নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৫৪

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৫৪
সিনথিয়া

‘কেনো লজ্জা লাগে, কখন লজ্জা লাগে? সেসব আমি পারবো না বলতে! আপনি শাস্তি দিতে হলে অন্য কোনো শাস্তি দিন!’
বাইরের তুমুল বাতাস আর বজ্রধ্বনির সাথে কেঁপে কেঁপে উঠলো মেয়েলী কুন্ঠিত গলার স্বর। ঘাড় ঘুরিয়ে লালিত মুখটা ঢাকার বৃথা চেষ্টা করলো আরশি। কিন্তু পারলো না বোধহয়। অমসৃণ আঙুলগুলো আলতো ছুঁয়ে দিলো তার চিবুক। লজ্জায় আবৃত মুখটা ফিরিয়ে নিলো নিজের দিকে।
‘তুমি পারবে না! বেশ তাহলে আমি শিখিয়ে দেই তোমাকে?!’

মেঘমেদুর ঐ স্বরে আরশির শ্বাসের গতি বাড়তে ন্যানোসেকেন্ড সময় না লাগলেও ঘোড়ার খুঁড়ের ন্যায় টগবগ শব্দ তুলে চলতে শুরু করলো হৃদযন্ত্রটা। বুকের গন্ডিতে ঝরে পড়লো মিশ্র অনুভূতির বৃষ্টি। অনেকটা লজ্জা আর কিছুটা ভয়ের এক অদ্ভুত অনুভূতি! তাতেই হয়তো ঘামলো মেয়েটা। কার্টেইনসের ফাক গলে আসা ঠান্ডা বাতাসে শিরদাঁড়া বেয়ে নামলো দুধসাদা স্রোত।
শেহজাদ তখনও তীক্ষ্ম চোখে চেয়ে। তৃষার্ত দৃষ্টিতে দেখে গেলো আরশির ঘেমেনেয়ে একাকার হওয়া মুখটা। পরপর উরুর উপর বসিয়েই ঘটিয়ে ফেললো আরেকটি কান্ড। আরশির ঠোঁটের ওপরে জমে থাকা ঘামটুকু মুছে নিলো বৃদ্ধা আঙুল দিয়ে। সম্মুখের ঐ বিস্ফোরিত চোখে চোখ রেখেই জিভে ছোঁয়ালো সেই আঙুলখানা।
আরশি থমকায়। মানুষটা এমন নির্বিকার মুখে এমন একটা কাজ করতে পারে? তা যেন নিজের চোখই বিশ্বাস করতে চাইলো না ওর।
ভ্রুজোড়া কুঁচকে গেলো আরশির। চোখ মুখ খিঁচে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘ আপনি আইসক্রিম খাচ্ছেন না কোনো! এটা আমার ঘাম! ইয়াক শেহজাদ! ইয়াক! আঙুল বের করুন বলছি মুখ থেকে!’
কথামতোই শব্দ করে মুখ থেকে আঙুল বের করলো শেহজাদ। তবে আরশিকে চোখমুখ কুঁচকে তাকিয়ে থাকতে দেখে হেসে ফেললো নিঃশব্দে।
‘আপনি হাসছেন? আপনার একটুও গা গুলিয়ে উঠলো না?’
শেহজাদ আর হাসলো না তখন। চোখে ফিরে এলো সেই ঘোরলাগা দৃষ্টি। হাতের অভদ্র বিচরণ শুরু হলো আরশির মেদহীন কোমর থেকে। পরনের এলোমেলো শাড়ির আঁচলের ফাঁক, তাকে যেনো আরো সুযোগ করে দিলো সেই বিচরণ জমানোর।

