নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৪৬
সিনথিয়া
‘কী হলো? ভালোবাসবেন না আমায়?’
রমনীর কিন্নরী স্বরের আকুল আবেদনখানা শেষ হলো গলার স্বরে কিঞ্চিৎ ফ্যাসফ্যাসে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে। তন্দ্রালু চোখ। আরশির শরীরের তীব্র উত্তপ্ততা বোধগম্য হতেই তড়িৎ বেগে চোখ খুললো শেহজাদ।
হুট করে কোলের উপর চড়ে বসা মেয়েটার দিকে তাকাতেই উদ্বিগ্ন হলো তার সৌম্যকান্ত মুখ। বুঝলো জ্বরের প্রকোপেই তার আদর-ভালোবাসা পাওয়ার এমন তীব্র অভিলাষ আরশির।
জ্বর না থাকলে আরশি হয়তো এমন আবদার করতো না ভেবেই বুক চিঁড়ে বেরোতে চাইলো এক অদৃশ্য দীর্ঘশ্বাস। তবে বউয়ের প্রতি নিখাঁদ ভালোবাসার সামনে সেই অদৃশ্য দীর্ঘাকায় শ্বাস বুঝি তার দীর্ঘতা হারালো।
মনের অজান্তেই শেহজাদের হাত উঠে এলো আরশির কপালে। গরম ত্বকের স্পর্শে প্রকট হলো চক্ষুদ্বয়। অবাক স্বরে আওড়ালো,
‘তোমার তো জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে!’
কথাটা কর্ণগোচর হতেই কপাল গোটালো আরশি। তন্দ্রালু চোখেমুখে নেচেকুদে উঠলো বিমূঢ়তা। কন্ঠে বিস্ময় ঢেলে বললো,
‘মানুষ মাত্রই জ্বর আসবে, তাই বলে আপনি আমায় ভালোবাসবেন না বলছেন? আপনার বউ আপনাকে কাছে ডাকছে! আর আপনি কিনা সেই প্রস্তাব এভাবে ডিনাই করে দিচ্ছেন প্রফে…?’
কথার মাঝেই আরশির পুরন্ত ঠোঁটে তর্জনী ঠেকালো শেহজাদ। রমনীর নিরন্তর বলে চলা অনুযোগ থামিয়ে দিশেহারা কন্ঠে বললো,
‘জ্বর নিয়ে এতো কথা বলতে হয় না!’
বাঁধা পেয়ে খানিকটা বিরক্ত হলো আরশি। নীরব অভিমানে টলমল করে উঠলো তার অক্ষিযুগল। ঈষৎ হলদেটে চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হলো সমান তালে। সে কঠিন স্বরে জানালো, জ্বর অবশ্যই সে ইচ্ছে করে বাঁধায়নি? ছাঁদে অমন বরফের মধ্যে জন্মদিনের সারপ্রাইজ দেয়া যার বুদ্ধি ছিল তাকে যেনো অতি অবশ্যই তার সামনে উপস্থিত করা হয়! তাকে কঠিন শাস্তি দেবে আরশি!
