নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৫৯
সিনথিয়া
ঘুম ভাঙেনি আরশির। শেহজাদ উবার থেকে নেমে এলো পেলব শরীরটা বুকে মিশিয়েই। চোখ সরাতে পারলো না। থামাতে পারলো না নিজেকে। মাথা নুইয়ে মেয়েটার এগালে ওগালে চুমু একে দিলো বারকয়েক। তবুও যেন তৃষ্ণা মিটলো না। মন ভরলো না। আরশির কানের নরম অংশে ঠোঁট চেপে কাতর স্বরে বললো,
“এতো তাড়াতাড়ি কেনো চোখে ঘুম নামালে আরশি?”
আরশি নড়ে উঠলো একটু। অক্টোবরের ঠান্ডা বাতাসে একটু উষ্ণতা খুঁজতে মুখ গুঁজল পোক্ত বুকে। অথচ শেহজাদের ঘুম হারাম করে এই স্নিগ্ধতা, এই রাত, এই প্রেম এমনকি শেহজাদের সবটুকু! সবটুকুর অধিকার মুঠোয় নিয়ে কী আরাম করে ঘুমোচ্ছে তার ঐ একরত্তি বউটা!
নিজের ভাবনায় নিজেই মুচকি হাসলো শেহজাদ। তাকে দেখে কেয়ার টেকার রবিন দৌঁড়ে আসতেই নিজেকে সামলে নিলো সে। নরম গলায় শুধু বলল,
“ গাড়ির ভিতরে আরশির কিছু বই আছে। কষ্ট করে একটু নিয়ে আসবেন রবিন চাচা?”
প্রৌঢ় রবিন চওড়া হাসে। ওপরনিচ মাথা নাড়িয়ে আস্বস্ত করে তাকে বাড়ির ভিতরে যেতে।
বসার ঘরে বসেই আড্ডা দিচ্ছিল জারা, আঞ্জুমান, আর মরিয়ম। সাথে আয়ান আর অভিনবও আছে। বাড়িতে যেন এখন অতিথিদের সমাহার। আঞ্জুমান তো ছিলেনই! সন্ধ্যায় অভিনব আর তার বাবা অনিলও এসেছেন বিয়ে উপলক্ষে।
তারমধ্যেই আরশিকে দুহাতে নিয়ে চৌকাঠ মাড়ালো শেহজাদ। সেকেন্ডখানেক নীরবতা পর অমনি যেন ছোটখাটো গোল বেঁধে গেলো সেথায়। হইহই করে উঠলো আয়ান। দু’হাতে শিষ বাজিয়ে, সোফা ডিঙিয়ে, লাফিয়ে এসে দাঁড়াল শেহজাদের সামনে।
দু’হাত লম্বা করে সামনে এনে নাটকীয় ভঙ্গিতে মাথা ঝোঁকালো অল্প। কৌতুক কন্ঠে আওড়ালো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ ওহে লাভগুরু! দয়া করে আপনার এই শিষ্যকেও একটু তার লাভলাইফের জন্য দোয়া দিয়ে যান!”
শেহজাদ পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলেই আয়ান ফের বলে উঠলো,
“ বউকে অক্ষত অবস্থায় কীভাবে কোলে তুলতে হয়, তার উপায় বাতলে দিয়ে যান লাভগুরু শেহজাদ! তা না হলে আপনার বোন যে হারে আমায় চিমটি কাটছে আজকাল! দেখা গেলো, অক্ষত অবস্থায় তাকে কোলে তুলতে গেলাম ঠিকই, কিন্তু নামালাম নিজের পিঠের চামড়া লাল বানিয়ে!”
আয়ানের কান্ড দেখে মরিয়ম আর আঞ্জুমান হেসে কুটিকুটি হলেও প্রলম্বিত শ্বাস ফেললো জারা। ভার মুখে মরিয়মের কাছে নালিশ করে বললো,
“ কীভাবে আমাদের দুই ভাইবোনের পিছনে লাগছে তোমার আদরের এই জামাই দেখেছো? সাধে কি আমি তাকে বানর ডাকি? তুমি একে ডিসকোয়ালিফাই করে দাও তো বিয়ে থেকে!”
আবারও অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো সবাই। আঞ্জুমান চোখের চশমাটা একটু উপরে ঠেলে বললেন,,
“ সে কিরে? বরকেই যদি বিয়ে থেকে ডিসকোয়ালিফাই করে দেই, তাহলে বিয়েটা হবে কার সাথে তোর পাগল মেয়ে?”
মুখে কিছু না বললেও আয়ান সজোরে মাথা দোলালো ওপরনিচ! অর্থাৎ আঞ্জুমানের সাথে সে শতভাগ সম্মতি জানাচ্ছে।
অভি কিছু বলতে পারলো না হাসির তোরে। একটু এগিয়ে আসে তো আবার ফর্সা চোখমুখ খিঁচে নুয়ে পড়লো মেঝের সাথে। অভিনবের এহেন দূর্দশা দেখে বেশ বিরক্তই হলো আয়ান। ত্যক্ত স্বরে আওড়ালো,
“শালাভায়া! আর হেসো না প্লিজ। তোমার যা অবস্থা! এখানে হাসতে হাসতে মরেটরে গেলে পুলিশ কেস হয়ে যাবে! তুমি বরং ঐ এনিমিয়ার রুমে গিয়ে হেসে আসো! যাও!”
