নীল চিরকুট পর্ব ৭+৮

নীল চিরকুট পর্ব ৭+৮
নৌশিন আহমেদ রোদেলা

শক্ত হাতের টানে রেলিং থেকে সরে দাঁড়াল নম্রতা। চোখে-মুখে আতঙ্ক। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অবিরাম জল। শরীরটা ভয়ানকভাবে কাঁপছে। নম্রতার ফ্যাকাশে মুখ দেখে সামনে দাঁড়ানো শ্যামবর্ণ মানুষটি আৎকে উঠল। আতঙ্কিত কন্ঠে বলল,
‘ আপনি ঠিক আছেন?’

নম্রতা হিংস্র দৃষ্টিতে সামনে দাঁড়ান মানুষটির দিকে তাকাল। শ্যামকায় দীর্ঘদেহী পুরুষ। শক্তপোক্ত গড়ন। পুরু ভ্রুজোড়ার নিচে গভীর দুটো চোখ। গায়ে বাদামী রঙের পাতলা শার্ট। হাতাদুটো কনুই পর্যন্ত গুটানো। ডানহাতে ল্যাপটপ। নম্রতা বাঘিনীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল মানুষটির ওপর। হাত থেকে ল্যাপটপটা ছিনিয়ে নিয়ে রেলিং-এ দুই দফা আছাড় লাগাল। শ্যামকায় মানুষটি বিস্ময়ে হতভম্ব। নম্রতা ল্যাপটপটা নদীতে ছুঁড়ে ফেলতেই সম্বিৎ ফিরে এলো মানুষটির। খানিকটা ধাতস্থ হয়ে ভয়ানক গমগমে কন্ঠে বলল,
‘ পাগল আপনি? কী করলেন এটা? আপনার কোনো ধারণা আছে? আমার কত বড় ক্ষতি করলেন আপনি।’
ততক্ষণে নম্রতার বন্ধুরা নিচে নেমে এসেছে। নম্রতাকে এমন বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে বিস্মিত তারা। রঞ্জন আতঙ্কিত কন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘ নমু? ঠিক আছিস? কী হয়েছে? এভাবে কাঁপছিস কেন?’
নাদিম ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলল,
‘ এই শালায় কিছু করছে নাকি তোরে? ক খালি। এইহানেই পু্ঁইতা ফেলুম। কি হইছে?’
নাদিম আর রঞ্জনের উঁচু কন্ঠে আরো কিছু যুবক পেছনে এসে দাঁড়াল। সামনের দিকে উঁকি দিয়ে কপাল কুঁচকে প্রশ্ন ছুঁড়লো তাদের একজন,
‘ এনিথিং রং আরফান? কি হয়েছে রে?’
রাগে স্তব্ধ আরফান রক্তলাল চোখে বন্ধুর দিকে তাকাল।
‘ শী ড্যামেজড মাই ল্যাপটপ।’
‘ মানে?’

‘ নদীতে ছুঁড়ে ফেলেছে ল্যাপটপ। ভাবতে পারছিস? আমার রিসার্চের পুরো ফাইল ছিল ল্যাপটপে।’
‘ কিহ! কিন্তু কেন? এই মেয়ে? পাগল নাকি আপনি? আপনার কোনো ধারণা আছে কী করেছেন আপনি? এসব পাগল ছাগলকে লঞ্চে উঠতে দেয় কে?’
নীরা ফুঁসে উঠে বলল,
‘ একদম ফালতু কথা বলবেন না। নমু অযথা হাঙ্গামা করার মেয়ে নয়। আপনার বন্ধু কী করেছে সেটা আগে বিবেচনা করুন। লঞ্চে উঠেও থার্ডক্লাস স্বভাব যায় না আপনাদের? দেখে তো ভদ্রলোকই মনে হচ্ছে। কী করেছেন আমার ফ্রেন্ডের সাথে? বলুন।’

দুই দলের মধ্যে তুমুল হট্টগোলের মধ্যেই হাউমাউ কান্নায় ভেঙে পড়ল নম্রতা। মুহূর্তেই থেমে গেল হট্টগোল। সবাই বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল কান্নারত মেয়েটির চোখে-মুখে। নম্রতার বন্ধুরা অস্থির হয়ে উঠল। লঞ্চের পাটাতনে হাঁটু গেঁড়ে বসে থাকা নম্রতার পাশে ধপ করে বসে পড়ল নীরা-ছোঁয়া। নম্রতা দু-হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে ডুকরে উঠছে। কান্নার শব্দটা বিশাল জলরাশিতে ঘুরেফিরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। কী বিষাদময় সে কান্না! আরফানের বন্ধুরা কিছুক্ষণ হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে দ্বিধা নিয়ে প্রশ্ন করল,
‘ কী হচ্ছে এসব দোস্ত? কাহিনীটা কী? কাঁদছে কেন এই মেয়ে?’
আরফান বিপন্ন কন্ঠে বলল,

