নীল চিরকুট পর্ব ৪৯+৫০

নীল চিরকুট পর্ব ৪৯+৫০
নৌশিন আহমেদ রোদেলা

আকাশে ঝকঝকে রোদ। টিএসসির পরিচিত চায়ের দোকানে বসে আছে নাদিম। গায়ে ঘর্মাক্ত টিশার্ট। পিঠে গিটার। ডানহাতে ধোঁয়া উঠা গরম চায়ের কাপ। এক ঝাঁক উত্তপ্ত রোদ এসে পড়ছে পায়ের খুব কাছে। কপালে চটচটে ঘামের আভাস। এমন অস্বস্তিকর পরিবেশে, খুব আয়েশ করে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে নাদিম। কুঁচকে থাকা ভ্রু জোড়াতে বিরক্তি নেই। নেই কোনো আড়ষ্টতা।

মুখোমুখি সামনের বেঞ্চিটিতে বসে আছেন ধবধবে সাদা লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরিহিতা এক ভদ্রলোক। মুখের গড়ন শক্তপোক্ত। ঠোঁটদুটো পানের রসে লাল। টকটকে ফর্সা কপালটা কুঁচকানো। চোখ দুটোতে বিরক্ত আর দ্বিধার দ্বৈত টানাপোড়েন। মকবুল সাহেব চায়ের কাপটা পাশে রাখলেন। তীব্র বিতৃষ্ণা নিয়ে বললেন,
‘ আমি মকবুল নিজে তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি।এর পেছনের কারণ কী তুমি অনুমান করতে পারো?’
নাদিম চোখ তুলে তাকাল। কুঁচকানো ভ্রু জোড়া শিথিল হলো। হালকা কন্ঠে বলল,
‘ জি না।’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মকবুল সাহেব হাসলেন। পানের রসে লাল হয়ে থাকা এক পাটি দাঁত ঝিলিক দিয়ে উঠল মুহূর্তেই। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা চাকর শ্রেণীর লোকটি পানের খিলি এগিয়ে দিতেই নতুন খিলি মুখে পুরলেন। হাসি হাসি মুখে পান চিবুলেন। বেশ কিছুক্ষণ নীরব হেসে, মুখ ভর্তি পানের রস নিয়েই কথা বললেন,
‘ মিথ্যা। মকবুলের সাথে মিথ্যা বলে লাভ নেই। মানুষ দেখেই নাড়ি-নক্ষত্র বুঝে ফেলার ক্ষমতা আমার আছে। আর মানুষ দেখে মনের কথা আঁচ করে ফেলার ক্ষমতা বোধহয় তোমারও খানিক আছে। আছে না?’
নাদিম উত্তর দিল না। চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে সিগারেট ধরাল। মকবুল সাহেব এক দলা থুতু ফেলে রুমালে মুখ মুছলেন। পানের রসে লাল হয়ে যাওয়া ধবধবে সাদা রুমালটা রাস্তার পাশে ছুঁড়ে ফেলে হাসলেন।

‘ তুমি খুব ভালো করে জানো, আমি কেন এসেছি? জানো না?’
নাদিম তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। হেসে বলল,
‘ হয়ত জানি। খানিকটা অনুমানও করতে পারছি। কিন্তু আপনার মেয়ের সাথে কোনোরূপ যোগাযোগ আমার নেই।’
মকবুল সাহেব অবাক হলেন। কয়েক মুহূর্ত নিষ্পলক চেয়ে থেকে নিজের মনে আওড়ালেন,
‘ আমার মেয়ে!’
‘ কেন? মিষ্টি কি আপনার মেয়ে নয়? মিষ্টির উপর অধিকার আইনত আপনারই বেশি। আমি বা আমরা কেউ নই। কেউ না।’
মকবুল সাহেব জবাব দিলেন না। নাদিমের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থেকে শক্ত কন্ঠে বললেন,

