পাতা বাহার পর্ব ২৬
বেলা শেখ
তপ্ত রৌদ্রোজ্জ্বল বিকেল। পশ্চিম দিগন্তে অরুণ হেলে পড়ছে। বিকেলে রোদের তীব্রতা কম থাকলেও তাপমাত্রা যেন আটত্রিশ ডিগ্রি সেন্ট্রিগেট। ভ্যাপসা গরমে নাজেহাল লোকালয়। সরকার বাড়িতে সকলেই ব্যস্ত সময় পার করছে। শান্ত শুনশান নীরবতায় ঘেরা বাড়িটা আজ হইহুল্লোড়ে মেতে আছে। বিয়ে বাড়ি মেহমানদের ভিড় অঢেল। মেহমান সহ বাড়ির সকলে বাড়ির বাইরে গার্ডেন এরিয়ায় অবস্থান করছে। বাচ্চারা দৌড়ঝাপ করতে করতে খেলছে। বয়স্করা বসে চায়ের কাপে সাংসারিক আলাপে ব্যস্ত। ইয়াং ছেলেমেয়েরা যান্ত্রিক ডিভাইস নিয়ে ব্যস্ত। ডেকোরেশনের লোকগুলো নিজেদের কাজে ব্যস্ত। বাইরে গার্ডেনে লাইটিং ও ডেকোরেটর এর কাজ চলছে।
তাদের মাঝে মাঝে ইন্সট্রাকশন দিচ্ছে অ্যাডভোকেট সরকার সাহেব । অরুণ দূরে একটা গাছের নিচে ব্রেঞ্চে বসে ল্যাপটপে মুখ গুঁজে অফিসের কিছু কাজে ব্যস্ত। দূরে বসার কারণ তার একেকটা হারামিখোর বন্ধু! সকালে এসেছে অবধি আজকের অনুষ্ঠান নিয়ে তার কানের পোকা বের করে ফেলেছে। বিকেলের হলুদ সন্ধ্যার অনুষ্ঠান না; হলুদ সন্ধ্যার পর রাতের ব্যাচেলর পার্টির অ্যারেঞ্জমেন্ট বিষায়ক আলাপ-সালাপ! অরুণ বলেছে; সব অ্যারেঞ্জমেন্ট হয়ে যাবে তোরা শুধু খেয়াল রাখবি আরিয়ানের কানে এসব কথা না পৌঁছায়। এর পরও ওই হারামীর দল নাছোড়বান্দা টাইপ আচরণ করছে। তাদের থেকে বাঁচতেই এখানে বসে!
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আশেপাশে বাচ্চারা দৌড়া দৌড়ি করছে অরুণ সেদিকেও খেয়াল রাখছে। ছেলেটা গরমে ঘেমে একাকার। তবুও ছোটাছুটিতে ব্যস্ত। ক্লান্তির ছিটেফোঁটাও নেই চেহারায়; বরং উজ্জ্বল মুখে সব বাচ্চাদের সাথে মিলে মিশে একাকার! এতো এতো খেলার সাথী রোজ রোজ মেলা ভার! আর পাতাবাহার তার পাশে তাকে ঘেঁষে বসে আছে। ছোট্ট মালিকের কাছেও গিয়েছিল। তার খেলার সাথী কোলে তুলে দু তিনবার ছুড়ে ফেলে। ব্যস! মহারাণী দৌড়ে তার কাছে চলে আসে। সে বিড়াল শাবকটির মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। বিড়ালটি আরেকটু ঘেঁষে বসে মিউ মিউ করে ডাকে। অরুণ তার কান টেনে বলে,
-” পাতাবাহার তুমি কি এক্সাইটেড তোমার নতুন সখির আগমনে? তার নামও পাতাবাহার। তোমার মতোই কিউট!”
বিড়াল শাবকটি মিউ মিউ করে ডাকে। অরুণ তার গাল চেপে বলে,
-” বুঝতে পারছি তুমি এক্সাইটেড!”
বলে নিজের কাজে মনোযোগ দেয়। তারাতাড়ি শেষ করলেই হলো। নইলে দেখা যাবে ওরা আবার হাজির হবে। বিয়ে উপলক্ষে তার সব বন্ধুদের আগমন। আরো অনেক আত্মীয় স্বজন। আসমা বেগমের বাবার বাড়ির লোকজন, আদুরির কিছু বান্ধবী, আরিয়ানের বন্ধুরা,রুবির বাবার বাড়ির দু একজন। আর ভোরের স্কুলের প্রিন্সিপাল সাবরিন সাবিনা ওরফে তার খালামনি! তার সাথে তার দুই নাতনি। আর মামা স্বাধীন চৌধুরী কাল আসবে বলেছে। শুধু তিনিই আসবেন অরুণ জানে।
কারণ তার একমাত্র মামার ছেলে মেয়ে ও স্ত্রীর সাথে অরুণের সম্পর্ক খানিকটা এলেবেলে! ছোটবেলায় বাবার সাথে মনোমালিন্যে রাগ করে মামার বাসায় থেকেছিল টানা একমাস। এতেই মামী ও মামাতো ভাই বোনের চোখের বালি হয়ে গিয়েছিল। মা হীন অরুণকে মামা একটু বেশিই আদর করতো। আপন ছেলে মেয়ের মতোই। তাই হয়তোবা! বাবার কথা আসতেই অরুণের তার কথা স্মরণে আসে। অনিক সরকার লোকটা গাম্ভীর্যে ভরপুর দায়িত্ববান কঠোর রগচটা জেদি লোক ছিলেন। অরুণের সাথে তার বাবার সম্পর্ক খুব সুবিধার ছিল না। মা হীন অরুণ বেপরোয়া, উচ্ছৃঙ্খল, জেদে টইটম্বুর ,বদমেজাজি ও মারকুটে স্বভাবের ছিল। অরুণের এমন শৃঙ্খল বিহীন জীবন নিয়ে অনিক সরকারের ঘোর বিরোধিতা ছিল। তিনি অরুণকে মানা করতেন!
