নীল চিরকুট পর্ব ৩৯+৪০
নৌশিন আহমেদ রোদেলা
বাইকের ছোট্ট আয়নার উপর ঝুঁকে পড়ে চুল ঠিক করছিল নাদিম। ভ্রু দুটো কুঞ্চকে আছে অজানা কোনো বিরক্তিতে। আয়না থেকে চোখ সরিয়ে মুখটা তেঁতো করে রঞ্জনের দিকে তাকাল নাদিম।
‘ এই গরমের মধ্যে এইসব সং-ঢং পিন্দার কোনো মানে আছে? টি-শার্ট পিইন্দা বিয়াতে গেলে সমস্যাটা কী মামা? বেহুদা এইসব বা*- ছা* পরাইলি। বিরক্ত লাগতাছে।’
রঞ্জন ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। বাইকের চাবিটা উপরের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে লুফে নিতে নিতে বলল,
‘ পাঞ্জাবিতে তোকে বন মানুষ থেকে মানুষ লাগছে। ধীরে ধীরে মানুষ হওয়ার চেষ্টা কর। বিয়েতে কত শত মেয়ে থাকবে। ডোন্ট ফরগেট, ফার্স্ট ইম্প্রেশন ইজ দ্যা বেস্ট ইম্প্রেশন দোস্ত।’
নাদিম পাঞ্জাবির হাতা গোটাতে গোটাতে বিরক্ত কন্ঠে বলল,
‘ ছাতার ইম্প্রেশন।’
রঞ্জন হাসল। হাসিটা তাকে মানালও খুব। নাদিম হাতের ঘড়ির দিকে এক পলক তাকিয়েই তাড়া দিল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘ বৌদি কখন আসবে? দশটা তো বাজতে চলল। এই গরমে খাড়াই থাকতে ভাল্লাগতাছে না আর।’
রঞ্জন চিন্তিত মুখে ফোনে সময় দেখল। পূজাকে আজ সাথে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে সে। কাল সন্ধ্যায় ফ্লাইট। বিদেশের মাটিতে আত্মাহুতি দেওয়ার আগে আজকেই তার শেষ দিন। এই দিনে মেয়েটাকে সময় দিতে না পারলে রঞ্জনের নিজেরই বড় অস্থির লাগবে। ফাঁকা ফাঁকা লাগবে।রঞ্জন রাস্তার দিকে তৃষ্ণার্ত দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বলল,
‘ বলল তো বেরিয়েছে। আমি পিক করতে চাইলাম। নিষেধ করে বলল প্রায় চলে এসেছে।’
‘ নমু-ছোঁয়াও কি অন্তুদের বাসাতেই যাবে নাকি? আমরা সব বরযাত্রী?’
রঞ্জন হেসে বলল,
‘ নমু-ছোঁয়া কনেপক্ষ। ওরা ডিরেক্ট রূপগঞ্জ যাবে। আজ ওরা আমাদের বেয়াইন। বেয়াইন বলে না ওটাকে?’
নাদিম জবাব না দিয়ে হাসল। রঞ্জন কৌতুক করে বলল,
‘ আজ বান্ধবী টান্ধবী বাদ। অনলি বেয়াই-বেয়াইন সম্পর্ক। প্রচুর ফ্লার্টিং চলবে।’
নাদিম দাঁত বের করে হাসল। ফিচেল কন্ঠে বলল,
‘ নমুকে তো চিনো না মামা। একবার যদি বুঝে তুমি তার প্রতিপক্ষ তাহলে বিশ্বাস কর, তোর কলিজা তোর কলিজা বের করে ছেড়ে দিবে। আর জান বের করার জন্য সাথে তোর জানপাখি তো আছেই।’
রঞ্জন প্রত্যুত্তর করার আগেই হঠাৎ বলে উঠল নাদিম,
‘ আরেহ! ফোনটা তো রুমেই ফেলে আসছি দোস্ত। সকালে চার্জে দিয়ে আর খুলতে মনে নাই। তুই থাক। আমি আনতাছি।’
রঞ্জনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই হলের দিকে ছুটে গেল নাদিম। পাঁচ দশ মিনিটের মাঝে ফিরে এসে দেখল পূজা এসে পৌঁছেছে। রঞ্জনের সাথে মিলিয়ে খয়েরী জামদানী শাড়ি তার গাঁয়ে। দুজনকে পাশাপাশি হাস্যোজ্জল মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মনের গুমোট ভাবটা খানিক কেটে গেল নাদিমের। বুকের ভেতর চাপা আনন্দ নিয়ে ওদের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াল। রঞ্জন রওনা দেওয়ার জন্য তাড়া দিতেই নাদিম হালকা অস্বস্তি নিয়ে বলল,
‘ সরি দোস্ত! আমি যেতে পারছি না। বড় মামা ফোন দিয়েছিল একটু আগে। আমাকে একটু মামার বাড়ি দর্শন দিয়ে আসতে হবে। আর্জেন্ট।’
রঞ্জন অবাক চোখে তাকাল। নাদিমের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে হাতেগুণা কয়েকটা কথা ছাড়া কিচ্ছু জানে না তারা। নাদিমের যে কোনো মামা আছে তা এই জীবনে আজই প্রথম শুনছে বলে তার ধারণা। রঞ্জন নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
‘ মামার বাড়িই তো। কাল যাস। বিয়েতে না গেলেও এটলিস্ট অন্তুর সাথে সাক্ষাৎটা করে যা।’
নাদিম দীর্ঘশ্বাস ফেলল। প্রসন্ন হাসি হেসে বলল,
‘ আরে ধূর! বিয়া তো আমাগো নীরুরেই করতাছে। অত সাক্ষাৎ টাক্ষাৎ করা লাগব না। প্রায় দশটা বাজে, সাড়ে এগারোটায় ট্রেন ধরব। স্টেশনে পরিচিত লোক আছে, টিকেট হয়ে যাবে।’
রঞ্জন হতাশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ এমন কী দরকার যে আজকের দিনটা ম্যানেজ করতে পারবি না তুই? বাই এনি চান্স, তুই অন্তুর উপর রেগে আছিস বলে….’
