নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৩৪

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৩৪
সিনথিয়া

বিক্ষুব্ধ শেহজাদ। চোয়ালের শিরাগুলোতে স্পষ্ট ক্রোধ। নীলাম্বরে আক্রোশের কালা ছায়া। সাঁঝের ফিকে লাল আলোয় অঙ্গারের ন্যায় জ্বলজ্বল করছে তার চোখজোড়া।
হুট করেই পিছনে এসে দাঁড়ালো আদির লোকগুলো। কাঁধ চেপে ধরে হাতজোড়া বেঁধে দিলো প্রফেসরের।
প্রহসনের সুর আদির গলায়। বলে উঠলো,
“আচ্ছা! শুনেছি মরে যাওয়ার পর মানুষের কৌতূহল হয়! মৃত ব্যক্তির মৃত্যুর কারণ জানার জন্য! তুমি মরে গেলে তোমার বউয়েরও নিশ্চয়ই এমন কৌতূহল হবে?”
শেহজাদ নিশ্চুপ! আদি নিজে থেকেই আওড়ালো ফের,
“বেশ! না হলেও আমার তো একটা দায়িত্ব আছে তোমার বউকে সবটা জানানোর।”

বিদ্রুপাত্মক আদির কন্ঠতালু। চাপাতি ফেলে ট্যাটু করা হাতটা হাঁটুর ওপর রাখলো। ঝুঁকে এলো শেহজাদের সামনে।
“মনে আছে তোমার বিয়েতে আমার প্রথমবার বাংলাদেশে যাওয়া! সেবার আরশিকে দেখে এতো ভালো লাগলো না? মনে মনে ভেবেছিলাম ইশ! এই মেয়েটা তোমার বউ না হয়ে যদি আমার বউ হতো?”
কথাগুলো বলেই ঘাড় বাঁকালো আরশির দিকে।
মেয়েটার ফ্যাকাসে মুখে স্পষ্ট ত্রাস।
ভয়ার্ত চোখ। মাস্কের পিছনের মানুষটাকে এতক্ষণে দেখে ঘৃণায় গুলিয়ে উঠলো ভিতরটা।
তাতে অবশ্য কিছু এলো-গেলো না আদির।
ওর মতো মানুষদের অনুভূতি শূণ্যের কোঠায়।
মস্তিষ্ক শুধু জানে কি করে কেড়ে নিতে হয়!
পরপর বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“সুযোগও পেয়েছিলাম একটা। বিয়ে হওয়ার সাথে সাথে যখন তুমি চলে এলে এদেশে! তখন! তিন তিনটা বছর অপেক্ষা করেছি! সময়মতো বাবাকে রাজি করাবো বলে। আরশিকে আমার চাই!
কিন্তু শেষমেশ কি হলো? আমার সব প্ল্যান, সব আশা ভরসায় জল ঢেলে তোমার মা-বাবা তোমার কাছেই আবার আরশিকে ফেরত নিয়ে এলো!
তখন আমি কি করলাম? স্টকিং!
আরশিকে নজরবন্দি করলাম ওর অজান্তেই। গ্রেন্ড ক্যানিয়নে আমিই কিডন্যাপ করেছিলাম ওকে। ভেবেছিলাম এই বুঝি হাতের নাগালে চলে এসেছে পুরো গেইমটা। কিন্তু না!
তখনও তুমি বাঁচিয়ে নিলে ওকে! তারপর মিস্টার উইলিয়ামকে এ্যাটাক; তার রক্তে ভেজানো মাস্ক তোমাদের বাসায় পাঠানো!
হ্যাঁ! সবটা আমিই করেছি!
আর ফোনে তোমাকে রুশার কথা বলে
এখানে এনে দাবার শেষ চালটাও আমিই চেলেছি! কেনো জানো? চিরতরে আমার পথের কাঁটা উপড়ে ফেলবো বলে!”

“কে কাকে উপড়ে ফেলবে সেটা তো সময় বলবে আদি!”
ভয়ডরহীন অক্ষিযুগলে অপার্থিব শীতলতা প্রফেসরের। কথার ভাজেই স্পষ্ট ইঙ্গিত ভবিষ্যতের। আরশিকে ব্যাধের দৃষ্টিতে গ্রাস করা চোখ দুটো ততক্ষণে ফের ফিরে চাইলো শেহজাদের দিকে।
ফের ধীর পায়ে এগিয়ে আসলো ওর কাছে। এসে দাঁড়ালো পিছনে। ঠোঁটের বাঁকে পৈচাশিক হাসি ফুটিয়ে শুধোলো,
“তাই নাকি? তা কি দিয়ে উপড়ে ফেলবে তুমি আমাকে? হাত দিয়ে?
আশেপাশে দাঁড়ানো লোকগুলো হেসে উঠলো সশব্দে। চোখ খিঁচে বন্ধ করলো আরশি। মাথা নোয়ালো পরাস্ত ভঙ্গিতে। বিড়বিড় করে আওড়ালো,
“জারা! আয়ান ভাই! তোমরা আসছো না কেনো এখনো?”
আর আচমকাই এক ধাতব শব্দ। ত্রস্ত চোখ খুললো মেয়েটা।
“ন-নাহ্! নাহ!”
কম্পিত কন্ঠস্বর ওর। উদভ্রান্তের মতো মাথা নাড়লো দুপাশে। প্রকট অক্ষিযুগল আবিষ্কার করলো শেহজাদের নিস্প্রভ চাওনি। ব্লেজারের কাঁধের কাছটা জবজবে। সেখান থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝড়ছে কংক্রিটের মেঝেতেও।
আদির হাতে চাপাতি। পাশবিক ফূর্তি তার চেহারায়। হাতে ধরে রাখা ইস্পাতের শাণিত অংশ দিয়ে চুইয়ে পড়ছে লোহিত তরল।