‘তোমার কাছে যেটা গা গুলিয়ে ওঠা মনে হয়? আমার কাছে সেটা আমার নির্ঘুম রাতের মেডিসিন স্নোফ্ল্যাক! তোমার থেকে যে তুমি তুমি ঘ্রাণটা আমি পাই? এই ঘ্রাণটা ছাড়া আমার ঘুম হয় না! ইয়র এক্সজিসটেন্স ইজ বিকামিং মাই অবসেশনস স্নোফ্ল্যাক! এন্ড আই ডোন্ট নো! হাউ টু হ্যান্ডেল ইট এনিমর!’
খসখসে শক্ত হাতটা যেন দাগ কেটে চললো চাঁদের গায়ে। শেহজাদের প্রতিটা কথায় নিশ্বাস আঁটকে এলো আরশির। চাইলো গলার পিছন থেকে হাত সরিয়ে মানুষটাকে আটকাতে। কিন্তু তার আগেই শেহজাদের অন্য হাত লুফে নিলো ওর দূর্বল হাতখানা।

‘তুমি কিন্তু আমার কথা শুনছো না স্নোফ্ল্যাক! আমি আমার উত্তর চেয়েছি!’
ঢোক গিলল মেয়েটা। সন্ত্রস্ত চোখে বার দুয়েক পলক ফেলে আওড়ালো,
‘আর আপনি বলেছেন আমি না পারলে আপনি আমাকে শিখিয়ে দেবেন উত্তরগুলো!’
‘পরে আফসোস করবে না তো!’
‘একটুও না!’
আরশিরও এবার সাহস হলো। মাউন্ট এভারেস্ট সমান সাহস! সে ফের জড়িয়ে ধরলো শেহজাদের গলা। শরীরী দূরত্ব মেটালো ঝুঁকে এসে। চোখে চোখ রেখে বললো,

‘ইউ নো হোয়াট? আ’ম অ্য গুড লার্নার প্রফেসর! যা শেখাবেন, তাই শিখবো!’
শেহজাদ এতোদিনে যেনো বড়সড় এক ধাক্কা খেলো আরশির কথায়। তাতেই ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো মেয়েটা। মানুষটার বিমূঢ় ওষ্ঠপুট ফাঁক হতেই দাবার চাল ঘুরিয়ে দিলো আরশি। কন্ঠমনির ঠিক নিচে মাথা নুইয়ে চুমু খেলো শেহজাদের। মানুষটা কেঁপে উঠলো সহসা! এই প্রথমবার চোখ বুঁজে শান্ত রাখতে চাইলো নিজেকে।
দু’হাত পিছনে রেখে ভর ছাড়লো শরীরের। মুঠোয় দুমড়ে মুচড়ে নিলো বিছানার চাদর।
শেহজাদের নাজেহাল দশায় আরশি নিম্নাষ্ঠ দাঁতে পিষে হাসলো কেবল। পরপর ফের চুমু বসালো কন্ঠমনি বরাবর। অধরপুট ছোঁয়ালো ঘাড়ের পাশে। তারপর আস্তে আস্তে নামিয়ে আনলো তা ক্লাভিকলের উপর। শেহজাদের ঘাড়ের পাশের নার্ভগুলো তখন ফুলেফেঁপে উঠেছে যেন৷ হাতের প্রতিটা ভেইন স্পষ্ট দৃশ্যমান।
আরশির হাসি প্রসারিত হয়। মুখ উঠিয়ে কানের নরম অংশে আলতো কামড়ে বলল,

‘আমাকে ছাড়া একা ঘুমোনোর অভ্যাস করুন প্রফেসর! আমি কিন্তু সবসময় আপনার কাছে থাকবো না!’
মূহুর্তেই চোখ মেলে চাইলো শেহজাদ। উঠে বসে এক নিমেষেই আরশির মেদুর মুখখানা নিয়ে নিলো হাতের আঁজলে। দৃঢ় স্বরে বলে উঠলো,
‘কথা উইথড্র করো!’
আরশি হাসলো নীরবে। শেহজাদের হাতের পিঠে হাত রেখে সপ্রশ্ন কন্ঠে শুধোলো,
‘কী উইথড্র করবো?’
‘এক্ষুনি যেটা বললে সেটা!’
‘কীসব বাচ্চাদের মতো বলছেন বলুন তো? বলে ফেলা কথা আবার উইথড্র করা যায় নাকি?’
‘তুমি করবে! আর মনের ভুলেও কখনো আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা বলবে না তুমি স্নোফ্ল্যাক!’
আরশির চোখমুখ শান্ত হয়ে এলো। নরম গলায় জানতে চাইলো,

