পাতা বাহার পর্ব ২৯
বেলা শেখ
প্রত্যুষের আবরণ ছেয়ে, বসুধায় যামিনীর অন্ধকারের আগমন। দ্যুলোকে বসবাসকারী শশধরের পূর্ণ আলোয় বসুধা ঝলমলিয়ে। সেথায় মেঘমালার অনুপস্থিতিতে তারকারাজির মিটমিট হাসি উপভোগ্য। গাছের পাতার নৃত্যের ছন্দপতনে স্নিগ্ধ পবনের আলতো গা ছুয়ে যাওয়া যেন তনুমন জুড়ালো। কৃত্রিম ক্ষণপ্রভার আলোকে আলোকিত অটবি। কাননে কুসুমকলি প্রসূণ শোভায় শোভিত। সেথা হতে মৃদু ঘ্রাণ নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করছে বিনা অনুমতিতে। ব্যস্ত লোকালয় সেই ঘ্রাণ উপেক্ষিত করে আপনাতে মজে। কৃত্রিম বাদ্যযন্ত্রের তান তাদের মন টানছে ।
সেই তানে অটবিতে বসবারত বিহঙ্গ দলের আরাম বিঘ্নিত। প্রত্যুষেই বিহঙ্গের জোট আপন নীড়ে ফিরে। নিত্যদিনের শান্তি পরিবেশ ভঙ্গ হওয়ায় তাদের নিদ্রায় বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে। মা বাবুই নিচের হৈ হুল্লোড় কৃত্রিম বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ হতে ছোট বাচ্চাদের আগলে রেখেছে ডানা মেলে। অন্যান্য বিহঙ্গের দলও নিজের আপন নীড়ে ঘাপটি মেরে আছে।
ড্রেসিন টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আয়নার দিকে বেশ খানিকটা এগিয়ে আঁখি বড় বড় করে কাজল পড়ছে নববধূ। কাজল লাগালেই তার সাজ সজ্জা সম্পূর্ণ হবে। কাজল বিনা কোনো রমনীর সাজ আদৌও সম্পূর্ণ হয়? কাজল লাগিয়ে নববধূয়া ঘুরে দাঁড়ায়। মাথায় ঘোমটা টেনে নিয়ে বিছানায় বসে থাকা ছোট শিশুটাকে ইশারায় সুধায় কেমন লাগছে? বাচ্চাটি নিত্যসময়ের মতো মিষ্টি হেসে অধরকোণের হাসি ও ছোট হস্ত যুগল প্রসারিত করে বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-” এতো এতো মিষ্টি লাগছে আম্মু! পুরাই কুইন!!”
পাতা মুচকি হাসে প্রশংসায়। এগিয়ে ভোরের সামনে দাঁড়ায়। কৃত্রিম রাঙা অধরজোরা ললাটে ছোঁয়ায়। ভোরের গাল টেনে বলে,
-” আমার সোনা ছেলে!”
বলেই খিলখিলিয়ে হেসে দেয়। সাথে যোগ দেয় ভোর! তাদের হাসির ছন্দপতনে পুরো রুম মুখরিত। তন্মধ্যে রুমে প্রবেশ করে অরুণ সরকার। নববধূয়া ও প্রাণ ভোমরার প্রাণোচ্ছ্বল হাসি দেখে মনটা প্রফুল্লচন্দ্রে ছেয়ে যায়। মনে মনে উপর ওয়ালার কাছে ফরমাইশ জারি করে যেন, তার তিমিরাচ্ছন্ন ঘরে যেন সর্বক্ষণ এভাবেই আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ে। অরুণ পকেট থেকে ফোনটা বের করে কিছু স্মৃতি লুকিয়ে রাখার প্রয়াসে। অরুণকে দেখে পাতা ও ভোরের হাসির ফোয়ারা থেমে যায়। রাগি শিক্ষককে দেখে ক্লাসের দুষ্টু ছেলে মেয়ে যেমন চুপটি করে ভদ্র চোখে চায় তেমনি দুজন অরুণের দিকে চেয়ে। অরুণ চোখ ছোট ছোট করে চায় তাদের দিকে। ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-” হোয়াট হ্যাপেন্ড? হাসি থামালে কেন? ভালোই লাগছিলো দুজনের হাসিমাখা মুখশ্রী।”
ভোর ‘আব্বু’ বলে কাছে ডাকে। পাতা সরে দাঁড়ায়। আঁখি জোড়া তার অরুণের দিকে নিবদ্ধ। সাদা কালো ফর্মাল ড্রেসআপ। মনে হচ্ছে অফিসে যাবেন! কিন্তু দেখতে মন্দ লাগছে না। ক্রাশ ট্রাশ খাওয়াই যায় নাক উঁচু ম্যানারলেস লোকটার উপর। অরুণ এগিয়ে এসে ছেলেকে কোলে তুলে সারা মুখশ্রী জুড়ে আদরের ফোয়ারা বইয়ে দেয়। আদর পাগল ভোর আদর পেয়ে খুব খুশি! আদর ফিরিয়ে দিতেও ভুলে না। পাতা দুজনের মধ্যে দর্শক আয়ন। হঠাৎ ভোর বলে ওঠে,
-” আব্বু দেখ আম্মুকে কত্তো মিষ্টি লাগছে! সো মাচ প্রিটি!”
অরুণ পাতার দিকে চায়। আপাদমস্তক ভালোভাবে দেখে নেয়। অরুণের তীক্ষ্ণ নজরে পাতা জড়সড় হয়ে দাঁড়ায়। অরুণ তা দেখে মনে মনে হাসে। মেয়েটা রিসেপশনের জন্য চ্যুস করা লেহেঙ্গা পড়ে নি, পার্লার থেকে আগত মেয়েদেরকেও ভাগিয়ে দিয়েছে। নিজে নিজেই তৈরি হয়েছে। হালকা পিঙ্ক কালারের উপর গাড় পিঙ্ক কালারের কারুকাজ করা জামদানী শাড়ি, কুচি দিয়ে পড়েছে। মুখাবয়বে ফেস পাউডার দিয়েছে হয়তোবা, সেরকমই ঘ্রাণ আসছে। চোখে চিকন কাজল, আইলাইনার, আই স্যাডো! মাথায় ছোট্ট স্বর্ণের টিকলি! কানে নাকে আগের গয়নাই রয়েছে। গলায় ভারী সীতাহার! হাতে চিকন বালার সাথে আরো দুটো করে মোটা স্বর্ণের বালা। মোট মিলিয়ে পুরো বাঙালি নববধূ; শুধু শাড়িটা বাঙালি ভাবে পড়েনি! সে যাই হোক! দেখতে সত্যিই অসাধারণ লাগছে! ভোর সত্যিই ক্যাচ করতে পেরেছে, মিষ্টি লাগছে।অরুণ মনে মনে কয়েকবার ‘মাশাআল্লাহ আওড়ায়। তারপর পাতাকে বলে,
-” লেহেঙ্গা পড়ো নি কেন?”