‘ তুমি কি আমায় ওভারটেক করার চেষ্টা করছ? এসব খেলায় পুরাতন খেলোয়াড় আমি। আমার সাথে খেলতে আসবে না। মিষ্টিকে লেলিয়ে দিয়ে আমার সামনে ভালো সাজার চেষ্টা চালাচ্ছ!’
নাদিম হেসে ফেলল। বিচিত্র ভঙ্গিতে সিগারেটের অবশিষ্ট ছাই টুকু ফেলে নিয়ে বলল,
‘ মিষ্টি আমার কাছে আসতে চায়। আমার সাথে থাকতে চায়। কিন্তু আমি নই। আপনি বুদ্ধিমান মানুষ। আমাদের পারিবারিক হিস্ট্রি সম্পর্কে খোঁজ না নিয়ে বসে থাকার কথা নয়। মিষ্টির প্রতি আমার শূন্য অনুভূতির খোঁজটাও আপনার জানা। তবুও আপনার মনে হয়, আমি মিষ্টিকে লেলিয়ে দিচ্ছি? আশ্চর্য!’
‘ মিষ্টির প্রতি শূন্য নয়, তোমার সুপ্ত অনুভূতির কথাও আমার জানা। মিষ্টিকে তুমি আগলে রাখতে চাও। আর আগলে রাখার জন্যই তাকে আমার থেকে ছিনিয়ে নিতে চাও। মনে রেখো, মকবুল ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়।’
নাদিমের চোখ-মুখে গম্ভীরতার ছাপ পড়ল। ভীষণ গম্ভীর কন্ঠে বলল,

‘ আপনি মানুষ হিসেবে অত্যন্ত খারাপ একজন ব্যক্তি মকবুল সাহেব। মিষ্টির ভাগ্য খুব সুপ্রসন্ন ছিল বলেই হয়ত তারওপর কন্যাস্নেহ কাজ করেছে আপনার। নয়ত, এতোদিনে বিদেশ-বিভুঁইয়ে বিলাসবহুল বিছানাগুলোতে শোভা পেত সে। কিন্তু তা হয়নি। হয়েছে তার উল্টো। কিন্তু এমনটা কেন হলো?’
মকবুল সাহেব উত্তর দিলেন না। তীক্ষ্ম চোখে চেয়ে রইলেন। নাদিম নতুন একটা সিগারেট ধরাল। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল,

‘ আমার ভাবনা ঠিক হলে, আপনি ব্যক্তিগত জীবনে খুব একা মকবুল সাহেব। সমাজের নিকৃষ্ট মানুষগুলো যেমন একা হয়, ঠিক তেমনই। মিষ্টি জন্ম দুঃখী মেয়ে। আর খুব আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, আপনার জন্মের ইতিহাসটাও খুব একটা সুখকর নয়। মিষ্টি আর আপনার জীবনের সূচনাটা একই। মিষ্টির প্রতি আপনার আলাদা মায়া জাগার খুব বড় একটি কারণ হলো, তার জন্ম ইতিহাস। দ্বিতীয় কারণটি হয়ত তার নিষ্পাপ মুখশ্রী। আপনি এই মধ্যবয়সে এসে হঠাৎ উপলব্ধি করছেন, এই পৃথিবীতে আপনি একা। ভালোবাসার মতো, ভরসা করার মতো নিজের কেউ নেই বলেই মিষ্টিকে আপনার চায়। মিষ্টিও আপনার মতোই একা। ভালোবাসার ক্ষমতাও তার প্রচন্ড। এ সকল কারণেই মিষ্টির প্রতি পিতৃস্নেহ কাজ করে আপনার। তারওপর সম্পত্তির যথার্থ উত্তরাধিকারীও প্রয়োজন। আমি কী ঠিক বললাম মকবুল সাহেব?’

এটুকু বলে থামল নাদিম। মকবুল সাহেবের দিকে পূর্ণদৃষ্টি নিক্ষেপ করল। মকবুল সাহেবের মুখ থমথমে। মনের সুপ্ত গহ্বরে লুকিয়ে রাখা সত্যগুলো অবলীলায় প্রকাশ পেয়ে যাওয়ায় তিনি বিরক্ত এবং শঙ্কিত। কী করে প্রকাশ পেল এই অপ্রকাশিত সত্য? কী করে জানল নাদিম? ছেলেটা কী সর্বজান্তা? নাকি কোনো মাইন্ড রিডার? মনের ভয় আর গোপনীতাগুলো চট করে ধরে ফেলার গুণটা কী তার ঈশ্বর প্রদত্ত? নাদিম মৃদু হেসে বলল,

