নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৪৭
সিনথিয়া
এতোগুলো দিন নিদারুণ ধৈর্যের পরীক্ষা দেয়া পুরুষটা অসহায় ঢোক গিললো আরশির সামনে দাঁড়িয়ে। বলিষ্ঠ হাতের আঁজলায় আঁকড়ে ধরলো সম্মুখে দাঁড়ানো রমনীর সরু কোমর। আরশির পায়ের নিচে বিছানা আছে বিধেয় লম্বায় এখন সে শেহজাদের সমান। দুটো ভরসার হাত তাকে ধরে রেখেছে তাই পড়ে যাওয়ার আর ভয় নেই আরশির। সে ঢুলু ঢুলু চোখে ঠোঁট ছোঁয়ালো প্রফেসরের ডান গালে। পরপর নিদ্রাহীন মানুষটার সামনাসামনি হয়ে বললো,
—‘জিজ্ঞেস করবেন না এই চুমুটা কীসের জন্য দিলাম? ক্লাসে এতো কঠিন কঠিন পড়া জিজ্ঞেস করতে পারেন, আর এখন এই সামান্য প্রশ্নটা করতে পারছেন না?’
—‘কেনো দিলে?’
—‘এই চুমুটা দিলাম আমাকে না ভালোবেসেও বিয়ে করার জন্য। আপনি যদি আমার জীবনে না আসতেন তাহলে হয়তো জানতেই পারতাম না যে এতো চমৎকার একটা মানুষও পৃথিবীতে আছে! যে আমাকে আমার মতো করে ভালোবাসতে পারে। আমার পাগলামিগুলো সহ্য করতে পারে!’
হৃদযন্ত্রের গতি বাড়লো শেহজাদের। রুদ্ধশ্বাসে সে চেয়ে রইলো প্রিয়দর্শিনীর পানে। আরশি ফের চুমু খেলো শেহজাদের বাম গালে। তারপর আরো একবার সামনাসামনি হয়ে আওড়ালো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
—‘এই চুমুটা হলো মা-বাবার মতো করে আমার খেয়াল রাখার জন্য। কতদূরে আছি তাদের ছেড়ে। অথচ কখনো মনেই হয়নি, যে আমি তাদের কাছে নেই। কারণ ঐ যে!তাদের ভালোবাসার অভাবটা আপনি কীভাবে যেনো কখনো বুঝতেই দেননি আমায়!’
শেহজাদ স্তব্ধ। স্তবক হারিয়ে যেনো মূর্তিমান সে পুরুষ। আরশি কপালে চুমু খেতেই বিস্ময় সমেত চোখজোড়া বুঁজে ফেললো আবেশে। নীলাদ্রির মতো নিঃশব্দে শুধু শুনলো তার স্ত্রীর আদুরে স্বর,
—‘আর এই চুমুটা আমার মতো করে আমার মা-বাবার খেয়াল রাখার জন্য। এই যে আমি ভুলে গেলেও আপনি প্রতিদিন ফোন করে তাদের খোঁজ খবর নিতে কখনো ভুলে যান না? সেই খবরটা কিন্তু আমি পেয়ে গেছি প্রফেসর! আমি আপনার ব্যাপারে আরো অনেক সিক্রেটস জানি!’
শেহজাদ ধীরে সুস্থে চোখ খুললো। বড় নেশালো দেখালো তার নীল অক্ষিযুগল। মেঘমন্দ্র স্বরে আওড়ালো,
—‘ আচ্ছা? তাহলে আমিও একটু শুনি আমার সিক্রেটসগুলো? আর কী কী জেনেছো তুমি আমার ব্যাপারে?’
—‘এই যে আপনি খরগোশ ভয় পান! এই সিক্রেটস টা অবশ্য মা বলেছে। আপনার খরগোশে ফোবিয়া আছে। তারপরও আপনি কী সুন্দর সেই কেনিয়নের ট্রিপে থাকাকালীন স্নোবলকে আমাদের কাছে রাখতে রাজি হয়ে গেলেন। আবার আজ স্নোবলের জন্য বউ আনতেও রাজি হয়েছেন! ওয়েট আপনার তো তাহলে আরো অনেকগুলো চুমু প্রাপ্য! কাছে আসুন তো। আমার চুমু খাওয়া শেষ হয়নি।’
শেহজাদ এবার আর কাছে এলো না। তবে সপ্রশ্ন কন্ঠে শুধালো,
—‘ উহু! আগে পুরোটা বলো! আর কী কী সিক্রেটস জানো?’