“কি হলো? মারবে না আমাকে? মারো! নাকি হাত নাড়াতে পারছো না এখন?”
শেহজাদ অনড়। যন্ত্রনার লেশটুকু টানলো না ঐ মজবুত ব্যক্তিত্বে। তাতেই যেনো চটে গেলো আদি। সামনাসামনি এসে দুম করে ঘুষি বসালো মানুষটার গালে। মুখ বেঁকে ছিটকে পড়লো রক্ত।
তবুও একটা কথাও বললো না প্রফেসর।
ব্যথায় হাত ঝাড়লো আদি। ঘনঘন শ্বাস ফেললো আক্রোশে! পরপর বললো,
“এই জখম কাঁধ নিয়ে আমিও দেখি আর কতক্ষণ টিকে থাকতে পারো তুমি!”
ধীরে ধীরে ফিরে চাইলো প্রফেসর। অবসন্ন চেহারা। চোখ দুটো মিশে যেতে চাইছে একে অপরের সাথে! তবুও অস্পষ্টে আওড়ালো,
“তোর মতো নর্দমার কীট আমি জুতোর তলায় ফেলে পিষে মারি। সেখানে হাত নষ্ট করা তো মূর্খতা!”
বাঁকা হাসলো আদি। আচানক ঘুরে এগিয়ে এলো আরশির কাছে! পাশে এসে দাঁড়িয়েই ধূর্ত গলায় বললো,
“তোমার আরশির শেষ নিশ্বাসটাও কিন্তু ঐ নর্দমার কীটেরই হাতে!”
থামলো লোকটা। নিষ্ঠুর চোখগুলো দিয়ে লোভাতুর দৃষ্টি ফেললো আরশির গলার দিকে। হাতের চাপাতিটা সেদিকে এগিয়ে আনলো সহসা! হিসহিসিয়ে বলে উঠলো,

“ইফ আই কান্ট কিল ইউ! আ’ল কিল হার! এন্ড দ্যান আ’ল কিল মাইসেল্ফ টু!”
আতঙ্কিত চোখগুলো মুহূর্তেই স্থির হলো
মেয়েটার। স্থির হলো বিধ্বস্ত শেহজাদের উপর! যেনো মৃত্যুকে বুকে আগলে নেয়ার আগে শেষবারের মতো ওরা দেখে নিতে চাইলো মানুষটাকে।
তিরতির করে কাঁপলো পাতলা অধরজোড়া। বলা হবে না জেনেও অন্তঃকরণজুড়ে তোলপাড় হলো ঝড়ের বেগে। ঘুটঘুটে অন্ধকার চোখে নামার আগে জানাতে চাইলো,
“আপনার দেয়া চেইনটা কিন্তু খুলিনি আমি!”
কিন্তু হলো না! আক্ষেপটুকু নোনাপানি হয়ে ঝাপসা করলো নেত্রপল্লব। ভালোবাসি নামক একটি ছোট্ট শব্দ না বলতে পারার কষ্ট ভীষণ পোড়ালো ওকে।
একবুক অনুতাপ নিয়ে নিমীলিত হলো অক্ষিযুগল। অন্তিম প্রহর যেনো ইস্পাতের ধারালো অংশের মতো অপেক্ষা করলো গলার কাছটায়।
অকস্মাৎ কন্ঠাস্থি অনুভব করলো টুপটাপ তরলের পতন। চোখ মেলে চাইতেই আঁতকে উঠলো আরশি।
চাপাতির ধারালো অংশ চেপে ধরে রেখেছে একটা শক্ত হাত। লম্বা গড়ন! বিমূঢ় নেত্রদ্বয় চিনতে সময় নিলো না
শেহজাদকে!