অমনি হাসি থামিয়ে দিলো অভিনব। উৎসুক চোখে চেয়ে শুধালো,
“এনিমিয়াটা কে আয়ান ভাই?”
আয়ান মুখ খোলার আগেই প্রসঙ্গ বদলে ফেললো শেহজাদ। স্বভাবসুলভ গম্ভীর কন্ঠে শুধোলো,
“ বাকিরা কোথায়? আর অভি কখন এলি?”
অভিনবের থেকে কথা কেড়ে নিয়ে আয়ানই বলল ফের,
“ অভিনব এসেছে আন্টিদের সাথে সন্ধ্যায়। ওর বাবাও এসেছেন। আমরা কতক্ষণ আড্ডা দিলাম চা খেতে খেতে! তোদের তো আসার নাম নেই! অগত্যা আঙ্কেল ওনাকে নিয়ে গেলেন ছাঁদে। একসাথে ফুটবল ম্যাচ দেখার জন্য! আজ বার্সেলোনার খেলা আছে তো!”
“ তাহলে তোরা এখানে কী করছিস?”
আয়ান একটু ঠিক হয়ে দাঁড়াল এবার। ডেনিম হুডির আড়ালে টানটান করলো সুঠাম পিঠ। দৃঢ় গলায় বলল,
“ তোকে পাহারা দিতে এসেছি! বউ রুমে রেখে ভালো ছেলের মতো চলে আয় ছাঁদে!”
আঞ্জুমান আপত্তি করে বললেন,
“ আহা! বাবা, থাক না! বাইরে থেকে এসেছে, একটু রেস্ট নিক না রুমে গিয়ে! আর মেয়েটাও তো ঘুমে কাঁদা!”
আয়ান একটু চেপে এলো শেহজাদের কাছে। স্বর নামিয়ে বললো,
“ কেউ তো আর জানে না, তুই রেস্ট নিতে রুমে যাওয়া মানেই আরশির ঘুম হারাম! তোর মতো এনাকন্ডাকে এক চুলও ভরসা হয়না আমার! তারউপর বিয়ে তোর আমার একসাথে হচ্ছে! আমি বউ নিয়ে না ঘুমোতে পারলে তুই কেনো ঘুমোবি?”
হিসহিসিয়ে উঠলো শেহজাদও!
“ বোন হয় আমার! ঠিক করে কথা বল!”
“ আগে ভালোয় ভালোয় আমার কথা শোন বলছি! আরশিকে রুমে রেখে ছাঁদে চলে আয়!”
“ পারবো না!”
শেহজাদের কন্ঠ অবিচল। ভণিতাহীন উত্তরে ঘাবড়ে গেলো আয়ান। আঁতকে উঠে বলল,
“ আন্টি কী বলেছিল সকালে মনে নেই? আজ থেকে শুক্রবারের আগ অবধি তুই বিবাহিত ব্যাচেলর! আর বিবাহিত ব্যাচেলরদের কখনোই বউয়ের সাথে ঘুমোনো উচিত নয়! তুই ঘুমোবি আমাদের সাথে!”
শেহজাদ চোখ উল্টালো। হাওয়ায় উড়িয়ে দিলো আয়ানের কথাগুলো। রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই এক লাফে ফের সামনে এসে দাঁড়াল আয়ান। পথ আঁটকে বললো,
“ তুই রুলস ব্রেক করলে কিন্তু আমাদের সবার আনন্দ মাটি! আমাদের টিম লিডারের মায়ের আনন্দও মাটি! তুই চাস আমাদের টিম লিডারের মায়ের আনন্দ মাটি করতে?”
“ ওর নাম আরশি!”
“ ঐ একই কথা!”
অভিনব জিজ্ঞেস করলো,
“ এই টিম লিডারের মা জিনিসটা কী?”
আয়ান যেন এতক্ষণে পছন্দ মতো একটা টপিক পেলো বলার। সে বেশ আয়েশ করে বলতে লাগলো,
“ কেনো? আমাদের স্নোবলকে দেখোনি তুমি? আরে যাকে তুমি এসেই জোর করে কোলে নিতে গিয়ে দু’বার ব্যাক কিক খেলে? সে হলো আমার টিম স্নোবল স্কয়াড এর লিডার! আর আরশি তার মা!”
ফাঁক দিয়ে শেহজাদ চলে যেতে নিলে আবারও তাকে ঘিরে দাঁড়াল আয়ান।
“ এই যে তুই! ফাঁক পেয়ে পালাচ্ছিলি? ছিহ শেহজাদ! ছিহ! আচ্ছা বল! তুই কী চাস না? আরশিকে নতুন করে পুরোনো বিয়ের ফিলটা দিতে? সারাক্ষণ জার্মান শেফার্ডের মতো বউয়ের আশেপাশে ঘুরঘুর করলেই বউ তোকে পাত্তা দেবে ভেবেছিস? খুশি হবে ভেবেছিস?”
অভিনব পিছন থেকে অবাক হয়ে শুধালো,
“ হবে না বলছো?”
“ আলবাত হবে না! কক্ষনও হবে না!”
আয়ান যে থামবে না শেহজাদ তা বেশ বুঝতে পারছে। অন্তত যতক্ষণ না সে ওর কথা মেনে, ছাঁদে যাবে ততক্ষণ এই ছেলে ঘ্যানঘ্যান করবে ওর কানের পাশে এসে!