অরুণ মাথা কাত করে সায় জানাতো। সায় জানানো অবধিই ঠিক; বাইরে বের হলেই যেই অরুণ, সেই অরুণই। অনিক সরকারের সাথে এ নিয়ে রাগে জেদে ফেটে পড়তেন। প্রহার করতে ভুলতেন না। অরুণ বাবার সাথে কখনো তর্কে জড়াতো না। সে জানে বাবা তাকে ভালোবাসে খুব। তার ভালো ভবিষ্যত চায় তাই চিন্তা করে। কিন্তু সে এভাবেই থাকতে ভালোবাসে। আজকের অরুণ সরকার আর এক যুগ আগের অরুণ সরকারের মাঝে ঢের ফারাক। আজকের অরুণ সরকার হওয়ার পেছনে বর্ষার হাত অনেক সেটা অস্বীকার করে না অরুণ। তার নিয়মহীন বিশৃঙ্খল জীবনে বর্ষা যেন রূপকথার সোনার কাঠি রুপোর কাঠি হয়ে ম্যাজিকের মতো জীবনকে পরিবর্তিত করে দিয়েছিল। তাকে ভরা নদী থেকে প্রণয়ের জোয়ারে ভাসিয়ে কিনারায় নিয়ে যাওয়া মানবী বর্ষা; আবার অথৈ সমুদ্রে ফেলে পালিয়ে যাওয়া মানবীও বর্ষা। সে তো বেঁচে আছে তার লাইফ বোট; তার কলিজার টানে!
বর্ষার সাথে তার প্রণয়ের সম্পর্ক বর্ষার ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই। তাদের প্রণয় কথা ভার্সিটির আনাচে কানাচে ছড়িয়ে। অরুণের ভার্সিটি লাইফ শেষ হওয়ার পরেই সে বাবাকে বর্ষার কথা জানায়। অনিক সরকার বিরোধীতা করে না। তিনি আগে থেকেই অবগত তার ছেলের পরিবর্তনের মুখ্য কারণ। তিনি সব মেনে নেন; তবে শর্ত দেন অরুণকে তার পারিবারিক ব্যবসায় বসতে হবে। অরুণের এতে আপত্তি ছিল না। সে কোন ক্লাস টপার ছিল না। কোনো মতে টেনে টুনে চালিয়ে লোকের মুখ বন্ধ রাখার মতো। কিন্তু বর্ষার এতে ঘোর আপত্তি। সে চাইতো অরুণ ব্যবসায় না বসে নিজ উদ্যোগে কিছু করুক। অরুণের বাবা বর্ষার বাসায় প্রস্তাব পাঠালে বর্ষা সময় চায়। অরুণ দেয় সময়; তার তাড়াহুড়ো নেই। কিন্তু এরই মাঝে অনিক সরকার পরলোকগমন করেন। এমন হৃদয় বিদারক সময় পেরিয়ে না যেতেই ব্যবসায় ধস! অরুণ নিজ হাতে ব্যবসার হাল ধরে। বছর খানিক বাদে বর্ষার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। সম্পর্কে ও ব্যবসায় ধাক্কা খেতে খেতে এখন সে আ সিঙ্গের ফাদার ও সফল বিজন্যাসম্যান। তার ভাবনাচ্ছেদ ঘটে ফোনের রিংটোনের আওয়াজে। অরুণ ফোন রিসিভ করে কানে ঠেকিয়ে তাচ্ছিল্যের স্বরে বলে,
-” টাইমিং দেখো! তোমার কথাই ভাবছিলাম!”
-” বাব্বাহ অরুণ সরকার এখনো আমাকে নিয়ে ভাবে!!”
বর্ষার কথায় অরুণ মৃদু হাসে। ল্যাপটপের সাটার অফ করে রিল্যাক্স হয়ে বসে।
-” অরুণ সরকার বেইমান ও স্বার্থপরদের কখনো ভোলে না!”
বর্ষা চুপ করে যায়। কিছু সময় পর শান্ত গলায় বলে,
-” শুনলাম বিয়ে করছো?”
-” না করার কথা ছিল নাকি?”
অরুণের ত্যারা কথায় বর্ষা বিরক্ত হয়ে বলে,
-” সেটা বলি নি। বিয়ে করছো ভালো কথা কনগ্রেটস! আমি বরুণের কথা ভাবছি। আমি বরুণকে নিতে..”
আরুণ তাকে থামিয়ে কড়া গলায় বলে,
-” আমার ছেলের কথা তোমাকে ভাবতে হবে না। আমার ছেলের জন্য আমি আছি। মার্ক মায় ওয়ার্ড আমি আছি আর আজীবন থাকবো!”