আরশি থামলো এবার। দুষ্টুমি বুদ্ধি ঘুরপাক খেলো তার ছোট্ট মাথায়। দাবি ছুঁড়ে বললো,
—‘ আগে আদর করুন! তারপর বলবো!’
বিপরীতে শেহজাদের বলার মতো কিছু রইলো না।
শেহজাদকে বাকবিতন্ডায় হারিয়ে ঠোঁট টিপে বিজয়ীর হাসি হাসলো রমনী। কিন্তু বিধাতা বোধহয় আরশির এই জিতে যাওয়ার সুখটুকু বেশি সময়ের জন্য তার কপালে রাখলেন না। কারণ তাকে অবাক করে দিয়ে দু’হাতে নাজুক শরীরখানা শূন্যে তুলে ফেললো শেহজাদ।
মেয়েটা হকচকিয়ে শেহজাদের দিকে তাকাতেই বুঝলো তার প্রশ্রয়সুলভ দৃষ্টি শাণিত হয়েছে বহুক্ষণ। আরশি কথা জড়িয়ে ফেললো ততক্ষণাৎ। বলিষ্ঠ দেহসৌষ্ঠব উত্তপ্ত শরীরটা দু’হাতের উপরে রেখে এগিয়ে গেলো দরজার কাছে। পরপর পা দিয়ে ঠেলে লাগিয়ে দিলো ভিড়ানো দরজাটা। আরশি শুষ্ক ঢোক গিললো এবার। ভয়ার্ত হলো তার নিটল কালো অক্ষিপুট।
কিছুক্ষণ আগের দাপুটে রমনী লেপ্টে পড়ে রইলো শেহজাদের বুকে। অন্তঃস্থলে বাড়তে থাকা ঢিপঢিপ আওয়াজের সাথে গলবিল শুকিয়ে এলো তার। অস্পষ্টে শুধালো,
—‘ আ-আপনি দরজা বন্ধ করছেন কেনো?’
শেহজাদের পাতলা অধরপুট নির্বিকার। চোখেমুখে ছদ্ম বিস্ময়টুকুও খুঁজে পেলো না আরশি। তারমানে প্রফেসর মজা করছেন না। সে সিরিয়াস? মানুষটা কেমন গুরুগম্ভীর স্বরে জানালো,
—‘ আদর করবো! তাই বন্ধ করেছি!’
আতঙ্ক ছড়ালো আরশির চোখেমুখে। হড়বড়িয়ে বলে উঠলো,
—‘ আমিও তো আপনাকে আদর করেছি! কই? আমি তো দরজা বন্ধ করিনি!’
শেহজাদ প্রলম্বিত শ্বাস ফেললো এক। বুঝলো যে আদর পাওয়ার জন্য তার স্ত্রী মরিয়া, সেই আদর সম্পর্কে বিন্দু মাত্র জ্ঞান তার স্ত্রীর নেই। শেহজাদের পৌরুষ স্বর হতাশ হয়ে আওড়ালো,
—‘ তোমার আদরে হয়তো হয় না। কিন্তু আমার আদর পেতে চাইলে দরজা বন্ধ করতে হবে। এটা রুলস!’
আরশি বকবক থামালো না। ভয় কাটানোর জন্য হলেও তাকে বকে চলতে হবে এমন অভিপ্রায় মনে নিয়ে সে বললো,
—‘ কিন্তু এটা তো চিটিং! আপনি আপনার ইচ্ছে মতো রুলস এন্ড রেগুলেশনস বানাবেন তা তো হবে না! আপনি শুরু শুরুতেও এমন করেছেন। একগাদা রুলসের স্তুপ চাপিয়ে দিয়েছেন আমার ছোট্ট ঘাড়ের ওপর! ভাগ্যিস মচাত করে ভেঙে যায়নি সেটা। নয়তো এতোদিনে ঘাড় বাঁকা বউ নিয়েই ঘুরতে হতো আপনাকে। সেটা বিষয় না, বিষয় হচ্ছে অন্যটা। আপনি রুলস বানিয়ে তারপর তো নিজেই সেই রুলস ভেঙে ফেলেন। মনে নেই আপনার? এপার্টমেন্টে যখন আপনি রুলস বানিয়েছিলেন আপনাকে না ছোঁয়ার। সেই তো গুন্ডাদের হাত থেকে বাঁচিয়ে নিজেই আমাকে ছুঁয়ে ফেলেছিলেন। ভুলে গেলেন সে…!’