‘ আপনি মানুষ হিসেবে নিকৃষ্ট হলেও বাবা হিসেবে দূর্দান্ত মকবুল সাহেব। আমার বাবার থেকে তো ঢের ভালো। প্রত্যেকটা মানুষের মাঝেই কিছু নেগেটিভিটি আছে। আপনি মানুষ হিসেবে নিকৃষ্ট। আর আমার বাবা মানুষ হিসেবে আদর্শ হলেও বাবা হিসেবে ছিলেন নিকৃষ্ট। তিনি বাবা হওয়ার অসাধারণ অনুভূতিটাকে কখনোই অসাধারণ কিছু মনে করতে পারেননি। তার ধারণা ছিল, আমার সন্তান বলে কোনো ব্যাপার এই পৃথিবীতে নেই। পুরো জন্ম পদ্ধতিটাতে নর-নারীর উপস্থিতিটা একটি মাধ্যম ব্যতীত অন্যকিছু নয়।’
এটুকু বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলল নাদিম। সিগারেটে ঘন ঘন টান দিয়ে নাকে-মুখে ধোঁয়া ছাড়ল। কিছুক্ষণ নীরব থেকে খুব স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,

‘ আমি ব্যক্তিগতভাবে এসব সম্পর্ক টম্পর্কগুলোতে বিশ্বাস রাখি না মকবুল সাহেব। ভাই হিসেবেও খুব একটা প্রসংশার দাবীদার নই। বোনের জন্য আকুলি-বিকুলি অনুভূতিও নেই। আপনাকে এই মুহূর্তে ভীষণ ফাদার ম্যাটারিয়াল পার্সোন বলে মনে হচ্ছে মকবুল সাহেব। সত্যিকারের বাবার মতোই অসহায়। আপনার চোখ বলছে, মিষ্টি ভালো থাকবে। এতটুকুই এনাফ। কোন দুনিয়ায় থাকছে। কার সাথে থাকছে তা নিয়ে ভাবার সময় আমার নেই। তার সাথে দ্বিতীয়বার দেখা করার ইচ্ছেও আমার নেই। আপনি চাইলেই সত্যটা প্রকাশ করতে পারেন। ভাইয়ের নামে মিথ্যে কিছু ঘটনাও রটাতে পারেন। মিষ্টির মনটা ভাইয়ের প্রতি বিষিয়েও দিতে পারেন। আমার কোনো আপত্তি নেই।’
নাদিমের ভাবলেশহীন কথায় হতভম্ব চোখে চেয়ে রইলেন মকবুল সাহেব। নাদিমকে ঠিকঠাক বুঝে উঠতে না পেরে হতবিহ্বল ভঙ্গিতে বসে রইলেন। বিস্ময় নিয়ে বললেন,

‘ তুমি মিষ্টিকে সত্যিটা জানাতে চাও? যদি জানাতেই চাও তবে সেদিন কেন বলোনি?’
নাদিম স্নিগ্ধ চোখে তাকাল। মনের কোথাও একটা হুহু করে উঠে বলল, ‘ রক্তের টান বড় শক্ত টান মকবুল সাহেব। এই টান ছিঁড়ার সাহস সবার নেই। বোনের ছলছলে দাবীর মুখে তিক্ততা ঢালার সাহস হয়ত পৃথিবীর কোনো ভাইয়ের বুকেই হয় না। কখনও না।’ নাদিম থেকে উত্তরের অপেক্ষা না করেই বিরবির করে বলে উঠলেন মকবুল সাহেব,
‘ মিষ্টিকে বুঝানো সহজ হবে না। তুমি বুঝতে পারছ না, আল্লাহর পর ভাইকে ছাড়া আর কাউকেই বোধহয় সে এতটা বিশ্বাস করে না। কাছাকাছি না থেকেও কিভাবে তৈরি হলো এই টান!’
নাদিম হতাশ নিঃশ্বাস ফেলল। চোখের সামনে ভেসে উঠল, ছোট্টবেলার এক গ্রীষ্মকাল। রৌদ্রতপ্ত উঠোনের কোণে ভাই নেউটা মিষ্টির বিস্মিত দুটো চোখ। ভাইয়ের কথা অকাতরে বিশ্বাস করে নেওয়া সরল একটি মন।

‘যাও পাখি বলো হওয়া ছল ছল
অবছায়া জানালার কাচ
আমি কি আমাকে হারিয়েছি বাঁকে
রূপকথা আনাচ-কানাচ।’

