নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৫১
সিনথিয়া
নিউইয়র্কের সন্ধ্যার আকাশটা আজ ভীষণ আদুরে। চঞ্চলা কিশোরীর শাড়ির পাড়ের মতো আলুথালু আঁধার নেমেছে শহরের গায়ে। নিয়ন আলোতে নীরব স্নান সেরে নিচ্ছে জেব্রা ক্রসিং আঁকা ব্যস্ত সড়ক। ঘরমুখী পথচারীদের ক্লান্ত পদচারণা বেড়েছে সেখানে। সাথে বেড়েছে কলেজ-ভার্সিটি ফেরত তরুণদলের খিলখিল হাসির শব্দ। মুক্ত বিহঙ্গের মতো বাঁধহীন হয়েছে তাদের উচ্ছ্বাস।
হাসির শব্দে মুখরিত হাসান ভিলার বসার ঘরও। শেহজাদের চিমটি খেয়ে আয়ান পেট চেপে ধরে নুয়ে পড়তেই জারার সে কি হাসি! আয়ান আড়চোখে দেখল সেই হাস্যোজ্জ্বল মুখটা। ধীরে ধীরে পুরু ঠোঁটজোড়া প্রসারিত হলো তারও।
আরশি দুই বন্ধুর কান্ড দেখে আইঢাই করে উঠল। এভাবে মারামারি করলে যে সর্বনাশ! তবে মুখ ফুটে ওদের থামতে বলার আগেই ঋজু হয়ে উঠে দাঁড়াল আয়ান। বোঝাই যাচ্ছে, শেহজাদ চোখ রাঙিয়ে শাসালেও তার খুব একটা প্রভাব পড়েনি তার উপর। সে তখনও নির্নিমেষ তাকিয়ে জারার মুখপানে। একহারা মুখটা লালিত, হাসির তোড়ে। সেদিকে তাকিয়ে থেকেই যেন স্বগোতক্তি করল অফিসার। ঘোরলাগা স্বরে বলে উঠল,
‘ শায়ান! আমাকে আরেকটা চিমটি দে তো ভাই!’
দৃষ্টি অনুসরণ করল শেহজাদ। তাকাল আয়ান যে দিকে তাকিয়ে আছে সেদিকে। পরপর জারাকে দেখেই চতুর মস্তিষ্ক বুঝে ফেলল যা বোঝার। যে ছেলের সকল রোগের অব্যর্থ মাদুলি তার চোখের সামনেই দাঁড়িয়ে, তার শরীরে ব্যথা অনুভব হবে কী করে?
শেহজাদ ছোট করে শ্বাস ফেলল। দুদিকে মাথা নেড়ে দৃঢ় কন্ঠে শুধাল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘ কেন? একটা খেয়ে মন ভরেনি?’
আয়ান লাজুক হাসল এবার। মাথা নুইয়ে নিম্নাষ্ঠ পিষলো দাঁতের মাঝে ফেলে। সেসব দেখেই মুখটা বিকৃত করে ফেলল শেহজাদ। এই বাঁদর যে হাজার একটা মেয়ে ফেলে একজন মেয়ের প্রেমে পড়েছে শেষমেশ, এটা বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছে প্রফেসরের।
হুট করেই আয়ান এক পা দু’পা করে চেপে এলো শেহজাদের পাশে। স্বর নামিয়ে আওড়াল,
‘ বাটারফ্লাইকে হাসানোর জন্য তোর থেকে এমন হাজার একটা চিমটি খেতেও এই আয়ান হান্টার রাজি!’
শেহজাদ তার প্যান্টের পকেটগুলোতে হাত ঢুকিয়ে মিনিটখানেক দাঁড়িয়ে রইল গম্ভীর মুখে। বন্ধুর সন্দেহী দৃষ্টির তোপে পড়ে ঘাবড়াল আয়ান। গলার চামড়া চিমটি দিয়ে ধরে রেখে, সাফাই দেয়ার মতো করে বলে উঠল,
‘ আমি সিরিয়াস ওর ব্যাপারে! সত্যি!’
শেহজাদের চোখমুখ কঠিন।
‘ তুই তো স্কুলে পড়ার সময় জিওগ্রাফি ম্যামের ব্যাপারেও সিরিয়াস ছিলি! তাকেই নাকি বিয়ে করবি! এখন আমি বুঝব কী করে যে এবারেও তেমন কিছু নয়?’
আয়ান মিইয়ে গেল অমনি। থমথমে গলায় বলল,
‘ পয়েন্টে এসো বন্ধু পয়েন্টে এসো! আমার ফ্লার্টিং স্কিল ভালো ছিল বলেই আমি ম্যামকে পটাতে পেরেছিলাম আর তুমি পারনি! তাই বলে..’
‘ ওটাকে পটানো বলে? ওটাকে বিরক্ত করা বলে আয়ান! তোর যন্ত্রণায় বিরক্ত হয়ে ম্যামকে স্কুল ছেড়ে অন্য জায়গায় চাকরি নিতে হয়েছিল!’
