নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ১৬
সিনথিয়া
মিনিট বিশেক আগের ঘটনা। ক্যাম্পিং এর পুরো টিমটা যখন হাইকিং ট্রেইল অনুসরণে ব্যস্ত তখনই মাঝরাস্তায় থেমে যায় আরশি।
অদূরে কিছু একটা দেখে দল ছেড়ে পা বাড়ালো সেদিকে।
পরনের অ্যান্টি-স্লিপ সোলযুক্ত জুতোজোড়া বরফ ভেঙে এগিয়ে এসে দাঁড়ালো একটা কটনটেইল রেবিটের সামনে। ক্যানিয়নের সবচাইতে ভীতু প্রাণী। সচারাচর এদের দেখা মেলে না। কিন্তু আজকে বেচারির নড়বার শক্তিটুকু নেই। গাছের একটা মোটা ডাল ভেঙে পড়ে আছে গায়ের উপর। টেনে হিচড়ে শরীরটুকু বের করতে পারলেও পা আঁটকে গেছে ডালের ফাঁকে।
আরশির বুক ভেঙে এলো খরগোশটার অবস্থা দেখে। অল্প ঝুঁকে গ্লাভস পড়ে থাকা হাতেই গায়ের সমস্ত শক্তি লাগালো ডালটা সরানোর জন্য। সফলও হলো একটা সময়। কিন্তু ততক্ষণে ভীষণ দেরি হয়ে গেছে ওর। খরগোশটাকে বাঁচাতে পারলেও হারিয়ে ফেললো দলের অন্যদের। আরশিকে রেখেই অনেকটা দূরে চলে গেছে দলের সবাই।
মেয়েটা দৌঁড়ে এলো আগের জায়গায়। কিন্তু সেখানে যে একটা নয়, দু’ দুটো সরু রাস্তা দুই দিকে। কি করবে! কোন পথ ধরে হাঁটবে! ভেবেই মাথায় হাত আরশির। কান্নাগুলো দলা পাকালো গলায়। হাঁটু ভেঙে বসে পড়লো ও। মেঘের দিকে তাকিয়ে ভেজা গলায় আওড়ালো,
“প্লিজ কাউকে একটা পাঠিয়ে দাও আমার খোঁজে খোদা!”
একে তো হিমাঙ্কের নিচে তাপমাত্রা। তারউপর ফোনে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না পাহাড়ি রাস্তায়। দূর দূর পর্যন্ত কোনো মানুষেরও চিহ্ন নেই। কিন্তু কোত্থেকে তুলো রঙা খরগোশটা এসে দাঁড়ালো ওর পায়ের সামনে।
আরশি তাকালো সেদিকে। খরগোশটাকে চিনতে পেরেই ঠান্ডার প্রকোপে শুকিয়ে যাওয়া মুখটায় হাসি ফুটলো ওর। এটাকেই তো বাঁচালো একটু আগে। খরগোশের দিকে হাত বাড়াতেই মাথা এগিয়ে দিলো ওটা। আদর চাই তার।
তখনই ওর পিছনে এসে দাঁড়ালো এক ছায়ামানব। ভারী ডাল দিয়ে দুম করে আঘাত বসালো মেয়েটার মাথায়। সূক্ষ্ম একটা শব্দ বাজলো কানের কাছে। মাথার পেছনে তীব্র যন্ত্রনায় বমি পেলো আরশির। উঠে দাঁড়ানোর শক্তি হারালো পা দুটো। ঘুরে তাকাতে শুধু দৃষ্টিগোচর একটা স্কেলিটন মাস্ক। মূহুর্তেই চোখের সামনে সবটা অন্ধকার হলো ওর! ক্ষীণ শরীরটা ঢোলে পড়লো বরফের গায়ে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“একটা সুস্থ মানুষ হাইকিং-এ এসে হারিয়ে গেলো আর এটা আপনাদের কাছে সিলি ম্যাটার মনে হচ্ছে? ”
শেহজাদের অনমনীয় কন্ঠে কাঁপলো পার্ক রেঞ্জাররা। পশ্চিমা ভাষায় কড়া কথাগুলো শুনে মিনমিন করে বললো,
“স্যার কাম ডাউন। উই উইল ট্রাই আওয়ার বেস্ট টু ফাইন্ড হার। ডোন্ট ওয়ারি!”
কিন্তু শান্ত হতে পারলো না মানুষটা। অস্থিরতা আড়াল করে ইংরেজিতেই বললো,
“আগামী এক ঘন্টার মধ্যে মিস আরশিকে না পাওয়া গেলে আপনাদেরকেও আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। কাইন্ডলি মাথায় রেখে দেবেন কথাগুলো!”
পার্ক রেঞ্জার দু’জন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। কথার পিঠে একজন আরেকজনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো চোরা চোখে। স্টুডেন্ট হারিয়ে গেছে বলে প্রফেসরের এমন রূপ তাদের ঠিক হজম হলো না ওনাদের।
অবশ্য পরে ভাবলো, এদের ভরসাতেই তো গার্জিয়ানরা ছেলেমেয়ে গুলোকে ছেড়েছে এতদূরে। খারাপ কিছু হলে কি তারা ছেড়ে দেবে কাউকে? তাই হয়তো এভাবে বলছে ইনি!
