নীল চিরকুট পর্ব ৩৭+৩৮
নৌশিন আহমেদ রোদেলা
সকালে খাবার টেবিলে বসেই অপ্রত্যাশিত এক খবর কানে এলো অন্তুর। আনিসুল সাহেব যখন জানালেন, ‘ নীরা বিয়েতে রাজি হয়েছে’ তখন কয়েক সেকেন্ডের জন্য বোবা বনে গেল সে। কানদুটো ঝা ঝা করে উঠল। ‘নীরা রাজি হয়ে গিয়েছে’ এই ছোট্ট খবরটা মস্তিষ্কের নিউরনগুলোতে বিষের মতো ঠেকল। এই একই খবর তিন-চারদিন আগে পেলেও খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়ত অন্তু। কিন্তু আজ এই খুশিই তার কাছে ভারী এক বোঝা বলে মনে হলো। নীরাকে সে চাইত, এখন আর চায় না। কিন্তু ভাগ্যের গুঁটি ভিন্ন।
সেই সাথে ভিন্ন তার চাওয়া-পাওয়ার হিসেব। নীরাকে সে বাস্তবিকই ভালোবাসে। কিন্তু সেই ভালোবাসার নির্যাসটা আজ বিদঘুটে, বিষাক্ত। নীরাকে কাছে পেতে চাওয়া মনটা এখন আর নেই। হাজারও ঘাত-প্রতিঘাতে পঁচে গলে গিয়েছে সেই কবেই। অন্তু এখন একটু শান্তি চায়। নিজেকে একটু গুছাতে চায়। কিন্তু তার এই ক্লান্ত জীবনে নীরা নামক মানবীকে আর চায় না। এই এক নীরাকে নিয়ে এতো জল ঘোলা হয়েছে যে সেই জলে নিজেদের হাসিখুশি চেহারা দেখার উপায় নেই। দুইজনের সম্পর্কটাও তো আগের মতো মসৃণ নেই। ভালোবাসা নামক পাটাতনে অপমান, অস্বস্তি, ক্ষোভ, রাগ, জেদ এতো বেশি জমে গিয়েছে যে সেই পটাতন ধোঁয়ে মুছে মসৃণ করার সাধ্য একা অন্তুর নেই। সেই চেষ্টাটাও সে করতে চায় না। তার শুধু মুক্তি চাই। মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিতে চায়।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
অন্তু নিজের সিদ্ধান্ত জানানোর আগেই খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে গেলেন আনিসুল সাহেব। অন্তুর আর খাওয়া হলো না। মাথায় এক ঝাঁক চিন্তা নিয়ে খাবারের প্লেট ঠেলে উঠে এলো ঘরে। বিছানায় মাথা চেপে ধরে বসে থাকতে থাকতে নীরার চিন্তাটাও মস্তিষ্কে খেলে গেল তার। অন্তু বিয়েটা নাকজ করে দিলে বেচারী নীরাকে আবারও একবার ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে আগুনে । যে মেয়ের বার বার বিয়ে ভেঙে যায় সেই মেয়ের চরিত্র নিয়ে নানান কথা তো উঠবেই। অন্তুর মুখটা বিরক্তিতে তেতো হয়ে উঠে।
সামনে থাকা চেয়ারটায় জোরে লাথি দিয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। কাঠের চেয়ার মুখ থুবড়ে পড়ে ফ্লোরে। অন্তুর রাগ কমে না। এই দমবন্ধ জীবন আর ভালো লাগে না। এতোকিছুর পর ভোঁতা হয়ে যাওয়া অনুভূতি নিয়ে নীরাকে কাছে টানা সম্ভব নয়। বিয়ে করে তাকে আগের মতো সুখী করার চেষ্টাও এখন প্রায় অসম্ভব। অন্যদিকে এই বিশ্রী সমাজে মেয়েটাকে একা ছেড়ে দেওয়াও কোনো পুরুষোচিত কাজ নয়। অন্তুর মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠে। এই মানসিক চাপের মুখে নাদিমের সাথে দূরত্ব মেটানোর ব্যাপারটা সে বেমালুম ভুলে যায়। খাওয়া শেষেই নাদিমের হলে হানা দেওয়ার সিদ্ধান্তটা হাজারও চিন্তার ভাঁজে চাপা পড়ে। সব ঠিক হতে হতেও এলোমেলো হয়ে যায় সব!
“যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে
আমি বাইব না
আমি বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে গো
যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে”
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে রবি ঠাকুরের গানটি শুনতে শুনতেই ঘুম ভাঙল নম্রতার। সকালের আলো তখন আছড়ে পড়ছে বারান্দায়। স্বচ্ছ কাঁচের জানালায় ঝিলিক দিয়ে উঠছে ভোরের প্রথম কিরণ। নম্রতা আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল। মোবাইল হাতে সময়টা দেখে নিয়ে অলস ভঙ্গিতে বিছানা ছাড়ল। দুইদিন হলো হল ছেড়ে বাড়ি এসেছে নম্রতা। গত দুইদিন যাবৎ এই একই গানে ঘুম ভাঙছে তার।
নম্রতা জানে আগামী দুইদিনও এই একই গানে ঘুম ভাঙবে তার। নম্রতার ব্যারেস্টার বাবা সব কাজেই বিশেষ কিছু প্যাটার্ন মেনে চলেন। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে গান শোনার মাঝেও তার অদ্ভুত এক প্যাটার্ন আছে। নম্রতা ঘুমু ঘুমু চোখে বাড়ির টানা বারান্দায় এসে দাঁড়াল। ব্যারেস্টার নুরুল মাহমুদ কাঠের চেয়ারে বসে পত্রিকা পড়ছেন। চোখে ভারী চশমা। ঠোঁটদুটো গানের তালে তালে মৃদু নড়ছে। চেয়ারের পাশে ছোট্ট টেবিলে রাখা পুরোনো ক্যাসেট থেকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গাইছেন, ‘চুকিয়ে দেব বেচা কেনা মিটিয়ে দেব গো, মিটিয়ে দেব …. ‘ নম্রতা এলোমেলো চুলগুলোকে হাত খোপা করতে করতে বলল,
‘ শুভ সকাল বাবা।’
নুরুল সাহেব মুখ তুলে চাইলেন। আজ তাঁর মন ফুরফুরে। মেয়েকে দেখেই মনের ফুরফুরে ভাবটা ঠোঁটের কোণে ধরা পড়ল। মুখভর্তি হাসি নিয়ে বললেন,
‘ শুভ সকাল মা। আয় বোস। চা খাবি?’