‘ আমি কী করে বলব? কেবিনে যাচ্ছিলাম হঠাৎ ইশতিয়াক ধাক্কা দিল। ধাক্কাটা সামলে উঠতে পারি নি। উনার সাথে শরীরটা একটু লাগতেই দেখি নিচের দিকে ফিরে চিল্লাপাল্লা করছেন। ভাবলাম পড়ে যাচ্ছেন। হাত টেনে সরিয়ে আনতেই নাটক শুরু করল। উফ! আমার রিসার্চ রিপোর্ট!’
নীরা অশ্রুরুদ্ধ কন্ঠে বলল,
‘ এই নমু? এভাবে কাঁদছিস কেন? কী হয়েছে? বল আমাদের।’
কান্নায় শ্বাস আটকে আসছে নম্রতার। জোরে জোরে শ্বাস টেনে আবারও কান্নায় ভেঙে পড়ল নম্রতা। জড়ানো কন্ঠে বলল,
‘ আম আমার ডায়েরি!’
এটুকু বলেই গগনবিহারী চিৎকারে কান্নায় ভেঙে পড়ল নম্রতা। অন্তু কপাল কুঁচকে বলল,
‘ কী হয়েছে ডায়েরির?’
‘ পা পা পানিতে ফেলে দিয়েছে এই লোক।’
আরফান অবাক হয়ে বলল,
‘ আমি! কখন!’
আরফানের বন্ধু কড়া মেজাজে বলল,

‘ ফাজলামো পাইছেন নাকি? একটা ডায়েরির জন্য আপনি গোটা ল্যাপটপ ছুঁড়ে ফেলবেন? ল্যাপটপের দাম জানেন? একটা ল্যাপটপে কত ইম্পোর্টেন্ট ডকুমেন্টস থাকতে পারে ধারণা আছে?’
এবার রেগে উঠল নাদিমও। খেঁকিয়ে উঠে বলল,
‘ একটা ডায়েরি মানে কী? আপনার ল্যাপটপ থেকে ওর ডায়েরি কম দামী নয়। ফিল দ্যা ইমোশন।’
রাগে মাথার ভেতরটা ধপধপ করছে আরফানের। নাদিমের কথায় রাগটা যেন দপ করে জ্বলে উঠল তার। অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের কন্ঠে বলল,

‘ আচ্ছা! আপনাদের কাছে নিজেদের বস্তাপঁচা আবেগ এতোটাই গুরুত্বপূর্ণ যে অন্যের…. ‘
এটুকু বলতেই অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটে গেল। সবাইকে অবাক করে দিয়ে হিংস্র বাঘিনীর মতো আরফানের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার চেষ্টা করল নম্রতা। হতভম্ব আরফান দু’পা পিছিয়ে দাঁড়াল। নম্রতার হাঁতের আচঁড়ে কব্জির ওপর দিকটার চামড়া উঠে জ্বালাপোড়া করছে। রঞ্জন দু’হাতে জাপটে ধরে নম্রতাকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালাল। নম্রতা চেঁচিয়ে উঠে বলল,

‘ খবরদার বস্তাপঁচা আবেগ বলবেন না। আমার ডায়েরি আমার আবেগ নয়, ভালোবাসা।’
নীরা দু’হাতে মুখ চেপে হতভম্ব চোখে তাকিয়ে আছে। এই প্রথম নম্রতাকে এমন উদ্ভট আচরণ করতে দেখছে সে। নম্রতার মতো বিচক্ষণ, প্রাণোবন্ত মেয়ে এমন গেঁয়ো, অসভ্য আচরণ কী করে করতে পারে? বিশ্বাস হয় না নীরার। কয়েকটা চিঠি আর কয়েকটা বছরে কী থেকে কী হয়ে গেল মেয়েটা? রঞ্জন নম্রতাকে জোরপূর্বক পাঁজাকোলে নিয়ে নিজেদের কেবিনের দিকে হাঁটা দিল। যেতে যেতে আরফানকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘ সরি ভাইয়া। আসলে ও একটু ডিপ্রেসড।’
আরফান জবাব দিল না। আরফানের পাশে থাকা বন্ধুটি ঝাঁঝ নিয়ে বলল,
‘ নিজের ডিপ্রেসড গার্লফ্রেন্ডকে সামলায় রাখেন মিয়া। লঞ্চ না তো নাট্যশালা। নাটক শুরু করে দিছে একেকজন। আজাইরা।’
নাদিম খেঁকিয়ে উঠে বলল,