‘দুজন ভালোবাসার মানুষ কখনো একে অপরকে ছেড়ে যেতে চায় না শেহজাদ! তাদেরকে নিয়তি দূরে ঠেলে দেয়!’
শেহজাদ আহত চোখে তাকায় আরশির দিকে। হুট করে এতো কঠিন কথা তাকে কেনো বলছে মেয়েটা?
শেহজাদের ঐ ভয়ার্ত মুখের দিকে তাকাতেই ফিক করে হেসে ফেললো আরশি।
‘এ কি? আপনি ভয় পাচ্ছেন? আরে আমি তো দেশে ফেরার কথা বলছিলাম! তখন তো আপনাকে একা একাই ঘুমোতে হবে! আপনাই থোরাই পারবেন ভার্সিটি ফেলে রেখে আমার সাথে যেতে? তারউপর কতদিন আম্মু-আব্বুকে ছেড়ে এখানে আছি! তাদের একটু দেখতে যেতে ইচ্ছে করতে পারেনা আমার?’
শেহজাদ তবুও কিছু বলতে পারলো না। তার চোখের সামনে ঝাপসা ঠেকলো আরশির মুখটা। দুফোঁটা উষ্ণ জল বেহায়ার মতো গড়িয়ে পড়লো কার্ণিশ বেয়ে।

তাতেই আঁতকে উঠলো আরশি। শেহজাদের হাত সরিয়ে নিজেই দু’হাতে তুলে নিলো ঐ গম্ভীর মুখটা।
‘আপনি কাঁদছেন কেনো? আরে বাবা! এটা তো কথার কথা বলেছি! ফিরতে চাইলেই তো আর ফিরতে পারবো না। কত কাজ করতে হবে তার আগে জানেন? ছুটির জন্য আবেদন, ভিসা, ইমিগ্রেশন, ফ্লাইট বুকিং! আরো কত কিছু! একি? তারপরও মুখ ফুলিয়ে থাকবেন? আচ্ছা বেশ! ফিরবো না দেশে! এই নিজের গলায় চিমটি কেটে কথা দিলাম!’
উহু! কাজ হলো না। অভিমানী রাজপুত্তুরের মুখে হাসি ফোটানো কি এতো সহজ? কিন্তু হাল ছাড়ল না আরশি! নড়ে চড়ে উঠলো শেহজাদের কোলের ওপর বসেই। ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে আওড়ালো,

‘আচ্ছা! এই দেখুন! কথাও উইথড্র করলাম! এবার খুশি?’
শেহজাদ উত্তর দিলো না। আগের মতোই মুখ ফিরিয়ে রাখলো অন্যদিকে! ঝুপ করে মনটা খারাপ হয়ে গেলো আরশির। বিড়বিড় করে বললো,
‘কী মুশকিল! এতো কিছু বললাম, তাও খুশি হওয়ার নাম নেই?! সাধে কি আমি জাম্বুবান ডাকি? এখন কী করে মহারাজের মান ভাঙাবো?’
আরশি চিন্তিত হয়ে বিড়বিড় করলেও শেহজাদ হাসলো ঠোঁট টিপে। গলা পরিষ্কার করে ছদ্ম গম্ভীর কন্ঠে বললো,
‘বলছিলাম…একটা কাজ করলে খুশি হয়েও যেতে পারে তোমার এই জাম্বুবান!’
আরশি আড়চোখে চাইলো শেহজাদের দিকে! তারমানে ওর বিড়বিড় করে বলা কথাগুলোও শুনেছে পাঁজি লোকটা? আর এই মান-অভিমানের খেলা? সবটাই নাটক? তবুও বিরস মুখে শুধালো,