-” ভুলে যেওনা আমি বরুণের মা। আমারো অধিকার আছে ওর উপর। এখন তো জোড় গলায় বলছো আমি আছি; দুদিন পরে কচি নতুন বউ আসবে তাতেই মজে থাকবে। বাচ্চা কাচ্চা আসবে। তাদের ভিড়ে বরুণ..”
অরুণ হেসে তার কথা শেষ করার আগেই বলতে শুরু করে,
-” শোন জন্ম দিলেই মা হওয়া যায় না। তুমি মা কথাটার যোগ্যই না। এতটুকু কোলের বাচ্চাকে রেখে চলে গেলে একবার মায়া হলোনা। এখন এতো দরদ কোথা থেকে আসছে শুনি? আর হ্যা জোর গলাতেই বলবো আমার ছেলের জন্য আমি আছি; থাকবো। নিজের মতো স্বার্থপর ভেবো না আমায়। আমার কাছে সবার আগে আমার ছেলে।”
বর্ষা উচ্চ স্বরে হেসে বলে,
-” তোমার অতিরিক্ত রাগ জেদই তোমাকে বরুণের কাছ থেকে দূরে নিয়ে যাবে। ঠিক তোমার বাবার মতোই। আমিতো তোমার মধ্যে তোমার বাবার প্রতিচ্ছবিই দেখতে পাচ্ছি আর বরুণের মধ্যে তোমার।”
অরুণের চোয়াল শক্ত হয়। নিজেকে শান্ত রেখে শান্ত গলায় জবাব দেয়,
-” তোমাকে এসব নিয়ে ভাবতে হবে না। নিজের রাস্তা মাপো! তোমার হাসবেন্ড ভালো মনের মানুষ। মাঝপথে তার হাত ছেড়ে দিও না। লোভ খুবই ভয়ংকর জিনিস। আর ভুলেও কল করার চেষ্টা করবে না। গুড বায়!”
বলেই কল কাটতে নিলে বর্ষা বলে ওঠে,
-” কাটবে না। ভোরের সাথে কথা বলবো আমি! ওর কাছে দাও?”
অরুণের কপালে চিন্তার রেখা ফুটে ওঠে।
-” দেব না। তোমার এসব বস্তা পঁচা কথাবার্তা আমার ছেলের কানে না যায়।”
বর্ষা অনুনয়ের সুরে বলে,
-‘ আমি ওতটাও খারাপ না অরুণ। ওর কাছে দাও একটু কথা বলবো। প্লিজ?”
অরুণ ফোন কান থেকে সরায়। বাচ্চাদের দিকে খানিক এগিয়ে ভোরকে ডাকে। ভোর শুনতে পায় না হইহুল্লোড়ের মাঝে। অরুণ উঁচু গলায় ডাকে। বাচ্চারা ভয় পেয়ে কেটে পরে এলোমেলো দৌড়ে। ভোর গোমড়া মুখে বাবার সামনে কোমড়ে হাত দিয়ে ঝগরুটে ভঙ্গিতে বলে,
-” আব্বু একটু মিষ্টি করে ডাকতে পারো না? এমনিতে ভেনোমের মতো গলা তোমার তারপর এতো জোরে ডাকছো; আমার বন্ধুরা ভয় পেয়ে পালিয়ে গেলো।”
অরুণ হাল্কা হেসে ছেলেকে কোলে নিয়ে ব্রেঞ্চে বসিয়ে দেয়। তার পাশে বসে ফোনটা বাড়িয়ে বলে,
-” কথা বলো?”
ভোর কপাল কুঞ্চিত করে গাল ফুলিয়ে চায়।
-” কার সাথে?”
বলে ফোনটা কানে লাগিয়ে ‘হ্যালো’ বলতেই ওপাশ থেকে বর্ষা আদুরে গলায় বলে,
-” বরুণ সোনা? আমি তোমার মা; কেমন আছো?”
ভোরের মুখশ্রী উজ্জ্বল হয়। কুঞ্চিত কপাল শিথিল হয় ; ফুলো গালে হাসির রেখা বয়।
-‘ মা! আমি ভালো আছি; তুমি কেমন আছো?”
-” আমিও ভালো আছি! খেলছিলে তুমি? আমি ডিস্টার্ব করলাম?”
-” খেলছিলাম কিন্তু ডিস্টার্ব হয় নি মা। খুশি হয়েছি তুমি কল করেছো! জানো মা আব্বু আমার জন্য একটা কিউট আম্মু সারপ্রাইজ দিয়েছে। আম্মু খুউব ভালো। আমায় অনেক ভালোবাসে ও আদর করে। একটুও বকে না।”
অরুণের অধরকোণে হাসি ফুটে বর্ষার রিয়াকশন কল্পনা করে। মেয়ে মানুষ হিংসা বিদ্বেষ পোষণ করবে না তা হয় নাকি! প্রাক্তন হোক বা বর্তমান! তার সাথে জড়িয়ে অন্য কোন মেয়ের কথা শুনলেই জ্বলবে আর লুচির মতো ফুলবে। অরুণ পকেটে থেকে রুমাল বের করে ছেলের মুখশ্রীর ঘাম মুছে দেয়।
বর্ষার হাসি মুখ খানি মলিন হয়। তার নিজের ছেলে কি সুন্দর করে অনায়াসে অন্য একজনকে আম্মু ডাকছে!
-” তাই? আম্মুকে ভালো লেগেছে তোমার?”
