নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ১৫
সিনথিয়া
ক্ষুরের মতো ধারালো দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে রেজা। বাংলা না বুঝলেও এটুকু বুঝেছে যে, আরশির পাশে বসতে চাওয়াই ওর উপর শেহজাদের চড়াও হওয়ার কারণ। তবুও শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“হোয়াট ডিড ইউ জাস্ট সেয় প্রফেসর?”
মানুষটার কালো বুট শব্দ তুলে এগিয়ে আসলো ওর কাছে।
“আই সেইড লিভ মাই ওয়াইফ এল্যোন অর আই উইল মেইক ইউ লিভ দিস ওয়ার্ল্ড উইথাউট ইভেন এনি ট্রেস!”
কানের পাশে মুখ নিয়ে কথাখানা বলেই রেজাকে এক প্রকার ছুড়ে ফেললো শেহজাদ। কয়েক কদম পিছিয়ে গেলো ছেলেটা।
বিমূঢ় মুখখানা লাল হলো অপমানে। আশেপাশে ফিসফিস শব্দ বাড়লো ওদের ঘিরে। উৎসুক ছাত্র-ছাত্রীর ভীড় দেখে তটস্থ আরশি। ভীত আনন রক্তশূন্য হওয়ার উপক্রম।
সেদিকে তাকিয়ে নিজের জেদে আর অটল থাকা হলো না রেজার। কাঙ্ক্ষিত সিটটা ছেড়ে দিলো পরাজিত সৈন্যের মতো। ঢোক গিলে গিয়ে বসলো অন্য পাশে।
কিন্তু ঘাড় ঘুরিয়ে মেয়েটাকে আরেকটা বার দেখতে গিয়ে চোখ আটকালো শেহজাদের আরশির পাশে বসার দৃশ্যে। মুহূর্তেই শ্যামলা হাত মুষ্টিবদ্ধ হলো ওর। চোয়াল কাঁপলো ক্ষোভে। বিক্ষুব্ধ মন নিঃশব্দে আওড়ালো,
“এন্ড আই উইল মেইক ইউ পেয় ফর দিস প্রফেসর! জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ!”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
পোর্টেবল টেবিলে সজোরে ল্যাপটপের ব্যাগ রাখার আওয়াজে কেঁপে উঠলো কিশোরী। কপালে ভাজ ফেলে চাইলো শেহজাদের দিকে। দোনোমোনোয় জিভ খসে বেরিয়ে এলো,
“প্রফেসরদের জন্য আলাদা সিট থাকতেও বসা নিয়ে এমন ছেলেমানুষী কেনো করলেন আপনি?”
আরশির প্রশ্নে ঠোঁট কামড়ে হাসলো মানুষটা। বসে থেকেই ঝুঁকে এলো ওর মুখের সামনে।
“তুমিই তো বলো আমি বুড়ো! আর বুড়ো হয়ে ছেলেমানুষী কি মানাবে আমাকে? নেহাৎ আমার সিটে কফি পড়ে গেছিল, তাই এখানে এসে বসেছি!”
বিশ্বাস হলো না আরশির। কৃষ্ণকালো চোখজোড়া ছোট ছোট হয়ে এলো সন্দেহে।
“তাহলে ফাঁকা জায়গা তো ওপাশেও ছিল! সেখানে কেনো বসলেন না?”
শেহজাদের কন্ঠের দুষ্টুমি ফুরিয়ে এলো অমনি। ছেয়ে গেলো ভিন্ন কোনো প্রগাঢ়তায়।
নীলাভ নয়নে হন্ন হয়ে ছুটে বেড়ালো ভালোবাসার স্বীকারোক্তি।
“তুমি যেটা শুনতে চাচ্ছো, সেটাই বলি তাহলে? হ্যাঁ তোমার কাছাকাছি থাকার জন্য এখানে বসেছি। এই বুড়ো মুখটা ছাড়া যে অন্যকোনো মুখ সহ্য হয়না তোমার পাশে! কি করবো বলো! ”
মানুষটার খাদে নামানো গলা কিশোরীর বুকের গতি থামালো। নিশ্বাস ফেলতেও যেনো ভুলে বসলো হৃদযন্ত্রটা। কল্পনা আর বাস্তবের দোলাচলে থাকা আরশির ধ্যান ভাঙলো ফের
ঐ একই স্বরে,
“এই নাও! বইটা ধরো!”