নন্দিতার গুনগুন কন্ঠ হাওয়ার তালে ভাসছে। রাতের ঝিমঝিম শব্দের সাথে চাপা গুঞ্জনের মতোই আঘাত হানছে পর্দায়। নম্রতা জানালার গায়ে ঠেস দিয়ে কান পাতল। মেয়েটির গলা ভারি মিষ্টি। হুটহাট গুনগুনিয়ে গাওয়া গানগুলো শোনায় চমৎকার। নন্দিতা বারান্দা ধরে পায়চারি করছে। বইটা মুখের সামনে ধরে মনের সুখে গান গেয়ে বেড়াচ্ছে। নম্রতা জানে এই গানের আয়ু সীমিত। কিছুক্ষণের মাঝেই মায়ের তীক্ষ্ণ চিৎকারে ঘেটে যাবে এই সুর। থমথমে পরিবেশটা উত্তপ্ত হয়ে উঠবে। নন্দিতার ফ্যাচফ্যাচে কান্নার আওয়াজে ভরে উঠবে বাতাস। নাক টেনে টেনে দুই-তিন লাইন পড়ার শব্দ আসবে। তারপর আবারও গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠবে নন্দিতা, যাও পাখি বল হাওয়া ছল ছল।

‘ অন্য কোনো গানও গাইতে পারে। একই গান বারবার রিপিট করতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। নন্দিতা পরবর্তীতে কি গান গাইবে ভাবতে চেষ্টা করল নম্রতা। ভাবনা ঠিকঠাক হলো না। টেবিলের উপর নীল খামে মোড়ানো চিঠিটা মন-মস্তিষ্ককে চম্বুকের মতো টানছে। ভাবনাসমূহে মনোযোগ দেওয়া যাচ্ছে না। টেবিল থেকে চিঠিটা তুলে নিয়ে পড়তেও ইচ্ছে করছে না। চিঠির জন্য চাপা উত্তেজনা, তীব্র অপেক্ষাটা ভীষণ মিষ্টি ঠেকছে। চিঠিতে কি লেখা থাকতে পারে তা নিয়ে নানান ভাবনা ভাবতেও ভালো লাগছে। চিঠির সেই পুরাতন ‘সে’ কে মনপ্রাণ দিয়ে অনুভব করছে। কম্পিত হৃদপিণ্ডে প্রেমানুভূতিটা তরতর করে বাড়তেই অদ্ভুত এক ঘোর আষ্টেপৃষ্টে ধরছে শরীর। নম্রতা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ধীর হাতে তুলে নিল নীলাভ খাম। কম্পিত হাতে চিঠিটা খুলতেই চোখে ভাসল চির পরিচিত গুটিগুটি অক্ষর,

‘ ভালোবাসা! আজকাল ভালোবাসা শব্দটা বড় বেশি জ্বালাচ্ছে শ্যামলতা। বুকের ভেতর ধুকপুক করতে থাকা হৃদপিণ্ডটা বারবার জানান দিচ্ছে, আমি তাকে ভালোবাসি। আমার ব্যস্ত দিন, ব্যস্ত রাত, তার ব্যস্ত অভিমানে নিজেকে ডুবিয়ে রেখেও হঠাৎ হঠাৎ ভীষণ একা হয়ে উঠছি। সেই একা, নিঃসঙ্গ জগতে স্বপ্নময়ী হয়ে ধরা দিচ্ছ তুমি। তোমাকে পাওয়ার ব্যস্ততায় দিনকে দিন ক্লান্ত হয়ে পড়ছি। হাজারও ব্যস্ততার মাঝেও হঠাৎ ভীষণ কৃপণের মতো বুকে চাপা দিতে চাচ্ছি আমার সম্পদ। অন্যমনস্ক মন কাজ-কর্ম ফেলে শিশুসুলভ অভিমানে বিদ্রোহ করছে। অন্যের প্রতি তোমার হালকা সজাগ দৃষ্টিতেই ঈর্ষায় জ্বলে পুড়ে মরছি। তোমাকে দুমড়ে-মুচড়ে বুকের নিষিদ্ধ কোনো প্রকোষ্ঠে বন্ধী করার তীব্র ইচ্ছে বহন করছি প্রতিটি রক্তকণায়। ইশ! এত হিংসুটে কবে হলাম আমি?… ‘

