নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৭
সিনথিয়া
জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পার হতেই শীত যেনো জেঁকে বসেছে ম্যানহাটন সিটিতে।
কুয়াশার চাদরে ঢেকে গেছে উঁচু উঁচু ভবনগুলো।
তেমনি কোনো এক বারো তলা ভবনের
সবচেয়ে উপরের তলার একটি রুমে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে আরশি। আজ যে পরিমাণে ঠান্ডা পড়েছে তাতে তিন নম্বর বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলেও সে উঠবেনা। ভার্সিটিতে যাওয়ার তো প্রশ্নই আসে না।
তুষারের গালিচায় মোড়ানো শহরটির ব্যস্ত রাস্তায় সবে মানুষের আনাগোনা শুরু হয়েছে। তাড়াহুড়োয় পা ফেলছে যে যার গন্তব্যে।
সেখানেই দেখা মিলল শেহজাদের। কালো হুডি আর ট্র্যাক প্যান্ট পরে পুরোদস্তুর জগিং এর জন্য প্রস্তুত সে।
সাথে আরো একটা কাজ বাকি। পুলিশ স্টেশন থেকে আরশির মোবাইল আর ব্যাগটা নিয়ে আসা। নয়তো মেয়েটা আজ ভার্সিটি যাবে কি করে?
আরশির ঘুম ভাঙলো সাতটার দিকে। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসতেই বুঝলো, ঘুম আসলে ভাঙেনি, ভাঙানো হয়েছে।
রুমের দরজায় বিকট শব্দে কড়া নেড়ে ওর এতো সাধের ঘুমটা ভাঙিয়েছে শেহজাদ।
আরশি আধবোজা চোখে টপাটপ হাই তুলছে।
দরজা খোলার জন্য উঠতে গেলেই যেনো পা জড়িয়ে ধরছে একরাশ অলসতা।
তবুও ঢুলতে ঢুলতে উঠলো মেয়েটা।
বাবুইপাখির বাসা হয়ে থাকা চুলগুলো চোখের ওপর থেকে সড়িয়ে দরজা খুলতেই
যেনো বিদ্যুৎ খেলে গেলো কিশোরীর শরীরে। সফেদ স্যুট প্যান্ট পড়া এক সুদর্শন পুরুষের রূপে হোঁচট খেলো দৃষ্টি। দুম করে রন্ধ্রে এসে ভিড়লো পারমিউমের কড়া গন্ধ।
মুগ্ধ নয়ন মনে মনে আওড়ালো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“আজ তো জাম্বুবানটাকে পুরো ভ্যানিলা ওয়াফেলের মতো লাগছে!”
হাই-টাই সব উড়ে গেলো আরশির। লোভাতুর দৃষ্টি তখন সম্মুখ পানে দাঁড়িয়ে থাকা শেহজাদের উপর।
ব্যায়াম করা সুঠাম দেহ আর ফুলে ফেঁপে থাকা বায়োপসি ঢাকা
পড়েছে শুভ্র শার্টের অন্তরালে। নিরেট মুখাবয়ব থেকে যেনো ঠিকরে বের হচ্ছে আত্নবিশ্বাস।
আর সেখানে আরশি ওরকম পাগলের মতো দাঁড়িয়ে। এক পায়ের প্লাজোটা পর্যন্ত হাঁটুর উপরে উঠে আছে! এটা মানা যায়?
তড়িঘড়ি প্লাজো নামিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো
মেয়েটা। নিজেকে মানুষটার সামনে বেমানান লাগলো খুব। মনে মনে কয়েক দফা মরেও গেলো এমন পরিস্থিতির শিকার হয়ে।
তবে সেসবে খুব একটা পাত্তা দিলো না শেহজাদ। এমনভাবে ওর দিকে নতুন টোট ব্যাগটা এগিয়ে দিলো যেনো এটা রোজকার ঘটনা। কন্ঠে মাত্রাতিরিক্ত সাবলীলতা মিশিয়ে বলল,
“তোমার পুরোনো ব্যাগটা দেখলাম ছিঁড়ে গেছে। তাই নতুন আরেকটা আনিয়েছি। নোট-বুক গুলো এর ভিতরেই আছে। দেখে নিও কিছু হারিয়ে টারিয়ে গেলো কি না!”