‘কী কাজ?’
আরশি যে তার কথা ফেলবে না এটা ভেবেই ওর দিকে ফিরে চাইলো শেহজাদ! তবে খুশি হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা চেপে রাখতে চেহারায় টিকিয়ে রাখলো স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্যতা। নির্লিপ্ত স্বরে বললো,
‘কাল আমার সাথে ঘুরতে যেতে হবে তোমাকে! আমি যেখানে নিয়ে যাবো, সেখানেই যাবে তুমি! না করতে পারবে না!’
আবদার শুনে দ্বিধায় পড়লো যেন আরশি। কিছু একটা ভেবে ইতস্তত স্বরে শুধালো,
‘শুধু আমরা দু’জনে বেরোলে ব্যাপারটা কেমন দেখাবে না? তারচেয়ে বাড়ির সবাইকে নিয়ে কোথাও একটা যাই চলুন! তাতে বাড়ির মানুষও খুশি আর আমিও খুশি!’
‘আর আমার খুশি?’
‘ঐটাই তো বললাম!’

‘উহু! বাড়ির সবার খুশি একদিকে! আর এই ব্যাপারে আমার খুশি অন্যদিকে। আমি আগামীকাল আমার বউকে নিয়েই শহর ঘুরবো! মা-বাবা বহুবার ঘুরেছে! আর যদি বলো রুশার কথা? তাহলে ওকে ওর বর ঘোরাবে! তোমার মণি আর বাড়ির বাকি সবাইকে নিয়ে এতোই যদি মন কেমন করে তাহলে তাদেরকেও নাহয় ঘুরিয়ে আনবো! তবে পরে! কালকের দিনটা শুধু তোমার আর আমার!’
‘কিন্তু…!’
ঐ কিন্তু পর্যন্ত এসেই থেমে যেতে হলো আরশিকে। ঠোঁট নেড়ে কিছু বলার সুযোগ অবধি পেলো না। কারণ খুঁজতে গিয়ে বুঝলো, তার নিজের ঠোঁট যে নিজের দখলেই নেই এখন। চোখের পলকে চলে গেছে অন্য একজনের দখলে। শেহজাদের দখলে।
গভীর থেকেও গভীর হলো ওদের অধরোষ্ঠের এই সন্ধিক্ষণ!
এক ফাঁকে মেয়েটাকে শ্বাস নিতে অল্প একটু সুযোগ করে দিলো শেহজাদ। তারপর ফের একবার ঠোঁটজোড়া লুফে নেয়ার আগে শুধু বললো,
‘আর একবার যদি যাবো না যাবো না বলে মোচড়ামুচড়ি করো? তাহলে এর থেকেও কঠিন শাস্তি কপালে আছে কিন্তু তোমার স্নোফ্ল্যাক!’
আরশি ধাতস্থ হয়েই এগাল-ওগাল হাসলো। কন্ঠে ফিরে এলো কিছুক্ষণের আগের সেই দুষ্টমি।
‘শাস্তি দেয়ার আগে কি যেন শেখাবেন বললেন না? কীভাবে ঐসব ইয়াক ইয়াক কথা বলতে হয়? ঐগুলো শিখিয়ে দেবেন প্লিজ!’