নম্রতা চিঠিটা ভাজ করে খামে পুরল। বাকিটা সে পড়বে না। আরফানের অনুভূতির পাগলামো শুনে গলে গেলে তো চলবে না। এতোদিনের জমানো অভিমান ভাসিয়ে দিলেও চলবে না। সে শক্ত থাকবে। আরফান যদি তার ব্যস্ততা নিয়েই ভালো থাকে তবে নম্রতাও ব্যস্ত থাকবে। আরফান তাকে অবহেলা করলে সে-ও করবে। কি এত দায় তার? কেন বারবার তাকেই এত এগুতে হবে? সব অপেক্ষা শুধু তারই কেন? করবে না সে অপেক্ষা। চিঠিও পড়বে না। সপ্তাহে দু’দিন যার ফোন করার সময় হয় না তার আবার ভালোবাসা কিসের? নম্রতা মুখ ফুলিয়ে বসে রইল। হাতে থাকা চিঠিটা গভীর আবেগে চেপে ধরল বুকে। মনের সুপ্ত কোনো প্রকোষ্ঠ দড়াক করে লাফিয়ে উঠে বলল, ‘তার প্রতি অভিমান নিয়ে বাঁচা যে বড় কষ্ট শ্যামলতা। বড় কষ্ট!’

ঘড়ির কাটা দশটা পাঁচে গড়াতেই ঘড়ি থেকে চোখ তুলে সামনে তাকাল আরফান। স্টিয়ারিং হুইলে ডানহাত রেখে বামহাতে দরজা খুলল। কপাল কুঁচকে বলল,
‘ পুরোপুরি পয়ত্রিশ মিনিট লেইট। তুমি বলেছিলে, তুমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছ। বাড়ি ফেরার চিন্তায় অলমোস্ট মারা যাচ্ছ। একসাথে এতগুলো মিথ্যা!’
নিদ্রা মিষ্টি হাসল। শপিং ব্যাগগুলো পেছনের সিটে ছড়িয়ে রেখে সীটবেল্ট বাঁধল। আরফানের দিকে চেয়ে অমায়িক কন্ঠে বলল,
‘ দেট ওয়াজ আ পানিশমেন্ট। তুমি ছোড়াছুড়িকে লাঞ্চের দাওয়াতে আনবে বলেছিলে, আনোনি। মা আর আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে বলেছিলে, দাওনি। মোস্ট ইম্পোর্টেন্ট টপিক, তুমি বলেছিলে ফটাফট বিয়ে করে ফেলবে, করোনি।’
আরফান হাসল। প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,

‘ এতো রাতে একা শপিং-এ আসাটা বোধহয় তোমার উচিত হয়নি নিদু।’
‘ ঠিক বলেছ, উচিত হয়নি। কিন্তু হিউম্যান সাইকোলজি কি বলে জানো? হিউম্যান সাইকোলজি বলে, মানুষ তার জীবনে উচিতের থেকে অনুচিত কাজগুলোই করে বেশি। তারা যে কাজগুলো না-জেনে করে এমনটা নয়। তারা জানে, বুঝে এবং সুস্থ মস্তিষ্কে অনুচিত কাজটা বেছে নেয়। যেমনটা তুমি করছ।’
আরফান প্রশ্নবোধক চোখে তাকাল। নিদ্রা হতাশ কন্ঠে বলল,

‘ তোমার উচিত ফটাফট বিয়ে করে ফেলা। কিন্তু তুমি তা করছ না। বিয়ে না করে ডেটিং ফেটিং-এ যাচ্ছ। ছোড়াছুড়িকে চুমু টুমু খেয়ে ফেলছ। কাজটা অনুচিত। আমি আর মা হতাশ।’
আরফান যেন বিষম খেলো। আকাশসম বিস্ময় নিয়ে নিদ্রার দিকে তাকাল। পরমুহূর্তেই হেসে ফেলে বলল,
‘ কি বলছ!’

নিদ্রা গম্ভীর মুখে বসে রইল। আরফান অসহায় কন্ঠে বলল,
‘ গিভ মি আ গ্রেট প্ল্যান। সে আমার ফোন রিসিভ করছে না। তার নাকি ভীষণ ব্যস্ততা। আমার সাথে কথা টথা বলার সময় নেই। আমি চাইলে তার বাবার সাথে কথা বলতে পারি। কি আশ্চর্য! প্রেম কি আমি তার বাবার সাথে করি নাকি?’
নিদ্রা ভাইয়ের দিকে তাকাল। হুহা করে হেসে উঠে বলল,
‘ শ্বশুরের সাথে প্রেম! কোয়াইট ইন্টারেস্টিং!’
আরফান হতাশ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আচ্ছা? এই জ্বালাময় মেয়েটিকে কি কিডন্যাপ করা যায় না?