‘ তুই সরি কইলি ক্যান? নমুর এই অবস্থা না থাকলে শালাগো দেইখা দিতাম আজকে।’
অতঃপর আবারও কথা কাটাকাটির সূত্রপাত হলো। রঞ্জন দাঁড়িয়ে না থেকে নম্রতা, নীরাকে নিয়ে তিন তলায় নিজেদের কেবিনের দিকে রওনা দিল।
কেবিনের পাটাতনে হাঁটু ভাঁজ করে বসে আছে নম্রতা। মাথাটা হাঁটুর ওপর নুয়ানো। কান্নার দামকে কিছুক্ষণ পর পরই কেঁপে উঠছে শরীর। কেবিনের দরজায় হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে রঞ্জন। তারপাশে চিন্তিত অন্তু। ছোঁয়া-নীরা বিছানার উপর বসে আছে। নাদিম বারান্দার রেলিং-এ ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সবার মুখই থমথমে। স্তব্ধ নীরবতাকে ঠেলে দিয়ে কথা বলে উঠল ছোঁয়া। হতাশ কন্ঠে বলল,

‘ কী একটা কাহিনী করে ফেলল নমু। ছিঃ মানুষ কী ভাবছে! এতোটা সীনক্রিয়েট করার কী প্রয়োজন ছিল? এমন গেঁয়ো আচরণ কী নমুর সাজে? আমাদের কতটা লো ম্যান্টালিটির ক্ষেত ভাবছে তারা।’
ছোঁয়ার কথার জবাবে টু শব্দটি পর্যন্ত করল না কেউ। কেবল কড়া চোখে তাকাল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে ভয়ানক রাগে ধমকে উঠল নাদিম,
‘ তুই তো জন্মগত ক্ষেত ম্যান্টালিটির মহিলা। বন্ধুর দুঃখে তোর মানসম্মানের প্রশ্ন আসছে। তোরে এই মুহুর্তে লঞ্চ থেকে ছুঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। নদীতে হাবুডুবু খেতে খেতে ম্যান্টালিটি বিচার করবি। বেয়াদব।’
নাদিমের কথায় নিভে গেল ছোঁয়া। বেচারী এতোদিক ভেবে বলেনি কথাগুলো। কী থেকে কী হয়ে গেল! বিরবির করে বলল,

‘ লোকটা তো আর ইচ্ছে করে ডায়েরি ফেলে দেয় নি। ধাক্কা লেগে পড়ে গিয়েছে। নমু যে তার ল্যাপটপটাই ফেলে দিল।’
নাদিম কপাল কুঁচকে বলল,
‘ তো? যেভাবেই ফেলুক। ফেলেছে তো? আর নমুই বা ইচ্ছে করে ফেলল কোথায়? রাগের মাথায় ফেলে দিয়েছে। রাগ উঠলে মানুষ যেকোনো কিছু করতে পারে। অত ধরতে আছে? ওই শালাদের উচিত নমুর পা ধরে মাফ চাওয়া। এদের নামে আমি মামলা করব। মানহানির সাথে ডায়েরিহানির মামলা।’

এমন একটা পরিস্থিতিতেও নাদিমের কথায় ঠোঁট চেপে হেসে ফেলল সবাই। নাদিম সব সময়ই এমন। বন্ধুরা হাজার দোষ করলেও সব দোষ মাফ। এমনকি পরীক্ষায় নাম্বার কম পেয়ে বন্ধুদের মন খারাপ হয়ে গেলেও সব দোষ স্যারের। বন্ধুরা তো পরীক্ষা দিয়েছিলই শালার স্যার যদি নাম্বার না দেয় তাহলে বন্ধুদের কী দোষ? এসব স্যারকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করে দেওয়া উচিত। নম্রতাকে হাজার বুঝানোর পরও যখন তার কান্নার গতি কমলো না। তখন সবার মিলিত সিদ্ধান্তে একা ছেড়ে দেওয়া হলো তাকে। পাঁচজনে গিয়ে বসল বারান্দায়। কীভাবে নম্রতাকে স্বাভাবিক করা যায় তা নিয়ে চলল তুমুল আলোচনা। আধঘন্টা- একঘন্টার মাঝে কান্নার বেগ কিছুটা কমে এলো নম্রতার। বামপায়ে থাকা সাদা পায়েলটির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে খুলে নিল হাতে। পায়েলটাকে খুব যত্ন করে বুকের সাথে চেপে ধরে চোখ বোজল। দীর্ঘসময়ের কান্নায় মাথাটা ধপধপ করছে তার। চোখদুটো ভয়ানক জ্বলছে। সেই সাথে জ্বলছে অবুঝ, অভাগা মন।

তখন এপ্রিল মাস চলছিল। বাংলায় বসন্ত। ঋতুরাজ সেবার রাজার মতোই দাপট নিয়ে এসেছিল নম্রতার জীবনে। ষোলো বসন্ত পেরিয়ে সতেরোতে এসে সুগন্ধি ফুলে ফুলে ভরিয়ে দিয়েছিল নম্রতার জীবন। নম্রতাদের প্রমালাপনের তখন প্রায় দেড় বছর চলে। কারো মুখে ভালোবাসার শব্দ উচ্চারিত না হলেও দু’জনেই জানে ভালোবাসাহীন শব্দগুলোর গভীরতা। ভালোবাসার স্পষ্ট প্রকাশও খুব বেশিদিন চাপা থাকতে পারল না। ওপাশের মানুষটি খামে পুড়ে পাঠাল উথাল-পাতাল প্রেম বার্তা। নম্রতার এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হয়েছিল মাত্র। প্রথম পরীক্ষাটা দিয়েই মা-বাবাকে ছাইপাঁশ বুঝিয়ে চলে গিয়েছিল শাহাবাগ।