-” খুউব! কালকে নিয়ে আসবো আম্মুকে। কাল থেকে আমাদের সাথেই থাকবে। আমি আম্মু আর আব্বু।”
বর্ষার বুকটা কেঁপে উঠলো কি?
-” ওহ্। তোমার আম্মুর সাথে পরিচয় করাবে না আমার?”
ভোর প্রবল উৎসাহের সাথে উত্তর দেয়,
-‘ অবশ্যই মা! তুমি আসো?”
অরুণের ভ্রুকুটি কুঞ্চিত হয়। বর্ষা মিছে অভিমানের সুরে বলে,
-” কিভাবে আসবো তুমি তো আমাকে ইনভাইট ই করো নি!”
ভোর জিভে কামড় দিয়ে বলে,
-” ইশ! একদম মনে ছিল না। এখন বলছি তো!”
-” না থাক আসবো না। তোমার আব্বুর ভালো লাগবে না আমি আসলে। তোমার নতুন আম্মু যদি রেগে যায়!”
ভোর ঘোর বিরোধিতা করে,
-” কেউ কিছু মনে করবে না। তুমি আসো না মা? আই মিস ইউ!”
বর্ষার মাতৃমনটা যেন কেমন ছটফট করে।
-” তোমার আব্বুর থেকে আগে পারমিশন তো নাও আমায় এলাও করবে কি না?”
ভোর হাসি মুখে বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,
-” আব্বু তুমি বলো না মাকে? তুমি বললে ঠিক আসবে। প্লিজ? প্লিজ আব্বু কলিজা?”
অরুণ শান্ত দৃষ্টিতে ছেলের দিকে চায়। কতটা মায়াময় নিষ্পাপ মুখশ্রী। সেদিনের ঘটনার পরও ভোরের ছোট্ট মনে একটুও দাগ কাটে নি? ভোর বসা থেকে উঠে বাবার গলা জড়িয়ে গালে চুমু খেয়ে অনুনয়ের সুরে বলে,
-” আব্বু কলিজা প্লিজ?”
এভাবে বললে মানা করা যায়? তার তো সাধ্য নেই;ছেলের হাসিমুখের আবদার ফেলতে পারে না। ফোন নিজের কানে ধরে বলে,
-” আসতে পারো। পরশু রিসেপশনে; সন্ধ্যার পরপরই!”
বলেই কেটে দেয়। ভোর খুশি হয়ে বাবার গালে আরো কয়েকটা চুমু খায়। অরুণ ফোন সরিয়ে ছেলেকে জড়িয়ে কোলে শুইয়ে দিল। গালে আলতো কামড় বসিয়ে বলে,
-” আদরের ব্লাকমেইল হুম? বাবাকে বশ করা শিখছো!”
ভোর খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে; হাসার দরূণ তার ছোট্ট শরীর দোদুল্যমানমান। অরুণ ছেলের পেটে মুখ ঘসে,
-” আমার দুষ্টু আব্বু! কবে বড় হবে? সব বুঝতে শিখবে?”
ভোর সুরসুরি পেয়ে কৈ মাছের ছটফট করে হাসতে হাসতে বলে,
-” আমি তো বড়ই। আর কিছুদিন পরে তোমার সমানও হয়ে যাবো দেখে নিও!”
-” না কলিজা তুমি এমন ছোট্ট টিই থেকো! বড় হলে তো বাবাকে ভুলে যাবে!”
ভোরের হাসি থেমে যায়। সোজা হয়ে বাবার চোখে চোখ রেখে শান্ত গলায় বড়দের মতো বলে,
-” ভোর কখনো তার আব্বুকে ভুলবে না দেখে নিও!”
অরুণের ঠোঁট হাসি বিস্তার হয়। ছেলের আদুরে মুখশ্রী আদরে ভরিয়ে তোলে। ভোর আবার হাসিতে মেতে ওঠে। ছোট্ট বিড়াল শাবক ল্যাপটপের উপর শুয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বাবা ছেলের ভালোবাসা দেখছে। তাকে তো ভুলেই বসেছে। সে কথা বলবে না বাবা ছেলের সাথে; মিও!
-” বাপ ছেলের হয়ে গেলে আমরা আমাদের কাজ করতে পারি?”
অরুণ ভোর সামনে তাকায়। শুভ, জীবন, ফয়সাল, মুস্তাকিম, দীপ্ত রাসেল দাঁড়িয়ে। সবার পরনে হাফ প্যান্ট ও হাতা কাটা গেঞ্জি। আর দীপ্ত ও রাসেলের হাতে বালতি ভরা পানি। মুস্তাকিম, ফয়সাল ও জীবনের হাতে কিছু আছে; তার থেকে লুকিয়ে রেখেছে। আর শুভ এগিয়ে এসে তার কোল থেকে ভোরকে এক প্রকার ছিনিয়েই নিল। অরুণ সন্দেহ দৃষ্টিতে তাদের দিকে চায়। শালাদের ভরসা নেই। সে উঠে পা চালায় কেটে পরার জন্য; কিন্তু পারে না। শুভ ভোরকে নামিয়ে দিয়ে অরুণকে পিছন থেকে জাপটে ধরে শক্ত করে। রাসেল মেজরের মতো করে বলে,
-” মিশন স্টার্ট!”
বলেই বালতির সকল পানি অরুণের মাথায় ঢেলে দেয়। আদুরি ক্যামেরা নিয়ে গাছের আড়াল থেকে বের হয়ে সাবাসী দেয়,
-” ওয়েল ডান। নেক্সট মিশন স্টার্ট করো ভাইয়ের বন্ধুগনস?”