আরশির নিরন্তর কথার ফুলঝুরি থেমে গেলো হুট করে। মাথার নিচে নরম মেট্রেস টের পেতেই ছানাবড়া হলো তার চোখজোড়া। শেহজাদ তখনও সামনে দাঁড়িয়ে। দ্রুত ওঠানামা করছে তার পেশিবহুল বুক। আরশির তাকিয়ে থাকার মধ্যেই একহাতে নিজের টার্টলনেক সোয়েটারটা খুলে ফেললো প্রফেসর। উন্মুক্ত হলো পেটানো শরীর। রমনীর নিশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম ঘটিয়ে সে উঠে এলো বিছানার উপর। চার হাতে পায়ে আরশির মুখোমুখী হয়ে কন্ঠ খাদে নামালো। হাস্কি স্বরে বললো,
—‘ আমি আমার ইচ্ছে মতোই রুলস বানাবো! আর সেগুলো ভাঙবোও নিজের ইচ্ছে মতো। এন্ড বিলিভ মি স্নোফ্ল্যাক, দিস টাইম ইউ উইল নট রিগ্রেট! ইউ উইল নট রিপেন্ট! আই সয়্যার!’
আরশি কথা খুঁজে পেলো না! শ্বাস আঁটকে শুধু ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে দেখলো শেহজাদকে উঠে বসতে। আরশির গলার খাঁজে এতোদিন ধরে নিরুত্তাপিত হয়ে পড়ে থাকা চেইনখানা হাতের আঙুলে তুলে নিলো মানুষটা। আচমকা চেইনটা তোলায় বেরিয়ে এলো হুডি দিয়ে আড়াল করে রাখা বানি পেন্ডেন্টটিও। শেহজাদের ঠোঁটের বাঁকে জিতে যাওয়ার হাসি। যেনো সে স্বগোতক্তিতেই আওড়ালো,
—‘ পেন্ডেন্টটা খুলে ফেলে দিলে ভেবে নেবো তুমি আমাকে ভালোবাসা না! এমন কিছুই বলেছিলাম বোধ হয়! কিন্তু দেখো! আজ আমি নিজে থেকেই জানি যে তুমি আমাকে ভালোবাসো!’
লজ্জায় লাল হয়ে বিছানার সাথে মিশে রইলো আরশি। অন্যদিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললো,
—‘ কিন্তু আমি তো এমন কিছু বলিনি এখনো!’
ফিচলে হাসলো শেহজাদ। চেইনটা আরশির গলার খাঁজে রেখে ঝুঁকে এসে চুমু খেলো তার উপর। পরপর আরশির কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে আওড়ালো,
—‘ ইজ ইট সো স্নোফ্ল্যাক? তাহলে আমি ততক্ষণ পর্যন্ত থামবো না যতক্ষণ পর্যন্ত না তুমি বলবে তুমি আমায় ভালোবাসো!’
আরশি ভড়কালো। মিনিটখানেকের নিস্তব্ধতা ভেঙে শেহজাদ উঠে গেলো বিছানা ছেড়ে। তারপর একে একে নিভিয়ে দিলো ঘরের আলো ঝলমলে সমস্ত বাতি।
অন্ধকার প্রতিটি কোণকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরতেই হুট করে বেজে উঠলো রুমের সাউন্ড সিস্টেম। ততক্ষণে উঠে বসেছে আরশিও। ভীত চোখজোড়া নৈঋতের আঁধারে খুঁজে চললো শেহজাদকে। কিন্তু বিধিবাম! অন্ধকারে তাকে খুঁজে না পেলেও না পায়ের কাছে টের পেলো একজোড়া হাতের স্পর্শ।
আরশি থমকালো। অনুভব করলো তার পদ্মের ন্যায় কোমল পায়ের পাতা হাতের আঁজলায় তুলে নিয়ে সেখানে চুমু বসিয়েছে এক উষ্ণ ওষ্ঠপুট। ত্রস্ত ছলকে উঠলো আরশির বুকটা। আতঙ্কিত স্বরে শুধালো,
—‘শে-শেহজাদ?’