ক্লান্ত শরীরে এক ঝাঁক আশা নিয়ে হাতে তুলে নিয়েছিল চির পরিচিত বইটি। প্রত্যাশিত চিঠিটা পেয়ে বুক ভরা উত্তেজনা নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল সে। বাড়ি ফিরে চিঠিটা খুলেই চমকে উঠেছিল নম্রতা। লজ্জায় লাল হয়েছিল। আবেগে কেঁদে-কেটে চোখ ফুলিয়েছিল। অপরিচিত মানুষটার সেই প্রেমময় চিঠি পড়লে আজও একই রকম কেঁপে কেঁপে উঠে নম্রতা। পাগল করা অনুভূতিতে দমবন্ধ হয়ে আসে। আচ্ছা? কী এমন মেশানো ছিল সেই চিঠিতে? নম্রতা জানে না। কিন্তু সেই চিঠিটা পড়লে আজও রাতে ঘুম হয় না। চিঠির শব্দবানে আহত হয়ে ঘুম কাতর নম্রতার রাতের ঘুম হারাম হয়। সারাটা রাত ক্ষণে ক্ষণে চিঠিটা পড়ে কেঁদে বুক ভাসায়। আবার কখনো লাজুক হাসিতে মত্ত হয়। নম্রতা চিঠির লাইনগুলো মনে করার চেষ্টা করল। মুহূর্তেই মুখস্থ হয়ে যাওয়া লেখাগুলো চোখের পাটাতনে স্পষ্ট হয়,

‘ প্রিয়…..
চলো একবার প্রেমে পড়ি। অদ্ভুত নীল ব্যথায় মড়িয়া হয়ে উঠি দুটো প্রাণ। দিনশেষে তুমি একটু কাঁদো। চোখের নিচে ছড়িয়ে পড়া কাজল রেখায়, আমি একটু মুগ্ধ হই। দীর্ঘ বিচ্ছেদ শেষে হঠাৎ দেখা হলে যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে, ঠিক সেভাবেই আমার রুক্ষ বুকটিতে ঝাঁপিয়ে পড়ো। আমার বুকে চলা নিত্য দিনকার টানাপোড়েন, চেনা জানা ঝড়গুলো একবারের জন্য হলেও থেমে যাক। তোমার কান্নাভেজা ফোলা চোখে একটি বার আমি ডুবে যাই। লাল-নীল ব্যথাগুলো রক্তে রক্তে ঘুরে বেড়াক। তোমাকে পাওয়ার তীব্র বাসনায় আমি একটু ছিন্নভিন্ন হই। তোমাকে দেখার আকুতিতে চোখের ঘুমগুলো মুক্তি পাক। তোমাকে হারানোর ভয়ে গভীর রাতে আমার পুরুষ চোখে জল নামুক। চলো শ্যামলতা, আমরা একবার প্রেমে পড়ি। মারাত্মক প্রেমে আহত হয়ে যাই দুজনেই। প্রেমময় ব্যথায় কেঁপে কেঁপে উঠি।
ইতি
শ্যামলতার ব্যক্তিগত সে ‘

সেই চিঠিতেই প্রথম নিজের সম্বোধনে কিছু একটা লিখছিল সেই মানুষটি। চিঠির সাথে কসটেপে আটকে দিয়েছিল অসম্ভব সুন্দর এক পায়েল। সেই সাথে ছিল কয়েকটি চ্যাপ্টা হয়ে থাকা বেলীফুল। কী তীব্র সুগন্ধ ছিল সেই বেলীফুলের। নম্রতা সারারাত নাকের কাছে নিয়ে বসেছিল সেই চিঠি। পায়েলটা পায়ে জড়িয়ে অযথায় ঘুরে বেড়িয়েছে পুরো ঘর জুড়ে। যখনই পায়েলে রিনঝিন শব্দ উঠেছে তখনই মনে হয়েছে সেই মানুষটি হাসছে। নম্রতার পাগলামোতে ঝংকার দিয়ে হেসে উঠছে সে। সারারাত ছটফট করে পরের দিন সকালেই গ্রন্থাগারে ছুঁটে গেল নম্রতা। গ্রন্থগারের গেইটে বিশাল তালা ঝুলতে দেখে মনে পড়ল, আজ শুক্রবার।