নম্রতা অলস পায়ে বাবার কাছে গিয়ে বসল। বাবার গায়ে শরীর এলিয়ে দিয়ে বলল,
‘ উহু। আমি এখনও ফ্রেশ হইনি৷ তোমার মনটা কী আজ খুব ভালো বাবা?’
‘ অবশ্যই। এই চমৎকার দিনে সবারই মন ভালো থাকা উচিত।’
নম্রতা হাসল। সোজা হয়ে বসে বাবার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল,
‘ তুমি আজও মাকে ফাঁকি দিয়ে চায়ে চিনি মিশিয়ে নিয়েছ, বাবা?’
নুরুল সাহেবের চোখদুটো চিকচিক করে উঠল। খুশি হয়ে বললেন,
‘ তোর মা পৃথিবীর সবচেয়ে বোকা মহিলা। এই বোকা মহিলাকে বিয়ে করাটা আমার উচিত হয়নি। আমি যখন ভার্সিটিতে পড়তাম তখন আমার এক বান্ধবী ছিল, রত্না। প্রচন্ড ইন্টেলিজেন্ট একটা মেয়ে। চোখের দিকে তাকিয়েই ফট করে বলে ফেলত, “তুমি মিথ্যে বলছ নুরুল।” ভাবতে পারছিস? আই শ্যুড হ্যাভ মেরি হার।’
নম্রতা হেসে ফেলল। চেয়ারে পা তুলে আরাম করে বসল। পত্রিকার বিনোদনের পৃষ্ঠাটা তুলে নিতে নিতে বলল,
‘ তোমার রত্না নামক ইন্টেলিজেন্ট বান্ধবীর কথা মা শুনে ফেললে কী হবে বাবা?’
নুরুল সাহেব চোখ বড় বড় করে তাকালেন। পত্রিকাটা ভাঁজ করে টেবিলের উপর রেখে চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। ফিসফিস করে বললেন,
‘ তোর মা মারাত্মক মহিলা। রত্নার ব্যাপারটা জানলে সে আমাকে দুই তলা থেকে ফেলে দিতে দ্বিতীয়বার ভাববে না।’
‘ তাহলে বাসায় একটা ইন্সট্যান্ট ডাক্তার দরকার তাই না বাবা? ধরো, মা তোমাকে দুই তলা থেকে ফেলে দিলো আমরা তোমাকে ঘরে এনে নিজস্ব ডাক্তার দিয়েই ফিটফাট করে ফেললাম। এক্সট্রা টাকা খরচ হলো না। অ্যাম্বুলেন্স খরচও মাফ।’
নুরুল সাহেব সরু চোখে তাকালেন। চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বললেন,
‘ তুই কী কোনো ছেলে সম্পর্কে আমায় কনভেন্স করার চেষ্টা করছিস?’
নম্রতা মাথা নেড়ে আবারও বাবার গায়ে গা এলিয়ে দিল। নুরুল সাহেব কুঁচকানো ভ্রু নিয়ে বললেন,
‘ হু ইজ দিস রাস্কেল?’
নম্রতা আহ্লাদী কন্ঠে বলল,
‘ একটা ডাক্তার।’
‘ তোর পত্রপ্রেমিকের কী হলো? গীভ আপ?’
‘ এটাই সেই। পত্রপ্রেমিক থেকে ডাক্তার।’
নুরুল সাহেব চমকে তাকালেন। পরমুহূর্তেই হেসে বললেন,
‘ ব্যাটাকে ধরে ফেলেছিস? গুড জব! গুড জব!’
নুরুল সাহেব আর নম্রতার কথার মাঝেই একরকম উড়ে এলো নন্দিতা। পাশে একটা চেয়ার টেনে বসে হাত-পা ছড়িয়ে দিল সে। ঘুমু ঘুমু কন্ঠে বলল,
‘ ধরে যখন ফেলেছ তখন চট করে বিয়ে করে ফেলো না বাপু। তোমার জন্য আমার বিয়ে আটকে আছে।’
নম্রতা উঠে বসল। অবাক হয়ে বলল,
‘ তোর বিয়ে আটকে আছে মানে? এই তোর বয়স কত? মাত্র সেভেনে পড়িস আর এখনই বিয়ে?’