রঞ্জনকে কথা শেষ করতে না দিয়েই পাত্তাহীন কন্ঠে বলল নাদিম,
‘ আরে ধূর! রাগের কী? ওই ছোট্ট একটা ইস্যু নিয়ে বসে থাকার কোনো মানে আছে? মামা আজ প্রায় সাড়ে চার বছর পর তলব করেছে আমায়। ব্যাটার কাহিনীটা তো এবার দেখতেই হয়!’
এটুকু বলে থামল নাদিম। রঞ্জনের দিকে চেয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘ যেতেই হবে দোস্ত।’
কথাগুলো বলতে বলতেই চোয়াল শক্ত হয়ে এলো নাদিমের। রঞ্জন অবাক চোখে চেয়ে থেকেই বিদায় দিল নাদিমকে। নাদিম রাস্তার বাঁকে হারিয়ে যেতেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল রঞ্জন। নাদিম আর অন্তুর মাঝে ঘটে যাওয়া ঝামেলাটা নতুন কিছু নয়। এর থেকেও বড় বড় ঝামেলা হয়েছে তাদের। ইচ্ছেমতো মারপিট করে ঘন্টা ঘুরতেই এক সঙ্গে সিগারেট ধরিয়েছে। হেসেছে। ফাজলামো করেছে। দূরত্ব অভিমান বাড়ায়। অভিমান থেকে জন্মায় ক্ষোভ। ক্ষোভ থেকে অহং। তারপর ধীরে ধীরে তৈরি হয় ধারালো এক ফলা। সেই ফলাতেই ক্ষতবিক্ষত হয় সুন্দর কিছু সম্পর্ক। ঝামেলাটা হওয়ার পর অন্তু আর নাদিম যদি একটাবার সামনা-সামনি দাঁড়াত তবেই সমাপ্ত হতো এই স্নায়ু যুদ্ধ। উবে যেত এই মান-অভিমানের খেলা। রঞ্জনও তাই চাইছিল কিন্তু…. রঞ্জন আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কিছুই ভালো লাগছে না তার। মনের মাঝে তীক্ষ্ণ একটা কাটা নিয়েই দেশ ছাড়তে হচ্ছে তাকে। মনে সূক্ষ্ম এক ভয়, সব আগের মতোই থাকবে তো?
অন্তুর মেজাজ খারাপ। তার এই মেজাজ খারাপ ভাবটা সময়ের সাথে সাথে তরতর করে বাড়ছে। আশেপাশের মানুষগুলোকে অযথায় ধমকাতে ইচ্ছে করছে। দুই একটা চড় থাপড়াও দিতে ইচ্ছে করছে। বিছানার উপর রাখা সাদা শেরওয়ানির দিকে তাকিয়ে থেকে ভ্রু কুঁচকাল অন্তু। সাধারণ ঘরোয়া বিয়েতে এমন ভারী শেরওয়ানি পরার কোনো মানে হয়? অন্তু কোমরে হাত রেখে মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ফেলল। পায়ের কাছে থাকা জুতোটা লাথি দিয়ে সরিয়ে চেঁচিয়ে অয়নকে ডাকল। অয়ন সেজেগুজে বাবু হয়ে এদিক-সেদিক ঘুরছিল। সমবয়সী কাজিনদের মধ্যে আজ তার কদরই বেশি। মেজাজটাও ফুরফুরে। ভাইয়ের এমন রাগান্বিত চিৎকারে মুখটা চুপসে গেল তার। ঘরের মাঝে উঁকি দিয়ে দ্বিধা নিয়ে বলল,
‘ ভাইয়া ডেকেছ?’
অন্তু দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘ আমার ফোন কোথায়?’
অয়ন পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিল। ভাইয়ের রক্তচক্ষুতে আরও একটু গুটিয়ে গিয়ে অসহায় কন্ঠে বলল,
‘ আমি জানি না ভাইয়া।’
অন্তু ধমকে উঠে বলল,
‘ একদম মিথ্যা বলবি না। তোকে পাঁচ মিনিট সময় দিচ্ছি। এই পাঁচ মিনিটে ফোন খুঁজে নিয়ে আসবি নয়তো থাপ্পড় দিয়ে গাল ফাটিয়ে দেব।’
অয়ন মুখ কাঁচুমাচু করে চেয়ে রইল। সকালে ভাইয়ার ফোন নিয়ে গেইম খেলেছিল সে। গেইম খেলতে খেলতে কখন যে চার্জ শেষ হয়ে গিয়েছে বুঝতেই পারেনি। মাত্রই চার্জে বসিয়েছে। খুব একটা চার্জ হয়েছে বলেও মনে হয় না। অন্তু আবারও ধমকে উঠতেই চুপসানো মুখ নিয়ে ফোন আনতে গেল অয়ন। তিন পার্সেন্ট চার্জসহ ফোনটা এগিয়ে দিতেই কটমট করে তাকাল অন্তু। অয়ন মাথা নিচু করে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকেই এক দৌঁড়ে অন্তুর দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল। অন্তু নিজেকে খানিক শান্ত করার চেষ্টা করল। টি-টেবিলটা লাথি দিয়ে সরিয়ে ফোন চার্জে বসাল। ফোনটা চার্জে লাগিয়েই নাদিমকে একের পর এক কল লাগাতে লাগল। প্রতিবারই লাইন ব্যস্ত। অন্তুর খিটমিটে মেজাজটা আরও একধাপ খারাপ হলো এবার। কাল সারাদিন নিজের রুমে পড়ে পড়ে ঘুমিয়েছে অন্তু। বিকেল দিকে রঞ্জনের ফোন পেয়ে ঘুম ভেঙেছে। রঞ্জনকে বিয়ের ব্যাপারটা শর্টকাট জানিয়ে দিয়ে আবারও ঘুমিয়েছে। রাতে বন্ধুদের জানানোর কথা মনে হতেই নাদিমকে ফোন দিয়েছিল সে। কিন্তু নাদিমের ফোন বন্ধ। ঝড়-বৃষ্টি চলাকালীন পুরোটা সময় চেষ্টা করেও নাদিমকে পাওয়া যায়নি। অন্তু ক্লান্ত হয়ে রঞ্জনের নাম্বার ডায়াল করল। প্রথমবারেই ফোন উঠাল রঞ্জন। অন্তু মেজাজ দেখিয়ে বলল,
‘ নাদিম তোর পাশে থাকলে ধুমিয়ে একটা ঘুষি মার ওর গালে। রাত থেকে কল দিচ্ছি কোনো খোঁজ খবর নাই। সমস্যাটা কী ওর?’