নীরা আজ শাড়ি পরেছে। হালকা নীল রঙের উপর সাদা সুতোর কাজ করা সুতি একটি শাড়ি। মুখে কোনো সাজগোজ নেই। প্রসাধনীহীন স্বচ্ছ মুখটা বড় সুন্দর দেখাচ্ছে আজ। টেবিলে খাবার দেওয়ার সময় অয়ন চমকে উঠে বলেছে, ‘নীরাপু? তোমাকে তো একদম পরীদের মতো সুন্দর দেখাচ্ছে।’ নীরা শুধু এক টুকরো হাসি ফিরিয়ে দিয়েছে তাকে। মনটা ভালো ছিল না তার। অন্তু বাড়ি ফিরবে-কি-ফিরবে না তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় অস্থির ছিল সে। ঠিকমতো খাওয়াও হয়নি। অন্তু যদি সত্যিই না ফেরে? কিন্তু অন্তু ফিরল। ঘড়িতে এগারোটা বাজার আগেই বাড়িতে দেখা গেল তাকে। নীরাকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়ে রাতের খাবার খেল। নীরা ঘরে ফেরার আগেই বইয়ে মুখ গুজে বসে রইল।

নীরা নামক প্রাণী আদৌ এই ঘরটিতে আছে কি-না তা যেন বেমালুম ভুলে গেল সে। নীরা বিছানায় গিয়ে বসল। শাড়ির আঁচলে মুখের ঘামটা মুছে নিতেই অদ্ভুত কষ্টে বুক ভার হয়ে এলো তার। ভার্সিটির কোনো অনুষ্ঠানে শাড়ি পরলেই হা করে চেয়ে থাকত অন্তু। নাদিম-রঞ্জন এতো মজা নিত তবুও দৃষ্টি সরতো না তার। নীরার হাজার গালি শুনেও মোহাচ্ছন্ন হাসি দিয়ে বলত, ‘ কি লাগছিস মাইরি!’ তাহলে আজ কেন চোখ তুলে তাকাল না অন্তু? সেই মোহাচ্ছন্ন দৃষ্টি কোথায় হারাল? সেই সকল বেপরোয়া, বেসামাল কথার মানুষটি কিভাবে এত গম্ভীর হলো? তবে কি নীরা আর আগের মতো নেই? অন্তুকে আকর্ষণ করার শক্তি কি তার নিঃশেষ? নীরার হঠাৎই মায়ের কথা মনে পড়ে গেল। এক ছুটে মায়ের কোলে মাথা রাখতে মন চাইল। জীবনের সব দুঃখগুলো বিছিয়ে বিছিয়ে বলতে মন চাইল। কে শুনবে তার দুঃখমালার কথা? কথাগুলো ভাবতেই স্থান-কাল ভুলে ফুপিয়ে উঠল নীরা। অন্তু ঘাড় ফিরিয়ে অবাক চোখে তাকাল। ভ্রু-কপাল কুঁচকে নীরাকে পর্যবেক্ষণ করল। নীরবতা ভেঙে গম্ভীর কন্ঠে বলল,

‘ কি সমস্যা? কান্নাকাটির কি হলো?’
হঠাৎ অন্তুর কন্ঠে চমকে উঠল নীরা। কান্না বন্ধ হয়ে গেল। ভেজা চোখে অন্তুর কুঞ্চিত কপালের দিকে তাকাল। অন্তু কি বিরক্ত হলো? পরমুহূর্তেই অন্তুর চোখ দুটোতে চোখ পড়ল নীরার। সাথে সাথেই কান্নার বেগ বেড়ে গেল তার। কেন নেই ওই চোখে মুগ্ধতা? কেন থাকবে না? নীরার হঠাৎ কান্নায় হতভম্ব হয়ে পড়ল অন্তু। বিস্মিত চোখে চেয়ে থেকে বলল,
‘ সমস্যাটা কি?’