পাতা অরুণের গম্ভীর মুখের তীক্ষ্ণ শাকুনি দৃষ্টিতে কাঁচুমাচু করলেও অরুণের কথায় স্বাভাবিক হয়ে বলে,
-” ওসব লেহেঙ্গা টেহেঙ্গা আমার ভালো লাগে না। কতো ভারি আল্লাহ! আমার জন্য শাড়িই ঠিক আছে! আপনি কিন্তু একদম বকতে পারবেন না?”
অরুণ পাতার নাক টিপে এক হাতে তার গাল টেনে বলে,
-” আচ্ছা বকলাম না। শাড়িতেই মাশাআল্লাহ দারুণ লাগছে। আমাকে আগে জানালে ভালো কোনো গর্জিয়াস শাড়ি অর্ডার করতাম! এখন এই লেহেঙ্গার কি হবে?”
পাতা গালে হাত রাখে। এ লোক এমন কেন? সে কি ছোট্ট বাচ্চাটি নাকি যে নাক টিপে, গাল টিপে? তবে লোকটা তাঁর প্রশংসা করছে এতেই যেন বেহায়া মনটা বাক বাকুম করছে।
-” এই শাড়িটাও বেশ সুন্দর! ভোর পছন্দ করে দিল যে! আর ছেলে বড় হচ্ছে, কয়েকদিন পর বিয়ে করাতে হবে তাই না? লেহেঙ্গাটা ছেলের বউয়ের জন্য রাখলাম, তাকেই দিবো! আর কোনো কথা?”
অরুণ খানিক চকিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। ভোরের কপোল জোড়া লালিমায় ছেয়ে যায়। বাবার কাঁধে মুখ লুকায়। অরুণ একহাতে ছেলের মাথার চুল ঠিক করে বলে,
-” এখন চল! সবাই ওয়েট করছে আমাদের জন্য! তোমার বাড়ির লোক কতদূর পৌঁছালো?”
-” আসছে, রাস্তায়।জ্যামে পড়েছিল তাই দেড়ি হচ্ছে।”
-“ওহ্!”
বলেই পা বাড়াতে নিলে ভোর মন খারাপের সুরে বলে,
-‘ আব্বু পাতাবাহারকেও নিয়ে যাই না সাথে? ও ভয় পাবে তো একা একা!”
অরুণ ছেলের গালে আদর করে বলে,
-” খাঁচায় এতো এতো খাবার দিয়েছি। পাতাবাহার পেটপুরে খেয়ে আনন্দে ঘুমিয়ে পড়বে দেখে নিও!”
ভোর মাথা নাড়ায়। অরুণ হাঁটা দেয়, দরজা অবধি গিয়ে পিছন ফিরে বলে,
-” তোমাকে কি নতুন করে আমন্ত্রণ পাঠাতে হবে?”
পাতা শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কিছুপল। তারপর কুঁচি গুলো ধরে বড় বড় পা ফেলে অরুণের কাছে গিয়ে তার বাহু এক হাতে পেঁচিয়ে ধরে বলে,
-” চলুন?”
অরুণ বাহু আকরে ধরা পাতার হাতের দিকে চায় গম্ভীর মুখে। পাতা হাতটা সরিয়ে নিয়ে একাই সম্মুখে হাঁটা দেয় হনহনিয়ে। ওভাবে তাকানোর কি দরকার? সরাসরি বললেই হয় হাত ধরবে না।
রিসেপশন পার্টির পরিবেশ রমরমা। গার্ডেন এরিয়ার সম্পূর্ণ জায়গা জুড়েই বিভিন্ন গাছের সমাহার। একটু ফাকা জায়গায় ফুলে সজ্জিত ঢালু স্টেজ তৈরি করা হয়েছে। অনেকটা ফেয়ারওয়েলের মতো করে। আর গাছ গাছালি গুলোতে রঙ বেরঙের লাইটিং করে লাভ শেপের বেলুনে সজ্জিত করা হয়েছে। অরুণ রিসেপশনের জন্য হলরুম বুক করতে চেয়েছিল কিন্তু বাধ সাধে আরিয়ান। নিজের এতো বড় বাড়ি ও বাড়ির গার্ডেন এরিয়া থাকতে হলরুম কেন প্রয়োজন? প্রাকৃতিক পরিবেশের সহিত তাল রেখে এই সবুজে ঘেরা গাছ গাছালির ভিড়েই সব আয়োজন করা হবে। এবং এর দায়িত্বও নিজে কাঁধে তুলে নেয়। বিশাল আঙিনার একাংশ জুড়ে ডেকরেটরের সাহায্যে সুন্দর ভাবে সজ্জিত করেছে। আগত মেহমান ডেকরেশনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ! গাছ গাছালির ছায়ায় পরিবেশ শীতল ও স্বস্তিদায়ক, মাথা উঁচিয়ে চাইলে গাছের পাতার ফাঁক ফোকরে চাঁদ মামার উঁকি ও তারকারাজির মিটমিট হাসি! সব মিলিয়ে অনন্য দৃশ্যবলি। আগত মেহমান পরিবেশটা বেশ এঞ্জয় করছে।
স্বাধীন চৌধুরী ও সাবরিনা সাবিনা একসাথে দাঁড়িয়ে আলাপচারিতায় মগ্ন। অরুণের খালা সাবিনা গায়ে হলুদের দিন শুধু পাতাদের বাড়িতে গিয়েছিল। তারপর আজকের রিসেপশনে। বিয়ের দিনও তিনি ছিলেন না। অরুণের অফিস থেকেও অনেক লোক এসেছে রিসেপশনে। তন্মধ্যে অর্পনা, লাবিব, সুজন, মিসেস রুনা ও তার ছোট ছেলে উল্লেখযোগ্য। আরো অনেক চেনাজানা আত্মীয় স্বজনদের উপস্থিতি। আদুরি প্রিয়কে নিজের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। প্রিয় মেয়েটাকে তার দারুণ লেগেছে।
আরিয়ান ডেকরেটরের লোকদের ও সব স্টাফদের কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছে। রুবি ছেলেকে কোলে নিয়ে তার ভাই ভাবী ও মায়ের সাথে কথায় ব্যস্ত! আসমা বেগম তার বোন ও কিছু প্রতিবেশিদের সাথে আড্ডা মেতেছে। ছোট্ট আনিকা বাচ্চাদের সাথে খেলতে ব্যস্ত। অরুণের সব বন্ধুদের দল মিনুকে ঘিরে দাঁড়িয়ে এটা ওটা বলছে। আভারি একটু দূরত্বে দাঁড়িয়ে বউয়ের পিছনে ঘুর ঘুর করা মৌমাছির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছে। স্যারের সব বাদর বন্ধুগুলো নিজেদের বউ বাচ্চা রেখে তার বউয়ের পিছনে পরে। মুস্তাকিম গার্ডেন থেকে গোটা কয়েক গোলাপ ছিঁড়ে এনে মিনুর দিকে বাড়িয়ে বলে,
-” ওহে ভূবনময়ী শ্যামসুন্দরী! ফুলের জন্য এই ভুলের তরফ থেকে ফুল নিবেদন। কৃপা করিয়া আপনার ওই খোঁপায় গুঁজে ফুল গুলোকে ধন্য করুণ?”
