নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৮
সিনথিয়া
শ্যামবর্ণের পুরুষটি থামলো এবার। কৃষ্ণ কালো তীক্ষ্ণ চোখ পরখ করছে
আরশির শুভ্র আনন।
সেই দৃষ্টি বুঝতে অক্ষম মেয়েটা পুরুষালী বাড়ানো হাত উপেক্ষা করলো কথার মোড় অন্যদিকে ঘুড়িয়ে।
সৌজন্যবোধের খাতিরে পশ্চিমা ভাষায় বলল,
“আমি আরশি। আর ও আমার বন্ধু জারা। আমরাও নতুন এই ব্যাচে।”
জারা বেশ অনেকক্ষণ যাবৎই চুপ। খটকা লাগলো আরশির। চোরাচোখে একবার চাইলো জারার দিকে। তখনই যেন আরেকটা ধাক্কা খেলো ও। বিস্ময়ের তোপে কেশেও উঠলো খানিকটা।
জারার রেজার দিকেই তাকিয়ে? চোখের পাতায় নড়ন নেই, ঠোঁট দুটোর ফাঁক দিয়ে শুভ্র দাঁত খানিক দৃশ্যমান। নীলাভ চোখজোড়ায় প্রথম প্রেমে পড়ার চিহ্ন।
বাকিটা বুঝে ফেলল আরশি। একটামাত্র বান্ধবী কাউকে পছন্দ করেছে। আর ও একটু সাহায্য করবে না?
জারার দিকে তাকিয়েই ভণিতা করে গলা পরিষ্কার করলো মেয়েটা। কিন্তু সেদিকে জারা খেয়াল করলে তো? তার সব খেয়াল তো সামনে দাঁড়ানো শ্যামবর্ণের পুরুষে গিয়ে আঁটকে।
মনে মনে মুচকি হাসলো ও। রেজার দিকে চেয়ে বলল,
“আপনার কাছে আগের দিনের নোটস্ গুলো হবে? আসলে আমরা গতকালকের ক্লাসগুলো এ্যাটেন্ড করতে পারিনি! তাই জিজ্ঞেস করছিলাম আরকি!”
ঠোঁট টিপে শক্তপোক্ত হাতটা ফিরিয়ে নিলো রেজা। বুঝলো এভাবে মন জয় করা যাবে না। আরো সাধনা করতে হবে ওকে। শুধু নোটস্ কেনো! এই মেয়ে বললে জানটাও দিয়ে দেবে না ও?
“শিওর! এক্ষুনি দিচ্ছি ! ”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ব্যস্তভঙ্গিতে ব্যাগ হাতরে নোটবুক বের করলো ছেলেটা। বাড়িয়ে ধরলো আরশির সামনে। চোখ-মুখ উচ্ছলিত আরশির মুখ থেকে আরো কিছু শোনার প্রয়াসে। হোক না সেটা ছোট্ট একটা থ্যাংক্স! ক্ষতি কি?
কিন্তু হঠাৎই ক্লাসে ঢুকলো শেহজাদ। কালো বুট আওয়াজ তুলতেই চারিপাশের গিজগিজ করা শব্দ এক লহমায় বন্ধ হলো। হুরমুরিয়ে বসলো যে যার জায়গায়।
আরশির পাশের সিটটাও খালিই ছিল। রেজাও সুযোগ বুঝে আচানক সেখানে গিয়ে বসে পড়লো।
আরশির কানের কাছে একটু ঝুঁকে পশ্চিমা ভাষায় আওড়াল,
“আসলে এই প্রফেসরটা একটু বেশিই খিটখিটে। এখনো বসিনি দেখলে হয়তো ক্লাস থেকেই বেরিয়ে যেতে বলতো। কিছু মনে করবেন না! না জিজ্ঞেস করেই আপনার পাশে বসে পড়লাম!”
রেজার হুট করে ওর পাশে বসায় হকচকালো আরশি। অপ্রস্তুতে চেপে বসলো কিছুটা জারার পাশে। প্রতু্ত্তরে কিছু বলার আগেই
শেহজাদের গমগমে কন্ঠে থেমে গেলো সে।
দৃষ্টি সামনে ফেরাতেই চোখ পড়লো সমুদ্রের মতো গভীর এক জোড়া চোখে। শেহজাদ ওর দিকেই তাকিয়ে?
কি অদ্ভুত সেই তাকানো। যেনো ওর ভিতর পর্যন্ত চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে লোকটা।
এভাবে কেউ তাকায়? এখন যদি এ্যাটাক-ফ্যাটাক কিছু হয়ে যায় আরশির? ঐ চোখে ওভাবে তাকালে মরে যাবে না ও?