‘ সমস্যাটা কি?’
অন্তুর প্রশ্নে মাথা নিচু করল নীরা। বাঁধ ভাঙা কান্নায় ফুঁপিয়ে উঠে বলল,
‘ মাকে মনে পড়ছে।’
নীরার উত্তরে হতভম্ব চোখে চেয়ে রইল অন্তু। এতো বড় মেয়ে মায়ের জন্য কাঁদছে? আশ্চর্য! নীরাকে কখনোই মা নেউটা বলে মনে হয়নি অন্তুর। সব সময় হোস্টেলে থেকেই পড়াশোনা করেছে সে। মাসের পর মাস বাড়িমুখো হতেও দেখা যায়নি তাকে। অন্তু শান্ত দৃষ্টিতে নীরার কান্না দেখল। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে হঠাৎই প্রশ্ন করল,
‘ কেউ কিছু বলেছে?’
নীরা চোখ তুলে তাকাল। ভেজা চোখদুটোতে একঝাঁক প্রশ্ন নিয়ে বলল,

‘ হু?’
অন্তু ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল। বইটা বন্ধ করে নীরার দিকে ফিরে বসল। নরম কন্ঠে বলল,
‘ আব্বা-আম্মা কিছু বলেছে? বকাঝকা করেছে?’
অন্তুর প্রশ্রয় মাখা কন্ঠে কান্নার বেগ যেন বেড়ে গেল নীরার। ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকিয়ে মাথা নুইয়ে অসম্মতি জানাল। ছোট্ট করে বলল,
‘ না।’
‘ তাহলে হঠাৎ কান্নাকাটি কেন?’
নীরা জবাব দিল না। অন্তু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ঘরের আলোটা নিভিয়ে দিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,
‘ এতো রাতে রূপগঞ্জ যাওয়া সম্ভব নয়। সবচেয়ে সম্ভবপর কাজ হলো ঘুমিয়ে পড়া। আলো জ্বালিয়ে ঘুমের অসুবিধা করব না। আমি বাইরে যাচ্ছি।’
কথাটা বলে ঘুরে দাঁড়াতেই ব্যস্ত হয়ে বলে উঠল নীরা,

‘ বাইরে কোথায়?’
অন্তু ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। অন্তুকে কপাল কুঁচকে চেয়ে থাকতে দেখেই থতমত খেয়ে গেল নীরা। ডানহাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছে মাথা নোয়াল। ভারি অসহায় কন্ঠে বলল,
‘ আমার একা থাকতে ভয় লাগছে।’
অন্তু জবাব দিল না। কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ চেয়ে থেকে ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল। শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বিছানায় এসে বসল। শার্ট পাল্টে টি-শার্ট পরল। টেবিলের উপর থেকে পানির গ্লাসটা তুলে নিয়ে গলা ভেজাল। তারপর বিছানা ছেড়ে দক্ষিণের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। দরজাটা খানিক ভেজিয়ে দিয়ে সিগারেট ধরাল। নীরা বেশ কিছুক্ষণ ভেজানো দরজার দিকে চেয়ে থেকে লম্বালম্বিভাবে শুয়ে পড়ল খাটে। অন্তুর মতো একহাত কপালে রেখে অন্যহাতে শাড়ির আঁচল খামচে ধরে চোখ বন্ধ করল। সাথে সাথেই চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল কয়েক ফোঁটা জল। এই প্রেমপিপাসু, জন্ম দুঃখিনী রমণী জানতেই পারল না গভীর রাতে জানালার ওপাশ থেকে এক জোড়া মুগ্ধ চোখ ঘুরাফেরা করছিল তারই অঙ্গজুড়ে। শাড়ির ভাজে ভাজে থাকা প্রতিটি কার্ভের গভীরতা মাপতে মাপতেই ছাড়ছিল রাশি রাশি ধোঁয়ার বহর।

রাত একটা। শব্দহীন এয়ারকন্ডিশনে হিমশীতল ঘরের পরিবেশ। দেয়ালে টাঙানো বিশাল টেলিভেশনের স্ক্রিনে বন্ধুদের ছবি ভাসছে। একের পর এক অগোছালো ছবি। পাশের সাউন্ডবক্স থেকে বাজছে মাইক শিনোদার গাওয়া প্রিয় একটি গান। মেঝেতে মাথা রেখে বিছানার উপর পা তুলে দিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে শুয়ে ছিল ছোঁয়া। মাথার পাশেই ধোঁয়া উঠা গরম কফির কাপ। চারপাশে ম্যাগাজিন আর বইয়ের ছড়াছড়ি। ঘরের আলো নেভানো। টেলিভেশনের মৃদু আলো এসে পড়ছে ছোঁয়ার মোমের মতো সাদা গায়ে। ছোঁয়া পা নাচাতে নাচাতে গানের সাথে ঠোঁট মেলানোর চেষ্টা চালাল,