‘নইলে?’
আরশি বিড়বিড় করে আওড়ালো,
‘নইলে শাস্তিটা বোরিং হয়ে যাবে না? আপনার কাছ থেকে আমি কী কী শিখলাম সেটা দেখানোর জন্য শাস্তিই তো মোক্ষম সময়! আপনি আমাকে শাস্তি দিতে এলেই আমি আপনাকে গালাগাল করে উল্টে ফেলবো!’’
শেহজাদের কন্ঠে অবিশ্বাস! মুখের সামনে হাত রেখে আঁতকে উঠল একপ্রকার। পরপর শুধালো,
‘স্নোফ্ল্যাক! ডু ইউ ইভেন নো হোয়াট ইউ আর সেয়িং?’
আরশির হাসি থামালো চট করে। তারপর আচমকাই শেহজাদের বুকের দুপাশে দু’হাত রেখে মানুষটাকে ঠেলে ফেললো বিছানায়। নিজেও ঝুঁকে এলো এক লহমায়। শেহজাদের মুখের ওপর খুলে পড়লো আরশির রেশম কোমল চুলের গোছা। লাজুক হাসল তার লাজবন্তী। পরপর ঐ নীল চোখের ওপর থেকে কাঁচের চশমাটা আলগোছে সরালো। তুলে নিয়ে রাখলো মাথার পাশে। পরপর শার্টের বোতামগুলো এক এক করে খুলতে খুলতে বললো,
‘জানি তো! আর জানি বলেই বলছি! আজ আপনি আমাকে যা বলবেন, যেভাবে বলবেন? আমি সব শুনবো! সব শিখবো!’

শার্টটা খুলে ফেলতে সময় লাগলো না রমনীর। চোখের সামনে উন্মুক্ত হলো পুরুষালী ভরাট বুক। কোমর তো বোধহয় আরশির দু’হাতে এঁটে যাবে! অথচ কাঁধ বুক এতো চওড়া কেনো এই লোকের?
আরশি ঢোক গিললো বড় করে। অতঃপর ঝুঁকে ঠোঁট ছোঁয়ালো শেহজাদের আবরণহীন বুকে। প্রতিটা স্পর্শে বাইরের বৃষ্টির ছাঁট এসে লাগলো ওদের গায়ে! বৃষ্টিমুখর বাতাবরণের হিমশীতল বাতাসে উড়লো আরশির কেশকুন্তল। তখনই যেন চমৎকার একটা বুদ্ধি এলো ওর মাথায়। পরপরই কোনোকিছু না বলে উঠে চলে গেলো কোথাও একটা।
আচমকা বুকের ওপরে আরশির অনুপস্থিতি অনুভব করতেই চোখ মেলে চাইলো শেহজাদ। আর ঠিক সেই সময়, কানে ভেসে এলো একটা হিন্দি গানের সুর…

❝ hoo bhigi bhigi raat mein
lekar ke tujhko saath mei
madhosh hue jaayein hum,
aa faasle karne de kum
zara paas tu aa mere,
dhire se chu ja mujhe
kho jaaun tere pyaar mein,
baahon mein bhar le mujhe
ooooo ooooo..❞

মিনিট খানেকের মধ্যে সুরের মূর্ছনা না থামলেও শিফন শাড়িতে শেহজাদের সামনে এসে থামলো আরশি। আগের শাড়িটা বদলে এটা পরায় যেন মেঘ নেমে এসেছে শেহজাদের ঘরে।
মরিয়ম বেগমের কাছ থেকে শাড়ি পরা শিখে নেয়ায় দুমিনিটে শাড়ি পরতে আজ আর অসুবিধে হয়নি আরশির। কিন্তু শেহজাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে অসুবিধে হলো ওর। পা জোড়া অবস হয়ে এলো ঐ ব্যাধের মতো চাওনিতে!
শেহজাদ আর শুয়ে থাকতে পারলো না। খোলা শার্টেই উঠে বসলো সে। আরশিকে ডাকলো চোখের ইশারায়। মেয়েটা ধীর পায়ে কাছে গিয়ে বসতেই হেসে ফেললো শেহজাদ। আরশি মেকি গাল ফুলিয়ে আওড়ালো,
‘আপনি আবার হাসছেন কিন্তু! এতো হাসলে আমি কিন্তু পাল্টে আসবো শাড়িটা!’
‘কে শেখালো তোমাকে এসব?’
‘কোনসব?’