নিরুপায় হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো শেহজাদ। আবার এক পা এগোতে নিলেই আয়ান ছটফট করে বলে উঠলো,
“ আন্টি কিন্তু আঙ্কেলকেও আউট করে দিয়েছে রুম থেকে! সে এখন আমাদের দলে। আমরা ছেলেরা এখন বরপক্ষ। আর তুই বরপক্ষ হয়ে যদি কনেপক্ষের মেয়ের সাথে এক ঘরে ঘুমিয়েছিস তাহলে কিন্তু…”
মরিয়ম দাঁড়িয়ে গেলেন হুট করে। সকালের মতো আবারও বেকায়দায় পড়ার ভয়ে আগেভাগেই আঞ্জুমানকে বলে উঠলেন,
“ আপা! চলুন শুয়ে পড়বেন চলুন! আজকে এমনিতেও শরীরটা ভীষণ ক্লান্ত! কাল তো আবার তাড়াতাড়ি উঠতে হবে! ওদের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানের আয়োজন, মেহেন্দির আয়োজন সবটাই কিন্তু আমরা করবো! ছেলেপক্ষকে ভরসা নেই আমার কোনো!”
আঞ্জুমান আমতাআমতা করে বললেন,
“ সেকি? এখনই চলে যাবো? আরশি তো মনে হয় সকালের আগে উঠবে না! কিন্তু ছেলেটা মাত্র এলো! ওর খাবারদাবারের কিছু…?”
“ বরপক্ষ কী খাবে সেটা তাদের ব্যাপার! আপনি চলুন তো আপা! ওদেরটা ওরা বুঝে নেবে!”
বলেই মরিয়ম দাঁড়ালো না আর এক মূহুর্তও। আঞ্জুমানকে একপ্রকার বগলদাবা করেই নিয়ে চলে গেলেন যে যার ঘরে।
“ আন্টি চলে গেলো বলে যদি চিটিং করেছিস শায়ান! নিজের টিমের সাথে বাটপারি করলে কিন্তু সারাজীবন তোকে এ নিয়ে কথা শোনাবো!”
আয়ানের কথা শুনে শেহজাদ ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো পেছনে,
“ ফ্রেশ হয়ে আসছি! ঘুমোবো না আমি! কিন্তু তোদের হাসহাসি শুনলে আরশির ঘুম ভেঙে যাবে! ওকে শুইয়ে আসতে দে অন্তত!”
বলেই লম্বা পা ফেলে সিঁড়ি ভাঙলো মানুষটা। ওদিকে মনে মনে বিজয়ীর হাসি হাসছে আয়ান। জিভ দিয়ে গাল ঠেলে দাঁড়িয়ে বন্ধুর প্রস্থান দেখতে দেখতে হাত রাখলো অভির কাঁধে। বিজ্ঞের মতো শুধোলো,
“ কী বুঝলে শালাভায়া!”
অভির মুখখানায় বিস্ময় খেলে আছে এখনো। ফ্লোর ছুঁয়েছে চোয়াল। বিমূঢ় স্বরে আওড়ালো,
“ শায়ান ভাই আর আগের সেই কাঠখোট্টা শায়ান ভাই নেই! আগের মতো বকাবকি করার স্বভাবটাও এক্কেবারে গায়েব। ও মাই গড! হি হ্যাজ চেঞ্জড!”
জারা পিছন থেকে দাঁড়ালো ওদের পাশে। অভিকে জিজ্ঞেস করলো,
“ ভাইয়া আগে বকাবকি করতো নাকি খুব?”
ফোঁস করে শ্বাস ফেললো অভি। পরপর আওড়ালো,
“ শুধু বকা? এক শহরে থেকেও ভাইয়ার হাতে মার খাওয়ার ভয়ে আমি এমুখো হতাম না! ধুপধাপ হাত তো চলতোই, একদিন ওনার সামনে পড়তে বসে এমন চড় খেয়েছিলাম না রুশা আপু! ওদিনই আমার ওনার কাছে পড়ার শখ মিটে গিয়েছিল!”
অমনি আয়ান সুর ধরে বললো,
“ আগে বলতে? আমি পড়াতাম তোমাকে!”
অভি শূন্য চোখে আয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ আপনি নিজেই তো পড়তে চাইতেন না আয়ান ভাই!”
জারা ঠোঁট টিপে হেসে ফেললো অমনি। ভ্রু নাঁচিয়ে শুধালো,
“ তাই নাকি? তা আমাকেও একটু বলো তো ভাই! তোমার আয়ান ভাই আর কী কী করতো?”
অভি উদাস কন্ঠে আওড়ালো,
“ কী আবার? ঐ যে গিটারটা আছে না এ বাড়িতে? ওটা নিয়েই বসে থাকতো সারাক্ষণ! আমরা তো ভাবতাম আয়ান ভাই পাক্কা কোনো সিঙ্গার টিঙ্গার হয়ে যাবে!”
আয়ান আহত চোখে তাকালো অভির দিকে,
“ শালাভায়া! তুমি সত্যি করে বলো তো! তুমি আমার বউয়ের কাছে আমার প্রশংসা করছো নাকি বদনাম? মানে একজন পুলিশ অফিসারের কোনো দাম নেই এ জগতে?”
অভি মুখ খোলার আগেই কথা কেড়ে নিলো জারা। আয়ানকে পাত্তা না দিয়ে উল্টে অভিকে তাগাদা দিলো। ব্যস্ত হয়ে বলল,
“ অভি তোমাকে না বাবা ডাকছিলেন? এখনো দাঁড়িয়ে আছো? শিগগির যাও ছাঁদে!”