আয়ান ধরা পড়ে গেছে! কিন্তু বাটারফ্লাইয়ের সামনে তো আর নিজের মান সম্মান উড়িয়ে দেয়া যায় না! তাই জান এবং মান দুটোই বাঁচাতে শেহজাদের কথাগুলোই হাত নেড়ে উড়িয়ে দিলো।
‘ সে যাই হোক! তাই বলে তুই হিংসে করবি আমাকে? অথচ এই তুই, হ্যাঁ তোকেই বলছি! তুই ছোটবেলায় কত আলাভোলা ছিলি শায়ান। আর এখন সেই তুই ঐ বাচ্চা মেয়েটার জীবন একেবারে ত্যানা ত্যানা করে ছাড়ছিস! সেখানে এই বয়সে এসে কিছু না করেও সব দোষ আমার তাই না? এইজন্যই..এজন্যই কবি বলেন..’
শেহজাদ ভ্রু কুঁচকে রেখেছে। আয়ান কথা শেষ করার আগেই সে বিরক্ত হয়ে শুধাল,
‘ কী বলেন?’
এবার শেহজাদের থেকে কিছুটা নিরাপদ দূরত্ব অবলম্বন করল আয়ান। বলেই যেন দৌঁড় দিতে পারে এমন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে অনেকটা সাহস করে বলল,
‘ দুষ্টু বন্ধু প্রফেসর হইলেও পরিত্যাজ্য!’
শেহজাদ হেসে ফেলতে গিয়েও থামল। তবে আয়ান থেমে নেই। সে এক দৌঁড়ে আরশির পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। তারপর গলা উঁচিয়ে শেহজাদের উদ্দেশ্যে শুধাল,
‘ নেহাৎ আমার মতো ভালো মানুষ তুই তোর ঐ লাখ টাকার ঘড়ি বেচেও পাবি না, তাই তোকে এখনো ত্যাজ্য করিনি! নইলে আয়ানের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কী বলছে জানিস?’
আরশি বোকা বোকা চোখে পিছনে ঘাড় ঘোরাল। নিষ্পাপ কণ্ঠে জানতে চাইল,
‘ কী বলছে ভাই?
আয়ানের বলতেও হলোনা কিছু। তার আগেই জারা এগিয়ে এলো ওদের সামনে। হাতের ফুলের তোড়াটা টেবিলে কেকের পাশে রেখে হাসি আঁটকে বলল,
‘ বানরমশাই, তুমি যা বলেছ তাতেই তোমার কপালে দুঃখ আছে! দয়া করে তোমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়কে আর কিছু বলতে বলো না। আজকের মতো চেপে যাও! নইলে বাসায় ফিরতে পারবে বলে মনে হয় না! তুমি মার না খেলেই হয় প্রফেসরের হাতে!’
জারা আয়ানকে যে আপনি বাদ দিয়ে তুমি করে ডাকছে, সেটা বুঝতেই থেমে গেল আয়ান। সদ্য প্রেমে পড়া কিশোরের মতো হাসল মনে মনে। তবে সেই হাসি স্থানী হলো না বেশিক্ষণ। ওদের এই ঠাট্টা আনন্দের মধ্যেই সিড়ির ওপর থেকে ভেসে এলো এমিলিয়ার কন্ঠ।
‘কে কী খাবে জানি না। তবে আরশি যে খালামুনির কাছে বড়সড় একটা ধমক খাবে সেটা বেশ বুঝতে পারছি!’
আরশিরা একযোগে সেদিকে তাকাতেই হিলে আওয়াজ তুলে নিচে নেমে এলো এমি। জারা তো একপ্রকার ভুলেই গিয়েছিল যে এই বাড়িতে আরো একজন আছে। এমিলিয়া! আয়ান বিরক্ত হয়ে আরশিকে ফিসফিস করে শুধাল,
‘ এই এনিমিয়া না এমিলিয়াকে এখনো বের করোনি বাড়ি থেকে?’
আরশি তপ্ত শ্বাস ফেলল। নিজেও কন্ঠে নামিয়ে বলল,
‘ ওনার খালাতো বোন হয় এই এমিলিয়া। বেড়াতে এসেছে খালার বাড়ি। কী করে বের করবো আয়ান ভাই? কী সব বলছো? মা কষ্ট পাবেন না?’
আয়ান জারা দু’জনই বেশ বুঝতে পারছে আরশিকে এমিলিয়া সহ্য করতে পারে না। এইজন্যই তো সুযোগ পেলেই চলে আসে ভুল ধরতে৷ অথচ এই মেয়েটা এখনও অন্যের কষ্ট নিয়ে ভাবছে?
এমিলিয়া নিচে এসেও চুপ করে নেই। বুকে হাত গুঁজে আরশির সামনে দাঁড়াল। তাচ্ছিল্যের স্বরে বলে উঠল,
‘ কী ভেবেছ? এসব করে খালামুনির মন গলাবে? তারপর আদরের ছেলের বউকে সে মাথায় করে নাচবে? ভুলে যেও না আরশি, খালামুনি কেন পছন্দ করেন না এসব বার্থডে সেলিব্রেশন! তোমার জন্য নিজের মেয়েকে হারিয়েছে সে! তোমার জন্য এতগুলা মানুষ এতগুলো বছর ধরে সাফার করে আসছে! আর তুমি দু’দিনের মেহমান, আসতে না আসতেই নিজের ইচ্ছেখুশি মতো এসব বাইরের লোকদের দাওয়াত করে এনে এ বাড়ির মানুষগুলোর দুঃখ ভোলাতে চাইছ?’
এমিলিয়া আরও কিছু বলতে উদ্যত হলেও তার আগেই তার মুখোমুখি হলো শেহজাদ। আরশিকে নিজের পেছনে আড়াল করে দাঁড়িয়ে কঠিন কন্ঠে শুধাল,
‘ কী সমস্যা তোর?’