আরশি বোকা বোকা চোখে তাকালো শেহজাদের দিকে! তাতেই যেন আরও একবার হেসে ফেললো শেহজাদ। তারপর আচমকাই… একটানে আরশিকে এনে ফেললো নিজের পাশে। আধশোয়া হলো ওর ওপর। আঙুল চালালো মসৃণ কপালে। খুচরো চুলগুলো এনে কানের পাশে গুঁজে দিতে দিতে
হাস্কি স্বরে আওড়ালো,
‘থ্যাঙ্ক ইয়্যু আরশি!’
শেহজাদের এই আদুরে স্পর্শেও বিছানার সাথে মিশে যেতে হলো রমনীর। তবুও কোনোমতে বলে উঠলো,
‘থ্যাঙ্কু কেনো?’
‘আমার পরিবারটা জোড়া লাগানোর জন্য! রুশাকে খুঁজে বের করে সবার সামনে আনার জন্য তোমাকে শুধু একটা ধন্যবাদ দিলে অনেক কম হয়ে যাবে জানি! তবুও!’
‘আচ্ছা!’
‘আচ্ছা মানে?’

‘মানে এই পরিবারটা শুধু আপনার পরিবার? এটা আমার পরিবার না? রুশা আমার বোন না? এভাবে সবসময় আমাকে আলাদা আলাদা ভেবেছেন তো আপনার সব চুল দাড়ি আমার আগে আগে পেকে যাবে! তখন বুঝবেন ইয়ং বউয়ের পাশে সাদা গোঁফ দাড়ি নিয়ে হাঁটতে কেমন লাগে!’
নিভৃতেই স্মিত হাসলো শেহজাদ।
‘তুমি জানো না আজ মা-বাবা কী ফিরে পেয়েছেন! ওনারা আজ কতটা খুশি হয়েছেন! তুমি জানো না আরশি!’
‘আর আপনি খুশি হননি?’
‘তোমার কী মনে হয়?’
আরশির আর চিন্তা ভাবনা করতে হলো না। ফট করে বলে বসলো,
‘মনে তো হচ্ছে খুশি! কিন্তু এইভাবে কি আন্দাজ করে কিছু বলা যায়? প্রমাণ করে দেখান যে আপনি কতটা খুশি?’
‘কীভাবে প্রমাণ করবো?’

আরশি নাটকীয়ভাবে আওড়ালো,
‘প্রশংসা করুন একটু আমার! বলুন, আরশি তুমি এতো মিষ্টি কেনো? শাড়িতে তোমাকে এতো পরীর মতো লাগছে কেনো?! কিন্তু আফসোস! আমি আমাদের বিয়ের তিন তিনটা বছর নিজের জীবন যৌবন খুঁইয়ে অবশেষে চার নম্বর বছরে এসে তোমার সৌন্দর্যের কদর বুঝেছি! তোমাকে দেখে অনেক নাক ছিটকে ছিলাম! তার জন্য আমি বিনীতভাবে ক্ষমাপ্রার্থী!’
পরপর একটু থেমে ছদ্ম বিষন্ন গলায় বলল,

‘ যদিও খালি হাতে চাওয়া ক্ষমা আমি এক্সেপ্ট করি না। কিন্তু শুধু আপনি আমার স্বামী বলে একটা আইসক্রিমের বদলে মেনে নিলাম। মনে করে কালকে খাইয়ে দিলেই হবে!’
শেহজাদ ঠোঁট টিপলো। আরশির মতোই অবুঝ হওয়ার ভান ধরে বললো,
‘শুধু একটা আইসক্রিম খাওয়ালেই ক্ষমা পেয়ে যাবো!’
আরশি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। হতাশ কন্ঠে আওড়ালো,
‘আপনারা ছেলেরা আমাদের কী ভাবুন বলুন তো? সে যা-ই হোক! এই আরশিকে একটা আইসক্রিমে সেটেল করতে পারছেন বলে এটা ভেবে বসবেন না, প্রতিবার একই ভুল করবেন আর আমি আইসক্রিম পেয়ে সব ভুলে যাবে!’
‘আর কোনো ভুল করার প্রশ্নই আসে না!’
আরশি চওড়া হাসলো। তারপর নিজের শাড়ি দেখিয়ে বলল,