আশেপাশে চাইলো মেয়েটা। সবার চোখ শেহজাদের দিকে। আর সে কি না অমন করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে?
“স্ট্যান্ড আপ!”
সামান্য কথাটাও সোজা তীরের মতো এসে লাগলো আরশির বুকে। কেঁপে উঠলো পেলব শরীরটা। এভাবে ধমকে দাঁড়াতে বলল কেনো জাম্বুবানটা? আবার কি করলো ও?
“আই সেইড স্ট্যান্ড আপ মিস আরশি!”
এবারটায় চট করে উঠে দাঁড়ালো মেয়েটা। ঘটনার আকস্মিকতায় বিস্মিত রেজাসহ পুরো ক্লাস।
দুহাত পোডিয়ামে রেখে একটু ঝুঁকে দাঁড়িয়েছে শেহজাদ। পাতলা ফ্রেমের চশমা ভেদ করে আরশিকে দেখছে সে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে পশ্চিমা ভাষায় বলে উঠলো,
“যদিও আপনারা এখন আর শাস্তি পাওয়ার বয়সে নেই। যথেষ্ট ম্যাচিয়র। কখন কথা বলা উচিত কখন উচিত নয় সেটা নিশ্চয়ই জানেন!”
আরশির গলবিল আঁটকে গেলো শঙ্কায়। নতমস্তকে ওপর নিচ মাথা দোলালো শুধু।
শেহজাদের কন্ঠস্বর হিমবাহের চাইতেও শীতল অথচ কি দাপুটে! মেকি হেসে বলল,
“তাহলে কথা বলছিলেন কেনো দু’জনে? আপনার কি মনে হয়, সার্কাস চলছে এখানে? আর আপনারা ঘুরতে এসেছেন?”
শেহজাদ কথাগুলো বলে থামলো কিছুক্ষণ। ঘনঘন কয়েকবার শ্বাস নিয়ে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর অন করলো। আরশি তখনও দাঁড়িয়ে। ওকে বসতে না বলেই পড়ানো শুরু করলো লোকটা ।
“ইন দিস সেমিস্টার ইউ হেভ টু নো’ এ্যাভরিথিং এবাউট ইকোনমিক্স এন্ড দ্যাটস্ হোয়াট আ’ম গোয়িং টু টিচ ইউ টুডেই। স্টারটিং নাও, টার্ন টু পেইজ নাইন ইন ইউর টেক্সটবুক।”
মানুষটা এমন ভান করলো যেনো আরশি কোনো মানুষ নয়, কার্বনডাইঅক্সাইড!
না হলে, এতোগুলা স্টুডেন্টের মধ্যে এভাবে কেউ দাঁড় করিয়ে রাখে?
একবারও ওর মান-ইজ্জতের দিকে তাকালো না জাম্বুবানটা?
দুঃখে-কষ্টে মনটা ভার হলো ওর।
গতকাল থেকে শেহজাদের প্রতি অল্প-স্বল্প ভালো লাগা অদৃশ্য হলো এক লহমায়।
মনে মনে তপ্ত কিশোরীর এরূপ নাজেহাল দশায় অনুতপ্ত রেজাও। নিজেকে আটকাতে না পেরে উঠে দাঁড়ালো শেহজাদের পড়ানোর মাঝখানেই।
“সো দ্যা ডিজিটাল এইজ ইস ট্রান্সফরমিং ইকোনোমিক্স ইন আ…”
“প্রফেসর!”
থামলো শেহজাদ। কাঁচের গ্লাসের ভিতর দিয়ে চাইলো অপরিচিত মুখের দিকে। ইংরেজিতেই জিজ্ঞেস করলো-
“কী সমস্যা? ”
রেজা ইতস্তত আওড়ালো,
“আরশি কথা বলেননি। কথা আমি বলেছিলাম। ওনার কোনো দোষ নেই প্রফেসর!”
এমনিতেই আরশির পাশে এই ছেলেটাকে বসতে দেখে তিরিক্ষি মেজাজ সামলাতে বেগ পেতে হয়েছে শেহজাদের৷
ভালো খারাপ না ভেবে আরশির উপর সব রাগ ঝেরেছে ও। তারউপর এখন পড়ানোর মাঝখানেও বাগড়া দেওয়া শুরু করেছে এই ছেলে? আর কার হয়ে ওকালতি করছে? ওর বউয়ের?