অরুণ বাকহারা। এগুলো কোন জাতের গরু!
জীবন , মুস্তাকিম, দীপ্ত হলুদের বাটি সম্মুখে এনে হাতের মুঠোয় ভরে অরুণের গালে মুখে গলায় ভরিয়ে দেয়। গায়ের শার্ট টেনে ছিঁড়ে খুলে ফেলে। অনাবৃত সম্পূর্ণ জায়গায় হলুদ মেখে ভুত বানিয়ে দেয়। অরুণ ছটফট করতে থাকে।
-” কাজটা ঠিক করছিস না!”
ফয়সাল বলিষ্ঠ পেটে চিমটি কেটে বলে,
-” বেশি ভাব নিলে প্যান্ট খুলে ওইখানেও হলুদ লাগিয়ে দেব! চুপ থাক শা*লা!!
অরুণ চুপ করে যায়। হারামিদের ভরসা নেই। গার্ডেন ভর্তি মানুষের তোয়াক্কা করবে না। সকলে এখন এখানেই উপস্থিত। বুড়ো বুড়ো ছেলেদের বাচ্চামো কান্ড দেখছে। ভোর তো হেসে কুটিকুটি। বাবাকে ইয়োলো ভুত লাগছে।
জীবন হাসতে হাসতে বলে,
-“গায়ে হলুদ অথচ হলুদ ছুবি না তাই কখনো হয়! নে হলুদে গোসল করিয়ে দিলাম। আদু যাহ এবার কনের বাড়ি হলুদ তত্ত্ব নিয়ে। এদিকের হলুদ সম্পন্ন।”
আদুরি ক্যামেরা থেকে মুখ সরিয়ে বলে,
-” থ্যাংকস ভাই গনস!”
মুস্তাকিম ভ্রু নাচিয়ে দুষ্টুমির সুরে বলে,
-” অরুণের হলুদ বলে কি ও একা হলুদ মাখবে নাকি! সবার হক আছে!”
রাসেল খালি বালতি নিচে ফেলে ভোরের দিকে যেতে যেতে বলে,
-” ওর কলিজাকে আগে লাগানো যাক। তার কিউট মাম্মি আসবে বলে কথা!”
ভোর দৌড় লাগায় হাসতে হাসতে। রাসেলও বড় বড় পায়ে তার পিছু ছুটছে। অরুণ রাসেলের পিছনে যেতে যেতে সাবধান গীত গায়।
-” এই সমন্ধির বাচ্চা হারামখোর খবরদার আমার ছেলের গায়ে হলুদ লাগালে!”
শুভ জিভে কামড় দিয়ে বলে,
-” ছিঃ ছিঃ অরু ভাষা সংযত কর! এগুলো মুখে আনাও পাপ!”
-” হ্যা তোরা একেকটা সাধুর ওঁলাদ! রাসেল ভাইপার দেখ শুধু গালে ছুঁইয়ে দিবি। ওর এমনিতেই বারোমাস ঠান্ডা!”
মুস্তাকিম দৌড়ে ভোরকে ধরে একহাতে উঁচুতে তুলে গালে মুখে পুরো শরীরে হলুদ মাখিয়ে বলে,
-” হলুদ লাগালে গ্লো করবে। তখন তোর বিয়ের পিরিতেই ওর জন্য লাল টুকটুকে বউ খুঁজে বিয়ে পরিয়ে আনবো!”
ভোর তো হলুদে মাখামাখি; হাসতে হাসতে দম বন্ধ হবার যোগাড়। অরুণ এগিয়ে এসে মুস্তাকিমের হাত থেকে ভোরকে ছাড়িয়ে নিয়ে তার ব্যাকসাইডে লাত্থি মেরে বলে,
-” শালা সম্বন্ধির দল! তোদের সব কটাকে মেনহলের বিশুদ্ধ পানিতে চুবাব। ওয়েট কর!