‘ তো? সেভেনে পড়ি তো কী হয়েছে? তুমি জানো? দাদির বিয়ের বয়স তেরো। আর আমি ফোর্টিন ইয়ারস্ ওল্ড। এক বছর অলরেডি চলে গিয়েছে।’
নম্রতার বিস্ময় যেন আকাশ ছুঁলো। উঠে গিয়ে নন্দিতার কান টেনে ধরে বলল,
‘ তুমি একটু বেশি পেকে গিয়েছ।’
নন্দিতা বোনের থেকে কান ছাড়িয়ে বাবার কাছে আশ্রয় নিল। বাবার পাঞ্জাবির বোতামে নখ খুঁটতে খুঁটতে বলল,
‘ আমার অতো পড়াশোনা ভাল্লাগে না বাবা। তুমি আমাকে বিয়ে শাদী দিয়ে দাও তো। রোজ রোজ এই বোরিং অঙ্ক করতে বিরক্ত লাগে। রোজ করি তবুও থার্টি ফাইভ। টিচাররা আমায় আসলে দেখতেই পারে না বাবা। ইচ্ছে করে নাম্বার কম দেয়, সত্যি বলছি।’
বোনের ফাঁকিবাজি কথা শোনে হেসে ফেলল নম্রতা। নুরুল সাহেব প্রত্যুত্তরে কিছু বলবেন তার আগেই ফোন বাজল নম্রতার। গোটা পাঁচদিন বাদে ফোন দিয়েছে আরফান। নম্রতা ফোন তোলার আগেই লাফিয়ে গিয়ে খপ করে ফোন নিয়ে নিল নন্দিতা। দৌঁড়ে গিয়ে বাবার গা ঘেঁষে স্ক্রিনে ভাসা নামটা পড়ল, ‘ডাক্তার’। চকচকে চোখে ফোনটা বাবার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘ বাবা? ডাক্তার! ইউ শুড টেইক আ এপেয়ন্টমেন্ট ফ্রম হিম।’
নম্রতা বার কয়েক ফোন নেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে হেসে ফেলল। চেয়ারে বসে বলল,
‘ গো এহেড।’
ততক্ষণে ফোন রিসিভ করে নুরুল সাহেবের কানে ধরেছে নন্দিতা। নুরুল সাহেব কিছুটা অপ্রস্তুত বোধ করলেন। ওপাশ থেকে নিরেট পুরুষালী কন্ঠ ভেসে এলো,
‘ হ্যালো ম্যাডাম!’
নুরুল সাহেব শব্দ করে গলা পরিষ্কার করলেন। গমগমে কন্ঠে বললেন,
‘ হ্যালো।’
নম্রতার বদলে কোনো পুরুষালি কন্ঠ ভেসে আসতেই থমকে গেল আরফান। কয়েক সেকেন্ড নীরব থেকে সন্দিহান কন্ঠে আবারও বলল,
‘ হ্যালো?’
‘ আমি শুনতে পাচ্ছি।’
নুরুল সাহেবের উত্তর শুনে মুখ চেপে হাসি আটকাল দুই বোন। আরফান থতমত খেয়ে বলল,
‘ আমার জানা মতে এটা নম্রতার নাম্বার। আপনি কে?’
নুরুল সাহেব ধমক দিয়ে বললেন,
‘ হু আর ইউ? নাম কি তোমার?’
আরফান হতবুদ্ধি হয়ে গেল। কলের পুতুলের মতো বলল,
‘ নিষ্প্রভ।’
‘ তুমি ডাক্তার?’
‘ জি।’
‘ তুমি ডাক্তার হয়ে আমার মেয়েকে ফোন দিয়েছ কেন? আমার মেয়ে কী হসপিটাল রিপ্রেজেনটেটিভ? ‘
আরফান কথা খুঁজে পাচ্ছে না। হঠাৎ এমন একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে কথার আগা-মাথা গুলিয়ে জগা খিচুড়ি বেঁধে যাচ্ছে। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে নিজেকে শান্ত করল আরফান। জোড়াল একটা শ্বাস নিয়ে বলল,
‘ নম্রতার সাথে আমার কথা ছিল, স্যার।’
‘ আমার মেয়ের সাথে তোমার কী কথা?’
আরফান এবার বিপাকে পড়ল। কি বলবে বুঝতে না পেরে বলল,
‘ কোনো কথা নেই স্যার। রাখি, আসসালামু…. ‘
আরফানের কথার মাঝেই ধমকে উঠলেন নুরুল সাহেব,
‘ এই ছেলে? একদম ফোন কাটবে না। এমন ম্যা ম্যা করছ কেন? ম্যা ম্যা টাইপ ছেলে আমি একদম পছন্দ করি না। আর কোনো কথা না থাকলে ফোন করেছ কেন? হুয়াই?’
আরফান চুপ করে রইল। নন্দিতা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে চেয়ারে। নম্রতা নন্দিতার মাথায় একটা চাটি মেরে আহ্লাদী চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টাল। নুরুল সাহেব অল্প হেসে ফোনটা টেবিলের উপর রেখে উঠে গেলেন। নম্রতা ঝটপট ফোনটা কানে নিয়ে বলল,
‘ হ্যালো?’
পরিচিত কন্ঠস্বরে আরফান যেন প্রাণ ফিরে পেল। ফিসফিস করে বলল,
‘ আশ্চর্য! কোথায় ছিলেন আপনি?’
নম্রতা উত্তর না দিয়ে বলল,
‘ আপনি ফিসফিস করে কথা বলছেন কেন?’
আরফান কেশে গলাটা হালকা পরিষ্কার করে বলল,
‘ কোথায় ছিলেন আপনি? আপনার বাবা ফোন রিসিভ করে ফেলল আপনি খেয়াল করেননি?’
নম্রতা হাঁটতে হাঁটতে নিজের ঘরে এসে দরজা দিল। ঠোঁট টিপে হেসে বলল,
‘ খেয়াল করব না কেন? আমিই তো দিলাম।’
আরফান অবাক হয়ে বলল,
‘ আপনি দিলেন! মানে কী?’