রঞ্জন শান্ত কন্ঠে বলল,
‘ রাতে ফোন বন্ধ ছিল ওর। এখন ট্রাই কর। আমার সাথে কথা হলো মাত্র।’
অন্তু কপাল কুঁচকে বলল,
‘ কথা হলো? কথা হলো মানে কী? নাদিম তোর সাথে নেই? তোরা আসছিস না?’
‘ আমি আসছি। নাদিম আসছে না।’
‘ কেন?’
‘ তুই ওকে বলছিলি? কেন যাবে ও?’
‘ বলার জন্য তো ফোনে পেতে হবে রে বাপ। বাচ্চাদের মতো জেদ কী ওকে মানায়?’
রঞ্জন উত্তর দিল না। অন্তু কল কেটে আবারও নাদিমের নাম্বারে ডায়াল করল। যাবে না মানে কী? নাদিম যাবে না তো ওর বাপ যাবে। ফাজলামো নাকি?
রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে বসে আছে নাদিম। ইচ্ছুক চোখে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। ফ্যাকাশে সাদা চামড়ায় কালো রঙের পাঞ্জাবিটা বেশ মানিয়ে গিয়েছে। কয়েক মাসের অযত্নে বেড়ে উঠা চুলগুলো কপাল আর ঘাড়ের উপর এসে পড়েছে। বামহাতে মাথাভর্তি চুলগুলো গোছাতে গোছাতে ঘড়ির দিকে তাকাল নাদিম। প্রচন্ড গরম পড়েছে। ঘন চুলের অত্যাচারে গরম বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। এবার ঢাকা ফিরেই চুল কেটে ন্যাড়া হয়ে যাবে নাদিম। চুল নিয়ে এক্সট্রা মাথা ঘামানোর সময় তার নেই। নাদিমের ভাবনার মাঝেই ঝকঝক শব্দ তুলে স্টেশন পাড় করল একটি ট্রেন। ছুটন্ত ট্রেনের দিকে চেয়ে থেকে হঠাৎই আনমনা হয়ে গেল নাদিম। মানুষের জীবনটা কী ট্রেনের মতোই ছুটন্ত নয়? ট্রেনের যেমন নির্দিষ্ট কোনো ঠিকানা হয় না। অযথা কোনো বিশ্রাম হয় না।
ঠিক তেমনই মানুষের জীবনটাও হয় বিশ্রামহীন। জীবনের সূচনালগ্ন থেকে শুরু হয় এই ছুটে চলার খেলা। ছুটতে ছুটতে মানুষ ক্লান্ত হয় কিন্তু ক্ষান্ত হয় না। হয়ত, ক্ষান্ত হওয়ার সুযোগটাই তাদের হয়ে উঠে না। মানবজন্মটাই কী ভাসমান নয়? ঠিকানাহীন, গন্তব্যহীন নয়? সেই ভাসমান জীবনে স্টেশনের মতো ক্ষনিকের স্বস্তি হয়েই কী আসে না প্রিয় কিছু মুখ? মানুষ থমকায়। ক্ষনিক বিশ্রাম চায়। তারপর আবারও ছুটে চলে ভাসমান গন্তব্যে। সেই গন্তব্যে ছুটতে ছুটতেই হঠাৎ হারিয়ে যায় মৃত্যু নামক অতল গহ্বরে। তার বাবার জীবনটাও কী এমনই এক ভাসমান ট্রেন ছিল না? মায়ের সাথে সাক্ষাৎ হওয়াটা কী নেহাৎই ক্ষণিকের বিশ্রাম ছিল না?