এবারেও নীরব রইলো আকস্মিক পায়ের কাছে আহুতি জানানো সেই ব্যক্তি। তবে নিঃশব্দে সে উঠে এলো আরশির মুখের কাছে। এবার হাতের আঁজলায় তুলে নিলো নরম কোমল কপোল জোড়া। কপালে, গালে, চোখে অজস্র চুমুতে অতিষ্ট করে তুললো আরশিকে। শুধু ঐ পুরন্ত ঠোঁটজোড়ায় আরেকবার নিজের আধিপত্য জানানোর আগেই যেনো সম্মতি পাওয়া সমস্ত তাড়া তার। ধীর কন্ঠে শুধালো,
—‘স্নোফ্ল্যাক! ভালোবাসো আমায়?’
সুখের তাড়নায় শব্দ ভুলে বসলো আরশি। চোখের জল ফেলে শুধু মাথা নাড়লো ওপর-নিচ। মুহূর্তেই শেহজাদ লুফে নিলো তুলতুলে ঠোঁট জোড়া। তারপর চোয়াল বেয়ে সেই ঠোঁট নেমে এলো গলার খাঁজে। আরশিকে পাগলপ্রায় করে আচমকা থেমে গেলো মানুষটা। বলে উঠলো,
—‘মুখে বলো আরশি!’
—‘ভা-ভালোবাসি আপনাকে শেহজাদ! অনেকটা ভালোবাসি!’
প্রফেসর নিঃশব্দে হাসলো। বড় সন্তুষ্টির সে হাসি। আরশিকে বালিশে শুইয়ে ভালোবাসার উষ্ণ চাদরে ঢেকে নিলো দুজনকে। ফিসফিসিয়ে আওড়ালো,
—‘যে রাতে তুমি আমাকে ভালোবাসি বললে, আই উইল মেইক শিওর, সেই রাতের কথা তুমি কোনোদিনও না ভুলতে পারো স্নোফ্ল্যাক! কোনোদিনও না!’
দুটি হৃদয় আজ দ্রবীভূত হলো ভালোবাসায়। গানের তালে মনের সুপ্ত নিবেশন জানাতেই যেনো তাদের কানে ভেসে এলো মৃদু লয়ে কিছু শব্দ তরঙ্গ,
❝আকাশ হারায় যেখানে
ও তোমায় ছোঁবো সেখানে
ও ভালোবাসো এখনি
পরে কি হয় কে জানে
সারাটাদিন
ঘিরে আছো তুমি এত রঙিন
হয়নি কখনও মন
সারাটা রাত..!
আসছে না ঘুম ধরেছি হাত
থাকবো সারাজীবন..!❞
নিউইয়র্কের নিশুতি রাত। হান্টার প্যালেস তার বিশাল লনের মাঝবরাবর একচ্ছত্র আধিপত্য নিয়ে দাঁড়িয়ে। যেনো শহরের বুকে একটুকরো আভিজাত্য মাথা উঁচিয়েছে নিঃসন্দেহে। এর নান্দনিক দেয়ালগুলোতে এখনো ব্যক্তিত্বের ছোঁয়া পাওয়া যায় এ প্যালেসের মালকিনের। সেই দেয়ালগুলোতেই হাত ছুঁইয়ে করিডোর দিয়ে পায়চারি করছে জারা। উলের সোয়েটার গায়ে জড়িয়ে কোনোমতে ঠান্ডার প্রকোপ আঁটকালেও আঁটকাতে পারেনি ভিতর ভিতর হওয়া দুশ্চিন্তাগুলোকে। আর দুশ্চিন্তার সিংহভাগ জুড়ে রয়েছে আয়ান।
এখনো বাড়ি ফেরেনি মানুষটা। না রিসিভ করছে জারার কোনো ফোন কল। পুলিশের ডিউটিতে দিন-রাত নেই। ইমার্জেন্সি মানেই ছুটে যাওয়া ভিক্টিমের এলাকায়। তদন্ত করে বের করা আসল কালপ্রিটকে। ঝক্কির কাজও বটে। কিন্তু আয়ান সেসবের মধ্যেও জারার খোঁজ খবর নিতো। সময় পেলেই একটা ছোট্ট মেসেজ করে জানাতো, ‘আসতে হয়তো দেরি হবে! তুমি না খেয়ে আছো, এটা যেনো এসে না দেখি! খেয়ে নিও লক্ষ্মীটি!’