চোখ পিটপিট করে জারার দিকে তাকালো অভি। কই তার তো মনে পড়ছে না এমন কিছু? মামা কখন ডেকেছে তাকে?
জারা ফের তাগাদা দিতেই ছেলেটা শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াল। বুঝতে বাকি রইলো না তাকে ইচ্ছে করেই ছাঁদে পাঠাতে চাইছে জারা।
“ সে যাচ্ছি! কিন্তু তোমরা বেশিক্ষণ এখানে থেকো না। মামি কিন্তু ওপরের ঘরেই আছে!”
অমনি লাজুক মুখে মেকি রাগ দেখালো রমনী৷ চোখ পাকিয়ে তাকাতেই মুচকি হেসে রুফটপে ওঠার সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালো অভি।
কিন্তু ট্রাউজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়েই এমিলিয়ার ঘরটা চোখে পড়লো ওর। থামবে না থামবে না করেও বারণ শুনলো না পা জোড়া। দরজায় লাগানো সফেদ পর্দাটার সামনে থেমে গেলো সহসা। অমনি নজরে এলো একটা শান্ত সুশ্রী গড়ন। টেবিলে মাথা এলিয়ে রাখা একটা বিক্ষিপ্ত মুখ। হাঁটুজোড়া ভাজ করে বুকের সাথে মেশানো। চেয়ারে বসা মেয়েটাকে কী কাঁদছে তবে?
এমি দরজার দিকে তাকাতেই ওর স্ফীত চোখজোড়া দেখে চমকে উঠলো ছেলেটা।
মামীর কোনো আত্মীয় স্বজনের সাথে তার খুব একটা পরিচয় নেই। তাই ভিতরে যাওয়ারও সাহস পেলো না। বুকের ভিতর ডানা ঝাপটানো অনুভূতিগুলোকে নিয়েই ঘাড় নোয়ালো। এলোমেলো পা বাড়ালো ছাঁদের দিকে। বিড়বিড় করে আওড়ালো,
“আয়ান ভাইয়া কী যেন নাম বলেছিল তখন? এনিমিয়া? ইনিই কি সেই এনিমিয়া?”
অভি যেতেই ব্যতিব্যস্ত হলো আয়ান। জারার দিকে না তাকিয়ে তাকালো সিঁড়ির দিকে। যেন ইচ্ছে করেই এড়িয়ে যেতে চাইছে ঐ নীল চোখদুটো! বিচলিত স্বরে আওড়ালো,
“ বুঝলে বাটারফ্লাই! আমারও শালাভাইয়ের সাথে এখন উপরে যাওয়া উচিত! বাচ্চা ছেলে, ফুটবল ম্যাচের কী বুঝবে বলো? আমি না গেলে তো খেলাটাই ঠিকমতো জমবে না! আমি যাই হ্যাঁ?”
অমনি পেছন থেকে ডেনিম হুডটা টেনে ধরলো জারা। কোমরে এক হাত রেখে টেনে আনলো নিজের কাছে।
আয়ান পারলো না পালাতে এবার। ঘাড় নুইয়ে স্বর নামিয়ে আওড়ালো,
“ প্লিজ…!”
“ প্লিজ হোয়াট? আমাকে ইগনোর করছো তুমি? বিয়ে ঠিক হতেই না হতেই পালাই পালাই করছো বানরমশাই?”
জারার কন্ঠের দৃঢ়তা আঁচ করতে পেরেই বুকের গতি বাড়লো বেচারার। অসহায় চোখ তুলে তাকালো প্রিয় মুখটার পানে। জারার আগুনকঠিন চোখে চোখ পড়তেই যেন ঝলসে গেলো সে। তড়িৎ চোখ নামিয়ে ফেলল আয়ান। মিনমিন করে বলল,
“ একটু বোঝো প্লিজ!”
“ ভালোবাসেন না আর আমায়? আর নিজের বাটারফ্লাইয়ের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হয়না আপনার? এটা বুঝবো আমি? আমিই রুশা জানার পর থেকে আপনি একবারও ভালো করে কথা বলেননি আমার সাথে! অথচ সবার সামনে এমন ভান করছেন যেন বিয়েতে আপনার থেকে খুশি আর কেউ নয়! কিন্তু আসল সত্যিটা তো আমি জানি! আপনি আসলে…মনে মনে আফসোস করছেন এখন! সত্যি করে বলুন তো, অন্য কাউকে মন দিয়ে বসেননি তো আবার! এমন নয় তো, যে আপনার অজান্তেই আপনি অন্য কাউকে ভালোবেসে…! ”
জারা শেষ করতে পারলো। পুরো অভিমান উগড়ে দেয়ার আগেই ঠোঁটের ওপর হাত রাখলো আয়ান। অন্য হাতে ওর কাঁধ আঁকড়ে, মেয়েটাকে নিয়ে গেলো কোথাও একটা।
জারা দেখলো না কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ওকে আয়ান। ওর চোখজোড়া শুধু দেখলো সামনে থাকা মানুষটার মধ্যে সেই আগের আয়ানকে। দেয়ালেই পিঠ ঠেকতেই সংবিৎ ফিরলো ওর। আশেপাশে তাকিয়ে বুঝলো সিঁড়ির নিচে নিয়ে এসেছে ওকে আয়ান।
যেন সহজে চোখে না পড়ে কারোর, এমনভাবে জারাকে আড়াল করে দাঁড়াল মানুষটা। জারা বলতে পারলো না কিছু। উপায়ন্তরহীন গুঙিয়ে উঠতেই আয়ান বলল,
“ শশশ! কী চাও তুমি? আমি নিজের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি? তুমি আমাকে ভুল বুঝে চলে যাও আর আমি ছুটে আসি তোমার ঘরে? মাঝ রাতে জড়িয়ে ধরে চুমু খাই তোমাকে? তোমাকে শূন্যে তুলে পাগলের মতো বলি, আমি নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসি তোমাকে? শুধু তোমাকেই ভালোবাসি! আর সারাজীবন এই আয়ান হান্টার শুধু তার বাটারফ্লাইকেই ভালোবেসে যাবে! এটা চাও তুমি?”