তার বলিষ্ঠ হাতের মুঠোয় ধাতব অংশ। করতালু কেটে রক্ত চুইয়ে পড়ছে মেয়েটার গলার ওপর।
“আই ওয়ার্নড ইউ আদি! ডু নট টাচ মাই ওয়াইফ!”
প্রফেসরের গলার স্বর ধীর। চোখজোড়া ভয়াবহ রকমের ঠান্ডা। যেনো খুন চেপেছে তাতে। কব্জিতে লাল দাগ! যে দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল বাঁধা ছিল হাতদুটো, সেটা ছিন্নবিন্ন হয়ে পড়ে আছে ফ্লোরে!
আদি হতবাক! যেনো বিশ্বাস করতে পারলো না শেহজাদ সত্যি সত্যি উঠে এসেছে।
আশেপাশে দাঁড়ানো লোকগুলোর মধ্যে দিয়ে একজন এগিয়ে এলো প্রফেসরকে আঁটকাতে।
সেটাই যেনো কাল হয়ে দাঁড়ালো তার জন্য।
এক হাত দিয়ে চাপাতি ধরে রাখলেও অন্য হাত চললো হিংস্র গতিতে। কনুয়ের এক ধাক্কায় তেড়ে আসা লোকটা উড়ে গিয়ে পড়লো দূরে।
মূহুর্তেই চাপা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো তেরো তলার রুফটপে। সাহস করে আরেকজন এগিয়ে এলো পরপর। তবে খালি হতে নয়!
হকি স্টিক সমেত।
তবে কাছে এসেও সুবিধা করতে পারলো না বিশেষ। চাপাতি ধরে রাখা হাতের ওপর আঘাত করলেও টলাতে পারলো না শেহজাদকে। কাঠের স্টিকে মাঝ বরাবর ভেঙে গেলেও মানুষটার অভিব্যক্তিশূন্য আননে ব্যথার তীব্রতা অনুপস্থিত।

ঘাবড়ে গেলো লোকগুলো। পেছালো এক এক করে!
সহসা কাঁধের জখম নিয়েই চাপাতি সহ আদিকে ধাক্কা দিলো প্রফেসর। কংক্রিটের মেঝেতে পিঠ ঠেকলো আদির। ব্যাধের ন্যায় ওর দিকে একপা একপা করে এগিয়ে আসতে নিলে পিছনে সরলো
আদি। মুহূর্তেই ওর গলার উপর গেড়ে বসলো শেহজাদের ব্ল্যাক অক্সফোর্ড।
মুখে জমা হওয়া রক্তটুকু উচ্ছিষ্টের মতো থু দিয়ে পাশে ফেললো প্রফেসর।
পরপর হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ঠোঁট মুছে নিলো আলগোছে। পিছনে লাল আভা ছড়িয়ে ডুবতে থাকা সূর্যটা ছায়া ফেললো মানুষটার ঐ নীল চোখে।
ঠোঁট বাঁকালো আদি।
কম্পিত কন্ঠস্বর। তবুও যেনো মিছে তেজ দেখালো সত্তাটা। সতর্ক করতে বলে উঠলো,
“ইউ কান্ট কিল মি প্রফেসর! ভুলে যেও না মেহমেদ হাসানের বিজন্যাসের ফিফটি পার্সেন্ট শেয়ার হোল্ডার কিন্তু আমার বাবা! জাস্ট ইম্যাজিন যখন সে শুনবে তার ছেলের মৃত্যুর পিছনে তুমি দায়ী!”
নিঃশব্দে হাসলো শেহজাদ।

“প্যাথিটিক!”
ঢোক গিললো আদি! সন্ত্রস্ত আওড়ালো,
“প্লিজ! মেরো না আমা-!”
ঠিক সেই সময় গলার উপর বুটের চাপ বাড়লো আদির। কথার মাঝপথেই দম আঁটকে এলো ওর। শুনলো শেহজাদের স্থুল আওয়াজ!
“ভুল! তোর তো আরো মৃত্যুকে ভিক্ষে চাওয়া উচিত এখন আমার কাছে!”
চোখমুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেলো আদির। শেহজাদের হাতে না মরলেও শ্বাসরোধ হয়ে মারা যাবে ও নির্ঘাত!
হঠাৎই পুলিশের ড্রোন ঘিরে ফেললো বহুতল বিল্ডিংটা। আদির পুরো গ্যাংকে আত্মসমর্পণের জন্য তাগাদা দেয়া হলো স্পিকারে।
হুলস্থুল বাঁধলো আদির লোকগুলোর মধ্যে। যারা আস্ত ছিল তারা যে যেভাবে পারলো ছুটলো সিঁড়ির দিকে। কিন্তু ততক্ষণে রুফটপে উঠে এসেছে আয়ান ও তার টিম।

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৩৩

“NYPD” লোগো লাগানো কালো জ্যাকেটধারী পুলিশগুলো যেনো এক একটা দাবানল।
মুহূর্তেই ধরে ফেললো সবকটাকে। কেবল বাকি রইলো শেহজাদের জুতোর তলায় পড়ে থাকা আদি। প্রফেসরের নির্মম চাওনিতে গুঙিয়ে উঠলো একটু। পরপর নিস্তেজ হয়ে গেলো শরীরটা।
“তুই বলেছিলি না একটু আগে? মরার পর মানুষ মৃত ব্যক্তির মৃত্যুর কারন খোঁজে! তোর মৃত্যুর কারণ খোঁজা হলে মানুষ কি পাবে জানিস? তুই আমার ওয়াইফের দিকে চোখ তুলে তাকানোর স্পর্ধা করেছিলি!”
থামলো শেহজাদ। পরপর ধীর স্বরে বলে উঠলো,
“আদি! ইয়র গেইম ইজ ওভার!”

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৩৫