শনিবারেও বন্ধ থাকবে গ্রন্থাগার। হতাশ, চঞ্চল, অস্থির নম্রতার পরের দু’দিন পড়াশোনা কিছু হলো না। ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষাটা সে কোনোরকম না পড়েই সমাধা করল। দিন-রাত ‘সে’ ‘সে’ করেই মন- মস্তিষ্ক জমাট বেঁধে গেল তার। রবিবার সকালে উঠেই গ্রন্থাগারের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। গ্রন্থাগার খুলতেই নীল রঙা খামে নিজের পায়েল পরা পায়ের একটা ফটো রেখে দিল নম্রতা। ধুরুধুরু বুক নিয়ে গ্রন্থাগার থেকে বেরিয়েই সেকী লজ্জা তার। কে জানে? পায়ের ছবি দেখে কী ভাববে সে? ছবিটা পাঠানো কী ঠিক হলো? এমন সব দ্বিধামাখা প্রশ্ন নিয়েই কেটে গেল প্রায় একটা সপ্তাহ। অস্থিরতা আর অনিশ্চয়তা নিয়েই একের পর এক পরীক্ষা সমাধা করল নম্রতা। পুরোপুরি এক সপ্তাহ পর আকাঙ্খিত চিঠিটা এলো। টকটকে নীল রঙা দুটো কাগজ ভরে শুধু একটাই লাইন,
‘ তোমার পায়ের তিলটা নেশাতুর। ভাবনাতীত সুন্দর।’

সেই এক লাইন দিয়ে ভর্তি চিঠিটা পেয়ে গলা শুকিয়ে গিয়েছিল নম্রতার। বুকের ভেতর থাকা হৃদপিণ্ডটা কী দ্রুতই না কাঁপছিল। আজও, আজও উপলব্ধি করতে পারে নম্রতা। আজও তার শরীরে ঘাম ছুটে। মুখটা হয় লজ্জায় রক্তিম। তারপর চিঠির উল্টো পাশে লেখা ওই লাইনটা, ‘ আমি মারাত্মক প্রেমে আহত। শ্যামলতাকে না পেলে এই প্রেমিকের মৃত্যু অনিবার্য!’ ইশ! মানুষটা কী অসভ্য কথা লিখেছিল সেদিন। প্রতিটি শব্দকে লজ্জার সাগরে জিইয়ে নিয়ে ছুঁড়ে মেরেছিল নম্রতার সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত শরীরে। এই লজ্জাবান কী মারাত্মকভাবেই না বিঁধেছিল নম্রতার প্রেমাহত মনে! নম্রতা শিউরে উঠে। ডায়েরি হারানোর ব্যথায় ভেতরটা চিনচিন করে উঠে! এই নিষ্প্রয়োজন জীবনটা নিয়ে কী করবে নম্রতা?

সকাল সাতটায় লঞ্চ হালুয়াঘাটে এসে পৌঁছাল। কেবিনের বিছানায় গুটিশুটি হয়ে শুয়ে থাকা নম্রতার ঘুম ভাঙল সবার পর। বন্ধুরা তখন ব্যাগ কাঁধে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। নম্রতা ভারী মাথা নিয়ে উঠে বসল। নীরা নিজের আর নম্রতার ব্যাগটা পাশে রেখে নম্রতার কপালে হাত রাখল। কপাল কুঁচকে বিজ্ঞদের মতো মুখভঙ্গি করে বলল,
‘ জ্বর তো কমই মনে হচ্ছে। হাঁটতে পারবি?’

নম্রতা কিছুক্ষণ অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। আশ্চর্য! রাতে তার জ্বর এসেছিল? নীরা আবারও একই প্রশ্ন করতেই মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়াল নম্রতা। মাথাটা ভার ভার লাগছে। চোখে-মুখে পানি ছিঁটাতে পারলে হয়ত কিছুটা শান্তি লাগত। চোখদুটোতেও ব্যথা হচ্ছে খুব। নীরার সহযোগীতায় চোখে-মুখে পানি দিয়ে কিছুটা ধাতস্থ হয়ে কেবিন থেকে বেরুতেই একটা পেটমোটা ডায়েরি ধরিয়ে দেওয়া হলো হাতে। নম্রতা প্রশ্নমাখা চোখে বন্ধুদের দিকে তাকাতেই নাদিম দাঁত কেলিয়ে বলল,
‘ এই ডায়েরিতে মোট পয়ত্রিশটা চিঠি আছে দোস্ত। কাল রাত জাইগা এই চিঠিগুলো লিখছি আমরা। যখনই মন খারাপ হবে বসে বসে পড়বি। আমরা কী কম সুন্দর চিঠি লিখি নাকি? তোর পত্রপ্রেমিক থেকে একটু কম ভালো হলেও ভালোই লিখি।’