অরুণের বাকি সব বন্ধুগুলো স্বমস্বরে ‘ওহ্ হো’ বলে বাহবা দেয়। মিনু লজ্জায় আঁচলে মুখ লুকায়। এই স্যারের বন্ধুরাও না!! দূর থেকে আভারি ফোঁস ফোঁস করছে। নিক ওই ফুল গুলো আজ , তারপর শ্যামসুন্দরীর হচ্ছে! জীবন হাসি মুখে বলে,
-” আরে মিনু ! কি ভাবছো? নিয়ে নাও! লাল শাড়িতে অসম্ভব সুন্দর লাগছে! একদম আগুন সুন্দরী। খালি খোঁপাটায় এই গোলাপ গুজে নিলে সোনায় সোহাগা! আজকের পার্টির গ্ল্যামার আমাদের মিনু!”
মিনু পারে না লজ্জায় আইস্ক্রিমের মতো গলে জমিনে গলে পড়ে। রেডি হওয়ার পর আভারিও দুটো গোলাপ এনে দিয়েছিল খোঁপায় পড়ার জন্য।সে মানা করে দিয়েছে! এই বয়সে খোঁপায় ফুল!! ইয়া আল্লাহ্! সে না না করে বলে,
-” আরে আরে পাগল নাকি তোমরা! বুড়ো বয়সে কি সব! আমি যাচ্ছি!”
বলে পা বাড়াতে নিলে ফয়সাল দু হাত মেলে সামনে দাঁড়িয়ে আটকায়। মুস্তাকিম দুটো ফুল খোঁপায় গুঁজে দেয়। শুভ ভদ্র ছেলের মতো বলে,
-” এখন লাগছে না পার্ফেক্ট!”
রাসেল শুভর পিঠ চাপড়ে বলে,
-” ঠিক বলছিস! সিঙ্গেল থাকলে একটা চান্স নেয়া যেতো! এখন কি আর করার বউ সাথে দুইটা টেও টেও!”
দীপ্ত ঠোঁটে হাত রেখে হেসে আভারির দিকে ইশারা করে বলে,
-” ওফ যা ভাই!! টাইম বোম্ব ফুটলো বলে। সাবধান হয়ে যা। হাতে ওটা কি দেখতে পাচ্ছিস!”
সবাই হাসিমুখে আভারির দিকে চায়। এদিকেই আসছে সে, হাতে স্ক্রুড্রাইভার। সবার হাসিমুখে আঁধার নামে। সিনা টান করে দাঁড়ায়। আভারি থমথমে মুখে এগিয়ে আসছে। মিনুও খানিকটা ঘাবড়ে যায়। ওভাবে আসছে কেন? আভারির থামার নাম নেই থমথমে গম্ভীর মুখে বড় বড় পা ফেলে আসছে স্ক্রুড্রাইভার শক্ত করে হাতের মুঠোয় পুরে। জীবন ঢোক গিলে রোবটের মতো করে গটগট করে কেটে পড়ে।
রাসেল টাইয়ের নট ঠিক করতে করতে অন্য দিকে চলে যায়। দীপ্তও সুযোগ বুঝে কেটে পড়ে। বাকি শুভ ও মুস্তাকিম ! মুস্তাকিম চোখ বড় বড় চেয়ে। তাকে না এই ক্ষ্যাপা আভারি মায়ের ভোগে পাঠিয়ে দেয়। আভারি হন হন করে শুভ ও মুস্তাকিমের মাঝখান দিয়ে চলে যায়। যাওয়ার সময় মুস্তাকিমের সাথে ধাক্কা লাগে খানিকটা। আভারি পা থামায় না। আরিয়ান তাকে স্ক্রুড্রাইভার নিয়ে যেতে বলেছিল। যাওয়ার পথেই এসব রঙ তামাশা দেখতে পায়। বদমাইশগুলো স্যারের বন্ধু না হলে দেখে নিতো। আর মগার বিটি মিনুকে দেখে নেবে।
আভারি চলে যেতেই শুভ ও মুস্তাকিম হাঁফ ছেড়ে বাচে। এরপর একে অপরের দিকে তাকিয়ে উচ্চ স্বরে হাসিতে ফেটে পরে। শুভর মেয়ে শুহানি এসে বলে,
-” বাবা এভাবে হাসছো কেন?”
মুস্তাকিম তাকে কোলে তুলে বলে,
-” ভুতে ধরেছে তোমার বাবাকে বুঝলে!”
সবাই রিসেপশনের প্রবেশদ্বারে তাকায়। সেথায় বর কনে দাঁড়িয়ে। সকলে তাদের সম্ভর্ধনা জানিয়ে বরণ করে নিচ্ছে। ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে দিচ্ছে। বর কনে প্রবেশের সাথে সাথেই বেশ কিছু আতশবাজি সমস্বরে শাঁ শাঁ করে খোলা জায়গায় দিয়ে আকাশপানে উড়ে যায়। সেথায় উচ্চ শব্দ সৃষ্টি করে রঙ বেরঙের আলোর বিচ্ছুরণ কনা ছড়িয়ে পড়ে। সুউচ্চ গাছে অবস্থিত কিছু পাখির দল উড়ে বেড়ায় ভয়ে।
ভোর খুশি হয়ে হাততালি দেয়। বাবাকে দেখায় কি সুন্দর আলো ছড়াচ্ছে। সাথে আবদার করে,
-” আব্বু আমিও উড়াবো আতুশবাজি! প্লিজ আব্বু?”
অরুণ শান্ত গলায় বলে,
-” একদম না! এগুলো খুবই রিস্কি কলিজা! জেদ করবে না!”