খসখসে হাতের তালুটা ধীরে ধীরে ঠোঁটের ওপর থেকে সরিয়ে গালের পাশে রাখলো জারা। ভেজা ভেজা নীল চোখে তাকালো আয়ানের অসহায় চোখদুটোর দিকে। ক্ষীণ স্বরে বলল,
“ চাই তো! আপনি আমাকে খুব ভালো না বাসুন, শুধু কথা বলা বন্ধ করে থাকবেন না। কেউ আমাকে সারাদিনে একবারও বাটারফ্লাই বলে ডাকলো না, এটা ভাবলেই যে দম বন্ধ লাগে আমার!”
আচমকাই ফিনফিনে শরীরটা বুকে টেনে নিলো আয়ান। দু’হাতে জড়িয়ে ধরে মুখ গুঁজলো জারার ঘাড়ে। উষ্ণ পানিতে গাল ভিজলো জারার। ফ্যাসফ্যাসে গলায় আওড়ালো,
“ সরি! অনেক পঁচা কথা বলে ফেলেছি না? কষ্ট দিয়ে ফেলেছি না আপনাকে খুব। কিন্তু বিশ্বাস করুন! ইচ্ছে করে করেনি আমি। আপনি অমন পালাই পালাই করছিলেন দেখে মাথা কাজ করছিল না তখন! আমি খুব সরি! খুব!”
আয়ান টুঁ-শব্দটিও করলো না। নরম গলায় মুখ গুঁজে পড়ে রইলো ওভাবেই। মানুষটা মুখে না বললেও জারা বুঝে ফেলল সবকিছু। বুঝে ফেলল কষ্ট পেয়েছে আয়ান। তখনই দু’হাতে আনত মুখটা তুলে জানতে চাইলো,
“ একটু আদর করি?”
আয়ান হ্যাঁ না কিছু বলার আগেই মেয়েটা অগোছালো চুমু খেলো তার সমস্ত মুখে।
এবার আর নিজেকে সামলাতে পারলো না আয়ান। মূহুর্তেই জাপ্টে ধরলো জারাকে।
“ এভাবে এলোমেলো করে দিও না আমাকে বাটারফ্লাই! বিয়ের এখনো দু’দিন বাকি!”
জারা শুনলো না সেসব। আয়ানকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে দাঁড় করালো সামনে। দু’গালে হাত রেখে হুট করেই আলতো ঠোঁট ছোঁয়ালো মানুষটার ঠোঁটে। আবার সরিয়েও নিলো সাথে সাথে।
হাতদুটো মুষ্টিবদ্ধ করে ফেললো আয়ান। আঙুলের গাঁট গুলোর সফেদ হলো। চোখ বন্ধ করে বলার চেষ্টা করলো,
“তুমি ভাবতে পারবে না গতকাল রাত থেকে কীভাবে নিজেকে সামলে রেখেছি আমি! তুমি পাগলামি করলে কিন্তু…”
অমনি আবার এসে ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে গেলো জারা। মানুষটাকে থামিয়ে দিলো মাঝ পথেই। কন্ঠে দুষ্টমি মিশিয়ে বলল,
“ আপনি ভাইয়া আর বাবাকে ভয় পান ঠিক আছে, কিন্তু আমি তো পাই না! আর না আমি আপনার মতো কন্ট্রোল করছি নিজেকে! তাই আপনাকে আদর করার দায়িত্বটাও আমিই নিলাম অফিসার !”
আয়ান চোখ খুললো এবার। জারা কথাগুলো বলে আনমনেই হাসছিল। কিন্তু আচমকা যখনই আয়ান ওর হাতদুটো চেপে মাথার উপরে, দেয়ালে সাথে নিয়ে ঠেকালো, তখনই হাসি নিভে গেলো ওর।
কর্ণকুহরে পৌঁছালো মানুষটার হাস্কি স্বর,
“ কে বলেছে আমি ভয় পাই তোমার ভাইয়া আর বাবাকে? নাকি প্রমাণ করে দেখাতে হবে?”
শুকনো ঢোক গিললো জারা। লাগামহীন ঘোড়ার মতো ছুটলো হৃদযন্ত্রটা বুকের ভিতর,
“ আ-আমি…আসলে…ওভাবে বলিনি কি…!”
বাক্যের মাঝপথেই কম্পিত ওষ্ঠপুট লুফে নিলো আয়ান। হঠাৎ এমনধারা আক্রমণে জিভজোড়াও তাল কেটে মিলে গেলো। স্পর্শ পেলো একে অপরের। এই প্রথম!