এমিলিয়া তখনও ফুঁসছে রাগে। আঁটসাঁট পোশাক পরনের বিদেশি গোছের মেয়েটা যেন শেহজাদকেও ভয় পেলো না মোটেও।
‘ সমস্যা আমার না তোমার বউয়ের? পুরো বাড়ি সাজিয়েছে, কীসব রান্না করেছে, কেক এনেছে, বাইরের কতগুলো মানুষকে আবার ইনভাইটও করেছে! তুমি জানো না খালামুনি কেন আজকের দিনটা পছন্দ করে না? তারপরও তোমার বউয়ের এসব করার সাহস হয় কী করে?’
শেহজাদের কপালের নীল শিরাগুলো দপদপ করছে ক্রোধে। নিজেকে যথাসম্ভব আঁটকে রাখছে রাগের মাথায় অসংগত কিছু করে বসার থেকে। ওর সাহস কী করে আরশির ব্যাপারে এগুলো বলার?
দাঁতে দাঁত পিষলো শেহজাদ। কঠোর হলো চোয়ালের পেশি। অবিচল স্বরে আওড়াল,
‘ ফর ইয়র কাইন্ড ইনফরমেশন এমিলিয়া! আমার বউ এসব করার সাহস অবশ্যই এবং অবশ্যই আমার থেকে পায়। আমার মায়ের থেকেও পায়। ও এ বাড়ির বউ! দু’দিনের মেহমান নয়, আর না আয়ান জারা বাইরের লোক। আয়ান আমার বন্ধু আর জারা তার উড বি ওয়াইফ। সো ফারদার যদি তোর মুখ থেকে আমার কাছের মানুষগুলোর ব্যাপারে উল্টোপাল্টা আর একটা কথাও শুনি, তাহলে আমি ভুলে যাব যে তুই আমার কাজিন!’
দীর্ঘাকায় ঐ পিঠের পিছনে দাঁড়িয়ে বড় মুগ্ধ হলো একজোড়া দৃষ্টি। প্রসন্নতায় টলমল করে উঠল অন্তঃপুট। আরশি কখনও কী ভেবেছিল এই মানুষটাই তার হয়ে রুখে দাঁড়াবে পুরো পৃথিবীর বিরুদ্ধে। হয়ে উঠবে তার ঢাল। আগলে নেবে সব বিপদ থেকে?
আয়ান জারাও একে অপরের দিকে তাকাল স্মিত হেসে। এমিলিয়ার কথায় খারাপ লাগলেও সেই খারাপ লাগাটুকু যেন ধুয়ে মুছে গেল নিমেষে। মুহুর্মুহ কানে ভাসছে, ‘আয়ান জারা বাইরের লোক নয়!’
ওদিকে এমিলিয়ার চোখ টইটুম্বুর জলে। প্রচন্ড রাগে নত হলো মুখ। মাথা নোয়াল। নিজে অতিরিক্ত স্পর্ধা দেখাতে গিয়ে ভুল করেছে। তাই বলে এতগুলো কথা শোনাবে শেহজাদ ওকে?
এমিলিয়া ছুটে নিজের ঘরে যেতে গিয়েও থামল। মেহমেদ হাসান আর মরিয়ম বেগমকে সিড়ি ভেঙে নিচে নামতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল সিঁড়ি গোড়ায়। মরিয়ম কোনো একটা বিষয় নিয়ে হাসছিলেন মেহমেদের সাথে। সেই হাসিতে ঝলমল করছে তার প্রৌঢ় মুখখানা। এমিলিয়া থমকায়। তবে কী ভুল ছিল ও? খালামুনি রেগে নেই আরশির উপর এই আয়োজন করার জন্য? সবটা তার অনুমতিতেই হয়েছে?
মরিয়ম বেগম এমিলিয়ার সামনাসামনি এসে থামলেন। এই মাত্র হয়ে যাওয়া ঘটনা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞাতবহাল থাকায় আলতো হাতে কাঁধ স্পর্শ করলেন মেয়েটার। অমায়িক হেসে বলে উঠলেন,
‘ ওমা! এমি? যাচ্ছিস কোথায়? কেক কাঁটবি না আমাদের সাথে? আয় আয়!’
এমিলিয়া ভেজাচোখে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল একবার শেহজাদের কঠিন মুখটার দিকে। তার আদলে যে স্পষ্ট ঘৃণা এমিলিয়ার জন্য। সে কী করে থাকবে এখানে?
অমনি আরশিও গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে এলো তার কাছে। দোনোমোনো করে হাতটা ধরলো এমিলিয়ার। নরম স্বরে বলল,
‘ যা হয়ে গেছে ভুলে যাও! খালামুনির এতো আনন্দের একটা দিনে তার এমি মুখ ভার করে ঘরে বসে থাকবে? এসো আমার সাথে! সবাই মিলে কিছুটা সময় কাটালে, আনন্দ করলে, দেখবে আমাদেরকে অতোটাও আর খারাপ লাগবে না তোমার!’
এমিলিয়া অপ্রস্তুত হলো ভীষণ। তার এখানে থাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই! তবুও কেন যেন আরশির কথা পারলোনা ফেলতে। আলগোছে ওপরনিচ মাথা দুলিয়ে সে থাকবে বোঝাতেই স্মিত হাসলো আরশি।
ওদিকে আয়ান কন্ঠে বিস্ময় ঢেলে জারাকে শুধাল,
‘ বাটারফ্লাই? আমাদের স্নোবল স্কয়াডের টিম লিডার কী দিয়ে তৈরি বলো তো?’