চোয়াল কটমট করে উঠলো শেহজাদের। মুষ্টিবদ্ধ হাতটা নিশপিশ করলো ঘুষি মেরে ঐ ছেলের নাক ভেঙে দিতে।
অথচ বরফের থেকেও ঠান্ডা কন্ঠে আওড়ালো,
“ও! তাহলে আপনিও দাঁড়াতে চাচ্ছেন?”
থতমত খেলো রেজা। ক্লাসের সবাই তখন ঠোঁট টিপে হাসছে। কি একটা বিব্রতকর পরিস্থিতি!
রেজা পশ্চিমা ভাষাতেই আবার বলল,
“না মানে…!”
“আউট! গেট আউট অফ মাই ক্লাস! রাইট..নাও!”
ভড়কালো ছেলেটা। করুন দৃষ্টিতে একবার আরশির দিকে তাকালো। বোঝাতে চাইলো, কত বড় ত্যাগ স্বীকার করলো সে।
কিন্তু সেই মেয়ে তার দিকে চাইলে তো! সে তো মাথাই তোলেনি এখন অব্দি।
রেজা আর কথা বাড়ালো না। ব্যাগ কাঁধে চলে গেলো ক্লাসের বাইরে।
জারার আহত দৃষ্টি সেদিকে। ঠোঁট উল্টে গালে হাত দিয়ে বিড়বিড় করলো,
“আহারে আমার কিটক্যাট টা!”
কিন্তু কিটক্যাট টুকু শুনে ফেললো আরশি।
আড়চোখে তাকালো জারার দিকে। কনুই দিয়ে গুঁতো দিতেই ধরা পড়া অপরাধীর মতো হাসলো মেয়েটা।
ক্লাস শেষ হতে হতে দুপুর গড়িয়েছে আরশিদের। ক্লান্ত বিকেলে সূর্যের নরম আলো টুকু মোটামুটি চোখে পড়ার মতো।
তারমধ্যে দিয়েই শুকনো ম্যাপল লিফে মরমর শব্দ তুলে হাঁটছে আরশি।
জারা চলে গেছে তার পার্ট টাইম জবে। স্থানীয় একটা লাইব্রেরির গ্রন্থাগারিকের কাজ তার।
আরশি উদাস মনে পা বাড়াচ্ছে সামনের দিকে। আসার সময় শেহজাদের গাড়িতে আসলেও, ঐ জাম্বুবানটার গাড়িতে চড়ে আবার বাসায় যাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই এখন।
তখনই ওর পাশে ধূমকেতুর মতো উড়ে এসে থামে একটা কালো গাড়ি।
চমকে-থমকে দাঁড়িয়ে যায় আরশি। কপালে ভাজ ফেলে গাড়ির দিকে তাকাতেই জানালার কাঁচ নামায় শেহজাদ। নিরেট কন্ঠে হুকুম ছোড়ে পরপর,
“গাড়িতে ওঠো!”
আরশির প্রতিবাদী সত্তা ভিতর ভিতর নড়েচড়ে বসে। ভাবে, এই বুঝি মুখ ঘুড়িয়ে হেঁটে যাবে ও। এমনভাবে অবজ্ঞা করবে
লোকটাকে, যেনো উনি এই রাস্তায় পড়ে থাকা শুকনো ম্যাপল লিফ।
কিন্তু তেমন কিছুই ঘটাতে পারলো না আরশি। উল্টে উগরে আসা অভিমান-অভিযোগের গলা চেপে গাড়িতে উঠে বসলো মেয়েটা। সিটব্যাল্টটা লাগাতে গিয়ে বেগ পেতে হলেও এবার নিজে নিজেই লাগালো সেটা।
একবারও ফিরেও চাইলো না শেহজাদের দিকে। গাড়ি চলতে শুরু করলে মুখ ঘুরিয়ে রাখলো জানালার গ্লাসে।
আরশির জেদ দেখে ওর অগোচরেই ঠোঁট টিপে হাসলো শেহজাদ। চোরাচোখে দেখে গেলো মুখ-ফুলিয়ে বসে থাকা আরশিকে। বরফে ঢাকা শহর দেখতে যেনো ভীষণ ব্যস্ত তার ঐ হরিণী চোখজোড়া।
তখনই গাড়ির স্টেরিও থেকে ভেসে আসলো পুরোনো দিনের একটি গান।
“Tumhein koi aur dekhe,
to jalta hai dil…
Badi mushkilon se phir,
sambhalta hai dil…
Kya kya jatan karte hain,
tumhein kya pata…
Yeh dil bekarar kitna,
Yeh hum nahi jaante…
Magar jee nahin sakte,
tumhare bina…!
Humein tumse pyaar kitna,
Yeh hum nahi jaante…
Magar jee nahin sakte,
tumhare bina…!”
