নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ২৮
সিনথিয়া
ইয়ার্ডের সবুজ ঘাসের বুকে পুরু আস্তরণ বরফের। ঝিরিঝিরি তুষারপাত হচ্ছে পুরো শহরজুড়ে। তবে ঝিমিয়ে নেই আলোয় মোড়ানো নিউইয়র্কের রাত। কর্মব্যস্তগুলো মানুষজন ক্লান্ত পা বাড়িয়েছে নিজ নিজ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে! বিরতিহীনভাবে জ্বলজ্বল করছে ডিজিটাল বিলবোর্ডগুলোও।
হাসান ভিলায় আংটিবদলের পর্ব শেষ। এরপরই খাওয়া দাওয়ার পালা।
মেহমেদ হাসান ব্যস্ত সেদিকটায়। তবে মরিয়ম বেগম অনেকক্ষণ যাবৎই খুঁজছেন শেহজাদ আর আরশিকে। একটু আগেও তো ওনার পাশেই দাঁড়ানো ছিল। অনুষ্ঠান শেষ না হতেই হুট করে কোথায় গেলো দুটোতে?
ঠিক সেই সময়েই আরশির পিঠ গিয়ে ঠেকলো ওয়াশরুমের পাশের দেয়ালটায়। পেলব হাতদুটো মুঠোয় করে মাথার উপর উঠিয়েছে শেহজাদ। অন্যহাতে চেপে ধরেছে মেয়েটার মুখ!
“শশশ! এতো বেশি কথা কেনো বলো তুমি?”
আরশি ঐ অবস্থাতেও বললো অনেক কিছু। কিন্তু শুধু গোঙানির মতো শোনালো সেসব। বিরক্তিতে প্রফেসর হাত সরালো মুখ থেকে!
অমনি যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচল মেয়েটা।
বড়সড় চোখে চেয়ে আওড়ালো,
“মোটেই বেশি কথা বলিনি। আপনি ওয়াশরুমে আসার সময়ও বাচ্চাদের মতো আমার হাত ধরে টানবেন আর আমি কিছু বলতে–!”
ত্রস্ত নরম ঠোঁটে তর্জনী ছোঁয়ালো শেহজাদ। ঝুঁকে আসলো সামনে দিকে। নীল চোখজোড়ায় কালো মেঘের আনাগোনা। অন্ধকার হয়ে আছে ফর্সা মুখটাও। সেদিকে তাকিয়েও চোখ ফিরিয়ে নিলো আরশি। বুকের ভিতর তোলপাড় শুরু হলো মূহুর্তেই। ধুকপুক শব্দে লাফাচ্ছে হৃদযন্ত্রটা।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কিশোরীর নিয়ন্ত্রণ নেই তাতে। না নিয়ন্ত্রণ আছে রক্তবর্ণ ধারণ করা গালদুটোয়।
প্রফেসরের গলার স্বর ভারী। পরিপাটি করা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে গেছে আরশিকে এদিকটায় আনতে গিয়ে। কপালের উপর নিদারুণ অযত্নে পড়ে আছে সেগুলো। দাঁতে দাঁত পিষে বললো,
“আদি তোমার এতো প্রশংসা করবে কেনো?”
মেয়েটা হতবাক। হতবুদ্ধ মস্তিষ্ক সময় নিলো সবটা হজম করার। জাম্বুবানের মন খারাপ করার কারণ তার মানে এটা? তার প্রশংসা না করে ওর প্রশংসা করা হয়েছে দেখেই এতো রাগ। হিংসুটে বুড়ো কোথাকার!
“আমি ছাড়া আর কেউ তোমার প্রশংসা তো দূর; তোমার দিকে চোখ তুলেও তাকাতে পারবে না!”
দুম করেই কিশোরীর ভাবনারা হোঁচট খেলো ঐ একটা কথায়। দীঘির ন্যায় দীঘল চোখে বিস্ময়। তখনই ডান গালে আলতো করে হাত রাখলো শেহজাদ।
আরশি বোকা বোকা চোখে চেয়ে। সেদিকে তাকিয়েই যেনো খেই হারালো প্রফেসর। পদ্ম কুঁড়ির ন্যায় ঠোঁটে দখল বসালো হুট করেই। কোনো ফাঁক-ফোঁকর বাঁধ রাখলো না ঐ পাতলা ওষ্ঠপুটে নিজের আধিপত্য বিস্তারের।
নেশালো কন্ঠ। অল্প থেমে ঘন ঘন শ্বাস ফেলে আওড়ালো,
“আ’ম সরি! বাট আই নিড টু কাম মাই সেলফ ডাউন!”