দুম করে স্বপ্ন ভাঙায় আহত মন নড়েচড়ে বসলো। রয়েসয়ে তাকালো শেহজাদের নিরেট মুখে। পরপর চোখ গিয়ে পড়লো মানুষটার হাতে থাকা পরিচিত একটা ইংলিশ নোভেলের উপর।
“ আপনি আমার বই কোথায় পেলেন?”
“দেখলাম ব্যাগে জায়গা হচ্ছিল না দেখে টেবিলের উপর রেখে আসছিলে! তাই সঙ্গে করে নিয়ে এলাম! না লাগলে বলো, অন্য কাউকে দিয়ে দেই!”
বললেই হলো! আরশির এতো শখের বই! অন্য কাউকে দিয়ে দেয়ার তো প্রশ্নই আসে না। সে ঝড়ের গতিতে শেহজাদের হাত থেকে লুফে নিলো বইখানা। বিড়বিড় করে বললো,
“গল্পে ডুবে থাকলে অন্তত এই বোরিং জাম্বুবানটার পাশে বসেও পনেরো-ষোলো ঘন্টা আমার আরামসে কেটে যাবে!”
কিন্তু বিধিবাম! সেটাও শুনে ফেললো শেহজাদ। বিলিতি চোখে দুষ্টুমি এসে ভিড়লো অমনি! ল্যাপটপে আঙুল চালাতে চালাতে বললো,
“তুমি আমাকে যতটা বোরিং মনে করো, আমি কিন্তু ততটাও বোরিং নই মিসেস চার্লি…চ্যাপলিন! তোমার ঐ গল্পের বইয়ের নায়কগুলোর মতো রোম্যান্স আমিও করতে জানি ! প্রুফ চাই?”
হাড় কাঁপানো শীতের রাত। বিকেল চারটা বাজতেই অমানিশার চাদর জড়ালো লন্ডনের শহরগুলো। সাথে বৃষ্টির মতো প্যাঁচপ্যাঁচে তুষারপাত। এই ঠান্ডায় ইউনিফর্ম পড়ে ডিউটিতে না যাওয়া মানুষটা একটু পরপর এটা ওটার ছুতোয় বারবার হাজির হচ্ছে জারার রুমে।
“একটা মুভি দেখবে বাটারফ্লাই? হরর মুভি?”
জারা বই থেকে মাথা তুলে চাইলো শব্দের উৎস খুঁজতে। তখনই নজর আটকালো দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো সুঠাম পুরুষে। হাতে এক বাটি পপকর্ণ আর মুখে একান-ওকান জোড়া হাসি নিয়ে যে অপেক্ষায় তার প্রিয়দর্শিনীর।
“আপনার ব্যাপারটা কি বলুন তো মশাই? আমাকে এতো তেল দিচ্ছেন কেনো হঠাৎ করে? আপনাকে কিছু বলছি না মানে কিন্তু এই নয় যে আমি আর রেগে নেই আপনার উপর!”
মেয়েটার কথায় আয়ানের হাসি-হাসি মুখটা হাওয়া ছেড়ে দিলো অমনি। তেল? নিজের মানুষকে কেউ বুঝি তেল দেয়?
টাইলসের মেঝেতে তাকিয়ে তিক্ত হাসলো অফিসার। চলে যাওয়ার আগে শুধু বললো,
“আমি আরো ভাবলাম আমরা বোধ হয় বন্ধু হয়ে গেছি বাটারফ্লাই! বাট ইটস্ ওকেই! তুমি পড়ছো যখন, আর ডিস্টার্ব করবো না তোমায়!”
কেমন একটা মন খারাপ করা দমকা বাতাস এসে লাগলো জারার বুকে। ওর কথায় কি কষ্ট পেলো লোকটা? একবার গিয়ে সরি বলে আসবে আয়ানকে?