কোনো ট্রেনই সারাজীবন স্টেশনে আটকে থাকে না। বাবাও থাকেনি। মা চেষ্টা করেছিল কিন্তু পারেনি। মা হয়তো ট্রেনের থিওরিটা জানত না। জানলে কখনো আটকানোর চেষ্টা করত না। নাদিমও এভাবেই ভেসে যাবে। হারিয়ে যাবে। পার্থক্য এতটুকুই বাবার মতো তাকে কেউ আটকানোর চেষ্টা করবে না। নাদিম দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। ট্রেন চলে এসেছে। নাদিম শেষ বারের মতো ঘড়িটা দেখে নিয়ে ট্রেনে গিয়ে উঠল। চ বগিতে নিজের সিটটা খুঁজে নিয়ে বসতেই ফোন বাজল। ফোনের স্ক্রিনে অন্তুর নামটা দেখে ভ্রু কুঁচকাল। কয়েক সেকেন্ড ফোন হাতে বসে থেকে ফোনটা তুলতেই ওপাশ থেকে উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠল অন্তু,
‘ শালা তুই আছিসটা কই? সারারাত ফোন বন্ধ করে বসে থেকে এখন ঢং মারাইতাছস? আধ ঘন্টার মধ্যে বাসায় আসবি। অপেক্ষা করছি।’
‘ ট্রেন ছেড়ে দিছে দোস্ত। ময়মনসিংহ যাওয়াটা খুব জরুরি নয়তো এতোক্ষণ তোর বাসায় থাকতাম।’
‘ ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে মানে কী? ফাজলামো করছিস আমার সাথে? তুই আসবি কি-না বল? তোকে ছাড়া যাব না। বিয়ে ক্যান্সেল।’
নাদিম হেসে বলল,
‘ পাগল নাকি? তুই বিয়া করতে না গেলে বিয়ার খাওয়ন পামু কই? শোন, বিয়েতে যাইতে পারতাছি না বলে কিন্তু আমারে রাইখা খাইতে বইসা যাবি না। আগে আমার জন্য প্যাক করবি তারপর খাইতে বসবি। নয়তো খবর খারাপ কইরালামু।’
অন্তু গরম কন্ঠে বলল,
‘ সবসময় ফাজলামো ভালো লাগে না নাদিম। আমি এখন সিরিয়াস। তুই না আসলে বরযাত্রী যাবে না। বিয়েও হবে না। ব্যস।’
‘ আরে ফ্যাসাদ। মাইয়া গো মতো এতো সেন্টি খাইস না তো মামা। আমি তো আর হারায় যাইতাছি না। কালকের মাঝেই চলে আসব। রঞ্জন, নমুরা তো আছেই।’
অন্তু জবাব না দিয়ে চুপ করে রইল। নাদিম হেসে ফেলে বলল,
‘ ঘরের বউয়ের মতো রিয়েকশন দিচ্ছিস ক্যান মামা? আচ্ছা, আমি রাত বারোটার আগে তোর বাসায় থাকলেই তো হলো? এখন দয়া কইরা বিয়ে করতে যা। আর জরুরি ভিত্তিতে দুই-তিনটা শালী নিয়ে আয়। নীরুরে রাইখা আসলেও চলব কিন্তু শালী রাইখা আসা চলব না। নীরু তো নিজে গো মানুষ। ওরে এতো আদর-যত্ন করে ঘরে তোলার কিছু নাই। ওর যা স্পিরিড, ওই হারামি একা একাই আসতে পারব।’
অন্তু মৃদু হাসল। নাদিম ফোন রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নিজের মাঝে অদ্ভুত একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করছে সে। ভেতরের অহংবোধটা মাঝে মাঝেই মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। আজ অন্তুর বিয়ে ছেড়ে পালিয়ে আসার পেছনে কি এই অহংবোধটা একটুও দায়ী নয়? শুধুমাত্র বড় মামার ফোন পেয়েই কি এভাবে ছুটে যাচ্ছে সে? এর পেছনে কী অন্য কোনো কারণ ছিল না? নাদিম জানে, ছিলো। তার চারপাশটা যে ধীরে ধীরে বিষণ্ন বিষে বিষাক্ত হয়ে উঠছে তা খুব টের পাচ্ছে নাদিম। এই দমবন্ধ শহরটা তাকে বাঁধতে চাইছে। আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরতে চাইছে। কিন্তু রক্ত যে কথা বলে!
শোবার ঘরের বিশাল আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ছোঁয়া। বিছানা আর ফ্লোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য জামা, শাড়ি আর অলংকার। সবসময় জিন্স-টপস পরা ছোঁয়া শাড়ি পরতে জানে না। বুদ্ধি হওয়ার পর কখনও শাড়ি পরেছে বলে মনে পড়ে না। তবুও শাড়ি পরতে হবে। নম্রতা তাকে সাফ জানিয়ে দিয়েছে, নীরার বিয়েতে দুজনেই নীল রঙের জামদানী পরবে। একই সাজে দুজন গুট গুট করে ঘুরে বেড়াবে। ভাবতেই ভালো লাগে। ছোঁয়ারও ভাবতে ভালো লাগছে। নম্রতার সাথে গিয়ে নীল রঙা জামদানীও সে কিনেছে। কিন্তু ছোঁয়ার মা সিঁথি হকের ব্যাপারটা ভালো লাগছে না। সিঁথি নিজে ডিজাইন করে মেয়ের জন্য শাড়ি আর ব্লাউজ বানিয়েছেন। তার ধারণা ছোঁয়াকে সেই পিচ রঙা শাড়িতে অপ্সরার মতো সুন্দর দেখাবে। এইসব ব্যাকডেটেড শাড়ির তার প্রয়োজন নেই। ছোঁয়ার একটু মন খারাপ হয়েছে। একটু নয় ভয়ানক মন খারাপ হয়েছে।
