নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৩২
সিনথিয়া
“আরশি..টাওয়াল টা?”
স্থুল স্বরে ধ্যান ভাঙলো আরশির। আচানক প্রশ্নে ঠিক বুঝতে পারলো না কি চাইছে প্রফেসর!
শেহজাদ তখনও বের হয়নি। বিশ্রামহীন পানির আওয়াজ জানান দিলো এখনো শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে তিনি।
তাই বলে পুরো এক ঘন্টা লাগাবে? বেরই বা হবে কখন, আর আরশি জানবেই বা কখন কে মেসেজ দিলো ওনাকে!
“টাওয়ালটা একটু নিয়ে আসবে আরশি? প্লিজ?”
হাঁক-ডাকে নড়েচড়ে উঠলো মেয়েটা। স্নোবলের আরামের বারোটা বাজলেও নেমে পড়লো মায়ের কোল থেকে। যেনো সুযোগ করে দিলো টাওয়াল দিয়ে আসার জন্য।
ছেলের চুপচাপ নেমে যাওয়ার দিকে সরু চোখে তাকালো আরশি। বিড়বিড় করে বললো,
“এখন খুব জাম্বুবানের নেওটা হয়েছিস? আর যখন তিনি তার মহামূল্যবান নাক কুঁচকে বলে– ইয়াক আরশি! আজকে বালিশের উপরও পটি করেছে! এখন আমি ঘুমোবো কোথায়? এই জন্য বলেছিলাম খরগোশ বিছানায় নিয়ে বোসো না!
তখন কেমন লাগে?”
শেহজাদকে নকল করে বলা কথাগুলো খুব একটা পছন্দ হলো না বোধ হয় স্নোবলের।
নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। পুরো পাঁচ মিনিট আগে খেয়েছে। এখন আবার একটু খেতে হবে না?
সেদিকে চেয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে শ্বাস ঝাড়লো আরশি। পরপর নিজেও ব্যস্ত হলো টাওয়াল খুঁজতে।
হুলুস্থুল বাঁধলো তখনই।
এতো খোঁজার পরও না পেয়ে কোমরে হাত রাখলো। ধৈর্য্য হারিয়ে গলা উঁচিয়ে শুধোলো,
“কোথায় রেখেছেন? পাচ্ছি না তো! আপনি এসে নিয়ে যান!”
নিম্নাষ্ঠ দাঁতে চেপে নিজের দিকে তাকালো শেহজাদ।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
পানিতে পুরো শরীর জবজবে।
কপালের উপর পড়ে থাকা ভেজা চুলগুলোয় আঙুলের ফাঁক গলিয়ে উপরে ঠেললো। বলিষ্ঠ হাতের বাইসেপ্স ফুলে ফেঁপে উঠলো তাতে। ভরাট গলায় বললো,
“সে আমি এসে নিতেই পারি! কিন্তু এই অবস্থায় বের হতে দেখলেই তো খরগোশের মতো উঠে দৌড় দেবে!”
আরশি বোকাবোকা চোখে চেয়ে। হতবুদ্ধ মস্তিষ্ক ধরতে পারলো না কথার মানেখানা! জিজ্ঞেস করে বসলো,
“আপনি বাঘ না ভাল্লুক! যে আপনাকে দেখে দৌড় দেবো?”
পাল্টা প্রশ্নে ওপর প্রান্তের মানুষটা নিশ্চুপ। কিছুক্ষণ পর বলে উঠলো,
“বাঘ ভাল্লুক নই! তবে শর্টস ছাড়া টারজান বলতে পারো!”
থতমত খেলো আরশি। জিভ কেটে চোখ খিঁচলো পরপর। জাম্বুবান তারমানে কাপড়চোপড় ছাড়া শাওয়ার নিতে ঢুকেছে? ছিহ্! মানইজ্জত কিছু রাখলো না লোকটা ওর!
“টাওয়ালটা কি এখনো নিজের এসে নিতে হবে? নাকি তুমি–?”
“আ-আনছি! আনছি!”
অপ্রস্তুত হয়ে তোঁতলালো মেয়েটা। চাইলো এদিক-ওদিক। ঘাড় ঘুরিয়ে আবার দেখে নিলো বাথরুমের দরজাটা। পাছে টারজানের মতোই না বেরিয়ে আসে জাম্বুবান এই আশঙ্কায় রুদ্ধ শ্বাসনালী।
“বিছানার ডান পাশে রেখেছি, দেখো!”