আরশি ধ্যানজ্ঞান আবার খেই হারালো শেহজাদের প্রশংসায়। মানুষটা এতো ভাবে ওর জন্য?
সেখানে কোন নোটবুক আছে, কোনটা খোয়া গেছে, সেটা থোড়াই কেয়ার করবে ও এখন!
আরশি ব্যাগটা ধরতেই শেহজাদ ব্লেজারের বুক পকেটে হাত দিলো। পরপর একটা নতুন মোবাইল বের করে আরশির সামনে ধরে বলল,
“তোমার আগের মোবাইলটার স্ক্রিনও দেখলাম ভেঙে গেছে৷ তাই নতুন আরেকটা আনালাম। সিমকার্ড সেট করে দেয়া আছে।
খুলে দেখো ভালোভাবে চলে কি না! আচ্ছা ওয়েট! আমিই দেখছি!”
নিজের মতো করে কথাগুলো শেষ করেই মোবাইলটা চালু করলো শেহজাদ। রং-বেরঙের আলোতে স্ক্রিনটা জ্বলজ্বল করে উঠলো নিমিষেই।
পরপর প্যান্টের পকেট থেকে নিজের মোবাইল বের করে কল দিলো আরেক হাতে থাকা আরশির নতুন মোবাইলে।
কিন্তু বিধিবাম! মূহুর্তেই ভ্রু যুগল এক হলো মানুষটার। ভ্রু সমেত কপালেও ভাজ পড়লো কয়েক পরত।
পরপর হাতের মোবাইলটা আরশির মুখের সামনে তুলে ধরলো ও।
সাদা স্ক্রিনে সদর্পে ভেসে থাকা জাম্বুবান নামে সেভ করা নাম্বারটা দেখিয়ে বলল,
“তুমি আমার নাম্বার জাম্বুবান নামে সেভ করেছো?”
চক্ষু ফুটবল হলো মেয়েটার।
“আমি? কই দেখি!” বলেই ছো মেরে শেহজাদের হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে সপাটে মুখের ওপর দরজা আটকে ঘন ঘন শ্বাস ফেললো আরশি।
ওপাশের মানুষটাকে আজকের মতো দেখার সাধ মিটে গেছে ওর। ভাগ্য ভালো! একটুর জন্য বেঁচে গেছে। নয়তো আরেকটু হলেই জাম্বুবান নামে নাম্বার সেভ করার অপরাধে কে জানে কি শাস্তি দিতো? ওর ভ্যানিলা ওয়াফেল ওকেই ওয়াফেল বানিয়ে বেঁচে দিতো নির্ঘাত!
অনিচ্ছা সত্ত্বেও রেডি হয়ে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বের হলো আরশি। ডার্ক কালো ওভার কোটের নিচে সাদা টি-শার্ট। সফেদ রঙা প্যান্ট টাও আজ জাম্বুবানের সাথে মিলিয়ে পড়েছে।
কাঁধের টোট ব্যাগ আর হাতের ঘড়ি ঠিক করতে করতে মেয়েটা গ্রাউন্ড ফ্লোরে আসতেই তারস্বরে গাড়ির হর্ণ বাজালো শেহজাদ।
চমকে-থমকে দিগ্বিদিক চাইলো আরশি। আশেপাশে চোখ বোলাতেই দেখলো কিশোরীর মনে সদ্য সদ্য প্রেমের সুর তোলা পুরুষটিকে।
পরপরই আবার আরশির ওভার থিঙ্কিং সত্তা ভিতর থেকে ওকে জানান দিলো,
“এই রে, লোকটা মোবাইল থেকে জাম্বুবান নাম চেঞ্জ করানোর জন্য আবার উঠে পড়ে লাগেনি তো? এজন্যই কি এতোটা সময় ধরে উনি গাড়িতে বসে অপেক্ষা করেছেন?