কিন্তু সেই মন খারাপে কিছু আসে যায় না। ছোঁয়া জানে, তাকে শেষমেশ মায়ের ডিজাইন করা শাড়িটাই পরতে হবে। সবসময় তাই-ই হয়। ছোঁয়ার পৃথিবীতে বন্ধুমহল ছাড়া বাদ বাকি সবই তার বাবা-মার পছন্দ-অপছন্দের উপর ভিত্তি করেই চলে। এইযে ছোঁয়া রোজ সকালে ব্রেড, ফ্রুটস আর কফি খায় এটাও তার মায়েরই নিয়ম। ছোঁয়া কখন কোন লিপস্টিপ লাগাবে, কোন নেইলপালিশ লাগাবে , তার কোন কোন বই পড়া উচিত সবই তার মায়েরই ঠিক করা। ছোঁয়ার গোছাল রুম। গোছাল চাল-চলন। গোছাল কথাবার্তা সবই তার মায়ের পছন্দ। মা যদি অগোছালো থাকতে পছন্দ করত তবে ছোঁয়াকে অগোছালোই থাকতে হতো। ছোঁয়ার জীবনটা ঘড়ির কাটায় কাটায় নিয়ন্ত্রিত। ছোঁয়া এই নিয়ন্ত্রণ মেনে নিয়েছে। ছোট থেকে এভাবেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে।
জীবনের কোনো পর্যায়েই সে অবাধ্য নয়। শুধু বন্ধুমহল নিয়েই তার যত নীরব বিদ্রোহ। তার বদ্ধ জীবনে এই বন্ধুমহলটাই শুধু তার নিজের। একান্তই নিজস্ব। এখানে কেউ তাকে নিয়ন্ত্রণ করে না। হাই ক্লাস ফর্মালিটি মেইনটেইন করতে হয় না। বন্ধুরা যখন গলা ছেড়ে গান গায়। হুটহাট উদ্ভট সব কাজ করে। ক্যান্টিনের রমরমা আড্ডা ছেড়ে হঠাৎ বৃষ্টিতে নেমে যায়। রেস্টুরেন্টে পেট পুড়ে খেয়ে বিল না দিয়েই দৌঁড়ে পালায়। আবার কখনও ফুটপাতে ওই নোংরা বাচ্চাদের পাশে বসে বিস্তর খায়, খাওয়ায়, গল্প করে।
সিনেমা হলে গিয়ে প্রাণ খোলে ছিটি বাজায়। তখন ছোঁয়া অবাক হয়ে দেখে। সেই সময়টুকু সে বিস্মিত সুন্দর এক পৃথিবী দেখে। প্রাণ খোলে হাসে। তার ধরা বাঁধা জীবনটাতে ওই মানুষগুলোই যেন বড্ড তৃপ্তির। ছোঁয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে মায়ের কাছে শাড়ি পরায় মনোযোগ দেয়। মুখটা হাসি হাসি করে রাখে। দামী অলংকার গায়ে বড়োলোকি অহং মাখে। আপাতদৃষ্টিতে ছোঁয়ার কোনো দুঃখ নেই। বিলাসিতার চাদরে ঘেরা জীবনটা তার খুব সুন্দর আর গোছাল। তবুও ছোঁয়ার বড় কষ্ট হয়। সহজ-সরল মনটা ধুঁকে উঠে বলে, আমার জীবনটা কেন নমু আর নীরু মতো স্বাভাবিক নয়? মধ্যবিত্ত ঘরনার টানাপোড়েন কেন আমার নেই? সেই টানাপোড়েনই বুঝি আনন্দ! বেঁচে থাকার অদ্ভুত এক স্বাদ! সংকটহীন বেঁচে থাকাটা আদৌ কী বেঁচে থাকা?
দুপুর গড়িয়ে আসন্ন বিকেলে পদার্পন করেছে সূর্য। উঠোনের উত্তর দিকে ভিন্ন রঙের চাঁদোয়া টানিয়ে সাজানো হয়েছে বিয়ের আসর। একদম আড়ম্ভরহীন, সাদামাটা আয়োজন। প্যান্ডেল থেকে কিছুটা দূরে ইট বিছিয়ে করা হয়েছে রান্নার আয়োজন। আলুথালু স্বাস্থ্যবান এক ভদ্রলোক কোমরে গামছা পেচিয়ে বিশাল ডেকচিতে খুন্তি নাড়ছেন। কপালে জবজবে ঘাম। মুখভর্তি পান। আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে রান্নার অন্যান্য সামগ্রী। সহযোগীদের কেউ সবজি কুটছে। কেউবা মাখছেন মাংস বা মাছের মিশ্রণ। শুকনো লাকড়িতে দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুনের শিখা, কমলা রঙের আগুন।
শেষ দুপুরের তেরছা আলোয় ঝিলিক দিয়ে উঠছে উত্তপ্ত ডেকচির গা। কিছু অল্প বয়স্ক তরুণ ব্যস্ত ভঙ্গিতে খাবার পরিবেশন করছে। কারো উপর মাংস দেওয়ার দায়িত্ব, কেউবা দিচ্ছে রোস্ট,ডাল,মাছ ভাজা। নম্রতাদের খাওয়া শেষ হয়েছে মাত্র। প্যান্ডেলের পাশে নীল রঙের টাংকিতে হাত ধোঁয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ছোঁয়ার কাছে এসব নতুন। অসংখ্য মানুষ একই সাবান দিয়ে হাত ধুচ্ছে। বিষয়টা নিঃসন্দেহে বিদঘুটে। ছোঁয়া চোখ-মুখ কুঁচকে হাত পরিষ্কার করল। হাত ধুতে গিয়ে পানি ছিটে ভিজে গেল শাড়ি। বড় বিরক্তিকর সব। হাত ধোঁয়া শেষে নম্রতার সাথে বরের স্টেজের দিকে এগিয়ে গেলো ছোঁয়া। নম্রতাদের আসতে দেখেই বিগলিত হাসল রঞ্জন। চাহনী যথাসম্ভব নিষ্পাপ করার চেষ্টা করে বলল,
‘ কলিজা? জুতো কোথায় লুকিয়েছ বলবে না?’
নম্রতা দাঁত বের হাসল। হাত বাড়িয়ে বলল,
‘ পাঁচ হাজার টাকা দে, বলে দেব।’
রঞ্জন মুখ কালো করে বলল,
‘ এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না কলিজা। তুমি টাকার লোভে বারবার নিজের বরকে ভুলে যাচ্ছ, বিষয়টা মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। গেইটেও জেদ ধরে পাঁচ হাজার টাকা উশুল করে নিয়েছ। এসব তো ঠিক না বউ।’
রঞ্জনের কথায় হেসে ফেলল পূজা। নম্রতা কোমরে হাত দিয়ে ভ্রু উঁচিয়ে তাকাল,
‘ রাখ তোর কলিজা। আগে টাকা দে। টাকা ছাড়া বউ বউ করবি তো খবর আছে। ডিরেক্ট ডিভোর্স।’
রঞ্জন অত্যন্ত দুঃখী কন্ঠে বলল,
‘ আমাদের এতো এতো ভালোবাসাকে তুমি এই সামান্য টাকার কাছে বলি দিতে পারলে বউ? শুধুমাত্র পাঁচ হাজার টাকার জন্য? আহ্! আমি মরে যাচ্ছি না কেন?’