জারার বিস্মিত চোখজোড়া তখনও মিটমিট করে হাসছে মুগ্ধতায়। একটু আগে রাগ তারও উঠেছিল। প্রফেসর সামনে এসে না দাঁড়ালে ও নিজেই চড় থাপ্পড় কিছু একটা দিয়ে ফেলত এমিলিয়াকে। কিন্তু এখন সেই রাগ পড়ে গেছে। আয়ানের প্রশ্নে লম্বা এক দম নিয়ে মেয়েটা আওড়াল,
‘ মাটি মাটি!’
‘ তাই বলে ঐ কুচুটে এনিমিয়াকে এত সহজে মাফ করে দিলো?’
এবারে আয়ানের দিকে ফিরে চাইলো জারা। বিমূঢ় চোখজোড়ায় চোখ রেখে আওড়াল,
‘ এমিলিয়ার মতো বিদেশিনীরা এ তল্লাটে যতই আমাদের নিজের চোখের বালি ভাবুক, আমাদের পিছনে ফেলে দিতে চাক! ধূলোবালি ঝেড়ে ঝুড়ে নতুন উদ্যমে আমরাও উঠে দাঁড়াতে পারি! শত্রুকেও আপন করে নিতে পারি।
কারণ আমরা বাঙালিরা ঠেকে শেখা মানুষ। সামনাসামনি দু ঘা না লাগাতে পারলেও অপমানিত হয়ে ধুকে ধুকে মরি না। হয় শুধরে দেই নয় তো শোধরানোর সময় দিয়ে আগলে নেই! ঠেলে ফেলে দেই না! বুঝলে অফিসার?’
জারা কথা শেষ করতেই তার সামনে এসে দাঁড়াল মরিয়ম। জারা থমকালো। চমকে দেখল হালকা গোলাপি সুতির শাড়িতে হাসিহাসি মুখে দাঁড়িয়ে থাকা প্রৌঢ়াকে।
হুট করেই মরিয়ম দু’হাত দু’দিকে ছড়ালেন৷ ইশারা করে বোঝালেন তাকে জড়িয়ে ধরতে। জারাও সময় নিলো না৷ হেসে উঠে জড়িয়ে ধরলো মরিয়মকে। মা মা গন্ধে মত্ত হলো নাসারন্ধ্র। কী আরাম, কত শান্তি! মায়েদের বুকে মাথা রাখলে বুঝি এমন শান্তি লাগে? গাজীপুরে থাকতে সে তো কতবার তার মণিকে জড়িয়ে ধরেছে। কই? তখনও তো এতো শান্তি পায়নি সে?
মরিয়ম বেগম ধীরে ধীরে জারার চুলে হাত বোলালেন। শান্ত স্বরে বললেন,
‘ তুমি যে এসেছ! আমি খুব খুশি হয়েছি! তোমাকে যে একেবারে আমার রুশার মতো লাগে মা!’
জারা তখনও পরে আছে মরিয়মের বুকে। ভেজা চোখ নিয়ে আওড়াল,
‘ আর তোমাকে একেবারে মায়ের মতো!’
‘ আমি তো মা-ই! তোমাদের সবার মা!’
আয়ানও ধীর পায়ে এগিয়ে এলো মরিয়মের সামনে। পুরুষালী কন্ঠে আবদার মেখে মেকি অভিমান দেখিয়ে বলল,
‘ আর আমি বুঝি কোনো আদর পাবো না? সব আদর আমার বউই নিয়ে যাবে নাকি?’
আয়ানের কথা শুনে হেসে ফেলল সবাই। মেহমেদ হাসানও তার গম্ভীর মুখের হাসি চেপে রাখতে পারলেন না। শেহজাদ আরশি তাকালো একে অপরের দিকে। তাদের মুখেও লেগে আছে খুশির চিহ্ন। তবে সেই চিহ্নের গাঢ়ত্ব সবচেয়ে বেশি আরশির মুখে। কেক কাটার আগেই তার যে আরো অনেক কাজ বাকি।
আয়ানের প্রশ্নের পিঠে মরিয়ম বেগমও দুষ্টুমি করে শুধোলেন,
‘ এত লম্বা ছেলেকে আদর করবো টা কী করে? দেখি মাথা নোয়া!’
আয়ান শেহজাদের দিকে তাকিয়ে গর্ব করে বলল,
‘ দেখলি? দ্যাখ! এখন তুই খালি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবি আর লুচির মতো ফুলবি! মাঝখান দিয়ে সব আদর আমি আর জারা মিলে ভাগাভাগি করে নিয়ে যাব!’
শেহজাদ অবশ্য লুচির মতো ফুলল না ঠিকই তবে ঠোঁট টিপলো আয়ানের কথায়৷ হাসলেই তো আবার মাথায় চড়ে বসবে বাঁদর টা।
আয়ান এসব বলে টলে একটু ঝুঁকতেই তার গালে হাত রাখলেন মরিয়ম। বললেন,
‘ দোয়া করি যেন হাজার বছর বেঁচে থাকিস বাবা। আমার এই মেয়েটাকে সুখে রাখিস!’
‘ আর নাতিনাতকুরের জন্য দোয়া করবে না? লাইক শত পুত্রের বাবা হও অর সামথিং?’