কথাটা বলে থামল নাদিম। নম্রতার দিকে খানিকটা এগিয়ে এসে গলা খাঁকারি দিল। তারপর ফিসফিস করে বলল,
‘ শোন, আমার চিঠিগুলাতে দু-একটা বানান ভুল হইতে পারে।’
নম্রতা ভ্রু বাঁকিয়ে তাকাতেই ঠোঁট উল্টে বলল,
‘ আচ্ছা যা সাত-আটটা ভুল হইতে পারে। ব্যাপারটা ইগনোর করিস। চিঠি লেখাটাই ফ্যাক্ট। কয়টা বানান ভুল হলো সেটা কিন্তু ফ্যাক্ট না।’
নম্রতা ঠোঁট চেপে হাসল। হাতে থাকা রোদ চশমাটা পরে নিয়ে বাঁকা হাসল অন্তুও। কৌতুক করে বলল,
‘ তোর ফিসফিসানি কথা পুরো লঞ্চের মানুষ শুনছে ভাই। মানসম্মান আর রাখলি না। ঢাবির স্টুডেন্ট হয়ে বাংলা বানান ভুল? আস্তাগফিরুল্লাহ!’
নাদিম গুজগুজ করে বলল,

‘ ধুর বাল! ইংরেজিতে এসাইনমেন্ট লিখতে লিখতে মাতৃভাষা ভুলে যাচ্ছি। ইউ শ্যুড প্রটেস্ট, বুঝলি? এই স্যারেরা কোনো কাজের না। আকামের ঢেঁকি সব।’
নাদিমের কথায় ঠোঁটে হাসি নিয়ে মাথা নাড়ল সবাই। ব্যাগ কাঁধে লঞ্চ থেকে নামার উদযোগ করল। নাদিম লঞ্চ থেকে নামতে নামতে অন্তুর কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
‘ আজ এতো মাঞ্জা মারছ মামা? কাহিনী কিতা? কোন সুন্দ্রীকে গায়েল করতে চায় তোমার মন? হ্যাঁ হ্যাঁ?’
অন্তু চমৎকার এক হাসি দিয়ে বলল,
‘ তোর বোনেরে। হেব্বি দেখতে। আমার হাতে তুলে দে। পরের বছরেই মামা ডাকার সু্যোগ-সুবিধা ফ্রী।’
নাদিম অন্তুকে লাথি দিয়ে বলল,

‘ তুই আসলেই খারাপ। শালা হারামখোর।’
অন্তু হু হা করে হেসে উঠে বলল,
‘ শালা ডাকছ কেন শালা? দুলাভাই ডাক। শালা তো ডাকুম আমি। শালা, ও শালা। শালা মশাই।’
অন্তুর কথায় অন্তুকে ধাওয়া করল নাদিম। ভীরে মাঝে ছুটতে ছুটতে বলল,
‘ তোরে তো আজ খাইছি।’
অন্তু-নাদিমের কথায় হেসে উঠলো বাকিরা। ভীরের মাঝে উচ্ছল হাসি নিয়ে ছুটতে থাকা দু’জন তরুনের দিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল অনেকেই। ছোঁয়া-নীরা কিছুটা এগিয়ে যেতেই পেছন থেকে দৌঁড়ে এসে নম্রতার পাশাপাশি হাঁটতে লাগল রঞ্জন। নম্রতার হাত থেকে লাগেজটা নিজের হাতে নিয়ে অন্যহাতে সানগ্লাস পরল। নম্রতার দিকে তাকিয়ে কপাল কুঁচকাল,

‘ কী রে? খুদা টুদা পেয়েছে তোর?’
নম্রতা ম্লান হেসে মাথা নাড়ল। নাদিমের দেওয়া ডায়েরিটির দিকে দৃষ্টি রেখে বুক ভরে শ্বাস নিল। ঠোঁটের হাসি ধরে রেখে বলল,
‘ আমি ঠিক আছি দোস্ত। চিন্তা করিস না।’
রঞ্জন প্রথমেই কিছু বলল না। সামনের ভীরটা অতিক্রম করার পর মুখ খুলল,
‘ ভাগ্যে বিশ্বাস করিস নমু?’
‘ হু, করি।’

‘ তাহলে সবটা ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দে। সবকিছুর পেছনেই তো কোনো না কোনো কারণ থাকে। তোর কিশোরী বয়সের প্রথম প্রেমিক হারিয়ে যাওয়া। স্মৃতিময় ডায়েরিটা নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়া সবকিছুর পেছনেও নিশ্চয় কারণ আছে। সৃষ্টিকর্তা হয়ত এমন কিছুই চাইছেন। লাইফে মুভ অন কর। অতীত খামঁচে ধরে পড়ে থাকলে তো চলে না। অন্য কাউকে সুযোগ দে। সুযোগ না দিলে বুঝবি কী করে? মানিয়ে নিতে পারবি নাকী পারবি না?’
নম্রতার চোখ দুটো ছলছল করে উঠল। রঞ্জনের চোখের দিকে তাকাতেই জমে থাকা জলটুকু মুক্ত হলো। সূর্যের আলোয় ফর্সা গালে জলের রেখাগুলো চিকচিক করে উঠল। রঞ্জনের পুরুষ মন ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,