পরপরই চিন্তাগুলো ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে পড়ায় মনযোগ বাড়ালো কিশোরী। কাজের ফাঁকে হোমওয়ার্ক আর এসাইন্টমেন্ট গুলো এগিয়ে না রেখে টার্ম ব্রেকের আরামটুকু হারাম করতে চায় না ও।
কিন্তু সেই মনযোগ আর বাড়তে পারলো কই? সেটা তো কখন আয়ান পপকর্ণের সাথে নিজের রুমে নিয়ে চলে গেছে।
মেজাজ খারাপ হলো জারার। বইয়ের একটা শব্দও মাথায় ঢুকছে না ওর। ঘুরে ফিরে খালি ঐ একটা মুখই ভাসছে চোখের সামনে।
ঠোঁট গোল করে শ্বাস ফেললো মেয়েটা। ছোট ছোট চুল গুলে কানের পিছনে গুঁজে নেমে পড়লো বিছানা ছেড়ে। পরনের ট্রাউজার আর হুডি ঠিক করে তাকালো ঘড়ির দিকে। বারোটা বাজতে এখনো পাঁচ মিনিট বাকি।
কিন্তু আয়ানের রুমের দিকে এগোতে নিয়েও যেনো থেমে গেলো পা জোড়া। এতো রাতে মানুষটার রুমে যাবে নাকি যাবে না এই দ্বিধা কাঁটিয়ে ওঠার আগেই বাতি নিভে গেলো ওদের ফ্ল্যাটের।
পুরোনো বিল্ডিং! জেনারেটর চালু হতে হতেও যে অনেকটা সময় নেবে সেটা জারা জানে।
উপায়ন্তর না পেয়ে অন্ধকারেই হাতড়ে বের হলো রুম থেকে। কিন্তু আয়ান বলে ডাকতেই থমকালো ও।
এক হাতে ছোট্ট একটা কাপকেকের উপর বিশাল বড় মোমবাতি নিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে কেউ একজন। কাছে এসে দাঁড়াতেই বেসুরো গলায় জন্মদিনের গান গাইতে শুরু করলো পরিচিত সেই কন্ঠ।
এই প্রথম মোমের নরম আলোয় আয়ানের শুভ্র আনন প্রেমের আঁচড় কাটলো কিশোরীর বুকে। সেদিকেই হুশ হারিয়ে তাকিয়ে রইলো মেয়েটা। কিন্তু বড্ড তাড়াহুড়ো দেখালো অফিসার!
“ঝটপট একটা উইশ করে ফেলো তো বাটারফ্লাই! পুরো বাসা খুঁজেও একটা ছোট মোমবাতি পেলাম না জানো! তারপর এটাকে ধরে এনেছি! তবে কখন গলে কেকের ক্রিম হয়ে যায় বলা যাচ্ছে না!”
জারা যেনো নেই এই দুনিয়ায়! চোখের সামনে তুড়ি বাজালো আয়ান। তবুও ঘোর কাটলো না ওর। সেভাবেই বলে উঠলো,
“আপনি কি করে জানলেন কাল আমার জন্মদিন?”
“ভাগ্যিস সন্ধ্যায় তোমার আশ্রমের দাদা-দাদুরা ভিডিও কলে এতো আস্তে তোমাকে বার্থডে উইশ করলো!
তুমি ফ্ল্যাটের বাইরে বেরিয়ে দেখো! শুধু আমি না! এতক্ষণে সবাই জেনে গেছে যে কাল তোমার জন্মদিন!”
এবারে হেসে ফেললো মেয়েটা। সেই হাসিতে চোখের কোটর ভিজলো ওর! আঁতকে উঠলো আয়ান। তড়িঘড়ি শুধলো,
“কাঁদছো কেনো বাটারফ্লাই? কেক পছন্দ হয়নি তোমার! মানলাম সাডেন প্ল্যান ছিল বলে বড় কেক জোগাড় করতে পারিনি। তাই বলে এভাবে কাঁদবে?”
জারা চোখের পানি মুছে চাইলো মানুষটার দিকে। নাক টেনে বললো,
“কোথায় কাঁদলাম? এই যে হাসছি আমি!”
ঠোঁট টিপলো আয়ান। ঝুঁকে এসে বুড়ো আঙুল দিয়ে মেয়েটার নাক মুছে বললো,
“তা ম্যাম! পৃথিবীর কোন হাসিতে নাক দিয়ে পানি পড়ে একটু বলবেন আমায় প্লিজ!”
অপ্রস্তুতে নাক মুছলো জারা। ইতিউতি বিব্রত দৃষ্টি ফেললো ও। লজ্জার রক্তিম আভা এসে গাল ছুঁতেই আবারও কেক কাঁটতে তাগাদা দিলো অফিসার।
তার মানে কিছু মনে করেনি আয়ান৷ অবশেষে পদ্মফুলের ন্যায় মুখে ফের হাসি ফুটলো ওর। মোমবাতি নিভিয়ে কেক কাঁটলো মেয়েটা। তবে কেকের টুকরো আয়ানের মুখের সামনে ধরতেই তারস্বরে ফোন বেজে উঠলো আয়ানের।
বিরক্ত হলো মানুষটা। শুভ্র কপালে ভাজ পড়লো। ‘চ’ সূচক শব্দ করলো মনে মনে। কল আসার আর সময় পেলো না?