আরশির অক্ষিপট কোটরের বাইরে বেরিয়ে আসতেই আরেকবার তপ্ত অধরজোড়া যেনো লুফে নিলো মেয়েটাকে।
তখনই ফোন বেজে উঠলো প্রফেসরের। অনবরত রিং হওয়ার শব্দে হুশ ফিরলো আরশির। কিছু একটা বলার জন্য
ছটফটালো মেয়েটা। হাঁসফাঁস টের পেতেই থামলো প্রফেসর। পরপর আস্তেধীরে হাতদুটো ছাড়লো মাথার উপর থেকে। ঠোঁট সরাতেই হাঁপিয়ে উঠলো আরশি।
অসাবধানে আরো একবার ঐ নীল চোখে চোখ পরলেও ত্রস্ত নামিয়ে নিলো তা। আনত মুখ। তর্জনী তুলে ধরলো শেহজাদের প্যান্টের পকেটের দিকে। অস্পষ্টে আওড়ালো,
“আপনার ফোন! বাজছে!”
আঙুল অনুসরণ করে সেদিকে তাকালো প্রফেসর। পরপর আবার ফিরে চাইলো আরশির দিকে। দাগ হওয়া ঠোঁটে বুড়ো আঙুল ছোঁয়ালো মেয়েটার। স্লাইড করতে করতে হাস্কি স্বরে বললো,
“ডোন্ট এভার লুক এট মি লাইক দ্যাট ডার্লিং! মাই ড্যাম পেশেন্স হেজ ইটস লিমিটস!”
উবার ডেকেছে আয়ান। ট্রলি নিয়ে বাইকে ওঠা ঝামেলা। আপতত থানায় যাবে। তারপর কাজ সেরে বাসা খুঁজবে। জারার ওপরে হওয়া রাগটা এখনো চড়ে আছে মাথায়। ভালোবাসে বলে যা খুশি তাই অপবাদ দেবে ওকে? চড়টা গায়ে লাগেনি তখন! কিন্তু কথাগুলো তো লেগেছে।
শ্বাস ফেললো অফিসার। গাড়ি চলে এসেছে ওর। তখনই বেজে উঠলো ফোনটা। পকেট হাতড়ে বের করতেই দেখলো জারা কল করছে। সমানে।
কপালে ভাজ ফেলে ঢোক গিললো আয়ান।
তবুও রিসিভ করলো না কলটা । উল্টে সুইচ অফ করে রেখে দিলো পকেটে।
কিন্তু গাড়ির দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতে গেলেই মনে পড়লো জারার ঐ কান্না ভেজা মুখ! সরিও তো বললো কতবার। এভাবে মেয়েটাকে ফেলে যাওয়া কি ঠিক হচ্ছে? এখন কলও রিসিভ করলো না? যদি আরো বেশি কান্নাকাটি করে?
থমকালো আয়ান। পেছালো দুকদম! না উঠেই গাড়ির দরজা লাগিয়ে গেলো ড্রাইভারের কাছে। ভাড়াটা হাতে ধরিয়ে পশ্চিমা ভাষায় জানিয়ে দিলো তার আর যাওয়া হবে না!
ঠোঁটে অল্প-বিস্তর হাসি নিয়ে ত্রস্ত পা বাড়ালো বাসার দিকে। গায়ে পুলিশের জ্যাকেট। চওড়া কাঁধে সাদা সাদা বরফের কুঁচি। চুলের উপরও এসে পড়লো কিছু। সেসব মাথায় নিয়েই পা-জোড়া এসে থামলো ফ্ল্যাটের গেটের সামনে। কিন্তু মুহূর্তেই মুখটা দপ করে নিভে গেলো ওর।
দরজা খোলা। ভেতরের সবকিছু ওলট-পালট। যেনো ইচ্ছে করে কেউ ভেঙে-চুড়ে রেখে গেছে সবকিছু।
আশেপাশে কোথাও জারা নেই। শুধু ওর রুমের দরজাটা বন্ধ। দৌড়ে সেদিকে গেলো অফিসার। বন্ধ দরজায় ধাক্কা দিলো কয়েকবার। জারা বলে ডাকও দিলো।
তবুও ভিতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ পেলো না। না পেরে শেষমেশ লাথি বসালো দরজার মাঝ বরাবর।
মুহূর্তেই খুলে গেলো ওটা।
হাঁপালো আয়ান। হেম চোখজোড়া খুঁজেও পেলো মেয়েটাকে।
রুমের এক কোনে গুটিশুটি মেরে বসে আছে জারা। হাত দিয়ে কান চেপে ধরে রেখেছে। ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে চেহারা।
হুট করে মাথায় কারোর হাত পড়তেই চোখ মেললো ও। আয়ান পাশে এসে বসেছে। পুরো শরীর কাঁপছে মেয়েটার। শুকিয়ে কাঠ গলবিল। কিছু বলতে গিয়েও কেশে উঠতে হচ্ছে বারবার।
অফিসার ঘাবড়ালো। তড়িঘড়ি টেবিলের উপরে রাখা পানির বোতলটা আনতে যাবে তখনই হাত চেপে ধরলো কিশোরী। মাথা নিচু করে ফ্যাসফ্যাসে কন্ঠে আওড়ালো,
“এ-একটা লোক। কেমন অদ্ভুত মাস্ক পড়া।একটু আগে এসে বেল বাজায়। আপনি এসেছেন ভেবে দরজা খুলতেই ভেতরে ঢোকার চেষ্টাও করে। কিন্তু আমি ঢুকতে দেইনি!”