‘ কেউ যদি আমায় সপ্তাহে একবারও মনে না করে তবে আমার মন খারাপ হয়। সেই মন খারাপের দায়ে এতটুকু পানিশমেন্ট তো ডাক্তারবাবুর প্রাপ্যই।’
‘ ব্যস্ত ছিলাম। আপনিও তো ফোন দেননি। উল্টো ফোন বন্ধ।’
নম্রতা মুখ ভার করে বলল,
‘ এতো কেন ব্যস্ত থাকেন আপনি?’
‘ ডাক্তারদের যে ছুটি নেই তাই। সবসময় অন ডিউটি। কখনও ক্লাস। কখনও রাউন্ড। কখনও পেশেন্ট। সময় কোথায়?’
নম্রতা ফুঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘ তাহলে এসব ডাক্তার ফাক্তারকে বিয়ে করা যাবে না। বিয়ের পরও ব্যাচেলরদের মতো টাইম স্পেন্ড করতে হবে। কে জানে? দেখা গেল, নতুন নতুন ঔষধের নাম মুখস্থ করতে গিয়ে ডাক্তারবাবু তার বউয়ের নামই ভুলে গেল! নাহ্ আমি কোনো রিস্ক টিস্ক নিব না। আমার হাজবেন্ড অন ডিউটি চাই। পার্ট টাইম হাজবেন্ড গ্রহণযোগ্য নয়।’
আরফান হেসে ফেলল। হাস্যোজ্জল কন্ঠে বলল,
‘ তাই নাকি?’
‘ একদম।’
‘ অন ডিউটি হাজবেন্ডের স্যালারী কী হবে? লোভনীয় কিছু হলে ডাক্তারী ছেড়ে হাজবেন্ডের ডিউটি করা যেতেই পারে। স্যালারী কী লোভনীয় খুব?’
নম্রতা লজ্জা পেয়ে গেল। হেসে বলল,
‘ আপনি অসহ্য!’
‘ আচ্ছা! আমি আর কী কী?’
বিষণ্ন সন্ধ্যার পর রাত নেমেছে শহরে। নিশুতি অন্ধকার কাটিয়ে বেজে চলেছে সূক্ষ্ম, বিরহী সুর। গিটারের তার আর শিল্পী আঙ্গুলের অবাধ্য নৃত্যে চারপাশটা হয়ে উঠেছে জন্ম দুঃখী। বড় বেশি বিষণ্ন। রঞ্জন ব্যাগ গুছাচ্ছিল। সুরটা কানে আসতেই থমকাল হাত। বুক বেয়ে উঠে এলো তপ্ত দীর্ঘশ্বাস। ব্যাগটা পাশে ফেলে নাদিমের সামনে বিছানায় এসে বসল। নাদিমের আঙ্গুল নির্ভুল ছুটছে। রঞ্জন কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে থেকে বলল,
‘ তোদের খুব মিস করব দোস্ত। তোদের ছাড়া থাকতে হবে ভাবতেই দমবন্ধ লাগছে।’
নাদিমের আঙ্গুল থামল। চোখ মেলে রঞ্জনের দিকে তাকিয়ে গিটারটা পাশে রাখল। চেয়ারে গা এলিয়ে বিছানায় পা দুটো তুলে দিয়ে আরাম করে বসল। ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
‘ মাইয়া গো মতো এতো সেন্টি খাইতাছস ক্যান মামা? এইজন্যই জিগায়, তোর সব ঠিকঠাক আছে নাকি নাই? আমারে কিন্তু কইতে পারস। আমি কাউরে কমু না।’
রঞ্জন নাদিমের পায়ে সজোরে একটা থাপ্পড় দিয়ে বলল,
‘ শালা তুই আসলেই এক নম্বরের হারামি। লাইফে কোনো সিরিয়াসনেস নেই। কাল পরশো আমি চলে যাব অথচ তুই ফাইজলামি করছিস।’
‘ সিরিয়াসনেস দিয়া কোন খাল কেটে ফেলবি বাপ? আইচ্ছা যা, আমি এহন সিরিয়াস। আয় তোরে একটু আদর কইরা দেই। যাবি গা। দীর্ঘ বিরহের আগে মিষ্টি আদর।’
রঞ্জন হতাশ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কয়েক সেকেন্ড কটমট করে চেয়ে থেকে ধুম করে লাথি মারল নাদিমের চেয়ারে। নাদিম উল্টে পড়তে পড়তে সামলে নিল। বুকে থুতু ছিটিয়ে বিস্ময় নিয়ে রঞ্জনের দিকে তাকাল,
‘ মামা তুমি তো দেখি ভায়োলেন্ট হয়ে যাচ্ছ। এতো ভায়োলেন্ট হইলেও কিছু হব না। আমি চুম্মার বেশি কিছু দিতে পারুম না।’
রঞ্জনের মেজাজ আরও বিগড়ে গেল। নাদিমের কোমর বরাবর লাথি মেরে উঠে দাঁড়াল। শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে বলল,
‘ আজ তোকে আমি জ্যান্ত পুঁতে ফেলব।’
নাদিম দাঁত কেলিয়ে বলল,
‘ কাম, কাম। কাম বেবি।’