ওদের বন্ধুদের খুনসুটি বাড়ির সকল মেহমান হাসিমুখে ইন্জয় করতে ব্যস্ত। মুস্তাকিম লাথি খেয়ে থেমে যায় নি। আদুরি, আরিয়ান, আনিকা ,আসমা বেগম, আভারি, মিনু সহ সবাইকেই হলুদে গোসল করিয়েছে।
হইহুল্লোড়ে পরিবেশ জমে ক্ষীর। বাড়ির ছাদে ভুল ভলিউমে হিন্দি গান বাজছে। ছোট থেকে বড় সব মেয়েরা হলুদ শাড়ি গায়ে জড়িয়ে কাঁচা ফুলে সজ্জিত হয়ে সম্পূর্ণ তৈরি। কেউ ছবি তুলছে তো কেউ আড্ডা দিচ্ছে। কেউ পাতার শশুড় বাড়ির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ডেকোরেশনের লোক থেকে শুরু করে গায়ে হলুদে সকলের শাড়ি, ফুল, মালা ও বাড়ি থেকে এসেছে। আরো বিভিন্ন তত্ত্ব ডালা এসেছে সেগুলোতে পাতার গায়ে হলুদের সাজসজ্জার জিনিসপত্র। সাথে বিয়ের বেনারসী,গয়না, লাগেজ ভর্তি আরো বিভিন্ন সরঞ্জাম ইত্যাদি ইত্যাদি। সবাই এসব তত্ত্ব দেখে বাকহারা। পাতার ভাগ্য প্রসন্নের কথা সকলের মুখে মুখে। সাথে পাতা ও পাতার শশুর বাড়ির গুনগান। পাতার পা যেন মাটিতে ফেলতে দিচ্ছে না।
পাতা অরুনের এসব কাজে যতটা না অবাক হয়েছে তার থেকে দ্বিগুণ অবাক সকলের হঠাৎ পরিবর্তনে। আগত আত্বীয় মেহমান কয়েকদিন আগেও তাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতো। তার থেকে দূরে দূরে থাকতো তারাই যেন আম্মু ছাড়া কথা বলছে না। এই মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে তো এই আদর করে মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে। লাবনী আক্তার, লুবমান ও লতা তো হা করে সকলের কর্মকান্ড দেখছে। পাতার বুঝতে অসুবিধা হয় না সকলের তাৎক্ষণিক পরিবর্তন। টাকা, সম্পদ, ক্ষমতা খুবই আজব জিনিস মানুষকে নিজের পিছনে ঘুরানোর মুখ্য বাহক। পাতা এখন চুপচাপ নিজের ঘরে বসে। পার্লার থেকে লোক পাঠিয়েছে নাক উঁচু ম্যানারলেস লোকটা।
পাতার হাসি পায় জীবনে পার্লারের ভিতরের চোপা খানি না দেখা মেয়েটাকে সাজাতে পুরো পার্লারের লোক এখানে উপস্থিত। কি সব ঘষামাজা করছে! পাতার বেশ লাগছে। সুন্দর একটা হলুদ জামদানি শাড়ি পড়ে আছে। শাড়িটা দেখতে বেশ সাথে দামিও। পাতার শাড়ির প্রতি আলাদা দূর্বলতা কাজ করে। সে একজন বাঙালি হিসেবে শাড়ি পড়তে খুব ভালোবাসে। তার তো ইচ্ছে করছে কিশোরী কন্যার মতো আঁচল উড়িয়ে নাচতে ছবি তুলতে। লতা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে পাতার দিকে তাকিয়ে আছে। ভারি মেকাপে পুরো চেহারার আদল বদলে দিয়েছে। পাতা লতাকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলে,
-” ওভাবে কি দেখছো?”
লতা মাথা নাড়িয়ে বলে,
-” কিছু না।তোর জামাই বাড়ি থেকে লোকজন এসেছে। জলদি কর?”
পার্লার থেকে আগত মেয়েটি মিষ্টি হেসে বলে,
-” হয়ে গেছে ম্যাম। নিয়ে যেতে পারেন।”
পাতা দাঁড়িয়ে আয়নায় নিজেকে দেখে। পাতা অবাক হয় এতো পুরো চেহারাটাই পাল্টে দিয়েছে। সে লতাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-” কে কে এলো? ভোর এসেছে কি?”
-” দেখলাম না তো। খালা শাশুড়ি এসেছে। তোর সাথে কথা বলতে চায়!”
বলার সাথে সাথেই একটা মধ্যবয়স্ক নারীর আগমন ঘটে ঘরে। ঘিয়ে রঙের শাড়ি পড়ে। চেহারা ও সাজসজ্জায় আভিজাত্যের ছাপ। পাতা সালাম দেয় তড়িঘড়ি করে,
-” আসসালামুয়ালাইকুম ম্যাম! কেমন আছেন?”
সাবরিনা সাবিনা হেসে পাতার সম্মুখে দাঁড়ায়। থুতনিতে হাত রেখে মাশাআল্লাহ আওড়ায়। পাতার আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে বলে,
-” মিষ্টি লাগছে। শোন আমি এখন প্রিন্সিপাল নই তোমার। খালামনি বলে ডাকবে। অরুণের আপন খালা আমি! বুঝলে?”
পাতা অবাক হয়। শুনেছে প্রিন্সিপাল ম্যামের চেনাজানা লোক অরুণ সরকার। কিন্তু ডিরেক্ট খালা? সেদিন অফিস রুমে তো ম্যাম বলেই ডাকলো। পাতা ভাবনা বাদ দিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানায়। লতা চেয়ার টেনে বসতে বলে তাকে। সাবরিনা সাবিনা অসম্মতি জানিয়ে বলে,
-” বসবো না। পাতার সাথে কিছু কথা আছে আমার। তোমরা একটু বাইরে যাও দয়া করে। আর দরজাটা লাগাতে ভুলবে না।”
লতা সম্মতি জানিয়ে চলে যায়। পার্লারের মেয়েরা নিজেদের সরঞ্জামসহ বিদায় হয়।সাবরিনা পাতার ঘরে বিছানায় বসে পাতা ঢোক গিলে। কি বলবেন উনি? বকাঝকা করবেন? সাবরিনা হেসে বলে,
-” ভয় পাচ্ছো কেন? আমি বাঘ ভাল্লুক নাকি! এদিকে এসো?”
পাতা এগিয়ে যায়। সাবরিনা পার্স থেকে একটা কিছু টাকা বের করে পাতার হাতে ধরিয়ে বলল,
-” কোনো বাহানা না; ভাগ্নে বউয়ের মুখ খালি হাতে কিভাবে দেখি! মানা করলে বকবো কিন্তু?”