‘ যে প্রেমিকের তরে এই রমণীর চোখ ভাসে। সেই নিঃস্ব প্রেমিকের কী কখনও মন হাসে?’
দূর থেকে নাদিমের দৃষ্টি আকর্ষণময় ডাকে ভাবনা কাটল রঞ্জনের। তাদের থেকে বেশ কিছুটা দূরে একটা রেস্তোঁরার সামনে দাঁড়িয়ে আছে নাদিমরা। রঞ্জন তাদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়তেই দৃঢ় কন্ঠে বলল নম্রতা,
‘ জীবনের সব পরিস্থিতিতে যুক্তি খাটে না দোস্ত। অনুভূতির মামলায় যুক্তি বেচারা বড্ড অসহায়। আমার ক্ষেত্রেও তাই ঘটছে। আমি পারছি না সরে আসতে। আর না পারতে চাইছি। আর না এই বিষয়ে কোনরূপ ডিসকাশন শুনতে চাইছি। চারটা বছর ধরে এইসব কথায় শুনে আসছি আমি। আর কত?’

এক দমে কথাগুলো বলে নিয়েই দ্রুত পা চালালো নম্রতা। রঞ্জন দৌঁড়ে গিয়ে ওর সঙ্গ নিল। বলল,
‘ আচ্ছা বেশ। আলোচনা-সমালোচনার দরকার নেই। তুই যেমন আছিস থাক শুধু হ্যাপি থাক। মন খারাপ করে থাকিস না। আচ্ছা, গান শুনবি?’
নম্রতা ভ্রু বাঁকিয়ে তাকাল। সুদর্শন রঞ্জন মন ভুলানো হাসি দিয়ে গলা ছেড়ে সুর টানলো,
‘ আমার কাছে তুমি মানে সাত রাজার ধন
আমার কাছে তুমি মানে অন্যরকম।
আমার কাছে তুমি মানে আমার পোষা পাখি,
দিনে রাইতে চোখ বুজিয়া তোমায় আমি দেখি।
তোমার কাছে হয়তো বন্ধু আমি কিছু না,
তাইতো তোমার স্বপ্নে বন্ধু আমি আসি না।
আমি মানে তুমি আর তুমি মানে আমি,
আমার কাছে আমার চেয়ে বন্ধু তুমি দামী।’
রঞ্জনের গান শুনে সেখান থেকেই গিটারে সুর তুলল নাদিম। উটপটাং লাফাতে লাফাতে চেঁচাতে লাগল,
‘ আহা! আহা!’

অন্তু মসৃণ ছিটি বাজিয়ে সুন্দর হাসল। নম্রতা হেসে ফেলে রঞ্জনের ধুমধাম কিল বসাল। হাসি ফুটল নীরা আর ছোঁয়ার ঠোঁটেও। রঞ্জনের গান থামল না। রেস্তোরাঁয় কোণার একটা টেবিল ঘিরে বসে একের পর এক গান চলতে লাগল আড্ডায়। নাদিম গিটার আর অন্তু টেবিল বাজিয়েই আড্ডা জমিয়ে তুলল। রঞ্জনের অদ্ভূত গানে কখনও বা সুর মেলাতে লাগল, কখনও-বা হেসে কুটি কুটি হতে লাগল নীরা-নম্রতা-ছোঁয়া। রেস্তোঁরায় থাকা অধিকাংশ খদ্দের মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল সোনালি সকালে ফুটে উঠা একদল উচ্ছল তরুণ-তরুণীদের। সকালের নাস্তা এলো ডিম,পরোটা আর দই। ধীরে সুস্থে নাস্তা শেষ করে চারপাশটা ঘুরে ফিরে দেখল ওরা। কিছুক্ষণ পা ছড়িয়ে ঘাটে বসে রইল। সমস্বরে গান গাইল। সারাটাক্ষন ফূর্তিতে মেতে রইল প্রতিটি প্রাণ। দশটায় লঞ্চ আসতেই তাড়াহুড়ো করে উঠে গেল তাতে। উদ্দেশ্য কুতুবদিয়া।

লঞ্চ ছাড়ার পর হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল সবাই। ঠিক তখনই মন খারাপের মেঘ এসে জমা হলো নম্রতার আকাশে। সেই সাথে এলো কান্না। এতোক্ষণ চেপে রাখা আক্রোশগুলো চামড়া ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইল।চিঠির ওপাশের মানুষটির কলার চেপে বলতে ইচ্ছে করল, ‘ কেন করলে তুমি এমন? সত্যিই হারালে? নাকি ধোঁকা দিলে? আমাকে মরণ যন্ত্রণায় ফেলে এভাবে পিছুতে পারলে তুমি? একটুও কষ্ট হলো না?’ এই উত্তরগুলোর জন্য হলেও নম্রতা তাকে খুঁজতে চায়। অপেক্ষা করতে চায়। এই উত্তরগুলো না পেলে যে তার ভালো থাকা হচ্ছে না। কিছুতেই না। তাছাড়া, ওই বেয়াদব লোকটিকেও ছাড়বে না নম্রতা। আবার দেখা হলে, শক্ত কয়েকটা চড় লাগাবে। ধাক্কা দিয়ে ডায়েরি ফেলে দিয়ে আবার আবেগ নিয়ে ছেরখানি! এতো বড় সাহস!