রাগে ফুঁসতে থাকা রঞ্জনের হাতে বেশ কিছু শক্ত ঘুষি খেয়ে। নিজেও কিছু দিয়ে। অল্প কিছুক্ষণের হাতাহাতিতে ক্লান্ত হয়ে পড়ল দু’জনেই। আহত চোয়াল,কপালে হাত বুলাতে বুলাতে একে-অপরের দিকে কটমট করে তাকাল। কয়েক সেকেন্ড নিশ্চুপ থেকে হঠাৎই ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠল দু’জনে। নাদিম ডানহাতে নিজের কাঁধটা চেপে ধরে বলল,
‘ বহুত শক্ত মাইর দিছস বা*।’
রঞ্জন নিজের চোয়ালে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
‘ তোর হাতে এতো শক্তি এলো কবে থেকে? চাপার দাঁত নড়ে গিয়েছে নির্ঘাত।’
তারপর কিছুক্ষণ নিশ্চুপ। বাইরে শন শন বাতাস বইছে। আজ আবারও ঝড় উঠবে মনে হয়। রঞ্জন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ নীরা রাজি হয়েছে বিয়েতে। অন্তু শেষমেশ পাচ্ছে ওকে।’
নাদিমের বুকে অদ্ভুত এক খুশি দামামা বাজিয়ে গেল। হঠাৎ ঠোঁটে ভাসল সত্যিকারের হাসি। চকচকে চোখে চেয়ে বলল,
‘ তাই নাকি? রোমিও জুলিয়েটের উপখ্যান শেষ হচ্ছে তাহলে। শালারা কি নাটকটাই না দেখাইল।’
রঞ্জন বিষণ্ন চোখে নাদিমের দিকে তাকাল। নাদিমের কাঁধে হাত রেখে বলল,
‘ নিজেদের মাঝে আর ঝামেলা রাখিস না দোস্ত। অন্তু তো সবসময়ই ছেলেমানুষ, শর্ট ট্যাম্পার। কিন্তু তুই তো বুঝিস।’
নাদিমের খুশিটা হঠাৎ-ই থিতিয়ে গেল। মনে তৈরি হলো গুমোট অন্ধকার। অতি সন্তপর্ণে দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাসার চেষ্টা করল,
‘ কবে ফিরবি তুই?’
‘ এখনই ঠিক বলতে পারছি না।’
এটুকু বলে থামল রঞ্জন। তারপর খুব উদাস কন্ঠে বলল,
‘ আমি ফিরে এসে তোদের এভাবেই পাব তো দোস্ত?’
নাদিম রঞ্জনের কাঁধ চাপড়ে বলল,
‘ পাবি না কেন? অবশ্যই পাবি। আমাদের আর কি হবে?’
নাদিমের প্রাণহীন কথাটি রঞ্জনকে খুব একটা শান্তি দিতে পারল না। পুরু ঠোঁটের উপর মুষ্টিবদ্ধ হাতদুটো জড়ো করে চুপ করে বসে রইল। উদাস, চিন্তিত চোখদুটো নিবদ্ধ হয়ে রইল ফ্লোরে। নাদিম আস্তে ধীরে সিগারেট ধরাল। নাকে-মুখে ধোঁয়ার কুন্ডলী ছড়িয়ে উঠে গিয়ে ব্যালকণিতে গিয়ে দাঁড়াল। বাইরের পরিবেশটা পর্যবেক্ষণ করে বলল,
‘ আজকেও ঝড় হইব মনে হয়। শরৎকালেও ঝড়-বৃষ্টি! স্ট্রেঞ্জ।’
রঞ্জন উত্তর দিল না। উঠে গিয়ে নিজের ব্যাগ গুছাতে মনোযোগ দিল। ঝুম বৃষ্টিতে ব্যালকণির রেলিঙটা যখন ভিজে গেল। আকাশটা শুভ্র ঝিলিকে দ্বিখন্ডিত হয়ে আর্তনাদ করে উঠল। তারই এক ফাঁকে খবরটা দিল রঞ্জন,
‘ কাল অন্তু-নীরার বিয়ে। ঘরোয়াভাবেই হবে। কোথাও উধাও হয়ে যাস না। আমরা বিয়েতে যাচ্ছি। নম্রতা – ছোঁয়াও আসছে। এই দিনটির জন্য কত পাগলামোই না করেছে অন্তু। তোর মনে….’
নাদিম উত্তর দিল না। রঞ্জনের বাকি কথাগুলো তার মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছাল না। সিগারেটের বিষাক্ত নিকোটিন ফুসফুসে টেনে নিয়ে অন্ধকার বৃষ্টির দিকে চেয়ে রইল। কপালে ফুঁটে উঠল বেশকিছু সরু চামড়ার ভাজ। বজ্রপাতের শব্দকে ছাঁপিয়ে নাদিমের ভেতরের বিদ্বেষী মানুষটি হঠাৎই ভীষণ ক্ষোভ নিয়ে বলে উঠল,
‘ তোমার নিজেকে ঘৃণা করা উচিত নাদিম।’
নাদিম চমকে উঠে বলল,
‘ কেন?’
‘ কেন! কারণ তুমি গুরুত্বহীন। তুমি বোকা! বন্ধুদের জন্য প্রাণ দিতে চাও অথচ বুঝতে চাও না তাদের কাছে তুমি মূল্যহীন। তোমার বিন্দুমাত্র সেল্ফ রেসপেক্ট নেই।’
‘ বাজে কথা। আমি কবে কার মূল্যের আশায় বেঁচে ছিলাম? আমি একা বেঁচে থাকতে অভ্যস্ত। কারো গুরুত্বের পরোয়া তো কখনো করিনি। তুমি আমাকে ডিসট্রেক্ট করার চেষ্টা করছ। কাজটা ঠিক হচ্ছে না।’
‘ কোনোদিন কারো গুরুত্বের পরোয়া করোনি ঠিক। কিন্তু এতটা সস্তাও তো হওনি।’
‘ হয়নি? তবে কী আজ হচ্ছি?’