পাতা আর না করার সুযোগ পায় না। টাকা গুলো হাতের মুঠোয় নেয়। অনেক গুলো টাকা! শুধু কচকচে হাজার টাকার নোট! সাবরিনা পাতার হাত মুঠোয় ভরে বলে,
-” কিছু কথা বলবো! মনোযোগ দিয়ে শুনো!”
পাতার কপাল কুঞ্চিত হয়। কি বলবেন উনি? সাবরিনা বেগম মলিন হেসে বলে,
-” তুমি জানোই হয়তো যে অরুণের মা বেঁচে নেই। ভোরের থেকে আরেকটু টান ছিল তখন মারা যায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে।আমার বোন; অরুণের আসল মা নাম ভাবনা। অরুণ মা পাগল ছেলে ছিল। বাবার সাথে ছোট থেকেই বনে না। মা মারা যাবার পর ভেঙে পরে। ওর বাবা অনিক সরকার ওর কথা ভেবে ওর থেকে অনুমতি নিয়েই আরেকটা বিয়ে করে। তোমার বর্তমান শাশুড়ি আসমা বেগমকে। আসমা বেগম ভালো মেয়ে ছিল। অরুণকে ভালোবাসাতো সাধ্যমতো। আমরা সেটাই জানতাম। একদিন বিকেলে সরকার বাড়ি গিয়েছিলাম। অরুণ ছিল না।বাবার সাথে কোথাও গিয়েছিল। তো আমি অরুণের ঘরে যাই। টুকটাক জিনিস দেখতে দেখতে একটা ডাইরি নজরে আসে। কৌতূহল বসত খুলে দেখি। কিছু লেখা ছিল না; তবে লাস্ট পাতায় ভাঙ্গা ভাঙ্গা অক্ষরে লেখা ছিল!
~ ছোটমা ভালো! আমাকে ভালোও বাসে। তবে আব্বুর সামনে বেশি ভালোবাসে; আদর করে। আব্বু না থাকলে কম কম ভালোবাসে।•
কথাগুলো পড়ে আমি স্থির থাকতে পারি না। ডাইরিটা রেখে আসমার কাছে গিয়ে অনেক কথা শুনায়। আসমা অবশ্য কিছু বলে না।আমি তার চরিত্র নিয়েও কথা শোনাই! আমি রেগে চিল্লিয়ে চলে যাই। অনিক সরকারকে কল করেও অনেক কথা বলি। ছেলেকে যেহেতু পালতে পারবেন না; আমাদের কাছে দিয়ে দিন! আর আপনি নতুন বউ নিয়ে চুটিয়ে সংসার করুণ। আমার বোনের ছেলেকে আমরা মানুষ করতে পারবো। কিন্তু সেটা হয় না। আসমা অনিক সরকারকে সব জানায়।
অনিক সরকার পরদিন সকালে অরুণকে জিজ্ঞেস করে,
-” তোমার ছোটমা তোমাকে ভালোবাসে না?”
অরুণ হাসিমুখে জবাব দেয়,
-” বাসে তো বাবা!”
অনিক শক্ত গলায় অরুণকে বলে,
-” তাহলে সাবিনার কাছে কি বলেছো? আসমা তোমাকে ভালোবেসে না, বকে, কখনো কখনো মারেও? বাইরের মানুষ এসে আসমাকে কটুক্তি করে অপমান করে চলে যায়! কথা বলছো না কেন?”
ছোট্ট অরুণ কেঁপে ওঠে। সে তো বলে নি এসব। বাবা কি সব বলছে?
-” কথা বলছো না কেন? স্পিক আউট?”
চিল্লিয়ে বলে অনিক সরকার। অরুণ ভয়ে দৌড়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজা লাগায়। বাবা চলে গেলে টেলিফোন দিয়ে খালামুনিকে কল করে জানায়, ছোটমাকে কি বলেছে! সাবরিনা অরুণকে ডাইরির কথা বলে বলে,
-” তুমি আমাকে আগে কেন বলো নি অরুণ?”
-” তুমি কোন সাহসে আমার ডায়রিতে হাত দিয়েছো? আমি কোথায় লিখেছি যে ছোটমা আমায় বকে মারে? হ্যা কথা বলো? সবাই আমাকে মিথ্যে বাদি ভাবছে! তুমি আর আমার সাথে কথা বলবে না! তুমি আমার খালামুনি নও!”
বলে কল কেটে দেয়। পুনরায় ফোন আসলেও ধরে না। চুপিচুপি কিচেন থেকে দিয়শলাই এনে ডায়টিটা পুরিয়ে ফেলে। আসমা বেগমের গলা জড়িয়ে ক্ষমা চায়। রাতে বাবা ফিরলে তার কাছেও ক্ষমা চায়। অনিক সরকার ধমকে বলে,
-” তার মানে তুমি সব স্বীকার করছো! কি হয়েছে মিথ্যে কথা বলে? তোমার জন্য আসমা কতটা অপমানিত হয়েছে?”
অরুণ মাথা নিচু করে বলে,
-” স্যরি বাবা আর হবে না!”
অনিক সরকার থামে না।
-” স্যরি বললে তো হবে না। আজ থেকে নানা বাড়ির সকলের সাথে যোগাযোগ বন্ধ তোমার। খবরদার তাদের সাথে কথা বললে হাড্ডি একটাও আস্ত রাখবো না।”
ছোট্ট অরুণ গম্ভীর গলায় বলেছিল,
-” খালামুনির সাথে কথা বলবো না। তবে মামু নানুর সাথে কথা বলবো আমি! তোমার সব কথা শুনবো না!”