কিশোর কুমারের এই গানটি আরশির প্রায় মুখস্থ। ছোটবেলায় বাবা-মায়ের সাথে বসে
কতবার যে শুনছে, তার ইয়ত্তা নেই।
কিন্তু আজ আবার সেই একই গান যেনো ভিন্ন ভাবে শুনলো ও। যেনো কোনো না বলা অনুভূতিরা মিশেছিল এই গানের প্রতিটি লাইনে।
তবে কি জাম্বুবানটা ইচ্ছে করে এই গানটা ছাড়লো? কিছু কি বোঝাতে চাইলো গানের মাধ্যমে ওকে?
গাঁট হয়ে বসে থাকা মেয়েটা এবার যেন নাজুক হলো। রিয়ারভিউ মিররে চোখ ফেলতেই ছলকে উঠলো ক্ষুদ্র শরীর।
শেহজাদ যে ওর দিকেই তাকিয়ে!
নীলাভ চোখজোড়ায় কি স্পষ্ট মাদকতা।
যেনো খেই হারিয়েছে তারা ঐ ছোট্ট মুখটার মায়ায়।
বসে থেকেই আইঢাই করে ওঠে আরশি। ইতিউতি দৃষ্টি ফেলে শিকারি চোখজোড়া এড়াতে। কিন্তু বিধিবাম! সেই নজর এড়ানোর ক্ষমতা কি আছে ঐ একরত্তি মেয়ের!
সময় গড়ালো। বরফের রাস্তা ভেঙে বাসায় এসে পৌঁছোতে পৌঁছতে প্রায় সন্ধ্যা। আজকেও রান্নার ঝামেলা নেই আরশির। শেহজাদ খাবার আনিয়েছে।
আজ একদিন যাবৎ একসাথেই টেবিলে বসে ডিনার করছে ওরা। ডিসট্যান্স মেইনটেইন করার বাতিকটা যে এইটুকু কমেছে লোকটার!
আরশি ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে বসেছে কেবল। পরনে শীতের হুডি আর ট্রাউজার। শেহজাদেরও তাই।
কিন্তু আজ আশ্চর্যজনকভাবে টেবিলে এসে বসতেই লোকটা বলে উঠলো,
“খাইয়ে দাও!”
মোটে ফ্রাইড রাইসের একচামচ মুখে তুলেছিল আরশি। অমনি সেটা ছিটকে বেরিয়ে এলো বিস্ময়ের তান্ডবে।
চোখ বড় বড় করে চাইলো সামনে থাকা মানুষটার দিকে। সে দিব্যি হাত গুটিয়ে বসে আছে আরশির খাইয়ে দেয়ার আশায়।
পানি খেয়ে গলবিলে আটকে থাকা খাবার নামালো মেয়েটা। তবে আজ তা আর হজম হবে কি না সন্দেহ!
অবিশ্বাসের ঢোক গিলে কোনোমতে শুধোলো,
“আ-আমি কেনো খাইয়ে দেবো? আপনার হাত নেই?”
শেহজাদের কন্ঠস্বর ততটাই নির্লিপ্ত। উত্তরে রয়েসয়ে বলল,
“দেখছোনা ডান হাতে ব্যান্ডেজ করা আমার?”
চোটপাটে কিছু বলতে গিয়েও ঠোঁট টিপলো আরশি। কথা তো মিথ্যে নয়। ওর জন্যই তো হাতের এই অবস্থা মানুষটার।
তবুও মিনমিনিয়ে বলল,
“কিন্তু গতকাল তো ঠিকই নিজে নিজে খেয়েছিলেন? তখন হাতে ব্যান্ডেজ ছিল না?
এবারেও শেহজাদের উত্তর সাবলীল।
“গতকাল ব্যান্ডেজ করা থাকলেও ব্যাথা ছিল না! আজ ব্যাথা বেড়েছে। তাই হাত দিয়ে খেতে পারবো না।
এবার নাও! তাড়াতাড়ি খাইয়ে দাও। নাকি এইটুকু কার্টেসি নেই তোমার মধ্যে? চোখের সামনে দেখছো যে ব্যাথায় হাত নাড়াতে পারছি না, তারপরও-”
নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৭
“আচ্ছা বেশ!”
মানুষটার কথা শেষ হলো না। তার আগেই গালে কৃষ্ণচূড়ারা উঁকি দিলো মেয়েটার।
সংশয় আর ভয়ে আটকে আসা কন্ঠে পুনশ্চঃ আওড়ালো,
“দি-দিচ্ছি খাইয়ে!”