ভোর গাল ফুলিয়ে অরুণের কোল থেকে নামার জন্য ছটফট করে। অরুণ ছাড়ে না। ধমকের সুরে বলে,
-” কি হচ্ছে টাকি ভোর?”
ভোর ধমক শুনে শান্ত হয়ে যায়, থমথমে গলায় বলে,
-” নামবো আমি। নামিয়ে দাও!”
অরুণ নামিয়ে দেয়। ভোর নেমেই দৌড়ে অন্যত্র চলে যায়। অরুণ ডাকে শোনে না। আরিয়ান ভাইকে বলে,
-” থাক অনেক বাচ্চা আছে তাদের দেখলেই সব ভুলে যাবে! তুই এখন এদিকে ধ্যান দে ভাই!”
অরুণ মাথা নাড়ে। পাতার পাশে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকে। আর পাতা নীরব দর্শক। ক্যামেরাম্যান নিজের কাজে ব্যস্ত। আদুরি বন্ধুবান্ধব সহ প্রিয়কে নিয়ে এগিয়ে আসে। পাতার হাত ধরে বলে,
-” বড় ভাবি কি সুন্দর লাগছে তোমায় শাড়িতে। লেহেঙ্গা পড়নি কেন? পছন্দ হয় নি?”
পাতা কি বলবে ভেবে পায় না। অরুণের দিকে চায় আড়চোখে। অরুণ বুঝতে পেরে আদুরিকে বলে,
-” লেহেঙ্গার ফিটিংসে কিছু প্রবলেম ছিল তাই!”
রাসেল এগিয়ে এসে অরুণের পিঠ চাপড়ে বলে,
-” আমি তো ভেবেছি তুই লেহেঙ্গাটা ছেলের বউয়ের জন্য রেখে দিয়েছিস!”
পাতা মাথার ঘোমটা টানে। কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে তার। বাড়ির লোকেরা এখনো আসে নি? সে প্রিয়কে ইশারা করে। প্রিয় তার ইশারার মানে বুঝে ঠোঁট উল্টিয়ে না বোঝায়। জীবন সেটা লক্ষ্য করে গুনগুন করে বলে,
-” চোখে চোখে এতো কথা মুখে কেন বলো না! আরে ভাবি আমার জান আইমিন ভাবিজান! কিসের ইশারা চলছে বেয়ানের সাথে হুম?”
ফয়সাল জীবনের কাঁধে মাথা রেখে আফসোস করে বলে,
-” অরুণ তুই কাজটা মোটেও ঠিক করিস নি! এইটুকুনি মেয়েকে ভাবি বলতে হচ্ছে! আর বেয়ানগুলো দেখ বাচ্চাদের বয়সী! মজা করে কিছু বলতেও পারি না।”
অরুণ চোখ রাঙিয়ে বলে,
-” অফ যা তোরা।”
তন্মধ্যে সেখানে সাবিনা ও স্বাধীন চৌধুরীর আগমন ঘটে। পাতা তাদের দেখে সালাম দেয়। স্বাধীন চৌধুরী সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-” সবাই এখানে কি করছো? স্টেজে যাও! সবাই বর কনেকে দেখার জন্য অধীর আগ্রহে!”
উপস্থিত সবাই সায় জানায়। অরুণ পাতাকে আসতে বলে পা চালায়। শুভ অরুণের হাত ধরে আটকিয়ে বলে,
-” আরে ভাই এতো তারা কীসের? ভাবিকে সাথে নি? হাত ধরে নিয়ে যা। সি ডিজার্ভ আ ট্রিটমেন্ট লাইক কুইন!”
পাতা শুভ স্যারের দিকে চায়। সথে সাথেই নজর ঘুরায়। একটু লজ্জা পেল কি? পাওয়ারই কথা এক কালের ক্রাশ ছিল! ডিপার্টমেন্টের সবচেয়ে মিষ্টভাষি ও হ্যান্ডসাম স্যার ছিল, সাথে অমায়িক ব্যবহার।স্টুডেন্টস দের প্রিয় ও আধুনিক ভাষায় মেয়েদের ক্রাশ। অথচ তিনি বিবাহিত!পাতা তোর পোড়া কপাল ক্রাশ যখন দেবর।পাতা মনে মনে নিজের গালে কষে একটা থাপ্পড় লাগায়।জামাই থাকতে জামাইয়ের বন্ধুর দিকে নজর দিস!
অরুণ শুভর দিকে চায় কটমট করে। কিন্তু শুভ শান্ত ও সিরিয়াস মুখে। শুভর অভিজ্ঞ নজর আগেই বুঝতে পারে অরুণ আর পাতার বিয়েটা যেমন স্বাভাবিক হয়েও স্বাভাবিক নয়, তেমনি তাদের সম্পর্কের বাঁধনও ভঙ্গুর। সে অরুণকে চোখের ইশারায় হাত ধরতে বলে। অরুণ হাত ছাড়িয়ে নেয়। শুভ অনুরোধের সুরে ধীমে সুরে বলে,
-” প্লিজ ভাই?”
অরুণ মেনে নেয়। এগিয়ে এসে পাতার ডান হাত হাতের মুঠোয় পুরে নেয়। পাতা অনুভূতি হীন। সে বুঝতে পারে না লোকটাকে। এমনিতে হাত ধরে, কাঁধ জড়িয়ে ধরে একান্তে। কাল রাতেও..!! অথচ এখন এমন বিহেভ করছে কেন? লোক সমাগমে হাত ধরলে কি তার জাত চলে যাবে নাকি!
ক্যামেরার ফ্লাশ লাইট জ্বল জ্বল করছে সেকেন্ড অন্তর অন্তর। অরুণ পাতা অন্যসব কাপলদের মতো রোমান্টিক পোজ দিচ্ছে না। দু’জনই চুপচাপ দাঁড়িয়ে। মাঝখানে ভোর হাসিমুখে দাঁড়িয়ে। অরুণের গম্ভীর মুখশ্রীতে হাসির ছিটেফোঁটাও নেই। তবে পাতা হাসিমুখেই। তার মনটা ভালো ও ফুরফুরে হয়ে গেছে। মন ভালো হওয়ার কারণ বাড়ির লোকের আগমন ও তাদের সাথে কুশল বিনিময়। আর মন ফুরফুরে হওয়ার কারণ বাবা ওরফে রহিম মিয়ার উপস্থিতি। পাতা তাকে দেখে কেঁদেই দিয়েছিল। বাবা ব্যস্ততার মাঝেও যে তার রিসিপশনে এসে, তাকে বুকে জড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে দেবে এটা সে ভাবেই নি।সব মিলিয়ে পাতা বেশ খুশি, চেহারার মলিনতা যেন উবে গেছে।
ভোর কিছু পল ছবি উঠিয়ে যেন হাঁপিয়ে গেছে। সে ছোট ছোট পা ফেলে স্টেজ থেকে নামতে নেয় পিছন থেকে অরুণ আটকে দেয়!