অথচ আজ সেই মানুষ একেবারেই লাপাত্তা। কিন্তু কেনো? অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদের আশঙ্কায় শুকিয়ে গেলো জারার একহারা আনন। সবহারা মেয়েটা খড়কুটোর মতো শুধু ঐ একটা মানুষকে আঁকড়ে ধরেই তো বাঁচতে চাইছে। তার কিছু হয়ে গেলে…
এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে পা জোড়া আয়ানের ঘরের সামনে এসে থেমেছে, ঠাওর করতে পারেনি জারা।
ভাবনার সুঁতো ছিঁড়তেই কৌতূহলী হলো মন। একটু এগিয়ে নিঃশব্দে ঘরে ঢুকলো সে। প্রিয় মানুষটার ঘর থেকেও বুঝি প্রিয় প্রিয় গন্ধ পাওয়া যায়? জারা চোখ বুঁজেই শ্বাস টানলো। পরপর নজরবন্দি করলো ঘরের জিনিসগুলোকে।
ছিমছাম গোছানো ঘর। বেডসাইড টেবিলের উপর রাখা একটা ফটোফ্রেম। আলো-আঁধারে ছবির মানুষটা অস্পষ্ট। জারা ধীর পায়ে এগোলো সেদিকে। ছবির ফ্রেমটা হাতে তুলে নিতেই নীলাম্বরী থমকালো। প্রকট হলো অক্ষিযুগল। স্বগোতক্তিতে আওড়ালো,
—‘আমার ছবি? এখানে?’
মিনিটখানেক থমকে থেকে নরম হলো বিস্মিত চোখজোড়া। কিছু একটা মনে পড়তেই পাতলা ওষ্ঠপুটে খেলে গেলো এক চিলতে লাজুক হাসি। বুঝলো ছবিটা তার বানর মশাইয়েরই তোলা। তাকে না জানিয়েই তাকে বন্দী করেছে এই স্থিরচিত্রে। ছবির ফ্রেমটা হাত থেকে নামিয়ে ফের টেবিলের উপর রাখতে গিয়েও থামলো জারা। কপালে ভাজ ফেলে দেখলো টেবিলের দ্বিতীয় ড্রয়ারটা খুলে আছে অনেকখানি। কিছু ফাইল অগোছালো ভাবে রাখা সেখানে। ফাইলগুলোকে প্রথমে আয়ানের জরুরী কোনো ডকুমেন্টস ভেবে গুরুত্ব না দিলেও ড্রয়ারটা আটকাতে গিয়েই সন্দিহান হলো জারার অন্তঃকরণ। মনের খচখচানি দূর করতে একটা ফাইল উঠিয়ে হাতে নিতেই আরেক দফা থমকালো রমনী। বিড়বিড় করে আওড়ালো,
—‘ওনার মেডিকেল রিপোর্টস?’
শুকনো ঢোকের সাথে মনের কুচিন্তাগুলো গিলে ফেলতে চাইলো জারা। তবে ভাগ্যবিধাতা বোধহয় চাইলেন অন্য কিছু। একের পর এক সবগুলো ফাইল ঘাটতেই রঙ হারালো জারার মেদুর মুখখানা। থমথমে মুখে হাঁটু ভেঙে বসে পড়লো আয়ানের বিছানার পাশে। ফাইলগুলো পড়ে রইলো মেঝেতে। শুধু দু’হাতে মুখ চেপে ডুকরে উঠলো একটু পরপর। করতালুর সামনে আঁটকে রইলো তার আর্তচিৎকার। অফিসারের আদুরে চুমুতে সিক্ত হওয়া গাল জোড়া ভিজে উঠলো নোনা জলে। জারার বাঁধ ভাঙা কান্নায় হয়তো শহরজুড়ে নেমে এলো বিষন্নতা। হাসতে ভুলে গেলো পিচঢালা রাস্তার সোডিয়াম আলো। তবে থেমে রইলো না ব্যস্ত নগরী। জারার চোখের পানির মতোই অম্বরের গা বেয়ে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে ঝরে চললো ফেব্রুয়ারীর শেষ তুষারকণা গুলো।
—‘আপনার রিপোর্টগুলো আমি দেখলাম মিস জারা!’