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
শেহজাদ অবশ্য সেসব শুনলো না। উরুর উপর থেকে দু’হাতে বাচ্চাদের মতো করে মেয়েটাকে তুলে শুইয়ে দিলো বালিশে। অর্ধচেতন অবস্থাতেই আরশি কতক্ষণ গড়াগড়ি খেলো বিছানায়। তার দুঃখের অন্ত নেই। অভিমানের শেষ নেই। এ দুনিয়ায় কেউ তাকে ভালোবাসে না। তার স্বামী তাকে কাছে ডাকে না। এতশত অভিমান অনুযোগের ঝুলির দিকে শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো শেহজাদ। হুট করেই খেয়াল হলো আরশির আঁচল সরে গেছে উদরের উপর থেকে। পদ্মবিলের ন্যায় ধীরে ধীরে উন্মুক্ত হচ্ছে তার নারীদেহের অপার্থিব সৌন্দর্য। শেহজাদের মতো ধৈর্যশীল মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙতে যে কোনো কার্পণ্য করবে না তারা, সে কথা অক্ষরে অক্ষরে টের পেলো ত্রিশ পেরোনো মানুষটা।
নতজানু হলো নীলাদ্রির পৌরুষ চোখ। মাথা ঘুরিয়ে দৃষ্টি ফেরালো দেয়ালের ম্লান পেইন্টিং গুলোর দিকে। ধীরে ধীরে থিতু হলো তার প্রলোভিত মন। মাথায় এলো শাড়ি পাল্টাতে হবে আরশির। ভেজা শাড়িতে নয়তো আরো ভুগবে মেয়েটা।
আরশি পড়ে রইলো বিছানায়। জ্বরের তাপে ক্রমশ লালচে হয়ে এসেছে তার গৌরবর্ণা গতর। নিখুঁত প্রাণশক্তি শুষে নিতে ক্রমান্বয়ে গা পুড়িয়ে জ্বর বাড়লো। লাবন্য হারিয়ে স্ফীত হলো প্রজাপতির মতো রঙিন মুখখানা।
শেহজাদ হুডি আর ট্রাউজার এনে বিছানার পাশে রেখেছে মাত্র। এবার শুধু শাড়িটা বদলে ফেলার পালা। মানুষটা ঠোঁট ফুলিয়ে শ্বাস ঝাড়লো। স্ত্রীর ভেজা বসন পাল্টাতে তার অসুবিধে নেই! এতটুকু আয়ত্ত তার নিজের উপর আছে। শুধু ভয়, মেয়েটা আবার ভুল না বোঝে তাকে। এই যে, তারা বন্ধুর মতো সহজ হওয়ার চেষ্টা করছে একে-অপরের সাথে, সেই চেষ্টায় না আবার ধ্বস নামে।
অতশত দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে তবুও শেহজাদ এগোলো। শুষ্ক ঢোকে ওঠানামা করলো গলবিলের ছোট্ট ঢিপির মতো জায়গাটা।
কিন্তু আরশির পাশে বসে ভাবনা মতো কার্য ঘটাতে গিয়েই বিপত্তিতে পড়লো সে। রমনীর বক্ষভাজে বিছিয়ে রাখা আঁচলে হাত দিতে না দিতেই কানে এলো বউয়ের কঠিন স্বর। ভড়কালো শেহজাদ! আরশি খুব রুষ্ট হয়ে আওড়ালো,
‘আপনি এখনো আনলেন না তাকে আমার সামনে?’
জ্বরের ঘোরে তার দিশেহারা বউয়ের কী কারণে সেই ব্যক্তির প্রতি এমন জরুরী তলব? ভেবে পেলো না শেহজাদ। তবে স্বভাববিশেষ কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করে বসলো,
‘যার বুদ্ধি ছিল তাকে এক্ষুনি তোমার সামনে আনতেই হব?’
‘হু’
‘আনলে তাকে কী করবে?’
‘তাকে চুমু খাবো! ভালোবাসতে বলবো আমাকে। আপনি তো আর বাসলেন না!’
নিজের প্রতি হিংসে হওয়া অসুস্থতার লক্ষণ কি-না শেহজাদ জানে না। তবে এই মূহুর্তে সে প্রচন্ড পরিমানে আত্মহিংসায় ভুগলো। বৈরিতা ফুটে উঠলো তার খুরখার দৃষ্টিতে। অথচ যে মানুষটাকে আরশি জ্বরের ঘোরে খুঁজছে সে মানুষটা তো প্রফেসর নিজেই।
অগত্যা প্রলম্বিত শ্বাস ফেললো শেহজাদ। চাপা হতাশ স্বরে বললো,
‘যাকে খুঁজছো সে তোমার কাছেই আছে স্নোফ্ল্যাক!’
আরশি ঐ নিভু নিভু চোখেই এবার উঠে বসলো। জ্বরের তীব্রতায় মাথার যন্ত্রণা সীমাহীন। আরশি সেই সীমাহীন যন্ত্রণা পরোয়া না করেই শেহজাদের চোখে চোখ রাখলো। নিরেট স্বরে জানতে চাইলো,
‘কতটা কাছে? যতটা কাছে থাকলে আমি তাকে চুমু খেতে পারবো ততটা কাছে?’