আবারও একদফা হেসে উঠল সবাই। মরিয়ম বেগম হাসতে হাসতে বললেন,
‘ ঐ দেখ! ভুলেই তো গিয়েছিলাম! হ্যাঁ হ্যাঁ! শত পুত্রের বাবা হও! আমাদের এই দুই বুড়ো বুড়িকে তাড়াতাড়ি নানা-নানু দাদা-দাদু বানিয়ে ফেল তো দেখি! শায়ানকে বললে তো শুনবে না! তোরাই ভরসা!’
জারার বুকটা ধক করে উঠল মরিয়মের কথা শুনে। এত সুখ কি আদৌও ওর কপালে আছে? আদৌ কি হবে ওদের সংসার? পারবে তো সারাজীবন একে অপরের হাত আগলে ধরে রাখতে? এই গোটা জীবনটা ভাগ্যের পরিহাসে একা কাটাতে হবে না তো কখনও?
আরশি লাজুক হাসল। চোখ তুলে তাকাতে পারলনা পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার পানে৷
এবারে তাগাদা দেয়া শুরু করলেন মেহমেদ। হাত ঘড়িতে সময় দেখে বলে উঠলেন,
‘ কই? তোমরা কেকটা কাঁটবে কখন? বিরিয়ানির গন্ধে তো অলরেডি ক্ষিদে ডাবল ডাবল হয়ে যাচ্ছে আমার!’
জারা সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে চোখ মুছল। মলিন হেসে দেখল মরিয়মের কপালে দুশ্চিন্তার ভাজ। মেহমেদের ডায়াবেটিস, হাইপ্রেশার সব একসাথে। তবুও যদি একটু নিয়ম মেনে চলে খাওয়া দাওয়ার বেলায়! মরিয়ম আঁতকে উঠে বললেন,
‘ তুমি বিরিয়ানি খাবে? তোমার না হাই প্রেশার? তারউপর রাতে প্রেশারের ওষুধ খেতেও তো ভুলে যাও! আমি ক্যারোলিনকে বলছি তোমার জন্য প্লেইন রাইসের ব্যবস্থা করতে!’
অমনি দপ করে নিভে গেল ভিলার কর্তার মুখখানা। প্রৌঢ় কন্ঠ আহত সুর টেনে আওড়াল,
‘ সবাই বিফ বিরিয়ানি খাবে আর আমি খাব প্লেইন রাইস?’
মরিয়ম রেগে গেলেন এবার! এ কেমন লোক? নিজের ভালোটা একটু বুঝবে না? এত অনিয়ম করে খাওয়ার কি বয়স আছে আর তার?
ওদিকে আয়ান দুইপক্ষের এই নীরবযুদ্ধ টের পেয়ে হেঁটে এলো মেহমেদের কাছে। কানের পাশে এসে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বলল,
‘ আঙ্কেল! আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন! খাওয়ার সময় তো টেবিলে আপনার পাশেই বসব। এক ফাঁকে নাহয় আপনার প্লেটে একটু খানি বিরিয়ানি তুলে দেবো আমি? এরা কেউ খেয়াল করবে না। আপনি এদের কথায় হ্যাঁ বলে দিন! আমি তো আছি নাকি?’
কথাগুলো বলে আয়ান মেহমেদের দিকে তাকিয়েই চোখ টিপে দিলো। ভড়কালেন মেহমেদ।
আজকালকার ছেলে ছোকড়া সবকটা আসলেই বাঁদর। তার মতো একজন রেস্পেক্টেড সিটিজেন কে কিনা এই ছেলে চোখ মারছে? পুলিশদের কি আজকাল এসব শেখাচ্ছে সরকার?
পরপর নিজের মনে নিজেই হতাশ হলেন একরাশ। বিড়বিড় করে বললেন,
‘ তোমার এখানে থাকাটাই তো আমার সবচাইতে বড় চিন্তার কারণ বাবা!’
‘ কিছু বললেন আঙ্কেল?’
মেহমেদ থতমত খেলেন। জোর করে ঠোঁটে হাসি টেনে আওড়ালেন,
‘ কই? না তো!’
আয়ান যদিও শুনেছে মেহমেদ কী বলেছেন তবুও রা করল না। ঠোঁট টিপে মাথা নুইয়ে হাসল শুধু।
মরিয়ম বেগম ডাকলেন গৃহকর্মী ক্যারোলিনকে। মেহমেদের জন্য ভাতের কথা বলতে যাবেন তখনই আরশি এগিয়ে এসে বলে উঠল,
‘ মা মা! কাউকে কিচ্ছু ব্যবস্থা করতে বলতে হবে না! আমি সবার জন্য যেমন বিফ বিরিয়ানি করেছি, তেমনি বাবার জন্যও চিকেন বিরিয়ানি করেছি! আমরা সবাই বিরিয়ানি খাবো আর বাবা খাবেন না এটা হয় নাকি?’
মেহমেদ হাসানের মন খারাপ কেটে গেল এবার। আরশির কথা শুনেই বিমর্ষ মুখখানা ফুরফুরে হলো সহসা। মরিয়ম স্বামীর এই খুশি দেখে নিজের মনেই হাসলেন। পরপর আরশির কাছে এসে গাল হাত রাখলেন মেয়েটার।
‘ সবার এত খেয়াল রাখতে কবে শিখে গেলি রে মা?’