অনিক রেগে থাপ্পড় লাগায়। আসমা বেগম আটকায় তাকে। অরুণ প্রথমবারের মতো বাবার উপর চেঁচিয়ে ওঠে। ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বলে,
-” একদম মারবে না। তুমি সবসময় বকো আর মারো! থাকবো না তোমার কাছে।”
বলে ঘরে চলে যায়। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পরে। ঘুমে অচেতন অরুণ জানে না তার বাবা তাকে কোলে নিয়ে সারাটারাত চোখের জল ফেলেছে। আসমা বেগম কাঁদতে কাঁদতে তার কাছে সাবরিনার সব কথা জানায়। আবার সাবরিনাও কল করে কত কথা শোনালো! সব মিলিয়ে রেগে ছিল। অরুণ দোষ স্বীকার করায় ক্ষেপে যায়। রাগ সামলাতে পারে না। সকাল হলে বাবা অফিস চলে গেলে অরুণ ব্যাগ পত্র গুছিয়ে ড্রাইভারের সাথে চলে যায় মামার বাড়ি। অনিক সরকার আনতে গিয়েছিল বেশ কয়েকবার। জেদি বাপের জেদি ছেলে আসে নি।
নানু ,মামুর ভালোবাসায় সে বাড়িতে থাকতে চাইলেও মামী ও মামাতো ভাইবোনের কটাক্ষে একমাস পর ব্যাগ পত্র নিয়ে একাই চলে আসে বাড়ি। আসমা বেগম তাকে জড়িয়ে অনেক কাঁদে, আদর করে। অনিকও আর কিছু প্রশ্ন করে না , বুকে জড়িয়ে নেয় ছেলেকে। জেদি ছেলে ফিরে এসেছেন এই অনেক! তবে এরপর থেকে যেন অন্য অরুণ সরকার জন্ম নেয়; উশৃঙ্খল, মারকুটে, ভবঘুরে! কারো কথাই শুনতো না। সাবরিনার সাথে আর কথা বলতো না। অনিক ভালো স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলে সেখানে যায় না। পারার কিছু বন্ধু বান্ধবদের সাথে ঘুরতো ফিরতো। তাদের স্কুলেই ভর্তি হবে জানায়। অনিক ভর্তি করিয়ে দেয়। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর কিভাবে যেন ঢাবিতে চান্স পায়। শুধু ও না ওর সকল বন্ধুরাও! এখন কিভাবে আল্লাহ তায়ালাই জানে। সেখানে অনেক পরিবর্তন হয়েছে অরুণ সরকার।
সাবরিনা সাবিনা বর্ষার কথা বলে না পাতাকে। পাতার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
-” ছেলেটা এখনো ভালোভাবে কথা বলে না। ম্যাম বলে ডাকে আমাকে। আমি আমার ভুল বুঝতে পারি। আসমা, অনিক সরকারের থেকেও ক্ষমা চাই। ওরা ক্ষমা করে দিলেও অরুণ এখনো সেটা মনে পুষে
রেখেছে। ও এমনিই। কারো কথায় বা আচরণে কষ্ট পেলে বুঝতে দেবে না। আস্তে আস্তে নিজেকে গুটিয়ে নিবে। ছেলেটা অনেক সহ্য করেছে; নিজেকে খোলসে আবৃত করে নিয়েছে। বর্ষার সাথে ডিভোর্স হওয়ার পর আমি ভেবেছিলাম ছেলেটা শেষ; কিন্তু না ও শক্ত ছিল।
ছেলেকে বুকে জড়িয়ে হাসিখুশি জীবন যুদ্ধে জয়ী হয়ে নিজেকে সামলিয়ে নিয়েছে। তোমাকে এসব বলছি কেন আমি নিজেও জানি না। শোন তোমার সাথে অরুণ সরকারের জীবনটা জড়িয়ে গেছে। অরুণ খুব শক্ত ধাঁচের। ওর ছেলে ওর প্রাণভোমরা। তোমাদের বিয়েটা কেমন পরিস্থিতিতে হয়েছে আমি জানি না! তবে এটা বলবো অরুণ সরকারের হৃদয়ের দোরগোড়ায় যেতে হলে ভোর নামক চাবিকাঠির প্রয়োজন। তুমি ভোরকে ভালোবাসবে আদরে রাখবে; দেখবে অরুণ সরকার তোমায় মাথায় রাখবে। কথাটা স্বার্থপরের মতো শোনালেও সত্যিই। স্বার্থ ছাড়া দুনিয়া চলে না। তুমি ওকে আর ওর কলিজাটাকে আগলে রেখ কেমন?”
পাতা বাহার পর্ব ২৫(২)
পাতা সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে। অরুণ সরকারকে সেভাবে না চিনলেও এখন ম্য্যমের কথাগুলো শুনে তার সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারনা পেয়েছে। সে তাকে আস্থার সুরে বলে,
-” আমি মাথায় থাকতে চাই না ম্যাম! আমি ওই হৃৎকুঠিরেই নিজের বাসস্থান তৈরি করতে চাই।আর অরুণ সরকার গোটা লোকটাই যেহেতু আমার! তার সাথে জুড়ে সকল কিছুও আমার। তার সুখ, দুঃখ, রাগ, জেদ এমনকি ভোর নামক কলিজা; সব। আপনি শুধু দোয়া করবেন!”