রঞ্জনের কথা বলার ভঙ্গিতে হেসে ফেলল নম্রতা। পূজার দিকে চেয়ে বলল,
‘ বউদি? তোমার বরকে কিছু বলবে? নাকি মাথা ফাটিয়ে স্মৃতিহারা এতিম বানিয়ে দেব?’
রঞ্জন ভাব নিয়ে বলল,
‘ আজ আমাদের দলটা হালকা বলে এতো জোর চালাচ্ছিস। নাদিমটা সাথে থাকলে বুঝিয়ে দিতাম বরযাত্রী কাকে বলে!’
প্যান্ডেলের পেছন দিকে মাটির মোটা রাস্তা। রাস্তার পাশে বিশাল এক জামগাছ। আরফান দ্রুত হেঁটে জামগাছের নিচে এসে দাঁড়াল। আরফানকে আসতে দেখেই গাড়ি থেকে সবিনয়ে নেমে এলো ড্রাইভার।
‘ স্যার খাওয়ন-দাওয়ন শ্যাষ?’
আরফান গাড়ি থেকে কালো চামড়ার ব্যাগটা বের করতে করতে ছোট্ট করে উত্তর দিল,
‘ হু।’
ড্রাইভার বেশ আগ্রহ নিয়ে আরফানের কার্যকলাপ দেখতে লাগল। মানুষটাকে তার খুব পছন্দ হয়েছে। ছোঁয়ার অন্যান্য বন্ধুদের মতো খিকখিক না করাটাই ভালো লাগার প্রধান উৎস। ম্যাম সাহেব বলেন, স্বল্প কথা বলা জ্ঞানী লোকের লক্ষ্মণ। আরফান কথা বলে অল্প। চুপচাপ থেকে হঠাৎ হঠাৎ গম্ভীর কন্ঠে উত্তর দেয়। কথাবার্তায় জ্ঞানের ছটা। ড্রাইভার মুগ্ধ চোখে চেয়ে থাকে। আরফান পকেট থেকে ফোন বের করে ফোনে মনোযোগী হল। ড্রাইভার গদগদ কন্ঠে বলল,
‘ স্যার আপনি মানুষটা খুব ভালা আছেন। আপনারে আমার খুব পছন্দ হইছে।’
আরফান জবাব না দিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকাল। সে আহামরি ভালো কোনো কাজ করেছে কি-না বুঝার চেষ্টা করল, মনে পড়ছে না। নম্রতার মন খারাপ দেখে বহু কাঠখড় পুড়িয়ে এখানে আসতে হয়েছে তাকে। তারওপর নীরাও ফোন দিয়ে ঝুলে পড়ল। বাধ্য হয়েই ডিউটি শিডিউল পরিবর্তন করে নম্রতাকে সঙ্গ দিতে হলো। গাড়িটা নম্রতার বান্ধবীর। এই ড্রাইভারকে সে চিনে না। প্রথম দর্শনেই খুব পছন্দ হয়ে যাওয়ার মতো কোনো কথা তাদের হয়নি। আরফানের ভাবনার মাঝেই নম্রতাকে আসতে দেখা গেল। এক হাতে শাড়ির কুচি সামলে ধীরে ধীরে হাঁটছে সে। নম্রতার দিকে এক নজর তাকিয়েই বড় আফসোস নিয়ে বলল ড্রাইভার,
‘ একটা কথা বলি, মাইন্ড কইরেন না স্যার। এই আফামনির সাথে আপনারে তেমন মানায় নাই। আফামণি দেখতে মা-শা-আল্লাহ কিন্তু অতিরিক্ত কথা কয়। মাইয়া মানুষ এতো কথা বলা ভালা না। মাইয়া মানুষ থাকব চুপচাপ। দশটা বেতের বাড়িতেও ‘ও’ শব্দ করত না। চুপচাপ মাইয়া মানুষ দিয়েই সংসারে সুখ আসে। পটরপটর মাইয়ারা কোনো কামের না। মাইন্ড করলেন স্যার?’
আরফান উত্তর দিল না। গাড়িতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে মনোযোগী চোখে ফোন ঘাটতে লাগল। কপালটা হালকা কুঁচকানো। চোখ-মুখ থমথমে। আরফানের থমথমে মুখ দেখে কথা এগুনোর সাহস পেলো না ড্রাইভার। নম্রতা পাশে দাঁড়িয়ে ফোনের দিকে একটু উঁকি দিয়ে মিষ্টি হাসল। হাসির বদলে হাসি ফিরে এলো না। আরফান আগের মতোই চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। নম্রতার দিকে ফিরেও তাকাল না। আরফানের থমথমে মুখ খেয়াল করে কিছুটা অপ্রস্তুত হলো নম্রতা। দ্বিধা নিয়ে বলল,
‘ আপনি ঠিক আছেন ডক্টর?’
আরফান তাকাল না। ছোট্ট করে বলল,
‘ হু।’
নম্রতা সাবধানে বলল,
‘ আপনাকে আপসেট দেখাচ্ছে নিষ্প্রভ। কিছু হয়েছে?’
আরফান গাড়ির দরজা খুলে নিজের স্যুটটা তুলে নিল। প্রচন্ড শব্দে দরজাটা বন্ধ করে বলল,
‘ না।’
নম্রতা বুঝল আরফান রেগে আছে। তার রাগ প্রকাশের ধরন সে ধরতে পারছে। নম্রতা অসহায় কন্ঠে বলল,
‘ আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলুন।’
আরফান তাকাল না। একহাতে কালো চামড়ার ব্যাগ। অন্যহাতে ভাজ করা স্যুট নিয়ে মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াল। নম্রতাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে অন্যদিকে মনোযোগী হওয়ার চেষ্টা করল।
‘ রেগে আছেন কেন?’