শেহজাদ তখনও বিমোহিতের ন্যায় দেখছিল আরশিকে। সহধর্মিণীর প্রতি মুগ্ধতার বানে ঘায়েল হচ্ছিল তার অন্তঃকরণ। আরশি যে এই ছোট ছোট বিষয়গুলোর প্রতি এত যত্ন নিয়ে খেয়াল রেখেছে, ভাবতেই সন্তুষ্টির হাসিতে ওষ্ঠপুট প্রসারিত হলো মানুষটার।
মরিয়মের কথার পিঠে মুচকি হাসল আরশি। মেহমেদ অনুষ্ঠান শুরু করার জন্য ফের তাড়া দিতেই আর্জি জানিয়ে বলল,
‘ অনুষ্ঠান শুরু হবে বাবা! তবে তার আগে তোমাদের আমার কিছু দেখানোর আছে!’
মেহমেদ মরিয়মসহ বাকি সবাই একজন আরেকজনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল আরশির কথা শুনে। শেহজাদ ভ্রু উঁচালো আরশির মুখের দিকে তাকিয়ে। ইশারায় জানতে চাইল কী দেখানোর কথা বলছে আরশি!
মেয়েটা ঘাবড়াল বটে। তবে ঢোক গিলে সাহস করে ডাকল আয়ানকে। বলল,
‘ ভাই! আমার সাথে একটু আসবে এদিকে? একটা জিনিস আনতে হবে!’
আয়ান আর কোনো প্রশ্ন করল না। বাধ্য ভাইয়ের মতো আরশির কথা শুনে চলে গেল তার সাথে৷
যে জিনিস আনতে আরশি তাকে ডেকেছে সেটা একটা প্রজেক্টর। আয়ান প্রজেক্টরটা রুমের মাঝবরাবর এনে রেখে, এসে দাঁড়াল জারার পাশে। জারা সপ্রশ্ন চোখে তার দিকে তাকাতেই কাঁধ উঁচাল অফিসার। কারণ সেও যে কিছুই জানেনা আরশি কী করতে চাইছে!
আরশি নিজের ফোনে একবার সময় দেখে নিল। যেন অপেক্ষায় আছে কারোর আসার। পরপর এসে দাঁড়াল সবার সামনে। নিজের ল্যাপটপের ক্যাবল প্রজেক্টরের সাথে লাগিয়ে যন্ত্রটা চালু করতেই মিটিমিটি আলো জ্বলে উঠল সেখানে। সেই আলো এসে পড়ল, সবাই যেখানে দাঁড়ানো তার পিছনের দেয়ালটায়। ভেসে উঠল কিছু স্থিরচিত্র। শেহজাদ, মেহমেদ, মরিয়ম, আয়ান, জারা সবাই একে একে দু’পাশে সরে দাঁড়াল ছবিগুলো দেখতে।
প্রথম ছবিটা একটা সদ্য জন্মানো ছোট্ট বাচ্চার। তোয়ালে পেঁচানো। তাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন মেহমেদ। চেহারায় বয়সের ছাপ নেই। বরং অনাবিল আনন্দে উদ্ভাসিত সেই মানুষটার মুখবিবর। তারপাশেই দশ বছরের একটা ছেলে। পায়ের আঙুলের উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে মেহমেদের কোলে থাকা বাচ্চাটাকে দেখার চেষ্টায় অন্ত নেই তার। ঠিক তখনই ক্যামেরা বন্দি করা হয়েছে ছবিটা।
সবাই স্তব্ধ। শুধু চোখে জল নিয়ে হাত দিয়ে মুখ চেপে হাসলেন মরিয়ম। তার বুকটা ভার হয়ে উঠছে ক্রমশ তবুও হাসতে হাসতে বললেন,
‘ এ যে আমার রুশা আর শায়ান। তুই কোথায় পেলি এই ছবিটা আরশি?’
আরশি শান্ত। চোখের কোল ঘেঁষে শিশির বিন্দুর মতো জল জমলেও স্থির তার গলার স্বর।
‘ তোমার ছবির অ্যালবাম থেকে নিয়েছি মা!’
মরিয়ম মাথা দোলালেন৷ আবার মনোযোগ ফেরালেন ছবিতে। প্রজেক্টরে একের পর এক আসতে রইল রুশার ছোটবেলার ছবি। কোনোটাতে শেহজাদ আছে, কোনোটাতে আছে মরিয়ম আর মেহমেদ। কোনোটাতে বা আয়ান।
জারা দম বন্ধ করে দাঁড়িয়ে। তার চোখে স্পষ্ট প্রশ্ন। এই ছবিগুলো তো…
আরশি আড়চোখে একবার দেখল তাকে। তারপর তাকাল শেহজাদের দিকে। মানুষটা যেন শক্ত হয়ে আছে নিজের জায়গায়। সৌম্য মুখটা শুকনো লাগছে ভীষণ। চলছে চোখের জলের বাঁধ ভাঙতে না দেয়ার নানা কৌশল। এভাবে সবার সামনে কাঁদা যে তার মতো শক্তপোক্ত মানুষের জন্য বেমানান।
আরশি দম ফেলল। ঠিক তখনই প্রজেক্টরে ভেসে উঠল সেদিন মরিয়ম বেগমের হাত থেকে পড়ে যাওয়া ছবিটা। মায়ের কোলে লাল টুকটুকে ফ্রক পরনের দুই বছরের রুশা। বাবার হাতে ক্যামেরা দেখেই খিলখিল করে হেসে উঠেছিল সে৷ তখনই মেহমেদ তুলে ফেলেছিলেন ছবিটা।
মেহমেদ সেই ছবি দেখে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না। দু’হাতে মুখ চেপে বসে পড়লেন সোফায়। মরিয়ম তাকে সামলে ধরে নিজেও বসে পড়লেন পাশে। অসহায় মুখে ফোলা দু’জোড়া চোখ শুধু তাকিয়ে রইল ছবিটার দিকে। আয়ান কী করবে কী বলবে বুঝতে পারল না। ঝাপসা হয়েছে তার দৃষ্টিও। শুধু সবকিছু ছাপিয়ে ভেসে এলো জারার বিস্ময়ভরা কন্ঠস্বর,
‘ এটা তো…আমি!’