‘ অবশ্যই হচ্ছ। অন্তু সেদিন রেগে ছিল মানছি। তুমি বলেছ, ছেলেটির বড় কষ্ট। সেটাও মানছি। কিন্তু আজ? আজ তো কোনো সংকট নেই তার। যাকে পাওয়ার জন্য এতোদিনের পাগলামো, তাকেই পাচ্ছে। আজ সে আনন্দিত, সুখী। তার সেই সুখের খবর সবাইকে জানালেও তোমাকে জানানোর প্রয়োজনবোধ সে করেনি। তুমি তার কাছে গুরুত্বহীন বলেই হয়তো তার এতো অপারগতা।’
নাদিম সিগারেটে শেষ টান দিয়ে ছুঁড়ে ফেলল দূরে। নতুন আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে নাক-মুখে ধোঁয়া ছড়াল। বিদ্বেষী মানুষটি হিসহিসিয়ে বলল,
‘ এরপরও? এতোকিছুর পরও তার বিয়েতে তুমি যাবে? যে তোমায় চাইছে না তার কাছে এতোটা বেহায়া তুমি হবে নাদিম?’
নাদিম অন্যমনস্ক হয়ে বলল,
‘ ও যে আমার বন্ধু্।’
‘ বাজে কথা।’
‘ তবে কী যাওয়া উচিত নয়?’
‘ কক্ষনো নয়।’
নাদিম দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কাছে কোথাও প্রচন্ড শব্দে বাজ পড়ল। নাদিমের মনে হলো বাজটা কাছে কোথাও নয় পড়ল তার মনে। ভগ্ন হৃদয়টা প্রচন্ড অভিমান নিয়ে বলল, ‘ খবরটা আমায় তুই নিজে কেন দিলি না অন্তু? কেন?’
শরৎের ঝকঝকে সকাল। কালরাতে ঝড় হয়ে যাওয়ায় আকাশটা এখন পরিষ্কার, ঘন নীল। গাছের পাতাগুলো ঝরঝরে। বাতাসে একটু ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। নীরা খোলা বারান্দার এক কোণে প্লাস্টিকের টোল পেতে বসে আছে। এক টুকরো রোদ এসে গড়াগড়ি খাচ্ছে তার পায়ের কাছে। চারদিকে ব্যস্ত মানুষের পদচারণ। নীরার হাতে মেহেদী পড়ানো হচ্ছে। হাতের মাঝ বরাবর লেখা হয়েছে অন্তু নামক ছেলেটির নাম। নীরার চোখদুটো টলমল করছে। বুকের কোথাও একটা কষ্ট আর সুখের ব্যথা মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। বছরের পর বছর অন্তুকে ভালো না বাসার জন্য নিজেকে শাসিয়েছে নীরা। নানাভাবে প্রত্যাক্ষ্যান করেছে তার ভালোবাসা।
‘এই মানুষটা আমার জন্য নিষিদ্ধ’ — ভেবেই হাজারও কষ্ট দিয়ে দূরে ঠেলার চেষ্টা করেছে। তার পাগলামোগুলো হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু আজ হঠাৎ সেই দিনগুলোর জন্য বড় কষ্ট হচ্ছে নীরার। সে যদি অন্তুর নামেই লেখা ছিল তাহলে কেন এতো কষ্ট, অবহেলার গল্প তৈরি হলো তাদের? কেউ কেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে বলে দিল না, সব মিথ্যা। সব বানোয়াট। শুধু এই ছেলেটাই সত্য। এই ছেলেটার হাতে ধরা পড়তে তুই বাধ্য। নীরার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। নীরা জানে কোনো কিছুই আর আগের মতো নেই। তাদের বিয়ে ঠিক হওয়ার পর একদিনও নীরার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেনি অন্তু। নীরার প্রতি কোনোরূপ উৎসাহ দেখায়নি। এতোকিছুর পর হয়তো উৎসাহ দেখানোর কথাও নয়। তাদের সম্পর্কটা এমন একটা অবস্থায় গিয়ে পৌঁছেছে যেখানে স্নিগ্ধতার আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। নীরা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কেউ একজন কাঁধে হাত রেখে তেজ নিয়ে বলল,
‘ আপু? তুমি আবারও কাঁদছ? সত্যি করে বলো তো, এই বিয়েতে তোমার মত আছে? নাকি মায়ের জোরে বিয়ে করছ?’
ইরার কথায় চোখ ঘুরিয়ে তাকাল নীরা। হাসার চেষ্টা করে বলল,
‘ ধূর! মা জোর করতে যাবে কেন বল তো? নিজের ইচ্ছেতেই বিয়ে করছি। অন্তুকে তো তুই চিনিসই।’
ইরা কথাটা ঠিক বিশ্বাস করল না। ফুঁসে উঠে বলল,
‘ তোমার চোখ-মুখের বিরহে দেখে কিন্তু এমনটা মনে হচ্ছে না আপু। অন্তু ভাই যেমনই হোক পুরো ব্যাপারটা আমার কেন জানি ভালো লাগছে না। অন্তু ভাইয়ের ফ্যামিলির মানুষগুলোকে দেখেছ? হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে কেউ মাথায় বন্দুক ধরে জোরপূর্বক ঘাড়ে তুলে দিচ্ছে মেয়ে। অথচ, প্রস্তাব তো তারাই এনেছিল না?’