প্রশ্নের পিঠে শেহজাদের শাণিত চোখের দৃষ্টি মোলায়েম হয়। বর্তায় আরশির তপ্ত ওষ্ঠপুটে। ভঙ্গুর শরীর নিয়ে টলতে টলতে তাকানো চোখগুলো বড় ঝড় তোলে শেহজাদের ভালোবাসা জমানো বুকে। অবশেষে মিনিটখানেকের নীরবতা ভেঙে বসে থেকেই রমনীর মুখপানে ঝুঁকে এলো কান্তিক পুরুষ। তারপর হুট করেই লুফে নিলো আরশির তপ্ত কোমল অধরজোড়া।
ঘটনার আকস্মিকতায় ভড়কায় না মেয়েটা। জ্বরের ঘোরে বোধহয় তার বিস্ময়শক্তি ম্রিয়মাণ। আর নয়তো অভিলাষ পূরণ হওয়ায় খুশির জোয়ারে রিক্ত শূন্য তার মস্তিষ্ক।
শেহজাদের একহাত উঠে এসেছে আরশির মসৃণ কেশকুন্তলে। নীল চোখের পাতা নামিয়ে যেনো শুষে নিতে শুরু করেছে প্রিয়দর্শিনীর শরীরের সমস্ত অসুস্থতা। জ্বরের তপ্ততা। আরশি থমকায়। শ্বাসরুদ্ধকর স্বপ্নের ঘোর থেকে বেরোনোর চেষ্টায় হাত দিয়ে ঠেলে সরাতে চায় শেহজাদকে। তবে লাভের লাভ খুব একটা হয়না। প্রস্তরীভূত শরীরটা ঠেলে সরাতে গিয়ে নিজেই কাহিল হয়ে পড়ে আরশি। শেহজাদ তখন ঠোঁট ছেড়ে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়েছে গলায়। হাড্ডিসার খাঁজে তার উন্মত্ততা একের পর এক রেখে চললো ভালোবাসার চিহ্ন। কামড়ের দাগ!
মাঝে কতটা সময় পেরিয়েছে আরশি জানে না। তবে যতক্ষণে শেহজাদ শান্ত হয় ততক্ষণে কিছুটা জ্বলতে শুরু করেছে তার ঠোঁটের অগ্রভাগ, গ্রীবাদেশ! আরশি ভেবেই নিয়েছে এই দুই জায়গায় কেটে ফেটে গেলেও খুব একটা অবাক হবে না সে। কারণ ঠোঁট আর গলার দিকে শেহজাদের অপরাধীর দৃষ্টিতে তাকানো সেই বিষয়টুকু কিছু হলেও আন্দাজ করতে পেরেছে তার অসার হয়ে আসা মস্তিষ্ক।
কিন্তু ঠোঁট নেড়ে কিছু বলার আগেই হুট করে দু’হাতের হাতের আঁজলায় আরশির মুখখানা তুলে নিলো শেহজাদ। অনুতপ্ত কন্ঠে আওড়ালো,
‘আ’ম সরি! আই থট আই কুড কন্ট্রোল মাইসেল্ফ বাট…!’
শেহজাদের কথা থামে। বৃদ্ধা আঙুলে আলতো করে ছুঁয়ে দেয় আরশির ঠোঁটের কাঁটা জায়গাটা। স্বর খাদে নামিয়ে শুধায়,
‘বেশি জ্বলছে?’
আরশি উত্তর খোঁজে। কিন্তু বলার মতো কিছু খুঁজে না পেয়ে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি মেলে শুধু তাকিয়ে রয় সম্মুখের মানুষটার পানে। শেহজাদ বুঝতে পারে না সেই চাওনির মানে। নিজের কাছে নিজেকে কুৎসিত অপরাধী মনে হয় তার। মনে মনে প্রস্তুতিও নিয়ে ফেললো ঘটনার এখানেই সমাপ্তি টানার জন্য। নয়তো আরশি আরো অসুস্থ হয়ে পড়লে হিতে বিপরীত হবে।
নিজেকে কক্ষনো ক্ষমা করতে পারবে না সে।
পরপর আরশির দিকে তাকিয়ে নরম স্বরে বলে উঠলো,
‘আই থিঙ্ক ইউ নিড রেস্ট আরশি! আমি মাকে ডেকে দিচ্ছি! মা এলে তোমার শাড়িটা বদলে ফেলো কেমন?’
আরশি এবারেও নিশ্চুপ! কাঠের পুতুলটির ন্যায় স্তব্ধ তার অনাবিল বকে চলা স্বভাব। শেহজাদের বুকের ভিতর ধক করে ওঠে। মাথা নোয়ায় সে৷ কিন্তু নিঃশব্দে বিছানা ছেড়ে উঠে যেতে নিলেই পিছন থেকে তার পেশিবহুল হাতখানা আঁকড়ে ধরলো মেয়েটা। বিমূর্ত স্বরে আওড়ালো,
‘ কোত্থাও যাবেন না আপনি!’