-” কোথায় যাওয়া হচ্ছে শুনি?কলিজা চুপচাপ আমার সাথেই থাকবে সর্বক্ষণ।”
অরুণের কথায় ভোর গাল ফুলিয়ে পাতার আঁচলে মুখ লুকিয়ে বলে,
-” আমি কারো কলিজা না। কেউ ভালোবাসে না আমায়!”
অরুণ কিছু বলে না। ঢের চেনা আছে তার নাট্যকার ছেলেকে। পাতা মুখ টিপে হাসে।
-” কেউ ভালোবাসে না ভোর সোনাকে? আমিও না?”
-” নাহ্। তুমি প্রমিজ ব্রেকাপ করেছ! ওই গাল ফুলো লাবিব, রুম্পা, শুনি সবাইকেই আদর করেছ!”
-” ওটা শুনি নয় শুহানি!”
ভুল ঠিক করে দেয় পাতা। এতে ভোরের ফুলো গালটা আরো ফুলে যায়। পাতার আঁচল ছেড়ে বাবার হাত ধরে সম্মুখে তাকায়। পাতা ভোরের মাথায় হাত রেখে কিছু বলবে এর পূর্বেই ভোর ‘মা’ বলে অরুণের হাত ছেড়ে দৌড়ে চলে যায়। পাতা অবাক হয় বেশ। মা কাকে ডাকলো? তার সামনে তাকানোর সাহস হয় না, সে অরুণের দিকে চায়। যে কিনা স্থীর নয়ন মেলে সম্মুখে চেয়ে পলকহীন। পাতা ঢোক গিলে সামনে ফিরে। তার শান্ত দৃষ্টি সামনের মানবীর দিকে, যার কোলে ভোর হাসিমুখে ভাব বিনিময়ে ব্যস্ত। বাকি উপস্থিত জনরা ও সরকার ফ্যামিলির মধ্যে চাপা গুঞ্জন শুরু হয় সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার পরিবারের দিকে তাকায়। সবার মুখেই অবাকতা ছেয়ে আছে। সে পুনরায় অরুণের দিকে চায়, অরুণ কিন্তু তার দিকে চায় না।
বর্ষা হাসিমুখে ভোরকে কোলে নিয়ে আদর করতে ভোলে না। এটা ওটা বলে স্টেজে উঠে আসে। অরুণ ও পাতার সামনে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে হাসিমুখে অভিনন্দন জানায়,
-” কনগ্রেটস অরুণ। দোয়া করি তোমাদের ম্যারিড লাইফ ভালোবাসায় ভরপুর হোক!”
অরুণ হাত মেলাতে নিলে পাতা ঝটপট হাত বাড়িয়ে বর্ষার হাত ধরে। কেন? জেলাসি, ভয় নাকি সংশয়!! হু নোস। অরুণ হাত গুটিয়ে নেয়। বর্ষা হাসে পাতার রিয়েক্টে। ভোর বর্ষার কোল থেকে নেমে পাতার হাত ধরে বলে,
-” এই হলো আমার আম্মু! অনেক সুন্দর ও মিষ্টি, তাই না মা? আমাকে অনেক ভালোবাসে। তোমার মতো রেখে যাবে না হুম! আম্মু আমাকে ছেড়ে কখনো চলে যাবে?”
শেষ কথা পাতার বাহু ঝাঁকিয়ে বলে। অরুণের অধরকোণে হালকা বাঁকা হাসির রেশ। পাতা একনজর বর্ষার আঁধার নামা মুখশ্রী দেখে নিয়ে নিচু হয়ে ভোরের ললাটে চুমু দিয়ে বলে,
-” কখনো না সোনা!”
ভোর হাসিমুখ উজ্জ্বল নক্ষত্রের নেয় জ্বল জ্বল করে ওঠে। অরুণ ভোরের চুলের ভাঁজে হাত বুলায়।
স্টেজে আগমন ঘটে আরিয়ান, আসমা বেগম, শুভ সহ আরো কিছু জন। আরিয়ান অরুণের দিকে তাকিয়ে বলে,
-” ভাই আমি কিন্তু বিনা দাওয়াতে আগত কোনো মেহমান খাওয়াতে পারবো না। পোটলা পাঠলি নিয়ে আগেই বের করো!”
বর্ষার তিরষ্কার বুঝতে সময় লাগে না। মুখে হাসি ঝুলিয়ে বলে,
-” বিনা দাওয়াতে আসি নি আরিয়ান! অরুণ ফোন করেছিল!”
সবাই অবাক নেত্রে অরুণের দিকে চেয়ে। অরুণ স্বাভাবিক ভাবেই বলে,
-” তুমিই ফোন করেছিলে আমি না। আর দাওয়াত ভোরের তরফ থেকে ছিল!”
আসমা বেগম গম্ভীর গলায় অরুণকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-” ভোর ছোট, কারো ভালোমানুষীর নাটক বোঝে না। তুমি তো বোঝ অরুণ! তোমার থেকে এটা আশা করি নি।”
বলেই স্টেজ থেকে নেমে যায়। বর্ষা ও পাতা থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে।ভোর বর্ষার হাত ধরে নিয়ে যায় অপর্ণা,লাবিবদের দিকে; তাদের সাথে মায়ের আলাপ করিয়ে দিবে।
শুভ এসে অরুণকে এক প্রকার টেনেই নিয়ে যায়। পাতা ভরাট চোখে সেদিকে তাকিয়ে। চোখ বেয়ে বারিধারা বইলো বলে , পাতা পলক ঝাপটিয়ে সেগুলো লুকোনোর বৃথা চেষ্টা করে। আদুরি তার কাঁধে হাত রেখে বলে,
-” বড় ভাবি তুমি ঠিক আছো?”
পাতা মুচকি হেসে জবাব দেয়,
-” হুম! চলো ওদিকটায় যাই!”
আদুরি সায় জানিয়ে পাতার হাত ধরে নিয়ে যায় সেদিকে।
শুভ অরুণকে টেনে ফাঁকা নিরিবিলি জায়গায় নিয়ে আসে, রিসেপশনের বাইরে। অন্ধকার না হলেও মানুষ জন নেই। শুভ রাগে ক্ষোভে অরুণকে বলে,
-” তোর থেকে স্বার্থপর মানুষ হয়? অথচ তুই বর্ষাকে স্বার্থপর বলিস!”