‘আচ্ছা আচ্ছা! এখন বলুন তো আমাকে শাড়িটাতে মানিয়েছে কি না? আপনার তো পছন্দের রঙ এটা! মণি নিয়ে এসেছে আমার জন্য। তাদের নিজেদের ওখানে একটা শাড়ির শো-রুম আছে কি-না। দেখুন না একটু!’
শেহজাদ চোখ নামিয়ে দেখলো ঠিকই। তবে শাড়ির রঙ নয়! অন্যকিছু। শুকনো গলায় ঢোক গিলে ফের চাইলো আরশির চোখের দিকে!
আরশি কী বুঝলো সেই চোখের ভাষা? হয়তো বুঝলো! নয়তো না বুঝেই জিজ্ঞেস করে বসলো,
‘কী ভাবছেন এতো?’
শেহজাদের বেলেহাজ মনটা বলে উঠলো,
‘ভাবছি! শাড়িটা কখন খুলবো!’
কিন্তু মুখে বলল,

‘যে সাদা পরীটা সরাসরি আকাশ থেকে আমার সামনে নেমে এলো, সেই পরী তো কিছুক্ষণ আগে হেঁটেও আসতে চাইছিলো না এই রুমে! কে যেন আজ মা আর রুশার কাছে ঘুমোবে বলেছিল?’
থতমত খেয়ে গেলো বেচারি। হাওয়া গিলে আওড়াল,
‘প…পরীর শর্ট-টার্ম মেমোরি লস হয়েছে! সে কিছু মনে করতে পারছে না আপতত!’
আরশি বিব্রত মুখখানা ঘুরিয়ে রাখলো একপাশে। ইশশ! নিজের কথার প্যাঁচে এভাবে পড়ে যাবে জানলে আগেই সাবধান থাকত ও এই জাম্বুবানের থাকে!
শেহজাদ তখনও হাসছে মিটমিটি। আরশিকে আরেকটু জ্বালাতেই যেন ছুড়লো নিজের শেষ স্তবকখানা।
‘কিন্তু পরী তো আমার পছন্দের রঙ, পছন্দের গান সবটাই মনে রেখেছি! শুধু এটাই ভুলে গেলো? তাহলে হয়তো তার শর্ট-টার্ম মেমোরি লস হয়নি, ব্রেইনে শর্টসার্কিট হয়েছে!’
আরশি আগুন চোখে ফিরে তাকালো শেহজাদের দিকে। মানুষটাকে ঠোঁট টিপে হাসতে দেখেই আরশির অভিমান গাঢ় হলো। উঠে যেতে যেতে বললো,

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৫৩

‘বেশ! মজা উড়াবেন তো আমার! উড়ান আপনি একা বসে বসে! আমি মা আর রুশার কাছেই গেলাম!’
ঠিক তখনই বলিষ্ঠ হাতের হ্যাঁচকা টানে আবারও মেয়েটাকে নিজের নিচে এনে ফেললো শেহজাদ। আচমকা আক্রমণে তটস্থ হলো আরশি। বিস্ময়বিমূঢ় চোখজোড়া খিঁচে বন্ধ করে নিলো সহসা।
মানুষটা হাসলো। ঝুঁকে এলো ওর কানের পাশে। ঠিক যেভাবে আরশি ওর কানের পাশে এসেছিল, ঠিক সেভাবে। উষ্ণ নিশ্বাসের বেগ বাড়তেই শেহজাদ ফিসফিস করে শাসিয়ে দিলো তার লাজবন্তীকে!
‘সাহস তো কম নয় তোমার মেয়ে! এতো যুদ্ধ করে ও ঘর থেকে বউ নিয়ে এসেছি কী রাতে একা একা ঘুমোবো বলে?’

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৫৫