শেহজাদ থমকায়। সপ্রশ্ন চোখে পিছন ফিরে চাইতেই আরশি বলে উঠলো,
‘একটা অসুস্থ মানুষকে রুমে একা ফেলে চলে যাচ্ছিলেন? চুপচাপ এখানে বসুন!’
‘কিন্তু তোমার শাড়িটা..’
‘ আপনি পাল্টে দিন! শুধু শুধু এই মাঝরাতে বউয়ের শাড়ি পাল্টে দেয়ার জন্য আপনি মা-বাবার রুমে যাবেন মাকে ডাকতে? তারা কত গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত থাকতে পারে আপনি জানেন?’
কপালে ভাজ পড়লো শেহজাদের। আরশির কথার অর্থোদ্ধার না করতে পেরে জিজ্ঞেস করলো,
‘এতো রাতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ মানে?’
‘আপনিই না বললেন তখন, বাবা আপনার থেকে মায়ের রাগ ভাঙানোর জন্য টিপস নিয়েছেন! যেহেতু সন্ধ্যায় টিপস নিয়েছেন তারমানে রাতে…’
কথার মাঝে নাটকীয় ভঙিমায় আরশি থেমে যেতেই থতমত খেলো শেহজাদ। প্রসঙ্গ বদলে বলার চেষ্টা করলো,
‘জ্বর নিয়ে কেউ এতো কথা বলে? আমিই পাল্টে দিচ্ছি শাড়ি। পিছনে ঘোরো!’
উদ্দেশ্য সফল হওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ কাজের বিষয়টা আর বেশিদূর টানতে হলো না আরশিকে। সে বাধ্য মেয়ের মতো পিছন ঘুরে বসলেও টের পেলো দুনিয়া নিয়ে ঘুরছে তার মাথা। জ্বরে কাবু হওয়ায় ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে দুপুর থেকে খাওয়া সবকিছু। আহারে! আহারে! মুহূর্তেই মন খারাপ হয়ে গেলো আরশির। মনে পড়লো মা-বাবা কতদিন হলো তাকে ফোন দেয় না, খোঁজ খবর নেয় না! ছাঁদে বসে ঠেসেঠুসে যে চকলেট কেকটুকু খেয়েছিল, তা-ও যেনো এখন বেরিয়ে আসতে চাইছে মনের দুঃখে।
শেহজাদ কোনোরকমে পিছনে দাঁড়িয়ে শাড়ি পাল্টে দিলো আরশির। হুডি সে পরিয়ে দিলেও পাজামাটা আরশি নিজেই পরলো। ততক্ষণে চোখ, শ্বাস সবই বন্ধ শেহজাদের।
আরশি, ‘পরা হয়ে গেছে’ বলতেই চোখ মেললো শেহজাদ। কিন্তু আঁটকে রাখা শ্বাসটুকু ছাড়তে নিলেই ডুকরে উঠলো আরশি। স্ত্রীর এরূপ আহাজারিতে তৎক্ষণাৎ থামতে হলো তাকে। বিভ্রান্ত হয়ে শুধালো,
‘আরশি? বেশি শরীর খারাপ লাগছে?’
‘না!’
‘মাথা ঘুরছে? শুয়ে পড়বে?’
‘না!’
‘তাহলে কাঁদছো কেনো?’
বিচলিত পৌরুষ স্বর। আরশির কান্না থামলো। ধরা গলায় বললো,
‘আপনার হাতটা বাড়ান!’
শেহজাদ পিছন থেকে হাত বাড়িয়ে দিতেই টার্টলনেইক সোয়েটারের হাতা টেনে নাক মুছে ফেললো আরশি। যতক্ষণ আরশি নাক মুছলো ততক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো শেহজাদ। চোখেমুখে বিরক্তির রেশটুকু নেই। উল্টে আরশি থামতেই ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘এখন একটু আরাম লাগছে?’
সর্দি ঘটিত ব্যাপারখানা শেহজাদের সোয়েটারে মুছে ওপরনিচ মাথা নাড়লো আরশি। তবে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকালো চিন্তিত মুখে। শুধালো,
‘এই যে, আমি নাক মুছলাম আপনার সোয়েটারের হাতায়, আপনি রাগ করলেন না?’