শেহজাদের কথামতো সেদিকে তাকাতেই
কাঙ্ক্ষিত বস্তুটা চোখের সামনে আসলো। নিশ্চিন্তের শ্বাস ফেললো আরশি।
কিন্তু টাওয়ালটা হাতে নিয়ে দরজা পর্যন্ত আসতেই থমকালো পা জোড়া। আনন জুড়ে রক্তিম আভা ছড়াতেই
ত্রস্ত মুখ ঘোরালো ও। দরজায় আঙুল দিয়ে দু’বার টোকা দিতে খুলে গেলো ওটা।
গমগমে কন্ঠ শেহজাদের।
“ভিতরে নিয়ে এসো!”
আকস্মিক ডাকে ভ্যাবাচাকা খেলো আরশি। চোখ মার্বেল বানিয়ে তাকালো মেঝেতে। কি সাংঘাতিক লোক! একে তো জামাকাপড় ছাড়া গোসলে ঢুকেছে!
কোথায় দরজাটা অল্প একটু ফাঁক করে ভদ্র মানুষের মতো হাত বাড়াবে, তা না! বলে কি না ভিতরে নিয়ে এসো!
মেজাজ খারাপ হলো অমনি! তেজ দেখিয়ে আওড়ালো,
“নিজের জিনিস নিজে এসে নিয়ে যান! পারবো না আমি ভিতরে ঢুকতে!”
“ইফ আই কাম আউট লাইক দিস, ইউ উইল রিগ্র্যাট ফর শিওর ডার্লিং!”
মেয়েটা উল্টে কিছু বলার আগেই আচমকা ডান হাতে টান পড়লো ওর। এলোমেলো পায়ে হুমড়ি খেয়ে এসে পড়লো লোমহীন চওড়া সিনায়।
ঠান্ডা থাবার নিচে বুকের মাংসপেশি কেঁপে উঠলো শেহজাদের।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সীমানায় বিধ্বস্ত কিশোরী। মানুষটার গায়ের পানিতে ভিজলো সেও। চোখ খিঁচে
কম্পিত কন্ঠে আওড়ালো,
“ইচ্ছে করে করেছেন না এমন?”
“একদমই না! তুমিই তো বললে নিজের জিনিস নিজে এসে নিয়ে যেতে!”
আরশি চোখ খুলছে না দেখে ঠোঁট টিপে হাসলো প্রফেসর। ভেজা মুখটা কানের পাশে নিয়ে আওড়ালো,
“ভয় নেই ম্যাডাম! একটা এক্সট্রা টাওয়াল ছিল এখানে। আপতত সেটা জড়িয়ে নিয়েছি! এবার অন্তত চোখ খোলো! প্লিজ!”
দুপাশে মাথা নাড়লো মেয়েটা। কাঁধ ভিজলো শেহজাদের চুলের পানিতে। শ্বাস ভারি হতেই মানুষটা বলে উঠলো,
“বেশ! তুমি যখন চোখ খুলবেই না, তাহলে আমার আর টাওয়াল পড়ে থেকে কি লাভ বলো? খুলে ফেলছি এটা!”
ধরফরিয়ে চোখ মেললো আরশি। অপ্রস্তুতে দৃষ্টি গিয়ে পড়লো ঐ উন্মুক্ত বুকে। ত্রস্ত অক্ষিযুগল সরালো মেঝেতে। উত্তপ্ত গাল। কুন্ঠায় নত মস্তক।
শেহজাদ হাস্কি স্বরে শুধোলো,
“সি! হাউ অবেডিয়েন্ট আই এম? ইউ শুড গিভ অ্য কমপ্লিমেন্ট অর মে আই কিস ইউ রাইট নাও?”
“আগে আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর দিন!”
থামলো প্রফেসর। কানের পাশ হতে মুখ সরিয়ে সামনাসামনি হলো আরশির। অনাবেষ্টিত নেত্রপল্লব কাঁপছে না আর৷ স্থির আনন। থমথমে গলায় শুধোলো,
“আপনার ফোনে একটা মেসেজ এসেছে একটু আগে! কেউ একজন থ্রেট দিচ্ছে আপনাকে! আপনি জানেন এসব?”
শেহজাদের কন্ঠ দৃঢ়। ধারালো চোয়াল শক্ত হলো সহসা।
“জানি আমি!”
ঢোক গিললো আরশি। শক্ত কন্ঠে শুধোলো ফের,
“এই লোকটাই কি তাহলে–”
“দ্য মাস্কম্যান!”
দম বন্ধ হয়ে আসে মেয়েটার। সন্ত্রস্ত কন্ঠে আওড়ায়,
“তবুও আপনি কাউকে কিছু না জানিয়ে একটা অপরিচিত জায়গায় যেতে রাজি হয়েছেন? কেনো?”