করতেও পারেন! নয়তো এতক্ষণে এই লোকের ভার্সিটিতে থাকার কথা!”
তখনই মোবাইল বেজে উঠলো ওর। রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপর পাশের পুরুষালী নিরেট কন্ঠ বলে উঠলো,
“গাড়িতে এসে বোসো!”
“না থাক। আ-আমি একাই যেতে পারবো!”
“হ্যাঁ গতকাল তো প্রায় যাচ্ছিলে কিডন্যাপারের বাড়িতে চলে? তা আজ কোথায় যাওয়ার প্ল্যান করেছো? ডাকাতের বাড়িতে?”
শেহজাদের সূক্ষ্ম খোঁচায় আরশির ব্রহ্ম তালুর ছাই চাপা আগুনটা জ্বলে উঠলো যেনো!
তবুও কন্ঠে শতাধিক নম্রতা এনে বলল,
“আপনি কিন্তু আবার আমাকে উল্টো পাল্টা বলছেন! কালকের বিষয়টা একটা এক্সিডেন্ট ছিল মাত্র। আমি সত্যি নিজে নিজে পারবো ভার্সিটিতে যেতে!”
কিন্তু মনে মনে আওড়ালো অন্য কিছু,
“তবুও আমি আপনাকে আমার মোবাইল থেকে জাম্বুবান নামটা কিছুতেই চেঞ্জ করতে দেবো না!
এতো শখ করে গাড়িতে নিয়ে যাবেন কি এমনি এমনি? আপনার চালাকি আমি ধরতে পারবো না ভেবেছিলেন? হুহ!”
শেহজাদের কন্ঠে তখন স্পষ্ট বিরক্তি। খ্যাঁক করে বলে উঠলো,
“দেখো, অলরেডি কিন্তু আমরা লেইট! বিরক্ত করো না আরশি। চুপচাপ উঠে বোসো গাড়িতে। তোমার একা যাওয়ার নমুনা আমার জানা আছে! ওঠো বলছি!”
মৃদু ধমকে কেঁপে উঠলো কিশোরীর ঠুনকো গতর। মানুষটার দ্বিতীয়বারের মতো দেয়া খোঁচাটা গায়ে না মেখেই পা বাড়ালো গাড়ির দিকে।
শেহজাদের পাশের সিটে উঠে বসতেই
ওর দিকে ঝুঁকে আসলো মানুষটা।
চোখের পলকে আরশির সিটব্যাল্ট লাগিয়ে ফের ঠিক হয়ে বসলো নিজের জায়গায়।
কিন্তু ততক্ষণে কিশোরীর অবাধ্য হৃদয়জুড়ে বইতে শুরু করেছে প্রেমের হাওয়া। শেহজাদের এই একটু আধটু যত্নকেই ভালোবাসা ভেবে মুচকি হাসলো মেয়েটা।
গোলাপের পাপড়ির ন্যায় গাল দুটোতে লজ্জা ভিড়তেই গাড়ি স্টার্ট দিলো শেহজাদ।
ম্যানহাটনের বরফ পড়া রাস্তা দিয়ে গাড়িটি ছুটে চলল নিউইয়র্ক ইউনির্ভাসিটির উদ্দেশ্য।
আরশিকে ক্লাসে ঢুকতে দেখেই দাঁড়িয়ে হাত নাড়লো জারা। ঘাড় সমান চুল, ব্যাগি জিন্স আর হুডি পড়া জারাকে দেখেই খুশিতে নেচে-কুঁদে উঠলো আরশির মন।
পুরো গাড়িতে যতটা চুপচাপ বসে ছিল শেহজাদের পাশে, ততটাই হই-হই করতে করতে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো জারাকে।
গ্যালারির মতো সুবিশাল রুমটির মাঝ বরাবর বসলো ওরা।
বসার সাথে সাথে জারা চেপে ধরলো, ওকে। আজ ফোন নাম্বার, ইন্সটা আইডি সব নিতে হবে একে অপরের। বেচারি নাম্বার ছিল না দেখে একটু ফোন দিয়ে খোঁজও নিতে পারেনি আরশির।
আরশি হাসলো। জারার মোবাইলে নিজের নাম্বার সেভ করে ফোন দিতেই বেজে উঠলো ওর নতুন ফোন। সেদিকে নজর যেতেই মনে
পড়লো শেহজাদের কথা।
গাড়িতে যখন ও জিজ্ঞেস করেছিল, এই ফোন শেহজাদ নিজে গিয়ে কিনেছে কি-না সকাল বেলা?