যখন হুঁশ ফিরলো, তখনও শ্বাস আঁটকে আছে ওদের। আয়ান আলতো হাসলো। আস্তে ধীরে ওকে ছেড়ে দিতেই দম নিলো জারা। নিজেকে সামলে আয়ানের দিকে তাকাতেই ছেলেটা নিম্নাষ্ঠ কামড়ে ধরলো। দাঁড়াল আরাম করে।
“ এটা কী ছিল?”
রমনীর প্রশ্নে আয়ান এগিয়ে এলো দু’পা! দেয়ালের সাথে কোণঠাসা করে দাঁড়ালো জারাকে। জারার মাথার দু’পাশের দেয়ালে হাত রেখে ঝুঁকে এসে বললো,
“ নিজের আদরটুকু বুঝে নিলাম!”
“ তাই বলে এভাবে…”
এতটুকুতেই থেমে গেলো জারা। রাঙা হয়ে এলো মুখটা ওর। একটু আগে রাগ দেখানো গলাটাও যেন কথা খুঁজে পেলো না কোথাও আর!
আয়ান বুঝতে পেরে মুচকি হাসলো। জারার কানের পিছনে খুচরো চুলগুলো গুঁজে দিলো আঙুল দিয়ে। পরপর সেখানে মুখ নিয়ে আওড়ালো,
“ মিসেস আয়ান বুঝি একাই আমাকে আদর করার দায়িত্ব তুলে নিতে পারে? আমি নিজের আদর নিজে বুঝে নিতে পারি না?”
গায়ে হলুদের সকাল। কাঁচা হলুদের গন্ধে ম-ম করছে চারিপাশ। হাসান ভিলার ব্যাক ইয়ার্ড গাদা ফুল দিয়ে সাজিয়েছেন মেহমেদ হাসান আর অভিনবের বাবা অনিল শিকদার। অনিল বয়সে মেহমেদের বছর পাঁচেকের বড় হলেও সম্পর্কটা এখনো যেন ঠিক আগের মতোই রয়ে গেছে।
যখন অভিনবের মা বেঁচে ছিলেন তখনও যেমন দেখা হলে তাদের শালা-দুলাভাই কম, বন্ধু বেশি মনে হতো। এখনও তেমনই হয়।
আঞ্জুমান আর মরিয়ম ব্যস্ত মেহমেদের বন্ধু ও তাদের সহধর্মিণীদের সমাদরে।
বিয়ের দু’দিন আগেই এতো আয়োজন। এতো কাজ। বিয়ের দিনের কথা চিন্তা করেই হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেলো আরশির।
নিজের রুমের আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো সে। পরনে গেরুয়া রঙের পেলাম পেপলাম টপ আর শারারা। বর্ডারে সূক্ষ্ম জরোয়ার কাজটুকু ঝলমল করছে লাজবন্তীর গায়ে। উজ্জ্বল ফর্সা শরীরে রঙটা আরো ফুটে উঠেছে যেন।
আরশি চোখ সরিয়ে নেয়। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় বিছানার উপর বসে থাকা বিশেষ একজনের দিকে। তাকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করে,
“ কেমন লাগছে আমাকে?”
ভদ্রলোক জবাব দেয় না। আবার চোখও ফেরায় না। আরশি ঠোঁট টিপে এবার পুরোপুরি পিছনে ঘুরলো। এগিয়ে এসে হাঁটু গেড়ে বসলো তার সামনে। ভদ্রলোকের মুখের সামনে মুখ বাড়িয়ে দিয়ে শুধালো,
“ মাম্মামকে কেমন লাগছে বলবে না? তোমার পাপার পাশে মানাবে না আমাকে?”
অমনি ভদ্রলোকও তার লম্বা কানসহ মুখখানা এগিয়ে দিলো আরশির দিকে। ছোট জিভ দিয়ে নিজেকে যেমন করে পরিষ্কার করে, তেমন করে আরশির নাক-মুখও চেটেপুটে পরিষ্কার করে দিতে লাগলো সে। যেন বোঝাতে চাইলো,
“ মানাবে না মানে? পাপা কতো কপাল করে আমার মাম্মামের মতো এতো সুন্দরী একটা বউ পেয়েছে জানো?”
স্নোবলের আদর পেয়ে খিলখিল করে হেসে উঠলো আরশি। তুলোর মতো রোমশ মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। চুমু খেলো ওর মুখে।
“ মা ছেলেকে ডিস্টার্ব করতে এই অবলা বাবা একটু ভিতরে আসতে পারে কি?
কন্ঠ শুনে চমকে উঠলো আরশি৷ সহসা দৃষ্টি ফেললো দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার দিকে। সাদা পাঞ্জাবিতে আঁটসাঁট দেহ। ঈষৎ লম্বা চুলগুলো এলোমেলো পড়ে আছে কপালের সামনে।
আরশি তাকাতেই ওষ্ঠপুট দু’দিকে ছড়িয়ে পড়লো শেহজাদের। বিস্ময়বিমূঢ় রমনী দাঁড়িয়ে যেতেই পিছনে হাত বেঁধে রুমে ঢুকলো শেহজাদ।
“ স্নোবলকে একটু বাইরে পাঠাও!”
আরশি যেন শুনতে পেলো না কিছু। মানুষটাকে পাঞ্জাবিতে দেখে এবার বোধহয় আসলেই শর্টসার্কিট ফার্কিট হয়ে গেছে তার ব্রেইনে। কিছুক্ষণ ভূতগ্রস্তের মতো দাঁড়িয়ে থেকে শুধায়,
“ আপনি তৈরি?”