এতো সুন্দর মূহুর্তটা এভাবে নষ্ট হয়ে গেলো?
মুখ কালো করে পকেট হাতড়ে ফোনটা বের করলো সে। কিন্তু কল রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে কোনো এক কনস্টেবল পশ্চিমা ভাষায় হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
“স্যার ইমেডিয়েটলি আপনাকে একবার থানায় আসতে হবে! এখানে লুট হয়েছে। কয়েকজন অফিসার গুরুতর আহত। আমরা অল্প ক’জন অক্ষত আছি। প্লিজ আপনি তাড়াতাড়ি আসুন!”
পেন স্টেশন থেকে শিকাগো ইউনিয়ন স্টেশন; তারপর সেখান থেকে গাড়ি করে ও’হেয়ার আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর। ক্লান্ত মুখগুলো কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার ছুটলো গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।
এফ নাইন ফ্লাইট ধরে চার ঘন্টায় ফিনিক্স পৌঁছোলেও গাড়ি করে সোজা গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন ভিলেজে আসতে আসতে ভোর হলো ওদের।
এতো এতো স্টুডেন্ট! যদিও ডিপার্টমেন্টের কেউই তাদের দায়িত্বে বিন্দু মাত্র অবহেলা করেনি। তবুও সবাইকে গাইড করে ঠিকঠাক মতো নিয়ে আসতে বেশ হিমশিম খেয়েছে প্রফেসররা। বিশেষ করে শেহজাদ।
ট্রেন থেকে নেমে অবধি এই পর্যন্ত একবারও সুযোগ পায়নি আরশির সাথে কথা বলার। কিন্তু বাজ পাখির মতো ঠিকই নজরে রেখেছে বউকে। রেজার ছায়াও এসে পড়তে দেয়নি মেয়েটার ওপর।
পুরো সকাল ভিলেজে বিশ্রাম আর খাওয়া-দাওয়ার পরপরই সবাই নেমে পড়েছে হাইকিং এর জন্য। যেনো এতো সুন্দর জায়গায় এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করতে নারাজ ওরা।
প্রায় দু’ঘন্টার মধ্যেই সবাই পৌঁছোলো ব্রাইট এঞ্জেল হাইকিং ট্রেইলে। সাউথ রিমে অবস্থানরত এই ট্রেইলটি ক্যানিয়নের ভিতর দিয়ে প্রায় এক মাইল নিচে নেমে গেছে। রঙ বেরঙের পাথরের স্তর, খাড়া ঢাল আর পাখপাখালিতে ভরপুর এক অপূর্ব নৈসর্গিক সৌন্দর্যের মূল কেন্দ্রবিন্দু কিন্তু কলোরাডো নদী।
আর ট্রেইলের নিচ থেকে বয়ে চলা এই কলোরাডো নদী দেখার আগ্রহেই যেনো এনার্জি দ্বিগুন হলো সবার। সমস্ত ক্লান্তি চাপা পড়ে গেলো হুল্লোড় আর শোরগোলে।
পিঠে হাইকিং ব্যাগ নিয়ে যাত্রা শুরু করলো ওরা। স্টুডেন্টদের পিছনে কয়েকজন ট্যুর গাইড থাকলেও শেহজাদ এবং অন্যান্য প্রফেসরদের থাকতে হলো দলটির সামনে।
আর তখনই ঘটলো অঘটনটা। কিছুদূর যাওয়ার পরই চেঁচিয়ে উঠলো একটা মেয়ে কন্ঠ। পশ্চিমা ভাষায় সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,
নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ১৪
“সবাই দাঁড়াও! টিমের একজনকে পাওয়া যাচ্ছে না!”
থমকে গেলো শেহজাদের পা। কান খাড়া করে কথাটা শুনতেই দৌঁড়ে আসলো পিছনে। উদভ্রান্তের মতো চোখ জোড়া এদিক ওদিক খুঁজলো আরশিকে। কিন্তু না! কোত্থাও যখন পেলো না মেয়েটাকে তখনই সন্দেহ মিলে গেলো ওর।
দুশ্চিন্তায় কপালে ঘাম জমলো। এক হাতে মুখ চেপে অস্পষ্টে আওড়ালো,
“ আরশি? আরশি ইজ মিসিং?”