নীরা হেসে ফেলে বলল,
‘ তুই একটু বেশি বেশি ভাবছিস।’
ইরা সে কথায় পাত্তা না দিয়ে বলল,
‘ আমি কিচ্ছু বেশি ভাবছি না। এরা যদি তোমার সাথে কোনোরূপ খারাপ ব্যবহার করে তো মুখের উপর ডিভোর্স পেপার ছুঁড়ে চলে আসবে। মায়ের মতো অতো সমাজ নিয়ে আধিখ্যেতা করবে না। এই সমাজ আমাদের দুই বেলা ভাত দিয়ে যায় না। তোমার জীবন তুমি যা ইচ্ছে তা করবে আশেপাশের খালা-ভাবির বাপের কী? কেউ কিছু বললে জিহ্বা টেনে ছিঁড়ে দিবে। চুপ থাকো বলে এতো বলার সুযোগ পায়। কই! আমার সামনে তো বলে না। তোমাদের এই আদিম যুগের আদিখ্যেতাটাই ভালো লাগে না আমার। ‘
নীরা এই বিদ্রোহী, জেদী মেয়েটির দিকে তাকিয়ে হাসে। ইরার অত্যাধুনিক তেজী মুখখানার দিকে তাকিয়ে মনে হয়, কেন সে ইরার মতো হলো না? কেন ইরার মতো নিজের উপর প্রতাপ চালানো মানুষগুলোর বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠা শিখল না? ইরার মতো হলে হয়ত নীরাদের সম্পর্কটা এতোটা বিষাক্ত হয়ে উঠত না বরং রূপকথার মতো সুন্দর হতো প্রতিটি পঙক্তিমালা। নীরার হঠাৎ জানতে ইচ্ছে হলো, ইরারও কী কোনো পাগলাটে প্রেমিক আছে? ইরা কী তাকে প্রশ্রয় দেয়? ভালোবাসে?
ফোনের বাজখাঁই শব্দ আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে ঘুম ভাঙল নম্রতার। ফোনের স্ক্রিনে ‘ডাক্তার’ নামটা ভাসতেই ঘুম ছুঁটে গেল তার। বিস্ময়ে বিমুঢ় হয়েই ফোন উঠাল। সন্দিহান কন্ঠে বলল,
‘ হ্যালো?’
ওপাশ থেকে নিরেট পুরুষালি কন্ঠ ভেসে এলো,
‘ হেই নম্রমিতা! রোড সাইডের প্রথমেই নীল রঙের দু’তলা বাসাটিতেই কী আপনার বাস?’
নম্রতা বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হয়ে গেল। হঠাৎ ঘুম ভাঙায় মস্তিষ্কটা কেমন এলোমেলো লাগছে। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে শুধাল,
‘ জি?’
‘ বারান্দায় আসুন।’
নম্রতা বোকার মতো বলল,
‘ কেন? আপনি কী বারান্দায়?’
‘ উহু। বারান্দায় আপনার জামা।’
‘ মানে?’
‘ বারান্দায় আসলেই বুঝতে পারবেন। আসুন।’
আরফানের তাড়ায় এলোমেলো পায়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল নম্রতা। বারান্দার রেলিঙে ঠেস দিয়ে অলস কন্ঠে বলল,
‘ আসলাম।’
কথাটা বলেই হঠাৎ চমকে উঠল নম্রতা। মস্তিষ্কের ধোঁয়াশা কেটে যেতেই উৎফুল্ল কন্ঠে বলল,
‘ আপনি কী কোনোভাবে আমার বাসার নিচে ডক্টর?’
‘ মাই গড! টি-শার্টে আর দুই বেণুণীতে একদম বাচ্চা লাগছে আপনাকে। আপনি এভাবে ঘুমোন রাতে?’
নম্রতা রেলিঙে ঝুঁকে পড়ে নিচের দিকে তাকাল। সাথে সাথেই রাস্তার ওপাশে ফোন কানে আরফানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। গাঁয়ে ঢোলা টি-শার্ট। পরনে চেইক টাউজার। পায়ে ক্যাডস। ঠোঁটে সকৌতুক হাসি। নম্রতা উচ্ছ্বাস আর বিস্ময় নিয়ে বলল,
‘ আপনি! আপনি এখানে কিভাবে?’
‘ কেন? এই এলাকায় কী ডাক্তারদের আসা নিষেধ?’
কথাটা বলে এদিক-ওদিক তাকাল আরফান। তারপর নম্রতার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ কই? কোথাও তো সাইনবোর্ড নেই।’
নম্রতা হেসে ফেলল।
‘ ফাজলামো করছেন?’
‘ একটু।’
‘ এতো সকালে এখানে কী চাই?’
‘ চাইলেই দিবেন নাকি?’
‘ উফ! কথা ঘোরাচ্ছেন কেন বারবার? আমার বাসা কিভাবে চিনলেন সেটা বলুন।’
‘ মর্নিং ওয়াকের জন্য বেরিয়েছিলাম। হঠাৎ আপনার বলা রোড নাম্বারটা মাথায় এলো। তাই ভাবলাম, আজকের সকালটা আপনার বাড়ির উঠোনেই শুভ হোক। আপনি বলেছিলেন রোডের পাশেই আপনার বাসা। আশেপাশের বাসা খেয়াল করতেই সৌভাগ্যবশত বারান্দায় শুকাতে দেওয়া জামাটা চোখে পড়ল। এই জামাটা আপনি দুইদিন পরেছিলেন। আমি দেখেছি।’
‘ বাপরে!’