‘ Looking for, trying to open doors.
Ringing bells, sending them to hell.
Or sitting by my side, expecting no surprise.
When it’s about love, nothing will work….’
ছোঁয়া হঠাৎ উঠে বসল। রিমোটের বোতাম টিপে গান বন্ধ করল। জীবনে প্রথমবারের মতো প্রিয় গানটাকে বিরক্তিকর, অর্থহীন বলে বোধ হলো তার। কি ভেবে, ইংরেজি গান পাল্টে বাংলা গান চালাল। নিস্তব্ধ রাতে এই প্রথমবারের মতো হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠ শুনে মুগ্ধ হল ছোঁয়া। গানের কথাগুলো আনমনেই গুনগুন করতে লাগল মনে,

‘ চঞ্চল মন আনমনা হয় যে তার ছোয়া লাগে
ভোরের আকাশে আলো দেখে পাখি যেন………. ‘
ছোঁয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলল। জানালার ভারী পর্দাটা সরিয়ে দিয়ে তারা ভরা আকাশের দিকে তাকাল। আচ্ছা? অস্ট্রেলিয়ার আকাশেও কি এমনই তারা হয়? তার দেশের মতোই এতোটা আপন আর নিজস্ব লাগে সব? উত্তরহীন মন নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে ছোঁয়া। পর্দাটা আবারও টেনে দিয়ে চোখ ফিরিয়ে টেলিভিশনের পর্দায় তাকায়। মাম্মার কথামতো, আজ ছোঁয়ার মনটা দূর্দান্ত ভালো থাকার কথা। কিন্তু ছোঁয়ার মনটা ভালো থাকছে না। মন ভালো থাকার মতো আহামরি কিছু খুঁজেও পাওয়া যাচ্ছে না। অস্ট্রেলিয়ান মিষ্টার পার্ফেক্টের সাথে ঘন্টাময় কথা বলেও আলাদা কোনো অনুভূতি তার হয়নি। লোকটির সুন্দর মুখশ্রী, ভদ্র ব্যবহার, পার্ফেক্ট সেন্স অব হিউমার তাকে মুগ্ধ করেনি। এই লোকটিকে সে বিয়ে করতে চলেছে বলে আলাদা উত্তেজনাও তার হয়নি।

সবকিছু খুব স্বাভাবিক মনে হয়েছে। যতটা স্বাভাবিক নতুন কোনো ড্রেস পেলে হয় ঠিক ততটা স্বাভাবিক। বিশেষ কিছু নয়। ছোঁয়া টেলিভিশন বন্ধ করে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। চোখ বন্ধ করে সাইম নামক ছেলেটিকে ভাবতে চেষ্টা করল। চেষ্টা সফল হলো না। সাইমের জায়গায় রিসেন্টলি পড়া বইটির ছবি ভেসে উঠল চোখে। ছোঁয়া আবারও চেষ্টা করল এবং অবাক হয়ে আবিষ্কার করল, সাইমের চেহারাটা তার মনে পড়ছে না।

নীল চিরকুট পর্ব ৪৭+৪৮

কি আশ্চর্য! যার সাথে আজ বাদে কাল বিয়ে তার চেহারাটাই ভুলে গেল ছোঁয়া? বিরক্তিতে চোখ মেলে তাকাল ছোঁয়া। মাম্মা বলেছিল, সাইমকে নিয়ে ভাবলেই সফ্ট কর্ণার তৈরি হবে। সাইম দারুণ একটি ছেলে। ছোঁয়ার উচিত এই দারুণ ছেলেটির প্রেমে পড়ে যাওয়া। বিয়ের আগেই আন্ডারস্ট্যান্ডিং স্ট্রং করা। কিন্তু এমন কিছুই তো হচ্ছে না। ছোঁয়া চেষ্টা করেও প্রেমে পড়তে পারছে না। প্রেমে পড়ার মতো কঠিন কাজটা নমু আর নীরু কি করে করে ফেলল সেটাও বুঝতে পারছে না। ছোঁয়ার কি কিছু টিপস নেওয়া উচিত?

নীল চিরকুট পর্ব ৫১+৫২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here