শেহজাদের বিচলিত মুখ মলিন হলো এবার। দুপাশে মাথা নাড়লো মানুষটা। কন্ঠে প্রশ্রয় মিশিয়ে বললো,
‘একদম না!’
‘তাহলে সেবার স্নোবল যখন আপনার বিছানায় পটি করলো, আপনি তো খুব চেঁচিয়ে বলেছিলেন, আরশি পরিষ্কার করে দিয়ে যাও বলছি! তাহলে এবার তেমন কিছু বলছেন না কেনো?’
শেহজাদ ঠোঁট টিপলো। বুঝতে পারলো জ্বরে কাবু হয়েই এসব ভুলভাল বলছে আরশি। পরপর বউয়ের বাচ্চাসুলভ প্রশ্নে প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে পাশে বসলো প্রফেসর। মাথায় হাত রেখে বললো,
‘কারণ এবার তো দুষ্টুমি খরগোশের আম্মু করেছে, তাই কিছু বললাম না!’
আরশি তবুও যেনো অনুতপ্ত। ম্লান কন্ঠে বললো,
‘বলেননি, কিন্তু বলতে কতক্ষণ? সোয়েটারটা আমি কাল ধুয়ে দিবো।’
‘ আশ্চর্য! আমি কি বলেছি তেমন কিছু? কিচ্ছু ধুয়ে দিতে হবে না আপনাকে ম্যাডাম। সেবারও যেমন আমিই বিছানাটা পরিষ্কার করেছিলাম, এবার না-হয় সোয়েটারটাও আমিই ধুয়ে ফেলবো!’
প্রশ্নের উত্তরে সন্তুষ্টসূচক মাথা নাড়লো আরশি। তারপরও দুঃখী দুঃখী ভাবটা গেলো না তার। শেহজাদ বুঝতে পেরে শুধালো,
‘আর কিছু?’
আরশি যেনো এই প্রশ্নের অপেক্ষাতেই ছিল। ভারাক্রান্ত মুখে ফট করে বলে ফেললো,
‘শরীরের অবস্থা বেশি ভালো না! কখন কী হয়ে যায়, আপনি আমার ছেলেটার একটা বিয়ে-থার ব্যবস্থা করুন। অন্তত ছেলের বউয়ের মুখ দেখে ওপরে গেলেও শান্তি!’
শেহজাদকে হতবিহ্বলের মতো তাকিয়ে থাকতে দেখে তাগাদা দিলো আরশি। ফের আওড়ালো,
‘কী হলো? বলুন! এনে দেবেন তো স্নোবলের জন্য একটা বউ?’
এবার আর হাসি আঁটকে রাখতে পারলো না প্রফেসর। আরশির অতি সিরিয়াস টপিকে জল ঢেলে বেচারা হুহা করে হেসে উঠলো। আরশির চোখমুখ থমথমে হয়ে গেলো তাতে। সে গম্ভীর স্বরে শুধালো,
‘আপনি হাসছেন কেনো? আমি হাসির মতো কিছু বলেছি? এই বয়সে এসেও ছেলের বউ চাওয়া আমার অপরাধ?’
শেহজাদ এবারও হাসলো শব্দ করে। তবে আরশি রেগে যাচ্ছে দেখে কেনোমতো তরুন্ত ঠোঁট টিপলো মানুষটা। কেশে টেশে গলা পরিষ্কার করে আওড়ালো,
‘আচ্ছা বেশ! এনে দেবো তোমার ছেলের বউ! আর কিছু?’
অমনি হাসি খেলে গেলো আরশির ভার হয়ে থাকা মুখে। জ্বর ট্বর ভুলে খুশিতে ঝুমঝুম করে উঠলো সে। বলাবাহুল্য আরো একখানা আবদার ছুড়ে বসলো শেহজাদের কাছে। তর্জনী তুলে বললো,
‘আর একটা! জাস্ট একটা জিনিস চাইবো!’
শেহজাদ সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠলো,
‘প্লিজ এবার বলো না, যে তোমার নাতি-নাতনীও চাই। নইলে ঘর ফাঁকা ফাঁকা লাগে। আরশি! এতো খরগোশ তুমি একা সামলাতে পারবে?’