জারার সামনেই বসে আছেন নিউরোলজিস্ট ক্যাথারিন। হাসিখুশী মধ্যবয়স্কা হুট করেই গম্ভীর করে ফেললেন চোখমুখ। থমথমে কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
—‘ কিছু মনে করবেন না মিস জারা! পেশেন্ট কী আপনার পরিচিত?’
জারার হুঁশ ফিরলো যেনো এতক্ষণে। সেই কোন সাতসকালে কোনো এক ঘোরের মধ্যে এসে উপস্থিত হয়েছে এই হসপিটালে? সে কথা ঠিক ঠাওর করতে পারলো না উদভ্রান্ত চেহারার জারা। সে ভূতগ্রস্তের ন্যায় জবাবে বললো,
—‘ উনি আমার হাসবেন্ড!’
ক্যাথারিন প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে মাথা নোয়ালেন। বোঝার চেষ্টা করলেন জারার অবস্থাটা। খুব একটা পারলেন না বোধ হয়। তবুও শান্ত স্বরে বললেন,
—‘আ’ম সো সরি ডিয়ার। কিন্তু আমি আশা করবো আপনি নিজেকে শক্ত রাখবেন। আসলে আপনার হাসবেন্ড…আলঝেইমার্সে আক্রান্ত!’
জারা যেনো এখনো বিশ্বাস করতে পারলো না কথাটা। অথচ রাত থেকে শ’খানেক বারের বেশি হলেও সে নেট ঘেটেছে এই বিষয়টা নিয়ে। যদি একটু আশার আলো পাওয়া যায়? হয়তো এই রোগটা তেমন মারাত্মক কিছু নয়?
তার প্রশ্নবিদ্ধ অসহায় চোখদুটো দেখে ক্যাথারিনের মায়া হলো ভীষণ। কতটুকুই বা বয়স হবে মেয়েটার? তবুও যতটুকু না জানালেই নয়, ততটুকু বলে গেলো মূক বোনে বসে থাকা জারাকে,
—‘এটি একটি মস্তিষ্কের রোগ। ক্যান্সারের মতো দ্রুত মানুষকে মেরে না ফেললেও এই রোগের কারণে মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষগুলো ধীরে ধীরে এতোটাই অকার্যকর, অচল হয়ে পড়ে, যা শেষ পর্যন্ত রোগীর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মস্তিষ্কের কোষগুলো ধ্বংস হওয়ার ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি প্রথম যে সমস্যায় পড়েন তা হলো… স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলা! তারপর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক কাজকর্মেও এর প্রভাব পড়তে শুরু হয়! যেমন ধরুন খাবার খেতে ভুলে যাওয়া, কোনো কিছু মনে রাখতে না পারা, মানুষ চিনতে না পারা! হ্যাভ ইউ নোটিসড এ্যানি অফ দিস সিনড্রোমস ইন ইয়র হাসবেন্ড?’
জারা মাথা নাড়তেও যেনো ভুলে গেলো এই মূহুর্তে। ক্যাথারিন ফের শুধালেন,
—‘হ্যাভ ইউ নোটিসড মিসেস জারা?’
জারা শূন্য দৃষ্টিতে দু’পাশে মাথা নাড়লো এবার। পরপর ক্যাথারিনের দিকে তাকিয়ে বড্ড অসহায়ের মতো শুধালো,
—‘ আর কি কোনো উপায় নেই ওনাকে সারানোর?’
ক্যাথারিন হাতের রিপোর্টগুলো উল্টে পাল্টে বললেন,
—‘দেখুন মিসেস জারা! রিপোর্টগুলো দেখে যতদূর বুঝতে পেরেছি, আপনার হাজবেন্ড চেষ্টা করেছিলেন। হি ট্রাইড হিজ বেস্ট! কিন্তু এই রোগগুলোর আসলে কোনো প্রতিষেধক নেই। না আপনি সারা জীবনের জন্য রোগটা সারিয়ে ফেলতে পারবেন! কিছুটা ডায়বেটিস এর মতো! মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পিছু ছাড়বে না!’
জারা শুষ্ক ঢোক গিললো। গলার কাছে দলা পাকানো কান্নাগুলো গিলে শুধালো,
—‘আমাদের হাতে আর কতটুকু সময় আছে ডক্টর?’