অরুণ ঝটকায় শুভর হাত ছেড়ে দিয়ে বলে,
-” কি স্বার্থ হাসিল করলাম শুনি?”
শুভ চোখ রাঙিয়ে বলে,
-” চিল্লাচিল্লি করবি না খবরদার! বর্ষা এখানে কি করছে? ওকে এখানে আনার কিসের দরকার? একবার ভেবেছিস পাতা মেয়েটার কথা? বিয়ের রিসেপসনে বরের প্রাক্তন স্ত্রী হাজির! ওর মনের ভিতর কি চলছে এখন? ওর কথা বাদই দিলাম ওর পরিবার?”
অরুণ খানিক নিরব থেকে বলে,
-” বর্ষা এখানে কি করছে আমি কিভাবে বলব? মার্ক মায় ওয়ার্ড ওকে আমি ইনভাইট করি নি! ভোরের জেদে এসেছে। আর কেউ কিছুই ভাববে না। ভাবলে আমার কিছু করার নেই!”
শুভ হাসে।
-” তোর কিছু করার নেই তাই না? ভালো! বিয়ে করে মেয়েটার জীবন নষ্ট করলি কেন অরুণ? তুই এখনো বর্ষার ঘোর থেকে বের হতেই পারিস নি আমার মনে হয়! ভোর তো কথায় কথায় জেদ ধরে। আতশবাজি ফোটানোর জন্যও তো জেদ করলো তুই মানা করে দিলি সাফ সাফ। তাহলে বর্ষাকে আনার জেদে মানা করিস নি কেন? নাকি বর্ষাকে ডেকে এনে জেলাস ফিল করাতে চেয়েছিলি? যে দেখ বর্ষা তোমার থেকে সুন্দর ও ভালো মেয়ে এনেছি যে ভোরকে সর্বদা ভালোবাসবে!”
ইতিমধ্যে অরুণ শুভর আলোচনায় উপস্থিত হয় বাকি সব বন্ধুরা। রাসেল শুভর কথার পিঠে বলে,
-” শুভ এ কেমন ছেলেমানুষী কথাবার্তা! ছোট্ট একটা ব্যাপার নিয়ে এতো কথাকাটাকাটির কি দরকার। আর এখানে অরুণের কি দোষ?”
-” ওর আবার কি দোষ! ও তো সাধু পুরুষ! সব দোষ ওই পাতা মেয়েটার।”
বলেই চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। এরমধ্যে জীবন টিপ্পনি কেটে বলে,
-” অশুভ! তোর দেখছি পাতা ভাবিইইজানের প্রতি খুউব দরদ! অরুণ ওর থেকে সাবধানে হ্যাঁ?”
শুভ তেড়ে আসার আগে অরুণ জীবনের পশ্চাতে লাথি লাগায়। জীবন সেথায় হাত বুলিয়ে আফসোস করে বলে,
-” ভালো মানুষের ভাত নেই! হুহ।”
শুভ কটমট করে বলে,
-” মেয়েটা স্টুডেন্ট আমার! মজাতেও আজেবাজে কথা বলবি না।”
-” আমি তো থমথমে মহলটাকে স্বাভাবিকে আনতে মজা করে বলেছিলাম ভাই! তোরা সব কয়টা হারামী! যা সর!”
বলেই জীবন চলে যায়। অরুণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে। শুভ তার দিকে তাকিয়ে হনহনিয়ে চলে যায়। বাকি সবাই অরুণের সহযোগী!
দুই বোনের মাঝে থমথমে ভাব বিরাজমান। লতা পাতাকে প্রশ্ন বাণে জর্জরিত করছে। পাতা নীরব, কখনো হু হা করছে। লতা অবশ্য এতে থামেনি। লতা ধীমে গলায় হিসহিসিয়ে বলে,
-” অনেক সুখের সংসার তোর। দেখতেই পেলাম! আহা চক্ষু জুরাইয়া গেলো! জামাই বাড়ি জামাই বাড়ি বলে লাফাচ্ছিলি, না? এখন লাফা! আহাম্মক, গর্দভ!”
পাতা চুপচাপ সব হজম করছে। এখানে তার কি দোষ, তারই বা কি করার আছে। তাদের দুজনের মধ্যে কথোপকথনের মাঝে বর্ষার আগমন ঘটে। পাতা লতার হাত শক্ত করে ধরে। লতা তার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ফিসফিস করে বলে,
-” তোর ঝামেলা তুই ই ম্যানেজ কর ! আমি টা টা বাই বাই!”
বলে চলে যায়। বর্ষা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
-” চলে গেল কেন?”
পাতা ঠোঁট উল্টিয়ে কাঁধ ঝাঁকায়। কি জানি! বর্ষা ঠোঁট গোল করে ‘ওহ্’ বলে। পাতা প্রতিত্তরে কিছু বলে না। কি বলবে? স্বামীর প্রাক্তন স্ত্রীর সাথে নিশ্চয়ই রসের আলাপ জুড়ে দেবে না। ওতটাও ভদ্রমহিলা পাতা না। বর্ষাই নিরবতা ভেঙ্গে বলে,
-” কি দিনকাল এলো বলো? মানুষ টাকার পাগল! টাকা দেখলে কিছুই বাছে না। সৎ অসৎ, বুড়ো বা এক বাচ্চার বাপ!”
বলে চুক চুক শব্দ করে আফসোস করে। পাতা বত্রিশ পাটি বের করে হাসি দেয়।
-” ঠিক বলেছেন! টাকা দেখলে কাঠের পুতুলও হা করে শুনেছি। টাকার পিছনে ছুটতে গিয়ে মানুষ নিজের দুধের বাচ্চাকে পর্যন্ত ভুলে যায়! তাদের কাছে টাকাই সব।”
বর্ষা ঢের বুঝতে পারে এ মেয়ে পুরাই ধানি লঙ্কা। দেখতে নরম শোভা, ইনোসেন্ট ফেস হলেও মোটেও সেরকম নয়। পাতা বর্ষার কথার পৃষ্ঠে জবাব দিতে পেরে যেন আকাশে ওড়ে। আহ্ এতো শান্তি শান্তি লাগছে কেন? ব্যাপারটা আসলেই অনেক আনন্দের। কেউ তোমাকে অপমান করার জন্য ইট হাতে মুখিয়ে আছে আর তুমি তার অপমানের পৃষ্ঠে অপমানের পাটকেল ছুড়ে জবান বন্ধ করে দাও এর যে শান্তিময় অনুভূতি তা বলে বোঝানো যায় না। বর্ষাও থেমে যাওয়ার পাত্রী নয়। মুখে প্লাস্টিকের হাসি ঝুলিয়ে বলে,
-” তুমি খুব মিষ্টি। আশা করি অরুণ খুব শিঘ্রই মেনে নেবে সব! একচুয়ালি হি ম্যাডলি লাভস মি..”