আরফানের মুখভঙ্গি পরিবর্তন হলো। ঠোঁটের কোনো হাসি চেপে বলল,
‘ আপনি এভাবেই ঘুমোন সবসময়? লুকিং এট্রাকটিভ।’
নম্রতা নিজের দিকে তাকাল। বারান্দায় ছড়িয়ে রাখা ওড়নাটা দ্রুত হাতে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে আড়চোখে আরফানের দিকে তাকাল। আরফান হাসছে। আরফান যে ঠোঁটকাটা স্বভাবের লোক তা ধীরে ধীরে বেশ বুঝতে পারছে নম্রতা। লোকটি যখন যা ইচ্ছে তাই বলে। বিন্দুমাত্র অস্বস্তির বালাই নেই। নম্রতা লজ্জাটাকে ঠেলে দিয়ে ঝাঁঝ নিয়ে বলল,
‘ রাস্তায় দাঁড়িয়ে অন্যের বাড়ির দিকে হা করে তাকিয়ে থাকাই বুঝি ডাক্তারদের স্বভাব?’
আরফান অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বলল,
‘ বাড়ির দিকে তাকিয়ে ছিলাম না তো। আপনি ভুল বলছেন, আমি তো হা করে অন্যকিছু দেখছিলাম।’
কথাটা বলে আবারও হাসল আরফান। নম্রতা নাক-মুখ ফুলিয়ে বলল,
‘ আপনি যাবেন?’
‘ অবশ্যই যাব। তার আগে বলুন, আপনি যাবেন?’
‘ আমি? আমি কোথায় যাব?’
‘ আমার বাসায়।’
নম্রতা ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ আপনার বাসায় কেন যাব?’
‘ নিদ্রা আপনাকে দাওয়াত করেছে তাই।’
নম্রতা ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
‘ আজ তো সম্ভব হচ্ছে না।’
‘ কেন? আপনি ব্যস্ত আজ?’
‘ আজ নীরার বিয়ে। আমি বিয়েতে যাচ্ছি।’
আরফান ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘ আচ্ছা।’
নম্রতা কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে হঠাৎ বলল,
‘ আপনিও চলুন না আমার সাথে। যাবেন? প্লিজ?প্লিজ?’
আরফান দুঃখী কন্ঠে বলল,
‘ আমার তো ছুটি নেই।’
‘ আপনি সবসময়ই ব্যস্ত থাকেন।’
নম্রতার কথায় সুপ্ত অভিমানের আঁচ পেয়ে হাসল আরফান,
‘ বিয়েটা কোথায় হচ্ছে?’
নম্রতা উৎসাহ নিয়ে বলল,
‘ রূপগঞ্জ। নীরার গ্রামের বাড়িতে। যাবেন আপনি?’
আরফান আৎকে উঠে বলল,
‘ রূপগঞ্জ! অতোদূর? বিয়ে শেষ করে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যাবে না?’
নম্রতা মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে আরফানের দিকে চেয়ে রইল। নম্রতার মুখে মন খারপের ছায়া দেখে হতাশ দীর্ঘশ্বাস ফেলল আরফান। কিন্তু কিছু করার নেই। এভাবে হুট করে ছুটি পাবে না সে। কারো সাথে ডিউটি শিডিউল পরিবর্তন করে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু অতোদূর থেকে ফিরে রাতের ডিউটিও ঠিকঠাক হয়ে উঠবে বলে মনে হয় না। তাদের এই নীরবতার মাঝেই পাশের বারান্দা থেকে নিচের দিকে উঁকি দিলেন একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক। গায়ে তার ছাই রঙা পাঞ্জাবি। চোখে মোটা চশমা। মুখে গাম্ভীর্য। ডান হাতে ভাজ করা খবরের কাগজ। ভদ্রলোকটি খানিক ঝুঁকে নম্রতার বারান্দার দিকে তাকাল। তারপর চশমা ঠিক করে ভ্রু কুঁচকে নিচে আরফানের দিকে তাকাল। আরফান ভদ্রলোকটিকে লক্ষ্য করে সন্দিহান কন্ঠে বলল,
‘ পাশের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রলোকটি কী আপনার বাবা নম্রা?’
নম্রতা ঘাড় ঘুরিয়ে পাশের বারান্দার দিকে উঁকি দিল। নুরুল সাহেব গম্ভীর মুখে ভ্রু’কুটি করলেন। নম্রতা মাথা ঘুরিয়ে নিচে আরফানের দিকে তাকাল। নুরুল সাহেবের দৃষ্টিও নেমে গেল নিচে। আরফান আবারও বলল,
‘ আপনার বাবা?’
নম্রতা অসহায় মুখে মাথা নেড়ে বলল,
‘ হ্যাঁ।’
আরফান বিপন্ন কন্ঠে বলল,
‘ ওহ শিট!’
নীল চিরকুট পর্ব ৩৫+৩৬
কথাটা বলেই ফোন কেটে দ্রুত পায়ে জায়গাটা থেকে সরে গেল আরফান। একটা রিকশা ডেকে দ্রুত রিকশায় উঠে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। নম্রতা অবাক হয়ে কিছু একটা বলতে গিয়েই বুঝল কল কেটে দিয়েছে আরফান। নম্রতা ভীত চোখে পাশের বারান্দায় বাবার দিকে তাকাল। নুরুল সাহেবও গম্ভীর মুখে মেয়ের দিকে তাকালেন। কয়েক সেকেন্ড গুরুগম্ভীর সময় কেটে যাওয়ার পর হঠাৎই বাবা-মেয়ে ফিক করে হেসে ফেললেন। নুরুল সাহেব শব্দ করে হেসে বললেন,
‘ ডাক্তার নাকি?’