আরশি এমনভাবে তাকালো যেনো মহাভারত অশুদ্ধ হওয়ার মতো কিছু বলে ফেলেছে শেহজাদ। মানুষটা এবারেও ঠোঁট টিপে হাসি আঁটকালো। পরপর জিজ্ঞেস করলো,
‘আচ্ছা বেশ! তুমিই বলো তোমার আর কী চাই? আমি এবার আর কিছু বলবো না প্রমিজ!’
আরশি এবার ঋজু হয়ে ঘুরে বসলো শেহজাদের দিকে। ওদিকে হুহু করে জ্বর বাড়ছে তার। সে সেই জ্বরের ঘোরে আচ্ছন্ন হওয়া চোখগুলো দিয়ে দেখলো সম্মুখে বসে থাকা মানুষটাকে। তারপর বললো,
‘যা লাগবে তাই দেবেন?’
‘যা লাগবে তাই দেবো!’
আরশি মিনিটখানেক চুপ থাকলো। তারপর বললো,
‘আমার আপনার আদর লাগবে! যদি মরে টরে যাই এই জ্বরে? ‘আমি এ জীবনে আপনার আদর পেলাম না’ এই আফসোস নিয়ে আপনি আপনার স্নোফ্ল্যাককে মরে যেতে দেবেন?’
শেহজাদ বাকরুদ্ধ হয়। অনাগত শঙ্কায় শক্ত হয়ে আসে তার চোয়ালের পেশি। উঠে যেতে নিলে আবারও হাতখানা আগলে ধরলো আরশি। অভিমানিনীর চোখে চোখ রাখতেই হৃদপিণ্ডের গতি বাড়লো শেহজাদের। শুষ্ক ঢোক গিলে আওড়ালো,
‘ আমার এঘরে থাকাটা তোমার জন্য সেইফ নয় আরশি!’
পরপর আরশির কেটে যাওয়া ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে নরম স্বরে বলে উঠলো,
‘আর না এই অবস্থায় তোমার আমার থেকে পাওয়া কোনো আদর! তোমার এই আবদার তোলা রইলো! আগে সুস্থ হও! তারপর নাহয় চেয়ে নিও আমার থেকে।’
জবাবে থমথমে হলো আরশির মেদুর মুখখানা। অনুযোগের স্বরে আওড়ালো,
‘আদর করলেন না তো? যদি মরে যাই?’
‘মৃত্যু জিনিসটা উপরওয়ালার হাতে। তুমি বললেই তো হবে না স্নোফ্ল্যাক। তোমার আগে আমিও তো মরে যেতে পারি? পারি না?’
আরশি দমে গেলেও থামলো না। কঠিন কন্ঠে জানালো,
‘না পারেন না! আপনাকে তো আমি আরো আগে কোথাও যেতে দেবো না!’
স্মিত হাসলো শেহজাদ। মাথা নুইয়ে হাতের এ্যানালগ ঘড়িতে সময় দেখে আওড়ালো,
‘একটু পরই ভোর হবে। তোমার এখন একটু ঘুমোনো দরকার স্নোফ্ল্যাক! আমি মেডিসিন নিয়ে আসছি দাঁড়াও!’
কিন্তু হাত ছাড়লো না আরশি। আর না মেডিসিন আনতে দিলো শেহজাদকে। কাতর চোখে তাকিয়ে বলে উঠলো,
‘ঘুম নয়, এখন আরশির আপনাকে বেশি প্রয়োজন! এতদূর এসে এভাবে হাল ছেড়ে চলে যেতে চাইছেন?’
শেহজাদ থমকায়। নিজের হাতের কব্জিতে ধরে রাখার আরশির ছোট্ট হাতটার দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ স্বরে আওড়ায়,
‘তুমি সামলাতে পারবে না আমাকে আরশি!’
নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৪৫
শেহজাদের কথার মাঝেই বিছানার উপর উঠে দাঁড়ালো আরশি। ধরে রাখা হাতখানা টেনে কাছে আনলো মানুষটাকে। দুজোড়া তৃষ্ণার্ত চোখ একে অপরের সাথে সন্ধি করলো ভালোবাসার।
আরশি ঝুঁকে এলো অল্প। প্রফেসরকে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের ন্যায় থমকে দিয়ে ঠোঁট ছোঁয়ালো তার অমসৃণ গালে। অস্পষ্টে বললো,
‘আপনি আছেন তো! না হয় সামলে নিয়েন আমাদের দু’জনকেই?’