মাথায় চক্কর কাটলো ওর। পিছিয়ে পড়ে যাওয়ার আগেই কোমরে হাত রাখলো প্রফেসর। ধরে ফেললো শক্ত করে।
বুকের সাথে মিশিয়ে নিতেই ফের প্রশ্ন ছুড়লো শেহজাদের দিকে,
“আর বোনকে হারাবেন মানে! ঐ লোকটার কাছে আমাদের রুশা আছে?”
উত্তর এলো না! ডুকরে উঠলো আরশি! এই প্রথমবার ভীষণ স্বার্থপর মনে হওয়া কাউকে ঠেলে সরাতে চাইলো ও। কিন্তু পারলো কই?
মানুষটার বাহুডোরে জেদটুকু বিসর্জন দিতে হলো কিশোরীর। ফুপিয়ে ফুপিয়ে বললো,
“আপনি তবুও এতো শান্ত কি করে? এখনো কেনো কাউকে জানালেন না কিছু?”
“কারণ রুশা বেঁচে নেই আরশি!”
শীতল কন্ঠে থমকায় মেয়েটা। প্রকট নেত্রে চেয়ে অস্পষ্টে আওড়ায়,
“রুশা বেঁচে নেই মানে? কিন্তু আমরা যে জানি ও শুধু হারিয়ে–?”
“সেই আঠারো বছর আগে, একটা মিথ্যেকে সত্যি বানিয়েছিল বাবা! সবাই জানতো রুশাকে পাওয়া যায়নি! ইনফ্যাক্ট মা-ও এখনো এটাই জানে। কিন্তু পুলিশ রুশাকে পেয়েছিল ঐ নদীতেই। মৃত।
মুখ বোঝা যায়নি। শুধু পরনের জামা দেখে আইডেন্টিফাই করেছিল ওরা, যে লাশটা রুশার। ততদিনে আমরা চলে এসেছি এদেশে। আর মা-ও কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠেছিল কেবল। বাবা জানতো এই খবর পেলে মা আবারও অসুস্থ হয়ে যাবে! তাই আমি আর বাবা ছাড়া আর কেউ জানতে পারেনি এটা!”
আরশি যেনো নির্বাক শ্রোতা! শুনলো ঠিকই ; কিন্তু মন থেকে মেনে নিতে পারলো না কিছুতেই। একটা নির্মম সত্যি; এতো বাজেভাবে পোড়ালো পুরো পরিবারটাকে?একজন মা হয়তো এখনো উপরওয়ালার দরবারে কাঁদেন তার মেয়েকে ফিরে পাওয়ার জন্য। আর একজন বাবা? ধুঁকে ধুঁকে শেষ হচ্ছেন মিথ্যে বয়ে বেরাবার কষ্টে।
তার তো মেয়ে ফিরে আসবে, এই আশাটুকুও নেই!
হাসফাস করে উঠলো আরশি। একটু কাঁদতে পারলে বোধ হয় বুকটা হাল্কা হতো ওর।
“এই যে সবাই এতো কষ্ট পেয়েছে! এর জন্য তো আমি দায়ী! আমার জন্য রুশা হারিয়েছে!”
এই একটা প্রশ্নে যে শেহজাদ একদিন আরশিকে বিদ্ধ করেছিল, সেই একই শেহজাদ আজ আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো মেয়েটাকে। শক্ত করে চুমু খেলো চুলে! পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে গেলে
আরশির ফোঁপানোর শব্দ বাড়লো। অশান্ত হয়ে উঠলো প্রফেসর। কিছু বলতে নেয়ার আগেই মেয়েটা শুধোলো,
নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৩১
“তারমানে ঐ লোকের বলা কথাগুলো–”
“একটা ট্র্যাপ!”
আরশি মুখ তুললো। ভেজা চোখদুটো মুছলো হাতের পিঠ দিয়ে।
“ আপনি কোত্থাও যাবেন না আজ! একা যেতে বলেছে মানে আপনার উপর এ্যাটাক করার প্ল্যান করছে লোকটা! যেনে বুঝে শত্রুর ফাঁদে পা দেয়ার কোনো দরকার নেই!”
ওষ্ঠযুগল পাশে ঠেলে হাসলো শেহজাদ। পরপর হুট করেই দু’হাতে শূন্যে তুললো মেয়েটাকে। কোলে নিয়ে বাথরুম থেকে বের হতে হতে বললো,
“শত্রুকে হাতেনাতে ধরতে গেলে তো শত্রুর ফাঁদে পা দিতেই হবে! কান্ট হেল্প সুইটহার্ট! আ’ম সো ডেস্পারেট টু মিট হিম ইন পার্সন!”