আরফান তাকাল। অদ্ভুত ঠান্ডা তার দৃষ্টি। শীতল কন্ঠে বলল,
‘ আপনার বন্ধু আপনাকে ওভাবে সম্বোধন কেন করল?’
নম্রতা ব্যাপারটা ঠিক ক্যাচ করতে পারল না। পুরো ব্যাপারটা বুঝতে খানিক সময় লেগে গেল। ভ্রু কুঁচকে চিন্তা করল। পরমুহূর্তেই হেসে বলল,
‘ ও! রঞ্জনের কথা বলছেন? ও ওমনই। ভীষণ কিউট না? ওর সব কিছুই কিউট। বাই এনি চান্স, রঞ্জন যদি মুসলিম হতো এবং আমার বন্ধু না হতো তাহলে আমি ড্যাম শিওর আমি ওর উপর ক্রাশড হতাম। প্রেমে পড়তাম। বিয়েও করে ফেলতে পারতাম।’
আরফান শীতল কন্ঠে বলল,
‘ গুড।’
নম্রতা আড়চোখে আরফানের দিকে তাকাল। আরফানের থমথমে মুখ আরও বেশি থমথমে দেখাচ্ছে এবার। শ্যামবর্ণ মুখটিতে রক্তিম আভা। আরফান নিজের ব্যাগ আর স্যুটটা নিয়ে রাস্তা ধরে হাঁটা দিল। নম্রতা বোকার মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আরফানের পিছু ছুটল। বিস্মিয় নিয়ে বলল,
‘ কোথায় যাচ্ছেন?’
আরফানের ছোট্ট উত্তর,
‘ ঢাকায়।’
নম্রতা আরফানের ডানবাহু চেপে ধরে বলল,
‘ আপনি আমায় এবোয়েড করছেন?’
আরফান দাঁড়াল। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে সাবলীল কন্ঠে বলল,
‘ হ্যাঁ।’
নম্রতা খানিক অবাক হয়ে বলল,
‘ কেন! আচ্ছা, আপনি কী জেলাস?’
আরফান উত্তর দিল না। হাঁটার গতি কী খানিকটা বেড়ে গেল? হয়ত। নম্রতা আরফানের সাথে পেরে উঠতে না পেরে বলল,
‘ আমরা শুধুই মজা করছিলাম। উই আর জাস্ট ফ্রেন্ডস নিষ্প্রভ। আপনি অযথায় রাগ করছেন।’
আরফান দাঁড়াল। চোয়াল শক্ত করে বলল,
‘ দেন হুয়াই হি কেয়ার ইউ সো মাচ? আমি খেয়াল করেছি। লঞ্চে ও আপনাকে কোলে নিয়েছিল। কেন নিবে?’
শেষের কথাটাতে যেন এক রাশ অভিযোগ ছুঁড়ে দিল আরফান। ভারি বাচ্চামো প্রশ্ন, কেন নিবে? নম্রতার হঠাৎ হাসি পেয়ে গেল। আরফানের রাগ দেখে বুকের ভেতর অদ্ভুত এক প্রশান্তি খেলে গেল। চারপাশের বাতাসটাকে মনে হলো, স্বর্গীয়। নম্রতা নরম কন্ঠে বলল,
‘ আমি কোনো ফ্যাক্ট নই। আমার জায়গায় নীরা বা ছোঁয়া হলেও রঞ্জন ঠিক একই কাজ করত। রঞ্জন সবসময়ই কেয়ারিং। কাছের মানুষগুলোকে আগলে রাখতেই পছন্দ করে ও।’
আরফানের গনগনে রাগ কমল বলে মনে হলো না। প্রচন্ড রাগ নিয়ে অন্যদিকে চেয়ে রইল, কথা বলল না। নম্রতা মৃদু হেসে বলল,
‘ রঞ্জনের পাশে থাকা অতিরিক্ত সুন্দরী মেয়েটি ওর হবু বউ। মেয়েটাকে ও পাগলের মতো ভালোবাসে। এতো সুন্দরী বউ রেখে রঞ্জন আমার প্রতি ইন্টারেস্টেড কেন হবে বলুন তো?’
আরফান ফিরে তাকাল। ভ্রু কুঁচকে নম্রতার মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলল,
‘ আপনার সৌন্দর্য সম্পর্কে আপনার কোনো ধারণায় নেই নম্রতা। না জেনে লেইম রেফারেন্স টানবেন না।’
আরফানের কথাটা খুব স্নিগ্ধ শোনাল নম্রতার কানে। পুলকিত চোখে চেয়ে রইল আরফানের শ্যামবর্ণ বলিষ্ঠ চেহারায়। আরফানের দৃষ্টিও তখন নম্রতার চোখে নিবদ্ধ। বিকেলের মিষ্টি আলোয় কিছুটা সময় একান্তে কেটে গেল তাদের। বেশ কিছুক্ষণ পর হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে চোখ ফিরিয়ে নিল আরফান। শক্ত গলায় বলল,
‘ আপনাকে কেউ উদ্ভট সব সম্বোধন করবে তা আমার পছন্দ নয়। আমি ছোট থেকেই হিংসুটে প্রকৃতির ছেলে। যা আমার নিজের তা শুধুই আমার নিজের। আমার জিনিসে কেউ তাকালেও আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। আমি খুব একটা জেন্টেলম্যান নই নম্রমিতা।’
এক প্রকার ঠান্ডা ধমকি দিয়ে নম্রতার দিকে তাকাল আরফান। কথাগুলো ধীরেসুস্থে বলা হলেও কথার ধরনে ভেতরের তপ্ততা টের পেল নম্রতা। আরফান তার ঠান্ডা অথচ তীব্র চাহনি দিয়েই বুঝিয়ে দিল, তার প্রতিটি কথা কতটা সত্য এবং গম্ভীর।
দুপুরের শেষ ভাগে বড় মামার বাড়িতে গিয়ে পৌঁছাল নাদিম। গ্রামের মাঝে বিশাল জায়গা নিয়ে বড় মামার বাড়ি। গেইট দিয়ে ঢুকতেই একপাশে দুটো বড় বড় চৌচালা ঘর। একটা ধানের গোদাম। অন্যপাশে পুরনো একতলা বাড়ি। ডানপাশে টিনের চালা দেওয়া বৈঠকঘর। বৈঠক ঘরের পাশে শান বাঁধানো বিরাট পুকুর। পুকুরের পাশে হাঁসের খামার। হাঁসের খামারটা নতুন হয়েছে। পাঁচ বছর আগে যখন এসেছিল তখন এই হাঁসের খামারটা দেখেনি নাদিম। নাদিম ক্লান্ত নিঃশ্বাস ফেলল। বাড়ির সামনে ধান শুকানোর বড় মাঠটা পাড় করে উঠোনে পা রাখতেই বেশ কিছু প্রাণী নীরবে তাকে পর্যবেক্ষণ করল। প্রায় সবাই চাকর শ্রেণীর মানুষ। এদের কাউকেই নাদিম চেনে না। নাদিমকে তারা চিনবে এমনটাও আশা করা যায় না। নাদিম বেশ কয়েক পা এগিয়ে যেতেই একজন উৎসুক কন্ঠে শুধাল,
‘ আপনি কেডা? কারে খুঁজেন?’