তখন মানুষটা কি বললো? না! এটা বাসার কেয়ারটেকার নিয়ে এসেছে দোকান থেকে। ও শুধু টাকাগুলো দিয়েছে।
বুক চিড়ে চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো মেয়েটার। কোথায় ভেবেছিল জাম্বুবানটাকে এই বুঝি ধরতে পেরেছে ছাই দিয়ে। কিন্তু না এবারেও হাতের ফাঁক গলে ঠিকই টাকি মাছের মতো বেরিয়ে গেলো লোকটা।
“কপালে ব্যান্ডেজ কেনো? কি করে কাঁটলো?”
জারার হঠাৎ করা প্রশ্নে ধ্যান ভাঙলো আরশির।
“ আরে এটা তো-”
এটুকু বলতেই টনক নড়লো আরশির। ঠোঁট টিপে টুপ করে গিলে ফেলো পুরো কথাটা। সত্যিটা বললে যে শেহজাদের কথাও জানাতে হবে ওকে। আর সেখানেই চূড়ান্ত অমত ঐ মানুষটার। ভার্সিটির কেউ যেনো জানতে না পারে আরশি শেহজাদের ওয়াইফ। এটাও অবশ্য শর্তের একটা অংশ।
মনে মনে প্রহসনের হাসি হাসলো মেয়েটা। কিসব অদ্ভুত শর্তে বেঁধে রেখেছে জাম্বুবানটা ওকে।
তখনই কাঁধে হাত রাখলো জারা। ঠান্ডা হাতের স্পর্শে চকিত ফিরে চাইলো মেয়েটা। জারা দিকে চেয়ে ফিকে হেসে বলল,
“টে-টেবিলের কোণায় লেগে কেঁটে গেছে। টেনশনের কিছু নেই। দু-একদিনে সেরে যাবে মনে হয়!”
আরশির কথায় হাফ ছাড়লো জারা। ব্যাগ থেকে নোটবুক বের করতে করতে বলল,
“যাক বাবা! বেশি যে কাঁটেনি এটাই রক্ষা।”
পরপর কিছু একটা মনে পরার ভঙ্গিতে সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো,
“ও হ্যাঁ! কাল তো তুমিও ছিলে না, আর আমারও সবগুলো ক্লাস করা হয়নি। এখন গতকালকের নোটস্ গুলো কার কাছ থেকে পাই বলো তো? তোমারও তো লাগবে তাই না?”
নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৬
আরশি ওপর-নিচ মাথা দোলাল। মনে মনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল মেয়েটা কিছু সন্দেহ করেনি দেখে।
তখনই ওদের সামনে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে এসে দাঁড়ালো কেউ একজন। আরশির দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো সেই সুতনু শ্যাম পুরুষ। মুখে এক ফালি হাসি নিয়ে পশ্চিমা ভাষায় আওড়াল,
“হ্যালো বিউটিফুল! আমি রেজা! এই ব্যাচে নতুন! ”