ক্যাথারিন পোড়া শ্বাস ফেললেন। তার পেশেন্ট মূলত পয়ষট্টি উর্ধ্বো মানুষজন৷ যে বয়সে আয়ান এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে সেই বয়সটা বিরল। কিন্তু পরিণতি নয়! এতো কম বয়সে এই রোগে আক্রান্ত পেশেন্ট তিনি পেয়েছেন হাতেগোনা মাত্র কয়েকজন। উনি শান্ত স্বরে বললেন,
—‘প্রাথমিক পর্যায়ে এই রোগ শনাক্ত হলেও রোগী বড়জোর চার থেকে আট বছর বাঁচে। তবে খুব রেয়ার কেসগুলোতে হয়তো পেশেন্ট বিশ বছর অবধি সারভাইভ করতে পেরেছে। মিসেস জারা! আপনাদের দু’জনের বয়সই কম। আমি বলবো, প্রার্থনা করুন! যেখানে চিকিৎসাবিজ্ঞান হাত গুটিয়ে ফেলে, সেখানেই উপরওয়ালার খেল শুরু হয়! এতটুকু ভরসা রাখুন ভাগ্যের উপর! দেখুন কী হয় শেষ পর্যন্ত!’
কিন্ডারকেয়ার স্কুলটির ছুটি হওয়ার সময় এখন। জারা বাচ্চাদের ক্লাস শেষ না করে নিজে বের হবে না। অগত্যা বাইকের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনলো অফিসার।
গতরাতে আদিকে খুঁজে বের করার চক্করে ফিরতে পারেনি বাসায়। ফোন করে জানাতেও ভুলে গেছে জারাকে। ইদানীং এমন হচ্ছে। কোনো কিছুই যেনো ঠিকঠাক মনে রাখতে পারছে না। আয়ান বেশ বুঝতে পারলো এমন চলতে থাকলে কোনো এক সময় পুলিশের উর্দিটাও ছাড়তে হবে ওকে। অসুস্থ মানুষকে নিশ্চয়ই এরা চাকরিতে রাখবে না!
অসুস্থ? আয়ান তো ভুলেই বসেছিল কথাটা। ইশ! প্রেয়সীর ভালোবাসায় রোগ ভুলে দিব্যি কেমন কাটিয়ে দিচ্ছিল দিনগুলো? এমন আর কটা দিন কাটাতে পারলে ভালো হতো না? অন্তত জারার আসল বাবা-মাকে খুঁজে বের করার আগ অবধি? নয়তো যে আবার একা হয়ে যাবে মেয়েটা! পুরো পৃথিবীতে একা বেঁচে থাকার মতো কষ্ট বোধহয় মৃত্যুতেও নেই। সেই কষ্ট, মরে গিয়ে কী করে সে দেবে তার বাটারফ্লাইকে?
আয়ানের ভাবনার মধ্যেই ক্লাসরুম থেকে বের হলো জারা। থমথমে মুখটা আয়ানকে দেখেই কঠিন হলো ভীষণ। নীলাম্বরীর চোখে চোখ পড়তেই ঋজু হয়ে দাঁড়ালো আয়ান। কিঞ্চিত হাসার চেষ্টা করলেও জারার থমথমে মুখ দেখে দপ করে নিভে গেলো তার হাসি। পুরো একদিন পর দেখা ওদের। তাতেই বোধহয় রেগে আগুন ম্যাডাম!
এমনটাই মনে মনে ভেবে নিলো অফিসার। প্রেয়সীর অভিমান ভাঙাতে ধীরে ধীরে দু’হাত তুললো কান বরাবর। পরপর
আশেপাশের সবাইকে অবাক করে দিয়ে কানের নরম অংশ ছুঁয়ে মাথা নোয়ালো অপরাধীর মতো। একজন সাধারণ স্কুল টিচারের সামনে একজন অনডিউটি পুলিশ অফিসারের কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকার বিষয়টা বেশ উপভোগ করলো পথচারীরা। ঠোঁট টিপে হাসলো মাঠে থাকা ছোট ছোট বাচ্চাগুলোও।
জারা এগিয়ে এলো নিঃশব্দে। নির্লিপ্ত তার মুখাবয়ব। কার্ডিগান আর জিন্সে বড্ড ছিমছাম তার পরিচ্ছদ।
আয়ানের সামনে এসে দাঁড়াতেই পাশ থেকে হাতের আঙুল টেনে ধরলো নয়-দশ বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে। জারা চমকে সেদিকে তাকাতেই মেয়েটা ফিসফিস করে বললো,
—‘টিচার! এই কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ আঙ্কেলটা কি তোমার বন্ধু?’