“ উমম…ভেবেছিলাম তো তাই! কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সাদা পাঞ্জাবি বদলে গেরুয়া রঙের পরতে হবে কিছু!”
“ আপনি গেরুয়া রঙ কেনো পরবেন?”
“ কারণ আমার ওয়াইফি পরেছে তাই? তার আগে তুমি স্নোবলকে জাস্ট দু’মিনিটের জন্য করিডর ঘুরে আসতে বলো! ইট’স আর্জেন্ট!”
“ কেনো?”
শেহজাদ লম্বা শ্বাস নেয়। চোখজোড়া ছোট ছোট করে তাকায় স্নোবলের দিকে। মুখখানা ছদ্ম গম্ভীর করে বলে,
“ আমার বউয়ের দিক থেকে তো এই ছেলের চোখই সরছে না! অনেক হয়েছে! অনেক দেখেছে সে আমার বউকে! এবার আমি দেখবো।”
আরশির ভ্রম কাটে। শেহজাদের মেকি রাগে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কোলে তুলে নেয় স্নোবলকে। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আদুরে গলায় বলে,
“ এভাবে বলছেন কেনো? খরগোশই তো!”
পরাজিত সিপাহীর ন্যায় মাথা নোয়ালো শেহজাদ। এই হয়েছে এক যন্ত্রণা। একে তো বউয়ের ঐ আদুরে মুখের ওপর সে কিছু বলতে পারে না! তারউপর তার বউ খরগোশ অন্ত প্রাণ।
অগত্যা মনের কষ্টে বিড়বিড় করে আওড়ালো,
“ খরগোশই তো? তুমি জানো? তোমার এই ‘খরগোশই তো’ রাতে আমার জায়গা দখল করে আমারই বউয়ের পাশে আরামসে ঘুমোন। আমি যে কাউচে বসি প্রতিদিন সে কাউচে তিনি পি করে দেন। লিটার বক্স থাকতেও ইচ্ছে করে বিছানায় আমার জন্য চকলেট চিপস সাজিয়ে রাখেন। আমাকে রুমে ঢুকতে দেখলেই পিছনের পা তুলে থপথপ আওয়াজ করেন ফ্লোরের সাথে। পুরো জাতশত্রু বিহেভিয়ার! হাউ ক্যান ইউ নট সি দ্যাট স্নোফ্ল্যাক?”
আরশির পেট গুরগুর করছে শব্দ করে হাসার জন্য। আহারে! কেমন বাচ্চাদের মতো অভিযোগ নিয়ে এসেছে তার কাছে! মেয়েটা ঠোঁট টিপে শুধালো,
“ আর কিছু?”
শেহজাদ ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার বাইরে তাকালো এবার। নাহ! আয়ান বা অভি, কেউই নেই এদিকটায়। পরপর ঋজু হয়ে দাঁড়িয়ে বললো,
“ ওকে কোল থেকে নামাও! আমার কাজ আছে!”
“ কী কাজ? আগে শুনি, তারপর নামাবো!”
“ এতো মহা ঝামেলা! খরগোশের মা, এতো জেদ ভালো নয়! আমি কিন্তু ভীষণ রেগে যাচ্ছি!”
“ আমিও রেগে যাচ্ছি! আপনি আমার খরগোশকে জাতশত্রু বলেছেন! আপনার সাথে আমার কথা নেই!”
বলেই অন্যদিকে মুখ ঘোরালো আরশি। সাথে স্নোবলও ঘোরালো। মা ছেলে একসাথে মুখ ঘুরিয়ে ফেলতেই অসহায় বোধ করলো শেহজাদ। স্নোবলকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল,
“ ভেবেছিলাম আপনার জন্যও একটা বউ আনবো! কিন্তু না! আনবো না! আমার বউয়ের কোল দখল করে সারাদিন বসে থাকলে আপনাকে কোনো বউই এনে দেয়া হবে না! উল্টে ডক্টরের কাছে নিয়ে গিয়ে আপনার নিউটর করিয়ে নিয়ে আসবো! তখন বুঝবেন! টিট ফর ট্যাট কাকে বলে!”
আরশি হাসবে না কাঁদবে খুঁজে পেলো না। নুয়ে স্নোবলকে ফ্লোরে নামিয়ে দিয়ে বলল,
“ আপনি বাড়ির বাকিদের সামনে আপনার এইরূপ দেখান না কেনো? ওরা ভাবে আপনি কত ম্যাচিওয়র। অথচ আপনি কিনা অবলা একটা বাচ্চাকে নিয়ে বাচ্চাদের মতো হিংসে করছেন?”
“ আরশি! ও মোটেই অবলা নয়! নেহাত কথা বলতে পারে না! নইলে প্রতিবেলায় ওর সাথে আমার তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লেগে যেতো তোমাকে নিয়ে!”
“ সে তো ও কথা না বলতে পারলেও লাগছে!”
“ কী বললে?”
“ কী বললাম?”
আরশি গাল ফোলাতেই নিজের ছদ্ম রাগটা আর ধরে রাখতে পারলো না শেহজাদ। ফিক করে হাসলো সদা গম্ভীর মানুষটা। মেঘমেদুর গলায় বলল,
“ আচ্ছা আচ্ছা! আর রাগ করতে হবে না! বলবো না তোমার খরগোশকে কিছু!”
আরশিও রাগ ছেড়ে দিলো। এতো আনন্দের দিন ঝগড়া করে মাটি করবে না ও! জিজ্ঞেস করলো,
“ কিছু নিতে এসেছিলেন আপনি?”