আয়ান জড়িয়ে ধরলো জারাকে। মাথাটা বুকের সাথে চেপে হাত বুলালো চুলে!
“শশশ! আর কিছু বলতে হবে না! একটু থামো! একটু শান্ত হও!”
মেয়েটা থামে না! বলে যায়,
“কোনোমতে সামনের দরজা আঁটকে রুমে এসে পড়ি। আপনাকে কলও করেছি অনেকবার। কিন্তু আপনি ধরেননি!”
“আ’ম সরি! আ’ম সরি! আর কক্ষনো এমন হবে না বাটারফ্লাই! আর কোনোদিন তোমায় একা ফেলে কোত্থাও যাবো না!”
বুকটা কাঁপছে অফিসারের। জারার কিছু হয়নি ভেবেই যা একটু স্বস্তি ওর। নয়তো কি কোনোদিন ক্ষমা করতে পারতো নিজেকে?
মেয়েটাকে বুকে নিয়ে উঠে দাঁড়ায় ও। রুম থেকে বের হতে যাবে তখনই দেখে মেইন দরজায় চিরকুট লাগানো। ও ভিতরে ঢুকতে লাগিয়ে রেখে গেছে কেউ একজন। তাতে গোটা গোটা অক্ষরে ইংরেজিতে লেখা,
“এটাতো কেবল ট্রেইলার ছিল অফিসার। ইনভেস্টিগেশন বন্ধ না করলে আসল মুভি দেখার জন্য প্রস্তুত রাখুন নিজেকে।”
প্রফেসরের নির্বিকার হুমকি। আরশির আর দাঁড়িয়ে থাকা হলো না। হাঁটু ভেঙে এলো যেনো কথার মানে ধরতে পেরে। কাঁপা কাঁপা হাতে কোনোমতে ঠোঁট হতে আঙুল সরালো শেহজাদের। পরপর
এক ছুটে পালালো সামনে থেকে।
অধর কামড়ে হাসলো প্রফেসর। পকেট হাতড়ে ফোন বের করলো সেদিকে তাকিয়েই৷ কিন্তু কল রিসিভ করে কানের কাছে ধরতেই শুনতে পেলো এক অপরিচিত পুুরুষ কন্ঠ! ভরা গলায় ছড়া কাঁটছে,
“টুইংকেল টুইংকেল লিটেল স্টার..
হাউ আই ওয়ান্ডার হোয়াট ইউ আর”
শেহজাদের চোখ-মুখ শক্ত! ধারালো চোয়াল মটমট শব্দ তুললো মূহুর্তেই। থেমে থেমে শুধোলো,
“হু…আর… ইউ?”
ফোনের ওপাশ হতে উত্তর এলো পশ্চিমা ভাষায়,
“কিছু মনে পড়লো প্রফেসর? এক বড় ভাই তার ছোট বোনকে কোলে নিয়ে হেঁটে হেঁটে ঘুম পারাচ্ছে আর এই ছড়াটা বলছে! হাউ এডোরেবল!”
প্রফেসরের কপালের রগগুলো দপদপ করলো আক্রোশে! ক্ষিপ্ত স্বরে ধৈর্য্যের বাধ ভাঙলো তার!
“ হু দ্য ফা–”
পুরোটা বলার আগেই ওপাশ হতে ফের ভেসে এলো সেই কন্ঠ!
“ ইয়র লিল প্রিন্সেস সিস্টার! রুশা! ডু ইউ নো দ্যাট শি ইজ স্টিল এলাইভ?
শেহজাদ স্তব্ধ! মাথায় শুধু ঘুরছে শেষের কথাগুলো! রুশা বেঁচে আছে? ওর ছোট্ট বোনটা বেঁচে আছে?
কিন্তু কে এই লোক?
শক্ত করে ফোন চেপে ধরায় আঙুলের গাঁটগুলো সাদা হলো ওর।
“রুশা কোথায়?”
দীর্ঘ এক শ্বাস ফেললো লোকটা।
“ গিভ এন্ড টেক পলিসিতে আসুন প্রফেসর!
আপনি আপনার ওয়াইফকে আমার হাতে তুলে দিন আর বোনকে নিয়ে যান! সহজ হিসেব!”
শেহজাদের গলার স্বর অনমনীয়। দাঁতে দাঁত পিষে ইংরেজিতেই বললো,
নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ২৭
“আমার ওয়াইফ আর বোনের উপর নজর দেয়ার আগে নিজের কবরটাও খুঁড়ে রাখিস! নয়তো আমি ধরলে মরার পর মাটিটুকুও পাবি না!”
হেসে উঠলো আগন্তুক। যেনো ভীষণ মজার কিছু শুনেছে! লাইনটা কাঁটার আগে পশ্চিমা ভাষায় শুধু আওড়ালো,
“ ‘মিডটাউন সেভেনথ এভিনিউ!’ আগামীকাল ঠিক সন্ধ্যে সাতটায়। দেখা হচ্ছে তাহলে?”