জারার কথায় চমকে তার দিকে তাকাল আয়ান। চমকে তাকাল শেহজাদ, মরিয়ম আর মেহমেদও। তবে চমকাল না শুধু আরশি। হাসি ফুটেছে তার মুখে। এবার শুধু শেষ ছবিটার পালা। যেটা সে দেখেছিল ক্যাফেটেরিয়ায় জারার ফোনে। বন্ধুকে না জানিয়েই এক ফাঁকে সেই ছবিখানা নিয়ে নিয়েছিল নিজের কাছে। মুঠোফোনের বদৌলতে নিয়েছিল আরো একজনের নাম্বার।
শেষের ছবিটা দেখে জারা বাদে থমকালেন বাকিরা সবাই। ছবিটায় বয়স্ক কিছু মানুষ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। মাঝখানে রুশাকে কোলে নিয়ে পরিপাটি শাড়িতে হাসিহাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছেন একজন ভদ্রমহিলা।
মরিয়ম বেগম আঁতকে উঠলেন। গলা ভেঙে গেছে তার কাঁদতে কাঁদতে। অস্পষ্ট স্বরে আওড়ালেন,
‘ এটা তো আমাদের রুশা। তুই এই ছবি কীভাবে পেলি মা? এটা তো আমাদের অ্যালবামের নয়। বল না আরশি? আমি যেটা ভাবছি সেটাই কী সত্যি তাহলে? আমার রুশা বেঁচে আছে?’
আরশি উত্তরে তাকাল জারার দিকে। মেয়েটা তখনও বিমূঢ় চোখে দেখছে সব। চোখ দিয়ে নিঃশব্দে গড়িয়ে পড়া পানিতে ভিজেছে তার মলিন গাল।
‘ রুশা হারিয়ে গিয়েছিল গাজীপুরে গিয়ে। ওকে যারা আমি ভেবে কিডন্যাপ করেছিল তারা ওকে নদীতে ভাসিয়ে দিতে পারেনি। দুই বছরের বাচ্চাটাকে জানে মেরে ফেলতে হয়তো ওদের মতো পাষাণদেরও বুক কেঁপে ছিল সেই সময়। তাই তো ফেলে রেখে গিয়েছিল একটা বৃদ্ধাশ্রমের সামনে। ওকে পেয়েছিল সেই বৃদ্ধাশ্রমেরই মালকিন। মিস আঞ্জুমান রোজী।’
জারা রুদ্ধশ্বাসে শুনছিল আরশির কথাগুলো। আরশি কথা শেষ করে এগিয়ে এসে ওর হাত নেয় নিজের হাতের মুঠোয়। তারপর মরিয়মের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,
‘ জারা-ই আমাদের রুশা মা। ওকেই সেদিন পেয়েছিলেন আঞ্জুমান রোজী। নাম রেখেছিলেন জারা! নিজের মেয়ের মতো বড় করেছেন। পড়তে পাঠিয়েছেন বিদেশের মাটিতে। কিন্তু সে বোধহয় জানতেন ও না! জারা যে এ দেশে এসেই নিজের আসল পরিবারের খোঁজ পাবে!’
‘ আসলেই জানতাম না! তবে আমার জারা যদি সত্যিই তোমাদের রুশা হয়, তাহলে আমার থেকে খুশি বোধহয় দ্বিতীয়টি কেউ হবে না!’
হাসান ভিলার দরজায় দাঁড়িয়ে কথাগুলো বললেন আঞ্জুমান। হাতে ট্রলি। পরনে পরিপাটি সাদা শাড়ি। মাথায় আধাপাকা চুল। চেহারায় সম্ভ্রান্তের ছাপ স্পষ্ট।
আঞ্জুমানকে দেখেই জারা অবিশ্বাসের স্বরে ডাকল তাকে।
‘ মণি তুমি? এখানে কীভাবে…? তোমার ফ্লাইট না আরো..’
জারার কথা পুরোটা শেষও হলো না। তার আগেই আঞ্জুমান হেসে বলে উঠলেন,
‘ মণি কী করবো বলো তো মা? তোমার ভাবি জরুরী তলব করলো যে! তাই আগেভাগেই চলে এসেছি। আমাকে ভিতরে আসতে বলবে না?’