কুতুবদিয়া পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় সন্ধ্যা হলো। এখানকার স্থানীয় একটা হোটেলে উঠেছে তারা। আজকের রাতটা কাটিয়ে সকালের লঞ্চে চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজার পৌঁছাবে। অন্ধকার আকাশে মেঘ করেছে। ঝড় হওয়ার সম্ভবনা প্রবল। চারপাশে উলোট পালোট হাওয়া। সেই হাওয়ায় উড়ে চলেছে নীরার অস্থির চুল, ওড়না। বারান্দার থামে ঠেস দিয়ে ফোনালাপ সারছে সে। চোখে-মুখে চাপা উৎকন্ঠা। হরিণীর মতো টানাটানি চোখে অল্পবিস্তর দ্বিধা। খানিক দূরে বসে থেকে এসবই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল অন্তু। আড্ডায় মশগুল রঞ্জন, নাদিম একপর্যায়ে থেমে গেল। অন্তুর দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে নীরার দিকে তাকাল। দু’জনেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে একে অপরের দিকে তাকাল। নাদিম ফট করে বলে ফেলল,

‘ এইবার ঢাকায় ফিইরা তোগো দুইডারে কাজি অফিসে ঢুকাইয়া তালা মাইরা দিমু। খুলতাম না। তোগো এসব পারু-দেবদাসের কাহিনী আর ভাল্লাগতাসে না।’
অন্তু কপাল কুঁচকাল। দৃঢ় কন্ঠে বলল,
‘ ক্যারা দেবদাস? ওর জন্য দেবদাস হওয়া লাগব? এতো বাজে দিন আসে নাই আমার।’
‘ হ। ওইডা তো তোর চোখ দেখলেই বুঝা যায়। দোস্তের দিকে এমন কামুক দৃষ্টিতে তাকাইতে তোর বিবেকে বাজে না?’
অন্তু নিরুত্তাপ কন্ঠে বলল,
‘ প্রথম যখন তাকাইছিলাম তখন তো আর দোস্ত ছিল না। সাধারণ সুন্দরী মেয়ে ছিল। দেখতেই প্রেমে পড়ে গেলাম। আর সেও আমাকে ফ্রেমেবন্ধী করার পায়তারা করতে লাগল। এই মেয়ের যন্ত্রণাতেই মরে যাব একদিন, দেখিস।’
রঞ্জন ফুঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

‘ বুঝিয়ে বললেই পারিস।’
‘ আর কত বুঝাব? তিনটা বছর ধরে তো বুঝাচ্ছিই। আমি কী দেখতে খুব খারাপ? আমার মধ্যে পছন্দ করার মতো কিচ্ছু নাই? একটা গুণও না?’
কথাগুলো বলতে গিয়ে গলা কেঁপে উঠল অন্তুর। চোখদুটো হয়ত একটু টলমলও করে উঠল। রঞ্জন অন্তুর কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
‘ কি বলিস এগুলো? তুই আর খারাপ দেখতে? মাইয়ারা তাহলে কী দেইখা পটে যায়, বল তো মামা। ফালতু চিন্তা বাদ দে। নীরা বুঝবে। সময় দে ওরে।’
নাদিম অসহায় চোখে তাকাল। হতাশ কন্ঠে বলল,
‘ এল্লায় ভাল্লাগে না বাল। নীরুর জায়গায় অন্যকেউ হইলে থাপড়া মাইরা ঠিক কইরা ফেলতাম। কিন্তু নীরুও তো আমাগোই দোস্ত। কারে কী কই বল তো? যন্ত্রণার এক শ্যাষ। শালা তুই প্রেমে পড়ার জন্য আর কোনো মেয়ে পাইলি না?’

নীল চিরকুট পর্ব ৫+৬

অন্তু ঠোঁটে চাপা হাসি নিয়ে বলল,
‘ পাইছিলাম তো। তোর বোনেরে। দিলি না। ছ্যাঁকা!’
নাদিম ওর দিকে তেড়ে এসে বলল,
‘ তোর লাইগা হুদ্দাই সেমপ্যাথি আসে। তোরে তো মাইরা ফেলানো উচিত।’
‘ তোর বোনের জন্য জান কুরবান শালা মশাই।’
রঞ্জন এবার হুহা করে হেসে উঠে। নাদিমের মুখ তখন রাগে আগুন।

নীল চিরকুট পর্ব ৯+১০

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here