জারার নির্লিপ্ত ভীষণ মুখখানা নরম হলো এবার। ঝুঁকে এলো মেয়েটার দিকে। স্ফীত চোখজোড়া হেসে শুধালো,
—‘কেনো বলো তো?’
মেয়েটা একবার মাথা তুলে তাকালো আয়ানের নির্বুদ্ধ মুখের দিকে। তারপর জারার দিকে তাকিয়ে বললো,
—‘উনি তো অনেক সুন্দর আর লম্বা, তাই আমি ঠিক করেছি, বড় হলে এই পুলিশ আঙ্কেলটাকে আমারও বন্ধু বানাবো! তারপর বিয়ে করবো! আমি তোমার বন্ধুকে বিয়ে করলে তুমি কি কষ্ট পাবে?’
কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যালে দৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকার মধ্যেই জারা শুনলো এক মহিলা কন্ঠ। কেউ একজন তাদের কাছে এসে বলছে,
—‘অলিভিয়া! আবার পাঁকা পাঁকা কথা বলছো তুমি! দাঁড়াও আজকেই জানাচ্ছি তোমার পাপাকে!’
পরপর জারা আর আয়ানের দিকে একবার করে তাকিয়ে ভদ্র মহিলা বলে উঠলেন,
—‘আসলে মেয়েটা এতো দুষ্ট হয়েছে না! আপনারা প্লিজ কিছু মনে করবেন না!’
এতক্ষণে মৃদু হাসি খেলে গেলো জারার বিস্ময় বিমূঢ় মুখে। বুঝতে পারলো বিব্রত মুখেও যিনি সৌজন্যতার হাসি হাসছেন সেই ভদ্র মহিলা বাচ্চাটার মা। আর বাচ্চা মেয়েটার নাম অলিভিয়া। কিন্তু জারা ভালোমন্দ কিছু বলার আগেই হুট করেই তাদের মাঝে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো আয়ান। ঠিক অলিভিয়ার সম্মুখে। মেয়েটার মাথার চুলগুলো একহাতে এলোমেলো করে দিয়ে বললো,
—‘কিন্তু তুমি বড় হতে হতে আমি যদি হারিয়ে যাই? তখন আমাদের বিয়েটা কী করে হবে?’
অলিভিয়া আয়ানের প্রশ্নে চিন্তায় পড়ে গেলো খুব। মিনিটখানেক কিছু একটা ভেবে জারার দিকে তাকালো। তারপর চিন্তিত স্বরে বললো,
—‘আসলেই তো! বন্ধু হারিয়ে গেলে আমার আর বন্ধুর বিয়ে কি করে হবে টিচার?’
জারাও এবার হাঁটু গেড়ে বসলো অলিভিয়ার সামনে। পাশাপাশি হলো ওরা দু’জন। গোটা এক যুগ পর যেনো আয়ান কাছাকাছি পেলো তার প্রেয়সীকে। মুগ্ধ দৃষ্টিতে শুধু দেখে গেলো তার মুখখানা। জারা খুব যত্ন নিয়ে এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে দিলো অলিভিয়ার। পরপর ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো আয়ানের দিকে। আয়ানের হেমচোখে চোখ রেখে বললো,
নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৪৬
—‘টিচার আছি না? অলিভিয়া বড় হওয়া পর্যন্ত অলিভিয়ার এই বন্ধুটাকে আমি কোত্থাও হারিয়েও যেতে দেবো না! কোত্থাও না!’
অলিভিয়া তার ছোট্ট কনিষ্ঠা আঙুলটি এগিয়ে দিলো জারার সামনে। বিষন্ন মুখে শুধালো,
—‘প্রমিজ?’
জারা স্মিত হাসলো। নিজের কনিষ্ঠা আঙুলে জড়িয়ে নিলো অলিভিয়ার আঙুলটা। আয়ানের দিক থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই বিষন্ন স্বরে বলে উঠলো,
—‘প্রমিজ!’