শেহজাদ ভ্রু উঁচালো এবার। এগিয়ে এলো এক পা এক পা করে। কাছাকাছি এসে চোখে চোখ রাখলো আরশির। আওড়ালো,
“ উহু! দিতে এসেছি তোমাকে কিছু!”
এমিলিয়ার হাতে গাদা ফুলের ডালা। গায়ে জরোয়ার কাজ করা হলুদ কামিজ। মরিয়মই জোর করলেন পরতে। এমিলিয়াও খুশি মনেই পরেছে। এখন যে সে আর রাগ পুষে নেই আরশির উপর। তাহলে বিয়েতে আনন্দ করবে না কেনো?
তারউপর ঠিক করেছে আরশির কাছে ক্ষমাও চেয়ে নেবে এতোদিনের করা ব্যবহারের জন্য। অনেক বাজে কথা শুনিয়েছে মেয়েটাকে। অনেক খারাপ ব্যবহার করেছে। অথচ আরশি? তবুও মরিয়মের জন্মদিনের দিন কেমন আপন করে নিলো ওকে? প্রথমে প্রতিশোধ নেয়ার কথা ভাবলেও শেষটায় মন বদলাতে বাধ্য হয়েছে এমি। শুধুমাত্র আরশির নিঃস্বার্থ আচরণের জন্য!
এতসব ভেবে ভেবে সদরদরজার ওপাশে যেই না পা বাড়াতে যাবে ও? অমনি সামনে থেকে ধেয়ে এলো কোনো একজন। তুমুল এক ধাক্কা খেলো তার সাথে এমিলিয়া। গাদা ফুলের ডালা শূন্যে উঠে ফুলগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলো চারিদিকে।
টাল সামলাতে না পেরে মেঝেতে পড়ে গেলো এমিলিয়াও। কোমরে মারাত্মক চোট না লাগলেও পা-টা মচকেছে নির্ঘাত। তবে যতক্ষণে আগন্তুকের মুখ দেখার জন্য ও সম্মুখে তাকালো, ততক্ষণে সেই লোক বেরোনোর পথ ধরেছে। ভিলার ভিতরে না ঢুকেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে পালিয়েছে সামনে থেকে।
এমিলিয়া শুধু পিছন থেকেই দেখলো লোকটার। প্রথমে স্বাভাবিক মনে হলেও আগন্তুকের পরনে থাকা কালো হুডিটা নজরে পড়তেই খটকা লাগলো ওর। আদির কথা মনে পড়লো হঠাৎ।
অকস্মাৎ শিরদাঁড়া বেয়ে খাড়া হয়ে নেমে গেলো কিছু একটা। কেঁপে কেঁপে উঠলো বুকের ভিতর। কিন্তু যে মানুষটা জেলে? সে তো আর কোনোভাবেই ওদের ক্ষতি করতে আসতে পারবে না! তাহলে কে এই লোক?
গায়ে হলুদের দিনে, বাড়ির ভিতরেই বা কেনো ঢুকতে চাইছিলো সে?
“ আপনি ঠিক আছেন?”
দুরুদুরু বুকে পুরুষালী কন্ঠ শুনতে পেয়েই তড়াক করে পাশ ফিরে তাকালো এমিলিয়া। লম্বাটে, ছিমছাম একটা ছেলে। উদ্বীগ্ন চেহারায় হাত বাড়িয়ে ঝুঁকে আছে ওর পাশে দাঁড়িয়ে।
“ আপনি উঠতে পারবেন? কিছু মনে না করলে আমার হাত ধরে ওঠার চেষ্টা করুন!”
এমিলিয়া চিনতে না পেরে গুটিয়ে গেলো বসে থেকেই। হাত ধরলো না। বাড়তি কোনো কথাও বললো না।
“ আমি খারাপ মানুষ নই! উঠে আসুন!”
এবারও বাড়ানো হাতটা ধরলো না এমি। কিন্তু যখন নিজে থেকে উঠতে গেলো, তখনই টনটন করে উঠলো মচকে যাওয়া জায়গাটা। মুখ থেকে ব্যথাতুর শব্দ বের হতেই অপরিচিত লোকটা হুট করে ঘটিয়ে বসলো আরেক কান্ড। কোনো কথাবার্তা ছাড়াই দু’হাতে কোলে তুলে নিলো এমিলিয়াকে। ঘাবড়ে গেলো মেয়েটা। বিস্ময়ভরা কন্ঠ শৃঙ্গে তুলে জানতে চাইলো,
নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৫৮
“ চেনা নেই জানা নেই! একজন অপরিচিত মানুষ হয়ে কোনো মেয়ের শরীরে তার কনসেন্ট ছাড়া আপনি হাত দিলেন কোন সাহসে?”
মানুষটা নির্বিকার তখনও। এমিলিয়াকে সহ গেস্ট রুমের দিকে যেতে যেতে বললো,
“ প্রথমত আমি অপরিচিত নই! বরং আপনি একটু বেশিই জেদি! আর আমার মতে দরজার সামনে পা ভেঙে পড়ে থাকার চাইতে এই অপরিচিতের কোলে চড়ে পায়ে সামান্য বরফ লাগিয়ে আসা ইজ মাচ বেটার! চিন্তা নেই, মানবতার খাতিরে এটুকু কনসেন্ট ছাড়া ছুঁয়েছি বলে আমি সরি না বলে পালাবো না!”