-” মেনে নেওয়ার প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে! উই আর হাসবেন্ড ওয়াইফ! এন্ড ইটস নট অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ ইটস সাম কাইন্ড ওফ লাভ ম্যারেজ। এভরিথিং ইজ ফাইন বিটউইন আস লাইক এভরি ম্যারিড কাপল!আই থিংক ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড হোয়াট আই মিন?”
বর্ষা শান্ত চোখে চায় পাতার দিকে।অরুণ নিঃসন্দেহে হাসবেন্ড ম্যাটেরিয়াল।এরকম ওয়াইফ ম্যাটেরিয়াল বউ পেলে তো সোনায় সোহাগা জুড়ি।সে হাসে,নকল হাসি নয়!মন থেকেই।পাতার থুতনিতে হাত রেখে শান্ত গলায় বলে,
-“স্বামী সোহাগী হও! মন খারাপ কোরোনা আমার কথায়।অরুণ খুব হাসবেন্ড ম্যাটেরিয়াল!তোমায় আদরে মাথায় তুলে রাখবে মিলিয়ে নিও। আমি খুবই বাজে মা আমি নিজেও স্বীকার করি! তবে আমি বরুণকে ভালোবাসি। তোমার হাসবেন্ডের সাথে আমার ছেলেটাকেও ভালোবেসো! আমি তো ভালো মা না, তুমি ওর ভালো আম্মু হয়ে উঠো। দোয়া করি অনেক অনেক সুখী হও!”
পাতা সন্দেহ নজরে তাকিয়ে আছে। পাশা পাল্টিয়ে দিল কেন? সে তো কোমড় বেঁধে নেমেছে। তার রিসেপশনে এসে বাগড়া দেয়া!কিছু সময় থেমে বর্ষা আবার বলে,
-” রাগ হচ্ছে আমার উপর তাই না? হওয়াটাই স্বাভাবিক! তোমাদের ইম্পর্ট্যান্ট একটা দিনে ঝামেলা সৃষ্টি করলাম। স্যরি! আসলে তোমাকে দেখার খুব ইচ্ছে ছিল, দেখলাম। আমাকে নিয়ে সংশয় রেখ না মনে। আমি তোমাদের সংসার থেকে অনেক দূরে। তবে মাঝে মাঝে বরুণকে দেখতে আসবো। ভালো থেকো আসছি! ভোরের মিষ্টি আম্মু মিষ্টি ভোরকে মন থেকে ভালোবেসো!”
বলে চলে যায়। পাতার কাছ থেকে না রিসেপশনের প্রবেশদ্বার দিয়ে বাইরে চলে যায়। পাতা অবাক লেচনে চেয়ে। কি হয়ে গেল, কি বলে গেল? যাক গে তার কি! পাতা ইউ সুড বি ফোকাস ওন ইউর শালার জামাই! দ্যাটস ইট।
-” দেখলি তো! একেবারে ভাগিয়ে দিল। এই মেয়ে দেখতে সাদাসিধা হলে কি হবে, গভীর জলের মাছ। তোর দিন ফুরিয়ে আসছে রুবি!”
মায়ের কথায় রুবি খানিকটা বিরক্ত হয়। কিছু না শুনে বুঝে এমনি একটা বললে তো হবে না। তারা পাতার থেকে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে তাদেরকেই লক্ষ্য করছিল। শুধু তারা না সকলেই। প্রাক্তন ও বর্তমান মুখোমুখি, এরকম এন্টারটেইনমেন্ট কেই বা মিস করতে চায়। বর্ষা ও পাতার কথাবার্তা কানে না আসলেও তাদের সর্বোচ্চ ধ্যান ওদিকেই ছিল। রুবি মায়ের কথার প্রেক্ষিতে বলে,
-” মা বাদ দাও এসব কথা। পাতা মেয়েটাকে শান্ত শিষ্ঠই মনে হয়। না হলে আমার কি! অরুণ ভাইয়া সংসার করবে আমি না!”
রুবির ভাবি হেসে রুবির কাঁধে হাত রেখে গলার স্বর নামিয়ে বলে,
-” একই বাড়ি, একই রান্নাঘর সবকিছুই একসাথে তো সংসার কি আলাদা নাকি?
তোমার বড় জা! ভালো হলে তো ভালোই। আর শেয়ানা হলে তো তুমি গেলে ননদিনী! তোমায় আঙ্গুলের ইশারায় নাচাবে বুঝতেও পারবে না। আজকাল আপন ভাইদের মধ্যেই পড়ে না মারামারি কলহ লেগেই থাকে। সেখানে অরুণ ভাইয়া তো সৎ, তোমার শশুরও বেঁচে নেই। এক সংসারে কলহ লাগতে কতক্ষন! নতুন বউ এলো সে যদি মাথা খায় তাহলে তো হলোই। মেয়ে মানুষ কঠোর সন্ন্যাসে ব্রতচারীদের ব্রতও ভেঙ্গে দিতে পারে এক চুটকিতে। আরিয়ানকে একটু বুঝিয়ে বলো!”
রুবি খানিকটা ভাবনায় পড়ে যায়। কথাগুলো বাস্তবিক দিয়ে যথার্থই মনে হচ্ছে। অরুণ ভাইয়াকে সে চেনে, ভালো মানুষ। কিন্তু পাতা ভাবি? তাকে তো সে চেনে না। ভাবীর কথা গুলোই কি ঠিক বর্তাবে? রুবির মা রুবির ভাবনা গুলোকে আরেকটু রঙিন করতে রঙ মিশিয়ে বলে,
-” শোন অরুণটাও কিন্তু কম শেয়ানা না। তোর শশুর সব প্রপার্টি ভাগ করে দিয়েছে। আরিয়ানের থার্টি, অরুণের থার্টি, তোর শাশুড়ি ও ননদের টোয়েন্টি পার্সেন্ট করে। অফিসের ভাগ কিন্তু করে যায় নি। আর এখন অফিস কার দখলে? কত বড় ব্যবসা! মোটা অংকের আয় হয় সেখানে; সংসারে কত দেয়? দেখ হয়তো এখানে ওখানে ফ্ল্যাট, প্রপার্টি কিনে জমা করছে। আরিয়ান কি পায় সেখানে থেকে? কচু পায় আর ভবিষ্যতেও তাই পাবে। ওকালতি করে কি করবে ভবিষ্যতে?”