শেহজাদ দাঁড়িয়ে নেই। দৌঁড়ে গেলো কিছুটা পেছনে। অন্যরাও আসলো সাথে সাথে। আরশির নাম ধরে অনেকক্ষণ যাবত ডাকলো সবাই। কিন্তু লাভ হলো না। কোত্থাও নেই মেয়েটা।
ঘন ঘন শ্বাস ফেললো শেহজাদ। বিপদের আশঙ্কায় দামামা বাজলো বুকের ভেতরে। বিশ মিনিট হলো আরশি চোখের সামনে নেই ওর। তাতেই কি এতো অসহ্য যন্ত্রণা?
কপালে ভাজ ফেলে আশপাশে তাকাতেই মনে পড়লো ট্রেনের কথা। তখন থেকেই ছেলেটার হাবভাব অসুবিধের লাগছিল শেহজাদের কাছে। পরপর অন্যদের জিজ্ঞেস করে জানতে পারলো, ক্লান্ত লাগছে বলে রেজা নাকি আসেইনি ওদের সাথে হাইকিং -এ। বিশ্রাম নিতে ভিলেজেই নাকি থেকে গেছে সে!
তুষারপাতের সাথে শেহজাদের খটকা প্রবল হলো তখনই। আরশি একা একা হারিয়ে যাওয়ার মেয়ে নয়! ওকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আর কে নিয়েছে সেটাও খুব ভালো করে বুঝতে পারছে মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষগুলো।
হুট করে আবহাওয়াও বৈরী রূপ ধারণ করায় সবাইকে নিরাপদে ভিলেজে পাঠিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলো শেহজাদ।
কিন্তু বাঁধ সাধলো অন্য প্রফেসররা। শেহজাদকে ফেলে নড়বে না তারা। প্রয়োজনে ভিলেজ থেকে লোক নিয়ে আসবে আরশিকে খুঁজে বের করতে।
মাথা ঝাঁকালো মানুষটা। হাতে এতো সময় নেই ওর। আনত মুখ; পশ্চিমা ভাষায় ধীরে ধীরে বললো ,
“আমি যদি ফিরি মিস আরশিকে নিয়েই ফিরবো! তার আগে নয়!”
জ্ঞান ফিরেছে আরশির। কিন্তু চোখের পাতায় যেনো ইট বেঁধে রাখা। টেনে তুলতেও শরীরের সমস্ত শক্তি ফুরিয়ে আসলো ওর। হাল ছেড়ে দিলো মেয়েটা। ওভাবেই চোখ বন্ধ করে থাকলো।
মাথার পেছন টনটন করছে ব্যাথায়। রক্তও পড়েছে নিশ্চয়ই। পিঠের কাছটাতে কেমন চিটচিটে ভাব। জ্বলছে ভীষণ। না পেরে চোখ মেললো আরশি। আশপাশে তাকাতেই বুঝলো একটা মোটা গাছের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে ওকে। সামনে পিছনে এমন হাজারো গাছ; আর বরফের উঁচুনিচু ঢিবি।
অমনি গায়ে ঠান্ডা বাতাস হাতে এসে লাগলো ওর। লোম দাঁড়িয়ে গেলো সহসা। গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন ভিলেজে শেহজাদ নিজের ব্যাগে করে আনা একটা জ্যাকেট আরশির গায়ে পড়িয়ে দিয়েছিল; সবার অগোচরে। যেনো ঠান্ডা না লাগে মেয়েটার।
অবহেলায় সেটা পড়ে আছে বরফের ওপর। কানটুপি, মাফলার গ্লাভস; সেগুলোও লুটোপুটি খাচ্ছে মাটিতে। শুধু মাত্র পরনের সাদা টি-শার্ট আর জিন্স এখনো অক্ষত।
হুট করেই স্কেলিটন মাস্ক পড়া সেই লোকটা কতগুলো শুকনো কাঠ এনে ফেললো ওর সামনে। চমকে উঠলো আরশি। তবে ঘাবড়ালো না একটুও। বিপদকে দূর্বলতা দেখাতে নেই! চোয়াল শক্ত করে ইংরেজিতে বললো,
নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ১৫
“কেনো বেঁধে রেখেছেন আমাকে? আর আমার জ্যাকেট, মাফলার এগুলোতে হাত দেয়ার সাহস কি করে হলো আপনার?”
এই প্রথম মুখ খুললো লোকটা। পশ্চিমা ভাষায় কিছুটা যান্ত্রিক আর ভোঁতা স্বরে বললো,
“অবশ্যই কষ্ট দেয়ার জন্য! বরফের মধ্যে গাছের সাথে বেঁধে রেখেছি, নিশ্চয়ই গরম কাপড় সহ বাঁধবো না!”