নাদিম উদ্বেগহীন কন্ঠে বলল,
‘ তুমি কে? বড় মামাকে গিয়ে বলো নাদিম এসেছে।’
লোকটির চোখ সরু হলো। নাদিমের পরিচয় বুঝতে পেরে বলল,
‘ ভাইজান তো পরিষদে গেছে। আপনে বাড়ির ভিতরে চলেন। ভাবিজানরা আছেন ভিতরে।’
নাদিম সপ্রতিভ পায়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকল। কিছুক্ষণের মাঝেই বাড়ির ভেতর হালকা এক সুর ধ্বনি খেলে গেল। হাজারও আদিখ্যেতা মাখা প্রশ্ন-উত্তরের পর বড় মামী তাকে বিশ্রাম নিতে বলে রান্নার তোড়জোড় করতে ছুটলেন। নাদিমকে যে মেয়েটা ঘর দেখিয়ে দিল তার নাম পরী। শ্যামলাটে মিষ্টি মুখটা পরীর মতোই সুন্দর, স্নিগ্ধ। নাদিম কলতলা থেকে হাত-মুখ ধুয়ে ফিরে আসা পর্যন্ত মেয়েটি তার পিছু পিছুই ঘুরল। ঘরে ফিরে বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে দিয়ে মেয়েটির দিকে তাকাল নাদিম। ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ তুই পরী না? বড় হয়ে গিয়েছিস অনেক। কোন ক্লাসে পড়িস?’
পরী উজ্জল মুখে তাকাল। চঞ্চল পায়ে বিছানার কাছে এসে দাঁড়াল। মুখভর্তি হাসি নিয়ে বলল,
‘ এইবার এসএসসি দেব নাদিম ভাই।’
‘ বাহ্! ভালো।’
পরী উৎসুক কন্ঠে বলল,
‘ তুমি এতোদিন আসোনি কেন নাদিম ভাই? আব্বা তোমার কথা রোজ বলত। আমিও বলতাম।’
নাদিম হাসল। ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে বলল,
‘ কী বলতি? আমি যখন এই বাড়িতে শেষবার আসি, তখন তো তুই বেশ ছোট ছিলি। আমায় তো মনে থাকার কথা নয়।’
পরী অবাক হয়ে বলল,
‘ যাও! তোমাকে মনে থাকবে না কেন? তুমি তখন কি সুন্দর দেখতে ছিলে। একদম সাদা রঙের। পরীদের ছেলের মতো। খুব মনে আছে আমার।’
নাদিম শব্দ করে হাসল।
‘ পরীদের ছেলের মতো? তুই পরীদের ছেলে দেখেছিস?’
পরী অধৈর্য হয়ে বলল,
‘ উফ! না দেখলেই বা কী? আমার নাম পরী না? আমি সব জানি। পরীর ছেলেরা খুব খুব সুন্দর হয়। তখন তোমাকেও ঠিক পরীর ছেলের মতোই লাগত।’
‘ তখন লাগত, এখন লাগে না?’
‘ এখন তো তোমায় তার থেকেও বেশি সুন্দর লাগে। আগে ছেলের মতো লাগত এখন বরের মতো লাগে। পরীদের বরের মতো।’
কথাটা বলে লাজুক হাসল পরী। নাদিম কয়েক সেকেন্ড চুপ করে চেয়ে রইল পরীর চোখে-মুখে। কিছু একটা বুঝার চেষ্টা করছে। তারপর ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করল। মনের ভেতর থেকে সুপ্ত মানব খেক খেক করে হেসে উঠে বলল,
‘ মুরগী নিজেই এসেছে শিয়ালের কাছে বাগি হতে। বড় মামাকে জব্দ করার চরম সুযোগ।’
নাদিম নিজের মনে হেসে বলল,
‘ তুমি সবসময় আমায় ডিসট্রেক্ট করার চেষ্টা করো। বড় মামাকে জব্দ করা নিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যথা নেই।’
‘ আরে ব্যস! এখন আমার দোষ? মেয়েটাই তো পটে গেল। পটে গেল বলেই না বললাম। ভোলা চেহারা দেখে পটে গেলে আমার কি দোষ?’
নীল চিরকুট পর্ব ৩৭+৩৮
‘ দূর হও। আমি ঘুমাব।’
সুপ্ত মানব মনের এক কোণায় বসে কৌতুকমাখা হাসি হাসতে লাগল। বিষয়টাতে তার খুব আনন্দ লাগছে। আনন্দ লাগছে নাদিমেরও। পৈশাচিক আনন্দ।