রুবি এবার সত্যিই ভাবনায় পড়ে। এ যে আধুনিক অ-কাল। আপন ভাই, ভাইয়ের হক মেরে খায়, ভাইয়ের সাথে দাঙ্গা লাগায়। সেখানে এরা তো সৎ। এখন মিল আছে কাল কলহ সৃষ্টি হতে কতক্ষণ। আর তাছাড়াও অরুণ ভাই ভোরকে নিয়ে তাদের থেকে একটু দূরে দূরেই থাকে। এসব খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে আরো আলোচনা চলতে থাকে তিনজনের মধ্যে। তবে সেটা ফিসফিস শব্দের। তবে তিনজনের এ খেয়াল নেই যে তাদের ফিসফিসানি শব্দও কারো কর্ণ গহ্বরে পৌঁছে গেছে। অরুণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এসব তার কাছে নতুন নয়। পারা প্রতিবেশি নিকটাত্মীয় যারাই বাড়ি আসে আড্ডা অনুষ্ঠানে তাদের মুখে এইসব কথায় শোনা যায়। অরুণ আর দাঁড়ায় না। পা বাড়ায়, ছেলেকে খোঁজার জন্য। পথিমধ্যে লতার ডাকে দাঁড়িয়ে পড়ে। লতা একা নয় সাথে লাবিব ও কাওছার। অরুণ পকেটে হাত ঢুকিয়ে বলে,
-” কিছু বলবে লতা? আসলে ভোরকে খুঁজছিলাম!”
লতা অরুণের থেকে যথারীতি দূরত্বে দাঁড়িয়ে মাথা উঁচু করে স্পষ্টতই বলে,
-” কিছু জরুরী কথা আছে। আর ভোর আপনার অফিসের লোক পরনা না কি যেন নাম তাদের কাছে আছে।”
লতার কথায় অরুণের কপালে ভাঁজ পড়ে। এ কি বলবে আবার।
-” ওহ্। কি বলবে বলো?”
লতা নির্দ্বিধায় বলতে শুরু করে,
-” আমি ভনিতা ভুজুং ভাজুং পছন্দ করি না। স্ট্রেটকার্ট কথা বলতে পছন্দ করি।কাল আপনার ও পাতার প্রথম রাত ছিল। ফাস্ট নাইট নিয়ে সকলের মনেই ফ্যান্টাসি থাকে। পাতারও ছিল। ও স্বামী সংসার নিয়ে অনেক স্বপ্ন বুনতো। এমনকি আমাদের বলতেও জড়তা করতো না। জানি আপনাদের বিয়েটি হয়তো ওতটাও স্বাভাবিক নয়। কিন্তু প্রস্তাব টা কিন্তু আপনি দিয়েছিলেন, পাতা মেনে নিল। তাহলে অস্বাভাবিক কিছু আসবে কিভাবে? কাল রাত আপনার আর পাতার ছিল। দুজনে একাকি গল্প করেই কাটাতে পারতেন, নিজেদের মধ্যে কথা বলে সম্পর্কটাকে একটু এগিয়ে নিতে পারতেন। কিন্তু আপনি দেয়াল স্বরূপ ভোরকে মাঝে আনলেন। আমার কথায় কিছু মনে করবেন না। ভোর এখানে থার্ড পারসন নয় বরং আপনাদের দুজনের মধ্যে সেতুবন্ধন হবে হয়তোবা। বাট কাল রাতটা আপনাদের দুজনের ছিল।”
লতা বলতেই থাকে কিন্তু তার কথা শোনার জন্য অরুণ দাঁড়ায় না গট গট করে চলে যায়। এদিকে ওদিকে তাকিয়ে পাতাকে খুঁজতে থাকে। পেয়েও যায়। তার বন্ধুদের ওয়াইফদের সাথে কথা বলছে। অরুণ তোয়াক্কা না করে পাতার হাত ধরে একপ্রকার টেনেই নিয়ে আসে। বন্ধুর বউয়েরা টিপ্পনী কাটে, অরুণ কানে নেয় না। পাতার শাড়ি সামলিয়ে হাঁটতে বেগ পোহাতে হয়। কুঁচি বাম হাত দিয়ে ধরে কোনো মতে পা চালায়।
-” কি হচ্ছে টাকি ভোরের বাবা? আমি গরু নাকি যে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন! বললেই তো সাথে যেতাম! হয়েছে টা কি?”
অরুণ একেবারে কোনায় নিরিবিলি জায়গায় গিয়ে থামে। পাতার দিকে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় সুধায়,
-” কাল রাতে আমি ভোরকে আমাদের সাথে রাখার জন্য আপনার থেকে পারমিশন নিয়ে ছিলাম কি না?”
পাতা মনে করার চেষ্টা করে কখন পারমিশন নিয়েছিল! শুধু বলেছিল ভোর আমাদের সাথেই থাকবে আপনার কোনো সমস্যা? পারমিশন তো চায় নি। তবুও পাতা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বোঝায়। অরুণ এক হাতে পাতার কাঁধ ঝাঁকিয়ে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে ধমকের সুরে বলে,
-” ভোর কাল রাতে আমাদের সাথে ছিল সেটা বোনের কাছে বলে নালিশ জানানোর কিসের প্রয়োজন পড়লো? আমায় অপমানিত হতে হলো কেন? কাল যা হয়েছে সেটা আমাদের পার্সোনাল বিষয় ছিল। অন্যকেউ কেন জানবে? আপনার প্রবলেম হলে আমাকে বলতে পারতেন তখন? ভোরকে আমাদের মধ্যে দেয়াল হিসেবে রেখেছিলাম কাল? স্পিক আউট!”
ধমকে পাতার অন্তর আত্মা কেঁপে ওঠে। আপু ওনাকে অপমান করেছে? সে তো নালিশ জানায় নি। আপু জিজ্ঞেস করেছিল ভোর তোদের সাথে ছিল কি না? সে শুধু মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানিয়েছে। এই আপুটাও না। পাতা ঢোক গিলে অস্পষ্ট সুরে ‘আপু’ বলে। অরুণ পাতাকে ছেড়ে দেয়। খানিক দূরে দাঁড়িয়ে বলে,
পাতা বাহার পর্ব ২৮
-” আমি আগেই বলেছি আমার কাছে পার্থিব জীবনে আমার ছেলে সবার আগে, তারপর বাকি সবাই। তাকে ছাড়া এই অরুণ সরকার শ্বাস পর্যন্ত নিতে পারে না। ওর হৃদস্পন্দনের জন্যই আমার হৃৎপিণ্ড স্পন্দিত হয়। আমার ভোর আমার কলিজা। আপনার বোনকে বলে দেবেন।”