিয়ে মিথ্যে বলে চলে গেল শাহাবাগ। দু’তলার নির্দিষ্ট বইটির মাঝে কাঙ্ক্ষিত চিঠিটাও পেয়ে গেল। নম্রতা উত্তেজনায় ছটফট করে চেয়ারে গিয়ে বসল। গুটি গুটি অক্ষরে লেখা চিঠিটির দিকে তাকিয়ে দম বন্ধ হয়ে এলো। চিঠির এক জায়গায় চোখদুটো আঠার মতো আটকে রইলো। চিঠিতে লেখা,

‘ আপনার স্বপ্নটা খুব সুন্দর শ্যামলতা। আমার কাছে জ্যোৎস্না বিলাস, বৃষ্টি বিলাস বড্ড ছেলেমানুষী বলে মনে হয়। কারণহীন, অকারণ বলে মনে হয়। কিন্তু আপনার বর্ণনা আর উৎসাহ দেখে কোনো এক জ্যোৎস্না রাতে ছাঁদে গিয়ে দাঁড়াতে ইচ্ছে করছে। কাকতালীয়ভাবে আমাদের ছাঁদের কিনারায় একটি বকুল গাছ আছে। বকুলের সাথে আরো কিছু ফুল গাছ আছে। সবই আমার ছোটবোন নিদ্রার লাগানো। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো সেই ফুলগুলোর ঘ্রাণ আমার ঘর পর্যন্ত এলেও কখনো খেয়াল করা হয় নি। আপনার চিঠি পড়ার পর খেয়াল করলাম। আর সম্বোধনের কথা বলছিলেন। সম্বোধন কী কখনো সম্পর্কের নাম হয় শ্যামলতা? আমার তো মনে হয় না। মানুষ মাত্রই তো আগুন্তকঃ। জীবনপথে প্রত্যেকেই ক্লান্ত, অপরিচিত পথিক। তুমি আমিও এর ব্যতিক্রম নই।
বিঃদ্রঃ আমি ভূতে ভয় করি না। যে জিনিসের অস্তিত্ব নেই তাতে ভয় কিসের? আর আপনি অতো সূরা জানলে রাতের ছাঁদে আপনারই বা অতো ভয় কিসের ম্যাডাম?’

নম্রতা চিঠিটা বেশ কয়েকবার পড়ল। তার লেখা ‘তুমি’ শব্দটাই বুক জুড়ে খুশির জোয়ার বয়ে গেল। কেন জানি ওই ‘তুমি’ শব্দটুকুই নম্রতার ভীষণ ভালো লাগতে লাগল। নম্রতার খুশি অবশ্য বেশিক্ষণ টিকল না। নম্রতার বলা মিথ্যে নিয়ে বাড়িতে বিরাট দূর্দশা লেগে গেল। নম্রতা মাকে চুপিসারে বলেছিল,
‘ নীরাকে দেখতে এসেছে মা। আমি ওর বেস্টফ্রেন্ড হয়ে যদি না যাই। তাহলে ব্যাপারটা কেমন হয়ে যায় না?’
নম্রতার মা উৎসাহ নিয়ে জিগ্যেস করেছিলেন,
‘ছেলে কী করে?’
নম্রতা ফট করেই বলে ফেলেছিল,
‘এইতো জেলা জাজ।’

নম্রতার বলা এই কথাটাই যেন কাল হলো। নম্রতার মায়ের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। নীরার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে জেলা জাজের সাথে? এতোবড় খবর কী চুপিসারে রাখা যায়? নম্রতা বেরিয়ে যেতেই পাশের বিল্ডিং-এ থাকা নীরার খালার কাছে কথা চালান করলেন নম্রতার মা। ভীষণ বিনয়ী আর আনন্দিত কন্ঠে জিগ্যেস করলেন,
‘ আপা? নীরার নাকি জেলা জাজের সাথে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। মাশাআল্লাহ। শুনে ভীষণ ভালো লেগেছে।’

নীল চিরকুট পর্ব ১+২

নম্রতার মায়ের কথায় নীরার খালার মাথাতেও আকাশ ভেঙে পড়লো। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিলের মতো ছোট্ট ঘটনাটা তালের মতো বৃহৎ আকার ধারণ করলো। নীরা আর নীরার মা ঘটনা শুনে হতভম্ব চোখে-মুখে বসে রইলেন। নম্রতার মিথ্যেটা খুবই ভয়ানকভাবে ধরা পড়ে গেল। এটুকু শুনে হু হা করে হেসে উঠল নম্রতার বন্ধুরা। রঞ্জন বলল,
‘ তুই তো সেইরকম বলদ ছিলি ছোটবেলায়। তারপর কী হয়েছিল? কেমন বাঁশ খেয়েছিলি? চিঠিপ্রেমের কাহিনী ফাঁস হয়ে গিয়েছিল নাকি তখন?’

নীল চিরকুট পর্ব ৫+৬

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here