জারা নড়তে পারলনা। আরশি ব্যাপারটা বুঝতে নিজেই এগিয়ে গেল আঞ্জুমানের কাছে। হাত থেকে ট্রলি নিয়ে সালাম জানাল তাকে। পরপর হাত ধরে নিয়ে এলো ভিতরে। সবার মাঝে।
আঞ্জুমান স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মরিয়ম বেগমকে দেখতেই হাতের ব্যাগের চেইন খুলে খুঁজলেন কিছু একটা। খুঁজেও পেলেন সাথে সাথে। সেটা বের করে মরিয়ম বেগমের হাতে দিয়ে শুধালেন,
‘ দেখুন তো, চিনতে পারেন কিনা? আমি জারাকে যখন পাই তখন ওর হাতে পরানো ছিল এটা। আপনার বউমা আমাকে ফোন করে বলেছিল আসার সময় সাথে করে জারার ছোটবেলার কিছু নিয়ে আসতে। কীভাবে আমার নাম্বার এই বাচ্চা মেয়েটা পেল, কীভাবে এতকিছু এত কম সময়ে আয়োজন করল আমি তাও জানিনা। শুধু ভাবছিলাম কী আনবো যেটা দেখে আপনারা চিনতে পারবেন আপনাদের রুশাকে। আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না গুটিকয়েক ছবি ছাড়া কী আনতে পারা যায়? তখনই মনে পড়ল এটার কথা!’
মরিয়ম বেগম কিছুটা সময় নিস্তব্ধ, নীরব হয়ে তাকিয়ে রইলেন নিজের হাতের মুঠোয়। ঝুলুরি লাগানো একটা রুপোর বালা। তার ভিতরের দিকে খোঁদাই করে লেখা ছোট্ট রুশার নামের প্রথম অক্ষর। বাচ্চাদের হাতে যেমন বালা পরানো হয়, ঠিক তেমন এটি। কিছু সময় বিস্ফোরিত নয়নে সেদিকে তাকিয়ে থেকেই মৃদু আর্তনাদ করে উঠলেন প্রৌঢ়া।
‘ এটা তো আমার রুশার। ওর হাতেই ছিল এটা যেদিন ও হারিয়ে যায়! তারমানে সত্যি সত্যি…জারাই আমার মেয়ে রুশা। ও আমার নিজের মেয়ে?’
আঞ্জুমান মাথা দোলায় ওপর-নিচে। চোখে জল নিয়ে মুচকি হাসছেন তিনিও। নিজে মা না হতে পারা আঞ্জুমান সন্তান হারানোর কষ্ট বুঝবেন না? তা কী করে হয়?
আয়ান গিয়ে দাঁড়িয়েছে মূর্তিবোনে থাকা শেহজাদের পাশে। চোখ ভিজেছে তারও। যদিও বেশ কয়েকবার জারার মোবাইলে মেয়েটার ছোটবেলার ছবি দেখে সন্দেহ হয়েছিল। কিন্তু ছোট্ট রুশার মুখটা যে স্মৃতিতে ম্লান৷ তাই ধরতে পারেনি কিছুই তখন। তবে এখন? এখন বুঝতে পারছে সবটা। জারাই ওদের রুশা? ওর আর শেহজাদের যাকে কোলে নিতে গিয়ে ছোটবেলায় কাড়াকাড়ি লাগতো সেই রুশা? বিস্ময়, খুশি সবমিলিয়ে বলিষ্ঠ মানুষটারও হাত কাঁপছে। সে তার ঐ কাঁপা হাতেই শেহজাদের কাঁধ জড়িয়ে ধরল। চোখ মুছে হেসে বলে উঠল,
‘ কী রে ব্যাটা! কিছু বল! বোনকে তো পেয়ে গেলি!’
শেহজাদ বাকরুদ্ধ। কিছু বলার মতো শক্তি যে অবশিষ্ট নেই তার মাঝে। নীল চোখের ফ্যালফ্যালে দৃষ্টিতে জারার মুখ। এখন সবটা পরিষ্কার নিজের কাছেও। এজন্যই হয়তো মায়ের মতো সে-ও জারার মুখটা কাকতালীয় ভাবে বারবার রুশার সাথে মেলাতো! স্নেহ করত নিজের বোনের মতো। কিন্তু কে জানত? ভাগ্য এভাবে ফিরিয়ে দেবে তার বোনটাকে তার কাছে?
মরিয়ম বেগম দাঁড়িয়ে রইলেন না আর। ছুটলেন মেয়ের কাছে। পেছন পেছন উঠে এলেন মেহমেদও। এই বয়সে এতটা ধকল সামলে ওষ্ঠাগত শ্বাসের গতি। তবুও কাছে গিয়ে জারার মাথায় হাত রেখেই আরো একবার ভেঙে পড়লেন কান্নায়। কেন সে আরও একটু ভালো করে খোঁজে তখন রুশাকে? কেন বিশ্বাস করে নিয়েছিল রুশার মৃত্যুর খবরটা?
নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৫০
নইলে যে আরও আগে কাছে পেত মেয়েটাকে!
মরিয়ম বেগম নিজের বুকে ফের একবার জড়িয়ে ধরলেন জারাকে। নাড়িছেঁড়া সম্পর্ক। সেই সম্পর্কের এত সহজে কী বিচ্ছেদ সম্ভব?
জারা এতক্ষণে একটু শান্ত হলেও ডুকরে উঠলো মায়ের বুকে ঠাই পেতেই। ওর নিজের মা? ওরও মা আছে? ভাই আছে? বাবা আছে? পরপর শক্ত করে আঁকড়ে ধরল মরয়িমকে। মা-মেয়ে দুজনই ভাসল চোখের জলে। মরিয়ম তার ধরা গলায় মন্ত্রের মতো জপে গেলেন শুধু,
‘ তুই আমার রুশা! আমার মেয়ে! আল্লাহ এতদিনে তোকে ফেরালেন মা! এতদিনে শান্ত করলেন আমার বুকটা!’